আলোকলতা-১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা

আলোকলতা-১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা

১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা

আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকাই।

পৃথক পৃথক ভাবে মণিকা পত্র দিল তার প্রিয় তিন বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্তকে।

এবারে পূজার ছুটিতে এস বেনারস, কাশী। কাশীতে দিদিমার বাড়িতে ছুটিটা এবারে কাটানো যাবে।

আপত্তি আর কি থাকতে পারে। প্রত্যেকবারই পূজায় ছুটির কয়েকটা দিন চারজনে মিলে কোথাও না কোথাও গিয়ে হৈ হৈ করে কাটিয়ে আসে।

গতবার গিয়েছিল ওরা লক্ষ্ণৌ, তার আগের বার শিলং। এবারে না হয় কাশীই হোক।

জায়গাটা তো আর বড় কথা নয়। সকলে মিলে কয়েকটা দিনের জন্য এক জায়গায়। একত্রে মিলিত হয়ে হৈ হৈ করে আনন্দ করা। তা সে লক্ষ্ণৌই হোক, শিলংই হোক বা কাশীই হোক—এমন কি পাতাল বলে সত্যি যদি কিছু থাকত সেখানে যেতেও আপত্তি ছিল না। অবিশ্যি কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে ছুটি কাটানো যে এই প্রথম তা নয়।

বছর তিনিকে আগে একবার পূজাবকাশটা ওরা কাশীতে মণিকাদের ওখানেই কাটিয়েছিল এবং সেবারে বেশ কিছুদিনই কাশীতে ওরা থেকেছিল।

তার কারণও অবশ্য একটা ঘটেছিল।

ছুটির মাঝামাঝি হঠাৎ মণিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সামান্য অল্প অল্প জ্বর—কিন্তু তিন-চারদিনেও সেই অল্প অল্প জ্বর যখন গেল না এবং ক্রমে জ্বরের সঙ্গে দু-একটা করে

উপসর্গ দেখা দিতে লাগল তখন সকলেই চিন্তিত হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত রোগটা গিয়ে টাইফয়েডে দাঁড়ায় এবং পুরো এক মাস লাগে মণিকাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে।

কাজেই দশ-পনের দিনের জায়গায় মাসখানেকের কিছু উপরেই সকলকে থাকতে হয়েছিল কাশীতে সেবারে।

এ ছাড়াও মধ্যে মধ্যে যে সকলেরই কাশীতে মণিকাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল না, তাও নয়।

.

মণিকার দিদিমা ছিলেন কাশীতে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাশীবাসিনী। মণিকারও ত্রিসংসারে ঐ এক বুড়ী দিদিমা ছাড়া আপনার জন বলতে কেউ ছিল না।

মণিকা এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। অথচ বুড়ী দিদিমাকে সর্বদা কাশীতে দেখাশোনা করবারও একজন কারও দরকার। বুড়ী দিদিমার জন্য মণিকার সর্বদাই একটা দুশ্চিন্তা।

কাশীতে অবিশ্যি সেরকম স্ত্রীলোকর অভাব ছিল না, কিন্তু দিদিমার খুঁতখুঁতে মন, কাউকেই তেমন পছন্দ হয় না।

এমন সময় দেশের গ্রাম থেকে নিরাশ্রয়া সুবালা গ্রামের একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তীর্থপর্যটন করতে করতে কাশীতে এসে উঠল মণিকাদেরই বাড়িতে।

সুবালা ব্রাহ্মণের মেয়ে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশী নয়।

সুবালা অভাগিনী। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারায়। মামা-মামীর কাছেই মানুষ। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়াও কিছু শিখেছিল এবং মামা-মামীর চেষ্টাতেই একপ্রকার নিখরচায়ই এক মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে বিবাহও হয়েছিল সুবালার। মেধাবী ছাত্রটি সুবালার রূপে মুগ্ধ হয়েই স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছিল সুবালাকে।

শুধু রূপসী বললেই সুবালা সম্পর্কে যেন সবটুকু বলা হয় না। আগুনের মত রূপ ছিল সুবালার। প্রখর সে রূপের জৌলুসে পুরুষ তো ছার, মেয়েদের চোখই ঝলসে যেত। কিন্তু বিনা পণে বিবাহের বাজারে রূপের জৌলুসে বিকিয়ে গেলেও সুবালার স্বামীভাগ্য ছিল না। তাই বিবাহের পর ছমাস না যেতেই সুবালা হাতের নোয়া ও সিঁথির সিঁদুর মুছে মামা-মামীর কাছে ফিরে এল।

এবং দুভাগ্য যখন আসে একা আসে না—মামার গৃহে ফিরে আসবার মাসখানেকের মধ্যেই মামা গেলেন মারা।

সুবালা শীঘ্রই সংসারে সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠল। দুঃখের অপমানের অন্ন তিক্ত হতে তিক্ততর হয়ে উঠতে লাগল সুবালার মুখে দিন যত যায়।

মৃত্যু-আকাঙক্ষায় রাত্রি ও দিনের মুহূর্তগুলো কাটতে লাগল।

এমনি করে অনেকগুলো বছর কেটে গেল বৈধ্যবের। তারপর একদিন গ্রামের একদল প্রবীণা তীর্থযাত্রীর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এসে কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে উঠল সুবালা।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী সুবালা অতি সহজেই মণিকার দিদিমার স্নেহকে জয় করে নিল। ফলে যাবার সময় সকলে ফিরে গেল, কিন্তু সুবালা থেকে গেল মণিকার দিদিমার ওখানেই। সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।

সুবালাকে পেয়ে মণিকার দিদিমাও নিশ্চিন্ত হলেন এবং মণিকাও দিদিমা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হল।

রান্না ও গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ সুবালা তো করেই, অবসর সময় ভাগবত রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি পড়ে শোনায় বুড়ী দিদিমাকে।

সুবালার অল্প বয়স ও আগুনের মত রূপ দেখে প্রথমটায় মণিকার বুড়ী দিদিমা মনে মনে একটু ইতস্তত করেছিলেন সুবালাকে গৃহে স্থান দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা।

কিন্তু দেখা গেল বয়স অল্প ও আগুনের মত রূপ থাকলেও সুবালার চরিত্রে একটা সংযত আভিজাত্য আছে ও সেই সঙ্গে আছে একটা অদ্ভুত নিষ্ঠার ও তীক্ষ্ণ মর্যাদাবোধ। ছ্যাবলা নয়, অত্যন্ত সংযমী। ধীর-স্থির।

নিশ্চিন্ত হলেন মণিকার বুড়ী দিদিমা।

সুবালার চরিত্রে আর একটি গুণ ছিল, আলসেমিকে সে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দিত। সাংসারিক কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে সময়টা সুবালা বই পড়ে অথবা উলের বা সেলাইয়ের কাজ করে কাটাত।

পাড়ার গৃহস্থদের উলের সেলাইয়ের কাজ করে সুবালা দুপয়সা বেশ উপার্জনও করত।

.

কাশীতে মণিকার দিদিমার বাড়িটা জঙ্গমবাড়ির একটা গলির মধ্যে। সেকেলে ধরনের তিনতলা পুরাতন বাড়ি। বাড়িটা বছর পনের-ষোল আগে চাকরিতে অবস্থানকালেই মণিকার দাদু কাশীশ্বর চৌধুরী কিনেছিলেন একটা মৌকায় মাত্র পাঁচ হাজারে।

সংসারে তাঁর আপনার বলতে ছিল স্ত্রী সারদা ও একমাত্র নাতনী মণিকা। মণিকা কাশীশ্বর চৌধুরীর একমাত্র সন্তান কন্যা রেণুকারও একমাত্র সন্তান। বহু অর্থব্যয় করে মনোমত পাত্রে কন্যা রেণুর বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু মণিকার যখন মাত্র চার বৎসর বয়স তখন একটা রেল-অ্যাকসিডেন্টে জামাই ও মেয়ে একসঙ্গে মারা গেল। সেই হতে মণিকা দাদু ও দিদিমার স্নেহযত্নেই মানুষ।

কাশীশ্বরের ইচ্ছা ছিল সরকারের চাকরি হতে অবসর নেওয়ার পর জীবনের বাকী কটা দিন দেবাদিদেবের লীলাভূমি কাশীধামেই নিঝঞাটে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। পেনসন নেওয়ার মাত্র যখন মাস চার-পাঁচ বাকী হঠাৎ এমন সময় অকস্মাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কর্মস্থল হতে ফিরে করোনারী থ্রম্বোসিসে এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলেন কাশীশ্বর।

প্রথম ও একটিমাত্র আক্রমণেই সব শেষ হয়ে গেল। মণিকা সেবার আই.এ. পরীক্ষার জন্য কলকাতার হস্টেলে থেকে প্রস্তুত হচ্ছে। মণিকার দাদু তখন মীরাটে কার্যস্থলেই ছিলেন। সেখানেই ঘটল দুর্ঘটনা। তার পেয়ে কলকাতা থেকে মীরাটে মণিকা ছুটে গেল। এবং মীরাট থেকে সোজা এসে দিদিমাকে নিয়ে উঠল কাশীর বাড়িতে। বাড়িটা খালিই, তালা দেওয়া ছিল। ভাড়া দেওয়া হয়নি কখনও।

কটা দিন কাশীতে থেকে সাধ্যমত সব গোছগাছ করে দিয়ে মণিকা আসন্নবর্তী পরীক্ষার জন্য আবার ফিরে এল কলকাতায়।

বুড়ী দিদিমার একমাত্র বন্ধন মণিকা ম্যাট্রিক পাস দেওয়ার পর হতেই কলকাতার হস্টেলে সেই যে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে—সেই যেন পাকাপোক্তভাবে তার দিদিমার আশ্রয়নীড় হতে হয়েছে বিচ্ছিন্ন। ক্রমে হস্টেল-জীবনেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একটি একান্তভাবে একেবারে নিজের ঘর বাঁধবার স্বপ্ন যে বয়সে মেয়েদের মনে এসে বাসা বাঁধে ঠিক সেই বয়সেই হস্টেলের স্নেহবন্ধনহীন ভাসা-ভাসা জীবনের মধ্যে পড়ে কেমন যেন দায়িত্বহীন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে সে। হস্টেলে থেকেই একটার পর একটা পরীক্ষায় পাস করে দিল্লীর এক কলেজে চাকরি নিয়ে আবার সেই হস্টেল-জীবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাড়ির সঙ্গে ও দিদিমার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এখন মাসান্তে এক-আধখানা চিঠিতে এসে পর্যবসিত হয়েছে।

গ্রীষ্মের ছুটিটা যদিও এসে কাশীতে দিদিমার কাছে কাটিয়ে যায়, পুজোর ছুটিতে তাও আসে না। তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে কোথাও না কোথাও গিয়ে ছুটিটা কাটায়।

দিদিমার সঙ্গে মণিকার সম্পর্কটি বড় মধুর। মেয়ে-বন্ধু মণিকার একজনও নেই। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা উঠলে বলে, মেয়েদের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি! মনের পরিধি বা ব্যাপ্তি ওদের মধ্যে কোথায়? ছোটখাটো স্বার্থ নিয়েই তো ওরা মশগুল থাকে।

মণিকার বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্ত দিদিমার পরিচিত।

মধ্যে মধ্যে দিদিমা ঠাট্টা করেছেন নাতনীকে, আচ্ছা মণি, এইভাবে বাউণ্ডুলের মত চাকরি নিয়ে হস্টেলে না থেকে তোর ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে যাকে হোক একজনকে বিয়ে করেই না হয় সংসার পাত্ না!

এইবার তুমি ঠিক বলেছ দিদিমা। একজনকে বিয়ে করি আর দুজন মুখ গোমড়া করে বসে থাকুক। জবাবে বলেছে মণি।

দিদিমাও হাসতে হাসতে বলেছেন, তাহলে না হয় কলির দ্রৌপদী হয়ে ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে বিয়ে কর ভাই।

ভুলে যাচ্ছ কেন দিদিমা, এটা কলি যুগই। এ যুগে দ্রৌপদীদের সতী বলে কেউ ভোরবেলায় স্মরণ করে না—স্বৈরিণী বলে কলঙ্ক রটায়। তাছাড়া বিয়ে করা মানেই তো দুজনকে হারানো, এতদিনের বন্ধু ওরা আমার, ওদের একজনকেও হারাতে পারব না।

শেষ পর্যন্ত দেখিস ভাই, ওই তিনের বন্ধুত্বই একদিন না তোর পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। কথায় বলে মেয়ে-পুরুষ!

এত বছরেও যখন বিষ হয়নি-বন্ধুত্ব আমাদের জীবনে অমৃত হয়ে থাকবে!

হলেই ভাল। দিদিমা আর প্রসঙ্গটাকে টানতে চান নি। ওই তিন বন্ধুকে নিয়ে দিদিমার কথা ছেড়ে দিলেও, মণিকাকে কম নিন্দা ও গ্লানি সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু কোন নিন্দাকেই যেন মণিকা গায়ে মাখতে চায়নি।

অনেকদিন বাদে পূজাবকাশের কয়েকটা দিন আনন্দে হৈচৈ করে কাটাবে বলে মণিকার ওখানে এল সকলে কাশীতে। কিন্তু পৃজাবকাশের আনন্দঘন দিনগুলোর মধ্যে আকস্মিকভাবে এমনি করে যে ভয়াবহ মৃত্যুর ছায়া নেমে আসবে এ কেউ কি ওরা স্বপ্নেও ভেবেছিল! আগের রাত্রে যখন একত্রে সকলে মিলে বসে প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হৈ হৈ করে তাস খেলেছে, তখনও তারা বুঝতে কি পেরেছিল রাত্রি প্রভাত হবে দলের একজনের জীবনাবসানের ভিতর দিয়ে! বুঝতে কি পেরেছিল ওরা কেউ চারজনের মধ্যে একজনও যে তাদেরই একজনের পশ্চাতে মৃত্যু এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে! অমোঘ অনিবার্য। অতুল, রণেন, সুকান্ত ও মণিকা। চারজনের মধ্যে যে কেবল দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয় তাই নয়—নিবিড় ঘনিষ্ঠতাও ছিল। চারজনই অবিবাহিত। অতুল সাইকোলজির প্রফেসর, রণেন ডাক্তার, সুকান্ত ইঞ্জিনিয়ার আর মণিকা প্রফেসর। অতুল, সুকান্ত ও রণেনের মণিকা সম্পর্কে সঠিক মনোভাবটা বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এবং তিনজনের মধ্যে একজনও কথাবার্তায় বা আভাসে-ইঙ্গিতে ঘুণাক্ষরে কখনও কিছু না প্রকাশ করলেও এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হত না যে, মণিকা সম্পর্কে একটা দুর্বলতা তিন বন্ধুরই আছে। তিন বন্ধুর মধ্যে সর্বপ্রকার আলোচনা হত, কেবল দুটি বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনা হত না—পরস্পরের বিবাহ ও মণিকা সম্পর্কে। ওই জায়গাটিতে ওরা যেন অতি সতর্ক ছিল। কোনক্রমে কখনও কোন আলোচনার মধ্যে অতর্কিতেও যদি ঐ দুটি ব্যাপার এসেও যেত প্রত্যেকেই অতি সতর্কতায় এড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যেত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

এদের তিনজনের মধ্যে অতুল ধনী পিতার পুত্র। নিজেও মেধাবী ছাত্র হিসাবে অল্প বয়সেই ভাল চাকরি পেয়েছে। রণেন কিছুদিন হল বিলাতী ডিগ্রী ডিপ্লোমা নিয়ে এসে একজন তরুণ চিকিৎসক হিসাবে ক্রমে চিকিৎসা-জগতে নাম করতে শুরু করেছে। রণেনের আর্থিক অবস্থা ভাল না হলেও মোটামুটি। ছাত্র হিসাবে সেও বরাবর মেধাবী ও বৃত্তি পেয়ে এসেছে। দুজনের চেহরার মধ্যে কারোরই এমন বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় ছিল না। তবে স্বভাবে দুজনেই নম্র, বিনয়ী, ধীর ও সহিষ্ণু। তৃতীয় বন্ধু সুকান্ত গরীবের ছেলে, বাপ গরীব স্কুলমাস্টার। বাপের ক্ষমতা ছিল না ছেলেকে খরচপত্র করে উচ্চশিক্ষায় মনোমত উচ্চশিক্ষিত করে তোলেন। কিন্তু সুকান্তর ভাগ্যক্রমে তার এক সহায় জুটেছিল নিঃসন্তান এক ধনবতী মাসী। মাসী তার মায়েরও বড়। সুকান্তরা চার ভাই ও পাঁচ বোন। ভাই বোনদের মধ্যে সুকান্ত তৃতীয়। সুকান্তকে একপ্রকার দত্তক পুত্রের মতই বরাবর তার মাসী নিজের কাছে রেখে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করে তুলেছেন। সুকান্ত ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে একটি বিলাতী ইলেকট্রিক্যাল ফার্মের বড় চাকুরে, মেসোরই সুপারিশে ভাল চাকুরিতে ঢুকেছে প্রায় বছর দেড়েক হল। সুকান্ত তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে সুশ্রী। দীর্ঘ পেশল চেহারা, গোরাদের মত টকটকে গায়ের রং। আরও একটি তার গুণ আছে, সে একজন সুকণ্ঠী এবং সুগায়কও। আর মণিকা? মণিকার গায়ের রং কালো হলেও সমগ্র দেহ এমন একটি লাবণ্যে ঢলঢল, বিশেষ করে মুখখানি, তার বুঝি তুলনা হয় না। রোগাটে চেহারায় এমন একটি সৌন্দর্যময়ী সজীবতা আছে যে মনে হয় জীবনপাত্রখানি তার বুঝি সুধারসে উছলে উঠছে। সৌন্দর্যময়ী, মাধুর্যময়ী ও লাবণ্যময়ী।

রণেন, সুকান্ত ও অতুল এদের কলেজে আই.এস-সি ক্লাসেই পরিচয়। পূজার ছুটিতে ও গ্রীষ্মের ছুটিতেই বরাবর তিন বন্ধুতে মিলে কোন-না-কোন জায়গায় গিয়ে কিছু হৈচৈ করে আসত। অমনি এক পূজার ছুটিতেই পুরীতে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রসৈকতেই ওদের প্রথম পরিচয় হয় মণিকার সঙ্গে। মণিকা তখন বি.এ. পড়ছে। মণিকারও অভ্যাস ছিল পূজার ছুটিতে কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যাওয়া। দেশভ্রমণের একটা অদ্ভুত নেশা বরাবরই তার ছিল তার সেই ছোটবেলা থেকেই। পুরীর সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ছুটির পর কলকাতায় ফিরে এসে চারজনের দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা ছিল একটা নিত্যকার ব্যাপার এবং প্রতি রবিবারের ছুটিটা বটানিকসে বা ডায়মণ্ডহারবারে অথবা নৌকো করে গঙ্গায় কিংবা দক্ষিণেশ্বরে—কোথাও-না-কোথাও সারাটা দিন হৈচৈ করেই কাটত ওদের চারজনের। একটি মেয়ে ও তিনটি পুরুষের মধ্যে এই হৃদ্যতা বেশ যেন বিচিত্র। এমনি করে ক্রমে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। শিক্ষা-সমাপনান্তে এক-একজন যে-যার কর্মপথে এগিয়ে গেল, ছাড়াছাড়ি হল চারজনের মধ্যে। অতুল গেল হুগলী কলেজে প্রথমে, সেখান হতে কুচবিহারে; রণেন পাটনায় প্র্যাকটিস করতে লাগল, সুকান্ত রইল কেবল কলকাতায়। মণিকা চাকরি নিয়ে গেল দিল্লীতে। কিন্তু পূজা-অবকাশে ঠিক চারজনে কোথাও-না-কোথাও একত্রে এসে মিলিত হত। সমস্ত ছুটিটা হৈচৈ করে কাটিয়ে তারপর এক বৎসরের জন্য যে-যার কর্মস্থানে যেত ফিরে। কেবল সুকান্তই বেশীদিন থাকতে পারত না। দিন–দশেক পরে সে কলকাতায় ফিরে যেত। এইভাবে তাদের পরস্পরের পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতায় দীর্ঘ আট বৎসর কেটে গিয়েছে। এবারে মণিকার আমন্ত্রণে সকলে পূজার ছুটিতে কাশীতে এসে মিলিত হয়েছে। এবং দুর্ঘটনাটা ঘটল সাতদিন পরে। ঠিক কোজাগরী পূর্ণিমার দিনতিনেক পরে রাত্রে।

পরের পর্ব :

২. অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনা
৩. রণেন আর সুকান্ত পরস্পর
৪. পূজার অবকাশটা কাটাতে
৫. জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত
৬. সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির
৭. সেইদিনই দ্বিপ্রহরে
৮. ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত