আঁধার ঘেরা নিকোটিন

আঁধার ঘেরা নিকোটিন

সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিলাম, তাও খেলে কেন? সরি কিসের সরি? হ্যাঁ? একটা সিগারেট খেলে তোমার এক সপ্তাহ আয়ু কমে। আমি তোমাকে এক সপ্তাহ কম পাবো জীবনে। এবারেই শেষ, আর খাবো না। না শাস্তি পেতেই হবে তোমার। এক সপ্তাহ কোন কথা নেই; যাও।

একা রেখে যেও না একা? কিসের একা? অনলাইনে আবার একা কিসের? কত মেয়েবন্ধু আছে, নক দাও না, যাও? এমন করছো কেন? এমনিতেই অনেক কষ্ট লাগছে, নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে, তার মধ্যে তুমি…. হওয়া দরকার। যাও, শুভরাত্রি ফ্রম রাত্রি ফর শুভ। শুনো! মেসেজটা সেন্ট হয়েই বসে রইলো অনাথের মত; ডেলিভার্ড হলো না। রাত্রি অফলাইন হলো। শীতকাল। শুভ বিছানায় মুখের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে শুলো। এভাবে শুলে নিজের আশপাশের জগতটাকে অনেক ছোট লাগে। মনে হয় চারদিকে দূরদূরান্তে নজর রাখার প্রয়োজন নেই, এখন আপন চিন্তায় আরামসে মনোনিবেশ করা যায়!

আজ বন্ধুদের আড্ডায় সিগারেটের কথা উঠলো। বিষয়টা এমন ছিল যে ফয়সাল আর অনিক সামান্য রক-পেপার-সিজার খেলল বাজিতে। যে হারবে সে সবাইকে এডভান্স খাওয়াবে। দুজনেরই বাবা বড়লোক, দু-চার প্যাকেট মার্লবোরো এডভান্স তাদের কাছে ডালভাত ব্যাপার স্যাপার। তারপর, খাওয়া হয়েই গেল। হই-হুল্লোড় করতে করতে পরপর তিনটে শেষ করে ফেললো শুভ, সঙ্গে ফখরুল মামার কড়া মালাই চা। হালকা শীতে জমজমাট আড্ডার মাঝে রাত্রির কথা একটুও মনে পড়ে নি তখন। আর এখন শুভর সমস্ত অন্তঃকরণ জ্বলে যাচ্ছে অপরাধবোধে। “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না” প্রবাদটা মাছির মত মাথায় ভনভন করছে। মগজটাও যেন মজা নিচ্ছে তার সাথে। নিজের কাছ থেকে পালানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ঘুম, তাও আসছে না..। কিরে, কী করিস? ঘুমানোর চেষ্টা করছি, আসছে না। তুই? টয়লেটে, কষা হয়েছে, বসেই আছি অনেকক্ষণ ধরে। তোর কী হয়েছে, ঘুম পালালো ক্যানো? রাত্রি রাগ করেছে। আমি আবার সিগারেট খেলাম তাই আমি তোকে ইশারায় মানা করার চেষ্টা করছিলাম। তুই খেয়ালই করলি না। তোর দোষ আছে ভাই।

তুইও এভাবে বলছিস, শাহেদ! কীভাবে বলব? রাত্রির জায়গায় নিজেকে চিন্তা কর। ওর কেমন লাগে? সব মানুষ একরকম না, এমন অনেক মেয়ে আছে নিজেরাও সিগারেট টানে, বয়ফ্রেন্ড উঠতে বসতে এক প্যাকেট শেষ করলেও ওদের গায়ে লাগে না। সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু রাত্রি তো তেমন মেয়ে না।; সেটা আমার চেয়ে তুই ভালো জানিস। আর তাছাড়া- ভাই শোন, আমি আমার ভুলের জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। আমাকে নতুন করে ভুল ধরাতে হবে না। তোকে ফোন দিলাম একটু মন ভালো করতে, তুই আরো আমাকে পিসড অফ করে দিচ্ছিস। আয় উনো খেলি মেসেনজারে। মন ভালো হবে।

টয়লেটে বসে মোবাইলে উনো খেলবি? তুই পারিসও বটে! মেসেনজারে যেতে ইচ্ছে করছে না। রাত্রির নামের পাশে এখন সবুজ বাতিটা অন থাকার কথা ছিল, তা নেই। জানি, তবু কেন জানি দেখলেই আরো বেশি করে মন খারাপ করবে। তাহলে একটা কাজ কর, হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসটা পড়, ভালোই লাগবে। বাট বেশি ‘আবেগায়িত’ হয়ে যাস নে আবার! আচ্ছা, ভাই শোন, মন খারাপ করে পড়ে থাকবি না। মিসড কল দিস খালি, আমি ব্যাক করবো নে। পকপক করিস আমার সাথে।

সময় কাটছেই না। ঘড়ির কাঁটার একঘেয়ে টিকটিক। আম্মা আব্বা গ্রামে বেড়াতে গেছেন। আসতে আরো তিন চারদিন। আম্মা খাসির মাংস রান্না করে রেখে গিয়েছিলেন ফ্রিজে, সেটা শেষ। এখন ডিমপোস আর ডালই তার ভরসা। কিন্তু উঠে যেয়ে সেটুকুর আয়োজন করারও শক্তি কিংবা মানসিক অবস্থা তার নেই। শুভ বাতি নিভিয়ে রেখেছে সব রুমের। ফাঁকা বাসার প্রতিটা কোণে জমে থাকা আঁধারে যেন তার হাহাকারটা ভাসছে। অনেক মনে পড়ছে মেয়েটাকে। কী করছে এখন রাত্রি? ঘুমায় নি এটা নিশ্চিত শুভ। হয়ত বাথরুমে গিয়ে কল ছেড়ে কাঁদছে। কিংবা দেওয়ালে নির্দয়ের মতো নিজের হাত আছড়াচ্ছে। একটা সিগারেটই তো। কিন্তু এত কষ্ট পেয়ে গেল মেয়েটা। ভাবতেই আরো কুঁকড়ে যাচ্ছে শুভ।

দুজনার পরিচয়ের দিনটা আহামরি নয়। বছর দেড়েক আগের এক গ্রীষ্মের কড়া গরমের দিনে তাদের পরিচয়, গল্প-উপন্যাসের মত বসন্তের দিনে কৃষ্ণচূড়ায় রাঙা পথে নয়; কড়া রোদে পিচগলা রাস্তায় দেখা। এই যে! আপনি শুভ না? আমার ক্লাসমেটই তো মনে হয়, আজকে দেখলাম না ক্লাসে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি সম্ভবত রাত্রি। হ্যাঁ, ঠিক! আচ্ছা তোমার কাছে ১০০ টাকা ভাঙতি আছে? স্যরি তুমি করে বললাম; ক্লাসমেটই তো। এই রিকশাঅলা মামার কাছে সামান্য একশোটা টাকাও ভাঙতি নেই। আমার কাছে তো খুচরা বিশ টাকা আছে, আর এক হাজার টাকার নোট। কী ঝামেলা! ধুর!

রাত্রি রিকশাঅলা মামার দিকে তাকালো। কিয়ৎক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো; আমিও তাকালাম। ঘর্মাক্ত শরীর, ঘামের কড়া গন্ধে কাছে যাওয়া দায়। মাথায় গামছা বাঁধা। ময়লা সাদা শার্টের বুক পকেটের ওপর কোন স্কুলের মনোগ্রাম লাগানো; সম্ভবত কোন স্কুলছাত্রের পুরনো শার্ট। মামা আপনি পুরোটা রেখে দেন তো, প্যারা নাই। পুরাটা রাইখা দিমু মা? হ্যাঁ, রাখেন। শোনেন, এই টাকা দিয়ে সিগারেট খাবেন না ভুলেও। সোজা দোকানে যাবেন, হাফ লিটার একটা কোকা কোলা কিনবেন, এক টানে শেষ করবেন, ঠিক আছে? রিকশাঅলা চুপ করে রইলো। কী মামা, কিছু বলেন? নাকি সিগারেট খাবেন? না মা, খাব না সিগ্রেট।

আরেকটা কথা, আমার জন্য চোখ বন্ধ করে একবার দোয়া করবেন। আমার আব্বা অসুস্থ, ফুসফুসে কী যেন জটিলতা, সিগারেট খেয়ে খেয়ে বাঁধিয়েছেন। উনি যেন ভালো হয়ে যান, ঠিক আছে? আইচ্ছা মা। আল্লাহ তোমার আর তোমার পরিবার, আর তোমার পরিচিত হগ্গলের ভালা করুক। রিকশাঅলা চলে গেল। বলাই বাহুল্য আমি জানি তিনি সিগারেট খাবেন না বটে, তবে কোকা কোলাও খাবেন না। আজ রাতে তার ছেলেপিলে, বউ বাচ্চা একটু ভালোমত খাবার পাবে সামান্য একশ টাকার বদৌলতে। আমি কথা বলার ফুরসত পেয়ে মুখ খুললাম। তোমার বাবার কী হয়েছে বললে?

বাবার অসুখ। সম্ভবত ক্যান্সার বাঁধিয়েছেন। বাট এখনো ধরা পড়ে নি। ভয়াবহ রকমের শ্বাসকষ্ট উনার। জানো, আমাকে বাবা অন্নেক আদর করতেন। আমি যা আবদার করতাম সব শুনতেন। কিন্তু একটা জিনিস আমার অনেক খারাপ লাগতো জানো। বাবা দিনরাত সিগারেট টানতেন। এই একটা জিনিস আমি কতবার কতরকমে বলার পরও বাবা ছাড়তেন না। ওহ, তারপর? তারপর আর কী? এখন ভুগছেন। আমার তবুও বাবাকে দোষ দিতে ইচ্ছে করে না, নিজের ওপরই রাগ লাগে। খালি মনে হয়, আমি যদি আরেকটু চেষ্টা করতাম, তাহলে হয়ত বাবার সিগারেট খাওয়া ছাড়াতে পারতাম। এই চলছে আরকি।

কী বলব বুঝতে পারছি না। আহ হা! আমি তোমাকে আনকমফোর্টেবল করে দিচ্ছি বুঝি? কী করব, বাবার কথা মনে পড়লেই আমার অনেক মন খারাপ হয়ে যায়। তোমার কথা বলো। কেমন লাগছে? কেমন লাগবে? নতুন নতুন ভার্সিটির ফিলিংস, আরো দিন যেতে থাকুক না। তোমার আমার নামে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। বলতে পারবে? আমি কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম, না তো, কী? তোমার নাম শুভ, আমার নাম রাত্রি। দুটো মিলে শুভরাত্রি হয়ে যায়! হি হি হি! এভাবে তো ভেবে দেখি নি…!

তারপর দিন গেল সময় গেল। গেল আস্ত একটা বছর পেরিয়ে। পৃথিবী সূর্যকে পুরো দেড়পাক দিয়ে ফেললো। বসন্তের গন্ধে মুখর প্রকৃতির মাঝে পার্কের ইটের পথে পথচলাতে দুজনার হাত মিললো। রাত তিনটের কাছাকছি বাজছে। ঘুম এখনো আসেনি। কীভাবে যে তিনটে বাজলো, সময় কোনদিক দিয়ে গেল, শুভ টের পেল না। ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে সম্বিৎ ফিরে এলো। এই শুভ, এই। জেগে আছো? হ্যাঁ, বলো। মেসেনজারে আসবে? ফোনে টাকা নেই, টেক্সট মেসেজে কথা কন্টিনিউ করতে পারব না বেশিক্ষণ। আচ্ছা আসছি। কিছুক্ষণ পর শুভ? রাত্রি এসেছো? স্যরি।

শুনো, আমার বাবা মারা গেছেন একটু আগে, কাশতে কাশতে রক্তবমি করে ফেললেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, প্রচণ্ড কাশিতে রগ ছিঁড়ে গেছে, বুঝলে? আমি তোমাকে পরে ফোন করে কথা বলব। এখন ভালো লাগছে না। মুড অফ। তুমি সিগারেট খেও না কেমন? নিকোটিন বাবাকে এভাবে নিয়ে গেল আমার থেকে। তোমাকেও হারাতে পারবো না…। আর শোনো, আমি রাগ করে নেই। ভালোবাসি। শুভরাত্রি ফ্রম রাত্রি ফর শুভ! আচ্ছা খাবো না!!!! রাত্রি শোনো…এই!!!

ফোন কেটে গেল। রাত সাড়ে তিনটে। চারদিকে কুয়াশা। আমার অবশ্য শীত করছে না। আমি খুব দ্রুত হাঁটছি। শাহবাগ থেকে শান্তিনগর; খুব দূরে নয়, আবার খুব কাছেও নয়! রিকশা পাই নি, হেঁটে যাচ্ছি; যতটা দ্রুত সম্ভব পা চালাচ্ছি। গন্তব্য-রাত্রির বাসা। ল্যাম্পপোস্টের আলো আর কুয়াশায় আঁধারের রহস্য ঘোলাটে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত