প্রথম যেদিন ইকরাম ক্লাসে ঢুকলো স্যার জিজ্ঞেস করল, “এই ছেলে তোমার বাসায় কি এর চেয়ে ভাল কাপড় নাই? এটা কী পড়ে এসেছ? পরিষ্কার জামা কাপড় পড়ে আসবে বুঝেছ?” ইকরাম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। কিছু বলেছিল কিনা সেটা সহপাঠীরা কেউ স্পষ্ট শুনতে পেল না । তবে ব্যাপারটা ইকরামের পরিষ্কার হয়নি সেটা সবাই বুঝতে পেরেছিল। কারন স্যার বলার পরেও ওই পুরাতন দাগে ভরপুর জামা পড়ে আসতে তাকে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যেত। এরপর স্যাররা আর কিছু বলেনি। গ্রীষ্মের দুপুর ভালো লাগছেনা ক্লাস করা। ম্যাক্সিমাম স্টুডেন্ট টিফিন চুরি করে বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ইকরাম প্রতিদিনের সবগুলো ক্লাস করত তখনও।
সহপাঠীরা কেউ মিশতে চাইতো না ইকরামের সাথে। আর তাই সেও নিজের মতো করে একা একা চলতো। আবার অন্য কেউ যখন তাকে ডাক দিত সে খুব তৃপ্তি সহকারে কাছে আসতো। সবাই তাকে ডাকুক সে চাইত। সবার সাথে মিলতে চাইতো। কিন্তু সবাই তাকে উপেক্ষা করতো। গরমের সময় ইকরাম মাথার মধ্যে এতোটাই বেশি পরিমাণে তেল দিয়ে আসত যে মাথা থেকে তেল গড়িয়ে পরতে দেখা যেত। কি একটা বিব্রতকর অবস্থা। এমনিতেই ওর জামা কাপড় দেখে একটা রাগ রাগ ভাব আসে সবার আবার মাথার মধ্যে এরকম চকচকা তেল দেখার পর তো আরো বেশি রাগ উঠতো।
একদিন ক্লাস ক্যাপ্টেন দিদার বলল, ” ইকরাম যা টিনার ব্যাগটা নিয়ে আয় তো। ” ইকরাম বললো ” টিনা তো এখন টিফিন টাইমে বাইরে গিয়েছে তাকে না বলে আমি তার ব্যাগটা কেন আনবো? ” তোকে আনতে বললাম তুই আন। টিনা আমার চাচাতো বোন হয় সমস্যা নাই নিয়ে আয়। ওর ব্যাগের মধ্যে বড়ই আছে সেগুলো আমরা খাব। ”
দিদারের ভয়ালো চাহনি আর ধমক শুনে ইকরাম অসহায় ভাবে টিনার ব্যাগটা নিয়ে আসলো। ব্যাগে আসলেই অনেক গুলা বড়ই। বান্ধবীরা মিলে হয়তো একটু পর খাবে। কিন্তু সেই সুযোগটুকু আর হয়নি। দিদার সবগুলো নিয়ে নিয়েছে। এবার বলল “যা ব্যাগটা যেখান থেকে নিয়েছিলি সেখানে রেখে দিয়ে আয়।” ইকরাম দিদারের কথামতো যেখান থেকে ব্যাগটা এনেছিল সেখানে রেখে যখন ফিরে আসছিল তখন টিনা দেখে ফেলে। টিনা ছুটে এসে খুব জোর গলায় বলে “তোমার সাহস কত বড় তুমি আমার ব্যাগে হাত দাও? ” হকচকিয়ে গিয়ে ইকরাম বলল,” আসলে দিদার বলল তাই।”
” দিদার বলল মানে? যা বলবে তাই করবে তুমি? তুমি কি দিদারের চাকর? আর তুমি এত বলদ কেন? যে যেটাই বললো সেটাই তুমি বিশ্বাস করতেছ? আজব মানুষ? কত বড় সাহস আমার ব্যাগে হাত দেয়। আর কখনো যদি আমার ব্যাগ আর আমার আশেপাশে আসো খবর করে দেব একদম। ছোটলোক কোথাকার।” এসব শুনে দিদাররা সবাই মিলে হাসাহাসি শুরু করে দিলো। হাসতে হাসতে একের উপর অন্যজন পড়ে যাচ্ছে। এরকম ঘটনা প্রায়ই হত। কতবার যে অপমান আর লাঞ্ছিত হতে হয়েছে এই ইকরামের তার হিসাব নেই। একদিন কোন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় একজন সাংবাদিক এসেছিলেন। তিনি বললেন “তোমরা সবাই একটু ওয়াশরুমে গিয়ে চুল ঠিক করে আসো তোমাদেরকে একটা ছবি তোলা হবে। ”
সবাই যে যার মতো গিয়ে সুন্দরভাবে সেজেগুজে আসলো। তাদেরমতো ইকরামও পানি দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিল। ছেলেমেয়েদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হবে। যথারীতি সবাই এসে লাইনে দাঁড়ালো। ইকরাম সরল মনে টিনা ও লাবনীর পাশে এসে দাঁড়ালো। ছবি তোলার ঠিক আগমুহূর্তে লাবনী আর টিনা একসাথে চিৎকার করে উঠল “এই তুমি এখান থেকে যাও। তুমি আমাদের পাশে দাঁড়াবো না। প্লিজ তুমি অন্য কোথাও যাও। ” সবাই ইকরামের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। খুব বশি লজ্জা পেল ইকরাম। এরকম যতবার ইকরামকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে সে চোখে কান্না না করলেও মনের ভিতর খুব বেশি আঘাত পেয়ে মানসিক কান্না করেছে। ছোট মানুষ তার এত কিছু বোঝার কথা না কিন্তু সে বুঝতো।
বাড়িতে গিয়ে যে বাবা-মাকে বলবে “আমাকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দাও আমাকে নতুনভাবে সাজিয়ে দাও” সেই সুযোগটুকু তো তার নেই। তার বাবা সারাদিন রিক্সা চালিয়ে এসে যেটুকু টাকা পায় তা নিয়ে ইকরামের পরিবার কোনমতে চলে। অথচ অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে ইকরাম প্রতিবারই ভালো রেজাল্ট করতো। হয়তো সে প্রাইভেট পড়েনি বলে প্রাইভেট টিচারদের থেকে ভালো একটা মার্কস পেতোনা। তবুও সবসময় সিরিয়ালে থাকতো।
সেসব ছিল এখন থেকে আরও আট-দশ বছর আগের কথা। সেই সব দুঃসময়, দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর কথা যদিও ইকরাম সবসময় ভাবে না তবে বড্ড মিস করে ফেলে মাঝেমধ্যে। সেই দিনগুলোই আসলে ইকরামের ভিত্তিপ্রস্তর করে দিয়েছিল। রাগ অভিমান সব গুলোকে নিজের মধ্যে নিয়ে নিজের ইচ্ছাটাকে এত বেশি আগুন দান করেছিল যে কোনো বাধাই তার সামনে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে এলাকার মধ্যে সেই প্রথমবারের মতোই বুয়েটে চান্স পেয়েছিল। সে এক ত্যাগ আর পরিশ্রমের লম্বা সময়।
আজ যখন রাজধানীর বড় বড় স্কুলের ছেলেমেয়েরা তার কাছে এক বেলা প্রাইভেট পড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার খুব মনে পড়ে সেই ছোটবেলাকার কথা। বড়লোক শিল্পপতি ব্যক্তিরা যখন ফোন করে বলে ” স্যার একবার এসে আমার মেয়েটাকে পড়িয়ে যাবেন, প্লিজ স্যার। ” তার খুব তৃপ্তি লাগে। সে যতটুকু পারে মানুষের মন রক্ষা করে। শুধু তাই নয় তার প্রতিটা ব্যাচে অসংখ্য স্টুডেন্ট ফ্রি পড়ে। সে জানে একটা মানুষকে আর্থিকভাবে পড়ালেখায় সাহায্য করার মত মহৎ কাজ খুব কম আছে এই পৃথিবীতে। সে যে মাটি থেকে উঠে এসেছে সে মাটির বৈশিষ্ট্য তার জানা।
ইকরামের গরিব বাবা মা এখন আরাম করে সোফায় বসে টিভিতে খেলা দেখে। সুখ-দুঃখের আলাপ করে। সৃষ্টিকর্তা যাদেরকে খুব বেশি কষ্ট দেয় তাদের উচিত কষ্টটাকে অনুপ্রেরণা ও শক্তির উৎস হিসেবে নেয়ার। ভেঙ্গে না পড়ে গিয়ে নতুন উদ্যোমে আবারও এগিয়ে যাবার। ইকরাম মাঝেমধ্যে সেই পুরনো স্কুলের স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে যায়। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর বাজারে যেতেই যে দোকানটা চোখে পড়ে এবং যে দোকানটার মালিক এসে হাত মেলাতে মেলাতে আপ্যায়ন করে সে আর কেউ নয় সে সেই ছেলেটা – দিদার।
যে মেয়েগুলা তাকে একসময় অপমান করতো। ওই যে টিনা লাবনী। তাদের অবস্থা এখন আর ভালো নেই।
লাবনীর বিয়ে হয়েছে একটা বদমাশ লোকের সাথে। কয়েকদিন পরপর লাবনীকে তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে অত্যাচার করে আবার বাপের বাড়ি পাঠায়। যে টিনা এত বড় বড় কথা বলত তার বিবাহ হয়নি। একটা খারাপ মিথ্যা বানোয়াট কথা নাকি রটিয়ে দেয়া হয়েছিল তার নামে। তাকে কেউ বিয়ে করতে আসে না। খুব কষ্টে সে এখন ঘর দরজা লাগিয়ে কান্না করে। সবই বিধাতার খেলা। অবশ্য ইকরাম কখনো কাউকে অভিশাপ দেয় নি।
আর এখনও যে তার জীবনটা সুখেই যাবে সেটাও ইকরাম নিশ্চিত করে ভাবেনা। সে প্রভুর নামে প্রভুর দেখানো পথে চলে। সবার দোয়া চায়। ইকরাম ভাবে, জীবন ছোট নয় বেঁচে থাকলে জীবন অনেক বড়। কাউকে আঘাত দেয়ার কী দরকার এ জীবনে? পারলে উপকার করা উচিত আর নাইলে নাই কিন্তু ক্ষতি কেন করবো। বিধাতা চাইলে সবকিছু করতে পারে। একটা মানুষকে এক সেকেন্ডের মধ্যে তছনছ করে দিতে পারে আবার একটা মানুষকে এক সেকেন্ডের মধ্যেই করে দিতে পারে ধনী।
সে সব সময় সবার জন্য দোয়া চায় সে জানে অপরের জন্য বেশি দোয়া চাইলে নিজের দোয়াটা বেশি কবুল হয়।
রোজ ভোরে ফজরের নামাজের পর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে “হে আল্লাহ আমায় অহংকারী বানিও না। যে পথে চললে আখিরাত ও দুনিয়াতে শান্তি পাবো সেই পথে চলার তৌফিক আমাকে দাও। সবাইকে হেদায়েত দাও, সবার মঙ্গল করো।” বাবা-মার হাসিমুখ আর চিরশান্তির কথাবার্তার ভিড়ে সে নিজেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবে। আর মনে মনে অগণিত বার বলে “আলহামদুলিল্লাহ।”