দেয়ালের এপাশ ওপাশ

দেয়ালের এপাশ ওপাশ

আজ তিথির জীবনের বিশেষ একটি মুহূর্ত৷ তার বিবাহর প্রথম রাত৷ বাসর ঘরের সাজ কি রূপ হয় সেটা তিথি আগেও দেখেছে৷ কিন্তু আজ সে নিজের বাসর ঘরে দাঁড়িয়ে আছে৷ গোটা ঘর তিথি চোখ ঘুরিয়ে দেখছে৷ খাটের চারপাশে রজনীগন্ধা এবং বেলি ফুলের তোড়া দিয়ে দেয়াল বানানো হয়েছে৷ বিছানার ওপর গোলাপের পাপড়ি৷ উত্তর দিকের দেয়ালটায় সাদা বোর্ডে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা৷ আজ মুহিত ও তিথির বাসর৷ লেখাটায় চোখ পড়াতে তিথির লজ্জায় ধরে বসলো৷

সেখান থেকে ঘাড় বাকিয়ে পশ্চিমের দেয়ালে তাকিয়ে দেখলো তিনটি পেইন্টিং বাঁধানো৷ একটি রবি গুরুর৷ অন্যটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের৷ মাঝের পেইন্টিংটার দিকে তিথি গভীর মনোযোগ নিয়ে দেখছে৷ সে বুঝতে পারছে না পেইন্টিং এর অর্থ৷ গোটা পেইন্টিং জুড়ে কেবলই বিস্তীর্ণ ঘাসের মাঠ৷ সবুজ ঘাসগুলো ঢেউ খেলানো৷ মাঠের মধ্যেখানে একটি কুয়া৷ সেখান থেকে কিছু পানি উপচে পড়ার দৃশ্যটি আর্টিস্ট ফুটিয়ে তুলেছে৷ ঘরের দরজা খোলার শব্দে তিথি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো৷ শাড়ির আচলটি মাথায় ঠিক মত রেখে ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷ মুহিত তিথির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কেমন আছো? তিথি মাথা নিচু করে বলল, শারীরিক ভাবে ভালো আছি৷ আপনি যা করতে চান৷ করতে পারেন৷ তবে দেয়ালের ঐ পেইন্টিংটা নিয়ে একটু ভাবনায় পড়েছি৷

হুট করে এমন কথা শোনে মুহিত খানিকটা চমকে গেছে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার এক হাসি দিয়ে বলল, তুমি বোধ হয় সোজা সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করো৷ আমার এমন মেয়ে পছন্দ৷ তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার পেইন্টিং এর প্রতি তেমন কোন জ্ঞান নেই৷ ছবিটির মর্ম তোমাকে বুঝাতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত৷ তবে এই ছবিটির পেছনে আমার এক স্মৃতি জড়িয়ে আছে৷ শোনবে?

তিথি বুকের উপর হাত জোড়ো করে বলল, আপনি যদি বলতে চান৷ তবে শুনবো৷ এত ফোর্মালিটিজ নিয়ে কথা বলার দরকার নেই৷ আপনি আমার সাথে কয়েক বছর পর যেভাবে কথা বলবেন৷ এখনো সেভাবেই কথা বলুন৷ বছর খানেক পার হয়ে গেলে নিশ্চয়ই আমার কাছে পার্মিশন নিয়ে কিছু বলবেন না৷ মুহিত বলল, হ্যা তা ঠিক৷ চা খাবে? চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে৷ তিথি বলল, আচ্ছা৷

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুহিত বলল, আমি কানাডায় পড়াশোনা করেছি৷ বছর দুয়েক আগে সেখানে জোর্জিয়া নামের এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়৷ এই পেইন্টিং এর আর্টিস্ট এক জন বাংলাদেশি৷ নাম রফিকুল ইসলাম৷ ভদ্রোলোকের সাথে মেয়েটির বিয়ে হয়৷ বিয়ের কয়েক বছর পর এক ট্রাম দুর্ঘটনায় রফিকুল ইসলাম মারা যান৷ জোর্জিয়া মেয়েটি খুব শক্ত প্রকৃতির৷ অল্প সময়ে নিজেকে গুছিয়ে নেন৷ কিন্তু তাঁর স্বামীর স্মৃতি তাকে পিছু টানে বলে সে সব কিছু সরিয়ে ফেলেন৷ আমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনি স্বামীর আঁকা এই পেইন্টিংটি উপহার দেন৷

কথা শেষ করে মুহিত চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে৷ খাটের পাশে ছোট টেবিলের ওপর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা চা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে তিথি বলল, জোর্জিয়া মেয়েটির সাথে কী আপনার এখনো যোগাযোগ আছে? মুহিত ঠোঁট টিপে মাথা নিচে নামিয়ে বোঝালো, আছে৷ তিথি বলল, আপনার আজ বিয়ে হয়েছে এই খবর কী সে জানে? মুহিত মাথা দু পাশে নাচিয়ে বলল, উহু! জানে না৷ আমার বিয়ের কথা তাঁকে বলেনি৷ তিথি বলল, আমার মন বলছে মেয়েটির সাথে আপনার প্রেমের সম্পর্ক জড়িয়েছে৷ ভুল বললাম?

মুহিত বলল, ঠিক ধরেছো৷ এই বিয়েটা আমি আপত্তি করতে পারেনি বাবার জন্য৷ বাবা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে৷ আমি জীবনে যা চেয়েছি৷ বাবা সবই দিয়েছে৷ সেই অর্থে আমি তাঁকে তেমন কিছুই দেই নি৷ বাবা তোমাকে খুব পছন্দ করেছেন৷ অনেক কষ্ট পেত যদি আমি এই বিয়েতে আপত্তি জানাতাম৷ তিথি কিছুখন নিঃশব্দে থেকে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ঠিক একই কাহিনী যদি আমি আপনাকে বলি৷ সেক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী হবে? মুহিতের চোখে জিঙ্গাসু দৃষ্টি৷

দেয়ালে টানানো এক জার্মান ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ করে উঠলো৷ তিথি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো তিনটা বেজে গেছে৷ তারপর মুহিতের দিকে ফিরে বলল, আমি একজনকে ভালোবাসি৷ তাঁর নাম আনিস৷ সে আপনাদের মত এত বড় বংশের না৷ ঢাকায় তার খালার বাসায় থাকে৷ ছোট একটি ফার্মে স্বল্প বেতনের চাকরি করে৷ তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক তিন বছরের৷ সম্পর্কের কথা আমার বাসায় জানায় নি৷ কোন ভাবে বুঝতেও দেয়নি৷ ভেবেছিলাম আনিস ভালো কিছু করতে পারলে বাসায় জানাব৷ বাসা থেকে রাজি না হলেও বুঝিয়ে শুনিয়ে মানানোর চেষ্টা করব৷ কিন্তু তাঁর আগেই বিয়েটা ঠিক হলো৷ আনিসের বিষয়টা আমার ভাইয়া জানতেন৷ কিন্তু আমি তাঁকে নিষেধ করেছি বাসায় কিছু জানাতে না৷ বিয়ের এ সময়ে হটাৎ করে বাবাকে এই সংবাদটি দিলে কোন এক দুর্ঘটনা ঘটে যেত৷ একবারটি বাবার হার্ট এট্যাক হয়েছে৷ সেদিকটায় মাথায় রেখে আমি হুট করে বিষয়টা জানাতে পারি নি৷ অন্য দিকে বাবাকে শান্ত ভাবে বুঝাবো সে সময়টুকু আমার হাতে ছিলো না৷

তিথি কথা শেষ করে কিছুখন চুপ থেকে বলল, আমার বোধ হয় এ বিষয়ে কথা বলা উচিত হয়নি৷ তারপর প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য মুখে চঞ্চলতা এনে মৃদু হাসি দিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল, জানেন একবার কী হয়েছে, আমার এক বান্ধবীর বাসর রাত৷ ওর নাম শেফালী৷ সে ঠিক করেছে বাসর রাতে তাঁর হাসবেন্ডকে যতসব উদ্ভট কথা বলে ভর্কে দেবে৷ যা ভাবনা, তাই কাজ৷ দুনিয়ার সব আজগুবি কথা তাঁর জামাইকে বলতে লাগলো৷ এবং এক পর্যায়ে বলল, জানো আমি কিন্তু ভার্জিন না৷ আমার কয়েক বার ফিজিক্যাল হয়েছে৷

এই ঠাট্টা শোনে তাঁর হাসবেন্ডের মাথা গেছে খারাপ হয়ে৷ সেই রাতেই আমার বান্ধবীকে মেরে পরদিন সকালে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷ কিন্তু আমার সব বান্ধুবীদের মধ্যে শেফালী ছিলো সব চেয়ে ভালো প্রকৃতির মেয়ে৷ সে এই জীবনে কোন প্রেম করে নি৷ কোন ছেলে তাঁর হাত পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখে নি৷ শেফালী সব সময় বলতো, আমার সব কিছু হবে আমার হাসবেন্ডের জন্য৷ আমার প্রেম, আমার মন সব রেখে দেব স্বামীর জন্যে৷ ঐসব পর পুরুষের সাথে লালটু ফালটু আমাকে দিয়ে হবে না৷

কাহিনী শেষে করে তিথি আক্ষেপের স্বরে বলল, ভালো মেয়েগুলোর কপালে থাকে বিরাট দুঃখ৷ আমার আরেকটি বান্ধবী আছে৷ ওর নাম রাবেয়া৷ সে বিয়ের পরেও দু’জনের সাথে প্রেম করে৷ অথচ তাঁর স্বামী কিছু ধরতে পারে না৷ ভাবছে তাঁর বউ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বউ৷ কথাটা বলে তিথি গা দুলিয়ে খিল খিল শব্দ করে হেসে উঠলো৷ মুহিত গভীর মনোযোগ দিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে আছে৷ মায়া ভরা মুখখানা ওর৷ তিথির কোন কথাই যেন মুহিত কানে নেয় নি৷ মুগ্ধতার সাথে চঞ্চল প্রকৃতির চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে৷

তিথির গা দোলানোর হাসির কারনে খাটটি কেঁপে উঠে রজনীগন্ধার ছোট একটি কলি খুলে পড়লো মুহিতের চোখের উপর৷ এতে যেন ওর হুশ ফিরে এলো৷ তারপর দ্রুততার সাথে তিথিকে বলল, সারাদিন দুজনের ওপর অনেক ধকল গেছে৷ এসব কথা পড়ে করা যাবে৷ এখন আমাদের ঘুমের প্রয়োজন৷ রাত চারটা বেজে গেছে৷ সকালে আরেক দফা হাঙ্গামা শুরু হবে৷ তুমি কাপড় বদলে শুয়ে পড়৷ আমি বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ফুঁকে আসছি৷ তিথি চোখ বড় করে তাকালে মুহিত একটু মৃদু হেসে বলেন, তুমি চিন্তা করো না৷ ঘরে আগে থেকে বাড়তি তোষক এনে রেখেছি৷ সেটা আমি নিচে পেতে শুয়ে পড়ব৷ তিথি চোখ নামিয়ে বলল, আচ্ছা৷

সকালে মুহিতের ঘুম ভেঙেছে হৈ হুল্লার শব্দে৷ বিভিন্ন রকমের শব্দ তাঁর কানে আসছে৷ পাতিলার মধ্যে চামচ দিয়ে ড্রাম বাজানোর শব্দে তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে৷ এর মানে ছোট খালা এসেছে৷ ছোট খালার পুত্র রাতুলের স্বভাব পাতিল দিয়ে ড্রাম বাজানো৷ ঠিক কিছুখন পরই মুহিতের কানে এলো ঝগড়া করার শব্দ৷ এর মানে বড় মামী এসেছে৷ এ বাড়িতে যত বারই ঝগড়া লেগেছে৷ তার নেতৃত্বে ছিলেন বড় মামী এবং ছোট খালা৷ পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে৷ যাদের কাছে ঝগড়া করাটা একটি শখ৷ শখের বসে ঝগড়া করে৷ বড় মামী এবং ছোট খালা হচ্ছেন সেই শখের ঝগড়াটে৷ তাদের ঝগড়ার বিষয়টি হয় অতি সাধারন৷ মুহিত শুয়ে থেকে একটু কান খাড়া করে ঝগড়ার বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলেন৷ এবং অল্প সময়েই বুঝতে পারলেন ঝগড়াটা মূলত লেগেছে শাড়ির দাম নিয়ে৷ বড় মামীর কথা হচ্ছে৷ শাড়ির যত দাম৷ তত ভালো মানের হয়৷ মেঝো খালা বলছেন৷ বুদ্ধি খাটিয়ে দর দাম করে শাড়ি কিনলে ভালো শাড়ি কম দামের মধ্যেই পাওয়া যায়৷

মুহিতের এসব কথা শোনে খানিকটা বিরক্ত লাগছে৷ নিজ মনে বলে উঠলো, বাসার এমন উৎসব পরিবেশে ঝগড়া করার কি প্রয়োজন! কিছুখন পরই সে বুঝতে পারলো ঘরে তিথি নেই৷ এবার শুয়া থেকে উঠে বসে বাথরুমে দরজায় তাকিয়ে দেখলো দরজা খোলা৷ সে আস্তে স্বরে কয়েক বার তিথি বলে ডাকলো৷ কোন সারা শব্দ নেই৷ মুহিত ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে যেতেই রাতুল দৌড়ে এসে বলল, ভাইয়া তুমি কেমন আছো?

মুহিত রাতুলের মাথা ঝাকিয়ে বলল, ভালো আছিরে৷ তুই আছিস কেমন? রাতুল বলল, আমি ভালো আছি৷ ভাবি ছাদে গিয়েছে৷ মুহিত বলল, আমি তোকে জিজ্ঞাসা করেছি, তোর ভাবি কোথায়! বেশি পাকনা হয়েছিস না? রাতুল বলল, আমি পাকনা হই নি৷ আমি শার্লক হোমস হয়েছি৷ এদিক ঐদিক তোমার চোখ ঘুড়ানোতেই বুঝেছি৷ তুমি ভাবিকে খুঁজছো৷ মুহিত এবার চোখে মুখে রাগী ভাবটা এনে বলল, চোখের সামনে থেকে সর৷ যতসব বিচ্ছুর দল৷ কথাটা বলে মুহিত গেলো বসার ঘরের দিকে৷

ড্রয়ইং রুমের কার্পেটের ওপর বসে বড় ফুপু আরাম করে পান খাচ্ছে৷ মুহিতকে দেখে বলল, রাইত্রে কী করলি? কথাটা বলে পান খাওয়া ঠোঁটে ফিক করে হেসে দিয়েছে৷ তাঁর হাসিতে ড্রয়ইং রুমের সকলই তাল মিলিয়ে হাসতে শুরু করেছে৷ মুহিত খানিকটা বিব্রত বোধ করে বলল, উফ! তোমাদের যন্ত্রনায় আর থাকা গেল না৷ আমি ছাদে যাচ্ছি৷ বুয়া খালাকে দিয়ে আমার জন্য এক কাপ চা পাঠিয়ে দিও৷

ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিথি৷ তাঁর হাতে কফির মগ৷ চারদিকে ঘন কুয়াশা৷ কুয়াশার কারনে আশে পাশের কিছুই পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না৷ এখন বাজছে বেলা সাড়ে এগারোটা৷ কুয়াশার কারনে সূর্যের আলোর কোন ছিটে ফোঁটা নেই৷ মুহিত নিঃশব্দে তিথির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, সুপ্রভাত৷ তিথি অনেকটা চমকে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়েছে৷ তারপর বলল, সুপ্রভাত৷ মুহিত বলল, কী নিয়ে চিন্তা করছিলে? তিথি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তেমন কিছু ভাবছি না৷ নিচে মানুষ বেশি৷ সে কারনে ছাদে এসে চা খাচ্ছি৷

মুহিত ঠোঁটে এক পাশে হেসে বলল, কিছু অবশ্যই চিন্তা করছিলে৷ তা না হলে আমার কথায় ওমন হকচকিয়ে উঠতে না৷ তোমার একান্তই কোন ঘটনা হলে বলার দরকার নেই৷ প্রতিটা মানুষের জীবনেই প্রাইভেসি বলে একটা শব্দ থাকে৷ মানুষ কিছু বিষয় নিজের সাথেও গোপন করে৷ গোপনীয়তা এত প্রখর হয় যে নিজের মুখে সেটা উচ্চারনে বাঁধা থাকে৷

কথাটা শোনে তিথি একটু শব্দ করেই হাসলো৷ মুহিত খেয়াল করলো ওকে খুব সুন্দর লাগছে৷ নিজের মনে প্রশ্ন করল, বিয়ের পর দিন কী মেয়েদের এমন অপ্সরী দেখায়? মুহিত তিথির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে৷ তিথি লাজুক হাসি দিয়ে বলল, ধন্যবাদ৷ তারপর দু’জন কিছুখন ধরে চুপ করে আছে৷ কে কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না৷ তিথির এখন লজ্জা লাগতে শুরু করেছে৷ তাঁর সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে সে তাঁর স্বামী৷ গতকাল বিয়ের বিভিন্ন চিন্তায় এসব বিষয় তিথির মাথায় আসেনি৷ কিন্তু আজ সকাল থেকে তার অদ্ভুত সব চিন্তা আসছে৷

দু’দিন আগেও মুহিত নামের ছেলেটি ছিলো তার জীবনের একদমই অচেনা অধ্যায়৷ আর আজ সে পবিত্র অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ পৃথিবীর সব চেয়ে আপন ও নির্ভরযোগ্য মানুষ৷ কিন্তু মুহিত তার ভালোবাসার মানুষ না৷ ভালোবাসার নাম আসলেই আনিসের নামটি মনে পড়ে তিথির৷ অনেকখন চুপ থাকার পর মুহিত বলল, কাল তুমি আনিসের ব্যাপারে আংশিক বলেছিলে৷ তুমি না বললে বাকি ঘটনা আমি জানতে চাইবো না৷ তবে আমি ভাবছি ও আবার কোন পাগলামি করে না বসে৷ তিথি বলল, মানে?

মুহিত বলল, ধরো৷ বাসার সামনে রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকা৷ তোমার নাম্বারে অসময়ে ফোন দেয়া৷ এমন পাগলামি যেন না করে৷ এসব বিষয় খুব খারাপ দেখায়৷ তোমার যদি মনে হয় আনিস এমন কিছু করতে পারে৷ তুমি তবে ওকে ফোন করে এমম পাগলামি করতে বারন করে দাও৷ তিথি দুপাশে মাথা ঝাকিয়ে হেসে বলল, আনিস এমন কিছুই করবে না৷ ও প্রেমিক পুরুষ৷ কিন্তু পাগল পুরুষ না৷ আমার এত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে৷ আমি সুখে থাকব৷ এটাই ও চেয়েছিলো৷ আনিসের একটাই চাওয়া৷ আমি যেন সুখে থাকি৷ মুহিত বলল, তুমি কী পারবে সুখে থাকতে? তিথি আবার হাসলো৷ এ হাসির অর্থ মুহিত ধরতে পারলো না৷ বলল, তুমি ভালো একজন মানুষকে ভালোবেসেছো৷

তিথি দেখলো চার পাশের কুয়াশা সরে গেছে৷ রোদ তাঁর পূর্ন আলো ফেলতে শুরু করেছে৷ চিলেকোঠার দেয়ালে দুজন মানুষের ছায়া পড়েছে৷ ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে মুহিত ও তিথি৷ সাত দিন পার হয়ে গেছে বিয়ের৷ তিথি ও মুহিতের সম্পর্কটা এখন অবধি বন্ধুত্বপূ্র্ন৷ এক ঘরে বাস করলেও মুহিত তাঁর স্বামীর অধিকারের পেছনে কামনা বাসনা নিয়ে তিথির পানে তাকায় নি৷ তিথি স্বামীর ওপর কোন স্ত্রীর অধিকার জারি করে নি৷ বন্ধুত্বে যতটুকু ব্যবধান থাকা উচিত৷ দুজনে সেটি বজায় রেখে হাসি ঠাট্টায় সাত দিন পার করেছে৷

এই হাসি ঠাট্টার মাঝেও যে তিথির প্রান ছিলো না৷ সেটি মুহিতের চোখে বেধেছে৷ প্রায় সন্ধ্যায় তিথিকে ছাদের ওপর ফোনে কথা বলতে দেখেছে৷ সে কখনো জিজ্ঞাসা করে নি কথা বলার মানুষটি কে? ধারনা করে নিয়েছে সেই মানুষটি আনিস৷ এই নিয়ে তিথিকে সে কিছু বলতে পারছে না৷ তিথির মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে৷ বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে বই পড়ছে মুহিত৷ বইটির নাম অমিতাভ৷ শরদিন্দু বন্ধ্যোপধ্যায়ের লেখা৷ এই বইটি সে টানা তিন দিন ধরে পড়ছে৷ কিন্তু গল্পের কাহিনী বুঝতে পারছে না৷ গল্পের কাহিনী বুঝতে না পারার কারনটা সে ধরতে পেরেছে৷ ভাষাগত জটিলতা৷ সাধু, চলিত, সংস্কৃতি৷ সব ভাষা মিলিয়ে বইটি লেখা হয়েছে৷ ভাষার দিকে জোর দিতে গিয়ে সে কাহিনী হারিয়ে ফেলছে৷

মুহিত ভ্রু কুঁচকে সিগারেট ধরাতেই তিথি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুহিত সেটা বুঝতে পারলেও ওর দিকে ঘুরে তাকায় নি৷ তিথি বলল, বইটা কী খুব ইন্টেরেস্টিং? মুহিত খানিকটা হকচকিয়ে যাওয়ার ভান করে বলল, ওহ! তুমি৷ হুম বেশ ইন্টেরেস্টিং বলতে পারো৷ তিথি এক গাল হেসে মুহিতের চেয়ারের পাশে বড় সাইজের একটা টুল এনে বসল৷ তারপর বলল, কিছুখন আগে আনিসের সাথে কথা হয়েছে৷

মুহিত বইটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে চেয়ারের পাশে রেখে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, তোমার এই কথার প্রেক্ষিতে আমি কী বলব সেটা বুঝতে পারছি না৷ তিথি বলল, আপনাকে বুঝতে হবে না৷ আমি বলছি আপনি শোনে যান৷ আমি আনিসকে কোন ভাবেই ভুলতে পারছি না৷ ভালোবাসা ভোলা এত সহজ না৷ ভুলে থাকার অভিনয় করা যায়৷ শীতের হিম বাতাস শো শো শব্দ করে বারান্দার গ্রীলের ফাঁকে দিয়ে এসে তিথির খোলা চুলগুলো এলো মেলো করে দিলো৷ মেয়েটিকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে৷ তাঁর চেহারার লাবণ্যতা ভুলে বুঝতে চাইলো মনের মধ্যে কী চলছে৷

আরেক পশলা হিম বাতাস এসে ধাক্কা দিলো মুহিতের বুকে৷ মনে হলো হিমালয় থেকে এক পিন্ড বরফ এসে পড়েছে তাঁর বুকের মধ্যে৷ মুহিত কী তিথির মনের কথা গুলো বুঝতে পেরেছে? হয়তো কথার ইঙ্গিতে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে৷ মুহিত নিজের চেহারার মধ্যে এক হাসির রেখা ফেলে বলল, তুমি কি বলতে চাইছো৷ আমি হয়তো বুঝতে পেরেছি৷ কিন্তু আমি তোমাকে কী বলব সে ভাষাটা খুঁজে পাচ্ছি না৷ তিথি বলল, আমি কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যাব৷ আশা করছি আপনার আপত্তি থাকবে না৷

মুহিত এবার মিহি শব্দ করে হেসে বলল, এখানে আপত্তির কী আছে! নিজের বাবার বাড়িতে কিছুদিন থেকে এলে মন ফ্রেশ লাগবে৷ তুমি কখন যাচ্ছো? ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে যেও৷ তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে৷ তিথি বলল, জ্বি আচ্ছা৷ তিথি বসা থেকে উঠে ঘরের দিকে চলে গেল৷ মুহিত রকিং চেয়ারে হেলতে হেলতে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বইটি খুলে ধরল চোখের সামনে৷ বই-এ মন বসছে না দেখে আবার বন্ধ করে এক মনে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো৷ তাঁর মনে হচ্ছে আজকের বাতাস অন্য দিনের তুলনায় বড্ড ঠান্ডা৷ দরজা খুলে হাসান দেখল তিথি দাঁড়িয়ে৷ আনন্দ স্বরে বলল, কিরে তুই! কেমন আছিস? তিথি বলল, তোমার তো ইন্টেনশন ক্ষমতা অসাধারন৷ তুমিই বলো আমি কেমন আছি৷

হাসান ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে উমম! শব্দ করে তিথিকে বলল, মোটা হয়েছিস৷ তাছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ তিথি বলল, বাইরে দাড় করিয়ে রাখবে? ভেতরে আসতে দিবে না! হাসান ব্যস্ততার ভঙ্গিতে বলল, ওহ! হ্যা৷ আয় ভেতরে আয়৷ তারপর গলা উচিয়ে বলল, মা দেখ কে এসেছে৷ তিথির মা আমেনা বানু রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে দেখলো তিথিকে৷ তারপর এক দৌড়ে এসে তিথিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল৷ তিথির চোখে পানি চলে এসেছে৷ মুখে হাসি ফেলে বলল, তুমি কেমন আছো মা?

আমেনা বানু কোন উত্তর না দিয়ে হাউ মাউ করে কেদেই চললেন৷ কান্নার শব্দে তিথির বাবা এনায়েত হোসেন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন এই দৃশ্য৷ তাঁর হাতে থাকা খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, মারে কেমন আছিস৷ তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, হাসান দেখ৷ তিথি এসেছে৷ হাসান এসব দৃশ্য দেখে হেসেই চলল৷ এনায়েত হোসেন তিথির মায়ের দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল, কী মরা কান্না শুরু করেছে৷ মেয়ে এসেছে৷ ভালো কিছু রান্না করো গিয়ে৷ কান্না বন৷ আমেনা বানু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ঘরে যা মা৷ আমি রান্নার কাজটুকু সেরে আসছি৷

তিথি ঘরে গিয়ে হাসানকে বলল, তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো ভাইয়া৷ গাল একদম বসে গেছে৷ হাসান বলল, এসব ছাড়৷ তোর সংসার কেমন চলছে তাই বল৷ তিথি বলল, ভালো৷ তারপর এদিক ঐদিক তাকিয়ে বলল, আনিসের সাথে কথা হয়েছিলো? হাসান বলল, হুম৷ আনিসের সাথে দেখা করেছি বিয়ের পরদিন৷ তিথি আগ্রহ স্বরে বলল, ও কী বলেছে? হাসান বলল, ওর স্বভাব তো চিনিস৷ স্বভাব সুলভ কথাই বলেছে৷ তুই যেনো সুখে থাকিস৷ এটাই ওর চাওয়া৷ তিথি বলল, ওহ! আচ্ছা৷ হাসান বলল, আনিসের বিষয়ে মুহিতকে কিছু বলেছিস? তিথি বলল, হুম৷

হাসান বলল, মুহিত এসব শোনে কী বলল? তিথি বলল, তেমন কিছু না৷ ভাইয়া আমি এখন একটু বের হবো৷ হাসান বলল, সবে মাত্র আসলি৷ এখনই বেরুবি! তিথি বলল, বেশি সময় নেব না৷ এক ঘন্টা লাগবে৷ আনিসকে ফোন করে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে থাকতে বলেছি৷ দেখা করাটা খুূব দরকার৷ কিছু মনে করো না ভাইয়া৷ এই বলে তিথি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে৷ হাসান কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে চুপ করালো৷ সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে বসে আছে আনিস৷ তিথি গেইট দিয়ে ঢুকছে৷ সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে তিথির দিকে৷

তিথি আনিসের পাশে এসে বসলো৷ কোন কথা বলল না৷ দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে৷
আনিসের অনেক কথা বলার আছে৷ কিন্তু বলতে পারছে না৷ তিথির বুকে জমানো আছে হাজার অভিমান৷ সে সব আনিসকে শুনাতে পারছে না৷ কে কোন অধিকারে বলবে়৷ সেটা বুঝতে পারছে না বলে দুজনই চুপ৷ ক্ষীনকাল পর আনিস বলল, শুনেছি বিয়ের পর মেয়েদের সুন্দর্য বেড়ে যায়৷ তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি কথাটি সত্য৷ তিথি বলল, তোমার অফিস কেমন যাচ্ছে? আনিস মাথা এক পাশে হেলে বলল, ভালো৷

তিথির চোখের এক কোণে পানি জমে গেছে৷ আনিস সেটা দেখতে পেয়ে বলল, প্রকৃতি সব কিছু মানুষের হাতে তোলে দেয় না৷ কিছু বিষয় প্রকৃতি নিজে কন্ট্রোল করে৷ মানুষের হাতে প্রকৃতি যেসব বিষয় তোলে দেয়, সেসব মানুষ জটিল করে তোলে৷ কিন্তু প্রকৃতি সব সময়ই মানুষের কল্যানের দিকটায় দেখে৷ আমাদের উচিত প্রকৃতির দেয়া সব সিদ্ধান্তকে গ্রহন করা৷ এতে ক্ষীনকালের আক্ষেপ থাকলেও, সারাজীবন সুখের অভাব হয় না৷ তিথি কিছুখন আনিসের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পড়ার মত তিথির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো চোখের পানি৷ তারপর বলল, ধন্যবাদ৷ আমি এখন আসি৷

তিথি উঠে চলে যাচ্ছে৷ আনিস তাকিয়ে দেখলো তাঁর যাওয়ার দৃশ্য৷ নিজ মনে বলল, তুমি তোমার সুখের গন্তব্যের দিকে যাচ্ছো৷ মুহিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো রিক্সা থেকে নামছে তিথি৷ তাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে না৷ কিন্তু মুহিত অস্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে৷ তিথির ফিরে আসাটা কী মুহিত ভেবেছিলো? ভাবলে হয়তো অস্বাভাবিক চিন্তাটা তাঁর মধ্যে আসত না৷ কিছুখন পর তিথি ঘরে এসে সোঁজা বারান্দায় চলে এলো৷ তারপর মুহিতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, শীতের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো৷ ঠান্ডা লাগবে যে৷

ওর মুখে তুমি শব্দটি শোনায় মুহিত চমকে উঠলো৷ তিথি গুটি গুটি পায়ে মুহিতের কাছে গিয়ে বলল, তোমার মুখটা ওমন শুকনো লাগছে কেন! দুপুরে খাও নি? তিথির কথা বার্তায় মুহিত স্বাভাবিক হতে পারছে না৷ তিথি বলল, তোমার কানাডিয়ান প্রেমিকা জোর্জিয়ার খবর কী? মুহিত স্বাভাবিক স্বরে বলল, ওকে আমার বিয়ের কথা বলেছি৷ আমি যে আর কানাডা যাচ্ছি না সেটিও বলেছি৷ তিথি এবার মুহিতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার হাত ধরে দেখোত৷ খুব কী ঠান্ডা হয়ে আছে?

মুহিত তিথির হাতের উপর হাত রাখলো৷ বিকেলের সূর্য ডুবে গেছে৷ মৃদু বাতাস লাগছে তার গায়ে৷ মুহিত বলল, আজকের হিম বাতাসে আমার প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে৷ তারপর তিথির দু’গালে হাত রেখে বলল, তোমায় একটা চুমু খেতে পারি? তিথি লজ্জা মাখিয়ে চোখ বন্ধ করলো৷ দেখতে পেল নতুন জীবন, নতুন স্বপ্ন৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত