আলোকলতা: ৪. পূজার অবকাশটা কাটাতে

আলোকলতা: ৪. পূজার অবকাশটা কাটাতে

৪. পূজার অবকাশটা কাটাতে

এবারেও পূজার অবকাশটা কাটাতে কিরীটী ও সুব্রত শিউশরণের ওখানে এসে দিন পাঁচেক হল উঠেছে।

সকালবেলা কাজে বের হবার আগে শিউশরণ পোশাক পরে টেবিলে বসে কিরীটী ও সুব্রতর সঙ্গে চা-পান করতে করতে খোসগল্প করছিল। এমন সময় রণেনকে নিয়ে একটা সাইকেল রিকশায় চেপে ডাঃ মজুমদারের কম্পাউণ্ডার এসে হাজির।

হরি কম্পাউণ্ডার একাই আসতে চেয়েছিল সাইকেল নিয়ে, কিন্তু রণেন একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে দুজনেই এসেছে থানায়। থানায় না দেখা পেয়ে এসেছে নিকটবর্তী শিউশরণের। বাসায়। ভৃত্যের মুখে ডাঃ মজুমদারের কম্পাউন্ডারের নাম শুনে শিউশরণ তাদের ঘরেই আহ্বান জানায়। ভৃত্যের পশ্চাতে হরি কম্পাউণ্ডার ও রণেন এসে ঘরে প্রবেশ করে। রণেনই নিজের পরিচয় ও বক্তব্য সংক্ষেপে পেশ করে।

শিউশরণ হাসতে হাসতে কৌতুক করে কিরীটীকে বলে, এই নাও কিরীটী, তুমি আসার সঙ্গে সনেই হত্যাসংবাদ! চল, যাবে নাকি একবার অকুস্থানে?

কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, না হে। তুমিই যাও।

উঁহুঁ। একা তীর্থদর্শনে পুণ্যসঞ্চয় হয় না। তোমাকেও সঙ্গী চাই। ওঠ—চল।

যাও না হে! কিরীটী এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

না। তোমাকেও যেতে হবে। চাই কি তুমি সঙ্গে থাকলে হয়ত অকুস্থানেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। বখেড়া মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। চল।

অগত্যা কিরীটীকে উঠতেই হল।

.

ছজন একটা সাইকেল রিকশায় যাওয়া চলে না তাই আর দুটিকে ডাকতে হল। একটায় উঠে বসে রণেন ও কিরীটী, অন্যটায় শিউশরণ ও সুব্রত, হরিকম্পাউণ্ডার ও একজন কনস্টেবল আর একটাতে।

ইতিমধ্যেই কাশী শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। পূজায় এবারে লোকসমাগমও অনেক হয়েছে শহরে। রাস্তায় ও দোকানে দোকানে নানাবয়েসী স্ত্রী-পুরুষের ভিড়—তাদের মধ্যে নিত্য গঙ্গাস্নান-যাত্রীদেরও আনাগোনা চলেছে। খোদাইচৌকির থানা থেকে গোধূলিয়ার দূরত্ব খুব বেশী নয়। হেঁটে গেলে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের বেশী লাগে না। কিরীটী তাই প্রথমটায় বলেছিল পথটুকু হেঁটেই যাবে কিন্তু শিউশরণ রাজী হয়নি।

চলন্ত রিকশায় রণেনের পাশে বসে কিরীটী নানা প্রশ্ন করছিল। কিরীটীর সজাগ তীক্ষ্ণ শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি ওদের কথাবার্তার প্রতি নিয়োজিত থাকলেও, অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে একটা চুরুট টানতে টানতে রাস্তার দুধারে চলন্ত জনতার প্রতি আকৃষ্ট ছিল।

আপনি বলছিলেন রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত আপনারা চারজনে তাস খেলেছেন, তারপর শুতে যান যে যার ঘরে!

হ্যাঁ।

শুতে যাবার পর আপনি কোনোরূপ চিৎকার বা অস্বাভাবিক কোনো শব্দ শোনেননি?

না। সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ গঙ্গায় দাঁড় টেনেছিলাম। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গে মণিকার ডাকে।

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি করেন রণেনবাবু?

আমি ডাক্তার। পাটনায় প্র্যাকটিস করি।

আপনিই কি ডক্টর আর চৌধুরীপাটনায় হার্ট ডিজিজ স্পেসালিস্ট?

হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় রণেন।

আপনি নিজে যখন একজন ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন ডাঃ মজুমদারকে আবার ডাকা হল যে? কিরীটী রণেনের মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।

কারণ মৃতদেহ দেখেই বুঝেছিলাম, আমাদের বন্ধু অতুলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাছাড়া আর একটা কথাও আমার ঐ সঙ্গে মনে হয়েছে। যেভাবে বাড়ির মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাতে করে স্বভাবতই সকলের ধারণা হবে বাড়ির মধ্যেই কেউ আমরা তাকে হত্যা করেছি; তাই তো আমি নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আর একজন বাইরের ডাক্তারকে ডাকা ও থানায় সংবাদ দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার মনে হয়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের, আমাদেরই মধ্যে একজনের এভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হল কেন? আর এর জন্য আমরাই কেউ দায়ী কিনা এটাও আমাদের জানা প্রয়োজন, নয় কি?

নিশ্চয়ই। সত্যিই আপনার সৎ সাহসের আমি প্রশংসা করছি ডাঃ চৌধুরী।

সৎ সাহসের কথাটা বাদ দিলেও অতুলের মৃত্যুটা যে কত বড় মর্মান্তিক আঘাত আমাদের পক্ষে, বাইরের লোক আপনারা বুঝতে ঠিক পারবেন না কিরীটীবাবু। এবং শুধু মর্মান্তিক নয়, অত্যন্ত লজ্জারও ব্যাপার। অতুলের মৃত্যু-রহস্যের একটা মীমাংসা বিশেষভাবেই প্রয়োজন। আমাদের বিবেকের দিক থেকেও। যতক্ষণ না এই ব্যাপারের মীমাংসায় আমরা পৌঁছতে পারব ততক্ষণ আমরা পরস্পর আমাদের পরস্পরের কাছেই থাকব guilty-দোষী।

কথাগুলো বলতে বলতে ডাঃ রণেন চৌধুরী শেষের দিকে নির্বাক কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও আপনার নাম আমার বিশেষ পরিচিত মিঃ রায়। আজকে আমাদের এত বড় বিপদের দিনে আপনাকে এ সময়ে এখানে পাওয়ায় সত্যি বলতে কি কতখানি যে নিশিন্ত হয়েছি বলতে পারব না। আপনি বোধ হয় ভগবান-প্রেরিত। আমাদের আজকের লজ্জা ও অপমান থেকে আপনি অন্তত যদি আমাদের মুক্তি দিতে পারেন—

কিরীটী নিরুত্তর থাকে।

কিরীটী তখন মনে মনে ভাবছে।

দীর্ঘদিনের চার বন্ধু। তিনজন পুরষ একজন নারী। না জানলেও সাধারণ মানব-চরিত্রের দিক দিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক, পরস্পরের বন্ধুত্ব ছাড়াও তিন বন্ধুর মধ্যবর্তিনী ওই নারী বান্ধবীকে কেন্দ্র করে ঐ তিনটি পুরুষের মনে এই দীর্ঘদিনে নিশ্চয় কিছু না কিছু দুর্বলতা ছিল। আর শুধু দুর্বলতাই বা কেন, হিংসা বা একটা বিদ্বেষ গড়ে ওঠাও তেমন কিছু বিচিত্র বা আশ্চর্য নয়।

হঠাৎ কিরীটী রণেনকেই প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, আচ্ছা একটা কথা, আপনারা চারজনের মধ্যে কে কে বিবাহিত?

কেউ নয়। আমরা তিন বন্ধু ও মণিকা কেউই বিবাহ করিনি।

কেউ বিবাহ করেননি?

না।

কেউ বিবাহিত নয়! দীর্ঘ নয় বৎসরের বন্ধুত্ব! তিনটি কৃতবিদ্যা কুমার ও একটি কুমারী। তিন পুরুষের মধ্যবর্তিনী এক নারী। তারই মধ্যে এসেছে অস্বাভাবিক মৃত্যু।

কিরীটীর মনে হয় জীবনে ইতিপূর্বে এমন জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন সে খুবই কম হয়েছে। স্নেহ ভালবাসা রাগ দ্বেষ হিংসা ও ঘৃণমানব-মনের গোপন অবগহনে যে সব স্বাভাবিক বৃত্তিগুলো আনাগোনা করে এক্ষেত্রে কোনটির প্রভাব পড়েছে কে জানে! আর কেমনই বা সেই মধ্যবর্তিনী নারী!

কিরীটীর চিন্তাপ্রবাহে ছেদ পড়ে। সাইকেল রিকশা গলির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এগুবে না বাকি সামান্য পথটুকু পদব্রজেই যেতে হবে।

.

প্রথমে রণেন, তার পশ্চাতে শিউশরণ ও সর্বশেষে কিরীটী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে। ডাঃ মজুমদার পাশের ঘরেই শিউশরণের অপেক্ষায় ছিলেন, তিনিও এগিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। কিরীটী কক্ষমধ্যে পা দিয়ে প্রথমেই তার চিরাচরিত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মাঝারি আকারের ঘরটি। দক্ষিণ দিকটা চাপা। পুর্বে দুটি জানালা। জানলা দুটিই খোলা। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ রয়েছে তারই হাত-দেড়েক ব্যবধানে একটা ক্যামবিসের খাটিয়ার ওপরে নিভাঁজ একটি শয্যা বিছানো। শয্যাটি ব্যবহৃত, শয্যাটিতে কেউ রাত্রে শয়ন না করলেও একটা ব্যাপার কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, শয্যার মাঝামাঝি একটা জায়গায় শয্যার চাদরটা যেন একটু কুঁচকে আছে। বোধ হয় কেউ ঐ জায়গাটায় বসেছিল। এবং তাতে করেই বোঝা যায় শয্যায় কেউ না শয়ন করলেও কেউ শয্যায় বসেছিল। শিউশরণ মৃতদেহের সামনে এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোধ হয় মৃতদেহ পরীক্ষা করছিল। এবারে সেই দিকে তাকাল কিরীটী। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ উপবিষ্টাবস্থায় রয়েছে সে চেয়ারটা সাধারণ কাঠের নয়, স্টীলের ফ্রেমে লোহার চাদরে তৈরী। এবং চেয়ারের পাশেই ডান দিকে একখানা বই বাংলা বই, মেঝেতে পড়ে আছে। এবারে মাথার উপরে তাকাল কিরীটী। শেডে ঢাকা ইলেকট্রিক আলো। আলোটি নেভানো।

কিরীটী রণেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, প্রথমে যিনি আজ সকালে এই ঘরে ঢুকে মৃতদেহ আবিষ্কার করেন তিনি কি ঐ আলোটা নেভানো দেখেছিলেন, না আলোটা জ্বলছিল?

ঘরের আলোটা নেভানো রয়েছে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে যেন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায়। সকলেই একে একে জবাব দেয়—আলো নোনোই ছিল।

এবারে কিরীটী মণিকাকেই প্রশ্ন করে, আপনি তো প্রথম সকালে এ ঘরে ঢোকেন চা। নিয়ে, তখন কি আলোটা নেভানো ছিল, না জ্বলছিল?

লক্ষ্য করিনি তো!

আচ্ছা সাধারণত উনি, মানে অতুলবাবু, কি ঘরের দরজা বন্ধ করেই শুতেন?

দরজা বন্ধ করে শুত এবং প্রত্যেক দিনই সকালে ওকে ডেকে ওঠাতে হত। তাই তো আজকে ঘরের দরজা খোলা পেয়ে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। জবাবে মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো মণিকা বলে।

কিরীটী মনে মনে ভাবে, শোবার ঘরের দরজা শয়নের পূর্বে যার চিরদিন বন্ধ করে শোয়াই অভ্যাস—কেন আজ তার দরজা খোলা ছিল? কেন?

বোঝা যায় মৃত ব্যক্তি বিছানায় শোয়নি গত রাত্রে, আগের রাত্রের সেই হাফশার্টটা পরা, চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থাতেই মারা গিয়েছে, চেয়ারের পাশেই মেঝেতে একটা বই—সব কিছু মিলে স্বাক্ষর দিচ্ছে শয়নের পূর্বে সে বই পড়ছিল বা পড়বার চেষ্টা করছিল এবং গত রাত্রে সেক্ষেত্রে আলোটা ঘরের জ্বলবে না কেন? কে নেভাল আলো? কেনই বা নেভাল? কেন?

আচ্ছা মণিকা দেবী! কিরীটীর ডাকে মণিকা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়। রাত্রে কি আপনাদের বাড়ির দোতলার সিঁড়ির মুখের যে দরজাটা দেখলাম সেটা বন্ধ থাকে না?

না, খোলাই থাকে। জবাবে বলে মণিকা।

বাড়িতে বর্তমানে আপনারা কজন আছেন?

দিদিমা, সুবালাদি, ঝি জাকিয়া আর আমরা চারজন। কয়েকদিনের জন্য একটা ঠিকে চাকর রাখা হয়েছে, তা সে রাত্রে নটা-দশটার পর বাড়ি চলে যায়। রাত্রে এখানে শোয় না।

গত রাত্রে দোতলায় আপনারা কে কে ছিলেন? আবার প্রশ্ন কিরীটীর।

এই ঘরে অতুল, পাশের ঘরে রণেন, তার পরের ঘরে আমি সুবালাদি ও দিদিমা, তার পাশের ঘরে সুকান্ত।

কোন্ ঘরে বসে গত রাত্রে আপনারা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাস খেলেছেন?

সুকান্তর ঘরে।

কেউ আপনারা মনে করে বলতে পারেন, গতকাল সমস্ত দিন ও শুতে যাবার আগে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কখন কখন এবং কতবার অতুলবাবু বা আপনারা এঘরে এসেছেন?

প্রথমেই ডাঃ রণেন চৌধুরী বললে, সিটিতে আমার এক সহপাঠী ডাক্তার আছেন, কাল সকালে চা-জলখাবার খেয়েই আমি ক্যামেরাটা লোড করে নিয়ে বের হয়ে যাই। বেলা চারটে পর্যন্ত সেই বন্ধুর ওখানেই ছিলাম। খাওয়াদাওয়া সেখানেই করি। এখানে ফিরে আসি বেলা পাঁচটা নাগাদ। অতুল তখন বাড়ি ছিল না। আমি ফিরে আসবার আরও আধঘণ্টা পরে অতুল ফেরে। প্রায় ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকা বাইবার জন্য যাই। রাত আটটায় ফিরে আমার ঘরেই সকলে বসে আড্ডা দিই। রাত নটায় খাওয়াদাওয়া সেরে তাস খেলতে বসি। সাড়ে এগারোটায় তাস খেলা ভাঙলে সোজা নিজের ঘরে শুতে যাই। ক্লান্ত ছিলাম, শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। গতকাল দিনে বা রাত্রে একবারের জন্যও এ ঘরে আমি আসিনি। আর দেখিওনি অতুল কতক্ষণ এ ঘরে ছিল বা কবার এসেছিল।

কথাগুলো যেন জবানবন্দির মতই একটানা গুছিয়ে বলে গেল ডাঃ রণেন চৌধুরী।

অতুলবাবু বাড়ি ছিলেন না, আপনি একটু আগে বললেন, আপনি যখন বাড়ি ফেরেন। অতুলবাবু কখন বের হয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন বা কতক্ষণের জন্য বাইরে ছিলেন জানেন কিছু ডাক্তার চৌধুরী? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না, আমি বলতে পারি না।

মণিকা দেবী, আপনি?

বেলা দুটো পর্যন্ত সে বসে চিঠি লিখেছিল ঘরে আমি জানি। ঠিক দুটো বাজতে চিঠিগুলো ডাকে ফেলতেই বাইরে গিয়েছিল। মণিকা জবাবে বলে।

ডাকঘর কতদূর এখান থেকে? দুটোর সময় বের হয়ে সাড়ে পাঁচটায় ফিরলেন চিঠি পোস্ট করে!

বলতে পারি না, অন্য কোথাও হয়ত যেতে পারে।

একটা কথা মণিকা দেবী, ঠিক দুটোর সময়ই যে অতুলবাবুবাইরে গিয়েছিলেন ঠিক আপনার মনে আছে?

হ্যাঁ। তার কারণ অতুল চলে যাবার পরেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী অতুলের ঘরের আলোটা ঠিক করতে আসে বংশী এসে যখন মিস্ত্রী এসেছে বললে তার আগে আমার একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। ঘর থেকে বেরুতে যাব এমন সময় ঘরের ওয়াল-কুকটায় ঢং ঢং করে দুটো বাজল। তাইতেই সময়টা আমার মনে আছে।

মণিকার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিরীটী। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন হঠাৎ অত্যন্ত সজাগ ও তীক্ষ্ণ হয়ে মণিকার কথা শুনছিল। চোখেমুখে একটা অদ্ভুত ব্যাকুল সুতীব্র উৎকণ্ঠা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গতকাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রী এসেছিল এই ঘরের আলো ঠিক করতে?

হ্যাঁ।

কেন?

ঘরের আলোটা পরশু রাত্রে হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। গতকাল সকালে উঠেই অতুল বলেছিল মাঝরাত্রে উঠে আলো জ্বালতে গিয়ে আলো জ্বলে নি, সুইচেও নাকি শক দিচ্ছিল। মণিকা জবাবে বলে।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কজনই কৌতূহলের সঙ্গে কিরীটীর প্রশ্ন ও প্রশ্ন করার পর জবাব শুনছিল।

অন্য কেউ না বুঝলেও সুব্রত ও শিউশরণ কিরীটীর পর পর প্রশ্নগুলো শুনে বুঝতে পেরেছিল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই কিরীটী সকলকে প্রশ্ন করছে। ঘরের মধ্যেই প্রাপ্ত কোনো-না-কোনো একটা সূত্র কিরীটীকে সজাগ করে তুলেছে।

কিরীটী কিন্তু আর প্রশ্ন করে না কাউকে। হঠাৎ যেমন প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল, হঠাৎই আবার তেমনি চুপ করে যায়। ঘরের মধ্যে সকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। মিনিট দু-তিন নিস্তব্ধে কেটে যায়।

আবার কিরীটীই প্রশ্ন শুরু করে। এবারে ডাঃ মজুমদারকে।

মৃতদেহ দেখে মৃত্যুর কারণ আপনার কি মনে হচ্ছে ডাঃ মজুমদার?

খুব সম্ভব কোনো একটা শকে মারা গিয়েছেন।

ইলেকট্রিক শক বলে আপনার মনে হয় কি?

হতে পারে। মৃদু কণ্ঠে ডাঃ মজুমদার বলেন।

তাহলে মৃতদেহ চেয়ারে কেন? কিরীটী যেন নিম্নকণ্ঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা করে। বলতে বলতে হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ থেকে একসময় আপন মনেই নিঃশব্দে কয়েকবার মাথাটা দোলায় এবং পূর্ববৎ অনুচ্চ কণ্ঠেই বলে, তা হতে পারে! তা হতে পারে!

সকলেই যুগপৎ কিছুটা বিস্ময় ও বোকার মতই যেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মৃদুচ্চারিত স্বগতোক্তিগুলো বোঝবার ব্যর্থ প্রয়াস পায়।

কিন্তু কিরীটী সময়ক্ষেপ করে না। অতঃপর মৃতের জামার পকেটগুলো খোঁজ করতে গিয়ে একটা পোস্টকার্ড পেল। কার্ডটা লিখেছে অতুলেরই এক বন্ধু দেরাদুন হতে। সে লিখেছে দুন এক্সপ্রেসে সে কলকাতায় যাচ্ছে। পথে কাশী স্টেশনে যেন অতুল তার সঙ্গে দেখা করে, বিশেষ প্রয়োজন আছে।

দুন এক্সপ্রেস বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছবে। চিঠিটা কিরীটী পকেটে রেখে দিল। তারপরে শিউশরণের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টোচ্চারিত কণ্ঠে বলে, শিউশরণ, এবারে তুমি তোমার কাজ কর ভাই। তবে আগে একটা চাদর দিয়ে মৃতদেহটা ঢেকে দাও।

কিরীটীর নির্দেশমতই একটি বড় চাদর এনে মৃতদেহটা ঢেকে দেওয়া হল।

এবং সকলে অতঃপর কিরীটীরই ইচ্ছামত সুকান্তর ঘরে গিয়ে বসল।

আগের পর্ব :

১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা
২. অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনা
৩. রণেন আর সুকান্ত পরস্পর
পরের পর্ব :

৫. জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত
৬. সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির
৭. সেইদিনই দ্বিপ্রহরে
৮. ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত