বৈষম্য

বৈষম্য

তমা আর তিশার সামনের টেবিলের উপরে পিরিচের মধ্যে একটা আপেল কেটে রাখা। একটা মাত্র আপেলকে- কে কতোটা পাতলা করে কেটে, কতো বেশি টুকরা করতে পারবে, সেরকম কোন প্রতিযোগীতার একটা পিরিচ হয়তো ভুল করে তাদের সামনে চলে এসেছে– এরকমটাই মনে হলো তমার কাছে। আর সেই পিরিচের পাশে আছে দুই গ্লাস ট্যাং এর শরবত। এখানেও মনে হচ্ছে ট্যাং এর গুড়া কতটা কম দিয়ে শরবত বানানো সম্ভব — সেই প্রতিযোগিতার দুইটা গ্লাস ভুলক্রমে এখানে চলে এসেছে। লজ্জায় ছোটবোন তিশার দিকে তাকাতে পারছিল না তমা। এখানে আসার আগে কতো বড়মুখ করে ওকে বলেছিল,

—- তুইও চল আমার সাথে। মিলাকে দেখলে বুঝতে পারবি, কতো ধনী হয়েও আমার মত মধ্যবিত্তের সাথে কতো আন্তরিকতার সাথে মেশে। টেবিলের অন্য পাশে বসে যে মেয়েটি মোবাইলে একমনে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিচ্ছে– সে হচ্ছে তমার ফ্রেন্ড মিলা। ওকে দেখে কে বলবে– ভার্সিটিতে বসে এই মেয়েই তমাকে ওদের বাসায় আসার জন্য খুব করে বলেছিলো!

তমা আর তিশা দু’বোন মিলাদের বাসায় এসেছে প্রায় আধাঘন্টা হবে। মিলা আর তমা দু’জনে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মিলাদের বাড়ি তমাদের বাসা থেকে খুবই কাছে। ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা দেয়ার সময় সেদিন কে কোথায় থাকে- এটা নিয়ে গল্প করতে গিয়েই ওরা জেনেছিল- মিলা আর তমাদের বাসা খুব কাছাকাছি। মিলা তখন খুব আন্তরিকতার সাথেই তমাকে বলেছিলো,

—– এত কাছে থাকো তুমি? আমাদের বাড়িতে চলে এসো একদিন। তখন অবশ্য তমা একেবারেই বুঝতে পারেনি- ওর আন্তরিকতার পুরোটাই ছিলো অভিনয়। বড়লোকেরা খেয়ালের বশে কত কথাই বলে, তাই বলে তাদের সব কথাকে গুরুত্ব দিতে নেই– সেটা এখন বুঝতে পারছে তমা।

আসলে তমাদের ফ্যামিলি এই এলাকায় নতুন এসেছে। বাবার নতুন অফিস এর কাছাকাছি বাসা খুঁজতে গিয়েই তাদের এই এলাকায় আসা। আর একটু মিশুক টাইপের তমা যখন দেখল তাদের বাসার এতো কাছেই মিলাদের বাসা, তখন এক ছুটির দিনে ছোটবোনকে নিয়ে চলে এলো। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে– না এলেই বরং ভালো হতো। আসলে মিলার ফ্যামিলি যে এরকম বিরাট ধনী আর অহংকারী– সেটা আগে বুঝতে পারেনি তমা। তাহলে হয়তো আসত না। তমা আর তিশা দু’জনেই উশখুশ করছিল ওঠার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে টুং টাং মিষ্টি শব্দে কলিংবেলটা বেজে উঠলো। একজন গৃহকর্মী এসে দরজাটা খুলে দিতেই তমা দেখল — ওদেরই আরেক ক্লাসমেট জেনী এসেছে। জেনী ভেতরে ঢুকতেই মিলা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তারপর জেনীর হাত ধরে টানতে টানতে বললো,

—- চল.চল ভেতরে আয় অবশেষে আসতে পারলি আমাদের বাসায়! বলে ওকে এনে সোফায় বসালো। তমাকে দেখে জেনী হাসিমুখে “হাই” বলে তিশাকে দেখিয়ে বললো,

—- এটা কে? তমা বলল,
—- আমার ছোট বোন। জেনী তখন তিশার সাথেও হাসিমুখে গল্প করতে লাগলো, কিসে পড়ে, কোথায় পড়ে, এই এলাকা কেমন লাগছে– এই সব…

জেনী তমাদের সাথে এতো আন্তরিকতার সাথে কথা বলছিল যে ওকে দেখে মনেই হচ্ছিল না – ওরা কত ধনী, ও কত ঝকঝকে গাড়িতে করে রোজ ইউনিভার্সিটিতে আসে। অন্য ক্লাসমেটদের কাছে তমা শুনেছিল ঢাকায় নাকি ওদের একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছ, আরো বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে ওদের। রাজপ্রাসাদের মতো তিনটা বাড়ি আছে। তাছাড়া ওর চালচলন আর বেশভূষা দেখেই বোঝা যায় ওদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কতখানি। জেনীকে বসিয়ে রেখেই মিলা ভেতরে চলে গেল। মিলা ভেতরে যেয়ে সম্ভবতঃ ওর আম্মুকে বলে আসলো জেনীর জন্য কী কী খাবার-দাবারের আয়োজন করতে হবে। মিলা এসে সোফায় বসতেই ভেতর থেকে মিলির মায়ের কন্ঠ শুনতে পেল তমা–

—- ফরিদা, ফ্রাইড রাইস আর ফ্রাইড চিকেন করে ফেল তো ঝটপট! একটা সালাদ করবি, আর ফ্রিজে কোক আছে… বের করে দিস… আর…

মিলা আর জেনী জোরে জোরে গল্প করছে বলে ওদের কানে হয়তো মিলার মায়ের কন্ঠ পৌঁছায়নি। কিন্তু তিশাও যে আন্টির কথা শুনতে পেয়েছে, সেটা ওর চোখে চোখ পড়তেই বুঝে গেল তমা। ওরা দু’জনেই এবার তড়িঘড়ি করে উঠে পরল। মিলা একবারের জন্যেও ওদেরকে সাধলো না। অথচ জেনী বার বার বলছিলো,

— আরেকটু থেকে যাও না তোমরা।

একটু জরুরী কাজ আছে, বলে বেরিয়ে পরল তমা আর তিশা। বের হওয়ার আগে মিলা আর জেনীকে তাদের বাসার লোকেশনটা বুঝিয়ে বলে বাসায় আসার জন্য বলেছিল ওরা।

ভার্সিটিতে মিলা তমার সাথে বেশি একটা না মিশলেও জেনী কিন্তু তমার সাথে খুব মিশতো। আর ওর সাথে তমার খুব ভালো একটা বন্ধুত্বও গড়ে উঠলো। তমারও খুব ভালো লাগতো জেনীকে। কতো বিত্তশালী হয়েও এতোটুকু অহংকার বোধ ছিলোনা ওর মনে।

একদিন ছুটির সকালে তমার মা পাটিসাপটা পিঠা বানাচ্ছিলেন। তমার বাবা সহ ওরা তিন ভাইবোন রান্নাঘরে যেয়ে হৈচৈ করে সেই পিঠা খাচ্ছিল। একটা পিঠা হয়ে গেলেই কে সেটা নেবে, তাই নিয়ে হৈচৈ। তমার মা সিরিয়াল করে একজনের পরে আরেকজনকে দিতে চাইলে সিরিয়াল ভেঙে তারা আগে পিঠা নেয়ার জন্য হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেলল। তমার মা প্রায়ই এই পিঠাটা বানান। প্রথমে পিঠা তৈরির লিকুইডটা অল্প করে ফ্রাইপ্যানে ঢেলে সেটাকে ঘুরিয়ে লিকুইডটি চারিদিকে ছড়িয়ে পাতলা একটি রুটির মতো তৈরি করেন।

তার মাঝখানে লম্বা করে পিঠার পুরের জন্য তৈরি ক্ষীর দিয়ে কি সুন্দর করে যে সেই পাতলা রুটিটি আবার ভাজ করে করে পাটিসাপটা পিঠা বানান তমার মা! এটা দেখতেও তাদের কাছে খুব ভালো লাগে, খেতে তো পুরাই অমৃত! আর যখনই মা এটা তৈরি করেন, তখনই ওরা তিন ভাইবোন এবং বাবা মিলে এরকম হৈচৈ আর আনন্দে মেতে ওঠে। অচেনা কেউ তাদেরকে দেখলে তখন ভাবতেই পারবেনা- তাদের বড় ভাইটি মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট, তমা অনার্স ফার্স্ট ইয়ার, আর তিশা ইন্টার্মিডিয়েটের স্টুডেন্ট। হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠতেই তিশা গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখলো জেনী আপু এসেছে। সাদা শাড়ি আর লাল-নীল রঙের ফুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করা পাড়ের শাড়িতে জেনী আপুকে ঠিক যেন একটা পরীর মতো লাগছিলো! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো তিশা।

—– কি হলো ভেতরে আসতে বলবে না?

হাসি মুখে প্রশ্ন করলো জেনী। তিশা লজ্জা পেয়ে তারাতারি তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে দরজা আটকে একবারে তাকে রান্না ঘরে নিয়ে আসলো। রান্নাঘরে তখনও চলছিলো পিঠা উৎসব। ছোটবেলায় মা কে হারিয়ে বাবার একমাত্র আদরের সন্তান হয়ে গভর্নেস আর গৃহকর্মীদের কাছে বড় হয়ে ওঠা জেনীর কাছে এই পিঠা উৎসবকে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেন রূপকথার কোন দৃশ্য! বাবা-মা, ভাই-বোনদের সাথে এভাবে একসাথে আনন্দ করা তার কাছে ছিলো স্বপ্নের মতো। তাই জেনী যেন স্বপ্নের ঘোরেই হাঁটতে হাঁটতে তমার মায়ের কাছে গিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আবদারের সুরে বললো,

—- এবার কিন্তু সিরিয়ালে আমি….

রান্নাঘরে সবাই এতো হৈ হুল্লোড় করছিলো, যে তিশা ছাড়া অন্য কেউই জেনীকে এতক্ষণ দেখতে পায়নি। হঠাৎ করে লাল-নীল রঙের লতাপাতা আঁকা পাড়ের সাদা শাড়ি পরা, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা জড়ানো আর চোখে কাঁজল দেয়া মায়াবী চেহারার জেনীকে দেখে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। তমা আর তিশা বাদে বাকি সবার কাছেই মনে হলো পরী রাজ্য থেকে কোন পরী বুঝি ভুল করে তাদের ঘরে চলে এসেছে। তমা বললো,

— ও হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড জেনী সবার বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই মা হাসি মুখে প্লেটে একটা পাটিসাপটা পিঠা তুলে জেনীর হাতে দিয়ে বললেন,

—- তোমার কথা তমার মুখে অনেক শুনেছি। আমাদের মতো গরীবের খাবার কি তোমার ভালো লাগবে মা?
মায়ের কথা শুনে তমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। জেনী আবার কি-না কি ভেবে বসে, সেটা ভেবে তড়িঘড়ি করে বললো,

—- এসব তুমি কি বলছো মা! আর জেনী তখন বললো, এই কথার শাস্তি হিসেবে আন্টিকে আমার মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হবে।

তমার মা নিজের হাতে ধরে খাইয়ে দিচ্ছেন জেনীকে। আর জেনী পরম তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে। মায়ের হাতে খাবার খেতে যে এত মজা, মা হারা মেয়েটি আজ প্রথম সেটা বুঝতে পারল। পাটিসাপটা পিঠা খেতে খেতে বারবার তার দু’চোখ ভিজে যাচ্ছিলো পানিতে। তমার মা সেটা দেখতে পেয়ে পরম মমতায় তার শাড়ির আঁচল দিয়ে জেনীর দুই চোখ মুছিয়ে দিয়ে লক্ষ্য করলেন, তার দু’চোখও জলে ভিজে যাচ্ছে…

তমা তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এই অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যটি দেখে মনেমনে ভাবছিলো– আসলে ধনী আর গরীবের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকে না, আমরা মানুষেরাই নিজেদের মত করে এই বৈষম্য সৃষ্টি করে থাকি। মিলার মত মানুষেরা যেমন সামান্য আতিথেয়তায়ও বৈষম্য সৃষ্টি করে পৃথিবীটাকে বিষাদময় করে তোলে, জেনীর মত মানুষেরা তেমনি ধনী-গরিবের সকল বৈষম্য ভেঙে ফেলে এই পৃথিবীকে আরো বেশি সুন্দর ও মায়াময় করে তুলতে পারে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত