১. ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা
ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা।
ছোরার ফলাটা ক্রমে সরু হয়ে অগ্রভাগটা তীক্ষ্ণ, অত্যন্ত ধারালো; ছোরার বাঁটটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত চন্দনকাঠের তৈরী! সুমিগ্ধ পাতলা একটা চন্দনের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে!
দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসে সি. আই. ডি-র ইন্সপেক্টার মজিবুর রহমান ও কিরীটী রায়। সামনেই একটা ছোট শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে অয়েল পেপারের উপরে রক্ষিত ছোরাটা।
কিরীটী প্রশ্ন করে, তারপর?
তারপর সকালে ভৃত্য মধুই নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষে ঢুকে প্রথম দেখতে পায়, নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন দেহটা ডেক-চেয়ারটার ঠিক সামনেই, মেঝের কার্পেটের উপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এবং বাম দিককার বুকে ঐ ছোরাটা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। গায়ে তখনও তার স্লিপিং গাউনটা পরা! The dagger pierced through and through the heart!
হুঁ! যে-ই নরেন মল্লিককে ছোরা দিয়ে হত্যা করে থাকুক আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা হাতে প্রচুর শক্তি রাখে! আচ্ছা স্লিপিং গাউনটা তখনও নরেন মল্লিকের গায়েই ছিল বলছিলেন ইনসপেক্টার, ঘরের শয্যাটা পরীক্ষা করা হয়েছিল কি?
হাঁ। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি শয্যাটা, রাত্রে ব্যবহৃত হয় নি। এমন কি প্রতি রাত্রে নাকি শয়নের পূর্বে নরেন মল্লিকের এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল পান করা অভ্যাস ছিল, মধুর সে রাত্রে রাখা শিয়রের সামনে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত জলভর্তি গ্লাসটা পর্যন্ত ঠিক তেমনই ছিল। রাত্রি দশটায় নিজে সে গ্লাসটা জলভর্তি করে রেখে এসেছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্টেও তাহলে মৃত্যুর কারণ ছুরিকাঘাতই—
অন্য কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় নি?
না।
কিরীটী সম্মুখের টেবিলের ওপরে রক্ষিত অয়েল পেপারের উপর থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। ইস্পাতের তৈরী মজবুত ছোরা। ওজনেও মন্দ হবে না। অগ্রভাগটা ধারালো ও তীক্ষ্ণ।
হঠাৎ মজিবুর রহমান বলে, কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়, ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপই পাওয়া যায় নি।
কিরীটী তখনও ছোরাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, মৃদু কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক!–বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, তা বই কি! প্রথমতঃ ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলে সর্বাগ্রে নিশ্চয়ই সে কথা আপনি আমাকে বলতেন। দ্বিতীয়তঃ অমন কৌশলের সঙ্গে যে খুন করতে পারে, ছোরার বাঁটে সে তার আঙ্গুলের ছাপ রেখে যাবে এমন ভাবাই তো অন্যায়! আর এসব ক্ষেত্রে by chance আঙ্গুলের কোন ছাপ পাওয়া গেলেও সেটা হত্যাকারীর কখনো হয় না, বরং যে নিহত হয় অনেক সময় তারই আঙ্গুলের ছাপ বা হাতের ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু সে কথা যাক। মৃতের কক্ষে হত্যার সূত্র বা প্রমাণ হিসেবে তার বক্ষে বিদ্ধ এই ছোরাখানি ছাড়া আর কিছুই তাহলে পাওয়া যায় নি বা নজরে পড়ে নি আপনাদের? যেমন ধরুন, কোন struggleয়ের চিহ্ন বা—
না। So far সবই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখা হয়েছে, but nothing more could be detected.
হুঁ।
এর পর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে।
হঠাৎ আবার কিরীটীই ডাকে, মিঃ রহমান?
বলুন?
সেই ঘরটা, মানে পার্ক সার্কাসে মৃত নরেন মল্লিকের বাড়িতে যে কক্ষে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই ঘরটা কি এখনো আপনাদের disposalয়েই আছে?
হাঁ নিশ্চয়ই! তদন্ত এখনো চলছে, করোনার্স কোর্টে বিচার এখনও শেষ হয় নি। নরেন মল্লিক নিহত হয়েছে গত ২৭শে পৌষ সোমবার—আর আজ বৃহস্পতিবার, মাত্র তিন দিন আগে।
বেশ। তাহলে আজ এখুনি যদি আপনার অসুবিধা না হয় চলুন না, আর একটিবার সেই ঘরটা দুজনে ভাল করে দেখে আসা যাক। আর সেই সঙ্গে বাড়ির লোকদেরও দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে আসা যাবে।
বেশ তো! আপত্তি কি, চলুন!
তবে আর দেরি নয়—শুভস্য শীঘ্র—চলুন ওঠা যাক।
ইন্সপেক্টার মিঃ রহমানের গাড়িতে চেপেই কিরীটী ও রহমান সাহেব রওনা হলো পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের বাড়ির দিকে অতঃপর। এবং গাড়িতে বসেই একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে হঠাৎ এক সময় কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা রহমান সাহেব, আপনি বলছিলেন নরেন মল্লিক বহুদিন বর্মা মুন্নকে ব্যবসা করেছেন। এবং মাত্র এক বৎসর আগে যদি তিনি হঠাৎ ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এসে থাকেন, কেন এলেন? আর শুধু তাই নয়, এক বৎসরের মধ্যেই খুনও হলেন নৃশংস ভাবে। কিন্তু কেন, কেন
আপনার কথাটা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!
মানে, বলছিলাম তার অর্থাৎ মল্লিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে একটা details পেলে আমাদের তদন্তের সুবিধা হতো না কি?-অনেক সময় দেখা গিয়েছে এ সব ঘটনার পিছনে থাকে অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার জড়িত হয়ে।
সৌভাগ্যক্রমে খুনের পরের দিন সকালে তদন্তের সময়ই নরেন মল্লিকের এক পুরাতন বন্ধু, অ্যাড়ভোকেট সমীর রায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, নরেন মল্লিক তার বহুকালের বন্ধু এবং নরেন মল্লিক হঠাৎ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে তারই বাড়িতে নাকি সর্বপ্রথম ওঠেন।
.
এক দিন সকালে ঠিক আজ থেকে এক বছর আগে।
সমীর রায় সকালে তার বাইরের ঘরে বসে ঐ দিনকার সংবাদপত্রটার ওপরে চোখ বুলোচ্ছে, বাইরে গেটের সামনে একটা গাড়ি থামবার শব্দ শোনা গেল। সমীর একটু কৌতূহলী হয়েই জানালার সামনে উঠে এসে দাঁড়াল। বাড়ির গেটের সামনে একটা মালবোঝাই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, ট্যাক্সির সামনে নরেন মল্লিক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে।
নরেন! এ সময়ে হঠাৎ! কোন চিঠিপত্র না দিয়ে!
একটু পরেই নরেন এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
নরেন তুই! হঠাৎ–
হঠাৎই। বর্মার ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এলাম।
গুটিয়ে দিয়ে এলি? হঠাৎ
চলে এলাম আর ভাল লাগল না। কিন্তু তার আগে তোর চারককে বল, আমার চাকর মধু ট্যাক্সিতে আছে, মালপত্রগুলো নামিয়ে আপাতত কোথাও গুছিয়ে রাখবার জন্য হাত দিতে।
তা না হয় বলছি—কিন্তু—
ব্যস্ত হোস নে। সব বোলবো–
সমীর ভৃত্যকে ডেকে ট্যাক্সি থেকে সব মালপত্র নামিয়ে নিচের ভিজিটার্স রুমে আপাতত গুছিয়ে রেখে দিতে আদেশ দিল।
নরেন মল্লিকের চেহারাটা সত্যই দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। বাঙালীর মধ্যে সচরাচর এমন চমৎকার সুগঠিত, উঁচু, লম্বা, সুশ্রী দৈহিক গঠন বড় একটা দেখা যায় না। নরেন মল্লিকের বয়েস বর্তমানে উনপঞ্চাশ এবং বয়সের অনুপাতে দেহের কোথাও এতটুকু ভাঙনও ধরে নি। সমস্ত দেহ জুড়ে এখনো যৌবন যেন স্থির হয়ে আছে।
কেবল কপালের দুপাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। চঞ্চল, ক্রীড়াশীল ও কৌতুকপ্রিয় স্বভাব। নরেন মল্লিককে দেখলেই মনে হয়, সত্যিই যেন সে বেঁচে আছে। এবং পৃথিবীতে বাঁচবার সমস্ত রহস্যটুকুই যেন ওর করায়ত্ত।
.
দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর নরেন ও সমীর মুখোমুখি বসে দুই বন্ধুতে সকালের কথারই জের চালাচ্ছিল। আজ রবিবার, আদালতও বন্ধ। ছুটি।
নরেন বলছিল, মোদ্দা কথা বন্ধু, I want to live the rest of my life, যদিও শাস্ত্রে বলেছে পঞ্চাশের পরেই বনং ব্রজেৎ, আমি স্বীকার করি না সে কথা। আমার ideal পুরুষ হচ্ছে বিখ্যাত ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিক ভরেনহ। অর্থ না থাকলে বাঁচা যায় না। এতকাল সেই অর্থের ধান্ধায় ঘুরেছি, সময় পাই নি জীবনের দিকে তাকাবার, আজ অর্থ আমার করায়ত্ত, এবারে eat, drink and be merry! এবারে বাঁচতে চাই! So–
So? হাস্যোফুল ভাবে সমীর বন্ধুর দিকে তাকায়।
So একটা বাড়ি ও একটা গাড়ি সর্বাগ্রে প্রয়োজন; তারপর শুরু করবো আমার জীবন।
বাড়ি আর গাড়ি?
হাঁ। বর্তমান দুনিয়ায় বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সই আধুনিক কালে বাঁচবার প্রচেষ্টায় প্রথম তিনটি সোপান; শেষটি আমি সঙ্গে করেই এনেছি এবার, প্রথম দুটি তুমি সংগ্রহ করে দাও, শুরু করি আমি আমার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বেশ!
বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত হাতে নেই বন্ধু! জীবনের অনেকটা সময় চলে গিয়েছে অতএব আর অপেক্ষা নয়—বাড়ি তৈরী করবার ধৈর্য বা সময় আমার নেই। ৬০।৭০ হাজারের মধ্যে একটা বাড়ি ক্রয় করতে চাই আমি—আর a nice-looking carFord fluid-drive, ওলডমবিল বা স্টুডিবেকার—নিদেনপক্ষে হাম্বার বা রোভার-১২।
বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত সময় হাতে নেই বন্ধু। জীবনের অনেকটা সময় একটা গাড়ি!
তারপর একটু থেমে বলে, দাঁড়াও, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে একটা চমৎকার নব্যকেতার বাড়ি আমার এক ক্লায়েন্টের ডিসপোজালেই আছে, বাড়িটা ভালই—দোতলা, উপরে নীচে খান আষ্টেক ঘর, সামনে লন, পের্টিকো, পিছনেও ছোটখাটো একটা বাগান, গ্যারাজ, গেটের পাশে দারোয়ানদের থাকবার ঘর।
চমৎকার! দাম?
সেলামী নিয়ে বোধহয় হাজার ষাটেক পড়বে—মানে যার বাড়ি তিনি একটু বেকায়দায় পড়েই বাড়িটা বিক্রী করে দিতে চান, নইলে ও বাড়ি ধরে রাখলে হাজার আশি পর্যন্ত—
ডোন্ট ওরি, এখুনি ফোন কর কিন্তু ঐ সেলামীর কথা কি বলছিলে?
থাকতে মগের দেশে, অধুনা কলকাতার সংবাদ তো রাখ না! বাড়ির problem বর্তমানে এ শহরে যা হয়েছে! ঐ সেলামী হচ্ছে বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়ের প্রথম সোপান। তা সেলামীও বলতে পার—আক্কেল সেলামীও বলতে পার কারণ প্রয়োজনটা যখন ক্রেতা বা ভাড়াপ্রার্থীর–
ঠিক আছে, ফোন কর।
বাড়ি দেখে নরেনের পছন্দ হয়ে গেল। সত্যি চমৎকার বাড়িটা। পরের দিনই বায়না করা হলো। এবং নির্দিষ্ট দিনে নতুন বাড়ি ও ফ্লুইড় ড্রাইভ একটা ফোর্ড গাড়ি কিনে নরেন মল্লিক গৃহপ্রবেশ করল। বাড়ির ফটকে নেমপ্লেট বসলো : শ্রীনরেন মল্লিক।
গেটের দারোয়ান বহাল হলো, খোট্টাই রামখেল সিং। আরো দুজন চাকর এলো, হরি আর যদু, পনের বছরের পুরাতন ভৃত্য মধু তো রইলই। ড্রাইভার নন্দুয়া এলো, পাচক উৎকলবাসী শ্রীমান জগন্নাথ। দামী দামী সাজসজ্জায় বাড়িঘরদোর ভরে উঠলো।
নিরহঙ্কার, সদালাপী স্বভাবের দরুন শীঘ্রই পাড়ায়, অভিজাত মহলে নরেন মল্লিকের নামটা এ-কান ও-কান হতে হতে দশ কানে ছড়িয়ে গেল। লম্বাচওড়া সুশ্রী চেহারা এখনো বিবাহাদি করে নি। বয়স যদিচ পঞ্চাশের কোঠায় চলেছে, এখনো অটুট স্বাস্থ্য ও যৌবনের প্রাচুর্যে ঢল ঢল, তার উপরে কাল্পনিক ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের গুজব, বাড়ি, গাড়ি এবং সর্বোপরি মিষ্টি সদালাপী অমায়িক ব্যবহার।
কলকাতার আধুনিক অভিজাত মহলে শীঘ্রই মুখে মুখে নরেন মল্লিক প্রসিদ্ধ হয়ে গেল। জাগিয়ে তুললো একটা রীতিমত সাড়া। অনেক অবিবাহিতা মেয়েদের মায়েরা নরেন মল্লিকের গৃহে প্রায়ই আনাগোনা করতে শুরু করলেন। আর এক শ্রেণীর মেয়ের মায়েরা আছেন, যাঁরা অল্পবয়সী ছেলে—জীবনে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সব পাত্রের চাইতে মধ্যবয়সী প্রতিষ্ঠিত ও অর্থবান পাত্রদের ঢের বেশী পছন্দ করেন, তাঁরাও অনেকে সেজেগুজে মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করলেন মল্লিক পারলারে।
আজ পার্টি, কাল উৎসব—একটা না একটা লেগেই থাকত নরেন মল্লিকের গৃহে; মোট কথা নরেন মল্লিক যা চেয়েছিল তা দিনেই হাতের মুঠোয় এসে গেল। ঐ সঙ্গে এলো প্রতিষ্ঠা।
আত্মীয়স্বজন বলতে গৃহে নরেন মল্লিকের এক ভাগ্নে, নাম সুবিমল এবং বয়স তার ৩০৩২য়ের মধ্যে। সুবিমলও বিবাহাদি করে নি, বি. এ. পাস। ইনসিওরেন্সের মাহিনা করা দালাল। দেখতে সুশ্রী না হলেও মোটামুটি শরীরে একটা আলগা শ্ৰী আছে। বলিষ্ঠ দোহারা দেহের গঠন, বেশ একটু সৌখীন প্রকৃতির।
সুবিমল ছাড়া বাড়িতে পুরাতন বৃদ্ধ ভৃত্য মধু; হরি ও যদু দুটি ভৃত্য, ঠাকুর জগন্নাথ, দারোয়ান রামভজন সিং ও রামখেল সিং, ড্রাইভার নন্দুয়া এবং বিনতা। আর বাড়িতে ঐ বিনতাই ছিল একমাত্র স্ত্রীলোক। বিনতা ভদ্রঘরের ব্রাহ্মণের বিধবা, মধ্যবয়সী। প্রকৃতপক্ষে নারীহীন সংসার নরেন মল্লিকের বিনতাই সব দেখাশুনা করতো। এবং ভদ্রমহিলা সব দেখাশুনা করলেও কখনও নরেনের সামনে বড় একটা বের হতো না। আর সর্বদাই মুখের ওপর টানা থাকত একটি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন।
নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্যে দিয়েই দিন কেটে যাচ্ছিল নরেন মল্লিকের। কোন একটি নবলব্ধ বান্ধবীর জন্মতিথি উৎসব অত্যাসন্ন—সুন্দরী, তরুণী বান্ধবী, একটা ভাল রকম প্রেজেন্টেশন দিতে হবে।
সন্ধ্যার কিছু পরে নরেন মল্লিক হীরালাল শেঠের প্রকাণ্ড জুয়েলারীর দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল।
আধুনিক ডিজাইন ও প্যাটার্ণের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রেতা হিসাবে হীরালাল শেঠের দোকানে অভিজাত মহলের সুন্দরীদের যাতায়াতটা খুব বেশী। উজ্জ্বল আলোয় শো কেসের জড়োয়ার গহনাগুলো বর্ণদ্যুতি বিকিরণ করছে।
নরেন মল্লিক দোকানের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। দোকানের ম্যানেজার যমুনাদাস শেঠ নরেন মল্লিকের পরিচিত। শাঁসালো খরিদ্দার হিসাবে মল্লিক এ দোকানে বহুবার পদার্পণ করেছে ইতিপূর্বে, সেই কারণেই ম্যানেজার শেঠজী তাকে যথেষ্ট খাতিরও করেন।
আইয়ে আইয়ে মল্লিক সাব!
যমুনাদাস নরেন মল্লিককে দোকানে প্রবেশ করতে দেখেই সাদর আহ্বান জানায়।
মল্লিক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে, নমস্তে যমুনাদাসজী। তবিয়ৎ আচ্ছা তো?
আপকি মেহেরবানি। ফরমাইয়ে সাব কেয়া দেখাউঁ—
আসলি মুক্তাকা কৌই হার হ্যায় তো জেরা মেহেরবানি করকে দেখাইয়ে শেঠজী—
আসলি মুক্তা! চলিয়ে সাব উধার, ও কাউন্টারকে পাশ–
দোকানের পশ্চিম কোণে একটু নিরিবিলি কাউন্টারের ছোট একটি অংশ, স্বল্প আলোআঁধারিতে ঘেরা। একপাশে স্ট্যাণ্ডের উপরে সবুজ ডোমে ঢাকা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে—আলোর নিচে আট-দশটা মুক্তার হার বের করে এনে ছড়িয়ে দিল যমুনাদাস, মল্লিকের সামনে।
লিজিয়ে মল্লিক সাব! সব আসলি মুক্তা!
নরেন মল্লিক হারগুলি পরীক্ষা করতে থাকে আলোয়।
হঠাৎ সামান্য দূরে কাউন্টারের অপর পার্শ্ব হতে একটা ঈষৎ চাপা ভারী গলা শোনা যায়, কোই দামী নেকলেস দেখাইয়ে সাব। হীরাকা নেকলেস। বহুৎ আচ্ছা হীরা হোনা চাইয়ে—
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই যেন চম্কে ফিরে তাকায় ঐকণ্ঠস্বরে নরেন মল্লিক। হাতপাঁচেক ব্যবধান মাত্র। লম্বাচওড়া দীর্ঘকায় এক পাঠান। পরিধানে দামী নেভী-রু সার্জের স্যুট, মাথায় কালো ফেজ। মুখের একাংশ মাত্র দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল আলোর খানিকটা তির্যক ভাবে মুখের দক্ষিণ অংশে এসে পড়েছে।
দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন দক্ষিণ অক্ষিকোণ হতে গালের অর্ধাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
নরেন মল্লিক তাড়াতাড়ি মুক্তার হারগুলো এক পাশে ঠেলে দিয়ে বলে ওঠে, ফির দোসরা কোই টাইমমে কাল আয়েঙ্গে শেঠজী। আচ্ছা নমস্তে।কতকটা যেন হন্তদন্ত হয়েই নরেন মল্লিক দোকান থেকে বের হয়ে আসে।
হঠাৎ পাঠান এমন সময় বলে ওঠে, এ কেয়া হীরা হায়! হীরা—ম্যায় আসলি হীরা চাহাতে হুঁ!
নরেন মল্লিক গাড়ির দরজা খুলে ঝুপ করে গাড়ির পিছনের গদীতে বসে পড়েই বলে, নন্দুয়া, বাড়ি!
সে রাত্রে নরেন মল্লিকের ভাল ঘুম হয় না। তার মনে হয় দীর্ঘকায় একটা ছায়ামূর্তি যেন তার শয্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে একটা কালো মুখোশ। ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নরেন মল্লিক। মুখখাশের দুটি গোলাকার ছিদ্রপথে, দুটি চক্ষু তো নয় যেন দুটি অগ্নিগোলক জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে মুখোশধারী এগিয়ে আসছে শয্যার দিকে, পায়ে পায়ে নিঃশব্দে। এসে দাঁড়াল একেবারে শয্যার গা ঘেঁষে।
তারপর একটু একটু করে মুখখাশটা যেন উন্মোচন করে ছায়ামূর্তি।
কে! কে! ঘুমের ঘোরেই চিৎকার করে ওঠে নরেন মল্লিক। ঘুম ভেঙে যায় নরেন মল্লিকের। অন্ধকার ঘরে সামান্য একটুখানি চাঁদের আলো খোলা জানালাপথে এসে কক্ষমধ্যে লুটিয়ে পড়েছে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বালিয়ে দেয় নরেন মল্লিক বেড় সুইটা টিপে। শূন্য ঘর। বাকী রাতটুকু চোখের পাতায় আর ঘুম আসে না।
আবার একদিন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারটায় গাড়িতে করে বেড়িয়ে ফিরছে নরেন মল্লিক, গাড়ি গেটের মধ্য দিয়ে ঢুকছে, হঠাৎ নরেনের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যায়। রাস্তার গ্যাসপোস্টের আলো গেটের ওধারে এসে পড়ছে—সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখে দীর্ঘ এক ছায়ামূর্তি, পরিধানে কালো স্যুট, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক গেটেরই কাছে।
মূর্তিটা যেন একটু নত হয়ে কুর্নিশ জানাবার ভঙ্গী করে এবং পরক্ষণেই একপাশে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
প্রায়ই এর পর থেকে ছায়ামূর্তি চোখে পড়তে লাগল নরেন মল্লিকের। কখনো পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, কখনো গাড়িতে করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো ছায়ার মত দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে হেঁটে অথবা গাড়িতে চড়ে অনুসরণ করে।
একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে শয়নকক্ষের খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো–বাড়ির অল্পদূরে গ্যাসপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে সেই দীর্ঘ ছায়ামূর্তি–মুখ তুলে অপলকে যেন তারই ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুধু নরেন মল্লিকেরই না, ড্রাইভার নন্দুয়ার দৃষ্টিতেও পড়ে। সেও দেখে কালো রংয়ের। একটা সেলুনগাড়ি যেন প্রায়ই নিঃশব্দে ওদের গাড়িকে অনুসরণ করছে। কখনো অনুসরণ করে একটা চকিত প্রহেলিকার মত, কখনো সোঁ করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো বা শোনা যায় একটা অস্পষ্ট শব্দ।
নন্দুয়া অবশেষে একদিন বলে, একটা কথা বলবো বাবু—
কি নন্দুয়া?
মাঝে মাঝে কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা কালো রংয়ের গাড়ি আমাদের গাড়ির পিছু আসছে—
হেসে ওঠে নরেন মল্লিক, যাঃ! কে আবার follow করবে? ও তোর দেখবার ভুল নন্দুয়া
না বাবু—
যা যা–ওসব কিছু না।
উড়িয়ে দিতে চাইলেও একটা বোবা আশঙ্কা নরেনের মনকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। ক্লেদাক্ত একটা অক্টোপাশের অষ্টবাহু যেন নরেনের সর্বাঙ্গ বেষ্টন করতে চাইছে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে একটা অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্নের মতই ওকে যেন। তাড়া করে ফেরে সর্বদা। অবাধ হাসি ও আনন্দের মধ্যে ঐ দুঃস্বপ্ন যেন নরেন মল্লিককে চঞ্চল, আনমনা করে তোলে। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তার কালো রেখা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বন্ধু সমীরের দৃষ্টিকেও এড়াতে পারে না নরেন মল্লিক। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেমন চমকে চমকে ওঠে। ভীত, শঙ্কিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়।
সমীর একদিন প্রশ্ন করে, ব্যাপার কি বল্ তো নরেন? আজকাল কিছুদিন হতে তোকে যেন কেমন চঞ্চল অন্যমনস্ক মনে হয়! হঠাৎ কেমন চম্কে চমকে উঠিস, কি ব্যাপার বল্ তো?
না না–ও কিছু নয়।
উঁহু, আমার কাছে গোপন করছিস তুই! Keeping some secret-no no my dear friend—আমার চোখে তুই ধুলো দিতে পারবি না। Be frank!
এবারেও কিন্তু নরেন মল্লিক চুপ করেই থাকে।
আমার কাছেও গোপন করবি নরেন?
আজ নয় সমীর, অন্য এক সময় বলবো-অন্য এক সময় বলবো। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নরেন মল্লিক কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
নরেন?
Its a long story সমীর! তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ আবার মৃদু চাপাকণ্ঠে বলে, রাজার ঐশ্বর্য! বহু রাজার রত্নভাণ্ডারেও নেই! বলতে বলতে আবার চুপ করে গেল। নরেন মল্লিক।
সমীর বুঝতে পারে। একটা রহস্য যা নরেন গোপন করতে চাইছে, কিন্তু কি এ রহস্য! নরেন বলে, তোকে বলবো সমীর, হ্যাঁ, একদিন তোকে সব বলবো। সাজাহানের ময়ূরসিংহাসন আলো করেছিল। এক হাত থেকে আর এক হাত-হস্তান্তর হতে হতে বাকীটুকু আর শেষ করলে না নরেন মল্লিক। সমীরের বাড়িতেই রাত্রে তারই ওখানে আহারাদির পর দুটো সোফার ওপরে মুখোমুখি বসে গল্প করছিল দুই বন্ধুতে।
আচমকা হঠাৎ একসময় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নরেন মল্লিক। ওয়ালক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি এগারটা ঘোষণা করলে।
উঃ, রাত অনেক হলো, চলি ভাই! Good Night।
.
এর দুদিন পর নরেন মল্লিকের বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হলো। আশ্চর্য, চোরের উপদ্রব হলো বটে কিন্তু কোন জিনিসই চুরি যায় নি শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। নরেন ওই ডিস্ট্রিকটের পুলিস কমিশনার মিঃ চট্টরাজকে চোরের উপদ্রবের কথা সব বললে। চট্টরাজ নরেনের বন্ধু। দিবারাত্রির জন্য নরেনের গৃহে পুলিস প্রহরী মোতায়েন হলো। এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তিও যেন মিলিয়ে গেল ছায়ার মতই।
তারপর দুমাস নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আর কোন উৎপাত নেই—নরেনও ভুলে গেল বোধ হয় সব কথা। পুলিস প্রহরী উঠিয়ে নেওয়া হলো।
ঐ সময় সমীর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় মাস তিনেকের জন্য কলকাতার বাইরে যায়। নরেনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবার সুযোগও হয় নি। যেদিন সমীর কলকাতায় ফিরে এলো তারই দিনতিনেক বাদে-নরেনের জন্মতিথি উৎসবে এলো সমীর নরেনের বাড়িতে। নরেনের আগের স্ফুর্তি যেন আবার ফিরে এসেছে, নরেন যেন অত্যন্ত খুশী!
সেই রাত্রেই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতে নিহত হলো নরেন মল্লিক।
চলন্ত গাড়ির মধ্যে রহমানের পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটী মুখের পাইপটা হাতে নিয়ে একসময় প্রশ্ন করলে, নরেন মল্লিকের তাহলে একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে বলুন-and quite interesting too! তারপর হঠাৎ আবার দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, বাড়ির সমস্ত লোকেদের জবানবন্দীই তো নেওয়া হয়েছে, না মিঃ রহমান?
হ্যাঁ। এই যে দেখুন না, জবানবন্দীর ফাইলটা এই তো আমার সঙ্গেই আছে।
দেখি? হাত বাড়িয়ে কিরীটী রহমানের হাত থেকে জবানবন্দীর ফাইলটা নিল।
.
জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছিল সেই দিন প্রাতে নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষেই বসে। পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্স এক একজন করে ঘরের মধ্যে ডেকে এনে জবানবন্দী নিচ্ছেন। টেবিলের ওপরে ফাইলটা খোলা, হাতে পেনসিল, থানা ইনচার্জ খোদাবক্স জবানবন্দী লিখে নিচ্ছেন একের পর একের।
সামনে দাঁড়িয়ে নরেন মল্লিকের পুরাতন ভৃত্য মধু ঘোষ। মধুর জবানবন্দীই প্রথমে নেওয়া হয়, কারণ সে-ই ঘরের মধ্যে ঢুকে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে মৃতদেহটা দেখতে পায়।
মধু ঘোষ : বেঁটেখাটো লোকটি, দড়ির মত পাকানো দেহের পেশীগুলো অত্যন্ত সজাগ।
মাথার চুলে ইতিমধ্যেই পাক ধরেছে। পরিষ্কার একটা ধুতি ও হাতকাটা একটা পিরান গায়ে। চোখ দুটো ছোট ছোট বর্তুলাকার। এক জোড়া ভারী গোঁফ। সামনের দুটো দাঁত বেশ উঁচু—নিচে ঠোঁটের ওপরে চেপে বসেছে।
তোমার নাম মধু ঘোষ?
আজ্ঞে।
কোথায় বাড়ি?
কাটোয়াতে।
জাত?
গোয়ালা, বাবু!
কতদিন এ বাড়িতে আছো?
আজ্ঞে বাবুর কাছে আজ প্রায় আট বছর আমি কাজ করছি।
আট বছর! তাহলে তো খুব পুরাতন লোক হে তুমি!
আজ্ঞে—
তাহলে বাবুর সঙ্গে তুমি বর্মাতেও ছিলে?
হাঁ। আট বছর আগে বাবু একবার এক মাসের জন্যে কলকাতায় আসেন। বাবুর যে উকীল বন্ধু সমীরবাবু তারই বাড়িতে আমার কাকা কাজ করতো। আমি তখন কাজের খোঁজে নতুন শহরে এসেছি, কাকার কাছেই আছি; বাবুর একজন দেশী লোকের প্রয়োজন হওয়ায়, উকিল বাবুই কাকাকে বলে আমাকে বাবুর কাজে বহাল করে দেন। আমার বয়স তখন বছর পঁচিশেক, সেই হতে এ পর্যন্ত বাবুর কাছেই আছি!
বেশ। আচ্ছা মধু, গতকাল রাত্রে বাবুর সঙ্গে শেষ তোমার কখন দেখা হয়েছিল?
আজ্ঞে রাত সাড়ে দশটায়। দশটা নাগাদ রাতে বাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেন আমায় ডেকে, ক্ষিধে নেই, কিছুই খাবেন না রাত্রে, কেবল এক কাপ দুধ খাবেন। আমি বিনতা দিদিকে তাই আর তুললাম না ডেকে। দুপুর থেকেই তিনি জ্বর হয়েছিল বলে শুয়ে ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, বাবুর খাবার সময় হলে তাকে ডাকতে কিন্তু বাবু রাত্রে খাবেন না জেনে আর তাকে তুলি নি। অনেক দিন থেকেই রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে বাবুর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়ার অভ্যাস ছিল। দুধ খাইয়ে রাত সাড়ে দশটায় ঘরে জলের গ্লাসটা রেখে যাই।
জলের গ্লাসটা রেখে যাবার সময় বাবু কি করছিলেন তোমার মনে আছে মধু?
হ্যাঁ, ঐ ডেক-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা বই পড়ছিলেন। আমায় বললেন, যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আমি নিচে চলে এলাম।
তারপর?
তারপর বিকালের দিকে কাল বাবুর জন্মতিথি উৎসবের জন্য বিশেষ খাটাখাটনি হওয়ায় সোজা নিজের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। রোজ খুব ভোরে আবার বাবু এক গ্লাস গরম জল নুন দিয়ে খেতেন। গ্লাসে করে গরম নুনজল নিয়ে আজ সকালে ঘরে এসে ঢুকলাম, তখনও কিছুই জানি না–
একটা কথা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা কি বরাবর খোলাই থাকত?
আজ্ঞে হাঁ। খুব ভোরে গরম নুনজল গ্লাসে করে এনে আমিই তার ঘুম ভাঙ্গাতাম। এটা বাবুর ২১/২২ বছরের অভ্যাস। চাকরিতে ঢোকার পর আমিই ঐ কাজটা করতাম।
হাঁ–বল তারপর?
ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম বাবু ঐভাবে মেঝের ওপরে–বলতে বলতে মধু থেমে গেল। সকলের দৃষ্টি মধুর কথা অনুসরণ করে যুগপৎ গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের ওপরে যেখানে নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন, ছোরাবিদ্ধ দেহটা পড়ে ছিল, সেই দিকে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।
দামী কার্পেটের ওপরে ঠিক ডেক-চেয়ারটার সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে নরেন মল্লিকের প্রাণহীন দেহটা তখনও।
বামদিককার বক্ষে প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত বাঁটওয়ালা একটা ছোরা। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। অসহায় একটা ভীতি যেন চোখের মণি দুটোয় তখনও স্পষ্ট হয়ে আছে।
ঐভাবে বাবু পড়ে আছেন–রুদ্ধ কান্নাঝরা সুরে কথা কটি যেন কোনমতে শেষ করার জন্যই উচ্চারণ করে মধু। প্রভুর আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে মধু যে মনে বিশেষ আঘাত পেয়েছে বুঝতে কারও কষ্ট হয় না।
এতক্ষণে যেন সত্যসত্যই শোকের একটা বিষণ্ণতা নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে কক্ষের মধ্যে নেমে এলো। থানা-ইনচার্জ খোদাবক্সও ক্ষণেকের জন্য তাঁর লেখা থামিয়ে মৃতের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
প্রসারিত দেহটা। ডান ও বাম হাতের মুষ্টি দুটো বদ্ধ। মাথাটা এক পাশে ঈষৎ হেলে পড়েছে।
মধুর দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
খোদাবক্স আবার তার পেনসিলটা তুলে নিয়ে সম্মুখে টেবিলের ওপরে রক্ষিত খাতার উপরে খস্ খস্ করে লিখে চলেন –
মধু ভয়ে চিৎকার করতে করতে হাউমাউ করে নিচে এসে যদু ও হরিকে সব বলে। সুবিমল তখনও নাকি নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিল, গিয়ে ডাকাডাকি করে তাকে তোলে। সুবিমলের চোখ থেকে তখনও ঘুমের ঘোর ভাল করে কাটে নি, হতভম্বের মত চেয়ে থাকে ওদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সুবিমলই ফোন করে পার্ক সার্কাস থানায় সংবাদ পাঠায়।
রবিবার সন্ধ্যায় নরেন মল্লিকের বাড়িতে তার জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল অনেকেই তাতে নাকি যোগ দিয়েছিল। উৎসব শুরু হয় বিকাল পাঁচটায় এবং শেষ হয় রাত্রি আটটায়। রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় নরেন মল্লিক গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যান। এবং ফিরে আসেন রাত্রি প্রায় দশটায়। ক্ষিদে না থাকায় রাত্রে বিশেষ কিছু খাওয়াদাওয়া করেন নি, কেবল এক গ্লাস গরম দুধ পান করেছিলেন মাত্র।
পরের দিন প্রাতে তাকে বুকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় মৃত দেখতে পাওয়া গেল শয়নকক্ষের মেঝের উপরে লম্বমান। এবং আশ্চর্য, ছোরাটা নাকি নরেন মল্লিকের নিজেরই ছোরা!
তাঁরই শয়নকক্ষে বুক-শেলয়ের উপরে একটা সুদৃশ্য জয়পুরী পিতলের প্লেটে ছোরাটা থাকত এবং অনেকেই সে কথা জানত। ছোরাটা তাকে উপহার দিয়েছিল তারই এক বন্ধু, মহীশূরে বেড়াতে গিয়ে কিনে এনে তারই কোন এক জন্মতিথি উৎসব উপলক্ষে।
মধু ঘোষ, গোয়ালার ছেলে, বাড়ি কাটোয়ায়। বছর আষ্টেক হবে নরেন মল্লিকের সঙ্গে আছে। নরেনের বেশীর ভাগ কাজ ও-ই করত। নরেনের জামা কাপড় ইত্যাদির ভারও মধুর উপরেই ছিল। নরেন ওকে অত্যন্ত ভালবাসতেন : লিখে চলেন খোদাবক্স।
মধু তার জবানবন্দীতে আরো বলে :
ইদানীং একটি মেয়ে বাবুর সঙ্গে একটু যেন বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বয়স তার বছর ২৪/২৫ হবে। দেখতে খুব সুন্দরী না, তার বাড়ির ঠিকানা আমি জানি না, ড্রাইভার নন্দুয়া হয়ত জানে। দেখলে হ্যাঁ, তাকে দেখলে নিশ্চয়ই আমি চিনতে পারবো, অনেক দিন তো তাকে। দেখেছি। আজ্ঞে মেয়েটি খুব ভাল বলেই তো মনে হয়। বাবুর ভাগ্নে ঐ সুবিমলবাবুকে বাবু খুব ভালবাসতেন। সুবিমলবাবুও তার মামাবাবুকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। না, মামা-ভাগ্নের মধ্যে কোন মন-কষাকষি বা রাগারাগিই ছিল না। কাল সুবিমলবাবু অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন, নিচের দালানের দরজা রাত্রে আমিই তাকে খুলে দিয়েছিলাম। না, বাবুর শত্রু থাকলেও সে খবর আমি রাখি না বাবু। অমন লোকের কোন শত্রু থাকতে পারে বিশ্বাস করি না। না, কাউকেই আমার সন্দেহ হয় না। না, কোন শব্দ বা চিৎকার আমি শুনি নি গতরাত্রে।
যদুনাথ পোল : আজ্ঞে–জাতিতে আমি সদ্গোপ। বাড়ি পাবনা জেলায়। মাস ছয়েক হলো বাবুর এখানে কাজে বহাল হয়েছি। সেদিন উৎসব শেষে সকলে চলে গেলে কিছুক্ষণ পরেই জামা কাপড় বদলিয়ে বাবু গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলেন। রাত্রি দশটায় আবার ফিরে আসেন। আজ্ঞে না, কোন শব্দই ঐ রাত্রে আমি শুনতে পাই নি। খাটাখাটনিতে বড্ড পরিশ্রান্ত ছিলাম, শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। পরের দিন মধুদার ডাকেই ঘুম ভেঙ্গে সব শুনতে পাই।
হরি সাধুঃ আমি বাবু জাতিতে তিলি, বাড়ি বগুড়া জেলায়। মাস তিনেক হলো বাবুর এখানে কাজ করছি। বাবু বেশ ঠাণ্ডামেজাজী লোক ছিলেন, কখনো কাউকেই গালমন্দ করতেন না। সন্ধ্যার ঝামেলা মিটে গেলে বাবুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে, আমার এক খুড়ো থাকে পার্ক সার্কাস বাজারের ওপরে, তার পানবিড়ির দোকান, তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি রাত যখন সাড়ে বারোটা হবে, দারোয়ানের ঘরের ঘড়িতেই সময় দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে বাবুর শোবার ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল। আজ্ঞে না, কোন চিৎকার বা শব্দ কিছুই শুনতে পাই নি। সকালে মধুদার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে, তার মুখেই প্রথমে শুনলাম বাবু খুন হয়েছেন।
রামখেল সিং : বাড়ি ছাপড়া জিলায়, এ বাড়িতে শুরু থেকেই আমি দারোয়ানের কাজ করছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, রাত্রি সাড়ে দশটার পরই সাধারণত গেট বন্ধ করে দিই। রাত যখন সাড়ে এগারোটা, নন্দুয়া এসে বিড়ি চাওয়ায় তাকে বিড়ি দিই, ঐ সময়ই বাবুর ঘরের আলো নিবে যেতে দেখি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঘরে আমার একটা ঘড়ি আছে, বাবুই কিনে দিয়েছিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রাত সাড়ে বারোটায় হরি ফিরে এলে আবার তাকে গেট খুলে দিই, আবার রাত সোয়া একটায় সুবিমলবাবুও ফিরে এলে গেট খুলে দিয়েছিলাম। না, শেষের দুবারের একবারও তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করি নি, তবে যতদূর মনে পড়ে জ্বলছিল না।
রামভজন সিং ও সন্ধ্যার পরই ছুটি নিয়ে টালায় তার এক দেশওয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়, ফিরেছে আজ সকাল বেলা সাড়ে নটায়। এখানে মাস পাঁচেক মাত্র চাকরি করছে।
ঠাকুর জগন্নাথ : বাড়ি উড়িষ্যায়। রান্নাঘরের পাশেই ছোট একটা ঘরে আমি শুই। উৎসবের ঝামেলা মিটে গেলে এবং বাবু রাত্রে কিছু আর খাবেন না শুনে শুয়ে পড়ি, বড্ড মাথা ধরেছিল বলে, কিছু জানি না, কোন চিৎকার বা শব্দও শুনি নি। পরদিন মধুদার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে এবং তার মুখেই প্রথমে শুনি বাবু খুন হয়েছেন।
নন্দুয়া : বাড়ি মজঃফরপুর। মাস আষ্টেক হবে বাবুর গাড়ির ড্রাইভারি করছি আমি। বাবু বেশীর ভাগই দেশপ্রিয় পার্কে বা লেকেই সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে যেতেন। ইদানীং মাস কয়েক আমীর আলী য়্যাভিনুতে ছোট একটা পার্কেও মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে গিয়ে তিনি বসতেন। সেখানে একটি খুব সুন্দরী মেয়ে, বয়স ২৫/২৬ হবে, বাবুর সঙ্গে বসে গল্প করতো দেখেছি, মাঝে মাঝে সেই দিদিমণিকে নিয়ে বাবু লেকে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে হগ মার্কেটে এবং মাঝে মাঝে রাত্রের শোতে সিনেমাতেও যেতেন। গতকাল রাত্রে দেশপ্রিয় পার্কে যান—ফিরে আসবার সময় সেই দিদিমণিকে পার্কের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। বাবুকে তারপর সোজা একাই গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসি। না, দেখিনি দিদিমণি কোন্ দিকে গেলেন। হ্যাঁ, দিদিমণির বাড়ি চিনি। দু-একবার তাকে চিঠিও দিয়ে এসেছি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাকে দেখলেই চিনতে পারবো। হ্যাঁ, রাত সাড়ে এগারোটায় বিড়ি ফুরিয়ে যেতে দারোয়ানের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে এনেছিলাম। হ্যাঁ, আমিও দেখেছি ঐসময় বাবুর ঘরের আলো নিবে যায়। না, রাত্রে কোন চিৎকার বা শব্দ শুনি নি। না, কোন রকম সন্দেহজনক কিছু দেখি নি, তবে আগে, মানে মাসখানেক আগে পর্যন্তও প্রায়ই দেখতাম একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি যেন আমাদের গাড়ির পিছু পিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে গেটের সামনে এগিয়ে যেতে দেখেই গাড়িটা ছেড়ে চলে যায়। না, গাড়ির নম্বরটা কখনো দেখতে পাই নি। হ্যাঁ, বাবুকে বলেছিলাম—বাবু বলেছিলেন, ও কিছু না। কে আবার আমাদের গাড়িকে follow করবে?
সুবিমল রানা : গত রাত্রে প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছি। দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছিল, মধু ভিতরের দরজা খুলে দেয়। হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি মামাবাবুর ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল, আমার বেশ স্পষ্টই মনে আছে। গতকাল সকাল নটায় অফিসের জরুরী কাজে ডায়মণ্ডহারবার যখন যাচ্ছি, মামার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়। না, মামার হাবভাবে বা কথাবার্তায় এমন কিছুই বুঝিনি যাতে করে কোন বিপদ আসছে বলে সন্দেহ মনে জাগতে পারে। না, তাঁর বন্ধু-বান্ধবীদের সম্পর্কে আমি কিছুই তেমন জানি না। মাস আষ্টেক হবে মামার একান্ত অনুরোধেই এখানে এসে আছি। আমার সংসারে আপনার বলতে একমাত্র বিধবা মা, এখনো তিনি বেঁচে আছেন, কুড়িগ্রামে দেশের বাড়িতেই আছেন। মা ও মামাবাবু বৈমাত্রেয় ভাই বোন। না, মামার কোন উইল আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না। না, আজ পর্যন্ত উইল সম্পর্কে কোন কৌতূহলও আমার মনে দেখা দেয়নি। ভারত বন্ধু বীমা কোম্পানীতে বছর দুই হলো চাকরি করছি। ফিক্সড তিনশত টাকা মাইনেতে আমি সেখানে এজেন্সী করি। আজ্ঞে না, বিবাহ করিনি, কারণ তেমন যে বিশেষ কিছু আছে তা নয়। প্রথম। কথা, যোগাযোগ তেমন কিছু ঘটেনি, আর আমার মতে আজকালকার দিনে ঐ সামান্য আয়ে বিবাহ করাটা খুব সুবিবেচকের কাজও নয়!
হঠাৎ ইল্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, সুবিমলবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো—ইদানীং শোনা যাচ্ছে আপনার মামা নরেন মল্লিক নাকি একটি সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, ও সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন বা কোনরকম—
জানি বললে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, দু-একবার একটি সুন্দরী তরুণীকে মামাবাবুর সঙ্গে দেখেছি। একবার নটার শোতে রক্সি সিনেমায় আর বার দুই হ মার্কেটে–
তার নাম শুনেছেন কখনো?
না।
আচ্ছা আপনার মামা বিবাহ করবেন বা করবার কোন মনস্থ করেছেন এ সম্পর্কে কোন কিছু আপনি আপনার মামার মুখে শুনেছেন বা—
না, তেমন কোন আভাসই পাইনি। তাছাড়া মামার এখানে আমি একান্ত অনুরোধেই এসে থাকি বটে, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনো হতো। আমি সর্বদাই আমার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
হুঁ। আচ্ছা যে সুন্দরী মেয়েটির কথা বললেন, তাকে কখনো রাত্রে এ বাড়িতে দেখেছেন?
না। কথাটা যেন একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করে সুবিমল।
মেয়েটিকে দেখলে চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই!
আশা তো করি।
বিনতা দেবী : নরেন মল্লিক নতুন বাড়িতে আসবার মাসখানেক বাদেই বিনতা দেবী এখানে এসে চাকরিতে ঢোকেন। একজন স্ত্রীলোক না হলে সংসারের কাজ ভালভাবে চলে না বলে ভদ্রঘরের একজন দুঃস্থ মহিলার জন্য নরেন মল্লিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বিনতা দরখাস্ত করায় বিনতাকে নরেন মল্লিক কাজে বহাল করেন। বিনতা বিধবা, বর্ষীয়সী, ভদ্রঘরের। বিনতা এসে কাজে ঢোকবার পর ধীরে ধীরে একটু একটু করে সংসারের আভ্যন্তরিক ব্যবস্থাটা তারই হাতের মধ্যে চলে যায়। অত্যন্ত শান্ত ও মৃদুভাষী। কথা একটা প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে তাকে বলতেই কখনো দেখা যায়নি। সংসারের আভ্যন্তরীণ খরচাদির টাকাকড়িও মাসের প্রথমেই মধুর হাত দিয়ে বরাবর নরেন মল্লিক বিনতার হাতেই পাঠিয়ে দিতেন। নিচের তলায় একটা ঘরে একাকিনী থাকতেন বিনতা, মাথার উপরে সর্বদা দীর্ঘ গুণ্ঠন থাকতো টানা। এ বাড়িতেও কেউ কখনো তার মুখ দেখেছে বলে মনে পড়ে না। নরেন মল্লিকের সকল ব্যাপারে সর্বদা বিনতার দুটি চক্ষু সজাগ থাকলেও গত ৮৯ মাসের মধ্যে কখনো তাকে কেউ নরেন মল্লিকের ঘরে বা তার সঙ্গে কথা বলতে সামনাসামনি দেখেনি। উভয়ের যাবতীয় কথাবার্তা মধুর মারফতই হতো। সেই বিনতাকে যখন ডাকা হলো, তিনি বললেন, ঘটনার দিন দ্বিপ্রহর থেকেই মাথায় যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে বিকাল থেকে তার নিজের ঘরের মধ্যেই ছিলেন। রাত্রে নরেন মল্লিক গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র দুই মিনিটের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মধুকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন নরেন মল্লিক রাত্রে কি আহার করবেন সেটা জানার জন্য। এবং মধুর মুখে রাত্রে তিনি আহার করবেন না জেনে আবার ঘরে গিয়ে ঢোকেন। পরের দিন সকালে ভৃত্যদের গোলমালে ঘুম ভেঙ্গে বাইরে এসে মধুর মুখেই সব ব্যাপারটা শোনেন। নরেন মল্লিক সম্পর্কে কোন কথাই বলতে পারলেন না তিনি। যে সুন্দরী তরুণীটি ইদানীং কিছুদিন ধরে নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং মধ্যে মধ্যে এ বাড়িতে আসততা তার গলাই এক-আধবার বিনতা শুনেছেন কিন্তু কখনো তাকে চাক্ষুষ দেখেননি বা তাকে দেখলেও চিনতে পারবেন না।
সেই সুন্দরী মেয়েটি!
প্রায় প্রত্যেকেরই জবানবন্দী থেকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে যে সুন্দরী তরুণীর ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে শোনা গেল, সেই মেয়েটিরই খোঁজে পরের দিন পার্ক সার্কাস থানার ইনচার্জ খোদাবক্স। নরেনের ড্রাইভার নন্দুয়াকে সঙ্গে করে আমীর আলী য়্যাভিনুর ত্রিতল একটি ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন। দরজা ভিতর হতে বন্ধ। দরজার গায়ে কলিং বেলের ব্যবস্থা আছে দেখা গেল।
নন্দুয়া, তুমি একটু আড়ালে দাঁড়াও, মেয়েটিই যদি এসে দরজা খুলে দেয় তো আমাকে চোখ-ইশারায় কেবল তুমি জানিয়ে দেবে।
বুঝেছি। নন্দুয়া একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।
কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজা খুলে গেল।
খোলা দরজাপথে এসে দাঁড়াল একটি ২৩।২৪ বৎসরের তরুণী। তরুণীর রূপের সত্যিই যেন অবধি নেই। চাপা ফুলের মত উজ্জ্বল গায়ের বর্ণ। ক্ষীণাঙ্গী নয়, সুডৌল স্বাস্থ্যে দেহযমুনায় যেন বান ডেকেছে। অপরূপ মুখশ্রী। টানা টানা গভীর কৃষ্ণ দুটি আঁখি। ভারী আঁখিপল্লব। নাকের পাশ দিয়ে বামদিককার গালে একটি ছোট্ট কালো তিল। তিলটি সৌন্দর্যকে যেন তিলাঞ্জলি দিচ্ছে। দাঁড়াবার ভঙ্গীটিও অপূর্ব, পুরাকালে রাজসভায় করঙ্ক বাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। অপর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশরাশি পৃষ্ঠব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কবির ভাষায় বলতে সাধ যায়, বিকীর্ণ কুন্তলা।
চকিতে অদূরে দণ্ডায়মান নন্দুয়ার দিকে তাকাতেই, নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সে জানাল, হাঁ ঐ মেয়েটিই।
ইশারা করলেন খোদাবক্স নন্দুয়াকে সরে যেতে। নন্দুয়া সরে গেল।
কাকে চান? তরুণীই কথা বললে প্রথমে খোদাবক্সকে সম্বোধন করে।
নমস্কার।
নমস্কার।-তরুণীও প্রতিনমস্কার দেয়।
আমি পার্ক সার্কাস থানার O.C., বিশেষ একটি জরুরী ব্যাপারে আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে বিশেষ দুঃখিত। ঘরে আসতে পারি কি?
তরুণী ভ্রূকুঞ্চিত করে মৃদু কণ্ঠে বলে, আসুন।
তরুণী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়, খোদাবক্স কক্ষে প্রবেশ করেন।
শৌখীন পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো-গোছানো ছোট একখানি ঘর। আসবাবপত্র ও ব্যবস্থা দেখে মনে হয় ড্রয়িংরুম হিসাবেই ঘরটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে সাধারণত। গোটা দুই সোফা। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিস্তৃত, মাঝখানে একটি গোল পিতলের স্ট্যাণ্ডে একটি জয়পুরী কারুকার্যখচিত পাত্রে একগোছা প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। ঘরের দেওয়ালে দু-তিনটি ফটোগ্রাফ, দুটি ল্যাণ্ডস্কেপ, কোন একটি বিলাতী কোম্পানীর সুদৃশ্য একখানা দেয়ালপঞ্জী।
ঘরের তিনটি জানলার প্রত্যেকটিতেই সুদৃশ্য জারাণী রঙের পর্দা খাটানো। দ্বিতীয় দরজাটিতে একটা ভারী সবুজবর্ণের পর্দা ঝুলছে। সেই দরজারই ঠিক বিপরীত দেওয়ালে একটি প্রমাণ সাইজের দর্পণ প্রলম্বিত।
সোফাটা দেখিয়ে তরুণী বললে, বসুন।
হঠাৎ এমন সময় কানে ভেসে এলো অন্তরাল হতে অতি শুদ্ধ, সুস্পষ্ট সু-উচ্চারিত ইংরাজীতে আবৃত্তির সুর—
The mind is its own place, and in itself
Can make a Heaven of Hell, a Hell of Heaven.
অন্তরাল হতে যেন সুললিত আবৃত্তির সেই সুর সহসা খোদাবক্সকে আকর্ষণ করে।
বাঃ চমৎকার!
আবার শোনা গেল : এবারে ইংরাজী নয়, বাংলায় আবৃত্তি, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পংক্তি–
তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে
শান্তি সমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে।
আবৃত্তি করছেন মনে হচ্ছে এই ফ্ল্যাটেরই যেন কেউ?
হ্যাঁ, আমার বাবা।
আপনার বাবার নামটা জানতে পারি কি?
শ্ৰীসঞ্জীব চৌধুরী। একটা পা ওঁর paralytic হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের হতে পারেন না, তাই সর্বদা লেখাপড়া ও আবৃত্তি নিয়েই থাকেন।
একেবারেই হাঁটা-চলা করতে পারেন না বুঝি?
সেই রকমই প্রায়, অতি কষ্টে ক্রাচে ভর দিয়ে সামান্য একটু-আধটু হাঁটা-চলা যা করেন। তরুণী বলে।
দেখেছেন মিস চৌধুরী, আমরা পুলিসের লোকেরা এত unsocial, এতক্ষণ আপনার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিনি!
আমার নাম কৃষ্ণা চৌধুরী।
সহসা এমন সময় খোদাবক্সের নজরে পড়ল, অদূরে সোফার উপরে ঐদিনকারই প্রাত্যহিক সুপ্রভাতখানা। এবং মাঝের পৃষ্ঠা—যেটিতে মৃত নরেন মল্লিকের ছবি দিয়ে তার হত্যাসংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই খোলা। সংবাদপত্রটার প্রতি কৃষ্ণার দৃষ্টি আকর্ষণ করে খোদাবক্স বলে ওঠেন, পড়েছেন নরেন মল্লিকের হত্যার সংবাদ?
ঈষৎ বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে কৃষ্ণা যেন জবাব দেয়, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি শব্দে, হুঁ।
ওঁকে তো আপনি চিনতেন কৃষ্ণা দেবী, তাই না?
ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় কৃষ্ণা খোদাবক্সের মুখের দিকে, কে বলেছে একথা?
বুঝতেই পারছেন জানতে পেরেছি, নইলে—মৃদু হাসি ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে খোদবক্সের অতঃপর।
কৃষ্ণা চুপ করে থাকে, মনে হয় সে যেন একটু অন্যমনস্ক।
শুধু যে চিনতেনই আপনি নরেন মল্লিককে তা নয়, বিশেষ ভাবে জানা গিয়েছে আপনি ওঁর সঙ্গে নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিলেন—অবিশ্যি—খোদাবক্স কথাটা শেষ না করে কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকালেন।
অস্বীকার করবো না যে তার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল, তবে আপনি যেরকম ঘনিষ্ঠতার কথা বলছেন—
দেখুন মিস চৌধুরী, পুলিসের লোক আমরা, ভাল ভাবে কোন সংবাদ না নিয়ে
দারোগা সাহেব, ভদ্রতার সীমাটা কি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন না? এখন মনে হচ্ছে, বোধ হয় ঐ কারণেই এখানে আপনার পদার্পণ হয়েছে। সত্যিই যদি তাই হয়ে থাকে, I must say you would be rather disapointed.
খোদবক্সের বুঝতে কষ্ট হয় না, শক্ত মাটিতে পা ফেলেছেন। তাই এবার নিজেকে বেশ প্রস্তুত করেই খোদাবক্স তার বক্তব্য শুরু করেন, কথাটা মানে আপনি যে বিশেষ ভাবেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, মিথ্যে বলেই কি একেবারে উড়িয়ে দিতে চান মিস্ চৌধুরী?
নিশ্চয়। কারণ যেটা সত্যিই মিথ্যা তাকে আইনের দোহাই পেড়ে বা গলাবাজীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে করা যায় না কোন দিনই, আপনার মত একজন আইনজ্ঞকে সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না আশা করি দারোগা সাহেব। তাছাড়া আপনার এ ধরনের প্রশ্ন—not only objectionable, damaging too.
শেষের দিকে কৃষ্ণার কণ্ঠস্বরে সুস্পষ্ট উম্মার ভাব একটা যেন জেগে ওঠে।
কৃষ্ণা যে রীতিমত চঞ্চল ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে বুঝতে কষ্ট হয় না।
মুহূর্তে সমগ্র পরিস্থিতিটাই বুঝে নেন খোদাবক্স এবং এবারে কতকটা যেন কর্তৃত্বভরা কণ্ঠেই বলে ওঠেন, দেখুন মিস্ চৌধুরী, আমি পুলিসের লোক–
খোদবক্সের কথাটা শেষ হলো না।
দিদি! হঠাৎ ঠিক অনুরূপ একটি মেয়েলী কণ্ঠস্বরে খোদাবক্স চমকে মুখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে দেওয়ালে প্রলম্বিত দর্পণে দেখতে পেলেন, প্রতিবিম্বিত হয়েছে বর্তমানে তার সম্মুখে উপবিষ্ট অনুরূপ একটি তরুণীরই যেন প্রতিচ্ছায়া।
খোদাবক্স যেন সহসা নিশুপ হয়ে গিয়েছেন। আর্শির বক্ষে দৃষ্টি তখনও তার স্থিরনিবন্ধ।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! হুবহু এক! তিলমাত্র প্রভেদ বা পার্থক্যও যেন জীবিত ও আর্শিতে প্রতিফলিত ছায়াতরুণীর মধ্যে কোথাও নেই! অবিকল প্রতিচ্ছবি যেন একে অন্যের!
চক্ষু, নাসিকা, ভূ, কপাল, চিবুক, ওষ্ঠ—এমন কি বাম গালের উপরে ছোট্ট কালো তিলটি পর্যন্ত। দাঁড়াবার বিশেষ ভঙ্গীটি যেন হুবহু এক দুজনারই। এবং সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর কণ্ঠস্বরের মিলটুকুও উভয় তরুণীর একই যেন। কথা বলার ও উচ্চারণ ভঙ্গীটি পর্যন্ত এক।
কে উনি? বিস্মিত হতভম্ব খোদাবক্স এতক্ষণে সম্মুখে সোফার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণাকে প্রশ্নটা করেন।
দর্পণে প্রতিবিম্বিতা নারী ধীরপদে ততক্ষণ কক্ষে প্রবেশ করে একই সোফার উপরে কৃষ্ণার পার্শ্বে এসে উপবেশন করল।
আমার বোন কাবেরী। কৃষ্ণা জবাব দেয়।
আপনার বোন! আপনারা—
আমরা যমজ বোন, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ছোট বড়।
কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ বোন!
পাশাপাশি দুটি বোন কৃষ্ণা কাবেরী সোফার উপরে বসে। পরিধানে শাড়ির রঙ, পাড় এবং পরবার স্টাইলটির মধ্যেও যেন বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। দুজনেরই মাথার চুল ভোলা। সাধ্য নেই কারো একটি ভগ্নীকে অন্যের থেকে পৃথক করে বুঝবার।
ক্রমে বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে গেলে ধীর সংযত কণ্ঠে খোদাবক্স এবারে কাবেরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম কাবেরী চৌধুরী?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি–
আমি পার্ক সার্কাস থানা থেকে আসছি। আমার নাম খোদাবক্স। আচ্ছা কাবেরী দেবী, আজকের সংবাদপত্রে—বলতে বলতে সংবাদপত্রটি তুলে নরেন মল্লিকের মৃত্যুসংবাদটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করে বললেন, এঁকে আপনি চিনতেন?
কথাটা কাবেরীকে জিজ্ঞাসা করা হলেও জবাবটা দিল কৃষ্ণা অনুচ্চ বিরক্তির সুরে, ওর বেলাতেও ঐ কথাই প্রযোজ্য মিঃ খোদাবক্স। বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ওরও তাঁর সঙ্গে ছিল না। আমারই মত সামান্য পরিচয় ছিল মাত্র।
দেখুন কৃষ্ণা দেবী, এবারে সুস্পষ্ট একটা আদেশের কাঠিন্য যেন প্রকাশ পায় খোদাবক্সের কণ্ঠস্বরে, কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, হয়েছে আপনার বোন কাবেরী দেবীকে। উনি শিশু নন—ওঁর যা বলবার ওঁর মুখে শুনতে পেলেই আমি খুশী হবো।
কাবেরী কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, এবার খোদবক্সের মুখের দিকে তাকাল।
বলুন কাবেরী দেবী, আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
সামান্য পরিচয় ছিল মিঃ মল্লিকের সঙ্গে। দু-একবার পার্টিতে, উৎসবে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে মাত্র এই হ্যাঁ। জবাব দিল কাবেরী।
আপনি নরেন মল্লিকের ওখানে মাঝে মাঝে যেতেন?
না। কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে কাবেরী এবারে জবাব দিল।
ব্যাপারটা খোদবক্সের দৃষ্টিতে কিন্তু এড়ায় না।
আপনি, কৃষ্ণা দেবী?
কস্মিনকালেও যাইনি।
হুঁ। সত্যিই খোদাবক্স এবার নিজেকে যেন যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন।
বুঝতে তার কষ্ট হয় না, যমজ দুটি বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে নিশ্চয়ই একজন মিথ্যা বলছে এবং দ্বিতীয়জন ইচ্ছা করেই অন্যজনের কথায় সায় দিচ্ছে। এবং এও ঠিক, অবিকল একই রকম দুজনে দেখতে, এদের মধ্যে কে যে মিথ্যা বলছে, নিজে হতে স্বেচ্ছায় এরা স্বীকৃতি না দিলে সেই আসল সত্যটুকু জানা কারো পক্ষে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও। কিন্তু উপায়ই বা কি? যারা এদের মধ্যে একজনকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে দেখেছে তারাও হয়ত এখন দুজনকে পাশাপাশি দেখলে আসলটিকে নির্দিষ্ট করতে পারবে না।
আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, গত রবিবার রাত্রে অর্থাৎ পরশু রাত্রে আপনি সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে শয্যায় শয়ন করতে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন বা কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, I mean all your movements and whereabouts in details, একটা বিবৃতি চাই।
এটা কি আপনার জুলুম নয় দারোগা সাহেব?
দেখুন কৃষ্ণা দেবী, আমি যদি তার উত্তরে বলি, নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপনারা যমজ ভগ্নী দুজন যথেষ্ট সন্দেহের কারণ ঘটিয়েছেন, মানে—কথাটা খোদবক্সের শেষ হলো না, যুগপৎকৃষ্ণা ও কাবেরী অস্ফুটকণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে।
অতএব বুঝতেই পারছেন-I want a detail report of the movements of both of you. আপনাদের দুই ভগ্নীরই একটা পূর্ণ জবানবন্দী আমার চাই। এটা আমি দাবী জানাচ্ছি আইনের দিক হতে
এরপর উভয়েই কিছুক্ষণ ঝিম্ দিয়ে থাকে, তারপর কৃষ্ণাই প্রথমে কথা বলে, সেদিন আমাদের দু বোনেরই off duty ছিল।
Off duty ছিল—আপনাদের? মানে, আপনারা কি—
আমরা দু বোনেই টেলিফোন অফিসে চাকরি করি।
ওঃ! আচ্ছা বলুন।
কৃষ্ণা তখন বলতে শুরু করে, গত রবিবার-শরীর আমার বিশেষ রকম ক্লান্ত থাকায় সারাটা দিন ঘরেই বই পড়ে ও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তারপর রাত্রি দশটায় খেয়েদেয়ে একেবারে শুয়ে পড়ি।
আপনি কাবেরী দেবী?
সারাটা দিন আমিও বাড়িতেই ছিলাম। রাত্রি সাড়ে সাতটায় একটু গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাই।
কতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন?
রাত্রি দশটা পর্যন্ত।
কি করে বুঝলেন ঠিক সময়টা?
হাতে ঘড়ি ছিল, ফিরবার মুখে দেখেছি রাত তখন দশটা ঠিক।
বাড়িতে ফিরে আসেন কখন?
এই সাড়ে দশটা নাগাদ হবে।
এসে দেখলেন আপনার দিদি তখন ঘুমিয়ে বোধ হয়?
হ্যাঁ।
আচ্ছা গঙ্গার ধারে যতক্ষণ ছিলেন, কারো সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
হয়েছিল—দুজনের সঙ্গে।
তাদের নাম পরিচয়টা জানতে পারি কি?
একজনের পরিচয় দিতে পারবো না—অবশ্য আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন, তিনি আপনার নরেন মল্লিক নন—
হুঁ। আর দ্বিতীয় জন?
আমার এক পরিচিত অ্যাডভোকেট বন্ধু–রবীন সেন, তিনিও ঐ সময় গাড়িতে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছিলেন।
আপনাদের কোন previous engagement ছিল ঐ সময় meet করবার?
না। বলতে পারেন নেহাৎ আকস্মিক ভাবেই তার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছিল আমার।
তার ঠিকানাটা?
৩।১ রিজেন্ট পার্ক–টালিগঞ্জ।
মিঃ সেন ওখানে কখন পৌঁছেছিলেন?
রাত্রি সাড়ে আটটা বোধ হয়।
একসঙ্গেই বোধ হয় আপনারা ফিরে আসেন?
হ্যাঁ। তিনিই তার গাড়িতে করে আমাকে পার্ক সার্কাস মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান।
এরপর খোদাবক্স বিনীত ভাবে উভয়কেই সম্বোধন করে বলেন, আবার হয়ত দেখা হতে পারে। আচ্ছা আজ আসি, নমস্কার।
কৃষ্ণা কিন্তু চুপ করেই থাকে। চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্নটা তখনও কৃষ্ণার নিঃশেষে মুছে যায়নি যেন।
.
গাড়ি চলেছে নরেন মল্লিকের গৃহের দিকে। ফাইলটা রহমানের হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে কিরীটী বলে, দুটি যমজ বোন সম্পর্কে আপনার মতামতটা কি রহমান সাহেব?
One of them must be telling deliberate lies—
আমারও তাই মনে হয়, রহমান সাহেব।
শুধু তাই নয়—আমার স্থির ধারণা মিঃ রায়, যমজ ওই দুই বোনের মধ্যেই একজন খুনী।
হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
গাড়ি ইতিমধ্যে নরেন মল্লিকের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল।
We have reached our destination মিঃ রায়।
গাড়ি গেটের মধ্যে প্রবেশ করল। গাড়ি হতে নামতে নামতে, কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনে বলে, একটা কথা কি জানেন রহমান সাহেব, স্রেফ probabilityর উপরেই basis করে এসব ক্ষেত্রে সবসময় conclusionয়ে পৌঁছানো যায় না, আর investigationয়ের ব্যাপারে সে proceedure-ও ভুল। হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আরও ব্যাপক ও সূক্ষ্ম তদন্তের প্রয়োজন।
নরেন মল্লিক যে ঘরে নিহত হয়েছিল সে ঘরে তেমনি তালা দেওয়াই ছিল। রহমান সাহেব পকেট হতে চাবি বের করে তালাটা খুলে ফেললেন, দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল।
ঘরটা অন্ধকার দিনের বেলাতেও। কারণ জানালা-দরজাগুলো সব বন্ধই ছিল। রহমান একে একে ঘরের জানালা-দরজাগুলো খুলে দিলেন। সকালের আলোয় ঘরটা ঝলমল করে ওঠে। ঘরের মেঝেতে সুদৃশ্য গালিচা বিস্তৃত, একটি সুদৃশ্য পালঙ্কে ধবধবে শয্যা বিছানো।
একটি আলমারি, গোটা দুই কাউছ, একটি রকিং আর্ম-চেয়ার। দেওয়ালে সুদৃশ্য সব পেনটিং। হঠাৎ কিরীটীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি প্রমাণ আয়নার উপরে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।
আয়নার কঁচটা ভাঙ্গা, মনে হয় কোন ভারী বস্তুর আঘাতে ভেঙ্গে গিয়েছে চৌচির হয়ে যেন।
আশ্চর্য! অস্ফুট কণ্ঠে কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
কি? রহমান কিরীটীর কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালেন।
ওই বড় আয়নাটা-ওটা কি সেদিন ভাঙ্গাই দেখেছিলেন?
লক্ষ্য করিনি, কিন্তু কেন বলুন তো?
এই ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র সব লক্ষ্য করে দেখলেই বুঝবেন, এ ঘরে যে ব্যক্তি থাকতেন, তাঁর রুচিতে ঘরের মধ্যে এমন একটি ভাঙ্গা আয়না ঝুলিয়ে রাখা উঁহু, সম্ভব নয়।
কিন্তু—
ডাকুন আপনার সেই মধু চাকরকে, সে-ই হয়ত প্রমাণ দিতে পারবে।
তক্ষুনি মধুকে ডাকা হলো এবং সবিস্ময়ে সে বললে, আয়নাটা আগে ভাঙ্গা ছিল না।
মধু চলে গেলে কিরীটী আবার ঘরের ভিতরটা ভাল করে চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।
আয়নাটা ঘরের মধ্যে এমনি ভাবে ঝুলানো, যাতে করে শয়নকক্ষ-সংলগ্ন স্নানঘর থেকে বের হলে প্রথমেই আয়নার উপরে ছায়া পড়ে। বাথরুমটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাথরুমের বাইরে দিয়ে মেথর যাতায়াতের জন্য একটি ঘোরানো লোহার সিঁড়িও আছে। তবে বাথরুমের দরজাটি তখন বন্ধই ছিল।
রহমান সাহেবও বললেন, সেদিনও মানে তদন্তের দিনও নাকি দরজাটি বন্ধই ছিল তিনি দেখেছিলেন। এবং সেদিন খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, দিনে একবার মাত্র দরজাটি নাকি খোলা হত এবং মেথরের কাজ শেষ হলেই আবার বন্ধ করে রাখা হত।
রবিবার মধুই মেথর কাজ সেরে চলে যাবার পর নিজহাতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমোদ্গীরণ করতে করতে বলে, ভাঙ্গা আয়না অথচ কেউ সে-রাত্রে কোনরকম শব্দই শোনেনি!
কি বলছেন মিঃ রায়? মজিবুর রহমান প্রশ্ন করেন।
কিরীটী মজিবুরের প্রশ্নটা আপাতত এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বলে, আচ্ছা মিঃ রহমান, এই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপাতত ছটা পয়েন্ট অত্যন্ত এলোমেলো বা জট পাকানো বলে কি মনে হচ্ছে না আপনার?
বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকান, ব্যাপারটা তিনি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বুঝে উঠতে পারছেন না যেন কিরীটী ঠিক কি বলতে চায়!
কি কি পয়েন্টস্ বলুন তো মিঃ রায়? তবু প্রশ্ন করেন।
প্রথমতঃ ধরুন, আপনার ঐ যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, circumstantial evidence থেকে মনে হয়, ওদের মধ্যে একজন বা দুজনই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বিশেষ এবং ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিল; অথচ মিঃ মল্লিকের জন্মতিথি বা জন্মদিন উৎসবে ওদের মধ্যে কেউই কেন নিমন্ত্রিতা হলো না কেন? এবং ওরা দুই বোনই যে অস্বীকার করেছে তাদের নিজ নিজ জবানবন্দীতে যে, ওদের কেউই কখনো নরেন মল্লিকের গৃহে আসেনি সেও মিথ্যা। কারণ। মল্লিক-বাড়ির অন্যান্য দু-একজনের জবানবন্দী থেকেই সেটা প্রমাণিত হয়, কিন্তু এখন কথা হচ্ছে কৃষ্ণা কাবেরী মিথ্যা কথা বললে কেন? মিথ্যা তারা বলেছে নিঃসন্দেহে এবং তারা যে বুদ্ধিমতী যথেষ্ট সে বিষয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র নেই। তারপর দ্বিতীয়তঃ, যে রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হন, সে রাত্রে এগারোটার পরে দারোয়ান দেখেছে তার ঘরের আলো নিবে গিয়েছে, অথচ সুবিমলের জবানবন্দী থেকে আমরা জানতে পারছি যে, রাত্রি এগারটার পরে মিঃ মল্লিকের ঘরে আলো জ্বলছিল। এর দ্বারা এই প্রমাণ হয়, রাত্রি এগারোটায় আলো নিবে গেলেও যে কোন কারণেই হোক, রাত্রি একটায় আবার ঘরের আলো জ্বলেছিল সুনিশ্চিত, কিন্তু কেন? তৃতীয়তঃ মিঃ মল্লিকের শয়নকক্ষের সংলগ্ন বাথরুমে মেথর যাতায়াতের দরজাটা পরের দিন সকালে ছিল ভিতর হতে বন্ধ-কেন? চতুর্থতঃ এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, ঘরের ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ সেরাত্রে এ বাড়ির কেউ কোন শব্দ পেল না, কেন? পঞ্চম, আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ মিঃ মল্লিক খুন হয়েছেন ছোরার আঘাতে—কেন? ষষ্ঠ : নরেন মল্লিক যে ছোরাটার দ্বারা নিহত হয়েছেন সে ছোরাটা তারই ঘরে ছিল এবং খুনী অন্য কোন ছোরা ব্যবহার না করে, বিশেষ করে ঐ ছোরাটাই বা ব্যবহার করতে গেল কেন?
মিঃ রহমান ভাবেন লোকটা পাগল নাকি, খুনের তদন্ত করতে এসে এসব কি অদ্ভুত আবোল-তাবোল প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন!
মধ্যে যাতায়াতের জন্য যাতায়াতের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ঘরের আলো দুবার জ্বলেছে কেন, ঘরের আয়নাটার কাচ ভাঙ্গল কেন, শব্দ কেউ শুনতে পেল না কেন?
মনে মনে রহমান সাহেব একটু বিরক্তই হন। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না।
আমার কি মনে হয় জানেন মিঃ রহমান—কিরীটী আবার বলে।
কি?
ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গার ব্যাপার ও শব্দটা যে কারো না কারো অন্ততঃ এ বাড়িতে শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি—এ দুয়ের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।
যে শব্দটা কারো না কারো অন্ততঃ শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি!
হাঁ। যে শব্দটা হারিয়ে গিয়েছে মিস্টিরিয়ালি অথচ যার অতীত অস্তিত্ব সম্পর্কে মনে আমার বিন্দুমাত্রও দ্বিধা বা সন্দেহ নেই। তারপর ধরুন আপনার ওই যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, তা যাক গে সেকথা, পরেও ভাবা চলতে পারে তাদের কথা, আপাতত আপনার মধু ও সুবিমলবাবু যদি বাড়িতে থেকে থাকেন তাদের এবং বিনতা দেবী ও দারোয়ান রামখেল সিং এই চারজনকে গোটাকতক কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল চারজনই তখন বাড়িতেই আছে।
প্রথমে ডাকা হলো দারোয়ানকে।
তোমারই নাম রামখেল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
জি।
আচ্ছা যে রাত্রে তোমার বাবু মারা যান সে রাত্রে তুমি দেখেছিলে সাড়ে এগারটায় বাবুর শোবার ঘরের আলো নিবে যায়, তাই না?
জি।
কেমন করে জানলে যে ঠিক তখন রাত সাড়ে এগারটা?
হরি ফিরে এলে আমাদের ঘরে একটা ঘড়ি আছে সেটায় ঢং ঢং করে এগারটা বাজল। তারপর আবার ঠিক ঢং করে সাড়ে এগারটার ঘণ্টা বাজতেই আমি শুতে যাবো বলে গেটের তালাটা আর একবার দেখতে যাই, ঠিক সেই সময় দেখলাম বাবুর ঘরের আলোটা নিবে গেল।
তারপর সুবিমলবাবু যখন ফিরে আসেন রাত্রে তুমি গেট খুলে দাও, কেমন তো?
হাঁ।
তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করেছিলে?
জি না। ঘুম-চোখে এসে গেট খুলেছি অতটা লক্ষ্য করিনি।
রাত্রি সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন শব্দ শুনেছিলে? যেমন ধর কোন কঁচটাচ ভাঙ্গার শব্দ?
না। ঘুমিয়েছিলাম।
সুবিমলবাবু ডাকতেই তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাই না?
জি না, আমার ঘরে কলিং বেল আছে, সেই বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল।
আচ্ছা তুমি যেতে পারো।
রামখেল অতঃপর চলে গেল।
এরপর এলো মধু।
কিরীটী এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করে।
আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা সাধারণত রাত্রে খুলেই কি বাবু ঘুমোতেন?
হ্যাঁ। রাত্রে তিনি কখনো দরজা বন্ধ করতেন না। রোজ সকালে আমিই এসে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে গরম নুন-জল দিতাম কিনা, তাই দরজা খোলাই থাকত।
আচ্ছা সে রাত্রে তুমি যখন গরম দুধ নিয়ে এলে, বাবু তখনি দুধটা খেয়েছিলেন কি?
হ্যাঁ, দুধটা খাবার পর আমি যখন খালি গ্লাসটা নিয়ে যাচ্ছি, তিনি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল ঘরে রেখে যেতে বললেন। শোবার আগে বাবু এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতেন।
তাহলে গ্লাস হাতে তুমি যখন ঘর হতে বের হয়ে যাও বাবু তখনও শোন নি, তাই না?
হ্যাঁ।
কি করছিলেন তখন তিনি মনে আছে তোমার?
ঐ আরাম-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা কি বই পড়ছিলেন যেন।
তোমার সঙ্গে আর কোন কথা হয়েছিল তোমার বাবুর সে রাত্রে?
হ্যাঁ, বলেছিলেন দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে।
আর একটা কথা মধু, সেদিন সকালে মেথর এসে বাথরুম পরিষ্কার করে যাবার পর তুমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলে?
তা মনে আছে বৈকি।
আচ্ছা তুমি যেতে পার মধু।
মধু ঘর ছেড়ে প্রায় চলে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ কিরীটী আবার তাকে ডাকে, মধু?
আজ্ঞে! ফিরে দাঁড়াল মধু যেতে যেতে।
আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর সঙ্গে তো তুমি অনেক দিন যাবৎ ছিলে, একটা কথা বলতে পারো, সাধারণত তোমার বাবুর ঘুম কেমন ছিল, রাত্রে কখনো উঠতেন কিনা?
তা ঠিক বলতে পারি না বাবু—তবে একবার-আধবার উঠতেন বোধ হয় মাঝরাত্রে।
মধু, বলতে পারো তোমার বাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন ছিল?
এবারে মধু মাথা নিচু করে।
বল, এতে লজ্জার কিছু নেই। শোন মধু, তোমার বাবুর হত্যার মীমাংসা করতে হলে তার সব কথাই যে আমাদের জানা দরকার—
আজ্ঞে—মেয়েছেলে ইদানীং, বিশেষ করে সেই সুন্দর দিদিমণি এখানে যাতায়াত করতেন। বটে, তবে কখনো কোন খারাপ কিছু বা নষ্টামি আমার চোখে পড়েনি।
আচ্ছা যাও।
এরপর এলো সুবিমল, নিহত নরেন মল্লিকের ভাগ্নে।
আপনার নাম সুবিমল রানা?
হাঁ।
বসুন, বসুন-দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আমাদের কর্তব্যটাই বড় বিশ্রী।
সুবিমল নির্দিষ্ট চেয়ারটার উপরে উপবেশন করে।
তারপর হঠাৎ ইন্সপেক্টারের দিকে চেয়ে সুবিমল বলে, ইপেক্টার, সেদিন আপনি মামার উইল সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কিছুই বলতে পারিনি তখন, কারণ সে সম্পর্কে তখনও আমি কিছুই জানতাম না। কাল সন্ধ্যার দিকে মামার সলিসিটার বোস এণ্ড চৌধুরীর মিঃ রাধেশ চৌধুরী এসেছিলেন। মামা উইল কিছুই যদিও লিখিতভাবে করে যাননি-তবে he had definite instructions–
বটে! কি instructions ছিল? রহমান প্রশ্ন করেন।
আমিই তার অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হব।
হুঁ, Good news no doubt! রহমান সানন্দে বলেন।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, মিঃ মল্লিকের সলিসিটারের কাছে তার সম্পত্তির পরিমাণ সম্পর্কে কোন কিছু শোনেননি সুবিমলবাবু? মানে কোন definite idea?
চোখ তুলে তাকাল সুবিমল কিরীটীর দিকে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, হাঁ বলেছেন। ব্যাংকে তার নগদ হাজার পঞ্চাশেক টাকা, কলকাতায় পার্ক সার্কাসের এই বাড়ি, যার valuation প্রায় সত্তর হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে, তাছাড়া কিছু কোম্পানীর কাগজ।
A good fortune! স্মিতভাবে কিরীটী বলে।
Really lucky আপনি মিঃ রানা। রহমান বলেন।
কিন্তু একা মানুষ আমি, এক বুড়ী বিধবা মা মাত্র সংসারে, কি হবে আমার এই বিরাট সম্পত্তি দিয়ে ইন্সপেক্টার! এর চাইতে তিনি—মামা যদি বেঁচে থাকতেন—বলতে বলতে সহসা সুবিমলের চোখের কোণ দুটো অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়। ট ট করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।
আর একটা কথা সুবিমলবাবু! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
বলুন?
আপনি বলেছেন, সে রাত্রে আপনি প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন, রানাঘাট কোথায় যেন গিয়েছিলেন–
হ্যাঁ, রানাঘাটেই insuranceয়ের একটা জরুরী কাজে যেতে হয়েছিল।
কোন্ ট্রেনে রানাঘাট হতে ফেরেন?
শেষ ট্রেনে, রাত সাড়ে এগারটায়।
সাড়ে এগারটায়?
হ্যাঁ, ট্রেনটা একটু লেট ছিল।
ওঃ, সাড়ে এগারটায় শিয়ালদহে পৌঁছালেন তো বাড়িতে পৌঁছাতে এত দেরি হলো যে?
ট্রাম, বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, একটা ট্যাক্সিও ছিল না। কোনমতে একটা রিক্সা করে এসেছিলাম।
.
এরপর ডাক পড়ল বিনতা দেবীর। সুবিমল ঘর থেকে চলে যাবার মিনিট দশেক বাদেই এলেন বিনতা দেবী। দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানা, সাদা থান পরিহিতা, নিরাভরণা, ধীর সংযত চলুন।
কিরীটীই কথা বলে, বসুন বিনতা দেবী।
বিনতা দেবী বসলেনও না, কোন সাড়াও দিলেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন।
।কিরীটী লক্ষ্য করছিল বিনতা দেবী শুধু যে মুখখানাই তার অবগুণ্ঠনের আড়ালে সযতনে রেখেছিলেন তাই নয়, সর্ব অবয়বই যেন পরিধেয় বস্ত্র দ্বারা অন্যের দৃষ্টির সামনে থেকে আড়াল করবার একটা সুস্পষ্ট সযত্ন প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছিল।
কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার জন্য আপনাকে ডেকেছি বিনতা দেবী। কিরীটী বলে।
এবারও কোন জবাব পাওয়া গেল না।
আপনার বাড়ি কোথায়?
বর্ধমানে। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।
আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ আছেন?
না।
কেউ নেই?
না।
আপনার স্বামী কতদিন আগে মারা গেছেন?
দশ-বারো বছরের বেশি হবে।
সুবিমলবাবু যদি আপনাকে চাকরিতে রাখেন তাহলে তো আপনি এখানেই থাকবেন?
না। আমি আর চাকরি করবো না, সুবিমলবাবুকে পরশুই বলে দিয়েছি।
চাকরি আর করবেন না?
না।
দেশে ফিরে যাবেন বুঝি?
বলতে পারি না।
আচ্ছা নরেন মল্লিকের সঙ্গে কি এখানে আপনার চাকরির এই কয় মাসে কখনো কথা বলেননি?
না।
নরেনবাবু লোক কেমন ছিলেন আপনার ধারণা?
ভালই।
কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?
বিনতা চুপ করে থাকেন শেষের প্রশ্নে।
কই, আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না?
কি জবাব দেবো?
কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?
না।
ঐ নাম দুটি কখনো শোনেননি?
না।
নরেনবাবুর সঙ্গে যে একটি সুন্দরী তরুণীর আলাপ ছিল, মধ্যে মধ্যে যিনি এ বাড়িতে আসতেন, তাকে কখনো দেখেন নি?
দেখেছি।
তার নাম শোনেন নি কখনও?
না।
তার নাম হয় কৃষ্ণা না হয় কাবেরী!
হবে।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
বিনতা যেমন নিঃশব্দে ধীরে এসেছিলেন তেমনি নিঃশব্দেই চলে গেলেন।
কিরীটী রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে চলুন ওঠা যাক রহমান সাহেব।
চলুন।
এরপর কিরীটী ও রহমান সুবিমল রানার কাছ হতে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
সুবিমল নিজের ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বসল। মনের মধ্যে অসংখ্য চিন্তা যেন জাল বুনে চলেছে একটা কালো মাকড়সার মত।
.
সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিকে নামছে ধূসর অঞ্চলখানি বিছিয়ে।
কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফার ওপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় চক্ষু বুজে, একটা পা আর একটা পায়ের ওপর তুলে অভ্যাসমত মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল। নরেন মল্লিকের হত্যার রহস্যটা ঠিক যে কোথা হতে শুরু করা যেতে পারে, গতকাল ইস্পেক্টারের সঙ্গে অকুস্থান হতে ঘুরে আসা অবধি সেই চিন্তাটাই কিরীটীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কতকগুলো বেখাপ্পা রকমের সূত্র বিশ্রী ভাবে জট পাকিয়েছে, সেগুলো সর্বাগ্রে ভোলার প্রয়োজন কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে আসল কোন্ জন মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল সেইটাই জানা। ইপেক্টার মজিবুর রহমানের কথাই ঠিক, ওদের মধ্যে একজন স্পষ্টই মিথ্যা কথা বলছে।
কিন্তু কে বলছে মিথ্যা কথা?
এবং এও ঠিক, একজন মিথ্যা কথা বললেও দ্বিতীয়জন তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে দুজনেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বেশ ভালভাবেই পরিচিত ছিল। আচ্ছা পরিচিতাই যদি ছিল দুটি বোনই তবে ওদের মধ্যে একজনও সেদিন নরেন মল্লিকের জন্মতিথি উৎসবে, নরেন মল্লিকের বাড়িতে গেল না কেন?
চিন্তাস্রোত পাক খেয়ে ফিরতে থাকে।
আচ্ছা ঐ ধরনের যমজ বোন, তাদের একজনকে অন্যজন থেকে কি ভাবে পৃথক করা যেতে পারে? এবং সত্যিই সেটা সম্ভব কিনা?
এমন কোন লোক যে ছোটবেলা হতে ওদের চেনে না বা জানে না এবং ওদের ঠিক পরস্পরের পরস্পর হতে পার্থক্য কোথায় জানে না, সে যদি ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে পৃথক করে নিতে চায়, কি ভাবে করতে পারে? এবং প্রকৃতপক্ষে সেটা আদপেই সম্ভবপর কিনা?
জংলী এসে অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, বাবু?
কিরে জংলী?
রহমান সাহেব এসেছেন—আপনাকে—
নিয়ে আয়, এই উপরের ঘরেই নিয়ে আয়। যা।
একটু পরে রহমান সাহেব কক্ষে এসে প্রবেশ করলেন, এ কি! ঘর অন্ধকার কেন হে সত্যাশ্রয়ী?
কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে আলোটা জ্বেলে দেয়, আসুন, আসুন রহমান সাহেব। একটু পরেই আপনার কাছে যেতাম। আমার এক বন্ধু আছেন ডাঃ সুকুমার গুপ্ত, সাইকো অ্যানালিস্ট, চলুন তাঁর কাছে একবার যাবো, সে হয়ত কৃষ্ণা কাবেরীর ব্যাপারে আমাদের help করতে পারে–
.
থিয়েটার রোডে সুন্দর প্যাটার্নের একখানি দোতলা বাংলো বাড়ি। গেটের মাথায় নিওন সাইনে লেখা : Dr. Guptas Clinic; গেটের গায়ে নেমপ্লেটে লেখা?
Dr. Sukumar Gupta, D. Sc, M. R. c. P. (Lond) Neurologist.
কিরীটীর গাড়িটা এসে নিঃশব্দে বাংলোবাড়ির গেটের মধ্যে ঢুকলো।
ডাঃ গুপ্তের কনসালটিং চেম্বার। ভিতরের কক্ষটি চমৎকারভাবে সাজানোগোছানো। একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ঘূর্ণায়মান একটি চেয়ারের উপরে বসে ডাঃ গুপ্ত।
বেশ লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। পরিধানে দামী গরম সুট, তার উপরে সাদা অ্যাপ্রন। চোখে রিমলেস্ চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চশমার কাচের অন্তরালে তীক্ষ্ণ একজোড়া চক্ষু। চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির একটি পরিচয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
এদিককার চেয়ারে একজন চ্যাঙ্গা, রোগা, বৃদ্ধ ভাঃ গুপ্তর সঙ্গে বসে কথা বলছেন। বৃদ্ধটির পরিধানে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গায়ে সার্জের গলাবন্ধ গরম কোট, কাধে দামী শাল একখানা পাট করা সযতনে। একমুখ দাড়িগোঁফ।
বৃদ্ধ বলছিলেন, বুঝলেন ডাঃ গুপ্ত, লভ—আমার ছেলে ন্যাপলার মস্তিষ্কে একালের ঐ লভ ব্যাধি ঢুকেছে। বৌমাটি আমার সতীলক্ষ্মী। এগার বছর বয়সের সময় ঘরে নিয়ে আসি মা-জননীকে আমার। বুঝলেন কিনা-ন্যাপলা কুম্মাণ্ডের বয়স তখন বাইশ। হারামজাদা ছয়ছয়টি কন্যের পিতা, বড় নাতনীটির বয়সই এখন তেরো। তা হতভাগা বুঝলেন কিনা—
ডাঃ গুপ্ত : দেখুন মিঃ চ্যাটার্জী, direct patient-য়ের সঙ্গেই কথা বলা দরকার কারণ এও এক ধরনের যৌন মনোবিকার, sexual insanity!
বৃদ্ধ ও কি বললেন?
ডাঃ গুপ্ত : sexual insanity মানে যৌন বিকৃতি, অর্থাৎ যৌন সংক্রান্ত মস্তিষ্ক বিকৃতি, তা-
বৃদ্ধ ও তা বেশ। হতভাগা কুণ্ডটাকে নিয়ে কবে আসতে হবে বলুন?
বেয়ারা এসে একখানা কার্ড দিল ডাঃ গুপ্তর হাতে।
কার্ডের দিকে তাকিয়েই ডাঃ গুপ্তর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আসতে বল। আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জী-তাহলে ঐ কথাই রইলো, আপনার ছেলেকে সঙ্গে করে একদিন নিয়েই আসবেন, তারপর যা করবার–
বৃদ্ধ ও আপনার ফিস্টা—
ডাক্তার : সোল।
বৃদ্ধ দেখুন ডাক্তার সাহেব, টাকার জন্য আপনি ভাববেন না। বুঝলেন কিনা—আপনার ন্যায্য ফিস ছাড়াও হতভাগাটির যদি মতিগতি ফিরিয়ে দিতে পারেন, আপনাকে খুশী করে দেবো, বুঝলেন কিনা—
.
কিরীটী আর রহমান সাহেব চেম্বারের সুইংডোর ঠেলে কমধ্যে এসে প্রবেশ করল; সুকুমার মৃদু হেসে বৃদ্ধকে সম্বোধন করে বলে, হবে হবে, আপনি আপনার ছেলেকে একদিন নিয়ে আসুন তো! তারপর কিরীটীর দিকে তাকিয়ে আনন্দোৎফুল্ল কণ্ঠে আহ্বান জানায়, এসো এসো রহস্যভেদী, তারপর?
বৃদ্ধ কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
তারপর পথ ভুলে নাকি?
না হে না। কিরীটী জবাব দেয়।
বসুন—কিরীটী এবার রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে। ওঁর নাম মজিবুর রহমান, লালবাজার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টার।
নমস্কার।
তারপর কি ব্যাপার বল তো ভাই, হঠাৎ এই অধীনের গৃহে–
তুই তো মানসিক চিকিৎসা করিস—সাইকোঅ্যানালিস্ট, একটা ডায়লেমার সলুশন করে দে তো ভাই–
কি ব্যাপার!
একটু সময় নেবো ভাই। তুই এখন ফ্রি তো?
হ্যাঁ, দাঁড়া চা আনতে বলি, আপত্তি নেই তো?
না, মৃদু হাসি দেখা দেয় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে, অমৃতে অরুচি কিরীটী রায়ের নেই।
সুকুমার টেবিলের উপরে রক্ষিত কলিং বেল বাজাতেই বেয়ারা এসে সেলাম জানাল। জগদেও—একটু চায়ের ব্যবস্থা কর। জগদেও সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।
তারপর এখন বাসা নিলি কোথায়? সুকুমারকে প্রশ্ন করে কিরীটী।
কোথায় আবার, এইখানে! সমস্ত বাড়িটাই ভাড়া নিয়েছি, ভিতরের দিকে ব্যাচিলার্স ডেন, বাইরে চেম্বার।
সুকুমারের কথায় কিরীটী ও রহমান দুজনেই হেসে ওঠে।
পসার কেমন জমলো?
কিরীটীর কথায় আড়চোখে রহমান সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, Confidential; হাঁড়ির খবর আজকালকার দিনে কেউ কাউকে দেয় রে!
চেম্বার তো বেশ জাঁকিয়ে বসেছিস।
হ্যাঁ, তা বসতে হবে বৈকি। এ দেশটাকে তো চিনলি না এখনও, আমাদের মত বাপের টাকা বা শ্বশুরের টাকার জোরে বিলেত-প্রত্যাগত আনকোরা বিশেষজ্ঞদের কেউ পোঁছে না ভাই, কেউ পোঁছে না। দাঁড়া, আগে না খেয়ে খেয়ে, দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় প্যান্টে তালি পড়ক, মাথার চুল সাদা হয়ে যাক, বাপের দেওয়া ব্যাংক ব্যালেন্সটা শেষ হয়ে আসুক, তবে তো।
কিন্তু এতগুলো institution, হাসপাতাল-visitingয়ের postও একটা জোটাতে পারলি না?
না ভাই। বাবা, মামা, শ্বশুর, মেসো কারোই তো জোর নেই, কোন হাসপাতালে অনাহারী বহির্বিভাগীয় পরিদর্শনকারী হওয়া কি এতই সহজ রে! তা আমিও বাবা শত হস্তেন দুর্জনদের পরিত্যাগ করেছি। My own Nursing Home & chamber, এতে করে কিন্তু মন্দ হয় নি, সুফলই পেয়েছি। একা মানুষ বেশ আনন্দেই আছি।
ট্রেতে করে ভৃত্য চা নিয়ে এলো। চা পান করতে করতেই কিরীটী সংক্ষেপে কৃষ্ণা ও কাবেরীর ব্যাপারটা বলে গেল।
এই হলো story, তুই তো একজন মনস্তাত্ত্বিক, এই ডায়লেমাটার সলুশন করে দে তো! ঐ দুই যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী ওদের পরীক্ষান্তে দৈহিক কোন চিহ্ন, যেমন বার্থ মার্ক, স্কার মার্ক বা ডিফিসিয়েন্সি ইত্যাদি ছাড়া, ওদের মনের বা চরিত্রগত গঠন বা প্রবৃত্তিগত ভাবধারার অনুশীলন দ্বারা কি এক থেকে অন্যকে পৃথক করা যেতে পারে না?
How interesting! Its marvellous idea! ঐভাবে ঠিক ইতিপূর্বে কখনো আমি ভেবে দেখি নি। হ্যাঁ, হয়ত কিছুদিন ধরে আলাদা আলাদা ভাবে ঐ যমজ বোনদুটিকে study করতে পারলে, হয়তো—হয়তো yes, একটা conclusion-এ পৌঁছানো যেতে পারে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
ভাবছি তা সম্ভবই বা হতে পারে কি করে? ভদ্রঘরের অবিবাহিতা সুন্দরী তরুণী, বাপ বর্তমান, রাজীই বা হবেন কেন? না ভাই, এদেশে এখনও এ সব সম্ভব নয়–
শোন ডাক্তার, আমি ইতিমধ্যেই একটা মতলব ঠাউরেছি, how do you like the idea কাগজে কাগজে তোর নাম দিয়ে সাইকোঅ্যানালিস্ট হিসাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।
বিজ্ঞাপন?
হ্যাঁ, বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে : যমজ ভাই বোন, যমজ ভাই বা যমজ বোন এদের মনোগত বা চরিত্রগত প্রবৃত্তি বা ভাবকে স্টাডি করে এদের মানসিক ও প্রবৃত্তিগত গঠন থেকে একজনকে অন্যজন হতে identify করা যায় কিনা, ঐ সম্পর্কে তুই গবেষণা করছিস এবং ঐ গবেষণার জন্য তুই যমজ ভাই, বোন ও ভাইবোনদের আহ্বান জানাচ্ছিস; নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তারা তোর চেম্বারে এসে sitting দেবে–
দূর পাগল! এদেশে ও ধরনের বিজ্ঞাপনে কেউ সাড়া দেবে না।
উঁহু, তুই আমার পরিকল্পনাটা ঠিক এখনও ধরতে পারিস নি। তাদের বেগার দিতে হবে, রীতিমত প্রতি sittingয়ের জন্য তাদের pay করা হবে—হ্যাঁ, handsomely pay করা হবে—বলতে থাকে কিরীটী, ধর এক বা দু ঘণ্টার জন্য যেমন প্রয়োজন, প্রতি sittingয়ে ৫০ হতে ৬০, ৮০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হবে।
বলিস কি!
হ্যাঁ, আর সে টাকা দেব আমি।
তুই দিবি?
হ্যাঁ, আমি দেবো কারণ দায়টা এক্ষেত্রে আমারই—
কিন্তু–
না, আর কিন্তু নয় বন্ধু। শুভস্য শীঘ্রম্। কালই আমি কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার সব ব্যবস্থা করছি।
বেশ। কিন্তু যাদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, যদি শেষ পর্যন্ত তারাই না সাড়া দেয়?
সাড়া তাদের দিতেই হবে এবং যতদিন না সাড়া দেবে বিজ্ঞাপন চলবে কিন্তু অতটা বোধ হয় করতেই হবে না। কারণ খোঁজ নিয়ে ইতিমধ্যেই আমি জেনেছি, আর্থিক অবস্থা তাদের এমন বিশেষ কিছু একটা নয়। এ ফাঁদে তাদের ধরা দিতেই হবে। আর শেষ পর্যন্ত ধরা যদি নাই দেয়, তখন অন্য উপায় না হয় একটা কিছু ভেবে দেখা যাবে।
বেশ, দে বিজ্ঞাপন।
তবে আজকের মত উঠি?
আয়—
.
কৃষ্ণা ও কাবেরীর ফ্ল্যাটবাড়ি।
অন্তরাল হতে সঞ্জীবের আবৃত্তি শোনা যাচ্ছে।
Our sincerest laughter
With some pain is fraught
Our sweetest songs are those
That tell of saddest thought.
ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণ শোণিমা,
স্বর্গ, মর্ত্য, আরাধ্যা, তুমি হে চিরবরেণ্যা।
কৃষ্ণা একটা সোফার উপরে বসে কাঁটা দিয়ে উলের একটা স্কার্ফ বুনছে। কাবেরী হাতে ঐদিনকার ইংরাজী একটা সংবাদপত্র নিয়ে কক্ষে এসে প্রবেশ করল, দিদি!
উঁ।
আজ কদিন থেকে খবরের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা বেরুচ্ছে—একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট যমজ ভাই ও বোনদের study করে তাদের মানসিক ও চরিত্রগত প্রবৃত্তি থেকে তাদের এক হতে অন্যকে পৃথক করে নেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে–
পড়েছি।
আয় না কেন, আমরা দুজনে দরখাস্ত করে দিই!
কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে মুখ তুলে তাকাল, কুঞ্চিত ভ্রূযুগল।
বিনা পরিশ্রমে কেবল কথাবার্তা বলবার জন্য প্রত্যেক সিটিংয়ে টাকা দেবে–
না।
না কেন? এত সহজে অর্থোপার্জন! তাছাড়া টাকার তো আমাদের যথেষ্টই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে–
তুই কি ক্ষেপে গেলি কাবি?
বাঃ রে! এতে ক্ষেপে যাবার মত কি দেখলি তুই?
তাছাড়া কি! সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে আমরা একজন পরপুরুষের সামনে বসে বসে তার খুশিমত যত সব আবোল-তাবোল প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবো! মান-সম্রম নেই আমাদের–
But really this is too much দিদি। তাছাড়া ভদ্র শিক্ষিত বিলাতফেরত ডাক্তার, তার রুচি ও ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
বাবা! বাবার কথা ভুলে যাস না কাবি। হ্যাঁ, তুই তো জানিস কোন পুরুষের সংস্পর্শে আমরা আসি—এ তিনি একেবারে চান না। একটু থেমে আবার কৃষ্ণা বলে, তা ছাড়া বাবা মনে যাতে দুঃখ পান আমাদের তা করারই বা কি প্রয়োজন? কোন এক পরপুরুষ ডাক্তারের চেম্বারে একা একা তার সঙ্গে বসে বসে এভাবে sitting দেওয়ায় তিনি কিছুতেই মত দেবেন না।
নেপথ্য হতে ঠিক এমনি সময় ওদের পিতা সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কৃষ্ণা কাবেরী!
কৃষ্ণা? যাই বাবা। চল, বাবা ডাকছেন।
দুই বোন ভিতরের ঘরের দিকে গেল।
.
ভিতরের একটি কক্ষ।
আসবাবপত্রের কোন বাহুল্যই নেই। একটি সিংগল খাট একপাশে, উপরে তার শুভ্র শয্যা বিছানো। একপাশে নানাজাতীয় ইংরাজী বাংলা বইতে ঠাসা একটা আলমারী। ছোট একটি বেতের টেবিলের উপরে মদের গেলাস ও মদের বোতল। একটি হেলান দেওয়া বেতের চেয়ারের ওপরে বসে, কোলে একটি মোটা বই, পাঠনিরত সঞ্জীব চৌধুরী।
অদূরে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে একজোড়া ক্রাচ ও দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি বেহালার বাক্স।
ক্রাচের সাহায্যেই সঞ্জীব চৌধুরী ঘরের মধ্যে সামান্য প্রয়োজনমত হাঁটা-চলা করেন।
সঞ্জীবের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। সরু ছুঁচালো মুখ—মাথার চুল ঝাকড়া আঁকড়া। বহুকাল চিরুনির সংস্পর্শ নেই বলেই মনে হবে। কোটরপ্রবিষ্ট দুটি চক্ষু। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে পায়জামা ও গায়ে কিমোনো।
কৃষ্ণা ও কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
বই হতে চোখ না তুলেই সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বলেন, তোমাদের বোনদের কথা কিছু কিছু আমার কানে এসেছে। I agree with কাবেরী
পিতার প্রকৃতিবিরুদ্ধ কথা শুনে দু বোনই যুগপৎ চমকে যেন পিতার মুখের দিকে তাকায়। কারো সঙ্গে মেলামেশা করা, বিশেষ করে কোন পরপুরুষের সঙ্গে, সঞ্জীব একেবারেই পছন্দ করেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁর সর্বদাই সজাগ ওদের প্রতি।
এমন কি এ কথাও তিনি বহুবার মেয়েদের বলেছেন, মেয়েদের স্বাধীনতার তিনি আদপেই পক্ষপাতী নন। মেয়েদের স্থান ঘরে-অন্দরের সীমানায়, আর লজ্জা ও সংযমের মধ্যে। শিক্ষার তাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সে শিক্ষা স্কুল কলেজের ডিগ্রী শিক্ষা নয়। বাড়িতে বসেই তারা অধ্যয়ন করবে, শিক্ষালাভ করবে আত্মোন্নতির জন্য। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যতটা কম হয় ততই ভাল ও মঙ্গল। সেই জন্যই ম্যাট্রিক পাসের পর ঘরে বসেই আই-এর পাঠ পড়তে পড়তে তাদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। মোট কথা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল পিতার প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বেশ ভালভাবেই পরিচয় আছে।
সেই পিতার মুখে আজ এ কি কথা!
বিস্ময়ে দুই বোনই চেয়ে থাকে পিতার মুখের দিকে।
আবার সঞ্জীব বলে ওঠেন, বুঝতে পারছি তোমরা কি ভাবছো। মত আমার আজও বদলায় নি। তবু এ ব্যাপারে আমার মত আছে দুটি কারণে–
একটু থেমে আবার সঞ্জীব বলতে শুরু করেন, হ্যাঁ, দুটি কারণে, ১নং আমাদের কিছু টাকার প্রয়োজন। এযাবৎকাল তোমাদের দুজনের মাইনে হতে যা আমি বাঁচিয়েছি, তার উপরে আরো কিছু টাকা হলে আমরা কলকাতা ছেড়ে কোন গ্রামে গিয়ে কিছু জমি-জায়গা করে সাধারণভাবে নিরুপদ্রবে ও শানিতে জীবন কাটাতে পারবো। তোমরতা দু বোন প্রত্যেক sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে চার্জ করবে, যদি এতে তারা রাজী হয় ভালো নচেৎ sitting দেবে না। আর ২নং কারণ—আমি দেখতে চাই এতদিন ধরে যে শিক্ষা তোমরা আমার কাছ হতে পেয়েছে, কতটুকু তার তোমরা গ্রহণ করেছে। সত্যিকারের মনের জোর যদি তোমাদের থাকে, তোমরা যে কোন situationয়েই উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পারবে।
কাবেরী বেশী উৎসাহিত হয়ে ওঠে পিতার কথায়, বলে, তাহলে একটা দরখাস্ত করে দিই বাবা?
দাও—তবে হ্যাঁ, ঐ একশ টাকা করে তোমরা প্রত্যেক sittingয়ের জন্য চাও, এ কথাটা mention করতে ভুল হয় না যেন। •
কাবেরী বলে, কিন্তু বাবা, একশ টাকাটা খুব বেশী নয় কি?
সঞ্জীব জবাব দেন, না। যে লোক সামান্য একটা অদ্ভুত খেয়ালের জন্য টাকা খরচ করতে রাজী থাকে, তার কাছে অর্থের মূল্যটা খুব বেশী নয় কাবেরী। তাছাড়া দিয়েই দেখ না দরখাস্ত, রাজীও তো হতে পারে। তাছাড়া লোকটা রাজী হয়ে যায় ভালইনচেৎ আমাদের ক্ষতিই বা কি?
কিন্তু বাবা—এতক্ষণে কৃষ্ণা কথা বলে।
আর কথা নয় কৃষ্ণা। তোমরা এখন যেতে পারো—সঞ্জীব কতকটা যেন মেয়েকে বাধা দিয়েই প্রসঙ্গটা থামিয়ে দিলেন।
বাপের প্রকৃতির সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরী যথেষ্ট পরিচিত, আর দ্বিরুক্তি না করে দুজনে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
***
মেয়েরা কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলে সঞ্জীব চেয়ার হতে উঠে ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে কক্ষের আলমারীটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
একটা ড্রয়ার খুলে বের করলেন একটা ফাইল—সেই ফাইলটা খুলতেই বের হলো ৩০/৩২ বৎসরের অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী এক নারীর ফটো। ফটোটা চোখের সামনে তুলে ধরে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী চাপা স্বরে বলতে থাকেন, করুণা করুণা করুণা! চোখের কোণে দুফোঁটা জল বুঝি এসে জমা হয় বৃদ্ধ সঞ্জীবের। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন সঞ্জীব চৌধুরী, তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটোটার দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে বলে ওঠেন, You-You cruel heartless woman, you ruined my life! কিন্তু আজ? কেমন জব্দ, কেমন জব্দ করেছি তোমায়! আমার বুকভরা অফুরন্ত ভালবাসাকে একদিন দুপায়ে তুমি থেঁতলে দিয়েছিলে। নিষ্ঠুর পাষাণ হৃদয়ে তোমার তিলমাত্রও সাড়া জাগাতে পারি নি। কিন্তু আজ! কেমন জব্দ, কেমন জব্দ?…World is too big, নয়?
হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী।
.
দীর্ঘ সতের বছর আগে—স্মৃতির পর্দায় আলোকপাত হলো।
হাঃ হাঃ করে একটি সুবেশধারী যুবক হাসছে। সুসজ্জিত একটি ড্রইংরুম। যুবকটির নাম অরুণ মল্লিক। অদূরে সোফার উপরে বসে সুন্দরী, সুবেশা সঞ্জীব চৌধুরীর তরুণী স্ত্রী করুণা।
না–না—হাসি নয়, সত্যি বলছি অরুণ, সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। লিখেছে, শীঘ্রই নাকি আমাদের সে চা-বাগানে নিয়ে যাবে
After all the good old Sanjib is really a devoted husband. মিথ্যে তুমি ভয় পাচ্ছ রুণা। চা-বাগানে নিয়ে যাবে তোমার মত একজন সোসাইটি লেডিকে, চা-বাগানের সেই অন্ধকার জীবনে সে কখনই টেনে নিয়ে যেতে পারে না। সকলে মিলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করবো। Vehemently protest করবো।
কিন্তু এ কথাটা তোমরা ভোল কেন অরুণ, আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী! তারই অধিকার সর্বাগ্রে–
বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা!
Dont be naughty অরু। সে আমার স্বামী।
অস্বীকার করি না, তাই বলে সীমা লঙ্ন করা কি উচিত?
এমন সময় ছয় বছরের শিশুকন্যা কৃষ্ণা ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণি! কাবি কোথায়?
কাবি ওঘরে খেলছে মা!
মা মেয়েকে কাছে টেনে এনে কুঞ্চিত কেশরাশিতে সস্নেহে হাত বুলাতে থাকেন।
অরুণ বলে, তাছাড়া তোমার এই যমজ মেয়ে কৃষ্ণা কাবেরী, ওদের কথা একবারও কি ভাবছো রুণা? চা-বাগানের বনজঙ্গলে গেলে ওদের লেখাপড়া, মানুষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করো? তোমার স্বামী মিঃ চৌধুরী তাঁর নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎকে নিশ্চয়ই অবহেলা করবেন না।
মুশকিল তো আমার মেয়ে দুটিকে নিয়েই আরো হয়েছে অরুণ।
এমন সময় বাইরে কাবেরীর উল্লসিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ওমা! দেখবে এসো বাবা এসেছে–
এ কি! উনি আজই এসে গেলেন নাকি! সবিস্ময়ে বলে ওঠে করুণা।
আমি তাহলে এখন চলি রুণা! আজকের পার্টির কথা ভোল নি তো?
না।
আসছো নিশ্চয়ই?
নিশ্চয়ই।
তা হলে চলি। পার্টিতে আবার দেখা হবে।
অরুণ যে দ্বারপথে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল তার ঠিক বিপরীত দ্বারপথে কাবেরীকে কোলে নিয়ে করুণার স্বামী মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী এসে কক্ষে প্রবেশ করলেন।
একটু বেশী বয়সেই সঞ্জীব সোসাইটির অন্যতম রত্ন তরুণী করুণাকে বিবাহ করেছিলেন। এবং করুণার অনুপাতে তার স্বামী সঞ্জীবকে বৃদ্ধ বলেই মনে হয়। অতিরিক্ত খাটুনি ও পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে, মুখটা লম্বাটে হয়ে গিয়েছে। রগের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে।
সঞ্জীব আসাম অঞ্চলের কোন এক চা-বাগানের ম্যানেজার। বেশ মোটা মাইনেই যে কেবল পান তা নয়, পিতৃসম্পত্তি এই বাড়িখানা ছাড়াও আরো খান-দুই বাড়ি কলকাতা শহরে ছিল। কিন্তু আজ আর একখানা বাড়িও তাঁর নিজস্ব বলতে নেই। যে বাড়িখানায় তাঁর স্ত্রী করুণা বর্তমানে আছে সেটাও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, এখন ক্রেতার কাছ হতেই মাসিক দুশ টাকা ভাড়া দিয়ে ওরা আছে।
করুণা ও সঞ্জীবের পরিচয় হয় কোন এক পার্টিতে।
সঞ্জীব চমৎকার আবৃত্তি করতে পারতেন ও বেহালা বাজানোর হাত ছিল তার সত্যিই মিষ্টি। কিন্তু অত্যন্ত চপল, বিলাসী ও অন্তঃসারশূন্য প্রকৃতির মেয়ে করুণা সঞ্জীবের গুণে নয়, তার মোটা মাইনের চাকরি, ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স ও কলকাতা শহরের উপরে তিনখানা বাড়ির লোভেই এবং একান্ত বুদ্ধিমতী, বিধবা, স্কুল-মিসট্রেস মায়ের সৎপরামর্শেই এ বিবাহে অগ্রসর হয়েছিল। সঞ্জীবের বয়স তখন চুয়াল্লিশ পার হয়ে গেছে, করুণা পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া মাত্র।
করুণার কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য অনেক বেকার বড়লোকের সন্তানও স্বল্প আয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন তরুণের দল সর্বদা করুণার পিছনে পিছনে মধুলোভী ভ্রমরের মত গুনগুন রব তুলে ফিরছে তখন।
কিন্তু করুণার জননী মুখে কাউকে কিছু না বললেও মনে মনে কাউকেই ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে পছন্দ করতেন না।
সঞ্জীব মাসখানেকের ছুটি নিয়ে সেবার কলকাতায় এসে নতুন একটা গাড়ি কিনে এক
অবিবাহিত ব্যারিস্টার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ক্লাবে ও নানা পার্টিতে যাতায়াত করছে।
ঐরকম এক পার্টিতেই সঞ্জীব আবৃত্তি করলে ও বাজিয়ে শোনালে বেহালা। করুণা যেচে এসে সঞ্জীবের সঙ্গে আলাপ করলে।
ক্রমে আলাপ-পরিচয়টা আরো ঘনিষ্ঠ হলো, পরস্পর পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলে। সঞ্জীব আরও এক মাসের ছুটি নিল। অবশেষে করুণার মা-ই একদিন সঞ্জীবের কাছে। বিবাহের প্রস্তাব করলেন কন্যার হয়ে।
সঞ্জীব মনে মনে যে কামনাটা ইদানীং ভীরু সঙ্কোচের সঙ্গে লালন করছিল, করুণার মায়ের প্রস্তাব শুনে অন্তরের সেই ভীরু বাসনা মুক্তির আনন্দে যেন দুকূল ছাপিয়ে গেল।
মৃদু সঙ্কোচের সঙ্গে সঞ্জীব বললে, কিন্তু মা, করুণা কি—
মৃদু হেসে করুণার মা বললেন, রুণার মন না জেনেই কি এ প্রস্তাব আমি তোমার কাছে করছি বাবা! তাছাড়া মেয়ে আমার এদিকে যতই সোসাইটির মধ্যে ঘুরে বেড়াক, ভীষণ লাজুক। আমি তো জানি রুণাকে।
***
যা হোক ঐ মাসেরই শেষে সঞ্জীব ও করুণার বিবাহ হয়ে গেল। এবং বিবাহের পরেই সঞ্জীব করুণাকে নিয়ে চা-বাগানে চলে গেল। দশ-পনের দিন যেতে-না-যেতেই কিন্তু করুণা বলতে শুরু করলে, এ কি ছাইয়ের জায়গা! মনের কথা বলবার একটা লোক নেই। না আছে ক্লাব, একটা হোটেল বা সিনেমা!
সঞ্জীব ভাবলেন, সত্যিই তো, অল্প বয়স করুণার, চিরদিন কলকাতার মত শহরে মানুষ। পাণ্ডব-বর্জিত এই বনজঙ্গলে তার মন টিকবেই বা কেন?
নিজে সঙ্গে করে সঞ্জীব রেখে এলেন করুণাকে কলকাতার বাড়িতে। ভৃত্য, চাকরানী, ড্রাইভার, বামুন নিযুক্ত হলো। করুণা মনের আনন্দে দিন কাটাতে লাগলো। হাতে অজস্র টাকা, বাড়ি, গাড়ি, সোসাইটিতে পজিশন করুণা তার নিজের খেয়ালখুশিতে মশগুল হয়ে উঠলো।
সঞ্জীব মধ্যে মধ্যে আসেন, ছয় সাত দিন থেকে যান। স্ত্রীকে যখনই নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলেন, করুণা মুখখানি ভার করে। সঞ্জীবের কেমন মায়া হয়, কিছু বলতে পারেন না।
বৎসর দেড়েক বাদে কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ দুটি মেয়ে হলো করুণার।
এবারে আবার সঞ্জীব করুণাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন নিজের কর্মস্থলে, কিন্তু করুণা রাজী হলো না।
স্ত্রীর ব্যবহারে সঞ্জীব মনে বিশেষ আঘাত পেলেন এবারে, মুখে কিছু বললেন না—কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবনে আর কখনো স্ত্রীকে নিজের কাছে যেতে বলবেন না। থাক সে এখানে, যদি কখনো সে স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাঁর কাছে, তবেই নিয়ে যাবেন নইলে নয়।
শাপে বর হল করুণার। আয়ার হাতে মেয়ে দুটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার সঁপে দিয়ে করুণা তার পার্টি, ক্লাব নিয়েই হৈ হৈ করে সারাদিন বেড়াতে লাগল।
.
ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সংবাদ বিবাহের পর থেকেই সঞ্জীব আর রাখতেন না, স্ত্রীর নামে ব্যাঙ্ক হতে টাকা তুলবার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলেন। বিবাহের বছর চারেক বাদে হঠাৎ একদিন সঞ্জীব আবিষ্কার করলেন ব্যাঙ্ক প্রায় শূন্য।
তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন সঞ্জীব কলকাতায়। শুধু যে ব্যাঙ্ক শূন্য তা নয়, বহু জায়গায় ধারও হয়েছে করুণার প্রচুর। সেই ঠেলা সামলাতে গিয়ে একখানা বাড়ি বিক্রয় হয়ে গেল। তথাপি সঞ্জীব করুণাকে কিছু বললেন না।
দুটো বছরও তারপর গেল না—বাকী দুখানা বাড়িও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেল, সময় থাকতে করুণাকে কিছু না বলবার জন্যই। কিন্তু এবারে আর সঞ্জীব চুপ করে থাকতে পারলেন না।
একদিন স্ত্রীকে বললেন, করুণা, এতদিন তোমায় আমি কোন কথা বলি নি, কিন্তু আর বলে পারছি না, এবার থেকে যদি তুমি সাবধানে না চল, ভবিষ্যতে তোমায়ই অসুবিধায় পড়তে হবে।
করুণা স্বামীর দিকে বিলোল কটাক্ষ হেনে বললে, সোনার হরিণের দাম কি কখনো কমে?
তারপর স্বামীর দেহের উপরে এলিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বললে, তাই বলে কঞ্জুস নাম কিনতে পারবো না। তোমার স্ত্রীর societyতে একটা position আছে তো!
সমস্ত আঘাতই সঞ্জীব সহ্য করেছিলেন করুণার দিক থেকে কিন্তু শেষ ও চরম আঘাত এলো যখন তিনি একটা উড়ো চিঠি থেকে জানতে পারলেন, করুণা অরুণ নামে কোন এক তরুণ ব্যারিস্টারের সঙ্গে কুৎসিত জীবনযাপন করছে, তারই স্বোপার্জিত অর্থে।
গোপনে সংবাদ নিয়ে সঞ্জীব জানলেন চিঠির একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। তথাপি করুণার প্রতি তার হৃদয়ভরা ভালবাসা তাঁকে রূঢ় হতে দিল না।
কেবল একখানা চিঠি লিখলেন, তিনি আসছেন—করুণা যেন প্রস্তুত থাকে, এবারে তাকে তিনি সঙ্গে নিয়েই আসবেন।
করুণা স্বামীর চিঠি পেয়েও এতটুকু বিচলিত হলো না, কারণ স্বামীর তার প্রতি যে কি প্রগাঢ় ভালবাসা সেটা তার অবিদিত ছিল না।
সেদিন সঞ্জীব আসবার একটু আগে সেই সম্পর্কেই করুণা ও অরুণের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল।
কাবেরীকে কোলে নিয়ে স্বামীকে হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে করুণা চিৎকার করে আয়াকে ডাকল, আয়া—আয়া—
আয়া ঘরে এসে ঢুকলো হন্তদন্ত হয়ে, জি মেমসাব–
বেবীকো লে যাও। দেখতা নেই—সা আভি আয়া, কেতনা পরেশান হুয়া—
সঞ্জীব বাধা দিলেন, না না, থাক।
No No, you look so tired darling! কাবি—যাও খেলগে যাও—
মাকে মেয়েরা যমের মতই ভয় করে, কাবেরী তাড়াতাড়ি বাপের কোল থেকে নেমে চলে গেল।
তারপর কেমন আছো?–করুণা প্রশ্ন করে।
ভাল—সব ready করে রেখেছে তো? পরশুই রওনা হবো আমরা।
এত তাড়া কেন? রহস্যপ্রিয় কণ্ঠে করুণা বলে।
কেন—তুমি আমার চিঠি পাওনি?
পেয়েছি গো পেয়েছি—
ঐদিন সন্ধ্যার মুখে সঞ্জীব তার কক্ষমধ্যে বসে কি একটা ইংরাজী বই পড়ছেন।
অপরূপ সাজসজ্জায় করুণা এসে স্বামীর সামনে দাঁড়াল।
ব্যাপার কি, হঠাৎ এত সেজেছো যে?
একটা পার্টি আছে মিঃ চাকলাদারের ওখানে—
পার্টি?
হাঁ-ফিরতে একটু রাত হবে।
আজ পার্টিতে না গেলেই নয় করুণা?
ওঃ ডিয়ার! কি বলছো তুমি? আমার জন্য সবাই হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—
সত্যিই I am serious, রুণা। আজ পার্টিতে তোমার যাওয়া হবে না। ফোন করে দাও—
Dont be so jealous। আচ্ছা চলি–
রঙীন প্রজাপতির মতই যেন রূপের একটা ঢেউ তুলে করুণা স্বামীকে আর দ্বিতীয় বাক্য পর্যন্ত উচ্চারণ করার অবকাশ মাত্র না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
একটু পরেই গাড়ির শব্দে জানা গেল করুণা চলে গেল।
স্তম্ভিত হয়ে সঞ্জীব ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অনেক রাত্রি। কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমিয়েছে।
শয়নকক্ষে একাকী বসে বসে সঞ্জীব বহুদিন বাদে বেহালাটা বাজাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ ধীরে ধীরে বেহালা বাজিয়ে থামবার পর হঠাৎ ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিতে তাঁর চমক ভাঙল।
রাত্রি একটা। আশ্চর্য, এখনো করুণা ফিরল না! মুখে বিরক্তির ছায়া নেমে এলো সঞ্জীবের।
ঘরের মধ্যে পায়চারি সুরু করলেন সঞ্জীব আর বেহালাটা একপাশে রেখে ঘন ঘন দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলেন। এমন সময় নিচে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে এলেন সঞ্জীব জানালাটার ধারে।
নিচের গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার স্ত্রী করুণা ও অরুণ পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে।
মুহূর্তে দাবাগ্নির মতই সমস্ত অন্তর জ্বলে ওঠে সঞ্জীবের।
অপেক্ষা করতে লাগলেন ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে।
একটু পরেই সিঁড়িতে চঞ্চল পদশব্দ ও সেই সঙ্গে জড়িত কণ্ঠে গানের একটি কলি শোনা গেল,–
কাছে যবে ছিল তারে হলো না চাওয়া—
করুণা কমধ্যে এসে প্রবেশ করল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রকঠিন কণ্ঠ সঞ্জীবের শোনা গেল, করুণা!
করুণার তখন দাঁড়াবার মতও অবস্থা নয়, রীতিমত টলছে, চোখ দুটো নেশার ঘোরে বুজে আসছে, ঢুলু ঢুলু।
করুণা!
Oh dear! Please—not now! Im feeling so sleepy!
জড়িত, ক্লান্ত কণ্ঠে কথা কয়টি বলে করুণা যেমন শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়াতে যাবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ আবার শোনা গেল সঞ্জীবের, শোনা করুণা, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে—
করুণা আবার যাবার জন্য পা বাড়িয়ে জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, Oh sweety, dont be so cruel! কাল-কাল সকালে সব-সব শুনবো–
করুণা! করুণা এবারে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
ছিঃ! এত দূর তোমার অধঃপতন হয়েছে! পরপুরুষকে নিয়ে শুধু যে ঢলাঢলি করছো তা নয়, ইতর মেয়েমানুষের মত মদও খেতে শুরু করেছ!
মদ! No No-শ্যাম্পেন—শেরী—that is not liquor!
Shut up! বাঘের মতই গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব, স্বৈরিণী!
হঠাৎ যেন করুণার নেশাটা টুটে গেল, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো সে, সঞ্জীব, how dare you insult me!
Insult! অপমানের কোন জ্ঞান আজ আর তোমার আছে? ভদ্রঘরের বৌ, ভদ্রলোকের স্ত্রী-সন্তানের জননী হয়ে যে জঘন্য কুৎসিত জীবন তুমি যাপন করছে তোমার লজ্জা নেই কিন্তু আমার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সঞ্জীব! ভুলে যেও না আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী হলেও নিজস্ব আমার একটা মতামত, একটা স্বাধীনতা আছে—
এর নাম স্বাধীনতা! You shameless filthy woman!
সঞ্জীব!
তুমি না শিক্ষিতা? স্বামী বর্তমানে যে জঘন্য রুচিত পরিচয় তুমি আজ দীর্ঘ সাত বছর ধরে দিয়েছে—কি বলবো, তুমি আমার সন্তানের জননী, নইলে–
নইলে কি করতে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে?
তাড়িয়ে দিতাম? না। অত বড় বোকা সঞ্জীব চৌধুরী নয়। তোমাকে আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো আর তুমি আমার পরিচয়ের শেষ চিহ্নটুকু বহন করে নিয়ে সর্বত্র কাদা ঘেঁটে বেড়াবে, নিজের সর্বাঙ্গে কালি মাখবে—সেই সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গে কালি ছিটাবে!
একটু থেমে সঞ্জীব আবার বলেন, না করুণা, সে সুযোগ এ জীবনে আর তোমায় আমি দেবো না। আমার অফুরন্ত বুকভরা ভালবাসা, বিশ্বাস ও ধৈর্যের শেষ পাওনাগণ্ডাটুকুও পর্যন্ত তুমি মিটিয়ে দিয়েছে। অনেক দিয়েছো তুমি আমায় এই জীবনের সুদীর্ঘ সাত বছর ধরে হাঁ অনেক দিয়েছে।
করুণা এবারে বাধা দিয়ে উঠলো, থাক। তোমার লেকচার শোনবার মত আমার এখন ধৈর্য নেই, তুমি মনে করো না, তোমার এই ঘর ছাড়া এত বড় দুনিয়ায় আর জায়গা নেই—World is too big! এরপর আমারও এখানে থাকা সম্ভব নয়। এখুনি আমি চলে যাচ্ছি–
করুণা পাশের কক্ষে, যেখানে ছোট মেয়ে দুটি কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমাচ্ছে সেই ঘরের দরজার দিকে অগ্রসর হতেই গম্ভীর বজ্রকঠিন কণ্ঠে সঞ্জীব বলে ওঠেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও!
স্তম্ভিত, হতচকিত হয়ে করুণা তার চলমান পা দুটো সহসা যেন থামিয়ে, কুঞ্চিত করে তাকায় সঞ্জীবের মুখের দিকে, I want to give a parting kiss to my kiddies।
না। ও ঘরের দরজা তোমার কাছে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তোমার ও অপবিত্র দেহের স্পর্শও আমার সন্তানদের গায়ে তোমায় আজ আর আমি লাগাতে দেবো না
ওঃ এতদূর! কিন্তু ভুলে যাচ্ছো ওরা আমারও সন্তান। I have got legal rights!
Legal rights! তোমার সন্তান সেটাই আজ ওদের জীবনের সবচাইতে বড় অভিশাপ, সবচাইতে বড় ক্লঙ্ক; সন্তানই বটে—যে মা সন্তানের জন্ম মাত্র দিয়ে পশারিণীর বৃত্তি নিয়ে–-
সঞ্জীব! বাঘিনীর মত গর্জন করে ওঠে করুণা, এবং মুহূর্তে করুণার সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে ওঠে, ও পরক্ষণেই হাতের কাছে স্ট্যাণ্ডের ওপরে রক্ষিত ফুলসমেত পিতলের ফুলদানীটা চোখের। নিমেষে তুলে নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে সঞ্জীবকে লক্ষ্য করে। ঠং করে সঞ্জীবের কপালের উপরে গিয়ে ফুলদানীটা আঘাত করে, ঝরঝর করে রক্ত পড়ে কপালটা কেটে গিয়ে; একটা আর্তনাদ করে সঞ্জীব বসে পড়েন। কয়েকটি মুহূর্ত, তারপর উঠে কোনমতে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ার থেকে লোডেড রিভলভারটা হাতে নিয়ে করুণার দিকে এগিয়ে এল সঞ্জীব। রাগের মাথায় অকস্মাৎ ফুলদানী স্বামীর কপালে ছুঁড়ে মেরেই কতকটা যেন বোকা বনে গিয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়েছিল, এখন রিভলভার হাতে স্বামীকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে আর্ত চিৎকার করে ওঠে, না, না—খুন করো না, আমায় খুন করো না। আমি, আমি
মরতে এত ভয়! বলেই সঞ্জীব পাগলের মত অট্টহাসি হেসে ওঠে, তারপর বলে, ভেবেছিলাম তোমায় খুনই করবো, কিন্তু না, খুন তোমায় আমি করবো না করুণা। তোমার মত একটা নরকের কীটকে খুন করে হাত আমার কলঙ্কিত করবো না। এখুনি এক বস্ত্রে, রিক্ত দেহে, এ গৃহ এই মুহূর্তে তোমায় ত্যাগ করে যেতে হবে। বলতে বলতে গিয়ে আলনা হতে সাধারণ একটা শাড়ি টেনে করুণার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কঠোর কণ্ঠে সঞ্জীব বললে, আমারই অর্থে ক্রয় করা তোমার ঐ মূল্যবান জড়োয়ার চোখ-ঝলসান গহনাগুলো তোমায় ত্যাগ করতে হবে, এমন কি পরিধানের ঐ শাড়িটি পর্যন্ত। ঐ সাধারণ শাড়িখানা পরে একবস্ত্রে একেবারে রিক্ত হয়ে এই মুহূর্তে এ গৃহ তোমাকে ত্যাগ করতে হবে। যাও—তাড়াতাড়ি করো, যত তাড়াতাড়ি এ গৃহ ছেড়ে তুমি যাও ততই মঙ্গল। তোমার পাপে এ গৃহের বাতাস পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। যাও—
বেশ।
একে একে গহনাগুলো গা হতে করুণা খুলে দিল, তারপর স্বামীর দেওয়া শাড়িখানা পরে নিল।
দাঁড়াও—এখনও একটা জিনিস বাকী আছে, তোমার সিঁথির ঐ সিঁদুর, আমার সামনে ওটা মুছে ফেলতে হবে। নিশ্চিহ্ন করে ঘষে মুছে ফেলতে হবে।
করুণা বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মোছ! মোছ সিঁথির সিঁদুর! বলতে বলতে সঞ্জীব নিজেই এগিয়ে এসে পাগলের মত মুছে দেয় ঘষে করুণার মাথার সিঁদুর।
হ্যাঁ, এবারে যাও। পৃথিবী অনেক বড়, কিন্তু একটা কথা, আমার শেষ কথা, তোমার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিলেও সমাজের চোখের দৃষ্টি তো মুছে দিতে পারবো না, তারা আঙুল তুলে টিটকারী দেবে। কিন্তু সেদিন আর আমাকে তারা খুঁজে পাবে না—সে টিটকারী তোমার গায়েই ফিরে আসবে। যাও–
হঠাৎ এমন সময় চমকে উঠলেন সঞ্জীব, ইতিমধ্যে একসময় কৃষ্ণা ঘুম ভেঙে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কৃষ্ণা ডেকে ওঠে, মা!
হঠাৎ যেন সঞ্জীব পাগলের মত ছুটে গিয়ে করুণাকে প্রাণপণে ধাক্কা দিতে দিতে ঘর হতে ঠেলে বের করে দেন, যাও–যাও!
কৃষ্ণা কেঁদে ওঠে চিৎকার করে, মা–মা!
ঠেলতে ঠেলতে করুণাকে ঘর হতে বের করে দিতে গিয়ে চৌকাঠে পা বেধে সঞ্জীব হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।
করুণা ছুটতে ছুটতে নিচে চলে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
তারপর আর কেউ করুণার সংবাদ কোন দিনও পায় নি।
***
সেই রাত্রেই কৃষ্ণা কাবেরীকে নিয়ে সঞ্জীব বাড়িতে তালা দিয়ে বের হয়ে পড়লেন। চাকুরিস্থলে আর ফিরে গেলেন না, দেশ হতে দেশান্তরে কৃষ্ণা কাবেরীকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন।
এদিকে সেরাত্রে চৌকাঠে পা বেধে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড়ে প্রচণ্ড আঘাত লাগে সঞ্জীবের। ক্রমে সেই পা নিয়ে সঞ্জীবকে অনেক ভুগতে হলো এবং শেষটায় পা-টা অকর্মণ্য হয়ে গেল।
ঘুরতে ঘুরতে আবার সুদীর্ঘ দশ বছর পরে সঞ্জীব কলকাতায় ফিরে এলেন এবং ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করলেন অতীতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
ইতিমধ্যে কৃষ্ণা কাবেরী প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করেছিল। প্রাইভেটে তারা আই. এও পাস করল। কিন্তু এদিকে সঞ্জীবের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ গেল ফুরিয়ে।
নিজে অথর্ব হয়ে পড়েছেন, অগত্যা মেয়েদের টেলিফোনে চাকরি নিতে দেওয়া ছাড়া আর উপায়ান্তর রইলো না।
মেয়েদের চাকরি করতে দিলেও সঞ্জীব মেয়েদের প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। এবং ছোটবেলা হতেই এমন কঠোর শাসনের মধ্যে মেয়েদের গড়ে তুলেছিলেন যে, মেয়েরা বাপকে বাঘের মতই ভয় করতো। বাপের অমতে এক পাও এগুবার সাহস ছিল না।
আসলে সঞ্জীব করুণার ব্যাপারে সমস্ত নারীজাতির উপরেই বিতৃষ্ণ ও সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। এবং তাদের তিলমাত্র স্বাধীনতা দেবারও ইচ্ছা তার হত না। সর্বদা ভয় ছিল, কখন মেয়েরা তার অধিকারের বাইরে চলে যায়-দশ চক্ষু মেলে তাই যেন তিনি সর্বদা মেয়েদের পাহারা দিতেন। এমন কি যতদিন বেঁচে থাকবেন, মেয়েদের বিবাহ পর্যন্ত দেবেন না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলেন।
.
ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।
সকালের ডাকে আজ অনেকগুলো চিঠি এসেছে। ডাক্তার চিঠিগুলো একটার পর একটা খুলে পড়ছে। হঠাৎ একখানা চিঠি পড়তে পড়তে ডাক্তারের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি পাশ থেকে ফোনটা তুলে নেয়, Please put me to south…. একটু পরে ওপাশ হতে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো!
কে, কিরীটী নাকি?
কে, ডাক্তার? কি খবর ভাই?
সুখবর। তোর কৃষ্ণা কাবেরী দরখাস্ত করেছে—
সুখবর। দিয়ে দাও—জবাব দিয়ে দাও এখুনি। শুভস্য শীঘ্রম্।
কিন্তু—
কিন্তু আবার কি? না না—appointment দিয়ে দাও।
২. কাজ হয়ে গেল
কাজ হয়ে গেল। সুকুমারও মনে মনে যেন একটা নতুন উৎসাহ অনুভব করে। ব্যাপারটার মধ্যে সত্যিই একটা নতুনত্ব আছে। আছে একটা বৈচিত্র্য ও উত্তেজনা।
পৃথক পৃথক ভাবে sitting শুরু হলো। এক-একটা sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে পারিশ্রমিকই দেওয়া হতে লাগল, যেমন কৃষ্ণা কাবেরী চেয়েছিল।
.
ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।
রাত্রি আটটা হবে। প্রশস্ত একটি হলঘরের মধ্যে নানাজাতীয় বিচিত্র আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। ঘরের মধ্যে জ্বলছে একটি ডোমে-ঢাকা নীলাভ আলো। কৃষ্ণার sitting।
একটি আরামকেদারার উপরে কৃষ্ণা অর্ধশায়িতভাবে বসে, পাশেই একটি স্ট্যাণ্ডের উপরে ভাসে রক্ষিত এক থোকা রক্তগোলাপ। ঘরের মধ্যে বায়ুস্তরে গোলাপের উগ্র একটি মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়ায়। জানালার উপরে লাল রক্তবর্ণের সব ভারী পর্দা টাঙানো, বাইরের জনতার গোলমাল বা শব্দ ঘরে প্রবেশ করে না।
সুকুমার বলছিল–
আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, মনে করুন আপনাকে একটা particular situation বলবো এবং আপনাকে যদি সেই বিশেষ situationটিতে পড়তে হয় আপনি কি করতেন? চটপট জবাব দেবেন না—ভেবে বলুন। মনে করুন আপনি যেন কোন একটা অচেনা পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন দিক ভুল করে। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আশেপাশে সব নির্জন, জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
সুকুমার গল্প বলে যায় কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে সামনের বড় আর্শিটার উপরে—যার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণার সম্পূর্ণ ছায়াটা প্রতিফলিত হয়েছে। কৃষ্ণার অজান্তে তার মুখের সমস্ত ভাব-বৈলক্ষণ্যই সুকুমারের দৃষ্টিতে ধরা দিচ্ছে।
সুকুমার বলতে থাকে—
আপনি চলেছেন—চলেছেন। হঠাৎ দেখলেন পথের মধ্যে একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে দুলছে। এবং পথও সেখানে সংকীর্ণ। সাপটাকে এড়িয়ে পথ অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। পিছনপানে ফিরে তাকালেন। একটি ছোট্ট শিশু টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। এ অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন?
কি আর করব—ছুটে পালাব! জবাব দেয় কৃষ্ণা।
আর সেই ছোট্ট শিশুটি! অসহায়—তাকে–
আপনি বাঁচলে বাপের নাম, আপনি কি করতেন? প্রাণ নিয়ে পালাতেন না?
কি জানি, হয়ত—হয়ত পালাতামই।
***
একই প্রশ্নের জবাবে দিন দুই পরে কাবেরী কিন্তু সাপের কথা শুনেই চিৎকার করে ওঠে অর্ধস্ফুটভাবে।
তারপর শিশুটির কথায় বলে, কি বিশ্রী নিষ্ঠুর গল্প আপনার ডাঃ গুপ্ত!
ডাঃ গুপ্ত হেসে ফেলে।
হাসলেন যে ডাঃ গুপ্ত? আমি কি মিথ্যা বলেছি?
ডাঃ গুপ্ত জবাব দেয় না।
.
আবার আর একদিন, ডাঃ গুপ্ত কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, প্রত্যেকেরই জীবন সম্পর্কে আমরা একটা কল্পনা বা আশা পোষণ করি মনে মনে, কেমন না?
কৃষ্ণা মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, তা করি।
ডাঃ গুপ্ত বলে, বেশ। বলুন তো আপনি ভবিষ্যতের জীবন সম্পর্কে আপনি মনে মনে কি আশা পোষণ করেন? লজ্জা করবেন না কিন্তু, be frank & straightforward!
অনেক টাকাকড়ি থাকবে ব্যাঙ্কে, সচ্ছল জীবন, গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষিত, রূপবান, স্বাস্থ্যবান স্বামী–
বলতে বলতে হঠাৎ মৃদু হেসে বলে, societyতে position না চায় কে বলুন ডাঃ গুপ্ত? স্বপ্ন আমরা সকলেই তো দেখি এবং শতকরা ৯৯টি ক্ষেত্রেই তা বাস্তবে পরিণত হয় না এই যা দুঃখ!
একটা নোটবুকে কৃষ্ণার মন্তব্যগুলো টুকে নিতে নিতে স্মিতভাবে সুকুমার বলে, অত pessimistic হচ্ছেন কেন? হয়ও তো!
কৃষ্ণা মৃদু হাসে।
পরের দিন ডাক্তারের একই প্রশ্নের জবাবে কাবেরী বলে, আকাঙ্ক্ষা বা কল্পনা বলতে আপনি কি ঠিক mean করছেন বলতে পারি না ডাঃ গুপ্ত। তবে এভাবে চাকরি করে জীবিকা উপার্জন করতে সত্যিই ভাল লাগে না। এর চাইতে–
বলুন-বলুন, dont be shy!
ছোটখাটো শান্ত সচ্ছল একটি পরিবার, সুখে দুঃখে দিন চলে যাবে, অশান্তি বা মনের গরমিল থাকবে না—তাছাড়া অভাব-অভিযোগ তো মানুষের কতকটা নিজেরই মনে সৃষ্টি করা ডাঃ গুপ্ত। শান্তি অর্থে ক্রয় করা যায় না, সেও মানুষের মনে।
ডাক্তার কাবেরীর মন্তব্যটা কৃষ্ণার মন্তব্যের পাশেই ঠিক টুকে নিতে নিতে বলে, যা বলেছেন। তবে মনকে সব সময় ঠিকভাবে যাচাই করতে গেলে দুঃখটা আমাদের বেশীর ভাগ মানসিকই বইকি।
***
দিনের পর দিন এই ধরনের আলাপ আলোচনা, দুটি সুন্দরী তরুণীর নিকটত্ব, একক সাহচর্য, তরুণ ডাক্তারের মনে রঙের ছোঁয়া লাগে বোধ হয়, অদৃশ্য মীনকেতুর ফুলশ্বর কখন বুঝি মনের একটি কোমল তারে মৃদু আঘাতে সুর জাগিয়ে যায়।
মনের আকাশে পঞ্চশরের ফুলবাণে কিসের স্পর্শ লাগে—ফুটে ওঠে কুসুমের কলি। মনের ঘরে অকারণে ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। ভাল লাগে সুন্দর মুখখানি, ভাল লাগে কোন একটি কণ্ঠস্বর, চোখের চাউনি, একটি তনুর ভঙ্গিমা। মন পড়ে থাকে পায়ের সাড়ার সঙ্গীতে।
কিন্তু কে? কৃষ্ণা না কাবেরী?
কিরীটী হঠাৎ একদিন রাতে এলো। তারপর মনস্তাত্ত্বিক, সংবাদ কি তোমার clientদের?
এগুচ্ছে। ডাঃ গুপ্ত বলে।
হঠাৎ কিরীটীর টেবিলের উপরে নজর পড়ে। একটা ব্লটারের উপরে কত ভাবেই যে লেখা, কৃষ্ণা কাবেরী—কাবেরী কৃষ্ণা দুটি নাম।
মৃদু হাসি দেখা দেয় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে, হুঁ! একটা কবিতা মনে পড়ে গেল ডাক্তার।
কবিতা? বিস্মিত সুকুমার বন্ধুর মুখের দিকে তাকায়।
হাঁ। একটু হেসে সুর করে কিরীটী বলে।
ভাল লাগে মোর দুটি নাম!
ভাল লাগে কানে কানে বলা–
আর মনে মনে জানা,
তটিনীর কলতান
ভাল লাগে খালি দুটি নাম।
লজ্জায় ডাক্তারের চোখে মুখে যেন রক্ত আবির ছড়িয়ে দেয়, যাঃ, কি যে বল!
কিরীটী বলে, বলি ভালই বন্ধু। তবে সত্য এই যা, সুন্দরী তরুণী, নির্জন একক সাহচর্য, দিনের পর দিন experiment বা studyটা তো মনের কথারও হতে পারে কি বল?
আঃ, কি আরম্ভ করলি বল্ তো! কাবেরী দেবীর আসবার সময় হয়েছে, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন, যদি শুনতে পান–
আনন্দই পাবেন, তাছাড়া এসে পড়বেন নয়—পড়েছেন। ঐ শোন তাঁর লঘু পদধ্বনি পাষাণ সোপানবক্ষে। শোন—কান পেতে শোন—নহে, নহে মিথ্যা বা মনের কল্পনা।
সত্যি সিঁড়িতে লঘু পদশব্দ শোনা গেল। কেউ উপরে উঠে আসছে।
চলি বন্ধু—দেখা হবে পুনঃমৃদু হেসে কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়।
কাবেরীর কণ্ঠস্বর সুইং-ড্ডারের ওপাশ হতে ভেসে এলো, ভিতরে আসতে পারি কি?
আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।
সানন্দ আহ্বান শোনা গেল ডাক্তারের কণ্ঠে।
.
টেলিফোন অফিসের অপারেটিং রুম। কানে হেড়পিস লাগিয়ে দুবোন কাজ করছে। পাশাপাশি। মধ্যে মধ্যে একথা সেকথা আলোচনা হচ্ছে। দুই বোনের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল, বাইরে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার ডানা মেলেছে।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে হঠাৎ একসময় আলোচনার মধ্যে, ডাক্তার গুপ্তকে তোর কি রকম মনে হয় কাবি?
কাবেরী : তা মন্দ কি! বেশ ভাল লোক বলেই তো মনে হয়। একটু যা মিস্টিরিয়াস—সব সময় যেন ঠিক বোঝা যায় না।
কৃষ্ণা : একদিন আমাদের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলে মন্দ হতো না—
কাবেরী? বাবাকে কি ভুলে গেলি দিদি!
হঠাৎ কৃষ্ণা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, মিস রেহানা এখনো তো এলো না। সোয়া সাতটা বেজে গেল।
কাবেরী বলে, আমারও তো রিলিফ মিস্ বোস এখনো এলো না।
এমন সময় দেখা গেল মিস্ রেহানা ও মিস্ বোস দুজনেই প্রায় আগে পিছে ঘরে এসে ঢুকছে।
কৃষ্ণা কাবেরী তাদের পরস্পরের ডিউটি মিস্ রেহানা ও মিস্ বোসের হাতে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
বাইরে সন্ধ্যার কলকাতা শহর আলোকসজ্জায় হাস্য ও লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে তখন।
টেলিফোন অফিসের ঠিক গেটের সামনেই লাইটপোস্টের নিচে স্যুট পরিহিত একটি ভদ্রলোক, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ বাঁ দিককার মুখের উপরে একটু টেনে গেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। ওদের দুবোনকে অফিস থেকে বের হতে দেখে যেন লোকটা সজাগ হয়ে ওঠে। কাবেরীর দৃষ্টি হঠাৎ স্যুট-পরিহিত লোকটার উপরে গিয়ে পড়ে। সে অলক্ষ্যে কৃষ্ণার গায়ে হাত দিয়ে চাপা কণ্ঠে ডাকে, দিদি
কি হলো আবার, থামলি কেন?
ওই যে লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে স্যুটপরা লোকটা, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও আমাদের প্রায়ই follow করে—
কি যে বলিস?
স্যুটপরিহিত লোকটি ততক্ষণে এক পা এক পা করে হাঁটতে শুরু করেছে।
হাঁ—I am sure about it. সেদিন রাত্রে ডিউটি সেরে ফিরছি—লোকটা ঠিক ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। প্রথমটা তত মন দিই নি, পরে ট্রাম থেকে বাড়ির কাছে গিয়ে নেমেছি, রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। রাস্তা ও তার আশপাশ বেশ নির্জন। মনে হলো হঠাৎ, তখনও যেন লোকটা আমার পিছু পিছু আসছে। পিছন ফিরে থমকে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখতে পেলাম, কেবল ঐ লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে। গাটার মধ্যে কেমন ছছ করে উঠলো।
নে নে চল, যত সব আজগুবী চিন্তা! আমার আবার ডাক্তার গুপ্তের ওখানে রাত আটটায় sitting আছে—তুই বাড়ি হ্যাঁ, আমি একেবারে sitting শেষ করে যাবো–
আজই রাত আটটায় sitting?
হ্যাঁ, রাত আটটায়।
আমারও তো sitting আছে আজ রাত নটায়–কাবেরী বলে।
ঢং ঢং করে ডাঃ গুপ্তর চেম্বারের সুদৃশ্য ওয়ালকটায় রাত্রি ঠিক আটটা ঘোষণা করলো। ডাঃ গুপ্ত একাকী চেম্বারের মধ্যে নিঃশব্দে কার্পেট-মোড়া মেঝের ওপরে পায়চারি করছে। এক-একবার ঘড়ির দিকে তাকায়।
তারপর এগিয়ে গিয়ে অদূরে স্ট্যাণ্ডের উপরে রক্ষিত রেডিও সেক্টা চালিয়ে দিল। গান শোনা যায় কলকাতা কেন্দ্রের।
আটটা বেজে ঠিক পাঁচ মিনিট। সুইং-ডোরের ওপাশ হতে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, আসতে পারি?
চট করে রেডিওটা বন্ধ করে দাঁড়ায় ডাক্তার, আসুন আসুন, কৃষ্ণা দেবী।
কৃষ্ণা কক্ষে এসে প্রবেশ করলো। বড় সুন্দর আজ মানিয়েছে সাধারণ একটি কালো রঙের শাড়ি ও টকে লাল রঙের একটা ব্লাউজ গায়ে কৃষ্ণাকে।
রেডিও বন্ধ করলেন কেন? বেশ সুন্দর গানটা হচ্ছিল—
Duty first—স্মিতভাবে ডাঃ সুকুমার জবাব দেয়।
তারপর তখনও কৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।
আমি আপনার কথা কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না ডাঃ গুপ্তহঠাৎ কৃষ্ণা বলে ওঠে।
বুঝতে পারলাম না আপনার কথা কৃষ্ণা দেবী।
ঐ যে একটু আগে বললেন-duty first! জীবনে সর্বক্ষণ যদি কেবল dutyকেই first preference দিতে হয়, আপনি কি মনে করেন না তাতে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের অনেক বড় আনন্দকে বাদ দিতে হয়?
কেন? তা হবে কেন?
তা ছাড়া কি? মানুষের জীবনটা কি কেবল bundle of duties-ই? কেবল কর্তব্য আর কাজ করেই যাবো?
তা তো ঠিক আমি বলি নি মিস্ চৌধুরী। বলেছি আগে কর্তব্য। তার মানে এ নয়, জীবনের আনন্দটুকু বাদ দিয়ে কেবল কর্তব্যই করে যাবো—কেবল কাজই করে যাবো।
তাহলে অমন সুন্দর গানটা শোনা যাচ্ছিল, আপনি বন্ধ করে দিলেন কেন? কতক্ষণই বা সময় লাগত গানটা শেষ হতে!
তা নয় মিস্ চৌধুরী, আপনাকে আমি একটা কাজের জন্য আসতে বলেছি, আপনার সময়ের দাম আছে, তাই–
কৃষ্ণা হাসতে থাকে।
হাসছেন যে? সুকুমার প্রশ্ন করে।
আপনি ঠিক আমার বাবার মত। Duty সম্পর্কে he is so sincere—একটি মুহূর্তও তিনি কখনো অলসভাবে কাটান না।
আপনার বাবার সঙ্গে একদিন পরিচয় করবো।
না না—না–কতকটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই আর্তস্বরে বলে ওঠে কৃষ্ণা। ডাক্তার একটু। বিস্মিত হয়।
তিনি—
না, তিনি বাইরের কারোর সঙ্গে কখনো কথাবার্তা তো দূরে থাক, দেখাশুনা পর্যন্ত করেন। এমনকি আমাদের দু বোনের সঙ্গেও দিনান্তে একটি দুটির বেশী কথা বলেন না।
কেন? বিস্মিত ডাক্তার প্রশ্ন করে।
কৃষ্ণা প্রসঙ্গটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়ে বলে ওঠে, সে কথা থাক। আজ কি করতে হবে বলুন।
ডাক্তার বুঝতে পারে, যে কোন কারণেই হোক কৃষ্ণা তার পিতার সম্পর্কে কোন আলোচনাই করতে ইচ্ছুক নয়।
অগত্যা ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে অদূরে দেওয়াল-আলমারিটার ড্রয়ার খুলে, একটা খামের মধ্যে ভরা খানকয়েক হাতে আঁকা বিচিত্র ছবি বের করে আনে।
কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, কি ওগুলো?
ডাক্তার বলে, ছবি। এবারে আপনি ঐ চেয়ারটার উপরে উঠে গিয়ে বসুন। এবার কাজ শুরু করা যাক।
ডাক্তারের হাতে খানকয়েক হাতে আঁকা ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইটের ছবি।
কৃষ্ণার চোখে-মুখে একটা কৌতুক ও আগ্রহ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছবিগুলো হাতের মধ্যে ধরে সুকুমার বলে, আজকের আমাদের sittingয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে এই ছবিগুলো। এই ছবিগুলো এক এক করে আপনাকে দেখতে বলবো এবং ছবিগুলো দেখে ছবিগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টিপাতেই যেমন যেমন আপনার মনে হবে বলে যাবেন—আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন তো?
কৃষ্ণা মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে জানায়, হাঁ।
কৃষ্ণা যে চেয়ারটার উপরে উপবেশন করেছে ঠিক তার সামনে, প্রলম্বিত একখানা প্রমাণ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তার সর্বাঙ্গীণ ছায়া।
কৃষ্ণা সুন্দরী নয় শুধু, রূপে তিলোত্তমা যেন।
কৃষ্ণার অল্প দূরে টেবিলটার উপরে ছবিগুলো রেখে, একখানা ছবি হাতে নিয়ে টেবিলটার উপরে অর্ধদণ্ডায়মান ও অর্ধউপবিষ্ট ভাবে ডাক্তার ছবিখানা এগিয়ে ধরলো কৃষ্ণার দিকে, বলুন এই ছবিটা দেখে, কি দেখছেন এই ছবিতে?
কৃষ্ণা ছবিখানা দেখতে দেখতে বললে, এ আবার একটা ছবি নাকি? থুড়থুড়ে বুড়ো মানুষের মত যেন মনে হচ্ছে কি দুটো বসে!
বলুন তারপর? বলতে বলতে ডাক্তার একটা নোটখাতায় কি সব লিখে যায় পেনসিল দিয়ে।
হাড়পাঁজরাগুলো জিরজির করছে, হাত-পাগুলো সরু সরু প্যাঁকাটির মত, বড় বড় চোখ, হাতের নখগুলো বাঁকানো বড় বিশ্রী–
আর কিছু?
আবার কি! বুড়োমানুষ না বলে ও দুটোকে—দুটো বাঁদরও তো বলতে পারেন। দুটো সাপও বলতে পারেন-গোলকধাঁধাও একটা বলতে পারেন।
ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে দ্বিতীয় ছবিটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বললে, বেশ, এই নিন দ্বিতীয় ছবিখানা, বলুন এ ছবিটায় কি দেখছেন?
ছবিখানা দেখতে দেখতে কৃষ্ণা বলে, চমৎকার! এগুলো আবার কি? একটা বাদুড় না চামচিকে-মুখে একটা পোকা ধরেছে বোধ হয়, নিচে ঘাস, বুনো আগাছা না কতকগুলো কেঁচো কিলবিল করছে!
খাতায় নোট করতে করতে সুকুমার বলে, আর কিছু?
সত্যি বলুন না—চামচিকে না বাদুর ওটা?
ডাক্তার মৃদু হেসে কৃষ্ণার হস্তধৃত ছবিখানা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে তৃতীয় ছবিখানা এগিয়ে দিয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন তো কি দেখছেন?
তৃতীয় ছবিখানা হাতে নিয়ে কৃষ্ণা ছবিটা দেখতে দেখতে বললে, Rare collections তো আপনার ছবিগুলো ডাঃ গুপ্ত!
কি দেখছেন বলুন?
একটা ঘাসের চাবড়া-না একটা মাটির ঢেলা—হ্যাঁ, তাই বলেই মনে হয়। উপরে কি একটা যেন বসে, একটা বোলতা না গুবরে পোকা! নিচে ওগুলো কি—আগাছা জন্মেছে অনেকগুলো, না?
বেশ। এই ছবিটায় কি দেখছেন এবারে বলুন? তৃতীয় ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে চতুর্থ ছবিখানা এবারে ডাক্তার কৃষ্ণার হাতে তুলে দেয়।
কতকগুলো গোল সার্কেল (circle)—সার্কেলগুলোকে pierce করেছে একটা ধারালো ছোরা–
0. K.–আজ এই পর্যন্ত।
ছবিগুলো গোছাতে গোছাতে সুকুমার বলে, সোজা টেলিফোন অফিস থেকেই তো আসছেন, না?
হাঁ।
এক কাপ চায়ে আশা করি আপত্তি হবে না, কি বলেন মিস্ চৌধুরী?
না—না। এখন আবার চা-কৃষ্ণা আপত্তি জানায়।
টেবিলের উপরে রক্ষিত কলিং বেলটা বাজিয়ে ডাক্তার বলে, আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে বলে দশ পা একত্র গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়। দশ পা একত্রে আমরা না গেলেও অনেকদিন একত্রে বসে অনেক আলাপ আলোচনাই তো আমাদের পরস্পরের হয়েছে মিস্ চৌধুরী।
ভৃত্য জগদেও এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
দুকাপ চা, জলদি।
ভৃত্য জগদেও আদেশ পালনের সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।
অবশ্য কাজের জন্যই আপনারা এখানে আসেন, কিন্তু কাজের মধ্য দিয়ে যে আলাপপরিচয়টা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তাকেও তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। পারেন কি, বলুন?
না। মৃদু হাস্যে কৃষ্ণা জবাব দেয়।
তাহলেই দেখ, সামাজিক জীবনটাকে অস্বীকার করতে আমরা কেউই পারি না। তার অবশ্য আরো একটা কারণ আছে, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের অনেকখানি জ্ঞাতেই হোক বা অজ্ঞাতেই হোক, ঐ সহজ সামাজিকতাটাই জুড়ে আছে।
হয়ত আপনার কথাই ঠিক ডাঃ গুপ্ত।
হয়ত কেন বলছো কৃষ্ণা, তোমার টেলিফোন অফিস ও সেখানকার ডিউটি দেওয়া ছাড়া তোমার কি একটা বাইরের সামাজিক জীবন নেই? কোথাও বেড়াতে যাও না, বন্ধু বান্ধবীদের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, পার্টি, উৎসব বা সিনেমা থিয়েটার।
একমাত্র অফিসের কাজ ছাড়া বাইরে বড় একটা আমরা বেরই হই না। কচিৎ কখনও ন-মাসে ছ-মাসে হয়ত এক-আধদিন সিনেমায় যাই—আর বন্ধু বা বান্ধবী নেই বললেই চলে।
বল কি! কখনো কি ইচ্ছা হয় না কারও সঙ্গে দুদণ্ড বসে আলাপ করতে, লেক বা গঙ্গার ধারে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে?
হয়, নির্জন গঙ্গার উপকূলে অথবা কোন নিরালা জায়গায় চুপটি করে একা একা এক এক সময় বসে থাকতে ইচ্ছা করে।
আচ্ছা কোন বন্ধু বা বান্ধবীই কি তোমার নেই?
বন্ধু বা বান্ধবীর কথা বলতে যেমন বইয়ে পড়ে থাকি বা শুনে থাকি তেমন কারও সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় তো আমার নেই—
বর্তমানে নেই, না পূর্বেও কোনদিন ছিল না?
এখনও নেই—আগেও ছিল না।
সে রকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না হয় কোনদিন কারও সঙ্গে ছিল না, কিন্তু পরিচয়?
একটু যেন ইতস্তত করে কৃষ্ণা এবারে জবাব দেয়, না।
জগদেও ট্রেতে করে চা নিয়ে এল।
চায়ের একটা কাপ নিজে তুলে নিয়ে অন্যটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বলে, চা নাও—
তারপর হঠাৎ মৃদু হেসে সুকুমার বলে ওঠে, দেখেছ ইতিমধ্যে কখন এক সময় আপনাকে তুমি বলতে শুরু করেছি–
তাতে কি হয়েছে, বয়সে তো আপনার থেকে কত ছোেট, এবার থেকে আপনি আমাকে তুমিই বলবেন–
এ অধিকারটুকু যখন দিলে, আর একটা ছোট্ট অনুরোধ জানাই—
অনুরোধ বলছেন কেন, বলুন না কি বলবেন?
পরশু শনিবার প্রাচীতে খুব ভাল একটা বই আছে, যাবে?
একটু ইতস্তত করে কৃষ্ণা।
অবশ্য আপত্তি যদি থাকে—
না—না। পরশু তো আমার off-dutyই আছে, বেলা ৫টার পর থেকে অসুবিধা হবে না।
বেশ, তবে সেই কথাই রইলো, তুমি এখানেই এসো–ছটায় শো। চন্দ্রিমা কাফেতে we will have our tea—তারপর সেখান হতে যাব সিনেমায়।
সুইংডোরের ওপাশ হতে কাবেরীর কণ্ঠস্বর সহসা ভেসে এল, আসতে পারি কি?
যুগপৎ দুজনই চমকে ওঠে।
ঠিক এমনি সময় চেম্বারের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা ঘোষণা করলে।
কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, উঃ! রাত নটা বাজে, আমি যাই।
আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।
ডাঃ সুকুমার সাদর আহ্বান জানায়।
কৃষ্ণা সুইংডোর ঠেলে বের হয়ে যায়, কাবেরী এক পাশে সরে দাঁড়ায়, ক্ষণেকের জন্য উভয়েরই চোখাচোখি হয়।
কাবেরী দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
কৃষ্ণা হন্ হন্ করে বের হয়ে যায়।
কাবেরী কমধ্যে প্রবেশ করলো।
কাবেরীর পরিধানে আজ অতি সাধারণ সাজসজ্জা। গেরুয়া রংয়ের খদ্দরের শাড়ি, লাল শাড়ির পাড়, গায়ে লাল রক্তবর্ণ ভয়েলের জামা। মাথার চুল বর্মিজ প্যাটার্নে বাঁধা। হাতে একগাছি করে সরু সোনার চুড়ি। দুই ভূর মাঝখানে বড় একটি কাজলের টিপ ও চোখের কোণে সূক্ষ্ম সুর্মার টান।
বসুন কাবেরী দেবী—
বসতে বসতে কাবেরী বলে, আজ প্রথমেই একটা প্রতিবাদ জানাবো ডাঃ গুপ্ত–
প্রতিবাদ? স্মিতহাস্যে তাকায় সুকুমার কাবেরীর হাস্যোচ্ছল মুখের দিকে।
হাঁ প্রতিবাদ। আপনার চাইতে বয়সে আমি অনেক ছোট, আপনি আমাকে এবার থেকে তুমি বলবেন, আপনি বলে আর কথা বলতে পারবেন না।
বেশ তো। কিন্তু আধুনিক সমাজে আজ ঐটাই প্রচলিত যে—
তা হোক। তাছাড়া আমাদের পরস্পরের এতদিনকার পরিচয়েও কি অপরিচিতের দূরত্ব বা সঙ্কোচটা কেটে যায় নি?
অন্তত আমি তো কেটে গিয়েছে বলে মনে করি।
একটু পরে সুকুমার আবার বলে, কৃষ্ণা দেবীও আজ আমাকে সেই অনুরোধই জানিয়েছেন।
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তাহলেই দেখুন আমরা দুজনেই কেউ আপনার ঐ আপনি সম্বোধনটা সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। Businessয়ের ব্যাপারে টাকাটা না নিলে চলবে না যখন নিতেই হবে, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই businessয়ের বাইরে পড়বে, কি বলেন? আমাদের সামাজিক সম্পর্কটা
বেশ তাই হবে।
আজ আমার sittingয়ের বিষয়বস্তু কি বলুন?
বিশেষ কিছু না, কয়েকটা ছবি সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই আজ, it wont take much time!
ছবি! কিসের?
ঐ চেয়ারটার উপরে বসুন আগে—
কাবেরী উঠে গিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।
আচ্ছা এবারে আপনাকে আমি পর পর চারখানা ছবি দেখতে দেবো। ছবিগুলো দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই আপনার যেমন মনে হবে বলে যাবেন, কেমন?
বেশ।
দেখুন এই ছবিটা–কি দেখছেন?
ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাবেরী বলে, দুটি বৃদ্ধ—একেবারে থুড়থুড়ে বুড়ো, পরস্পরের পিঠের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে। কি রোগা বুড়ো দুজন! মনে হয় যেন দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে উঠে এসেছে। ভাসা ভাসা উদাস চোখের দৃষ্টি।
বেশ। ধরুন এই ছবিটা-what do you find in this picture?
বাঃ, কি সুন্দর একটা পাখী! ডানা দুটি মেলে নীল আকাশে উড়ে চলেছে, ঠোঁটের মধ্যে রেখেছে বোধ হয় নীড় বাঁধবার জন্য একটি খড় বা কাঠি। নীড়ের মায়ায় পৃথিবীর যাবতীয় পশু, পাখী, প্রাণীই বোধ হয় এমনি ঘুরে মরছে!
আর কিছু দেখছেন ছবিটায়?
হুঁ। নীচে বোধ হয় ওগুলো ঘাস জন্মেছে, ঘাসের বুকে ছড়িয়ে আছে কতকগুলো শুকনো ঝরা পাতা।
নোটবইয়ে কাবেরীর কথাগুলো টুকতে ঢুকতে আর একখানা ছবি কাবেরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ডাক্তার বলে, দিন ও ছবিখানা, এইখানা দেখুন এবারে। বলুন এ ছবিটায় কি আছে?
চমৎকার একটি ফুল, দলগুলো মেলে ফুটে উঠেছে। ফোঁটা ফুলটির উপরে বসে আছে মধুলোভী একটি কৃষ্ণ ভ্রমর, নিচে ছড়িয়ে আছে দেখছি একরাশ ঝরা ফুলের পাপড়ি। তাই না ডাঃ গুপ্ত?
Good! দিন ছবিটা—now have this one! বলুন কি দেখছেন এইটায়?
চতুর্থ চিত্রখানা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাবেরী বলে, এটা কি! দাঁড়ান। হুঁ, মনে হচ্ছে কতকগুলো বৃত্ত। বৃত্তগুলোকে চিহ্নিত করছে আড়াআড়ি ভাবে একটি রেখা—সরল রেখা। কোন জিওমেট্রিক figure নিশ্চয়ই! জিওমেট্রি আমার ছিল বটে তবে ভাল বুঝতে পারতাম না কোন দিন। বরাবর তাই এড়িয়ে এসেছি ওটাকে—
ছবিখানা কাবেরীর হাত হতে ফেরত নিয়ে একটা খামের মধ্যে ছবিগুলো ভরে ফেলে সুকুমার।
আজকের sitting এইখানেই শেষ কাবেরী দেবী। হ্যাঁ, কৃষ্ণা দেবী চলে যাবার সময় তাড়াতাড়িতে তাঁর আজকের sittingয়ের পারিশ্রমিকটা নিয়ে যেতে ভুলে গেলেন। বলতে বলতে ডাক্তার ড্রয়ার খুলে ১০ টাকার কুড়িখানা নোট বের করে কাবেরীর হাতে দিতে দিতে বলে, একশ টাকা কৃষ্ণা দেবীর, বাকী একশ টাকা আপনার।
কাবেরী বিনম্ৰ কুণ্ঠার সঙ্গে ডাক্তারের হাত থেকে নোটগুলো নিতে নিতে সলজ্জ কণ্ঠে বলে, সত্যি এভাবে আপনার কাছ হতে টাকা নিতে কেমন যেন সঙ্কোচ অনুভব করি ডাঃ গুপ্ত
সঙ্কোচ! কেন? পারিশ্রমিকের মূল্য হিসাবে টাকা নিচ্ছেন, দান-খয়রা তো আর নয়—
তবু, সামান্য কথাবার্তা, আলোচনার জন্য এভাবে টাকা নেওয়া, সত্যি মনকে বড় পীড়া দেয়।
না, না–ও কথা ভাবেন কেন মিস্ চৌধুরী! সময়েরও মূল্য আছে একটা। বিশেষ করে আপনাদের ও আমাদের মত যাদের মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে জীবিকা উপার্জন করতে হয়। এতে সঙ্কোচ লজ্জা বা দ্বিধার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না—শুধু তো আপনারাই নন, আরো দুজনে sitting দিচ্ছেন।
টাকা নেবো বলেই যখন আপনার কাছে sitting দিতে এসেছি, তখন ও সম্পর্কে মনে আজ দ্বিধা বা সঙ্কোচ জাগলেও অন্তত আমাদের মুখ দিয়ে সেটা প্রকাশ করা নিশ্চয় শোভা পায় না।
আলাপ-আলোচনার মধ্যে হঠাৎ একসময় কাবেরীই প্রশ্ন করে বসে, আচ্ছা ডাক্তার, যখনই আমি এখানে এসেছি তখন দেখি আপনি চেম্বারে বসে বই-ই পড়েন, দিনরাত খালি বুঝি লেখাপড়া নিয়েই থাকেন? কখনো কোথাও বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যান না?
সিনেমায় মাঝে মাঝে যাই ভাল বই থাকলে। আপনি বুঝি বেড়াতে, সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসেন?
বেড়াতে, সিনেমা দেখতে খুবই ভাল লাগে তবে কোনটাই হয়ে ওঠে না তেমন এই যাদুঃখ।
কেন?
বাবা! তিনি পছন্দ করেন না। কারো সঙ্গে মেলামেশা করা, থিয়েটার, সিনেমা বা ক্লাবে যাওয়া এসব তিনি আদপেই পছন্দ করেন না। তবু মাঝে মাঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে যে যাই না তা নয়, তবে–
কেন? আপনার বাবা–
বাবা একজন অদ্ভুত typeয়ের লোক। এত স্নেহ করেন, এত ভালবাসেন আমাদের—তবু in some respects he is so queer! নিজে তো কখনো কোথাও বেরই হন না, আমরা যে কোথাও বের হবো, তাও পছন্দ করেন না একেবারে।
কেন বলুন তো?
তা ঠিক জানি না বলতে বলতে কাবেরী যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন কাবেরীর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে যায়।
থাক ওসব কথা ডাঃ গুপ্ত। এক এক সময় এ জীবন এমন ক্লান্ত ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে ইচ্ছা করে সব ভেঙেচুরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই, কিন্তু বাবা—he is so affectionate, so tender—তাছাড়া বাবা কোন কারণে দুঃখ পাবেন, ভাবতেও পারি না-
কথার মোড়টা ফিরিয়ে দেবার জন্যে হঠাৎ সুকুমার প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিস চৌধুরী, কি টী
আবার আপনি! জবাব দেবো না আপনার কথার—
Sorry! অনেক দিনের অভ্যাস কিনা—
Love picture আমার খুব ভাল লাগে—
রোমিও জুলিয়েট ছবিটা দেখেছেন?
দেখেছি, কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়—
কিন্তু রোমিও জুলিয়েটের কাহিনী তো বিশ্বসাহিত্যের একটি প্রধান প্রেমের উপাখ্যান।
তা হোক। Effeminate love! তার চাইতে সিজার অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্রা ঢের ভাল লেগেছে।
ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করলে দেওয়াল-ঘড়িতে।
উঃ-রাত দশটা! তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় কাবেরী।
চল তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আসি
না না—তার প্রয়োজন নেই, আমি একাই যেতে পারবোকাবেরী কতকটা যেন ত্রস্ত পদেই ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল, শেষ বিদায়সম্ভাষণটুকুও জানাতে বোধ হয় ভুলে যায়।
কাবেরী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যেতেই সুকুমার ঘরের রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দিয়ে সামনে দাঁড়াল।
খোলা জানালাপথে তাকিয়ে সুকুমার দেখলে, হন হন করে কাবেরী নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে একাকী।
কাবেরী হন হন করে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। পিছনদিকে ফিরে তাকাবারও যেন কাবেরীর সময় নেই। কেবল মধ্যে মধ্যে রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িটার উজ্জ্বল লেখাগুলোর দিকে তাকায়। কাবেরী পিছনপানে তাকালে দেখতে পেত বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা কালো। রংয়ের গাড়ি নিঃশব্দে শ্লথগতিতে ওকে পিছু পিছু অনুসরণ করে চলেছে।
থিয়েটার রোড পার হয়ে সার্কুলার রোড ও পার্ক স্ট্রীট যেখানে এসে মিশেছে সেখানে চৌমাথার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা সবুজ রংয়ের ফুইড় ড্রাইভ ফোর্ডগাড়ি কাবেরীর পাশটিতে এসে দাঁড়াল, গাড়ির চালক সুবিমল।
মৃদুকণ্ঠে সুবিমল আহ্বান জানায়, এসো।
দরজাটা খুলে যায় গাড়ির, কাবেরী গাড়ির মধ্যে উঠে বসে।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করে।
পশ্চাতের গাড়িটা এতক্ষণ কিছুটা দূরত্ব বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাও এবারে চলতে শুরু করে ওদের গাড়িটাকে অনুসরণ করে।
এত দেরি হল যে? ভাবছিলাম ভুলে গেলে বুঝি!
মৃদু হাসি জেগে ওঠে কাবেরীর ওষ্ঠপ্রান্তে, ভুলিনি, ডাক্তারের সঙ্গে কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল।
ডাক্তার যে বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।
ছিঃ, কি যে বল! লোকটা সত্যিই ভাল, I like him.
দেখো, বেশী ভাল লাগলে দেখা যায় ভালবাসায় পরিণত হয় কিন্তু—
তোমরা পুরুষরা ভারী jealous!
আর তোমরা মেয়েরা ভারী উদার, নয়?
আকাশে ইতিমধ্যে কখন কালো কালো মেঘ ঘন হয়ে উঠেছে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের চকিত আলোর ঝলকানিও লক্লকিয়ে গেল দুচারবার।
বৃষ্টি আসবে নাকি?
ক্ষতি কি আসুক না-সুবিমল জবাব দেয়।
কোথায় চলেছো?
যেদিকে দুচক্ষু যায়। সত্যি আর ভাল লাগে না, এই লুকোচুরি আর অন্তহীন এই প্রতীক্ষ্ণ। চল সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই পৃথিবীর কোন এক নির্জন প্রান্তে বা—
তারপর?
তারপর বেঁধে নেবো ছোট একখানি ঘর, নিরজনে তোমাতে আমাতে বাঁধিব বাসা—
বৃষ্টি শুরু হয়, উইণ্ড-স্ক্রীনের উপরে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে।
হঠাৎ সুবিমল ডাকে, প্রিয়া?
ও কি!
বাধা দিও না প্রিয়া, বাধা দিও না, ডাকার নেশায় পেয়েছে আজ আমায়—
রাত অনেক হলো, এবারে ফিরে চল—
হোক, শেষ হয়ে যাবে আজকের এই রাত্রি, আবার আসবে রাত্রি, রাত্রির পর রাত্রি। এমনি কত রাত্রি পার হয়ে যাবে আর আমরা চলবো এগিয়ে বন্ধনহীন যাত্রী। সেই কবিতাটি জান—
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী
* * *
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন
নাইরে ঘরের লালন-ললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তি প্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।
হঠাৎ সোঁ সোঁ শব্দে হাওয়া বইল, ঝমঝম্ বৃষ্টি হলো শুরু।
গাড়ির কাচটা তুলে দিতে দিতে কাবেরী বলে, জোরে বৃষ্টি নামল যে—
নামুক। নামুক–আকাশ ভেঙে নামুক–
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, সোঁ সোঁ করে বইছে ক্ষ্যাপা হাওয়া। নিজের ঘরের খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে কবিতা আওড়াচ্ছেন। ঝোড়ো হাওয়ায় রুক্ষ এলোমেলো বড় বড় চুলগুলো উড়ছে। ঘরের কাগজপত্র, পর্দা উড়ে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সঞ্জীব চৌধুরী আবৃত্তি করছেন নিম্নস্বরে—
A dungeon horrible, on all sides round,
As one great furnace flamed; yet from those flames
No light, but rather darkness visible.
Served only to discover sights of woe,
Regions of sorrow, doleful shades, where peace
And rest can never dwell, hope never comes
That comes to all; but torture without end–
ঘুমাতে যায় নি অত রাত্রেও কৃষ্ণা, বাইরের ঘরে একাকী চুপটি করে বসে, একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছিল কাবেরীর প্রতীক্ষ্ণয়।
এত রাত হয়ে গেল, এখনো কাবেরী ফিরে এলো না!
বইটা সোফার উপরে রেখে দিয়ে জানালাপথে গিয়ে দেখে এলো একবার, কাবেরী আসছে কিনা। সঞ্জীবের আবৃত্তি থেমে গিয়েছে, শোনা যাচ্ছে বেহালার সুর। সঞ্জীব বেহালা বাজাচ্ছেন।
দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
কে?
দিদি আমি কাবি, দরজাটা খোল।
কৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
কাবেরীর সর্বাঙ্গ ভিজা।
এত রাত করলি কেন?
হঠাৎ বৃষ্টি নামল দেখে ডাক্তার গুপ্ত আসতে দিলেন না। বলতে বলতে কাবেরী এগিয়ে যায় শয়নকক্ষের দিকে।
কাবি?
কি? কাবেরী ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণার ডাকে।
কটা রাত হয়েছে খেয়াল আছে কি?
হাতে যখন ঘড়ি আছে এবং চোখের দৃষ্টিও যখন নষ্ট হয়ে যায় নি এখনো—
কাবেরী! কৃষ্ণা তীক্ষ্ণ চাপা কণ্ঠে ডেকে ওঠে।
দেখো দিদি—ফিরে দাঁড়ায় কাবেরী, আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি একটু কম মাথা ঘামালেই সুখী হবো, mind your own business! বলে দৃঢ় পদবিক্ষেপে কাবেরী কক্ষান্তরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাবেরীর গমনপথের দিকে কৃষ্ণা।
পাশের ঘরে সঞ্জীবের বেহালা সুরের ঝঙ্কা তুলেছে তখন। কড়কড়াৎ শব্দে মেঘের হুঙ্কার চারিদিক সচকিত করে গেল।
***
তাজ হোটেলে সেই রাত্রে।
দামী স্যুট পরিধানে এক দীর্ঘকায় পাঠান অধীর আগ্রহে একটি চেয়ারের উপরে বসে ঘন ঘন বন্ধ দরজাটির দিকে তাকাচ্ছে আর মণিবন্ধের ঘড়ি দেখছে।
এমন সময় পূর্ব-পরিচিত সেই পাঠানটি কক্ষে প্রবেশ করে উপবিষ্ট পাঠানকে দেখে সসম্রমে দাঁড়িয়ে পড়ে, আপ–
হাঁ, কুছ পাত্তা মিলা ফৈয়াজ?
আভিতক ঠিক ঠিক পাত্তা নেহি মিলা জনাব। কৌসি ত ম্যায় কর রাহা হুঁ।–
কর রাহা হুঁ–কর রাহা হুঁ! ও বাত ত বহুৎ দফে শুন চুকা। ফিরভি শুননা নেহি চাতা! জলদি হামে ও মিলনা চাহি, সমঝা—
লেকেন–
দেখো আউর দশ রোজ তুমহে time দিয়া যায় গা। দশ দিনকা অন্দর-অন্দর নেহি ও সামানকো ফায়সলা কর সেকে ত, হামেভি দোসরা কই নওজোয়ান কো এ কামকে লিয়ে ভেজনা পড়ে গা, সমঝা?
জি—
আচ্ছা ত ম্যায় চলতা। রূপেয়াকা কোই জরুরৎ হো ত—
নেহি—
পাঠান ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ফৈয়াজ ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে। নিম্নস্বরে আত্মগতভাবে বলে, ওহি—জরুর ওহি হোগি। খপসুরৎ লেড়কী—
***
ডাঃ গুপ্তর চেম্বার।
ডাক্তারের চেম্বারে আজ বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সমগ্র কক্ষটি, দেওয়াল হতে শুরু করে মেঝে আসবাবপত্র সব কিছু কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারের টেবিলটির ওপরেও কালো টেবিলক্লথ বিস্তৃত এবং সেই টেবিলের উপরে সাদা হাড়ের তৈরী একটি অপূর্ব প্রতিমূর্তি : একটি পুরুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পশ্চাৎ হতে একটি নারীমূর্তি পুরুষটির পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে একটা তীক্ষ্ণ ছোরা তুলেছে।
ঘরের এক কোণায় জ্বলছে কেবল একটি লাল আলো স্বল্পশক্তির। রক্তাভ সেই আলোর দ্যুতি সমগ্ৰ কক্ষখানিকে যেন ভৌতিক এক বিভীষিকায় থমথমে করে তুলেছে। টেবিলের একধারে লাউডস্পীকার-সংযুক্ত একটা গ্রামোফোনে একটি রেকর্ড প্লেটের ওপরে বসানো। সাউণ্ড বক্সটাও রেডি করা আছে, মুহূর্তে ইচ্ছামত রেকর্ডটি বাজানো চলতে পারে।
ডাক্তার মধ্যে মধ্যে হাতঘড়িটা দেখছে।
ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা বাজল। সুইংডোরে মৃদু করাঘাত শোনা গেল, আসতে পারি?
আসুন।
কক্ষে এসে প্রবেশ করল কাবেরী।
সাদা জরির পাড় দেওয়া কালো সিল্কের একখানি শাড়ি পরিধানে, গায়ে কালো রংয়ের সাদা জরির বর্ডার দেওয়া টাইট-হাতা ব্লাউজ। মাথার চুল বেণীবদ্ধ, বক্ষের দুপাশে লম্বমান।
এ কি, ঘরে এমন আলো কেন?
বোস কাবেরী। ঐ চেয়ারটার ওপরে আরাম করে বোস।
কাবেরী নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।
আবছা আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট ছায়ার মত ডাঃ সুকুমারকে দেখা যায়, গায়ে বোধ হয় একটা কালো অ্যাপ্রন। অ্যাপ্রনটার বুকের কাছে সোনালী জরি দিয়ে বীভৎস একটা ড্রাগনের মূর্তি তোলা।
ডাঃ গুপ্ত! ভীত একটা শঙ্কিত সুর যেন কাবেরীর কণ্ঠ হতে বের হয়।
Feeling nervous?
নার্ভাস! না–মানে–
We wont take much time কাবেরী। আজ কয়েকটা প্রশ্ন পর পর তোমাকে করে যাবো, তুমি প্রশ্নের পিঠে পিঠে যেমন মনে হবে জবাব দিয়ে যাবে, বুঝতে পেরেছো?
ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় কাবেরী, হুঁ।
বেশ। Ready?
Ready!
ফুল?
গন্ধ।
কীট?
পতঙ্গ।
নর?
নারী।
চাঁদ?
জ্যোৎস্না।
রাত্রি?
দিন।
পতঙ্গ?
পাখী।
দর্পণ?
প্রতিচ্ছায়া।
ড্যাগার?
সোর্ড।
প্রশ্নোত্তরের পর কাবেরীর সর্বশরীরকে যেন অসহ্য একটা ঘুমের ক্লান্তি ও শৈথিল্য আচ্ছন্ন করে ফেলে। যে চেয়ারটার ওপরে কাবেরী এতক্ষণ বসেছিল, সেই চেয়ারটারই গায়ে অবশভাবে শরীরটা এলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।
ডাঃ সুকুমার চেয়ারের ওপরে এলায়িত কাবেরীর সামনে আরো একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।
কাবেরীর চোখের পাতা দুটো নিমীলিত।
সুকুমার কিছুক্ষণ চেয়ারের ওপরে এলায়িত, মুদ্রিত চক্ষু কাবেরীর প্রতি চেয়ে থেকে ধীরে মৃদুকণ্ঠে ডাকে, মিস্ চৌধুরী! কাবেরী দেবী!
উঁ! ক্ষীণকণ্ঠে সাড়া দেয় কাবেরী।
খুব ক্লান্তি বোধ করছে, না?
হ্যাঁ, ঘুম আসছে—
ঘুমাও, ঘুমাবার চেষ্টা কর। হাঁ ঘুমাও–
একাগ্র তীক্ষ্ণদৃষ্টি ডাঃ সুকুমারের চোখে। অন্ধকারে জন্তুর চোখের মত জ্বল জ্বল করে ডাক্তারের চোখের মণি দুটো জ্বলছে যেন। গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, কিন্তু পাথরের মতো স্থির, অচঞ্চল।
Sleep-sleep Kaberi!
কাবেরীর মাথাটা আরো একটু ঝুলে পড়ে।
ডাক্তারের কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, কাবেরী?
উঁ! বহুদূর হতে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আবার।
এই পৃথিবীতেই এমন একটা জায়গা আছে যেখানে ছয় মাস থাকে দিনের আলো আর ছয় মাস থাকে রাত্রির জমাট কালো অন্ধকার। চারিদিকে শুধু জমাটবাঁধা ঠাণ্ডা বরফ। হু-হু করে বইছে যেখানে অবিশ্রাম হিমতীক্ষ্ণ ক্ষ্যাপা এলোমেলো হাওয়া। কোথাও সেখানে ফুলের কোন সমারোহ নেই-বর্ণের সাত রঙের খেলা প্রজাপতির মন ভোলানো অস্তিত্ব নেই। নেই মধুপের মধুগুঞ্জন। শীল মাছ, শ্বেত ভল্লুক আর বড় বড় শিংওয়ালা হরিণ। জনহীন জমাটবাঁধা বরফের সেই নিঃশব্দ নির্জনতায় মাঝে মাঝে শোনা যায় শ্বেত ভল্লুকের ক্ষুধার্ত চিৎকার—
কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে একসময় ডাক্তার পার্শ্বেই রক্ষিত অ্যাপ্লিফায়ার সংযুক্ত গ্রামোফোনে, ইংরেজী শব্দময় বাজনার একটা রেকর্ড যেটা আগে বসানো ছিল, সেটা চালিয়ে দিয়ে আবার বলতে থাকে? আহারের কোন সংস্থান নেই নেই কোন খাদ্যবস্তু, একমাত্র ঐ শীল মাছ ছাড়া। তাই ওদেশের লোকেরা তীক্ষ্ণ ধারালো ছোরা চালিয়ে শীল শিকার করে, হরিণ শিকার করে—ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে রক্তাভ হাতে
সহসা রেকর্ড বেজে উঠলো মুহূর্তে যেন। ঝম্ ঝম্ করে তীব্র বাজনার শব্দ ঝঙ্কৃত, শায়িত করে তোলে সমগ্র কক্ষখানিকে মুহূর্তে।
সহসা একটা আর্ত চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় কাবেরী, না! না! না!
কি হলো? কি হলো কাবেরী? ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ডাঃ সুকুমার।
কাবেরী ততক্ষণে নিজের বিহ্বল, ভয়ার্ত ভাবটা সামলে উঠেছে। বড় রকমের একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, কিছু না। আমি বড্ড ক্লান্ত—feeling extremely tired! আমি এবারে যেতে চাই ডাঃ গুপ্ত।
চল, আমার ড্রাইভার তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে—
না, না—তার কোন প্রয়োজন নেই, হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। আমি, আমি আমি একাই বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।
না, তোমাকে সত্যিই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে—তা ছাড়া ডাক্তার হিসাবে আমার একটা কর্তব্যও তো আছে—চল।
কাবেরী ডাক্তারের কথায় আর আপত্তি করে না।
আর আপত্তি করার মত শক্তিও তার ছিল না তখন।
নিচে এসে ড্রাইভারকে ডেকে ডাক্তার কাবেরীকে গাড়িতে তুলে দিল এবং ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিল, মেমসাবকো সিধা কোঠি পৌঁছা দেনা লছমন্।
জি সাব্।
আপনার ফিস্টা মিস্ চৌধুরী–
ডাক্তার পকেট হতে দশ টাকার দশখানা নোট গাড়ির জানালাপথে এগিয়ে দিল কাবেরীর দিকে।
কাবেরী কুণ্ঠার সঙ্গে নোটগুলো হাতে নেয়।
আচ্ছা Good Night!
Good Night। মৃদুকণ্ঠে কাবেরী জবাব দিলে।
গাড়ি চলে গেল।
কাবেরীকে বিদায় দিয়ে সুকুমার চেম্বারে আবার যখন ফিরে এলো, দেখলে কিরীটী একটা সোফার ওপরে বসে পায়ের ওপরে পা তুলে দিয়ে চোখ বুজে একটা বর্মা সিগার নিঃশব্দে টানছে। সিগারের তীব্র কটু গন্ধ কক্ষের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুকুমারের পদশব্দে চোখ খুলেই এবং দাঁত দিয়ে সিগারটা চেপে ধরে কিরীটী বললে, কাবেরী দেবী চলে গেলেন?
সুকুমার সিগারেট কেসটা পকেট হতে বের করে, একটা সিগারেট নিয়ে ওষ্ঠের ফাঁকে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, হুঁ। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি হলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাবেরী অমন হিস্টিরিক ব্যবহার করলে কেন?
মনস্তাত্ত্বিক তুমি ডাক্তার, বোঝা উচিত ছিল। রোমান্টিক মাইণ্ড!
রোমান্টিক মাইণ্ড সে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু—
আবার তবে কিন্তু কেন? ভাবুক মনের কল্পনাবিলাস বা স্বপ্ন—
কিন্তু একটা কথা–
কি?
So far তোমার কাজ excellent! চমৎকার। কিন্তু এবারে তোমাকে একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে।
মানে?
মানে–প্রেমের ব্যাপারে দুটির সঙ্গেই তোমার আরো একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে। যদিচ সেটা বিশেষ তোমার মত তরুণের পক্ষে জানি নিদারুণ risky খেলা—
কি বলছিস কি?
আহা অবোধ শিশুটি রে! কিছু যেন বুঝতে পারছেন না! শোন হে মনস্তাত্ত্বিক, অবশ্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি একটি ভগিনীর প্রেমে আপাততঃ তুমি যদিচ হাবুড়ুবু নদের নিমাই—দ্বিতীয়টির সঙ্গেও নদের নিমাইদের অভিনয় করতে হবে।
আঃ, কি হচ্ছে সব!
মধুর! মধুর! কিন্তু সত্য কথা বলতে ভাই, কে? কৃষা না কাবেরী? সুকুমার কিরীটীর প্রশ্নের জবাব দেবে কি, নিজেই এখনো মনের মধ্যে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি, সত্যি কোন জন ওর হৃদয়কে আকর্ষণ করেছে!
কৃষ্ণা, না কাবেরী?
হৃদয় যেন দুলছে একবার এদিক, একবার ওদিক। এক বৃন্তে দুটি ফুল যেন দুটি বোন। মনকে কখনো আকর্ষণ করে কাবেরী, কখনো কৃষ্ণা। দ্বিধা-সংশয়ে দোলে মন।
কি? জবাব দিচ্ছিস না যে? নির্বাক-হতবাক যে!
কি বলবো তাই ভাবছি—
হুঁ। তা বন্ধু, বলি সাবধান! পূর্বকালে শাস্ত্রে বিষকন্যা বলে এক ধরনের কন্যার কথা শোনা যায়। পাতঞ্জলির শাস্ত্রে খুঁজলেই পাবে। এবং শোনা যায় ঐ অপূর্ব, মনোমোহিনী কন্যাদের স্পর্শেই নাকি মৃত্যু ঘটতো। কন্যার দেহ হতে বিষ সংক্রামিত হতো হতভাগ্য রূপমুগ্ধ প্রেমিকের দেহে। কৃষ্ণা ও কাবেরী তোমার ওই দুটি মানসপ্রিয়ার একটি কিন্তু কলির বিষকন্যা। অতএব সাবধান বন্ধু সাবধান
কি আবোল-তাবোল সব বকছিস? এখুনি হয়ত কৃষ্ণা আসবে—তারও আজ রাত্রেই sitting দেবার কথা—
অর্থাৎ বলতে চাও, তুমি যাও! কিন্তু বন্ধু, দ্বিতীয় সিটিংয়েও যে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে!
সত্যি এমন সময় সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল।
ঐ বোধ হয় আসছেন কৃষ্ণা দেবী—অতএব কিরীটী এবারে তুমি অন্তরালে আত্মগোপন করো—বলতে বলতে মৃদু হেসে কিরীটী উঠে পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করে।
কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণার দেহসজ্জায়ও আজ নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়—তবে সহজ ও সরল। কৃষ্ণারও আজ সাধারণ গেরুয়া রংয়ের শাড়ি ও ব্লাউজ পরিধানে—মাথার পর্যাপ্ত চুল বেণীর আকারে পীনোন্নত বক্ষের দুটি পাশে লম্বমান।
এসো–এসো কৃষ্ণা! সাদর আহ্বান জানায় ডাক্তার।
আজকের sittingয়ের সময়টা এত রাত্রে করলেন কেন ডাঃ গুপ্ত?
উপায় ছিল না।
একই পরিবেশের মধ্যে একই প্রশ্ন করা হয় কৃষ্ণাকেও।
বোস–দাঁড়িয়ে কেন কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা উপবেশন করে কক্ষের চতুর্দিকে একবার তাকায়।
কি দেখছো?
কিছু না।
Ready?
Yes!
ফুল?
কীট।
নর?
বানর।
চাদ?
সূর্য।
রাত্রি?
অন্ধকার।
পতঙ্গ?
আরশুলা।
দর্পণ?
ছায়া।
ড্যাগার?
ডেথ।
পূর্বের মতই দপ করে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো ঘরে ও বাজনা বেজে ওঠে। ক্ষণপূর্বের আলোছায়ার রহস্য দূরীভূত হলো।
কৃষ্ণা শুনতে থাকে বাজনাটা, কি অদ্ভুত সব আবোল-তাবোল প্রশ্ন আজ আপনি করছিলেন বলুন তো ডাক্তার? জোরালো গলায় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।
সুকুমার মৃদু মৃদু হাসতে থাকে, কৃষার প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।
আবার একসময় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আমাদের নিয়ে যে গবেষণা আপনার চলছে, কতদূর successful হলো বলুন তো? এও কি কখনও সম্ভব নাকি, মানুষের মনের গতি বা সুপ্ত ও জাগ্রত প্রবৃত্তিকে অনুশীলন করে, এই প্রকারের বিভিন্ন দুজন মানুষ নর বা নারী একজন হতে অন্যজনের identityতে আসতে পারবেন?
কেন সম্ভব নয় বল? ডাক্তার মৃদু হেসে কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকায়।
ধরুন আমি একবার যদি কৃষ্ণা, আবার একবার কাবেরী বলে নিজের পরিচয় দিই এবং আমরা দুটি বোন পরস্পর পরস্পরকে যতটা closely study করবার সুযোগ বা সুবিধা পেয়েছি সেই হতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে যতটা ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ ভাবে চিনি ও জানি সেদিক থেকে আমরা একে অন্যের কথাবার্তা, হাবভাব, চালচলন একই ভাবে প্রকাশ করলে, সাধ্য কি কেউ তা জানতে পারে?
তোমার কথা যে কতকটা সত্য অস্বীকার করি না কৃষ্ণা, কিন্তু এও ঠিক, প্রত্যেক মানুষের। অবচেতন মনে যে প্রবৃত্তিগুলো জন্মগতভাবে সুপ্ত থাকে, অনেক সময় নিজের অজ্ঞাতে চিন্তায় ভাবে ও প্রবৃত্তিতে প্রকাশ হতে দেখা যায়। মানুষ তার পরিবেষ্টনী ও অবচেতন চিন্তার দ্বারা নিজের অজ্ঞাতেই অনেক ক্ষেত্রে চালিত হয়ে থাকে এ কথা কি অস্বীকার কর কৃষ্ণা! ডাক্তার তার বক্তব্য শেষ করে।
না।
তবে?
হঠাৎ ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটা ঘোষণা করল দেওয়াল-ঘড়িতে।
কৃষ্ণা চমকে উঠে দাঁড়ায়, উঃ অনেক রাত হয়ে গেল!
আমার গাড়ি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে কৃষ্ণা।
না, প্রয়োজন নেই, রাস্তা থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেবোখন।
না। এত রাত্রে একাকী তোমার ট্যাক্সি করে যাওয়া উচিত হবে না, তা ছাড়া তোমার বাবা শুনলেও হয়ত অসন্তুষ্ট হবেন।
বাবা! হ্যাঁ, তা হবেন—কথাটা যেন অন্যমনস্কের মতই বলে কৃষ্ণা কতকটা আত্মগতভাবেই।
তারপর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন কৃষ্ণার বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো কৃষ্ণা, অবশ্য যদি মনে কিছু না করো—
কি?
তোমার বাবার সম্পর্কে যখনই কোন কথা উঠেছে তুমি যেন–
না, না—ওকথা থাক ডাঃ গুপ্ত, আমি এবারে যাবো—
বলতে বলতে সহসা যেন উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণা।
হ্যাঁ, চল—
কৃষ্ণাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সুকুমার ড্রাইভারকে বলে, ওহি কোঠি পরই মেমসাবকো ভি পৌঁছা দেনা লছমন্।
জি।
গাড়ি চলে গেল। অন্ধকারে ক্রমবিলীয়মান গাড়ির লাল টেইল লাইটটার দিকে তাকিয়ে করিডোরেই দাঁড়িয়ে থাকে সুকুমার।
সহসা কিরীটীর ডাকে ও চমকে ওঠে, এবারে আমিও গুডনাইট জানাবো ডাক্তার।
যাবি?
হ্যাঁ, ধ্যানের সময় আর যাই হোক দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিও ভাল লাগবে না।
একটা কথা কিরীটী—
বল্।
আচ্ছা কৃষ্ণা কাবেরী বোন দুটি সম্পর্কে তোমার ধারণা মানে মতামত কি?
দেখ, তোর প্রতিদিনকার সিটিংয়ের রিপোর্ট পড়ে এবং ওদের সম্পর্কে তোর মতামত শুনে ও আজকের ব্যাপার দেখে আমরা একটা যাহোক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।
কি?
কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ বোন দুটির মনোগত চিন্তা বা প্রবৃত্তির মধ্যে সুস্পষ্ট একটা পার্থক্য আছে স্বীকার করিস, না করিস না?
সে তো নিশ্চয়ই–কিন্তু–
হ্যাঁ, পরস্পরের মধ্যে তাদের যতই similarity থাকুক না কেন, চিন্তাধারা ও প্রবৃত্তির দিক হতে কতকগুলো জায়গায় they distinctly differ from each other—অর্থাৎ একে অন্য হতে বিশেষ ভাবেই পৃথক। কিন্তু সে কথার আগে একটা প্রশ্ন, এদের এতদিন ধরে study করে নিজস্ব নিশ্চয়ই তোর একটা মতামত গড়ে উঠেছে—সেটা কি বল তো?
একটু যেন চিন্তা করে সুকুমার বলে, আমার মনে হয় কৃষ্ণা ও কাবেরী দুটি বোনের মধ্যে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, তীক্ষ্ণ ও চতুর—অথবা একেবারে নিরেট, আর তা না হলে একজন চতুর ও বুদ্ধিমতী হয়েও বোকার অভিনয় করে চলেছে এবং অন্যজন সত্যই হয়ত খুব নিরীহ, সরল, শান্তশিষ্ট ও একটু ভীতু প্রকৃতির।
তোমার কথা যে একেবারে মিথ্যা জোর গলায় বলতে পারি না ডাক্তার। অবশ্য আমার মনে হয় যাকে তুই অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও চতুরা বলছিস—তাকে আমি বুদ্ধিমতী ও চতুরা তো বলবোই সেই সঙ্গে অতিরিক্ত রোমান্টিক মনোভাবাপন্নও বলবো এবং মনের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রোমান্স দুটোতে মিলে কিছুটা মানসিক insanity develop করেছে বলবো।
Insanity—মানসিক বৈকল্য বা বিকৃতি?
হ্যাঁ, এখানে insanity বলতে ঠিক আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, মন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও রোমান্টিক হওয়ার জন্য যে এক ধরনের মানসিক পরিবর্তন ঘটে তাই and nothing more কিন্তু সে কথা যাক, definite প্রমাণ বা প্র ছাড়া তো আজকের দিনে কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করানো যেতে পারে না। আমরা দুটি বোনের মানসিক ও প্রকৃতির পরিচয় কিছুটা পেয়েছি মাত্র কিন্তু আসলে ঐ যমজ দুটি ভগ্নীর মধ্যে কোন্ জন সত্যি করে নিহত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল সে সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বর্তমান সমস্যা এক পা-ও এগুচ্ছে না। যে জট ওদের দুটি বোনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সমস্যাকে ঘোরালো করে রেখেছে সে জট এতটুকুও খুলছে না।
কোন উপায়ই কি খুঁজে পাচ্ছিস না?
পেতে হবেই কিন্তু তার আগে আরো একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজের ভার তোর ওপরে আমি দিয়ে যেতে চাই।
আবার কি কাজ?
That mysterious father of কৃষ্ণা কাবেরী—হ্যাঁ, কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ ভদ্রলোকটি যেন নিজেকে একটা কুহেলীর আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছেন; যতটুকু আজ পর্যন্ত ভদ্রলোকটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, লোকটা ঘরের মধ্যে দিবারাত্র নিজেকে বন্দী করে রাখে, কারো সঙ্গে দেখা করে না, কথা বলে না, মেয়ে দুটির উপরে অসাধারণ একটা আধিপত্য ভদ্রলোকের, যার মধ্যে হয়তো আছে একটু হিংসা, একটু ভয়, একটু সন্দেহ ও একটু আশঙ্কা এবং সব কিছু মিলে রহস্যঘেরা বিকৃত ও অস্বাভাবিক একটা সংশয়।
এত সংবাদ তুই পেলি কোথা হতে?
পাওয়াটাই যে আমার কাজ—হাঁ বলছিলাম, শুধু তাই নয়, ভদ্রলোকের একটা পা paralytic, ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, সেক্সপীয়ার, মিল্টন, কীটস নিয়ে ও মদ্যপান করে সময় কাটান। সব কিছুতে মিলে একটা মিস্ত্রি, একটা কিউরিও। একটু থেমে আবার বলে, হয়ত ঐ পিতার রহস্যের সঙ্গেই কন্যা দুটিরও অনেক রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে—অতএব তোকে ঐ বোন দুটির কাছ হতে যেমন করে হোক পিতা ও মেয়ে দুটির মধ্যে আসল ও সত্যিকারের সম্পর্কটুকু খুঁজে বের করে আনতে হবে, পারবি না?
আমি তো বুঝতে পারছি না–কি করে তা সম্ভব হবে?
কেন? প্রেম দিয়ে বন্ধু চিনিয়া লইও তোমার বঁধুর সে হৃদয়খানি।
.
ভিটোরিয়া মেমোরিয়াল-এর বাগানে নিরিবিলি একটা বৃক্ষতল। অদূরে গাছের নীচে দাঁড় করানো আছে ডাঃ সুকুমার গুপ্তর গাড়ি। পাশাপাশি বসে সুকুমার ও কৃষ্ণা।
একটা ঘাসের শীষ দাঁত দিয়ে কাটছে আনমনে কৃষ্ণা। সাধারণ পিঁয়াজী রংয়ের ব্লাউজ ও শাড়ি পরিধানে কৃষ্ণার, মাথার চুল এলো খোঁপার আকারে বাঁ কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়েছে।
কি ভাবছেন ডাঃ গুপ্ত? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে। টী করছো।
বেশ, তুমি বললে যদি আপনি সুখী হন তুমিই বলবো।
কথাটা বলতে বলতে কৃষ্ণা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
কি ভাবছো? ডাক্তার প্রশ্ন করে।
ভাবছি এর চাইতে তোমার আমার পরিচয় না হলেই ভাল ছিল—
এ কথা কেন বলছো? এক-এক সময় তোমার হাবভাব দেখে মনে হয়, কি একটা গভীর সংশয় যেন দিবারাত্র তোমায় পীড়া দিচ্ছে। আমাকে সব কথা খুলে বল, এমনও তো হতে পারে তোমায় আমি সাহায্য করতে পারি।
না, না—তুমি জান না, তুমি তো জান না, কত বড় একটা দুঃস্বপ্ন দিবারাত্র ছায়ার মতোই আমাকে অনুসরণ করে ফেরে।
কৃষ্ণা আবার যেন অন্যমনস্ক, চিন্তিত হয়ে যায়।
শোন। সেদিনও তোমাকে বলেছি, আজও আবার বলছি আমি তোমার বাবার সঙ্গে একবার—
না, না—কতকটা আর্ত আকুল কণ্ঠেই যেন বলে ওঠে কৃষ্ণা, ও কাজও তুমি করো না, বাবাকে তুমি চেন না। মত তো তিনি দেবেনই না, আর এ জীবনে আমাদের পরস্পরের এই দেখাসাক্ষাৎ, এও তিনি চিরজীবনের মত বন্ধ করে দেবেন হয়ত।
কিন্তু চিরদিনই কি তাহলে আমাদের এমনি করেই লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে? প্রকাশ্যে তোমাকে কোনদিনই দাবী করতে পারবো না?
.
কলকাতা শহরের চৌরঙ্গী অঞ্চলে সুবিখ্যাত একটি ইংলিশ হোটেলের মধ্যে। আলোকিত হোটেলটি। বহু নরনারী একত্র বা জোড়া টেবিলে বসে পান ও আহার করছে। হোটেলের এক পাশে ইংরাজী বাজনা বাজছে নানা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে। একটি কর্ণার সীটে মুখোমুখি বসে কাবেরী ও সুবিমল, সামনের টেবিলের উপরে রক্ষিত কেক চা ইত্যাদি। সুবিমলের পরিধানে সাহেবী পোশাক।
চা পান করতে করতে সুবিমল বলছিল, সত্যি বলতে পারো, এমনি করে কতকাল আর আমাদের লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে?
কি করব বল! তবু দেখাশুনাটাও তো হচ্ছে কাবেরী জবাব দেয়।
কিন্তু মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছো, বিবাহ তো একদিন মেয়ের দিতেই হবে—তবে তোমার বাবার তোমাদের বিবাহে এত আপত্তিই বা কিসের?
বুঝতে পারি না, কেন বাবা কোন পুরুষের সঙ্গেই আমাদের মিশতে দেন না। এমন কি সেদিন রাত্রের sittingয়ের পর বাড়িতে ফিরে গেলে ডাক্তারের চেম্বারে যেতেও সেদিন হতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তোমার সঙ্গে মিশি একথা ঘুণাক্ষরে জানতে পারলেও আর রক্ষা রাখবেন না।
কিন্তু এ অত্যাচার! সত্যি, ক্রমেই যেন এ আমার অসহ্য ঠেকছে। চলো—তার চাইতে না হয় আমরা বিবাহ করে তারপর তোমার বাবার কাছে
না না, এত তাড়াতাড়ি বিবাহ আমাদের হতেই পারে না। বাবা আমাদের বাবাকে তুমি জান না, তিনি আমাকে কিছুতেই তা হলে ক্ষমা করবেন না। আর তার ক্রোধ! না না, সে আমি ভাবতেও পারি না। তুমি—তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
এমন সময় দীর্ঘকায় ফৈয়াজ, পরিধানে সাহেবী পোশাক আর চোখে কালো কাচের চশমা, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হোটেলে এসে প্রবেশ করল। এবং সহসা কাবেরী ও সুবিমলের উপর নজর পড়তেই ওদের অল্প দূরে একটা চেয়ারে এসে উপবেশন করে ভারী গলায় ডাকল, বোয়!
বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল, টি অ্যাণ্ড স্যাণ্ডউইচ।
বেয়ারা সেলাম দিয়ে চলে গেল।
ফৈয়াজ একটা পাইপ ধরিয়ে ধূমোদগীরণ করতে থাকে।
তোমাদের দুই বোনেরই তোমাদের বাবা সম্পর্কে এমন একটা আতঙ্ক কেন বল তো? হাজার হলেও তিনি তো তোমাদেরই বাপ-তোমরা তার সন্তান—আবার এক সময় সুবিমল বলে।
হ্যাঁ, কিন্তু না—বাবার অমতে কোন কিছু করা অসম্ভব, তাছাড়া বাকী কথাগুলো আর কাবেরী শেষ করে না, সহসা অদূরে পাঠানটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে কাবেরী।
অধীর কণ্ঠে বলে ওঠে, চল—আমরা যাই।
এখনি উঠবে? আর একটু বসবে না?
না চল। ওঠ। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়।
বয়—বিল লাও। সুবিমল বেয়ারাকে ডাকে।
.
পরের দিন প্রত্যুষে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের কক্ষ।
কৃয়া বসে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছে, কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল, চোখে মুখে বেশভূষায় সদ্য নিদ্রাভঙ্গের সুস্পষ্ট চিহ্ন। আজকাল কিছুদিন থেকে দুই বোনের নিবিড় একাত্মবোধ ও অন্তরঙ্গতার মধ্যে যেন একটা চিড় খেয়েছে। স্পষ্টভাবেই আজকাল যেন পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।
কাল অত রাত করে ফিরলি যে কাবি! অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলি?
একটা হাই তুলে সোফাটার উপর বসতে বসতে কাবেরী বলে, গিয়েছিলাম—
গিয়েছিলি তা তো জানিই, কিন্তু কোথায় অত রাত পর্যন্ত ছিলি তাই তো জিজ্ঞাসা করছি।
ডাঃ গুপ্তর ওখানে।
সংবাদপত্র হতে মুখ তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে কৃষ্ণা কাবেরীর মুখের দিকে তাকাল।
Sitting ছিল বুঝি?
না।
তবে?
তবে আবার কি? পরিচিত লোকদের সঙ্গে একমাত্র কাজ না থাকলে কি আর দেখাসাক্ষাৎ করা যেতে পারে না? এমনি একটা social call!
বাবা না নিষেধ করে দিয়েছিলেন সেখানে যেতে! আশা করি ভুলে যাস নি এত তাড়াতাড়ি–
না, ভুলবো কেন? স্মৃতিশক্তি আমার এখনো এত ক্ষীণ হয় নি যে—
সহসা এমন সময় কক্ষের আর্শিতে সঞ্জীবের ছায়াপাত হলো।
ক্রাচে ভর দিয়ে ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে ওদের অলক্ষ্যে সঞ্জীব দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন ওরা দুজনার একজনও টের পায় নি।
স্মৃতিশক্তি তোমার অবশ্য তা হলে প্রশংসনীয়ই বলতে হবে কাবেরী—
যুগপৎ দুই বোনই চম্কে ফিরে তাকালো এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
অস্ফুট শব্দ দুজনারই কণ্ঠ হতে নির্গত হলো, বাবা!
সঞ্জীব ক্রাচে ভর দিতে দিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন।
তাহলে আবার তুমি ডাক্তারের ওখানে গিয়েছিলে কাবি! আশ্চর্য, আমার আদেশ অমান্য করতে সাহস করো! সঞ্জীবের চোখের মণি দুটোতে অদ্ভুত একটা আলো দেখা দেয়, হিংস্র কুটিল।
সভয়ে কৃষ্ণা বলে ওঠে, বাবা!
কি? জবাব দিচ্ছ না যে? আবার সঞ্জীবের কণ্ঠ শোনা গেল। কঠিন নির্মম।
আমি—
সহসা বোমার মতই ফেটে পড়েন সঞ্জীব—আমি! আমি কি? কেন–কেন আমার নিষেধ সত্ত্বেও ফের আবার ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বারে গিয়েছিলে? বল—জবাব দাও!
কাবেরী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন জবাব দিতেই বোধ হয় সাহস পায় না। সঞ্জীবের দুচক্ষুর তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন কাবেরীর সর্বাঙ্গে দ্রুত পরিক্রম করছে। স্তব্ধতা। নীরেট পাষাণের স্তব্ধতা সমগ্র কক্ষখানি জুড়ে।
সহসা আবার সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বেশ, আজই ডাক্তারের কাছে কালকের দরুন ১০০ টাকার একটা বিল দেবে–
বাবা! আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে কাবেরী।
হ্যাঁ, আমার মেয়েরা বেকার নয় লোফার নয়, তাদের প্রতিটি মুহূর্তের দাম আছে।
বাবা–, আবার কাবেরী কি যেন বলবার চেষ্টা করে।
না, কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। বিল তুমি দেবেই, হ্যাঁ, এই আমার আদেশ—আমার আদেশ। বাধা দিয়ে সঞ্জীব বলে ওঠেন।
না না, আমি পারবো না, আমি তা পারবো না! রুদ্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় কাবেরী।
পাষাণের মত দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে কৃষ্ণা।
পারবে না? গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব।
না, না-পারবো না। আমি পারবো না। বলতে বলতে স্খলিত পদে কাবেরী ঘর থেকে চলে যায়।
পারবে না? কাবেরী? কাবেরী? কাবেরী? বলতে বলতে সঞ্জীব মেয়েকে অনুসরণ করতে যেতেই এতক্ষণে কৃষ্ণা এসে বাপকে দুহাতে আগলে দাঁড়ায়।
বাবা! বাবা—
কৃষ্ণা! থমকে দাঁড়ান সঞ্জীব।
বাবা-কাবি ছেলেমানুষ, ওকে ক্ষমা করুন। ও—
ক্ষমা! হাঃ হাঃ—পাগলের মতই উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন সঞ্জীব।
ক্ষমা-সঞ্জীব চৌধুরী ক্ষমা কাউকে করে না। কিন্তু আমি জানতাম, এ আমি জানতাম। রক্তের ঋণ তোমাদের শোধ করতেই যে হবে—করুণার দেহরক্তের বিষ। জানতাম, আমি জানতাম—বিষ একদিন ফেনিল হয়ে উঠবেই, তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। কেউ রোধ করতে পারবে না।
বাবা–তুমি হাঁপাচ্ছ। বসো, এই চেয়ারটার ওপরে বসো।
কৃষ্ণা সঞ্জীরকে টেনে এনে চেয়ারটার উপর বসিয়ে দেয়।
কৃষ্ণা, শোন। এ বাড়ি ছেড়ে এ শহর ছেড়ে–যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের চলে যেতে হবে।
চলে যাবে? কোথায়?
জানি না। শুধু এইটুকু জানি দূরে—দূরে–বহুদূরে।
কিন্তু–
শোন, তোমাদের আমি এতদিন বলি নি–তোমাদের অনুপস্থিতিতে দুতিনদিন রাত্রে এ বাড়িতে নিশ্চয়ই চোর এসেছে–
চোর!
হ্যাঁ, খস খস শব্দ শুনে আমি পাশের ঘরে গিয়েছি—ঘর অন্ধকার। আলো জ্বেলে কাউকে দেখতে পাই নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কোন অজানা লোক আমাদের ছায়ার মতই অলক্ষ্যে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে। তার পদশব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।
কিন্তু বাবা, তেতলার ফ্ল্যাটে যে আমরা—
বিশ্বাস কর কৃষ্ণা, এসেছে, নিশ্চয়ই কেউ এসেছে—তার স্পষ্ট পদশব্দ আমি শুনেছি। বেশী দিন নয়, নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই এ ব্যাপারটা চলেছে–
নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই! আর্তকণ্ঠে যেন চিৎকার করে বলে ওঠে কৃষ্ণা।
হাঁ।
ফ্যালফ্যাল্ করে বোবাদৃষ্টিতে কৃষ্ণা তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
.
হাঁ বাবু—কর্তাবাবু মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই রাত্রে উপরের তলায় বাবুর ঘরটার মধ্যে কি সব শব্দ শোনা যায়। কখনো মনে হয় কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, কখনো মনে হয় কেউ বা কারা যেন ঘরের সব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। শুধু আমিই নয় দাদাবাবু, হরি আর যদুও শুনেছে–
নরেন মল্লিকের বাড়িতে সকালবেলা সুবিমলের কক্ষে সুবিমল চেয়ারে বসে চা-পান করছে, সামনে দাঁড়িয়ে মধু।
মধুই কথাগুলো বলছিল।
কিন্তু এ কথা তোকই এতদিন তুমি আমাকে বল নি মধুদা!
এতদিন বলি নি দাদাবাবু, কিন্তু আর না বলে পারলাম না। হরি, যদু, ঠাকুর ওরা তো বেশ ভয় পেয়েই গেছে।
ভয় পেয়েছে?
হ্যাঁ, ওরা বলাবলি করছিল কর্তাবাবুর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে–তাঁর প্রেতাত্মা–
Nonsense! সে যাক্, এক কাজ করো, আজ থেকে ওঘরে তালা দিয়ে রেখো।
বেশ।
.
কিরীটীর বাড়িতে। কিরীটী ও তালুকদারের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল। সামনে ক্রিয়ের ওপরে কাপে চা। মধ্যে মধ্যে ওরা চা-পান করছে।
সেই লোকটার উপরে বেশ ভাল করে নজর রাখা হয়েছে তো তালুকদার?
হ্যাঁ, ভূপেন রথীন আর যতীন তিনজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রায়ই লোকটাকে নরেন মল্লিকের বাড়ির আশেপাশে ও কাবেরীদের বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।
ও লোকটার রহস্য সব জানতেই হবে। লোকটার বাড়ি, জাতি, পেশা—সব।
কিছু কিছু জেনেছি—লোকটা জাতিতে পাঠান, পেশা দালালী, ব্রোকার। থাকে Taj Hotelয়ে, একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি আছে। গাড়ির নং BLA 6786.
আর একটা কথা, সঞ্জীব চৌধুরীর অতীত ইতিহাসটা জানা গেল?
সামান্য–লোকটা এককালে আসামের এক চা-বাগানে ম্যানেজার ছিল এবং প্রচুর নগদ পয়সা ও স্থাবর সম্পত্তি কলকাতার ওপরে তিনখানা বাড়ি ছিল। এককালের নামকরা আধুনিক সমাজের মেয়ে করুণা সেনকে বিবাহ করেছিল। বিবাহের পর স্ত্রী এখানেই থাকত। লোকটার মাঝখানের দীর্ঘ ১৫ বছরের ইতিহাসটা শুধু এখনো জানা যায় নি।
বেশ। আর সুবিমল? তার ওপরেও নজর রেখেছ তো?
হ্যাঁ, এইটুকু বোঝা গিয়েছে, দুটি বোনের একটির সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। কিন্তু দুটি বোনকেই হুবহু একই রকম দেখতে হওয়ায় আমার লোকেরা এখনো স্থির করতে পারে নি কোন্ বোনটি আসলে সুবিমলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠা। ভাল কথা, তোমাদের ডাক্তার গুপ্ত কি বলেন?
আপাততঃ সে বেচারীও হর্নস অব এ ডায়লেমাতে পড়েছে হাসতে হাসতে জবাব দেয় কিরীটী।
কি রকম?
হ্যাঁ, বেচারী এখনও ঠিক করেই উঠতে পারে নি কার প্রেমে সত্যি সত্যি পড়লো!
ইনটারেস্টিং তো!
তা একটু বৈকি, কিন্তু সে যাক্-একটা কথা—
কি?
নিহত নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষটা আরো একবার ভালো করে তন্ন তন্ন করে আমাদের সার্চ করতে হবে অর্থাৎ সেই ঘরের আলমারি, ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদিগুলো।
হঠাৎ ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদি—কোন কিছু পাওয়া যাবে আশা করো নাকি?
একেবারে করি না বললে সত্যের অপলাপই করা হবে বৈকি।
যদি কিছু না মনে কর তো আরো একটু যদি বিশদভাবে খুলে বল।
কত কি-ই তো পাওয়া যেতে পারে, যেমন ধরো চিঠিপত্র কিংবা কোন মূল্যবান কাগজপত্র বা অন্য ধরনের কিছু–
হুঁ, বুঝেছি।
৩. নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ
নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ থেকে ফিরবার পর থেকেই কয়েক দিন ধরে কিরীটীর সমস্ত ঘটনার মধ্যে এবং মল্লিক-গৃহে যে যে মুখগুলি কিরীটী দেখেছিল তাদের মধ্যে বিশেষ একটি মুখ—যেটা তার দেখবার সৌভাগ্য হলো না, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢাকাই ছিল, সেই অদেখা মুখখানির কথাই বার বার তার মনে পড়ছিল। মুখখানি কেমন কে জানে! তবে দেহের রং ও হাতের পায়ের ও দেহের গঠন দেখে মনে হয় মুখখানি নিশ্চয় ছিল সুন্দর।
কিন্তু সুন্দরই যদি মুখখানি হবে তবে তাকে সর্বদা সযতনে অবগুণ্ঠনে ঢেকে রাখবার টী বলতে কেউ তো দেখে নি বা শোনেই নি, এমন কি কেউ তার অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানিও নাকি দেখে নি।
কেন? কি কারণে তার নিজেকে ঐভাবে সযতনে আড়াল করে রাখবার প্রয়াস? বাড়ি বললেন বর্ধমানে এবং স্বামী তো নেই—এমন কি কোন আত্মীয়স্বজনও নাকি নেই তার। এবং পেটের দায়েই যখন তিনি মল্লিক-গৃহে এসে চাকরি নিয়েছিলেন তখন, আর চাকরিই বা এখন করবেন না কেন? সুবিমলবাবুকে ইতিমধ্যে চাকরি ছাড়বার নোটিশ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। চাকরি করবেন না আবার দেশেও ফিরে যাবেন কিনা বলতে পারলেন না।
কারো সঙ্গে মল্লিক-গৃহে কথা বলতেন না, অবগুণ্ঠনের অন্তরালে সর্বদা নিজেকে গোপন করে রাখতেন অথচ সর্ব ব্যাপারেই নজর ছিল তার। এমন কি ঐ গৃহে কৃষ্ণা বা কাবেরীর যাতায়াতের ব্যাপারটাও তার অজ্ঞাত ছিল না। আত্মগোপনেচ্ছু অথচ সজাগ।
কয়েক দিন ধরে অনবরত চিন্তার পর কিরীটী তার পকেট-ডাইরীটা খুলে সেদিন সন্ধ্যার দিকে সোফার ওপরে বসে নিজের ঘরে পাতা উল্টোতে লাগল।
এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি স্থির হলো।
সেই পাতার মধ্যস্থলে কালিতে একটি বৃত্ত আঁকা। বৃত্তের মধ্যস্থলে লেখা নিহত নরেন মল্লিক। এবং বৃত্তের গা থেকে তিনটি এ্যারো (তীরচিহ্ন) টানা। একটির মাথায় লেখা কৃষ্ণা, একটির মাথায় কাবেরী ও একটির মাথায় লেখা সঞ্জীব চৌধুরী। কিরীটী পকেট থেকে কলমটা বের করে বৃত্তটির গায়ে আর একটি নতুন তীরচিহ্ন আঁকলো এবং তার শেষপ্রান্তে লিখল বিনতা দেবী–রহস্যময়ী। সঙ্কেতময়ী।
সিঁড়িতে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। ভারী জুতা পায়ে দিয়ে কে যেন দ্রুত উপরে উঠে আসছে।
পদশব্দ কিরীটীর পরিচিত এবং তাই বুঝতে কষ্ট হয় না আগন্তুক স্বয়ং রহমান সাহেব। রহমান সাহেব বেশ দ্রুতই এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট একটা উত্তেজনার আভাস যেন চিক চিক করছে।
মিঃ রায়!
বসুন–বসুন রহমান সাহেব। কি ব্যাপার, কি এমন নতুন ব্যাপার হঠাৎ আবিষ্কার করলেন?
সত্যি নতুন আবিষ্কারই বটে। তবে বুঝলেন কি করে? বসতে বসতে রহমান সাহেব বললেন।
আপনার চোখ-মুখই যে তারস্বরে বলছে রহমান সাহেব।
কিন্তু আবিষ্কারটা কি বলুন তো?
এ কেসের ব্যাপারে একটা দামী ডকুমেন্ট। বলতে পারেন হয়ত সূত্রও।
সূত্র!
হাঁ—একটা ডাইরী।
কার? মৃত নরেন মল্লিকের বোধ হয়?
আশ্চর্য! তাই। এই দেখুন—বলতে বলতে পকেট থেকে রহমান সাহেব একটা কালো মরোক্কোয় বাঁধা ছোট ডাইরী বের করে এগিয়ে দিলেন কিরীটীর দিকে।
আগ্রহে ও কৌতূহলে ডাইরীটা রহমান সাহেবের হাত থেকে নিয়ে কিরীটী ডাইরীটার পাতা উল্টাতে শুরু করলো। হাতের লেখাটি বিশেষ সুবিধার নয়। তবে নেহাত পড়তে কষ্ট হয় না। ইংরাজীতে লেখা ডাইরী। নিয়মিত সন তারিখ দিয়ে সুসংবদ্ধ ডাইরী নয়।
এলোমেলো খণ্ড খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সব ঘটনা বা সংবাদ নোট করা হয়েছে ইংরাজীতে।
একের চার অংশ ডাইরীর পাতাগুলো পড়ে পড়ে চোখ বুলিয়ে উল্টিয়েও বিশেষ তেমন কোন আগ্রহের সৃষ্টি করে না বা মনের কোথাও কৌতূহল জাগায় না, তবু কিরীটী পাতাগুলো উল্টে যেতে থাকে।
হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গায় একটা পাতায় এসে তার নজর পড়ল, লেখা আছে— কলকাতায় বাড়ি কিনলাম। সমীর এই বাড়ি কেনার ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বাড়িটা আমার পছন্দসই হয়েছে।
ব্যাস্ ঐ পর্যন্তই।
তারপর কয়েকটা পাতায় হিসাবের অঙ্ক। আবার কিরীটী উল্টে চলে পৃষ্ঠা। এবং সাত আট পৃষ্ঠা বাদে আবার এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। লেখা আছে কি আশ্চর্য! হঠাৎ যেন চমকে উঠেছিলাম ওর কণ্ঠস্বরে। কত দিন হয়ে গেছে, তবু যেন ভুলতে পারি নি আদৌ সে কণ্ঠস্বর। অদ্ভুত আশ্চর্য মেয়ে! শোনা মাত্রই মনে হলো যেন এ সেই তারই কণ্ঠস্বর। দূর, এসব কি ভাবছি! কোথাকার কে তার ঠিক নেই। তাছাড়া কত সময় একের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্যের কণ্ঠস্বরের তো কত আশ্চর্য মিলই না থাকে। এও হয়ত তাই।
এ আমার মনের ভুল নিশ্চয়ই।
আবার কয়েক পৃষ্ঠা পরে একটা পৃষ্ঠা। —আশ্চর্য! ওর কণ্ঠস্বর শুনলে এবং ওর চলা দেখলে তার কথাই আমার মনে পড়ে কেন? সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে রেল গাড়িতে কাটা পড়ে। না না, এ আমার মনের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। মিথ্যে কল্পনা।
কয়েক পৃষ্ঠা পরেই আবার এক পৃষ্ঠায়।
আশ্চর্য! কদিন থেকে কেবলই মনে হচ্ছে, কে যেন অনুক্ষণ আমাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি মনে হয় যেন ছায়ামূর্তি আমার পিছনে পিছনে ফিরছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছিলাম। তিনি বললেন, নিউরোসিস। স্নায়ুর দুর্বলতা শেষ পর্যন্ত কিনা আমার মধ্যে দেখা দিল!
সত্যিই কি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি? না এটা বয়সের দোষ? অন্য আর একটি পৃষ্ঠায়।
সত্যি, আশ্চর্য মুখের সৌসাদৃশ্য তো! যেন একেবারে তারই প্রতিচ্ছবি। কতকাল আগেকার কথা—স্মৃতির পৃষ্ঠা ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু সেই ঝাপসা পটে আজও যে দুচারটে রেখা মনে আছে তার সঙ্গে যেন কোন পার্থক্য নেই।
নতুন আর একটি পৃষ্ঠা।
মাঝে মাঝে লোভ হচ্ছে বটে ককে নিয়ে ঘর বাঁধি। কিন্তু সাহস হয় না। এই জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে ঘরের মধ্যে হয়ত ধরে রাখতে পারব না। হয়ত বৃথাই পুড়ে ঝলসে যাব। তার চাইতে এই ভালো। থাক সে অবন্ধনা। চট করে ছেড়ে আমাকে যাবে না। কারণ অর্থের খাকতি আছে। ও অবিশ্যি ভাবে যে আমি সেটা বুঝি বুঝতে পারছি না, কিন্তু জানে না তো ওদের মত মেয়েদের অন্তত আমার আর চিনতে বাকী নেই।
আমি ওদের ভাল করেই চিনি।
তারপর ডাইরীর আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা কিরীটী উল্টে যায়, কিন্তু বিশেষ তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য চোখে পড়ে না। ডাইরীটা অতঃপর ধীরে ধীরে মুড়ে তাকালো রহমান সাহেবের মুখের দিকে।
এতক্ষণ রহমান সাহেব নিঃশব্দেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। কিরীটী
ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই বললেন, পড়লেন?
হাঁ। কোথায় পেলেন এ ডাইরীটা?
নরেন মল্লিকের বেড়রুমে বিছানার নিচে ছিল। ডাইরীটা মধুই গতকাল বিছানাপত্র রোদে দিতে গিয়ে পায়। তারপর আজ বিকেলে থানায় এসে দিয়ে গেল আমাকে।
মধু এসেছিল আজ থানায়?
হ্যাঁ, বললাম তো সে দিয়ে গেল।
মল্লিক-গৃহের আর কোন নতুন খবর পেলেন?
নতুন খবর আর কি পাবো! পাবার মত আর আমাদের আছেই বা কি? বিনতা দেবীর কোন সংবাদ জানেন?
বিনতা দেবী!
হ্যাঁ, উনি তো সেদিন বলছিলেন সুবিমলবাবুকে চাকরি ছাড়বার নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন। তা তিনি চলে গিয়েছেন, না আছেন এখনো জানেন কিছু?
হ্যাঁ, মধুই নিজে থেকে বলল বিনতা দেবী দিন পাঁচেক হলে চলে গিয়েছেন। তারপর একটু থেমে রহমান সাহেব প্রশ্ন করলেন, ডাইরীটা পড়ে কিছু বুঝতে পারলেন মিঃ রায়?
বিশেষ তেমন কিছুই আপাততঃ বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা আমার কি মনে হচ্ছে জানেন?
কি? রহমান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
নিহত নরেন মল্লিক সম্পর্কে আমরা আজ পর্যন্ত যেটুকু তার অতীতের জীবন থেকে জেনেছি সেটা সামান্যই।
কি রকম?
তাই। আমার মনে হচ্ছে নিহত নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের পৃষ্ঠাগুলোতে এমন কিছু আছে যেখানে হয়ত তার এই আকস্মিক হত্যা রহস্যের কোন বড় রকমের একটি জটিল সূত্র রয়ে গিয়েছে।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ আমি বলতে চাই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারটা আকস্মিক নয় বা আচমকাও নয়। তার হত্যার বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক অনেক দিন আগে। হত্যালিপ্সা মনের মধ্যে পোষণ করে হত্যাকারী সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিল মাত্র এবং তারই যোগাযোগ হচ্ছে হত্যার ব্যাপারটা। অবিশ্যি যোগাযযাগটা পরে ঘটনাচক্রে বা আকস্মিকও হতে পারে। হত্যাকারীকে আমাদের খুঁজে বের করতে হলে যে উপায়েই হোক আমাদের ফিরে যেতে হবে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনে। যেখানে ঘটনাচক্রে রোপিত হয়েছিল সেদিন হত্যার বীজ। তাই তো বলছিলাম, শুধু নরেন মল্লিকের গৃহই আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখা নয়, কলকাতায় আসবার আগে যেখানে সে ছিল সেখানকার ইতিহাসও তো কম দিনের নয় নেহাৎ। সেটাও যথাসম্ভব অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এবং কলকাতা ছেড়ে বর্মায় গিয়ে ব্যবসা ফঁদবার আগেকার দিনের ইতিহাসটাও আমাদের সাধ্যমত সংগ্রহ করতে হবে। এমনি সে কলকাতা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বর্মায় গিয়েছিল, না অন্য কোনভাবে নিরুপায় হয়ে সে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল!
সে সংবাদটা সংগ্রহ করা হয় বিশেষ কষ্টসাধ্য হবে না। রহমান সাহেব বলেন।
দুজনের মধ্যে যখন কথা হচ্ছে তালুকদার এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এসো তালুকদার, কি খবর? কিরীটী আহ্বান জানাল।
নরেন মল্লিকের হত্যারহস্যের কোন কিনারা করতে পারলে রায়?
এতক্ষণ ধরে রহমান সাহেবের সঙ্গে সেই আলোচনাই করছিলাম।
কিন্তু কদিন তোমার কোন পাত্তাই ছিল না, ব্যাপার কি?
আর ভাই বল কেন? একটা রেলওয়ে ডাকাতির ব্যাপারে তদন্তে এলাহাবাদ পর্যন্ত ছুটতে হয়েছিল। আজ সকালেই ফিরেছি। অফিসে এসে ভাবলাম যাই তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। যদি কোন নতুন ডেভেলপমেন্ট হয়ে থাকে।
অন্ধকারে ক্ষীণ একটা আলোর শিখা ধরতে পেরেছি। মনে হচ্ছে এবারে হয়ত কিছুটা আরো এগুনো যাবে।
কথাটা শুনে তালুকদার সাহেব উৎসাহিত হয়ে ওঠে, বলে, বটে!
হ্যাঁ, মধুর কাছ থেকে মৃত নরেন মল্লিকের একটা ডাইরী পাওয়া গিয়েছে।
সংক্ষেপে কিরীটী অতঃপর তালুকদারকে ডাইরীর ব্যাপারটা বলে যায়। এবং এও বলে ঐ সঙ্গে, তাই বলছিলাম রহমান সাহেবকে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের ইতিহাসটা যতটা সম্ভব খুঁজে বের করবার জন্য।
সমীরবাবুর কাছে ছাড়াও নরেন মল্লিকের কলকাতা ত্যাগ করে বর্মা যাবার পূর্বের ইতিহাস কিছু কিছু আমি সংগ্রহ করেছিলাম।
করেছিলে নাকি! কই এ কথা তো আমাকে জানাও নি!
হঠাৎ এলাহাবাদ চলে যেতে হলো তাই জানাতে পারি নি, তালুকদার বললে।
কেমন করে কার কাছ থেকে শুনলে?
সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার।
কি রকম?
আমার বন্ধু ব্যারিস্টার অমল ঘোষকে তো তুমি চেন?
না চিনি না, তবে নাম শুনেছি তাঁর—ভা প্র্যাকটিস।
এলাহাবাদ যাবার আগের দিন তার বাড়িতে একটা কাজে যেতে হয়েছিল আমাকে। সেখানেই সে কথায় কথায় আমাকে বলে নরেন মল্লিককে নাকি সে চিনত, একই সঙ্গে বিলেত থেকে তারা একই বছরে ব্যারিস্টার হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তারপর?
কলকাতায় ফিরে এসে অমলের সঙ্গেই প্র্যাকটিস শুরু করে। তবে বাপের কিছু পয়সা থাকায় প্র্যাকটিস্ জমানোর চাইতে স্ফূর্তির দিকেই তার নজর ছিল। একদল সোসাইটি মেয়ে পুরুষের সঙ্গে আজ পার্টি, কাল পিকনিক, পরশু চ্যারিটি শো এই সব নিয়েই থাকত। এমন সময় তার বাপ হঠাৎ মারা গেলেন সন্ন্যাস রোগে এবং তার মৃত্যুর পর দেখা গেল মৃত বাপ বাজারে প্রচুর দেনা করে গিয়েছেন, যার ফলে মল্লিকের টানাটানি হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তা তো হলোই না বরং পূর্বের মতই সে হৈ হৈ করে বেড়াতে লাগলো।
তারপর?
তারপর হঠাৎ বছর দুয়েক বাদে সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেল বাজারে প্রচুর দেনা করে কেউ জানতে পারল না। অনেকদিন পরে অবিশ্যি জানা যায় যে সে গিয়েছিল মগের মুলুকেই।
কিরীটী তালুকদারের কথা উগ্রীব হয়ে শুনছিল। এবার মৃদু কণ্ঠে বললে, তা হলে নরেন মল্লিকের বর্মা যাবার পশ্চাতে একটা উদ্দেশ্য পাওয়া গেল। পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া!
তা ছিল বৈকি। তাই তো অমল বলছিল, মল্লিক লোকটা যাদু জানে নচেৎ বর্মা থেকে পনের বছর পরে যখন ফিরে এলো, ব্যাগ ভর্তি করে সৌভাগ্য নিয়ে এলো কি করে? পনের বছরে কি করে সে ভাগ্যটাই ফিরিয়ে নিল?
তোমার ব্যারিস্টার ঘোষের সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দিতে পারো তালুকদার?
পারবো না কেন! কবে যেতে চাও বল!
যত শীঘ্র সম্ভব।
কাল চলো সন্ধ্যার পর।
বেশ তাই যাব, তাহলে এবারে উঠি।
এসো। আর একটা কথা তালুকদার!
কি বল তো?
বলছিলাম শুধু নরেন মল্লিকের বাড়িটাই আর একবার ভাল করে সার্চ করা নয়, ঐ সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটাও আর একবার ভাল করে সার্চ করা প্রয়োজন।
তার মানে সেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর ফ্ল্যাট! না বাবা, সেখানে আমি যেতে পারবো না। ভদ্রলোক যেন খোঁচা খাওয়া বাঘের মত সর্বদা থাবা বাড়িয়েই আছে। যেতে হয় তুমি যাও।
বেশ, আমিই না হয় যাবো। হাসতে হাসতে কিরীটী বলে, তাহলে তুমি যাও মল্লিক ভবনে।
তা যাবো।
বিদায়ের আগে রহমান সাহেব বললেন, ডাইরীটা কি তাহলে আপনার কাছেই—
হাঁ রহমান সাহেব। ডাইরীটা আমার কাছেই থাক।
রহমান ও তালুকদার বিদায় নিল। কিরীটী কিন্তু উঠলো না। সে যেমন সোফার উপরে বসেছিল তেমনই বসে রইলো।
ডাইরীটা পড়বার পর থেকে এবং তালুকদারের মুখে নরেন মল্লিক সম্পর্কে আরো কিছুটা নতুন তত্ত্ব শুনে তার মনের চিন্তাধারাটা যেন সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পথে বইতে শুরু করেছে। এবং এতক্ষণে যেন সমস্ত ঘটনাগুলোকে নতুন করে পর পর সাজিয়ে নির্দিষ্ট একটি আকারে পৌঁছবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছে। কৃষ্ণা ও কাবেরীর ফ্ল্যাটটা সার্চ করবার চাইতেও খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছাটাই কিরীটীর প্রাণে প্রবল হয়ে উঠছিল। খোঁড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ হয়েও মেয়েদের প্রতি তার অদ্ভুত একটা আধিপত্য, বিশেষ করে তারা অপরূপ সুন্দরী, শিক্ষিতা ও উপার্জনশীল হওয়া সত্ত্বেও, যা এ যুগের মেয়েদের মধ্যে বড় একটা দেখাই যায় না এবং শুধু আধিপত্যই নয়, বাপের অমতে চলবার কৃষ্ণা বা কাবেরীর কারোই সাহস নেই। বাঘিনী যেমন বাচ্ছাদের আগলে রাখে সর্বদা তেমনি করেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরী তার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরীকে আগলে রেখেছে।
কিন্তু কেন এ সতর্কতা!
এর মূলে কোন সন্দেহ বা কোন রকম কমপ্লেকস্ সঞ্জীবেরই। আর মেয়েরাই বা বাপকে অত ভয় করে চলে কেন? কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পর দীর্ঘ পনের বছরের সঞ্জীব চৌধুরীর ইতিহাসটা আজো জানা যায় নি। দীর্ঘ পনের বছর এক আধ দিনও নয়। একটা যুগ। দীর্ঘ পনের বছর। হঠাৎ যেন বিদ্যুৎচমকের মতই একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের মধ্যে উঁকি দেয়।
কি আশ্চর্য! আশ্চর্য, সেও ঠিক পনের বছর! সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো সরল হয়ে আসে। আনন্দে চোখের তারা দুটো চক্ চক্ করে ওঠে। আর দেরি নয়, কালই যেতে হবে তাকে সঞ্জীব চৌধুরীর ওখানে। কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। ডাক্তারই তাকে ঠিক সংবাদ দিতে পারবে। এবং যেতে হবে তাকে কৃষ্ণা ও কাবেরীর অনুপস্থিতিতে।
বেলা তখন ঠিক দ্বিপ্রহর। কিরীটী আগে হতেই সংবাদ নিয়ে জেনেছিল ঐদিন দ্বিপ্রহরে দুটি বোনেরই অফিসে ডিউটি আছে, দুজনের একজনও দ্বিপ্রহরে বাড়ি থাকবে না। আসবার পথে কিরীটী পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্সের কাছ থেকে দুজন লাল পাগড়ী সঙ্গে করে নিয়ে এল।
সোজা উপরে উঠে এসে কিরীটী দরজার কলিং বেল টিপতেই একটু বাদে একটি বৃদ্ধা গোছের ঝি এসে দরজা খুলে দিল।
কাকে চান বাবু?
মিঃ চৌধুরী, মানে বুড়ো বাবু বাড়িতে আছেন?
আছেন, কিন্তু তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করেন না বাবু।
তুমি বুঝি এ বাড়িতে চাকরি করো, কি নাম তোমার?
আজ্ঞে সরলা।
দিনরাতের?
আজ্ঞে বাবু না, ঠিকে কাজ করি।
আমার বড্ড জরুরী দরকার, একটিবার বাবুর সঙ্গে দেখা না করলে চলবেই না। তুমি গিয়ে বাবুকে বরং একবার—
ঝি ভীত, শঙ্কিত ভাবে বলে ওঠে, ওরে বাবা! তাঁর কাছে কে যাবে বাবু? কদিন থেকে কর্তাবাবুর যা মেজাজ হয়ে আছে, আর তা ছাড়া বাবুর ঘরে ঢুকবারও আমার হুকুম নেই–
এমন সময় হঠাৎ ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় কে যেন প্রশ্ন করল, কে? একটা খট্ খট্ শব্দও শোনা গেল ঐ সঙ্গে।
খট খট খট! …শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
একটু পরেই ভিতর ও বাইরের মধ্যবর্তী দরজার উপরে দেখা গেল সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সঞ্জীব প্রশ্ন করলেন, কে আপনি, এখানে কি চান?
কিরীটী বিনম্র কণ্ঠে বললে, এখানকার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এইচ. কিউ. থেকে আসছি, আমার নাম ধূর্জটি রায়।
ওঃ। তা এখানে আপনার কি প্রয়োজন?
আপনিই কি মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী?
হাঁ।
তা দেখুন, প্রয়োজন বিশেষ একটা আছে বৈকি। কিন্তু সেটা তো এভাবে এইখানে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলা চলে না।
ওঃ। আসুন তাহলে ভিতরে।
কিরীটী কমধ্যে এসে প্রবেশ করল।—বসতে পারি?
বসুন।
কিরীটী একটা সোফার উপরে উপবেশন করল।
বলুন কি চান আপনি?
আপনার বাড়িটা একবার সার্চ করতে চাই—
সার্চ করতে চান, মানে?
হ্যাঁ, বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের অফিস অবগত হয়েছে, আপনার বাড়িতে নাকি কতকগুলো জরুরী পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্ লুকানো আছে—
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সঞ্জীব চৌধুরী কিরীটীর দিকে বারকয়েক তাকালেন, কি বললেন পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্?
আজ্ঞে।
কিছুক্ষণ ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব যেন কি ভাবলেন, পরে গম্ভীর নিরুৎসুক কণ্ঠে বললেন, বেশ, আসুন। দেখুন খুঁজে।
কিরীটী প্রথমেই কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরটা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা শুরু করলে।
কিরীটীকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে সঞ্জীব তার নিজের কক্ষে গিয়ে চেয়ারটার উপরে একটা বই খুলে নিয়ে বসলেন। কিরীটী কিন্তু কিছু তেমন খুঁজে পেল না কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরে।
এ ঘরের যা কিছু দেখবার দেখে কিরীটী সঞ্জীবের কক্ষে এসে প্রবেশ করলো।
সঞ্জীব বই হতে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন, কি চাই?
আপনার ঘরটাও একবার দেখতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন!
দেখুন—স্বচ্ছন্দে।
কথাটা বলে সঞ্জীব যেমন বই পড়ছিলেন তেমনি বই পড়তে লাগলেন।
কিরীটী বিনা বাক্যব্যয়ে তার অনুসন্ধান শুরু করে দিল।
প্রথমেই বইয়ের আলমারি ও অন্যান্য ড্রয়ার ও ডেস্কগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেও কিরীটী তার অভীপ্সিত বস্তু খুঁজে পেল না।
কি হলো, কিছু পেলেন?
অ্যাঁ! কি বললেন?
বলছিলাম, পেলেন খুঁজে সেই পরশ পাথরটি—that valuable document of your most Honourable the ইংরাজ সরকার বাহাদুরের?
সঞ্জীবের কথায় চকিতে ফিরে দাঁড়াল কিরীটী। সঞ্জীবের চোখের দৃষ্টিও কিরীটীর উপরে নিবদ্ধ, পাথরের মত স্থির দৃষ্টি, সমস্ত মুখের রেখায় যেন একটা সুকঠিন তাচ্ছিল্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শুনুন মিঃ সি. আই. ডি. যে মুহূর্তে আপনি ঘরে এসে ঢুকেছেন আপনার আসল ইচ্ছাটা আমার কাছে আর অস্পষ্ট থাকে নি। আমি জানি কি জন্য আপনি এ সময় আমার বাড়িতে হানা দিয়েছেন। আপনি কেন, এ দুনিয়ায় কারো সাধ্য নেই একবার সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে মুঠোর মধ্যে যা আসে তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। যাক সে কথা, আশা করি আপনার যা জানবার ছিল আপনি জেনেছেন।
কিরীটীর চোখে মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে ওঠে, বুঝলাম, কিন্তু যাবার আগে আমি একটা জিনিস মাত্র আপনার এখান হতে নিয়ে যাবো–
কি? বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।
বিশেষ তেমন অবিশ্যি কিছুই নয়—আপনার হাতের ঐ বইটি—
এই বইটা! ফ্যালফ্যাল করে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।
হাঁ। বলেই মুহূর্তে যেন ছোঁ মেরে কিরীটী সঞ্জীবের কোলের উপর রক্ষিত বইটা তুলে নেয় এবং তাকে দ্বিতীয় বাক্যব্যয়ের অবকাশমাত্র না দিয়ে বলে ওঠে, যা আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম পেয়েছি মিঃ চৌধুরী। ধন্যবাদ। আচ্ছা good bye!
কিরীটী তড়িৎ-পদে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।
সঞ্জীব চৌধুরী কতকটা যেন বোকা বনে গিয়েছেন এমনি ভাবে কিরীটীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
.
কিরীটীর বসবার কক্ষ। একা একা তালুকদার বসে বসে খানকয়েক চিঠি একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছিল। কিরীটী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
আরে তালুকদার যে, কতক্ষণ?
তা আধ ঘণ্টাটাক তো হবেই—এই যে এই চিঠিগুলো নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষের একটা আলমারির গুপ্ত ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
কিরীটী সঞ্জীব চৌধুরীর ঘর হতে আনীত মোটা বইখানা পাশের টেবিলের উপরে রেখে একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিতে দিতে বললে, প্রেমপত্র নিশ্চয়?
হুঁ।
প্রেমিকাটি কে?
সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না।
কি রকম?
এই দেখো না—এগিয়ে দিল তালুকদার চিঠিগুলো ও খামগুলো কিরীটীর দিকে।
চিঠি ও খামগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, হুঁ, এখানেও অগাধ জল। প্রত্যেকটা চিঠির মধ্যেই দেখছি সম্বোধন করা হয়েছে প্রিয়া আমার প্রিয়তম বলে আর চিঠির নিচে নাম স্বাক্ষর করা হয়েছে ইতি তোমার ক বলে। ক অর্থাৎ কৃষ্ণাও হতে পারে। কাবেরীও হতে পারে। এদিকে আমি যে চিঠিগুলো উদ্ধার করে এইমাত্র আনলাম তাতেও দেখলাম লেখা আছে, প্রিয়তম আমার সম্বোধনে, আর ইতি করা হয়েছে তোমার প্রিয় ‘ন’ বলে। Again that blessed কৃষ্ণা কাবেরীর puzzle!
যা বলেছে, যে দিকে যাই ঐ কৃষ্ণা কাবেরী যেন পথরোধ করে দণ্ডায়মান–
কিন্তু যেমন করে হোক কৃষ্ণা কাবেরী রহস্য আমাদের সমাধান করতেই হবে। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সুর ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে।
রায়, এবারে দেখছি সত্যিই তোমায় হার মানতে হলো!
হার মানতে হলল! সিংহের মত গ্রীবা বেঁকিয়ে, কেশর ফুলিয়ে কিরীটী যেন সহসা সোজা হয়ে বসে, আমিও কিরীটী রায়, তালুকদার।
কিরীটীর চোখে, মুখে, সর্বদেহে এবং কণ্ঠস্বরে পর্যন্ত একটা ঋজু কাঠিন্য যেন ইস্পাতের মতই ঝিকিয়ে ওঠে।
হঠাৎ কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবার জাল গুটাবো। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ফোনের মাউথ-পিষ্টা তুলে নেয়। হালো! Put me to P. K. …Please!
কে, ডাক্তার? আমি কিরীটী।
হাঁ। কি সংবাদ?
শোন—
.
মধুর কাছে অনুসন্ধান করতেই কিরীটী বিনতা দেবীর একটা সন্ধান পেয়ে গেল। কলকাতা ছেড়ে বিনতা দেবী আপাততঃ যান নি। পার্ক সার্কাসের কাছে একটা অখ্যাতনামা গলির মধ্যে একটা ঘর নিয়ে আছেন। মধু সেখানে মধ্যে মধ্যে যায়। বেচারী মধু তাকে সত্যিই ভালবেসেছিল। তাই আজও তার মায়াটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। মধ্যে মধ্যে সেখানে গিয়ে তার বাজারটা-আসটা করে দিয়ে আসে। মধু গলির নাম বা বাড়ির নম্বরটা বলতে পারল না, কিন্তু দূর থেকে কিরীটীকে দেখিয়ে দিল।
হঠাৎ মধু একটা প্রশ্ন করে কিরীটীকে, বিনতা মাকে আপনার কি দরকার বাবু? তার এত খবর নিচ্ছেন কেন এত করে?
তোমার বাবুর চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, তাই ভাবছিলাম যদি ওঁর অন্য কোথাও একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পারি!
আহা, তা যদি পারেন তো তার বড় উপকার হয়। মা আমার বড় ভাল।
তা সুবিমলবাবু তো শুনলাম ওঁকে চাকরি থেকে ছাড়াতে চান নি, তবে উনি চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন মধু?
কি জানি বাবু, সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। তবে আমার মনে হয় ভয়ে।
ভয়ে! কিসের ভয়ে?
মধু এবার যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার বল তো?
বাড়িটার মধ্যে বাবু মারা যাবার পর থেকেই কেমন যেন সব শব্দ শোনা যায়—
বল কি!
হাঁ বাবু, আর আর যারা সব আছে তারাও ইতিমধ্যে পালাই পালাই শুরু করেছে।
শব্দ! কি রকম শব্দ বল তো?
সে বাবু নানা রকমের শব্দ!
কিরীটীর ইচ্ছা ছিল কথাপ্রসঙ্গে মধুর ক্ষণপূর্বের বিনতা সম্পর্কে কৌতূহলের চিন্তাধারাটা একটু ঘুরিয়ে দেবে। কথাপ্রসঙ্গে সেটা আপনা থেকেই হয়ে যেতে কিরীটী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
মধুর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে তাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী অন্য পথ ধরলো। পার্ক সার্কাস অর্থাৎ এ অঞ্চলেই কৃষ্ণা ও কাবেরীদের ওপর সর্বদা নজর রাখবার জন্য সে নিজের যে লোকটিকে নিযুক্ত করেছিল, ভাবল তার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে যখন এ অঞ্চলেই এসেছে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটা সেখান থেকে বেশী দূরেও নয়।
বড় রাস্তাটার একদিকে ফ্ল্যাট বাড়িটা এবং ঠিক তার উল্টোদিকে ডিলুক্স রেস্তোরা। সন্ধ্যা সবে তখন উত্তীর্ণ হয়েছে। শীতের সন্ধ্যা। রেস্টুরেন্ট ইতিমধ্যেই চা-পিয়াসীদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে অল্প দূরে গাড়িটা পার্ক করে মন্থর পদে এগিয়ে চলল কিরীটী রেস্টুরেন্টের দিকে। মাঝারি গোছের একটি ঘরের মধ্যে রেস্টুরেন্ট। ভিতরের খরিদ্দারের ভিড় দেখে বোঝা যায় বিক্রিপত্র ভালই। ঘরের মাঝখানে গোটাচারেক টেবিল পেতে খদ্দেরদের বসাবার জন্য স্টীলের চেয়ার পাতা আর দেওয়ালের ধার ঘেঁষেও ব্যবস্থা আছে। দেওয়ালের চারদিকে চারটে ফ্লোরেসেন্ট টিউব জ্বলছে। কাউন্টারের একপাশে রেডিও সেটে শোনা যাচ্ছে পল্লীমঙ্গল আসর জমে উঠেছে। ঘরের বাতাসে পিঁয়াজ রসুন ও মাংস ভাজার একটা লোভনীয় মিশ্র গন্ধ।
ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী একবার চারদিকে তাকাতেই দৃষ্টিটা তার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দক্ষিণ কোণে মুসলমান বেশভূষায় মাথায় একটা শালের টুপী ২৫/২৬ বছরের একটি যুবক একাকী বসে চা-পান করছিল। কিন্তু চা-পানের চাইতেও তার মনোযোগ ছিল বেশী রাস্তার ঠিক অপর পারে কৃষ্ণাদের ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটার দিকে। কারণ সেখান থেকে স্পষ্ট সব কিছু দেখা যায়।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে তার টেবিলেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
রেস্টুরেন্টের একটি ছোকরা এগিয়ে এলো, কি দোব?
এক কাপ স্ট্রং করে চা দাও। ছোকরাটি চলে যেতেই চাপা গলায় কিরীটী তার সামনে উপবিষ্ট মুসলমান-বেশ-পরিহিত লোকটিকে সম্বোধন করে বলল, চন্দ্রনাথ খবর কি?
খবর আছে, স্যার। চা-টা খেয়ে সামনের পার্কে আসুন। আমি সেখানেই অপেক্ষা করছি। চন্দ্রনাথের চা-পান হয়ে গিয়েছিল। উঠে গিয়ে কাউন্টারের দাম মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল।
মিনিট পাঁচেক বাদে কিরীটীও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। বড় রাস্তাটা ধরে একটু এগুলেই বাঁ-হাতে একটা ছোট ত্রিকোণা পার্ক। একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে কিরীটী সেই পার্কের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো চন্দ্রনাথের সন্ধানে।
হঠাৎ তার নজর পড়ল চন্দ্রনাথ তারই দিকে এগিয়ে আসছে।
আরো কাছে এসে চন্দ্রনাথ বললে, চলুন স্যার, ঐ বেঞ্চটায় গিয়ে বসা যাক।
বেঞ্চে তখন আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না। দুজনে পাশাপাশি বসল।
আপনার কাছে কালই আমি যেতাম আপনি না এলে। গত চার-পাঁচদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম রাত এগারটার পর একটি রিকশা ঠুং ঠুং করে ঐ ফ্ল্যাট বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর সর্বাঙ্গ চাদরে মোড়া ঘোমটা টানা একটি ভদ্রমহিলা রিকশা থেকে নেমে ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং কিছুক্ষণ বাদে আবার বের হয়ে যান। কিন্তু কাল রাত্রে–
কি?
ভদ্রমহিলাকে গতকাল রাত্রে আমি ফলো করেছিলাম।
করেছিলে?
হাঁ। ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢোকবার পর আমিও কিছুক্ষণ পরে ফ্ল্যাটটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
তারপর?
দেখলাম সোজা তিনি কৃষ্ণা দেবীদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বদ্ধ দরজার গায়ে আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে তিনটি টোকা দিতেই একটু পরে কৃষ্ণা বা কাবেরী দুজনার মধ্যে একজন এসে দরজা খুলে দিলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
তার পর কি হলো?
তা ঠিক বলতে পারব না, কারণ রাত দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম ভদ্রমহিলা আর ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলেন না, আমি ফিরে গেলাম।
হুঁ! কিরীটীর হৃদুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
তাই আজ ভাবছিলাম, আজও যদি তিনি আসেন তো আবার তাঁকে ফলো করবো ও শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করবো।
কিন্তু হয়তো আর তিনি ও-বাড়ি থেকে না-ও বের হতে পারেন।
আপনি বলছেন গত রাত্রে সেই যে তিনি ঢুকেছেন আর বের হন নি!
হাঁ।
হতে পারে। তবু দেখবো।
বেশ। তুমি অপেক্ষা করো। আমিও রাত্রে একবার আসবো।
আসবেন?
হ্যাঁ।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পূর্বেই কিরীটী এসে হাজির হলো এবং বাড়িটা থেকে কিছু দূরে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে গাড়িটা পার্ক করে সব আলো নিবিয়ে অপেক্ষায় রইলো। চন্দ্রনাথ পিছনের সীটে বসে রইলো। কিন্তু রাত তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন রিকশা বা অবগুণ্ঠনবতী মহিলার দেখা পাওয়া গেল না। এবং রাত বারোটা নাগাদ ফ্ল্যাটের মেইন দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু কিরীটী এক রাত্রের বিফলতাতেই হতাশ হলো না। পরের রাত্রেও তেমনি অপেক্ষা করল। এবং সে-রাত্রিও নিম্ফলেই গেল।
দেখা মিলল তৃতীয় রাত্রে।
রাত বারোটায় ঠিক গেট বন্ধ হয়ে গেল। এবং রাত যখন একটা হবে, কিরীটীর একটু ঝিম মত এসেছে, পিছন থেকে পৃষ্ঠদেশে একটা মৃদু ধাক্কা খেয়ে সে সচকিত হয়ে উঠল।
এসেছে, স্যার!
অদূরে গীর্জার ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষিত হলো।
কিরীটী তাকিয়ে দেখলো সর্বাঙ্গে একটা সাদা চাদর আবৃত একটি ভদ্রমহিলা নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে আসছেন। মেইন গেটটার সামনে এসে দাঁড়াবার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ গেটটা খুলে গেল। খোলা গেটের উপরে রাস্তায় লাইটপোস্টের আলোটার খানিকটা অংশ গিয়ে পড়েছে। এবং সেই আলোতেই দেখা গেল, খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর এক বোন।
আগন্তুক ভদ্রমহিলা ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গেটের কপাট দুটো বন্ধ হয়ে গেল।
অপেক্ষমাণ এক-একটা প্রহর যেন এক এক যুগ বলে মনে হয়। তবু অপেক্ষা করেই থাকে কিরীটী-শেষ পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবেই! এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। রাত যখন ঠিক চারটে বেজে দশ, গেট খুলে গেল এবং একাকিনী সেই চাদরে আবৃত মহিলা বের হয়ে এলেন।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে তাকে অনুসরণ করল। পায়ে ছিল তার পুরু রবার সোলের দামী জুতো। নিঃশব্দে অগ্রগামী মহিলাকে অনুসরণ করে সে চলল।
নির্জন রাস্তা। একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বাঁয়ে জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শুধু রাত্রিশেষের অন্ধকারে এসেছে একটা দিকে অস্বচ্ছ আভাস। কিন্তু আর ওকে অগ্রসর হতে দেওয়া উচিত হবে না। এবারে একেবারে গলির মুখোমুখি এসে পড়েছে।
কিরীটী আচমকা তার চলার গতি অত্যন্ত দ্রুত করে অগ্রগামী মহিলাকে একেবারে ধরে ফেললে এবং ডাকলে, বিনতা দেবী দাঁড়ান!
চকিতে ভদ্রমহিলা কিরীটীর সেই ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন।
বিনতা দেবী!
সুস্পষ্ট নারীকণ্ঠে এবারে জবাব এলো, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?
হাঁ।
আপনি বোধ হয় ভুল করেছেন।
ভুল করেছি!
হাঁ। আমার নাম বিনতা নয়। সুস্পষ্ট প্রত্যুত্তর, কোন সংশয় বা জড়তা মাত্রও নেই কণ্ঠস্বরে।
না, আমি ভুল করি নি। তবে বিনতা দেবী ছাড়াও আপনার অন্য কোন যদি নাম থাকে তো বলতে পারি না। কিন্তু সে কথা থাক। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল যে—
আমার সঙ্গে! কিন্তু আপনাকে চেনা তো দূরে থাক, কখনো দেখেছি বলেও তো মনে পড়ছে না আমার। বলতে বলতে হঠাৎই যেন মহিলা তার মুখের উপরের অনতিদীর্ঘ অবগুণ্ঠনটা বাঁ হাত দিয়ে টেনে একেবারে কপালের উপরে তুলে দিলেন।
গলির ঠিক মুখেই একটা গ্যাসপোস্ট ছিল, অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানির ওপর চকিতে সেই আলো এসে পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্ত শব্দ কিরীটীর অজ্ঞাতসারেই তার কণ্ঠ দিয়ে বের হয়ে আসে। কোন জীবিত মানুষের মুখ যে এত ভয়াবহ, এত কুৎসিত হতে পারে এ যেন কিরীটীর চিন্তারও অতীত ছিল।
শুধু ভয়াবহ ও কুৎসিত বললেই হয়ত সবটুকু তার বলা হয় না, বিকৃত একটা দুঃস্বপ্ন। যেন! আগুন বা তীব্র অ্যাসিড জাতীয় কিছুতে পুড়ে গেলে বিশ্রীভাবে যা দাঁড়ায় ঠিক তাই।
মুখের রেখা বা গঠনটাই আছে শুধু। নাক চোখ মুখ ওষ্ঠ জ্বর কোনটারই চিহ্নমাত্রও নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। একটা চোখ আছে, দ্বিতীয়টা নেই।
যার হাঁটা, দেহের গঠন, হাত এবং পায়ের রং দেখে একদা কিরীটীর মনে হয়েছিল কতই না সুন্দরী মহিলা, তার অবগুণ্ঠনের তলায় যে এত বড় একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ঢাকা থাকতে পারে বুঝি সে কল্পনাও করে নি।
বিস্ময়ের ঘোরটা কেটে যাবার পর কিরীটীর স্বাভাবিক অবস্থাটা যখন ফিরে এলো দেখলো অবগুণ্ঠিতা মহিলা ধীরে ধীরে সামনের গলির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছেন।
নির্বাক কিরীটী দাঁড়িয়ে রইলো। একটি শব্দও আর তার ওষ্ঠপ্রান্তে জাগল না। ফিরে এলো যখন কিরীটী, গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রনাথ।
কি হলো স্যার?
বিশেষ তেমন কোন সুবিধা করতে পারলাম না চন্দ্রনাথ। গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিতে দিতে কথাটা মৃদু কণ্ঠে বললে কিরীটী।
আমি কি এখনো যেভাবে ফ্ল্যাটটার দিকে নজর রাখছিলাম রাখব?
হ্যাঁ।
ঐদিন সন্ধ্যার ঠিক মুখে। টেলিফোন অফিস। অপারেটিং রুমে অপারেটাররা যে যার মাথায় হেডপিস লাগিয়ে কাজে ব্যস্ত।
হঠাৎ এক সময় কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়, তার রিলিফ এসে গিয়েছে সুধীরা নাগ।
রিলিফের হাতে কার্যভার তুলে দিয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, আমার duty off হলো, আমি চললাম কাবি, তোর তো দশটা পর্যন্ত ডিউটি আছে, না?
হাঁ। কৃষ্ণা অপারেটিং রুম থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
অপারেটিং রুমে কাজ চলেছে, মধ্যে মধ্যে অপারেটাররা নানা আলাপ-আলোচনা, হাসিতামাশাও করছে।
নবনিযুক্ত দুটি মেয়ে ইতিমধ্যে পরস্পরের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত আলোচনা নিয়ে মেতে উঠেছে।
একজনের নাম মিস লীলা ঘোষ, অন্যটির নাম মিস সবিতা চ্যাটার্জী। আরো দুচারজনও সেখানে এসে আড্ডায় যোগ দিয়েছে।
লীলা—জানিস ভাই সাবি, হিমাংশুটা একটা আসল ন্যাকা, কেবল শুনতে চাইবে তাকে আমি ভালবাসি কিনা?
সবিতা-বললেই পারিস, বাসি না।
লীলা—ওরে বাবা! তাহলে রক্ষে আছে? বলবে পটাসিয়াম সায়ানাইড় খাবো।
মিস ঘোষ স্থূলকায়া, বয়সও প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এগিয়ে এসে বলে, অমন ঢের বীরই সায়ানাইড় খেয়ে থাকে, এই তো সবে শুরু, বলে কত দেখলাম!
নীরা মল্লিক বলে ওঠে, বলুন না মিস ঘোষ, আপনার সেই fifty second লাভারের কথাটা!
ওদিকে বোর্ডে তখন ঘন ঘন ক আসছে, শ্ৰীমতীদের সেদিকে কারো কিন্তু এতটুকু খেয়াল নেই।
মিস ঘোষ কানেকশনটা দিয়ে বলে, Number please?
ওধার থেকে জবাব আসে, কতক্ষণ ধরে তো বলছি, B. B. 4542-শুনতে পান না নাকি?
মিস ঘোষ কানেকশনটা কেটে আবার আলাপে রত হয়, সে এক মজার ব্যাপার! সে ছেলেটি এক ইনসিওরেন্স অফিসে ১০০ টাকা না কত মাইনের যেন কাজ করতো–
বোর্ডে আবার আলো জ্বলে ওঠে, কল্ এসেছে।
পাশের থেকে একজন অপারেটার বলে ওঠে, আঃ জ্বালাতন! বলুন না মিস ঘোষ এনগেজড!
মিস ঘোষ আবার কনেকশনটা দিয়ে বলে, Number please!
Please put me B. B….
নম্বর বলা শেষ হবার আগেই মিস ঘোষ জবাব দেয়, Engaged! বলেই কনেকশনটা কেটে দেয়।
আর একজনও নম্বর চাওয়ায় বলে দিল, West line engaged!
আর একজনকে বললে, No reply!
আলাপ-আলোচনায় সব মশগুল।
যাকে No reply জবাব দেওয়া হয়েছিল, সে আবার কল্ করলে, শুনছেন? Clerk-inchargeকে কনেকশন দিন তো?
সবিতা জিজ্ঞাসা করে, কি বলছে রে মলি?
মলি হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ক্লার্ক ইশ্চার্জকে কানেকশনটা দিতে বলছে।
চুপ করে থাক। সাড়া দিস না। কতক্ষণ ট্যাপ করবে করুক না।
এবার সুধীরা নাগের আলোটা জ্বলে উঠলো।
Number please!
দেখুন আপনাদের অপারেটর মিস চৌধুরী আছেন?
কি নাম বললেন? কৃষ্ণা চৌধুরী? সুধীরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, কৃষ্ণা চৌধুরী। বলুন থিয়েটার রোড থেকে ডাঃ সুকুমার গুপ্ত কথা বলতে চাইছেন, অনুগ্রহ করে একটু ডেকে দিন না—
কথাটা কাবেরীর কানে গিয়েছিল, মিস নাগ জবাব দেওয়ার আগেই সে কানেকশনটা নিয়ে প্রশ্ন করলে, হ্যালো কে? ডাক্তার গুপ্ত?
হাঁ। মানে—আপনি, মানে
হ্যাঁ, কৃষ্ণা কথা বলছি, ব্যাপার কি?
কৃষ্ণা, আজ তোমার off কখন?
কেন বল তো?
বল না আগে, তারপর বলছি—
রাত দশটায়।
আজ ডিউটির পর আসবে এখানে?
যেতে পারি, কিন্তু আগে বল তো কেন?
বলতেই হবে!
নিশ্চয়ই।
আজ ভাবছি দুজনে গিয়ে কাফে-ডি-মুনে ডিনার খাবো, ইনডিয়ান ডিশ।
তারপর?
তারপর a long pleasure drive—
Oh how lovely! কোথায়—কতদূর?
So long as the petrol tank is not empty! রাত দশটায় ঠিক হাজির থাকবো। গেটের সামনে—with my car–
O. K.!
.
ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।
ডাঃ সুকুমার একটা সোফার উপরে আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে কৃষ্ণাকে ফোন করছিল, ফোন শেষ হতেই ফোনটা যেমন নামিয়ে রাখতে যাবে, সুইং ডোর ঠেলে কৃষ্ণা এসে প্রবেশ করল কক্ষে। পদশব্দে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাতেই সুকুমার চমকে ওঠে, কতকটা আত্মগতভাবেই যেন উচ্চারণ করে, এ কি! তু-তুমি?
খুব আশ্চর্য হয়েছে তো! Surprise একটা রীতিমত দিয়েছি তো?
পরক্ষণেই ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণাও যেন কতকটা বিস্মিত হয়ে বলে, ব্যাপার কি বল তো? এসে কি অন্যায় করলাম নাকি হঠাৎ এ সময়? ফিরে যাবো?
কৃষ্ণা সত্যি সত্যিই চলে যেতে উদ্যত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।
আরে না না—চলে যাচ্ছো কেন—সুকুমার ততক্ষণে অভাবনীয় পরিস্থিতিটা সামলে উঠেছে, মৃদু হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, চলে যাবে মানে? জান এই মুহূর্তে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম!
কৃষ্ণা মৃদু হেসে ফেলে, কিন্তু ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মুখের চেহারা যা হয়েছিল তাতে করে মনে হয়েছিল
কি মনে হয়েছিল বল তো?
কি আবার! মনে হয়েছিল—মনে হয়েছিল আর যাকেই হোক ঠিক ঐ মুহূর্তটিতে আমাকে অন্তত যেন তুমি expect করো নি।
হা ভগবান! দিবানিশি যার ধ্যানে আছি নিমগন, সেও কিনা হেন বাক্য করে উচ্চারণ! কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন কৃষ্ণা, বোস! চা আনতে বলি, কৃষ্ণা জবাব দেবার আগেই বেল্ বাজিয়ে জগদেওকে ডাকে সুকুমার।
জগদেও এসে কক্ষে প্রবেশ করে। সুকুমার বলে, জগদেও, জলদি চা!
সোফা হতে উঠে সুকুমার বলে, এক মিনিট—একটু বোস, আমি চট করে dressটা একটু বদলে আসি।
হঠাৎ? ড্রেস চেঞ্জের কি এমন দরকার পড়লো এ সময় শুনি?
হঠাৎ নয় দেবী, পূর্বপরিকল্পিত এবং ইতিমধ্যে তুমি না এসে পৌঁছে গেলে হয়ত তোমাকে ফোন করতাম।
কিন্তু পেতে না, কারণ আজ সন্ধ্যা ঠিক ছটায় আমার duty off তুমি জানতে না—
দ্বিতীয়টা স্বীকার করি, কিন্তু প্রথমটা স্বীকার করতে রাজী নই।
মানে?
মানে যাকে মনেপ্রাণে ডাকা যায়, ফোনে তার সাড়া না পেলেও সশরীরে এসে সে হাজিরা দেয়—ইহাই বেদবাক্য কহে সুধীজন। সুকুমার কথাটা শেষ করে হাসতে থাকে।
তা বইকি! কক্ষনো না। রাস্তায় বের হয়েই হঠাৎ তোমার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম তোমার এখানে সোজা।
আসতেই হবে, জান তো আমি একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট একেই বলে টেলিপ্যাথি, এর আকর্ষণ মাধ্যাকর্ষণের চাইতেও বেশী। বেচারী নিউটন ভূমি আকর্ষণ নিয়েই মেতে ছিল—মনের আকর্ষণ যে ভূমির আকর্ষণের চাইতে শত-সহস্র গুণে বেশী টের যদি পেত তাহলে হয়ত–
থাক, আর আকর্ষণের কাজ নেই যাও পোশাক বদলাতে যাচ্ছিলে তাই বদলে এসো।
হাঁ যাই—তুমিও ইতিমধ্যে বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখটা ধুয়ে এসো না।
মন্দ বল নি। কৃষ্ণা উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
কৃষ্ণা ঘর হতে বের হয়ে যেতেই চট্ করে সুকুমার ফোনটা তুলে নিল : হ্যালো, please put me to south…
ওপাশ হতে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, Kirity Roy speaking!
কে, কিরীটী? আমি সুকুমার।
কি ব্যাপার? হঠাৎ ফোন?
আজকেই–সব ready রাখবি, সুযোগ হঠাৎ মিলে গিয়েছে অভাবনীয়, এখন আর নয়, আবার মিলনী সঙ্ঘ থেকে তোকে ring করবো।
সুকুমার ফোনটা নামিয়ে রেখে বেশ পরিবর্তনের জন্য পাশের কক্ষে চলে গেল। কৃষ্ণা তখনও বাথরুম থেকে বের হয় নি।
.
একটু পরে জগদেও ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। ত্রিপয়ের ওপরে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে চলে যেতেই কৃষ্ণা প্রসাধনান্তে কক্ষে এসে প্রবেশ করল গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে। কাপ সাজিয়ে দুধ চিনি দিয়ে সব প্রস্তুত করে রেখে কৃষ্ণা সুকুমারের অপেক্ষা করতে থাকে। এবং একটু পরেই সুকুমারও এসে কক্ষে প্রবেশ করল, পরিধানে তার ধুতি-পাঞ্জাবি।
এ কি, বসে আছো কেন? শুরু করলেই পারতে। সুকুমার কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে।
এসো, আজ কি তোমার চেম্বার বন্ধ?
আজ যে রবিবার।
সত্যিই তো, মনে ছিল না।
চা-পান চলতে থাকে। হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আচ্ছা অফিসে আমাকে ফোন করবে বলেছিলে কেন?
আজ তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
কোথায়?
মিলনী সঙ্ঘে!
মিলনী সঞ্জ?
হ্যাঁ, দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত মহলের নর-নারীদের একটা ক্লাব বা মিলন কেন্দ্র। আজ সেখানে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে—বিখ্যাত আধুনিক গাইয়ে শ্রীমন্ত মুখার্জি সন্ধ্যায় গান গাইবেন। শুনেছো শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর গান?
না।
সত্যিই শোনবার মত। যেমন মিষ্টি তেমনি সুরেলা কণ্ঠ।
কিন্তু–
ভয় নেই, রাত দশটার আগেই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।…আর দেরি করলে হয়ত ওদিকে গানের পালা শেষ হয়ে যাবে, চল ওঠো।
কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটী রায়কে তুমি চেনো সুকুমার?
চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সুকুমার, কিরীটী রায়!
হ্যাঁ, চেনো নাকি তাই বল না?
চিনি। কিন্তু কেন বল তো? তুমিও তাকে চেনো নাকি?
হ্যাঁ, গতকাল পরিচয় হলো।
ও। তারপর হঠাৎ কি ভেবে প্রশ্ন করে, কেমন লাগল ভদ্রলোকটিকে?
আজ নয়, এ প্রশ্নের জবাব তোমাকে অন্য একসময় দেবো।
.
কিরীটীর বাড়ি। তালুকদার ও রহমানের সঙ্গে কিরীটী কথা বলছিল।
বেশ, রহমান জবাব দেয়, তাহলে আমি উঠি।
হ্যাঁ, আসুন।
রহমান চলে যেতে উদ্যত হতেই কিরীটী সহসা রহমানকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, হাঁ ভাল কথা রহমান সাহেব, গতরাত্রি থেকেই নরেন মল্লিকের মার্ডার সম্পর্কে একটা কথা ভাবছিলাম আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো, তা—
কি বলুন তো?
আচ্ছা নরেন মল্লিকের বাড়িটা ভাল করে সার্ভে করা হয়েছিল নিশ্চয়?
হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
আচ্ছা, মল্লিকের বাড়িতে মেইন গেট ছাড়া আর কোন প্রবেশ পথ আছে কিনা জানেন?
হ্যাঁ, বাড়িটার পিছন দিকে ছোট একটা বাগান আছে, বাগানের প্রাচীরের ওপাশে সরু একটা blind lane আছে, সেই blind lane দিয়েই একটা দরজা আছে বাড়িতে প্রবেশ করবার দেখেছি।
আছে? যাক বাঁচা গেল। শেষ পর্যন্ত এসে ঐ puzzleটাই আমাকে বিব্রত করে তুলেছিল গত দুদিন ধরে, যদিচ ঐরকম একটা কিছুর সম্ভাবনা সম্পর্কে না জানা থাকলেও কতকটা sureই ছিলাম—It was so important—কিরীটীর কণ্ঠস্বরে উল্লাস যেন উপচে পড়ে।
আমি আপনাকে ঠিক follow করতে পারলাম না তো! মিঃ রহমান বলে ওঠেন।
বলেন কি রহমান সাহেব! খুনোখুনির ব্যাপারে একটা দরজা থাকার importance কি কম?
কিন্তু দরজাটায় তো সর্বদা তালা লাগানো থাকত—সেদিনও তালা লাগানোই ছিল, যতদূর মনে আছে আমার।
কোন্ দিক থেকে তালা লাগানো থাকতো, ভিতরের দিক থেকে না বাইরের দিক থেকে?
বাইরের দিক থেকেই—অবশ্য তালাটা কখনো সেইজন্য ভোলাই হতো না।
ঠিক উল্টো। সেই কারণেই প্রায়ই তালা খোলা হতো এবং ঐ দ্বারপথেই নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষে ঘোরানো সিঁড়ি অতিক্রম করে, পরে সেরাত্রে বাথরুমের দরজা দিয়ে খুনী প্রবেশ করেছিল।
কি বলছেন? আমরা তো পরের দিন সকালে গিয়ে বাথরুমের সে দরজাটা বন্ধ দেখেছিলাম! খুনী যদি ঐ রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে থাকবে তবে–
তবে সে কোন্ পথে পলায়মান হলো, এই তো আপনার প্রশ্ন?
হ্যাঁ, মানে—
পালিয়েছে সে সদর দ্বার দিয়ে।
অ্যাঁ! তালুকদার এবার বলে ওঠে।
হ্যাঁ, easiest and shortest route! খুনীর গৃহে প্রবেশ, হত্যা ও পলায়ন পর্যন্ত solved! বাকী এখন আয়নাটার ভাঙা কাচ and why at all that particular knife was used and not a bullet! এটার জবাব অবশ্য আশা করি কৃষ্ণা ও কাবেরীর কাছ থেকেই পাবো।
একটু পরে কিরীটী আবার রহমানকে লক্ষ্য করে বলে, আচ্ছা রহমান সাহেব আপনি তাহলে আসুন।
রহমানের প্রস্থানের পর কিরীটী তালুকদারকে বললে, চলো একবার মিলনী সঙ্ঘের আশপাশ চক্কর দিয়ে আসা যাক্।
সেখানে আবার কেন?
চলই না।
.
মিলনী সঙ্ঘ। দক্ষিণ কলকাতার অতি আধুনিক ও আধুনিকাদের মিলন কেন্দ্র ঐ সঙ্। সুকুমারের গাড়ি যখন মিলনী সঞ্জের বাড়ির পোর্টিকোর নিচে এসে দাঁড়াল রাত্রি তখন সোয়া সাতটার বেশী নয়। সামনেই আলোকোজ্জ্বল হলঘরটি বহু নর-নারীর কণ্ঠস্বরে গুঞ্জনমুখরিত তখন। হাসির হল্লা উঠছে।
গাড়িটা একপাশে পার্ক করে সুকুমার কৃষ্ণাকে নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করতেই যুগপৎ সকলেরই মুগ্ধ ও বিস্মিত দৃষ্টি প্রথমে কৃষ্ণাকে পরিক্রম করে পরে সুকুমারের ওপরে নিবদ্ধ হলো। সকলেই সুকুমারের পরিচিত। অথচ কৃষ্ণাকে ইতিপূর্বে কেউ দেখে নি এবং চেনেও না। দুচারজন তরুণ সাদর আহ্বান জানায়, সুস্বাগত—সুস্বাগতম্ ডাঃ গুপ্ত!
একটি হালফ্যাসনদুরস্ত, এনামেলিং করা শ্যামবর্ণা তরুণী এগিয়ে এসে আধো আধো ন্যাকামিভরা কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যালো সুকুমার, naughty boy, where been so long!
ব্রিফলেস ব্যারিস্টার মিঃ নির্মল মিটার দুর্দান্ত সাহেব, ওষ্ঠাধরে ধৃত সরু পাইপে সিগারেট। একটু কাছ ঘেঁষে এসে মৃদু চাপা কণ্ঠে বলে, who is this dream, my dear Gupta?
আঃ, কি হচ্ছে মিত্র! চাপা তর্জন করে ওঠে সুকুমার।
সুকুমার এরপর কৃষ্ণাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার বান্ধবী কৃষ্ণা চৌধুরী।
হঠাৎ একসময় সেই এনামেলিং করা তরুণীটি সুকুমারের সামনে এগিয়ে এসে চাপা কণ্ঠে বলে, আমাদের লতা সেনকে তা হলে
সুকুমার ভূ-কুঞ্চিত করে একবার সেই তরুণীটির দিকে তাকিয়ে হলের অন্যদিকে কৃষ্ণাকে নিয়ে সরে যায়।
একটু পরেই শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর গান শুরু হলো। আধুনিক এক গীতিকারের একটি আধুনিক গান প্রথমে গাইতে আরম্ভ করেন শ্ৰীমন্ত মুখাজী। একটি বিরহের সঙ্গীত।
গানের সুরে সবাই মশগুল, কৃষ্ণাও মুগ্ধ হয়ে যায় শ্রীমন্ত মুখার্জীর গান শুনে, মুগ্ধবিস্ময়ে সে একপাশে বসে গান শুনতে থাকে। ঐ অবসরে নিঃশব্দে অন্যের অলক্ষ্যে সেই ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ছোট একটা টেবিলের উপরে রক্ষিত ফোনটার রিসিভারটা তুলে নেয়? Please put me to south…
***
ফোন সেরে হলঘরে ফিরে এসে দেখে কৃষ্ণা সেখানে নেই। সুকুমার হলঘরের সামনের টানা বারান্দায় বের হয়ে আসে। লম্বা টানা বারান্দা মৃদু আলোয় ছায়াচ্ছন্ন, রেলিংয়ের ধার দিয়ে সব টবে পামট্রি বসানো, ঝুড়িতে নানাজাতীয় সব অর্কিড়। একপাশে অন্ধকারে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণা নিঃশব্দে যেন ছায়ার মত।
সুকুমার এগিয়ে এসে ডাকে, কৃষ্ণা!
কে? চম্কে ফিরে তাকায় কৃষ্ণা, বলে, ওঃ তুমি! হঠাৎ আমাকে একা ওখানে ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?
কিন্তু তুমি এখানে যে—গান ভাল লাগল না?
মাথাটা হঠাৎ বড্ড ধরেছে—তাই এখানে খোলা জায়গায় একটু—
চল গঙ্গার ধারে খানিকটা না হয় ঘুরে আসি, মাথাটা ছেড়ে যাবেখন।
না। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও সুকুমার।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুকুমার বললে, রাত মাত্র তো সবে সাড়ে আটটা, এখুনি বাড়ি যাবে?
হ্যাঁ, চল—
কি ভেবে সুকুমার বলে, বেশ চলল।
বাড়ির কাছে এসে সুকুমার কৃষ্ণাকে নামিয়ে দেয়।
Good night—সুকুমার বলে।
Good night!
সুকুমারের গাড়ি চলে গেল।
কৃষ্ণা কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকল না, সামনের পার্কের দিকে এগিয়ে গেল। পার্কটি তখন প্রায় নির্জন হয়ে এসেছে, কেবল দুচারজন ইতস্তত পরিক্রমণ করছে। কৃষ্ণা একটা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসল।
.
টেলিফোন অফিস।
কাবেরীর ডিউটিও শেষ হয়ে গিয়েছিল রাত্রি সাড়ে আটটায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে বেশভূষা করে আবার কাবেরী অফিসেই ফিরে এল।
সুকুমারকে বলেছে সে, রাত দশটায় duty off হবে—সে আসবে এখানে। অপেক্ষা করতে থাকে কাবেরী সুকুমারের জন্য অপারেটরদের বিশ্রামকক্ষে বসে। হাতঘড়িতে ঠিক দশটা বাজতেই কাবেরী বেশভূষাটা ঠিক করে উঠে দাঁড়াল।
বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই কাবেরী বেশভূষার মধ্যে সামান্য অদলবদল করে নিয়েছিল, এবং নিজের নাম লেখা ভ্যানিটি ব্যাগটা আনবে না ভেবেও দৈবক্রমে কৃষ্ণার নাম লেখা ব্যাগটা আনতে গিয়ে নিজেরটাই নিয়ে এসেছিল অজ্ঞাতে। আর কৃষ্ণা লেখা ব্রোটা শাড়ির ওপরে কাঁধে এঁটে এসেছে। গেটের কাছে আসতেই দেখলে সুকুমারের গাড়ি আসছে।
সুকুমার গাড়িটা গেটের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিয়ে কাবেরীকে আহ্বান জানাল, এসো কৃষ্ণা।
কাবেরী মৃদু হেসে গাড়িতে উঠে সুকুমারের পাশের সীটে এসে বসল, খুব punctual তো?
হ্যাঁ, বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে appointment ঠিকমত রক্ষা করতে না পারলে
আজকালকার দিনে কি চলে!
তাই নাকি?
নিশ্চয়ই।
পাতলা একটা স্নিগ্ধ সুবাস কাবেরীর বেশভূষা থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
যদি কিছু মনে না কর কৃষ্ণা, বাড়িটা একবার ঘুরে যেতে চাই—
বাঃ, কি আবার মনে করবো, চল!
.
কাবেরী লক্ষ্য করে নি, অদূরে সুবিমলও ঠিক ঐ সময়টিতে তার ফ্লুইড় ড্রাইভ ডজ গাড়িতে বসে ওদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। ডাক্তার ও কাবেরীর সম্পর্ক কিছুদিন হতেই তার মনের মধ্যে একটা সন্দেহের ছায়াপাত করেছিল। ..
তাই কিছুদিন হতে কাবেরীকে সে অলক্ষ্যে অনুসরণ করছিল। কাবেরীকে ডাক্তারের গাড়িতে উঠতে দেখে ব্যাপারটা ঠিক সে বুঝে উঠতে পারল না, তা ছাড়া কৃষ্ণা বলে ডাক্তারের ডাকটাও তাকে কতকটা বিভ্রান্ত করেছিল। ডাক্তারের গাড়ি চলে যেতে সুবিমলও গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
সুকুমারের গাড়ি তার বাড়ির কম্পাউণ্ডে এসে প্রবেশ করলো।
এসো কৃষ্ণা—সুকুমার আহ্বান জানায় কাবেরীকে দরজা খুলে। দুজনে এসে সুকুমারের চেম্বারে প্রবেশ করলবোস।
সুকুমারের নির্দেশে কাবেরী একটা সোফার উপরে উপবেশন করে।
হঠাৎ তোমার আজকে বেড়াবার ও হোটেলে ডিনার খাবার শখ হলো যে সুকুমার? কাবেরী প্রশ্ন করে।
কাবেরীর সুকুমার সম্বোধনে সুকুমার প্রথমটায় চমকে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কি ভোলা মন তোমার কৃষ্ণা, এর মধ্যেই পরশু রাতের কথা ভুলে গেলে? কি কথা হয়েছিল আমাদের লেকের ধারে বসে?
এবারে কাবেরীর চমকাবার পালা, কিন্তু কাবেরীর হাবভাবে এতটুকু সেটা প্রকাশ পেল না, বরং মৃদু হেসে বললে, সত্যিই তো! দেখেছো কি ভোলা মন আমার, একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
তারপর সহসা একসময় সুকুমার কাবেরীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, একটা কথার সত্য জবাব দেবে কৃষ্ণা?
বল, কি কথার জবাব চাও?
সত্যি কি তুমি কিছু বুঝতে পারো নানা বুঝেও বুঝতে চাও না?
বুঝতে যে পারি না তা নয়—তাছাড়া সত্যিই এই দূরে দূরে থাকতে ভালও লাগে না, কিন্তু–
কিন্তু কি কৃষ্ণা?
ভাবছি বাবার কথা। তিনি যদি রাজী না হন?
নাই-বা হলেন রাজী, তাই বলে চিরকালটা এমনি করেই জীবন কাটাতে হবে নাকি? এমনি করেই তোমাদের দুটি বোনের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে নাকি?
কাবেরী সুকুমারের কথার কোন জবাব দেয় না, নিঃশব্দে বসে বসে শাড়ির আঁচলের পাড়টা টানতে থাকে।
কিন্তু তোমরা ওভাবে ব্যাপারটার অতটা importance দিলেও আমি কিন্তু ততটা চিন্তিত নই। একটা লোকের অদ্ভুত একটা খেয়াল নিয়ে আর দশজনের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে কেন? কিন্তু তা ছাড়াও যে জিনিসটা আমাকে মধ্যে মধ্যে চিন্তিত করে তোলে সেটা—
কি?
মনে পড়ে পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে পুলিসের কর্তৃপক্ষ তোমাদের দুবোনকে suspect–
সুকুমারের কথাটা শেষ হল না, কাবেরী তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, nonsense! কোথায় কি? কারো সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুলিসের সন্দেহের কথা ছেড়েই দাও, তুমি—তুমিও কি—
আমি? আমার কথা না হয় ছেড়েই দাও, কিন্তু একটা সন্দেহের দুঃস্বপ্ন অবিরত আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে ফিরবে এও তো–
কিন্তু আমি তোমার কথাই জানতে চাই।
অন্য কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি কিন্তু এটা তো ঠিকই, তোমাদের দুবোনের মধ্যে একজন নরেন মল্লিককে চিনতে–
সুকুমার!
হ্যাঁ, এটা শুধু মুখের কথা নয়, সাক্ষীপ্রমাণও যে তার আছে। সত্য যা একদিন না একদিন তা দিনের আলোর মত আত্মপ্রকাশ করবেই, সেদিন—একটু থেমে হঠাৎ সুকুমার আবার বলে, অন্তত আমার কাছে তুমি সব কথা খুলে বল কৃষ্ণা, সত্যিই যদি তুমি আমাকে ভালবাস, এ যন্ত্রণা থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দাও। আমাদের পরস্পরের প্রেমের মধ্যে এই যে সন্দেহের একটা কালো রাহু এ থেকে আমাকে মুক্তি দাও।
কাবেরী যেন পাষাণের মতই স্থির, অনড়। চোখের দৃষ্টি অকম্পিত।
কৃষ্ণা!
বল।
বল, বল কৃষ্ণা, সত্যিটুকু আমাকে খুলে বল! সহসা এগিয়ে এসে দুহাতে কাবেরীর একখানা হাত তুলে ধরে আবেগকম্পিত কণ্ঠে কথা কটি বলে সুকুমার।
সহসা কাবেরী সুকুমারের মুষ্টি হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, না না, আমি কিছু জানি না—আমি কিছু জানি না—
কৃষ্ণা!
সস্নেহে কাবেরীর অবনত পৃষ্ঠে একখানা হাত রেখে সুকুমার বলে, আমায় তুমি বিশ্বাস টী
না, না—আমায়—আমায় তুমি ক্ষমা করো সুকুমার। আমি কিছু জানি না জানি না। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়, তার কোলের ওপর থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা মাটিতে পড়ে যায়।
নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলতে গিয়ে সুকুমারের নজর পড়ল, ব্যাগটার গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ও কাবেরী।
ঠিক এমনি সময় টেলিফোন বেজে ওঠে : ক্রিং! ক্রিং! ক্রিং!
সুকুমার তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নেয়, হ্যালোর্য্যা, হাঁDr. Gupta speaking. কি—কি বললেন, হ্যাঁ, accident! Motor accidentয়ে মারা গেছেন? হাঁ। হাঁ আসছি, এখুনি আসছি–
কি–কি ব্যাপার সুকুমার? প্রশ্ন করে কাবেরী।
বড় sad news কৃষ্ণা! তোমার বোন কাবেরী, মানে—
কি–কি হয়েছে কাবির? বল—বল সুকুমার, চুপ করে রইলে কেন, বল?
সে, মানে, কাবেরীর মোটর অ্যাসিডেন্ট—। মুহূর্তে কাবেরীর সমগ্র মুখখানা যেন রক্তহীন, ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটা আর্ত অস্ফুট চিৎকার কাবেরীর কণ্ঠ হতে নির্গত হয়। কাবেরী মুহ্যমানের মত সোফাটার ওপরেই ধপ করে বসে পড়ে।
সুকুমার কাবেরীর পাশে এসে দাঁড়ায়, সস্নেহে ধীর কণ্ঠে বলে, এ সময় নার্ভ হারালে তো চলবে না কৃষ্ণা—চল বরং তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমিই হাসপাতালে যাই।
না, না—আমি—আমিও তোমার সঙ্গে যাবো সুকুমার—
তুমি যাবে?
হাঁ। আমায়—আমায় তুমি নিয়ে চল।
বেশ চল।
দুজনে উঠে দাঁড়ায়। গাড়িতে উঠে সুকুমার গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়ি ছুটে চলল। হাসপাতালের দিকে।
সার্কুলার নার্সিং হোম। সুকুমারের গাড়ি কাবেরীকে সঙ্গে নিয়ে এসে নার্সিং হোমের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করল। নার্সিং হোমের কক্ষে কক্ষে খোলা জানালাপথে নজরে পড়ে ডোমেঢাকা স্বল্প পাওয়ারের মৃদু আলোর আভাস। বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দায় একটি যুবক বোধ হয় ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, বললে, ডাক্তার গুপ্ত?
হাঁ।
এইদিকে আসুন।
যুবকের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে সুকুমার আর কাবেরী আললাকিত নাতিপ্রশস্ত একটি কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করে। অল্পবয়েসী একজন নার্স বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আর ঘরের মধ্যে অস্থির অশান্ত পদে কিরীটী পায়চারি করছে। স্বল্পবয়েসী একজন ডাক্তার অ্যাপ্রন গায়ে একপাশে দাঁড়িয়ে।
ওদের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখেই কিরীটী ডাক্তারকে আহ্বান জানায়, এই যে ডাক্তার, আসুন।
ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়? কি করে দুর্ঘটনা ঘটল?
সত্যিই বড় দুঃখের ব্যাপার। আমারই গাড়ির নীচে হঠাৎ—মানে আমি আমীর আলি অ্যাভিনু দিয়ে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে গাড়িতে করে আসছিলাম, রাস্তা অনেকটা খালি থাকায় বেশ জোরেই গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ আচমকা মেয়েটি ছুটে রাস্তা cross করতে গিয়ে আমার সামনে এসে পড়ে, আমি থামাতে পারলাম না, ফলে—
আঘাত, মানে—
মাথাটা একেবারে চাকার তলে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে যান, একটু আগে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মাত্র জ্ঞান হয়েছিল, কি সব নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপার, আপনার নাম, কৃষ্ণা না কাবেরী—কি সব যেন বললেন। আপনার নামটা আমার জানা ছিল, ফোন গাইড থেকে আপনার নাম খুঁজে বের করে তাই আপনাকেই ফোন করেছি। আর একটু আগেও যদি আসতেন ডাঃ গুপ্ত, হয়ত শেষ দেখাটা হতো
আমি—আমি তার dead bodyটা একবার দেখতে পারি না! অ্যাপ্রন পরা ডাক্তারটি বললে, আসুন—পাশের ঘরেই আছে।
সুকুমার ডাক্তার ও নার্সের সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে পর্দার ওপাশে।
.
একটা চেয়ারের উপরে মুহ্যমানের মত বসেছিল কাবেরী। মনের মধ্যে যে তার প্রচণ্ড একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার চোখ-মুখ দেখে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
একসময় পায়ে পায়ে কিরীটী কৃষ্ণার ছদ্মবেশে কাবেরীর ঠিক সামনে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বলে, মাপ করবেন, যিনি মোটর অ্যাসিডেন্টে একটু আগে মারা গেছেন, আপনার চেহারার সঙ্গে তার চেহারার অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে বলে মনে হচ্ছে, আপনারা
হ্যাঁ, সে আমারই যমজ বোন কাবেরী।
ঠিক ঐ সময়ে ইনসপেক্টার মজিবুর রহমান এসে কক্ষে প্রবেশ করে কাবেরীকে অদূরে উপবিষ্ট দেখেই বলে ওঠে, আপনি এখানে?
হাঁ ইনপেক্টার, আমার বোন কাবেরী—
I see! আপনারই বোন তাহলে মোটর অ্যাকসিডেন্টে—
হাঁ।
নরেন মল্লিক মার্ডার কেসের একজন suspect তাহলে দুর্ঘটনাতেই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়ে গেলেন! কতকটা যেন আত্মগতভাবেই কথাটা উচ্চারণ করলেন মজিবুর রহমান।
ইনসপেক্টার! কাবেরীর ডাকে রহমান ওর দিকে তাকান।
আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই—
কি বলুন তো?
আজ আর আপনার কাছে কোন কথাই গোপন করবো না ইনসপেক্টার—
ইনপেক্টার মজিবুর রহমান আবার কাবেরীর মুখের দিকে তাকালেন।
কাবেরী বলতে লাগল, কারণ যেজন্য সেদিন বাধ্য হয়েই আমাকে গোপনতার আশ্রয় নিতে হয়েছিল আজ আর তার প্রয়োজন নেই। কাবেরীর দুচোখে অশ্রু ঘনিয়ে আসে। চোখের জল মুছে কাবেরী বলে, যাকে পুলিসের সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্য সেদিন—মায়ের পেটের বোন হয়ে মিথ্যার আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছিল, হতভাগিনী সে-ই যখন আজ আর বেঁচে নেই—
একটু অপেক্ষা করুন মিস্ চৌধুরী! কাবেরীর বক্তব্যে বাধা দিয়ে হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে তাকিয়ে রহমান বলে, অবিনাশ, কৃষ্ণাদেবীর জবানবন্দিটা টুকে নাও। Yes—হ্যাঁ, এবারে বলুন মিস চৌধুরী কি বলছিলেন!
কাবেরী অরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে শুরু করে, আমাদের বাবা সঞ্জীব চৌধুরীকে আপনি জানেন ইনপেক্টার। আমাদের দুই বোনের স্বাধীনতা বলতে সত্যিকারের কিছুই ছিল না। বাড়িতে এবং বাইরে সর্বদা যেন বাবার হাজারটা অদৃশ্য চক্ষু আমাদের প্রতি সজাগ হয়ে থাকত। একান্ত অর্থাভাবের জন্যই আমাদের দুই বোনকেই টেলিফোনের কাজ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারও সঙ্গে, বিশেষ করে কোন পুরুষেব সঙ্গেই আমাদের দুবোনের কারোই। আলাপ-পরিচয় করবার বা মিশবার উপায় ছিল না। বাবার কড়া আদেশ ছিল, কোন পুরুষের সংস্রবেই যেন আমরা না যাই।
আপনাদের বিবাহ দেবার ইচ্ছাও তার ছিল না? প্রশ্ন করে কিরীটী।
না। বাবা বলতেন, বিবাহ করলেই নাকি আমরা পর হয়ে যাব। বাবার তা সহ্য হবে না। আমাদের ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।
তারপর? রহমান বলে।
কিন্তু বাবার এত সাবধানতা, সদাসতর্ক ও জাগ্রত দৃষ্টি আমাদের ওপরে থাকা সত্ত্বেও কাবেরী যেন কোন্ একাকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল—আমি বা বাবা প্রথমটায় আদপেই তা টের পাইনি। পরে যখন জানতে পারলাম—
আপনার বাবা তাহলে শেষ পর্যন্ত কাবেরী দেবীর মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরেছিলেন? প্রশ্ন করে কিরীটী।
আচমকা কিরীটীর প্রশ্নে কাবেরী যেন চমকে ওঠে। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই জানতেন। এত বড় একটা ব্যাপার তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাবে তা মোটেই সম্ভব নয়।
তারপর আপনার বাবা ঐ ব্যাপার জানা সত্ত্বেও কোনরকম গোলমাল করেন নি বা বাধা দেন নি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
আশ্চর্য! বলুন, তারপর?
মধ্যে মধ্যে গোপনে আমাদের বাড়ির সামনেই যে পার্কটা আছে, সেখানে নরেন মল্লিক কাবির সঙ্গে এসে দেখা করতে এবং পার্কেই একদিন তার সঙ্গে কাবির মধ্যস্থতাতে আমারও আলাপ হয়।
আচ্ছা একটা কথা কৃষ্ণা দেবী—কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলুন?
মিঃ নরেন মল্লিক ও আপনার বোন কাবেরী দেবী, এদের মধ্যে, মানে পরস্পরের মধ্যে পত্রবিনিময় হতো কিনা আপনি জানেন কিছু?
কি জানি, বলতে পারি না ঠিক। আর হলেও আমার নজরে কখনও পড়ে নি।
হুঁ, বলুন—তারপর?
তারপর সেই ২৭শে পৌষ রবিবার যেদিন রাত্রে নরেন মল্লিক তার শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন—
কিরীটী লক্ষ্য করে কাবেরীর চোখে-মুখে হঠাৎ যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চোখের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ, সমগ্র মুখখানি রক্তচাপে রক্তিম হয়ে উঠেছে, গলার দু পাশে ও কপালের দুদিককার শিরাগুলো আরো স্পষ্ট ও সজাগ হয়ে উঠেছে, নাসিকার অগ্রভাগ ফুলে ফুলে উঠছে।
কাবেরী বলতে থাকে ও আমাদের দুবোনেরই সেদিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত off-duty ছিল। সন্ধ্যার কিছু পরেই সাজগোজ করে কাবেরী বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। রাত্রি এগারটা সাড়ে এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে যখন ফিরল না, বাইরের ঘরে তার অপেক্ষায় সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়তে পড়তেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মৃদুভাবে দরজার গায়ে শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো চাপা গলায় কে যেন ডাকছে : দিদিদিদি! উঠে দরজা খুলে দিতেই দেখি—কাবেরী! কাবেরী ঘরে এসে প্রবেশ করল। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় কাবেরীর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। তার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি। আর—আর–
বলুন? বলুন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
রক্ত! তার কাপড়ে রক্তের দাগ! অকারণে একটা ভয়ে বুকের ভিতরটা আমার কেঁপে উঠলো। বললাম, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি? আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে সে সোজা শয়নকক্ষের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে আমি যখন শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, দেখলাম ঘর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার ঘরে কার চাপা কান্নার শব্দ যেন গুমরে গুমরে উঠছে। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি কাবেরী তখনও ঘুমিয়ে—তার ডিউটির সময় হয়েছে, তবু তাকে না জাগিয়ে আমি একাই ডিউটিতে চলে যাই।
***
ঠিক এমনি সময়ে বাইরে একটা মোটর গাড়ি এসে থামবার শব্দ শোনা গেল। কাবেরী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, অফিসে সে সেদিন একটু লেটেই এলো। পাশাপাশি বসে দুজনে কাজ করছি, তবু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না।
বাইরের বারান্দায় একটা শব্দ শোনা যায়—খট্ খট্ খট্। খট খট শব্দটা ক্রমে যেন ঐ ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে।
খট খট শব্দে সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষিত হয়। ক্রাচে ভর দিয়ে দরজার উপরে এসে দাঁড়ালেন সঞ্জীব চৌধুরী। চোখে মুখে তার উদ্বেগের সুস্পষ্ট চিহ্ন।
সঞ্জীবকে দরজার গোড়ায় দেখেই হঠাৎ কাবেরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং তার বিস্মিত কণ্ঠ হতে অর্ধস্ফুট একটা আর্ত শব্দ নির্গত হয়, বাবা!
কাবেরী কোথায়? সত্যিই কি সে মোটর-অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে? বলতে বলতে সঞ্জীব চৌধুরী কমধ্যে এসে প্রবেশ করেন এবং পরক্ষণেই কাবেরীকে অদূরে দণ্ডায়মান দেখে বলে ওঠেন, কিন্তু এই তত—এই তো! তবে—তবে যে কে এক ডাক্তার ফোনে বললে, তুমি—তুমি নাকি মোট অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে!
সঞ্জীবের কথায় কাবেরীর মুখখানা যেন সহসা ছাইয়ের মত রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সে তাকায় বাপের মুখের দিকে।
কিরীটীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ শোনা গেল, তাহলে আপনি—আপনিই কাবেরী চৌধুরী! এতক্ষণ তাহলে কৃষ্ণা চৌধুরীর পরিচয়ে ধোঁকা দিচ্ছিলেন! মারা গেছেন তাহলে আসলে কৃষ্ণা দেবীই কাবেরী চৌধুরী নন?
আমি-আমি–, কি যেন কাবেরী বলবার চেষ্টা করে।
কিরীটী ঘুরে সঞ্জীব চৌধুরীকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করে, মিঃ চৌধুরী, তাহলে ইনিই কাবেরী। দেবী?
নিশ্চয়ই। আমার মেয়েকে আমি চিনি না! ঐ তো আমার ছোট মেয়ে কাবেরী—কিন্তু–
হঠাৎ কাবেরী যেন পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, না না, আমি কাবেরী নয়—আমি কৃষ্ণা। বাবা, তুমি কি আমায় চিনতে পারছো না? চেয়ে দেখো ভাল করে চেয়ে দেখো বাবা, আমি–আমি কাবেরী নই, আমি—আমি তোমার কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা! হঠাৎ হাঃ হাঃ হাঃ করে পাগলের মত হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী, তুই কৃষ্ণা, হ্যাঁ। তুই কৃষ্ণা! হাঃহাঃহাঃ! পাগলের মতই হাসতে থাকেন সঞ্জীব চৌধুরী।
কাবেরী ছুটে এসে তার বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, বাবা–বাবা! আমি—আমি সত্যিই তোমার কৃষ্ণা! দেখো, আমি সত্যিই তোমার বড় মেয়ে কৃষ্ণা—
য়াঁ! হঠাৎ হাসি থামিয়ে বোবাদৃষ্টিতে তাকান সঞ্জীব মেয়ের মুখের দিকে। তারপর অধস্ফুট স্বরে বলেন, তুমি—তুমি তাহলে কাবেরী নও? তুমি কৃষ্ণা? তাহলে—তাহলে কৃষ্ণা মরে নি—মরেছে কাবেরী? না না, তা কি করে হবে? কাবেরী কাবেরী! কৃষ্ণ কৃষ্ণা! না না, আমি যাই—আমি যাই—
ক্রাচে ভর দিয়ে অস্থিরভাবে খট খট শব্দ তুলে সঞ্জীব ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
আর কাবেরী হঠাৎ চেয়ারটার উপরে বসে দুহাতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রোরুদ্যমানা কাবেরীর দিকে।
হঠাৎ কাবেরী উঠে পড়ে। তারপর বলতে বলতে বের হয়ে যায় ঘর হতে, বাবা–বাবা, শোন—শোন, দাঁড়াও!
অবিনাশ ও রহমান দুজনেই কাবেরীকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, কিরীটী ওদের বাধা দিয়ে বলে, না, ওঁকে যেতে দিন রহমান সাহেব।
.
কক্ষের মধ্যে যেন নাটকের একটা দৃশ্য অভিনীত হয়ে গেল।
কাবেরী ও তার পিতা সঞ্জীব চৌধুরীর পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তাগুলো নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে গত ২৭শে পৌষ যে রহস্যজাল বিস্তৃত করেছিল এ যেন তারই সমাপ্তির রূঢ় ইঙ্গিত। সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কারো মুখে কথাটি পর্যন্ত নেই।
সর্বপ্রথম কথা বললে কিরীটী, এতটা আমি ভাবি নি। অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত তীর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করেছে।
রহমান বললেন, কাবেরীকে ওভাবে না যেতে দিলেই কি ভালো হতো না মিঃ রায়!
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ভয় নেই রহমান সাহেব, এ অজগরের গ্রাস, একবার যখন দাঁত বসিয়েছে, পূর্ণগ্রাসের থেকে আর ও নিস্তার পাবে না।
ইতিমধ্যে একসময় ডাঃ সুকুমারও কক্ষে এসে প্রবেশ করে একপাশে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, ডক, this is the world! কিন্তু আমি বলছি তুমি ঠকে নি!
ঠিক এমনি সময়ে একটা গাড়ি এসে থামবার শব্দ পাওয়া গেল।
কে এলো?
দেখুন তো রহমান সাহেব কে এলেন!
রহমানকে আর বাইরে বের হয়ে দেখতে হলো না, তালুকদার কক্ষে প্রবেশ করলে, চোখেমুখে তার সুস্পষ্ট একটা উত্তেজনার ভাব।
ব্যাপার কি তালুকদার সাহেব?
জব্বর সংবাদ! উত্তেজিত ভাবে তালুকদার বলে।
হেঁয়ালি ছেড়ে বল, বর্মা থেকে কোন সংবাদ পেয়েছ বোধ হয়!
আশ্চর্য! How could you guess?
Simple rule of three! বর্তমানে যে কেস নিয়ে আমরা ব্যস্ত তার মধ্যেই তো একটা অপ্রাপ্ত সূত্র ঐ বর্মা-সংবাদ। এবং এত রাত্রে হন্তদন্ত হয়ে যখন এসেছো, বুঝতে কষ্ট হওয়া তো উচিত নয়—কি হতে পারে তোমার অত্যাশ্চর্য সংবাদ। Now—now tell me, নরেন মল্লিকের অতীত বর্মা-বাস সম্পর্কে কি এমন সংবাদ গ্রহণ করলে!
তুমি জান, আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে বর্মার স্পেশাল পুলিশে নরেন মল্লিকের details চেয়ে পাঠানো হয়েছিল তোমারই পরামর্শমত!
হ্যাঁ, তা তো জানি।
এই কিছুক্ষণ আগে এখানকার হেড কোয়ার্টারে সিগন্যাল মেসেজ এসেছে। নরেন মল্লিকের যৌথ কারবার ছিল বার্মা-টিকের ইসমাইল খাঁ নামে এক পাঠানের সঙ্গে। ইসমাইলের বাপ ছিল পাঠান ও মা বর্মী এবং ব্যবসাসূত্রেই নরেনের ইসমাইল-গৃহে যাতায়াত ও ঘনিষ্ঠতা খুবই ছিল।
অর্থাৎ মল্লিক মশাই ইসমাইল খাঁর ঘরে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করে! বল, তারপর?
ইসমাইল খাঁর এক পরমা সুন্দরী শিক্ষিতা কন্যা পীরবানু নরেনের সঙ্গে বিশেষ একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
কলির ডন যুয়ান একেবারে, তারপর?
কিন্তু ইমসাইল খাঁ কন্যার পরদেশীর সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠতাটা ঠিক বরদাস্ত করে উঠতে পারে নি।
ফলে পিতা ও কন্যার মধ্যে মতান্তর!
Exactly—
হতেই হবে, শিক্ষিতা কন্যা যখন! Yes, go on—তারপর?
এমন সময় সহসা এক রাত্রে নরেন পীরবানুকে নিয়ে—
পলায়মান! চমৎকার! তারপর?
ইসমাইল খাঁ ক্ষেপে গেল সংবাদ পেয়ে এবং ছুটলো ওদের পিছু পিছু। শেষ পর্যন্ত ধরে ফেললে বর্মা সীমান্তে। বাপ-মেয়েতে কথা-কাটাকাটি হলো এবং শেষ পর্যন্ত বাপ মেয়েকে জোর করে নিয়ে গেল নরেন সোজা ফিরে এল কলকাতায়।
উঁহু, শুধু ঐ নয়—আরো story আছে!
আছে, তবে সেটা সঠিক জানা যায় নি, কেবল জানা গেছে ইসমাইলের রত্ন-ভাণ্ডারে—
তালুকদার এই পর্যন্ত বলেছে, সহসা কিরীটী লাফিয়ে ওঠে, Hurry up—চল, এখুনি চল–
বিস্মিত তালুকদার শুধায়, কোথায়?
কিরীটী বলে, আমীর আলি অ্যাভিনুতে কৃষ্ণা কাবেরীর ফ্ল্যাটে —quick!
***
ঘণ্টা দুই পরে।
কৃষ্ণাদের ফ্ল্যাট বাড়ির বাইরের ঘর। সোফার উপরে বসে দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে কাবেরী। দরজাটা হা-হা করছে খোলা। নিঃশব্দে কিরীটী এসে কক্ষে প্রবেশ করে-কাবেরী দেবী!
চমকে মুখ তুলে তাকায় কাবেরী—কে?
পুলিশ এসেছে, আপনাকে নরেন মল্লিকের হত্যাপরাধে গ্রেপ্তার করতে। কিরীটী বলে।
পুলিশ! আর্ত চিৎকার একটা বের হয়ে আসে কাবেরীর কণ্ঠ হতে।
হ্যাঁ, ঐ দেখুন।
সত্যিই দরজার গোড়ায় দুজন লাল পাগড়ী নিঃশব্দে দণ্ডায়মান।
ত্রস্ত ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়ায় কাবেরী, কিন্তু আমি—আমি তো হত্যা করি নি নরেনকে! আমি
বৃথা লুকোবার আর চেষ্টা করে কোন ফল হবে না কাবেরী দেবী। আপনি—আপনি নরেন মল্লিককে হত্যা করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণা দেবী পুলিসের কাছে statement দিয়ে গিয়েছেন—
কিরীটীর কথা শেষ হলো না, কাবেরী পাগলের মতই যেন চিৎকার করে উঠল, মিথ্যা—মিথ্যা! কৃষ্ণা-কৃষ্ণা মিথ্যা কথা বলেছে।
না। সে মিথ্যা কথা বলে নি। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাঁ—সে মিথ্যা বলেছে, বলতে বলতে সহসা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় কাবেরী এবং উঠে দাঁড়াতেই তার পূর্ণ প্রতিকৃতি সম্মুখে দেওয়ালের গায়ে প্রলম্বিত দর্পণে প্রতিফলিত হলো। সেই প্রতিবিম্বিত নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়েই অকস্মাৎ যেন ক্ষেপে ওঠে কাবেরী এবং মুহূর্তে নিজের কোমর থেকে তীক্ষ্ণ ধারালো একখানা ছোরা বের করে, কতকটা উন্মাদিনীর মতই যেন ছুটে গিয়ে দর্পণের কাচের উপরে ছোরা দিয়ে সজোরে আঘাত করে চিৎকার করে ওঠে, কৃষ্ণা—
ঝন্ ঝন্ করে ছোড়ার আঘাতে দর্পণের কঁচটা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। তাতেও যেন কাবেরীর রোষ প্রশমিত হয় না, আবার আঘাত হানবার জন্যে হাত তুলতেই চোখের পলকে কিরীটী এগিয়ে এসে সজোরে কাবেরীর উত্তোলিত হাতটা চেপে ধরে কঠিন কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠে, আবার—আবার আপনি কাবেরী দেবী সেরাত্রের মতই ভুল করেছেন! She is not কৃষ্ণা—but reflection-your own reflection on the mirror! কৃষ্ণা নয়, দর্পণে আপনারই ছায়া ওটা। ভাল করে চেয়ে দেখুন—আপনারই ছায়া, আপনি কৃষ্ণা নয়!
আর্ত চিৎকার করে ওঠে কাবেরী, ছায়া! কৃষ্ণা নয়—ছায়া!
হ্যাঁ, ছায়া—আপনারই ছায়া। যমজ বোনের একজন—আপনারই ছায়া, কাবেরী দেবী।
কৃষ্ণা নয়? ছায়া-ছায়া!
হ্যাঁ, ছায়া। এখন বসুন—স্থির হয়ে বসুন।
মুহ্যমান কাবেরীকে একপ্রকার যেন জোর করেই কিরীটী সোফার উপরে বসিয়ে দেয়। —এখন বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন, হিংসায় অন্ধ হয়ে রাগে উত্তেজনায় সে-রাত্রে নরেন মল্লিকের শয়নঘরের আয়নাটার উপরে আঘাত হেনে আপনি সেটা ভেঙে দিয়েছিলেন— নিজের ছায়াই আয়নাতে দেখে কৃষ্ণা ভেবে কৃষ্ণাকে ছোরা দিয়ে খুন করতে গিয়ে!
দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে কাবেরী বলে ওঠে, সত্যিই বলছেন কৃষ্ণাকে আমি দেখি নি–কৃষ্ণাকে আমি দেখি নি–
না, দেখেন নি। That was your own reflection! নরেন মল্লিকের ঘরের আয়নার ভাঙা কাচই সে কথা সেদিন আমায় বলেছিল। এবং তাই প্রথমে আমার সব কেমন গোলমাল ঠেকেছিল, ছোরাটা মৃতের বক্ষে বিদ্ধ রইলো, কোন গুলি ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল না, অথচ আয়নার কাচটা ছিল ভাঙা!
এমন সময় রহমান, ডাক্তার সুকুমার ও কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
আসুন কৃষ্ণা দেবী! কিরীটীই আহ্বান জানাল।
কাবি? কৃষ্ণা বলে ওঠে।
অকস্মাৎকৃষ্ণার কণ্ঠস্বর শুনে কাবেরী যেন বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায় এবং উন্মাদিনীর মতই কৃষ্ণার দিকে চিৎকার করে ছুটে যায়, খুন করবো তোকে সর্বনাশী! তুই-তুই-তুই-ই আমার
জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু!
মুহূর্তে কিরীটী এগিয়ে এসে কাবেরীকে প্রতিরোধ করে, কাবেরী দেবী!
না—না, আমায় ছেড়ে দিন আমায় ছেড়ে দিন। ওকে ওকে আমি খুন করবোই।
কিরীটীর বজ্রমুষ্টি হতে নিজেকে ঝাঁকি দিয়ে মুক্ত করবার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে
কাবেরী বলতে থাকে।
কাবেরী দেবী! দুহাতে কাবেরীর স্কন্ধের দুপাশ দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে প্রচন্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠে কিরীটী, চুপ করে বসুন–না হলে বাধ্য হবো আমি আপনার হাতে হাতকড়া লাগাতে!
কাবেরী সোফাটার উপরে বসে পড়ে সোফার মধ্যেই মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। মিনিট পাঁচ-সাত কিরীটী কাবেরীকে কঁদতে দেয়। কিছুক্ষণ কেঁদে কাবেরী একটু সুস্থ হলে কিরীটী ডাকে, কাবেরী দেবী, এখন নরেন মল্লিককে কেন খুন করতে–
খুন—হ্যাঁ, খুন নরেনকে আমি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি—শুধু নরেনকে কেন, একই সঙ্গে দিদি কৃষ্ণাকেও!
কিন্তু কেন—কেন ওদের খুন করতে চেয়েছিলেন? কথাটা বলে ওঠেন রহমান সাহেব।
কেন খুন করতে চেয়েছিলাম! জঘন্য, হীন প্রতারকরাগে উত্তেজনায় কাবেরীর সমগ্র মুখখানি যেন রক্তচাপে লাল হয়ে ওঠে, কেন খুন করতে চেয়েছিলাম জিজ্ঞাসা করছেন? ভাবতে পারেন, যাকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে আমি ভালবেসেছিলাম—যাকে ভালবেসে জীবনের নীতিকে বর্জন করেছি, পিতার স্নেহ-ভালবাসাকে উপেক্ষা করেছি, পিতাকে প্রতারণা করেছি, সেই শঠ প্রতারক নরেন—যখন জানতে পারলাম আসলে সে কৃষ্ণাকেই ভালবাসে, আমাকে নয়, আমার প্রতি ভালবাসা তার অভিনয় মাত্র, দিনের পর দিন আমার বুকভরা ভালবাসাকে নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে, পদদলিত করেছে—ভাবতে পারেন নারী হয়ে সে কি মর্মান্তিক লজ্জা, কি দুঃসহ বেদনা! শঠ, নীচ, প্রতারক!
কিরীটী বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু তাই যদি হয় সে তো ওর দোষ নয়!
আবার ক্ষেপে ওঠে কাবেরী এবং কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, দোষ নয়? ওরই দোষ-ঐ—ঐ শয়তানীকে সে ভালবাসতো অথচ পরিচয় আগে তার আমার সঙ্গেই। আমিই কৃষ্ণার সঙ্গে পরে তার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। দিনের পর দিন প্রলোভনের জাল বিস্তার করে, প্রেমের ভালবাসার অভিনয় করে আমাকে আকর্ষণ করেছে, এমন কি চোরের মত লুকিয়ে ওর বাড়ির পশ্চাতের দ্বার দিয়ে রাত্রে সেই শঠ প্রতারকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছি। কিন্তু যেদিন বুঝলাম আসলে সে আমাকে চায় না, চায় কৃষ্ণাকেই—স্থির করলাম তাকে খুন করবো-শুধু তাকেই নয়, কৃষ্ণাকেও!
বুঝতে পারছি এখন আপনার তখনকার মনের অবস্থা কাবেরী দেবী সহানুভূতির সঙ্গে কিরীটী বলে।
কতটুকু বুঝতে পেরেছেন সে জ্বালা, সে দাহ! না না, কেউ বুঝতে পারে না—আমার মত যে না জ্বলেছে সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না, পারবে না। হ্যাঁ, তারপর থেকেই সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! সুযোগ এলো। জন্মতিথি উৎসবে নরেন আমায় নিমন্ত্রণ করলে না, করলে কৃষ্ণাকে—রাত্রে তার ওখানে যাওয়ার জন্য। চিঠি নন্দুয়ার হাতে পাঠিয়েছিল, আমার হাতে এসে পড়লো। এই সুযোগ। লুকিয়ে ফেললাম চিঠিটা। অফিস হতে ঐদিনই কৃষ্ণার পরিচয়ে নরেনের সঙ্গে appointment করলাম রাত্রি সাড়ে আটটায় দেশপ্রিয় পার্কে দেখা করবার জন্য।
তারপর? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী প্রশ্ন করে।
কৃষ্ণার পরিচয়েই দেশপ্রিয় পার্কে কৃষ্ণার মত সাজসজ্জা করে ঠিকসময় নরেনের সঙ্গে দেখা করলাম—বললাম, চিঠি পেয়েছি। রাত বারোটায় তার শয়নকক্ষে গিয়ে দেখা করবো, সে যেন বাথরুমের দরজাটা খুলে রাখে। আমার কথা শুনে আনন্দে সে উল্লসিত হয়ে উঠলো। এতদিন সে আমার সঙ্গে অভিনয় করে এসেছে, কিন্তু এমন নিখুঁত অভিনয় সেরাত্রে আমি তার সঙ্গে করলাম ধরতে পারলে না সে!
একটু থেমে কাবেরী আবার বলতে লাগল, আগেই একটা ছোরা কিনে রেখেছিলাম বাড়িতে ফিরে দেখি কৃষ্ণাও ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে এসেছে। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে, কোনমতে মুখে চারটি খুঁজে তাড়াতাড়ি শয্যায় গিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে শুয়ে পড়লাম যে যার পৃথক শয্যায়। ঠিক রাত যখন সাড়ে এগারটা, নিঃশব্দে শয্যার ওপরে উঠে বসলাম।
ঘর অন্ধকার। অন্ধকারেই চেয়ে দেখলাম, কৃষ্ণা তার শয্যায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে বাবার শরীর খারাপ বলে বাবা নাকি কৃষ্ণা যখন সন্ধ্যার সময় বের হয় তাকে বলেছিলেন বিরক্ত না করতে। ঘরের আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন আমাদের আগেই।
বাবার ঘরের দিকে তাকালাম, কোন সাড়াশব্দই নেই। পা টিপে টিপে শয্যা হতে উঠে, প্রথমেই কোমরে ছোরাটা গুঁজে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের কক্ষে চলে এলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ ভাল করে সাজলাম। অভিনয় করতে চলেছি। অভিনয়—অভিনয়ের শেষরাত্রি। লাল রক্তবর্ণ শাড়ি পরলাম। মাথার চুল এলোখোঁপা করে বেঁধে, ঠিক কৃষ্ণার মত করে তার ব্রোচটা শাড়িতে এঁটে, তার ভেইলটা মাথার ওপরে দিয়ে রাস্তায় এসে নামলাম। হনহন করে হেঁটে চললাম নরেনের বাড়ির দিকে। নির্জন রাস্তা, একটুকু ভয় করে নি আমার।
নরেনের বাড়িতে অনেক রাত্রেই তো অমনি করে অভিনয় করে গিয়েছি এসে বাড়ির পশ্চাতের গলিপথের দরজাটা দিয়ে ঢুকে। তাই বাইরে থেকেই সেটায় ইদানীং তালা লাগানো থাকতো। চাবি আমার কাছেই থাকতো। চাবি দিয়ে তালা খুলে বাগানে প্রবেশ করলাম। ঘোরানো সিঁড়িপথে নরেনের শয়নকক্ষ-সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। বাথরুমের দরজাটাও ভোলাই ছিল কিন্তু নরেনের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দেখি ঘর অন্ধকার দেওয়ালের গায়েই সুইচ, হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বাললেই–
হ্যাঁ, মুহূর্তে যেন মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো-মনে হলো যেন কৃষ্ণাই ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, দ্বিধামাত্র না করে কোমর থেকে ছোরাটা টেনে ছুটে গিয়ে কৃষ্ণা ভেবে দর্পণের ওপরেই হাতের ছোরাটা দিয়ে আঘাত হানলাম। ঝনঝন করে দর্পণের কঁচটা ভেঙে যেতেই সেই শব্দে আমার জ্ঞান যেন ফিরে এলো এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনের দিকে নজর পড়তে আতঙ্কে দুপা পিছিয়ে গেলাম! নরেনের মৃতদেহটা মেঝের কার্পেটের ওপরে পড়ে আছে। আর তার বুকে বিঁধে আছে সমূলে একখানা ছোরা। ভয়ে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ এমন সময় ফিরে চেয়ে দেখি পিছনের বাথরুমের দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে বাবা আর তারই পিছনে কৃষ্ণা!
আমি—আমি এবারে বলবো ইন্সপেক্টার, আমায় বলতে দিন—আচা কাবেরীর উক্তিতে বাধা পড়ায় এবং অন্য একটি কণ্ঠস্বরে একসঙ্গে ফিরে তাকাল কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে।
ঠিক দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার উপরে ইতিমধ্যে কখন যে একসময় নিঃশব্দে সকলের অলক্ষ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী কেউ তা লক্ষ্য করে নি। কিন্তু সঞ্জীব চৌধুরীকে কথা বলতে শুনে সেই দিকে ফিরে তাকিয়ে কাবেরী যেন পাষাণে পরিণত হয়ে গেল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণাও চিৎকার করে উঠলো, বাবা! বাবা! না না—তুমি না—তুমি না!
ছুটে এসে কৃষ্ণা সঞ্জীবকে যেন দুহাতে আগলে ধরতে চেষ্টা করে।
সঞ্জীব বাধা দিয়ে মেয়েকে সরিয়ে দেন, বলতে দে মা আমায় বলতে দে! পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমায় করতে দে!
বাবা! বাবা! কৃষ্ণা আবার পিতাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে।
আঃ সরে যা! শুনুন ইনসপেক্টর-নরেন মল্লিককে আমিই খুন করেছি কাবেরী খুন করে নিখুন করেছি আমি, আমার মেয়েকে সে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে আমি সহ্য করতে পারি নি। আমার স্ত্রী করুণার ব্যবহারে আমি মেয়েজাতটার ওপরেই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। তাই নিজের ঔরসজাত মেয়েদেরও আমি বিশ্বাস করি নি কারো সঙ্গে মিশতে দিই নি। সর্বদা চোখে চোখে রেখেছি। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম কাবেরী তার মায়ের রক্তের ঝণই শোধ করতে চলেছে, আমাকে প্রতারণা করে নরেনের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে, কাবেরীর ওপর নজর রাখলাম। ওর ঘর থেকেই চিঠি চুরি করে সব জানতে পারলাম। তারপর যখন জানতে পারলাম—শুধু আলাপই নয়, কাবেরী অনেক রাত্রে নরেনের গৃহে যায়—রাগে তখন আমার মাথায় খুন চেপে যায়। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। এলো সুযোগ-নরেন যে চিঠিতে তার জন্মতিথির দিন রাত্রে কৃষ্ণাকে ওর বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ করে, সে চিঠিখানা কাবেরী তখন তার ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে স্নানঘরে গিয়েছে, সেই ফাঁকে লুকিয়ে পড়ি, এবং বুঝি ঐ চিঠি হতে, কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে নরেনের ব্যাপারে একটা গোলযোগ আছে। যা হোক, ঠিক করলাম ঐ রাত্রেই দুজনকে একসঙ্গে হত্যা করবো। লোডেড রিভলভারটা নিয়ে—ওরা দুবোন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই সিঁড়ির নিচে গিয়ে আত্মগোপন করে রইলাম কাবেরীর অপেক্ষায়। ঠিক রাত সাড়ে এগারোটার কিছু পরে সিঁড়িতে পদশব্দ পেলাম, বুঝলাম কাবেরী আসছে। সত্যিই কাবেরী! কাবেরীকে অনুসরণ করলাম নিঃশব্দে। কাবেরী তালাচাবি খুলে নরেনের বাড়ির পশ্চাতের দ্বারপথে প্রবেশ করল–গলির মধ্যে অন্ধকারে কিছুদূরে আত্মগোপন করে রইলাম।
রহমান এমন সময় প্রতিবাদ জানিয়ে ওঠেন, তা হলে মিঃ চৌধুরী, আপনি যদি কাবেরী দেবীকে ফলো করে থাকেন, তবে কেমন করে–
হাঁ হাঁ, আমি—আমিই খুন করেছি! মিঃ চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন।
না, আপনি খুন করেন নি। নিজের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি মিথ্যা কথা বলছেন—খুন করেছেন তাকে আপনার বড় মেয়ে কৃষ্ণা!
এতক্ষণ কিরীটী নীরবে সঞ্জীব চৌধুরীর কথা শুনতে শুনতে ভূ কুঞ্চিত করে কি যেন ভাবছিল, হঠাৎ সে বলে ওঠে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে, Now কৃষ্ণা দেবী, বলুন আপনি কি জানেন!
সকলের দৃষ্টি কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যুগপৎ গিয়ে অদূরে দণ্ডায়মান কৃষ্ণার উপরে পড়লো। সকলের চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। একসঙ্গে পাঁচজোড়া চোখের অনুসন্ধানী, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি যেন কৃষ্ণাকে গ্রাস করছে। কিরীটীর অদ্ভুত ঋজু কঠিন কণ্ঠস্বর এবারে যেন সকলকেই সচকিত করে তোলে। সে বললে, বলুন কৃষ্ণা দেবী আপনার যা বক্তক বলুন!
আবার প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠলেন সঞ্জীব চৌধুরী, আমি তো বলছি, ও কিছু জানে না মিঃ রায়! কেন—কেন মিথ্যে মিথ্যে ওকে আপনারা পীড়ন করবেন?
এবারে কিরীটী সঞ্জীব চৌধুরীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, মিঃ চৌধুরী, আপনি যদি এভাবে আমাদের কাজে বাধা দেন তো বাধ্য হবো আপনাকে পুলিসের হেফাজতে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে!
কিন্তু যা ও জানে না তার জন্য ওকে আপনারা পীড়ন করবেন? বিশ্বাস করুন আমার কথা মিঃ রায়, ও কোন কথাই গোপন করে নি কৃষ্ণা সম্পূর্ণ নিরপরাধ। করুণ মিনতিতে যেন সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠস্বর ভেঙে গুড়িয়ে গেল।
কিন্তু আমি বলছি, উনি—আপনার বড় মেয়ে কৃষ্ণা দেবী অনেক কিছুই গোপন করে রেখেছেন। কৃষ্ণা দেবী, আমার দিকে ফিরে তাকান, এখনো বলুন সব কথা!
কৃষ্ণা যেন পাথর। কেবল দেহই নয়, যেন তার অনুভূতিও পাথর হয়ে গিয়েছে। নিষ্কম্প ভাবলেশহীন দৃষ্টি।
কৃষ্ণা দেবী, আর চুপ করে থেকে লাভ হবে না! বলুন, কি আপনার বলবার আছে?
আমি—আমি কিছুই জানি না। এতক্ষণে ক্ষীণকণ্ঠে প্রত্যুত্তর শোনা গেল কৃষ্ণার।
আপনি কিছুই জানেন না?
না।
বেশ। তবে সে রাত্রে অর্থাৎ ২৭শে পৌষ রবিবার, যে-রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হয়, সেরাত্রে কেন গিয়েছিলেন মল্লিক ভবনের পিছনদিককার বাগানে?
বাগানে আমি যাই নি।
আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন এবং তার প্রমাণও আমার হাতে আছে। কঠোর প্রতিবাদ জানায় কিরীটী।
প্রমাণ।
হাঁ। দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা? বলতে বলতে পকেট থেকে একটা গগলস্ বের করে হাতটা সামনের দিকে তুলে ধরল কিরীটী, চিনতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে না আপনার যে এটার মালিক আপনিই! দেখুন, ভাল করে চেয়ে দেখুন—চশমাটার উঁটে দেখুন লেখা আছে কৃষ্ণা ইংরাজীতে। নিশ্চয়ই কোন একসময় নিজের নামটা ডাঁটের গায়ে কুঁদে নিয়েছিলেন, পাছে আপনার বোন কাবেরী দেবীর চশমার সঙ্গে গোলমাল হয়ে যায় বলে, তাই নয় কি? এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি বাগানে ডালিয়ার ঝাড়ের কাছে।
কৃষ্ণা একেবারে নির্বাক নিষ্কম্প।
চুপ করে আছেন যে! এ চশমাটা কি আপনার নয়?
হাঁ আমারই।
তাহলে এবার বলুন কেন সেরাত্রে বাগানে গিয়েছিলেন? কারো সঙ্গে দেখা করতে কি?
হাঁ।
কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? বিনতা দেবী, না মিঃ মল্লিকের সঙ্গে?
কিরীটীর কথায় যেন ভূত দেখার মতই চমকে মুখ তুলে তাকাল কৃষ্ণা ওর মুখের দিকে।
চমকে উঠবেন না। কিন্তু বুঝতেই পারছেন যে, আমি জানি যে বিনতা দেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল!
সঞ্জীব চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন এমন সময় সহসা, কৃষ্ণা!
কিন্তু কিরীটী সে চিৎকারে যেন ভূক্ষেপও করল না। কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়েই আবার প্রশ্ন করল, কি করে আপনার বিনতা দেবীর সঙ্গে আলাপ হলো, বলবেন কি?
তিনিই আমাকে চিঠি দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলেন। মৃদু ক্ষীণ কণ্ঠে কৃষ্ণা প্রত্যুত্তর দেয়।
হাঁ। তাহলে সেই আলাপের সূত্র ধরেই তিনি এখানেও ইদানীং মধ্যে মধ্যে রাত্রে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতেন তাই বোধ হয়, না?
কিন্তু জানেন কি তাঁর সত্যিকারের পরিচয়টা?
না।
জানেন না?
না।
সত্যি বলছেন, জানেন না? তিনিও কখনও তাঁর পরিচয় দেন নি?
না।
সেরাত্রে তাহলে আপনি বাগানে তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
হাঁ।
কেন?
তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কেন?
তার কিছু কথা আমাকে বলবার ছিল তাই।
কি কথা জানতে পারি কি?
ক্ষমা করবেন। বলতে পারবো না।
ঠিক ঐ সময় চন্দ্রনাথ এসে ঘরে প্রবেশ করল। কিরীটী চন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি খবর চন্দ্রনাথ? তুমি একা?
তাঁকে পাওয়া গেল না সে-বাড়িতে।
পেলে না?
না। আজ সকালেই তিনি সে-বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
কোথায় কিছু জানতে পারলে?
না। কেউই তা বলতে পারল না। তবে—
কি?
বাড়িওয়ালার হাতে তিনি আপনার নামে একখানা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন যাবার আগে। চিঠি!
হ্যাঁ, এই যে, চন্দ্রনাথ জামার পকেট থেকে একটা মুখ-আঁটা পুরু সাদা খাম নিঃশব্দে এগিয়ে দিল কিরীটীর দিকে।
মুখ-আঁটা খামটার উপরে পরিষ্কার অক্ষরে বাংলায় লেখা—শ্ৰীযুক্ত কিরীটী রায় সমীপেষু। ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলেই তখন স্তব্ধ বিস্ময়ে কিরীটী ও চন্দ্রনাথের পরস্পরের কথোপকথন শুনছিল। কিরীটী খামটা ছিঁড়ে ফেলল। ভিতর থেকে বের হলো একখানা চিঠি। দীর্ঘ তিনপৃষ্ঠা ব্যাপী। কিরীটী চিঠিটা পড়তে লাগল।
কিরীটীবাবু,
আপনি সেরাত্রে ঠিকই আমাকে চিনেছিলেন, ভুল আপনার হয় নি। ভেবেছিলাম কাউকে কিছু না জানিয়েই নিঃশব্দে চিরদিনের মত সরে যাবো। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আমার নিজস্ব বক্তব্যটুকু অন্তত যদি না জানিয়ে যাই শেষ বিদায়ের আগে, কোন তৃতীয় নিরপরাধ ব্যক্তি হয়তো শেষ পর্যন্ত নরেন মল্লিকের হত্যাপরাধের সন্দেহে অযথা পীড়িত হবে। সেও একটি কথা এবং নরেনের হত্যা-ব্যাপারটার সঙ্গে এমন দুজন জড়িত আছে যাদের চাইতে প্রিয় এ জগতে আমার আর কিছুই নেই—এবং বিশেষ করে শেষোক্ত কারণেই এই চিঠিখানা যাবার আগে আপনাকে লিখে গেলাম।
সেদিন রাস্তার মাঝখানে গ্যাসের আলোয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার চোখে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল তা আমার নজর এড়ায় নি। কিন্তু সে বিস্ময়কে জানতে হলে আমার অতীত কাহিনী আপনার জানা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, আমার কথা বুঝতে হলেও আমার অতীত না জানলে সবটা ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না।
আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা। কাহিনী হচ্ছে একটি তথাকথিত আলট্রামডার্ন বা আলোকপ্রাপ্তা(?) শিক্ষিতা(?) তরুণীর কাহিনী। ভগবান রূপ দিয়েছিলেন তার দেহে অকৃপণভাবে ঢেলে। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থাৎ তার দেহে যখন কৈশোর এলো তখন থেকেই তার মা তাকে তার রূপ সম্পর্কে এমন আত্মসচেতন করে তুলেছিল যে যৌবন তার দেহে আসবার আগেই রূপের দেমাকে হয়ে উঠেছিল সে আত্মহারা, তার সঙ্গে মায়ের শিক্ষায় হয়ে উঠেছিল সে উদ্ধৃঙ্খল বেপরোয়া। মার কাছ থেকে সে শিক্ষা পেয়েছিল, নারীর রূপ হচ্ছে পুরুষ-পতঙ্গকে পোড়াবার জ্বলন্ত অগ্নিশিখা এবং যে মেয়ে সে নীতিকে জীবনে না অনুসরণ করে, তার দুঃখের আর সীমা থাকে না। বোকা মেয়ে তাকেই জীবনের পরম সত্য বলে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলল।
উচ্ছৃঙ্খল জীবনে তার হৃদয় বলে কোন পদার্থই ছিল না। অর্থাৎ দেহের অভ্যন্তরে যে একটা মন থাকতে পারে তার সন্ধান সে কোন দিনই পায় নি। রূপমুগ্ধ পুরুষদের নিয়ে খেলা করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শোষণ। এমনি করে যখন জীবনের একুশটা বছর কেটে গিয়েছে, এমন সময় দেখা হলো তার একটি পুরুষের সঙ্গে কোন একটি পার্টিতে, যে পুরুষটির তথাকথিত ঐসব মেয়েদের সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিল না। পুরুষটির তখন বয়স চল্লিশের কোঠা ছাড়িয়ে চলেছে।
ধীর, সৌম্য, শান্ত, রূপবান এবং অবস্থা খুব ভাল। কলকাতায় তিন-চারখানা বাড়ি, মোটা ব্যাংক-ব্যালেন্স। পুরুষটিও পার্টিতে প্রথম দিন সেই মেয়েটিকে দেখেই মুগ্ধ হলো। মেয়েটিরও যে পুরুষটির উপরে কিছুটা দুর্বলতা জেগেছিল সেদিন অস্বীকার করা যায় না। যাহোক সেই পার্টির পর থেকেই দুজনার মধ্যে আলাপ জমে উঠলো। মেয়েটির মা একদিন বললে, যদি বিয়ে করতে হয় তো একেই কর। গোবেচারী ধরনের লোক। টাকাকড়ি যথেষ্ট আছে। বয়সও হয়েছে। একে তুই অনায়াসেই মুঠোর মধ্যে রেখে নিজের খুশিমত জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবি। তাছাড়া আজ রূপ-যৌবন আছে, কিন্তু একদিন যখন ওসব কিছুই থাকবে না তখন একটা শক্ত আশ্রয় না পেলে বাঁচতে পারবি না। মেয়েটিও ভেবে দেখলো, কথাটা নেহাৎ মিথ্যা নয়। যার ফলে মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির বিবাহ হয়ে গেল।
কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই দুটি সত্য মেয়েটির চোখের সামনে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার একটি হচ্ছে, নির্বিবাদী শান্ত ও সংযমী পুরুষ হলেও তার স্বামীর মনের মধ্যে একটা লৌহ কঠিন পৌরুষ আছে যা সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করে না বটে কিন্তু একবার বিদ্রোহী হলে তাকে শান্ত করা স্বয়ং বিধাতারও দুঃসাধ্য। দ্বিতীয়, লোকটির অসম্ভব এবং অত্যুগ্র একটা আভিজাত্য ও রুচিবোধ আছে। যার ফলে কারোই সহজ চলার পথে সে অনিচ্ছা থাকলেও বাধা দেয় না। এবং ঠিক দুটি কারণেই মেয়েটি বিবাহের পরও যখন তার স্বামীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেই নিজের গতানুগতিক উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে গা ভাসিয়ে চলতে লাগল, স্বামীর গৃহ থেকে বহুদিন পর্যন্ত কোন বাধাই পায় নি—আর ঐটাই হলো তার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল। যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তাকে সর্বস্ব দিয়ে করতে হলো। বেঁচে থেকেও তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে কাউকে দেখেছেন কি মিঃ রায়! ধারণা করতে পারবেন না—সে কি যন্ত্রণা সে কি দাহ!
যাক যা বলছিলাম—বুঝতে পারছেন বোধ হয় সেই মেয়েটিই আমি! বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যেই আমি মা হলাম। কিন্তু তবু হতভাগিনী আমার চোখ খুলল। যে মাতৃত্ব নারীকে দেয় নতুন জীবন, যে মাতৃত্ব নারীর জীবনে আনে অমৃতের স্বাদ, সে মাতৃত্ব পেয়েও আমি সুধা ফেলে গরলের পিছনেই ছুটতে লাগলাম! আকণ্ঠ গরল পান করেই নেশায় বুদ হয়ে রইলাম। সেই গরলই হচ্ছে আপনাদের ঐ নরেন মল্লিক। নরেনের দুটো নাম ছিল—একটা পোশকী, একটা সর্বত্র চলতি। চলতি নামটা আর করবো না, নরেন নামটাই বলি।
জানি না সদ্য বিলাত-প্রত্যাগত ঐ নরেন কি কুক্ষণেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঐ নরেনই শেষ পর্যন্ত আমার এত দুঃখের কারণ, নরেনই দিল আমাকে যত উৎসাহ, যত বুদ্ধি-বুদ্ধি নয় বলবো দুর্বুদ্ধি!
স্বামী আমার কোন কাজেই বাধা দেন না। মুক্ত স্বাধীন আমি। যথেচ্ছাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে দিন কাটছে। আর বিশ্বাস করে স্বামী তার যে অর্থ ও সম্পত্তি আমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন–সেই অর্থ ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু জেনেও বুঝতে পারি নি, চোখ আমার খোলে নি যে প্রায়শ্চিত্তের দিন আমার এগিয়ে এসেছে।
হঠাৎ তারপর একদিন এলো আমার স্বামীর চিঠি, কলকাতার বাস উঠিয়ে এবার তার কাছে যেতে হবে। তখনও ভেবেছি ও কিছু না। কেবল একটা নিছক হুমকিই বুঝি। আর নরেনও তাই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু অকস্মাৎ যেদিন স্বামী এসে হাজির হলেন, তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই বুঝলাম, কোথায় যেন সত্যিকারের গণ্ডগোল ঘটেছে। আমার ভাগ্যাকাশে কত বড় দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে ঝড়ের কালো মেঘ! সুখের স্বপ্ন আমার ভাঙার মুখে। কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য, রাহু যখন একবার তাকে গ্রাস করে মুক্তি যে তার সহজে মেলে না তা তো বুঝি নি। তাই সেদিন রাত্রেই গৃহে ফিরে স্বামীর কণ্ঠস্বরে সেই মেঘই যখন গর্জে উঠলো, তখনই স্পষ্ট বুঝলাম আগুন জ্বলছে এবং ভয়াবহ সে আগুন মেলেছে শত শত লোল বাহুঁ। রক্ষে নেই আর। মুহূর্তে সে আগুন আমার সর্বাঙ্গে বেষ্টন করে ধরল। পদাঘাতে বিতাড়িত হলাম আমি সেই রাত্রেই স্বামীগৃহ থেকে। ধাক্কা খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে এসে পড়লাম কিন্তু তবু মৃত্যু আমাকে আশ্রয় দিল না। দেবেই বা কেন? পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে তখনও আমার পূর্ণ হয় নি। রক্তাক্ত মুখে ছুটে গেলাম সেই রাত্রেই নরেনের গৃহে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখিনরেন তখন আর এক নারীর আলিঙ্গনে বদ্ধ। একে অপমানের জ্বালায় পুড়ছিলাম, তার উপরে নরেনের সেই মিথ্যাচার প্রতারণা আমাকে যেন একেবারে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য করে তুলল। নরেনকে আঘাত দেবো বলে পাগলিনীর মত যেমন তার দিকে এগিয়ে গিয়েছি সে আমাকে দিল একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম টেবল-ল্যাম্পটার ওপরে। বিস্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম। তিন দিন পরে জ্ঞান ফিরে এলো হাসপাতালে। সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। টেবল-ল্যাম্পটা ফেটে সমস্ত মুখটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, পরে জানতে পারি। এবং হাসপাতাল থেকে তারপর বের হয়ে এলাম একদিন মুখের উপরে অবগুণ্ঠন টেনে। সেই হলো নবজন্ম। নাম নিলাম বিনতা।
এবারে শুনুন বিনতার ইতিহাস :
মাসচারেক বিনতা বাংলাদেশের একেবারে বহুদূরে এক তীর্থক্ষেত্রে আত্মগোপন করে রইলো। এবং ঐ চার মাস সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড এক অগ্নিদাহ চলেছিল বিনতার নিভৃত মনে। এবং সেই অজ্ঞাতবাসের সময়েই বিনতা জানতে পারল যে তার নারীমনের মধ্যে সহজাত যে মাতৃত্ব, যাকে সে এতকাল কণ্ঠরোধ করে অবহেলা ও অবজ্ঞায় অস্বীকার করার চেষ্টা করে এসেছে—কোন নারীই যাকে আজ পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারে নি, তাই মনের এক কোণে জ্বলছে যখন প্রতিহিংসার ভয়াবহ অগ্নিস্রোত, অন্য কোণে চলেছে বয়ে নিঃশব্দে অতৃপ্ত মাতৃত্বের স্নিগ্ধ এক ক্ষীণ ধারা এবং একদিন সেই ধারাই তাকে অজ্ঞাতবাস থেকে টেনে নিয়ে এলো কলকাতা শহরে তার ছেড়ে যাওয়া সন্তানদের সন্ধানে। এসে শুনল স্বামী তার সন্তানদের নিয়ে সেই রাত্রেই কোথায় যেন নিখোঁজ হয়েছেন। আরো শুনলো নরেন মল্লিকও বর্মায় গিয়ে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু অতৃপ্ত মাতৃত্ব তাকে যেন স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। সে বের হলো তার সন্তানদের সন্ধানে এবং শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে সে পেল তার সন্তানদের সন্ধান। দূর থেকে আজ সে শুধু দেখেই তার বুকজোড়া নিধিদের কিন্তু অধিকার নেই তার তাদের স্পর্শ করবার। দূরত্ব রেখেই সে তার সন্তানদের পিছনে পিছনে সর্বত্র ছায়ার মতই ঘুরতে লাগল। ভাবতে পারবেন না মিঃ রায়, এক অভাগিনী জননীর দিনের পর দিন তার বুকভরা স্নেহের সঙ্গে সে কি যুদ্ধ! কত সময় মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে তাদের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি কিন্তু স্বামীর ভয়ে ও নিজের কলঙ্কিত পরিচয় পাছে তার সন্তানদের শুভ্রতায় কালি ছিটায়, পারেনি সে অভাগিনী নারী কোনদিনই তাদের সামনে দাঁড়াতে। বুকভরা তৃষ্ণার হাহাকার নিয়ে সে দূরে সরে রয়েছে। তারপর দীর্ঘকাল পরে আবার তার স্বামী কলকাতায় এলে তাঁর সন্তানদের নিয়ে। এবং তারই বছর দেড়েক বাদে বর্মা প্রত্যাগত নরেন মল্লিক এসে কলকাতায় জাঁকিয়ে বসল। আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন কৃষ্ণা কাবেরীর অভাগিনী জননীই আমি। নরেন যে কলকাতায় ফিরে এসে জাঁকিয়ে বসেছে আগে কিন্তু তা টের পাই নি। হঠাৎ একদিন রাত্রে নরেনকে পার্ক সার্কাসের একটা স্টেশনারী দোকানে দেখে চমকে উঠলাম। তার পাশে ছিল কাবেরী। দোকানের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় এতকাল পরে নরেনকে দেখেও আমার চিনতে কষ্ট হয় নি। কিন্তু নরেনকে দেখে যতখানি না চমকে ছিলাম, তার চাইতেও বেশি চমক লেগেছিল আমার সেরাত্রে নরেনের পাশে আমার মেয়ে কাবেরীকে দেখে। আমার কাজকর্ম করবার জন্য ও আমাকে সদাসর্বদা দেখাশোনা করবার জন্য একটি পাহাড়ী ভৃত্য ছিল বীরবাহাদুর। তাকে নিযুক্ত করলাম নরেনের সমস্ত সন্ধান নেবার জন্য। সে-ই আমাকে নরেনের সব সংবাদ এনে দিল। তার মুখেই শুনলাম নরেনের গৃহে কৃষ্ণা কাবেরী দুজনারই যাতায়াত আছে। শয়তান নরেন মল্লিককে আমি চিনি। সে একদিন আমার জীবনে রাহুর মত উদয় হয়ে আমার সর্ব গ্রাস করেছিল, আজ আবার সে আমার আত্মজাদের জীবনে রাহুর মত উদয় হয়েছে। বহুদিনের পুরাতন ক্ষতে আবার নতুন করে রক্ত ঝরতে লাগল। নরেনের হাত থেকে যেমন করেই হোক আমার কৃষ্ণা ও কাবেরীকে বাঁচাতে হবে প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু কেমন করে? এমন সময় ভগবানই যেন হাতে আমার সুযোগ এনে দিলেন। নরেন একজন হাউস-মেইডের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একটা দরখাস্ত ছেড়ে দিলাম। অনেকের সঙ্গে নয়, মাত্র তিনজনের ইন্টারভিউ হলো। লক্ষ্য করেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর শুনেই নরেন যেন হঠাৎ চমকে উঠেছিল। তারপর নানাভাবে আমাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল। বুঝেছিলাম আমাকে সে তার পূর্বপরিচিত সন্দেহ-বশেই যাচাই করে দেখছিল—তার সন্দেহ বা অনুমান সত্য কিনা। কি বুঝল জানি না, তবে আমাকেই সে কাজে বহাল করলো।
মাথায় দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টেনে থাকলেও এবং কারো সঙ্গে একমাত্র মধু ছাড়া ও বাড়িতে কোন প্রকার কথাবার্তা না বললেও, দুটি কান আমার সর্বদা সজাগ থাকত। চক্ষুও আমার সজাগই থাকত অবগুণ্ঠনের তলায়।
কিছুদিন যেতেই দুটি ব্যাপার নজরে পড়লো। একটি হচ্ছে কৃষ্ণা ও কাবেরীর নরেনের গৃহে যাতায়াত আছে। এবং নরেন ওদের মধ্যে কৃষ্ণার প্রতি আসক্ত ও কাবেরী নরেনের প্রতি আসক্ত। এবং দ্বিতীয়তঃ কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে কাবেরীই যেন পেয়েছে আমার অতীতের মনোবৃত্তি। কৃষ্ণা হয়েছে তার বাপের মত স্থির ধীর ও সংযত। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, সুবিমল কাবেরীর প্রতি আসক্ত কিন্তু কাবেরী সুবিমলকে নিয়ে খেললেও তার নজর ছিল আসলে নরেনের প্রতি নয়, তার সঞ্চিত বা অর্জিত অর্থের প্রতি। সঙ্গে সঙ্গে আমি সাবধান হলাম,-সতর্ক হলাম, যাতে করে নরেনের দ্বারা ওদের কোন অনিষ্ট না হয়। জানতাম আমি, মধ্যে মধ্যে রাত্রে কাবেরী বাগানের দ্বারপথে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাথরুমের দরজাপথে নরেনের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করত। তাদের দেখাসাক্ষাৎ হতো রাত্রে গোপনে। ঐ ব্যাপারটাই আমাকে সত্যিকারের চঞ্চল করে তোলে। অর্থের লোভে কাবেরীর নরেনের গৃহে রাত্রের ঐ গোপন অভিসার যে একদিন কাবেরীর সর্বনাশ ডেকে আনবে এ যেন কেন মন আমার পূর্বেই বলেছিল। তাই একদিন শেষ পর্যন্ত কাবেরীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় ভীতা আমি রাত্রে নরেনের শয়নঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
আমি জানতাম রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কখনো সে ঘুমোয় না। সে রাত্রেও সে জেগেই ছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। অবিশ্যি আশাও করি নি যে ঘরের দরজাটা খোলা থাকবে। বলতে পারেন দৈবই আমার সহায় ছিল বোধ হয় সেরাত্রে। নিঃশব্দে ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলতেই দরজার কবাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। আর সেই ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করেই আমি যেন চমকে উঠলাম। চেয়ারের উপর বসে আছে নরেন আর তার হাতে একটা ছোট কেসে একটা বাদামের আকারের পাথর যার সংকীর্ণ বিচ্ছুরিত জ্যোতি ঘরের টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু আলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যেন। পরে বুঝেছিলাম সেটা একটা দামী। হীরা। সামান্য কয়েকটা মুহূর্ত ইতস্তত করে কমধ্যে প্রবেশ করলাম। নিজের মধ্যে তন্ময় ছিল নরেন তাই বোধ হয় প্রথমটায় ঘরের মধ্যে আমার নিঃশব্দ পদসঞ্চার সে টের পায় নি। কিন্তু আমি দুপা এগুতেই সে টের পেল। চমকে লাফিয়ে উঠে হীরাটা জামার পকেটে লুকিয়ে ফেলে সে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে।
কে? এ কি বিনতা তুমি? তুমি এ সময়ে এ ঘরে কেন?
আমার দু-একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
আমার সঙ্গে কথা!
হ্যাঁ।
কি কথা তোমার?
কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে আপনি মিশতে পারবেন না!
আমার বক্তব্য এত আকস্মিক ও এত বিস্ময়কর যে প্রথমটায় নরেন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। নিষ্ঠুর হাসিতে তার মুখটা ভরে গেল। এবং প্রায় চাপা কণ্ঠেই সে বলল, তাহলে আমার অনুমান মিথ্যা নয়!
কি বলছেন আপনি?
কি যে ঠিক আমি বলছি তা তুমিও জান! তাহলে তুমি আজো বেঁচে আছে! বলতে বলতে হঠাৎ নরেন এগিয়ে এলো যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত। করুণাকরুণা—তুমি তাহলে সত্যিই আজো ঘেঁছে আছো?
সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে গিয়ে কঠোর কণ্ঠে আমি বললাম, কি সব পাগলের মত যাতা বলছেন! কে করুণা?
কেন মিথ্যে ছলনা করছে করুণা?
আপনি ভুল করছেন—আমি করুণা নই, আমি বিনতা।
তুমি করুণা নও?
না।
বেশ। করুণা তুমি নও—তুমি বিনতাই, কিন্তু কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?
সে শুনে আপনার লাভ নেই। আপনাকে যা বললাম তাই করবেন।
ক্ষণকাল চুপ করে থেকে নরেন বললে, আর তা যদি না করি?
আপনার ভালর জন্যই কথাটা বললাম। যদি আমার কথা আপনি না শোনেন—
না শুনি তত কি?
কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে সব আমি জানাবো। জানবেন আপনার সত্যিকারের পরিচয় সে জানতে পারলে আপনাকে সে এবারে আর জীবন্ত রাখবে না।
আমার সত্যিকারের পরিচয়?
হাঁ। আমি সব জানি আপনার অতীত ইতিবৃত্ত। যা বললাম মনে থাকে যেন। আমি চললাম। বলে আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করলাম না, ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু তারপর কয়েকদিন লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার সাবধান বাণী নরেনকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারে নি।
তখন অনন্যোপায় হয়ে আমি কৃষ্ণাকেই একটি চিঠি দিলাম রাত্রে গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। তাকে নরেন সম্পর্কে সাবধান করে দেবো, যাতে সে কাবেরীকে বুঝিয়ে বলে সময় থাকতে নিবৃত্ত করতে পারে।
নরেনের জন্মতিথির উৎসবের আগের রাত্রে কৃষ্ণা এলো গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মা ও মেয়েতে এই প্রথম সামনাসামনি ও প্রথম কথা।
কৃষ্ণা বললে, আপনি আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন দেখা করবার জন্য?
হাঁ।
কেন বলুন তো?
এ বাড়ির মালিক নরেন মল্লিকের সঙ্গে তোমরা মিশো না।
কেন এ কথা বলছেন?
তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি। তা ছাড়া আমার নিশ্চয়ই ধারণা, তোমরা যে এখানে যাতায়াত কর এবং নরেন মল্লিকের সঙ্গে মেশো নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা জানেন না!
আমার শেষের কথায় যেন কৃষ্ণা ভয়ানক চমকে উঠলো।
আপনি—আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
মৃদু হেসে বললাম, জানি।
আপনি—আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?
মৃদু, অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললাম, এককালে পরিচয় ছিল।
কিন্তু আপনি—আপনি কে?
আমি এ বাড়ির হাউস-মেইড।
না, না—তা নয়। আপনার পরিচয়—কি করে আমার বাবাকে আপনি জানলেন?
তোমার মা আমার বান্ধবী ছিলেন কলেজের ছাত্রীজীবনে।
আপনি তাহলে আমার মাকে জানতেন?
জানতাম। বলেই হঠাৎ যে কি হলো, একটা কথা কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা করবার লোভ যেন কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার-তোমার মাকে মনে আছে কৃষ্ণা?
মা!
হ্যাঁ, মনে আছে তাকে তোমার?
খুব অস্পষ্ট মনে পড়ে, আবছা আবছা—
তোমার বাবার মুখে কোনদিন শোন নি তোমাদের মার কথা?
না। কেবল এইটুকুই একবার শুনেছিলাম—
কি–কি শুনেছিলে?
আমাদের খুব ছোটবেলায় মা নাকি কি একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যান।
অ্যাকসিডেন্টে মারা যান?
হাঁ। তাছাড়া—
তাছাড়া আর কি কৃষ্ণা?
বড় হয়ে ভাল করে জ্ঞান হবার পর বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা নিজেও যেমন মার স্মৃতি কখনো মনে করতে চান না তেমনি আমাদেরও মনে করতে দেন নি। তাতেই মনে হয়—
কি?
মার ব্যাপারে বাবার মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা মর্মান্তিক দুঃখ লুকিয়ে আছে। তাই আমরাও কখনো ও সম্পর্কে ভুলেও উচ্চবাচ্য করি নি। একটা ছবি পর্যন্ত বাড়িতে কোথাও নেই মার। অথচ–
কি কৃষ্ণা?
মুখে বাবা যাই বলুন না কেন, আমার কিন্তু ধারণা বাবার মনের মধ্যে আজও মা বেঁচে আছেন।
কৃষ্ণা!
হ্যাঁ, কতদিন ঘুমের মধ্যে বাবাকে মার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তাই তো ব্যাপারটা চিরদিন যেন কেমন গোলমেলে মনে হয়েছে। আচ্ছা আপনি তো মার বান্ধবী ছিলেন, আপনি জানেন কিছু মার অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যুর কথা?
না। কেবল শুনেছিলাম এক রাত্রে আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়।
আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন মা?
হাঁ। কিন্তু আর দেরি করো না কৃষ্ণারাত অনেক হলো, এবারে বাড়ি যাও।
সে-রাত্রে কৃষ্ণা চলে গেল। কিন্তু বাকী রাতটুকু মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতায় আমার ঘুম এলো না।
আমার বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে মিঃ রায়। এবার নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কথা বলে এ কাহিনীর উপরে আমি পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেবো।
মনে আছে সে তারিখটা, ২৭শে পৌষ সোমবার। নরেনের গৃহে তার জন্মতিথি উৎসব। বিরাট হৈ-চৈ হলো বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। ভিড় কমতে কমতে রাত প্রায় পৌনে আটটা হলো। নরেন উৎসবের পরে বের হয়ে গিয়েছিল। ফিরলো রাত দশটায়। উৎসব-শেষে সমস্ত বাড়িটা যেন অকস্মাৎ একেবারে নিঝুম হয়ে গিয়েছে। উৎসবের খাটুনিতে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে ছিল, নিজের ঘরে শয্যার উপরে আলো নিবিয়ে চোখ বুজে পড়েছিলাম। আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, নরেনের শয়নঘরের ঠিক নীচের ঘরেই আমি থাকতাম। তাই উপরের ঘরের সামান্যতম শব্দও রাত্রে নীচের ঘরে আমার কানে আসতো। রাত তখন বোধ করি সাড়ে এগারটা হবে, হঠাৎ মনে হলো উপরের ঘরে কি যেন একটা ভারী বস্তু মেঝেতে পড়ল। তারপরই একটা দুষ্পাপ পায়ের শব্দ। কি রকম কৌতূহল হলো, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এলাম। সিঁড়ির প্রথম ধাপ পার হয়ে দ্বিতীয় ধাপে উঠেছি, দেখি কে যেন অত্যন্ত দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সিঁড়ির আলোটা রাত্রে নেভানোই থাকত, তাই হয়তো অন্ধকারে সে আমাকে দেখতে পায় নি বা উত্তেজনায় আমার দিকে নজর দেবার ফুরসৎ পায় নি। আমি তাড়াতাড়ি একটু পাশে সরে দাঁড়ালাম। ঝড়ের মতই সে আমার পাশ দিয়ে নেমে, প্যাসেজটা পার হয়ে প্যাসেজের অপর প্রান্তের দরজাটা দিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে চলে গেল। প্যাসেজের শেষ প্রান্তের আলোয় অপস্রিয়মাণ সেই মূর্তিকে আমার চিনতে কষ্ট হয় নি, সে আমারই মেয়েদের মধ্যে একজন—হয় কৃষ্ণা, না হয় কাবেরী। কিন্তু খানিকটা দূর থেকে তাড়াতাড়ি দেখেছিলাম বলে ঠিক দুজনের মধ্যে কে, কৃষ্ণা না কাবেরী চিনে উঠতে পারি নি। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে সিঁড়ির সেই ধাপে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরই সোজা উপরে উঠে গেলাম। নরেনের শোবার ঘরটা হা-হা করছে খোলা। ঘরের মধ্যে জ্বলছে আলো। খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। একপাশে কাত হয়ে নরেনের দেহটা পড়ে তখনো আক্ষেপ করছে। দুটো হাতই গোটানো। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে নরেনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। একটা ছোরা সমূলে প্রায় বিদ্ধ হয়ে আছে নরেনের বুকের বাঁ দিকে। আর ছোরার বাঁটটা তখনও সে ডানহাতের মুষ্টি দিয়ে ধরে আছে। রক্তে সমস্ত জায়গাটা ভেসে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নরেনকে চিৎ করে শুইয়ে দিলাম। নরেন একবার মাত্র যেন অতিকষ্টে চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল, কি যেন বলবার চেষ্টা করল, সবটা নয়—কেবল বুঝলাম একটি কথা, ক্ষমা। তার পরই একটা হেঁচকি তুলে দেহটা স্থির হয়ে গেল। স্তব্ধ নির্বাক কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পরেও মনে নেই।
খেয়াল হতেই দেখি, বাথরুমের দরজাটা হা-হা করছে খোলা। ভয় পেয়ে আর সেখানে না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি আমি সোজা নিজের ঘরে নীচে চলে এলাম। নিজের ঘরে বসে আছি ভূতের মত, বোধ হয় আরো আধ ঘণ্টা পরে আবার উপরের ঘর থেকে ঝঝন্ শব্দ কানে এলো। আবার উপরে গেলাম কিন্তু ভোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার স্বামী কাবেরীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাথরুমের দরজা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। কাবেরী বাধা দিচ্ছে তাকে যাবে না বলে, আর কৃষ্ণা চাপা গলায় বলছে, চল্ কাবি, শীগগিরি এখান থেকে চশীগগিরি চ।
শেষ পর্যন্ত কোনমতে কৃষ্ণা ও আমার স্বামী কাবেরীকে নিয়ে চলে গেল। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, প্রথমবারে যখন উপরের ঘরে সেরাত্রে আমি যাই—ঘরে ঢুকবার পরই, বোধ হয় মিনিটখানেক পরেই, একটা গাড়ির শব্দ আমি পেয়েছিলাম। কৌতূহলে জানালাপথে তাকাতে দেখেছিলাম, বাড়ির গেটের সামনে থেকে একটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। গাড়িটা কালো রংয়ের সিডনবডি। গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলাম এবং নম্বরটা আজও আমার মনে আছে, কারণ মধুর মুখে আগে একবার শুনেছিলাম ঐ নম্বরের ঐ গাড়িটাকে নাকি দুএকবার রাত্রে নরেনের ঘরে জল রেখে আসবার সময় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে সে দেখেছিল, ঠিক গেটের অল্পদূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এবং সে-ই আমাকে বলেছিল নম্বরটা—BLA 6786। তাই গাড়িতে পরিচিত নম্বরটা দেখে চমকে উঠেছিলাম সেরাত্রে। মধু এও আমাকে বলেছিল, সে নাকি ড্রাইভার নন্দুয়ার মুখে শুনেছে-প্রায়ই একটা গাড়িকে নিঃশব্দে নন্দুয়া তার প্রভুর গাড়িকে অনুসরণ করতে দেখেছে। আমার যা জানাবার বা বলবার জানালাম। এবং এইটুকু আমি নিশ্চয়ই করে বলতে পারি, নরেনের হত্যার জন্য। আমার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরী দায়ী নয়। এবং নরেনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয় একটা রহস্য আছে। আপনার কাছে তাই শেষ প্রার্থনা অভাগিনী জননীর প্রতি অনুকম্পায় কৃষ্ণা ও কাবেরীকে এ হত্যার কলঙ্ক থেকে আপনি যেন বাঁচাবার চেষ্টা করেন। আর একটা কথা, নরেনের মৃত্যুর পর কৃষ্ণার সঙ্গে আমি দুচার দিন দেখা করেছি তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে-বিনতার পরিচয়েই। সে আজও জানে না আমিই তার হতভাহিনী কলঙ্কিনী স্বামীপরিত্যক্তা জননী। তাদের চোখে আজ মৃতা হয়েও বেঁচে আছি। এবং দয়া করে একথা তাদের জানাবেন না। তারা যেমন জানে জননী তাদের মৃতা তাই যেন জানে। আমার কিছু অর্থ আছে ব্যাঙ্কে সঞ্চিত—সে টাকার জন্য আমি ব্যাঙ্কে আপনার নামে নির্দেশ দিয়ে গেলাম, আপনি টাকাটা তুলে কোন অবলা আশ্রমে দান করে দেবেন। আমাকে খোঁজবার চেষ্টা করবেন না, কারণ পৃথিবীতে কারো পক্ষে আমাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। নমস্কারান্তে–
বিনতা দেবী।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী একটানা চিঠিটা পড়ে গেল।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় যেন। তারপর কিরীটী ঘরের সেই জমাট বরফের মত স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডাকল, কৃষ্ণা দেবী।
বলুন।
এই চিঠিটা কার জানেন?
কৃষ্ণা কিরীটীর কথার কোন জবাব না দিয়ে কেবল নির্বাক দৃষ্টিতে বারেকের জন্য তাকাল ওর মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে প্রশ্ন বা বিস্ময়, ভয় বা ব্যাকুলতা যেন কিছু নেই। ভাবলেশহীন স্থির পাথুরে দৃষ্টি।
চিঠিটা লিখেছেন বিনতা দেবী। তাঁর পরিচয়টা নিশ্চয়ই নতুন করে আর আপনাকে দিতে হবে না! আপনি তো তাকে ভাল করেই চেনেন, তাই না?
চিনি।
হঠাৎ ঐ সময় সঞ্জীব চৌধুরী ব্যাকুলকণ্ঠে কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করলেন, কে-কাকে তুই চিনিস কৃষ্ণা? কার নাম বিনতা?
মিঃ চৌধুরী, আবার আপনাকে এই শেষবারের মত আমি বলছি—হয় আপনি চুপ করে থাকবেন যদি এঘরে থাকতে চান, নচেৎ বাধ্য হবো আমি আপনাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে!
কিন্তু কেন—কেন বলুন তো মিঃ রায় আপনি এভাবে আমাদের উপরে অত্যাচার করছেন, জুলুম করছেন? আমি তো বলছি বার বার যে আমিই নরেন মল্লিককে হত্যা করেছি। ওরা—কৃষ্ণা কাবেরী কিছুই জানে না। নরেনের প্রতি বহুদিন আগে থাকতেই আমার কোন পারিবারিক ঘটনার জন্য আক্রোশ ছিল, তাই তাকে আমি হত্যা করেছি।
না। সে-সবই আমি জানি মিঃ চৌধুরী, আপনি নরেন মল্লিককে হত্যা করেন নি, করতে পারেন না। কথাটা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল আবার কৃষ্ণার দিকে এবং প্রশ্ন করল, কৃষ্ণা দেবী, রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে আপনি নরেন মল্লিকের হত্যার রাত্রে তার বাড়িতে তার শয়নঘরে গিয়েছিলেন? বলুন, মিথ্যে আর সব কিছু গোপন করবার চেষ্টা করবেন না—আমি সব জানি।
হাঁ গিয়েছিলাম।
কোন্ পথ দিয়ে তার শয়নঘরে প্রবেশ করেছিলেন?
বাথরুমের দরজা দিয়ে।
কৃষ্ণা—ওরে হতভাগী কি বলছিস তুই! আবার চেঁচিয়ে উঠলেন সঞ্জীব চৌধুরী যেন সব কিছু ভুলে।
বাধা দিও না বাবা, মিঃ রায় যা জানতে চান—সব আমাকে বলতে দাও। বলে উঠলো এবারে কৃষ্ণাই। এবং তার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞার সুর যেন ঝরে পড়ল এতক্ষণে। কৃষ্ণা বলতে লাগল, হাঁ মিঃ রায়, গিয়েছিলাম সে-রাত্রে আমি নরেন মল্লিকের ঘরে।
কেন—কেন গিয়েছিলেন?
তাঁকে সাবধান করে দিতে গিয়েছিলাম, কাবেরীর সঙ্গে যেন তিনি আর ভবিষ্যতে না মিশবার চেষ্টা করেন।
তারপর দেখা হয়েছিল—কোন কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গে?
না।
কোন কথাবার্তাই হয় নি?
না, কারণ ঘরে যখন ঢুকছি দেখি বক্ষে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় তিনি তখন রক্তাক্ত ঘরের মেঝের উপরে পড়ে ছটফট করছেন। তাই দেখেই ভয় পেয়ে তখুনি আমি ছুটে পালাই।
সিঁড়ি দিয়ে আপনি পালিয়েছিলেন?
হাঁ।
সে সময় কারো সঙ্গে সিঁড়িতে আপনার দেখা হয়েছিল বা কাউকে সিঁড়ির নীচে দেখতে পেয়েছিলেন?
কোনদিকেই তখন আমার লক্ষ্য ছিল না, ছুটে পালাতেই তখন আমি ব্যস্ত।
আপনি যখন নরেন মল্লিকের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, ঘরের মধ্যে আর কাউকে দেখেছিলেন?
না।
ভাল করে ভেবে বলুন!
না, দেখি নি।
আর একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন, কৃষ্ণা দেবী?
বলুন।
নরেনের মুখে কখনো দামী জুয়েলস্ বা অন্য জাতীয় কিছুর কথা শুনেছেন?
না।
কাবেরী দেবী, আপনি?
না।
আপনারা ঐজাতীয় কখনো কিছু তার কাছে দেখেছেন?
উভয়েই একসঙ্গে জবাব দিল, না।
ঠিক এই সময় একটি সাধারণ বেশভূষায় সজ্জিত তরুণ যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি খবর বিভূতি?
ইনসপেক্টর মিঃ রক্ষিত আমাকে পাঠিয়েছেন একটা কথা বলতে—
বল।
ফৈয়াজ খানের details পাওয়া গেছে। সে বর্মা থেকেই আসছে। এবং মাস দশেক আগে তার বর্মার বাড়ির সেফ থেকে একটা দামী হীরা আশ্চর্যরকমভাবে চুরি যায়, যার সন্ধান বর্মা পুলিস আজও করতে পারে নি। সে আদপেই দালাল নয়।
কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন কি এক উত্তেজনায় ঝক্ঝক্ করে ওঠে। সে ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, আর কোন সংবাদ বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন ফৈয়াজ খানের মুভমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো দুচার ঘণ্টার মধ্যেই হোটেল ছেড়ে চলে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী রহমানের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে তো জীপ আছে রহমান সাহেব?
হাঁ।
তাহলে আসুন। কিরীটী দরজার দিকে এগুলো।
কোথায়–কোথায় যাবো?
আঃ, এখন তর্ক করবেন না—আসুন!
একপ্রকার যেন টানতে টানতেই কিরীটী রহমান সাহেবকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাকী সবাই ঘরের মধ্যে স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল, নির্বাক।
সোজা কিরীটীর গাড়ি তাজ হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। ম্যানেজারকে ডাকতেই সে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে এলো, কি চান? সিট খালি নেই!
পরক্ষণে পুলিসের পোশাক পরা রহমানকে দেখে একটা ঢোক গিলে ম্যানেজার বললো, ব্যাপার কি?
ফৈয়াজ খাঁ নামে কোন পাঠান এখানে আপনার হোটেলে আছে? কোন্ ঘরে থাকে লোকটা? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সে তো এইমাত্র আধ ঘণ্টাটাক হলো হোটেলের বিল চুকিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বর্ধমান চলে গেল!
বাকী কথাটা আর কিরীটী শেষ করতে দিলে না, আবার রহমানকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নীচে নেমে গেল এবং গিয়ে জীপে উঠে বসল।
গভীর রাত্রি। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড। ঝড়ের বেগে কিরীটীর গাড়ি ছুটে চলেছে। ড্যাসবোর্ডের নীলাভ আলোয় দেখা যায় স্পিডোমিটারের নিডল্টা কাঁপছে—৬০-৬৫, ৬০-৬৫! এগিয়ে চলে ঝড়ের বেগে নির্জন রাস্তা ধরে জীপটা।
লিলুয়া, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, মাহেশ, শ্রীরামপুর শ্রীরামপুর লেভেলক্রসিং পার হয়ে এলো বদ্যিবাটি। আরো আরো দ্রুত। ব্যাণ্ডেলের স্টেশন ইয়ার্ডের আলো দেখা যাচ্ছে। ঐ—ঐ যে সেই গাড়ি ছুটে চলেছে! টেল ল্যাম্পে দেখা যাচ্ছে নম্বরটা : BLA 6786। উল্লাসে কিরীটীর মন নেচে ওঠে।
অগ্রগামী গাড়ির আরোহীও বোধ হয় বুঝতে পারে একটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে, গতিবেগ তারও বেড়ে যায়।
কিরীটীও তার গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয় একসিলারেটারে আরো চাপ দিয়ে। স্পিডোমিটারের নিল্টা এবারে কাঁপছে—৬৫-৭০, ৬৫-৭০! সামনের গাড়িটা ছুটছে ঝড়ের গতিতে।
কিরীটীর নির্দেশে রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে আগের গাড়ির পশ্চাতের চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
দুড়ুম! দুড়ুম!
আগের গাড়িটা এঁকেবেঁকে চলে হঠাৎ মন্দগতিতে। আবার গুলির শব্দ।
হঠাৎ এবার সামনের গাড়িটার পশ্চাতের একটা টায়ার ভীষণ শব্দ করে ফেটে যায়, সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা একটা গাছের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেল।
কিরীটীর গাড়ি এসে থামল উল্টে-যাওয়া গাড়িটার সামনে। গাড়ির আরোহী মৃত। কিরীটী মৃতের বুকপকেট হতে পাসটা টেনে বের করলে এবং পার্সের মধ্যে থেকেই বের হলো বাদামের মত একটা হীরা। অন্ধকারে ঝলমল করে উঠলো হীরাটা।
কিরীটী উত্তেজিত কণ্ঠে রহমান সাহেবকে বললে, এই কমল হীরাটা নরেন মল্লিক বর্মা টী এরই খোঁজে এসেছিল হতভাগ্য ঐ পাঠান ইসমাইলের চর হয়ে, কিন্তু নরেন মল্লিককে হত্যা করেও সে হীরাটা পেল না—ভগবানের মার হাতে-হাতেই পেল। চল এবার ফেরা যাক।
উভয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ফিরে চললো কলকাতার দিকে।
.
দিন-দুই পরে। ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার। ডাক্তার একটা সোফার উপরে আড় হয়ে শুয়ে আপনমনে একখানা ইংরাজি নভেল পড়ছিল। সুইংডোরটা খুলে গেল। ডাক্তার চেয়ে দেখলে ঘরে প্রবেশ করছে কৃষ্ণা।
ডাক্তারের মুখখানা হাসিতে ভরে গেল, মধুর কণ্ঠে আহ্বান জানাল, আরে এসো এসো কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা নই তো আমি, আমি কাবেরী!
পাশে এসে দাঁড়ায় ডাক্তার, মৃদু হেসে বলে, তবে প্রশ্নের উত্তর দাও আমার।
কর প্রশ্ন?
Ready!
Ready.
রাত্রি?
উঁহু, এখন সন্ধ্যা—ঠিক সন্ধ্যা।
শুভদৃষ্টি?
যাও। লজ্জায় রক্তিম হয়ে কৃষ্ণা মুখখানা নিচু করে।
যাও বললে চলবে না, জবাব দিতে হবে। সোফা ছেড়ে উঠে কাছে এসে দাঁড়াল সুকুমার কৃষ্ণার মুখোমুখি।
তবু কৃষ্ণা কোন জবাব দেয় না।
ডাক্তার, ওর হয়ে আমি জবাবটা দিচ্ছি শোন!
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকায়।
দুহাতে পর্দাটা সরিয়ে দরজার ধারে কেবল পর্দার ফাঁক দিয়ে মুখখানা মাত্র বের করে নিঃশব্দে হাসছে কিরীটী।
আরে কিরীটী! এসো এসো।
না ভাই, হীরাটা সরকারকে ফেরত না দিয়ে যার প্রাপ্য তার হাতেই তুলে দিতে এসেছি। নিন কৃষ্ণা দেবী, নরেনের হয়ে আপনাদের দেয় তার বিবাহের যৌতুকটা আমিই দিয়ে গেলাম।
কৃষ্ণা সলজ্জ কুণ্ঠার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হীরাটা নেয়।
তবে ভাই চলি!
আরে শোন শোন—
না ভাই, কৃষ্ণা দেবীকে তোমার প্রশ্ন শুভদৃষ্টি এবং তার জবাবটা শুনবার অধিকার একমাত্র তোমারই—তাছাড়া জান তো, আমাদের দেশে প্রথা আছে শুভদৃষ্টির সময় চাদর দিয়ে আচ্ছাদন দিতে হয় অন্যের দৃষ্টিকে। হাতের কাছে যখন চাদর নেই, মধুর অভাবে গুড়ং দদ্যাৎ—শাস্ত্রবিধি যখন আছেই, অতএব–
হাসতে হাসতে দুহাতে দরজার পর্দাটা টেনে দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, একটা কথা মিঃ রায়, বিনতা দেবীর কোন সংবাদ পেলেন?
কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকাল, না।
তারপরই কি রকম যেন সন্দেহ হতে সে-ই প্রশ্ন করে, তাঁকে কি আপনি চিনতে পেরেছিলেন কৃষ্ণা দেবী?
হাঁ।
চিনেছিলেন?
হ্যাঁ, শুধু আমিই নয়, বাবাও। বাবা তারই সন্ধানে বের হয়ে গিয়েছেন গত পরশু।
কৃষ্ণা চুপ করল। তার দুচোখের কোলে যেন দুফোঁটা অশ্রু টলমল করছে।