আদিম রিপু

আদিম রিপু

০১.

ফোনের রিসিভারটা হাতে করেই সুভাষ বসে রইল।

রিসিভারটা যে ফোনের উপর নামিয়ে রাখবে তাও যেন ভুলে গিয়েছিল সুভাষ।

রিসিভারটা হাতের মধ্যে ধরা থাকে। আর সুভাষ শয্যার উপর বসে থাকে।

গীতা মারা গিয়েছে।

প্রতুল বলল, গীতা সুইসাইড করেছে–আত্মহত্যা করেছে গীতা।

কিন্তু কেন?

গীতা সুইসাইড করতে যাবে কেন? মাত্র তো কয়েক ঘণ্টা। রাত বারোটার পর গীতার বাড়ি থেকে ওরা তিন বন্ধু বের হয়ে গেছে হাসিমুখে শুভরাত্রি জানিয়ে।

আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল।

গীতা থাকে বালিগঞ্জে, আর ওরা তিনজনেই থাকে উত্তর কলকাতায়। সুভাষ ফড়িয়াপুকুরে, প্রতুল বিডন স্ট্রীটে, আর কুনাল শ্যামপুকুর স্ট্রীটে।

গতরাত্রে বাস-ট্রাম সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুভাষই তার গাড়িতে করে দুই বন্ধু প্রতুল ও কুনালকে যে যার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রাত দেড়টায় বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়ছে।

গাড়িটা পের্টিকোতেই এখনও পড়ে রয়েছে, গ্যারাজ করা হয়নি।

গ্যারাজ করবে কি গাড়ি, ঘুমে তখন তার দুচোখ জড়িয়ে আসছে। বাড়িতে সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাগ্যি সদরের একটা ড়ুপলিকেট চাবি তার কাছে থাকে। দরজা খুলে সোজা এসে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। তাহলেও সীতারাম টের পেয়ে গিয়েছিল ও যখন ঘরের দরজা খুলছে। ওর ঘরের কাছে বারান্দায় সীতারাম বরাবর শোয়।

সীতারামের ঘুমটাও পাতলা।

দরজা খোলার শব্দ পেয়েই সীতারাম ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কে, দাদাবাবু?

হ্যাঁ  রে।

এত রাত হল ফিরতে?

নিচের ল্যানডিংয়ের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় ঢং করে তখন রাত দেড়টা বাজল।

কটা বাজল?

রাত দেড়টা।

সীতারামের প্রশ্নের জবাবে বলেছিল সুভাষ।

অনেক রাত করে কাল শুয়েছিল বলেই বোধ হয় সকাল সকাল ঘুমটা ভাঙেনি সুভাষের।

নচেৎ সাধারণত সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যেই ঠিক ঘুম ভেঙে যায় সুভাষের।

আজ অনেকটা বেলা হয়ে গিয়েছে।

খোলা জানালাপথে রোদ এসে ঘরে ঢুকেছে। কালকের মেঘলা আকাশ আর নেই।

মেঘমুক্ত পরিষ্কার নীল আকাশ।

সামনেই টেবিলের উপরে হাতঘড়িটার দিকে তাকাল সুভাষ।

বেলা সোয়া আটটা।

এখনও হয়ত ঘুম ভাঙত না। মাথার কাছে টেরিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দেই ঘুমটা ভেঙেছে।

গীতা নেই।

হঠাৎ কথাটা যেন আবার মনে পড়ে গেল। একটু আগে প্রতুলই তাকে ফোনে সংবাদটা দিল।

গীতাকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে-মনে হচ্ছে সুইসাইড-ই করেছে।

আত্মহত্যা।

পাশেই ছোট একটা টেবিলের উপর বিষের শিশি একটা পাওয়া গিয়েছে। একটা আইলোশনের শিশি। নিচে লেখা পয়জন-বিষ!

প্রতুল ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিল, একবার যাবি না ওখানে?

সুভাষ কোন জবাব দেয়নি।

জবাব দেবে কি সে! বিমূঢ়—কেমন যেন বোবা হয়ে গিয়েছে সুভাষ।

একসময় বিমূঢ় ভাবটা যখন কাটে, সুভাষ হাতের রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল।

ফোনটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেজে উঠল। আবার রিসিভারটা তুলে নিল সুভাষ।

সুভাষ—

বল।

কি রে, কোন কথা না বলে কনেকশনটা কেটে দিলি? যাবি না গীতার ওখানে?

তুই কার কাছে শুনলি যে গীতা–

গীতার চাকর শম্ভু ফোন করেছিল, সে-ই প্রথমে জানতে পারে ব্যাপারটা। পুলিস এসেছে বাড়িতে। ও আর সৌদামিনী মাসী ছাড়া তো কেউ নেই। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।

ভয় পেয়েছে! শম্ভু ভয় পেয়েছে কেন? সুভাষ প্রশ্ন করে।

ভয় পাবে না! কি রকম একটা unexpected ব্যাপার। শোন, তুই বরং আমার বাড়িতে চলে আয়, আমি কুনালকেও একটা সংবাদ পাঠাচ্ছি আমার বাড়িতেই আসতে, তিনজনেই যাব।

সুভাষ কোন জবাব দেয় না।

কি রে, আসছিস তো?

আসছি।

প্রতুল ফোন ছেড়ে দেয়। সুভাষ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

গীতা সুইসাইড-আত্মহত্যা করেছে!

কিন্তু কেন? তার মত শান্ত ধীর-প্রকৃতির মেয়ে কোনদিন আত্মহত্যা করতে পারে সুভাষের যেন চিন্তারও অতীত ছিল।

গীতাকে তো আর এক-আধদিন নয়, প্রায় গত পাঁচ বছর থেকে চেনে। ওদের দলে গত পাঁচ বছর ধরে একসঙ্গে এক পার্টিতে কাজ করছে।

যেমন শান্ত ধীর গীতা তেমনি কোন সেন্টিমেন্টেরও ধার ধারে না। জীবনটাকে সে সহজ ও অনাড়ম্বর ভাবেই নিয়েছিল।

বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে।

বাপ ছিল শহরের নামকরা ডাক্তার। বর্তমানে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে পণ্ডিচেরীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বছর তিন হল। গীতার মাও সেখানে।

এক ছেলে এক মেয়ে-শান্তনু ও গীতা। শান্তনু বড় শহরের নামকরা একজন সার্জন।

দিনপাঁচেক হল নেপালে রানা ফ্যামিলির কার একটা অপারেশনের ব্যাপারে গিয়েছে। আজ-কালই ফেরার কথা।

ভাই-বোন কেউ বিয়ে করেনি।

বাড়িতে ঠাকুর, ড্রাইভার, দারোয়ান, বুড়ী ঝি মানদা ও শম্ভুচরণ আর অভিভাবিকা প্রৌঢ়া সৌদামিনী মাসী। সৌদামিনী মাসী নিঃসন্তান বিধবা। বিধবা হবার পর থেকেই গত পনেরো-ষোল বছর বোনের কাছেই আছে। বোন ও ভগ্নীপতি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে পণ্ডিচেরী চলে যাবার পর বাধ্য হয়ে সৌদামিনী মাসীকেই সংসারের হালটা ধরতে হয়েছে।

সংসার তো ভারি!

পয়সার অভাব নেই, কলকাতা শহরে বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্কব্যালেন্স কোন কিছুরই অভাব নেই।

শান্তনুও প্রচুর উপার্জন করে।

গীতা এম. এ. পাশ করে পার্টি করে বেড়ায় এবং এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপিকা।

মাসী অনেক চেষ্টা করেছে ভাই-বোনকে বিয়ে দেবার। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শান্তনু বলে, বুঝি মাসী, বিয়ে একটা করা উচিত আর ইচ্ছেও ষোল আনা আছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে–

তোর আবার মুশকিলটা কি? বিয়ে করলেই তো হয়! মাসী বলে।

মুশকিল হচ্ছে গীতা।

গীতা!

হ্যাঁ। ও বিয়ে করলেই আমি নিশ্চিন্ত। ঝাড়া-হাত-পা একেবারে সটান গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারি।

গীতা পাশেই ছিল, সে মুখ ভেংচে বলে ওঠে, ওঃ কী দরদ রে! গীতা না বিয়ে করলে উনি বিয়ে করতে পারছেন না! মনে করলেই তো হয় গীতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!

সেটা শান্তনুর ব্যাপারেও মনে করে নিলে হয়।

সত্যি দাদামণি, বিয়ে কর না একটা। একটা বেশ sweet বৌদি আসবে।

আর আমার বুঝি একজন ভগ্নীপতির শখ নেই!

ইতর! গীতা বলে ওঠে।

ক্রুয়েল! শান্তনু জবাব দেয়।

হিপক্রিট!

আনসিমপ্যাথেটিক!

কাওয়ার্ড!

আনসোস্যাল।

কথা-কাটাকাটি করতে করতে ভাই-বোন একসময় ক্ষান্তি দিয়েছিল।

গীতাই হাসতে হাসতে পরের দিন সবিস্তারে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিল ওদের তিন বন্ধুর কাছে।

সত্য দাদামণিটা ভারি ইন্টরেস্টিং!

ঐ সময় হঠাৎ প্রতুল বলেছিল, কিন্তু সত্যি গীতা, তোমার ব্যাপারটা কি বল তো?

কীসের ব্যাপার?

বিয়ে কি সত্যিই তুমি করবে না নাকি?

করব না কবে আবার বললাম।

তবে?

কি তবে?

করছ না কেন?

মনের মত স্বামী জুটবে! তবে তো। যার তার হাত ধরে তো কিছু আর বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসে পড়তে পারি না।

প্রতুল বলেছিল আবার, কেন, আমাদের পার্টিতেও এত ছেলে রয়েছে-মিত্রা, রেবা, রীতি ওরা তো পার্টির ছেলেদেরই বিয়ে করল।

করেছে বটে, তবে ভুল করেছে।

ভুল।

হ্যাঁ, কমরেডদের ভিতর থেকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। কারণ পার্টি পলিটিকস ও সংসার-পলিটিকস্ সম্পূর্ণ দুটো আলাদা ব্যাপারকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো ওদের বুদ্ধির কাজ হয়নি।

কুনাল ঐ সময় বলেছিল, কিন্তু কারও প্রতি কারও যদি ভালবাসা হয়ই

একটা কথা ভুলে যেয়ো না কুনাল, পার্টির কর্মী হলেও প্রত্যেকে মানুষ, মেসিন নয়। এবং কতকগুলো জায়গায় তাদের সংসারের আর দশজন মানুষের সঙ্গে কোন তফাৎ নেই।

ল্যান্সডাউন যখন পুরোপুরি ল্যান্সডাউন হয়নি, গীতাদের বাবা ডাঃ সুকান্ত চক্রবর্তী এসে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করেছিলেন।

তারপর অবিশ্যি ক্রমে বহু ঘর-বাড়ি তৈরি হয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে।

বাড়ির নাম নিরালা।

তিনতলা বাড়ির মধ্যে অনেকগুলো ঘর।

একতলার খান-দুই ঘর নিয়ে শান্তনুর চেম্বার এবং বাকি দুটো ঘরে গীতাদের পার্টির আড়া।

নন-রেজিস্টার্ড শাখা-অফিস।

দোতলার দুটো পাশাপাশি ঘরের একটাতে থাকে সৌদামিনী মাসী আর একটায় গীতা। বাকি সব খালিই পড়ে।

তিনতলায় শান্তনুর আড্ডা।

ব্যাপারটা অবিশ্যি দাসী মানদাই প্রথমে জানতে পারে। সাধারণত বেলা করে কখনও ওঠে না গীতা। কিন্তু বেলা সাতটা বেজে গেল, গীতা ওঠেনি দেখে মানদা ডেকে তুলতে গিয়েছিল দিদিমণিকে।

ঘরের দরজা খোলাই ছিল–মাত্র ভেজানো।

ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই মানদা কেমন যেন থমকে দাঁড়ায়। শয্যাটা এলোমেলো। আড়াআড়ি ভাবে গীতা শয্যার উপর শুয়ে। একটা হাত অসহায় ভাবে খাটের পাশ দিয়ে ঝুলছে, অন্য হাতটা ছড়ানো।

চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে, মুখটা ঈষৎ হাঁ করা। ডানদিকের কষ বেয়ে ক্ষীণ একটি রক্তের ধারা।

তবু সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মানদা এবং বুঝতে পারে গীতার দেহে প্রাণ নেই।

তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে আসে।

সোজা একেবারে একতলায়। শম্ভু ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে উপরে যাচ্ছিল গীতার ঘরে।

শম্ভু! চিৎকার করে ওঠে মানদা।

কি হল? চমকে ফিরে তাকায় শম্ভু।

ওটা রাখ, শীগগিরি ওপরে চল!

কেন? কি হয়েছে?

দিদিমণি—

কি হয়েছে দিদিমণির?

মরে গেছে।

সে কি!

হ্যাঁ–চল শীগগির—

শম্ভু তাড়াতাড়ি ছুটে তখুনি উপরে যায়। গীতার ঘরে ঢুকে গীতার দিকে চেয়ে সেও বুঝেছিল গীতা আর বেঁচে নেই, তবু সে বাড়ির পারিবারিক প্রৌঢ় চিকিৎসক ডাঃ সান্যালকে ফোন করে দেয়।

ডাঃ সান্যাল এসে দেখেন, শয্যার উপর একপাশে একটা খালি পয়জন আইলোশনের শিশি পড়ে আছে।

ব্যাপারটা সুইসাইড ভেবে তিনিই তখন নিকটবর্তী থানায় পুলিশ অফিসারকে ফোনে সংবাদ দেন।

অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিস এসে পড়ে।

শম্ভু ও মানদাকে নানারকম জেরা করে জানতে পারেন থানার ও. সি. মিঃ দত্তরায়, গতকাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত গীতা তার পার্টির বন্ধু সুভাষ কুণাল ও প্রতুলকে নিয়ে আড্ডা দিয়েছে।

শম্ভু জানত গীতার ঐ তিনজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা।

তখন সে প্রতুলকে ফোন করে।

.

প্রতুল এসে পৌঁছল বেলা তখন সাড়ে নটা।

থানার ও. সি. দত্তরায় তখন গীতার শয়নঘরের পাশের ঘরে বসে মানদার জবানবন্দি নিচ্ছিলেন সৌদামিনীর জবানবন্দি শেষ করে।

সৌদামিনী বিশেষ কিছু বলতে পারেনি।

বয়স হয়েছে, তাছাড়া ইদানীং চোখে ছানি পড়ায় ভাল দেখতে পায় না। বাতও আছে। কদিন ধরে বাতের কষ্টটা বেড়েছে।

গতকাল তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল। গীতা ঐ সময় নিচের তলায় তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল।

মানদা তার জবানবন্দিতে বললে, দিদিমণি ও তার বন্ধুরা রাত সাড়ে দশটা নাগাদ নিচের ডাইনিং হলে বসে একত্রে খাওয়া-দাওয়া করে। গীতা নিজে মার্কেট থেকে মাংস এনে রান্না করেছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরে আবার ওরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসে। বাইরে তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে।

মানদা ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে শুতে চলে যায়, তারপর সে আর কিছু জানে না। দিদিমণির বন্ধুরা কত রাত্রে গিয়েছে, গীতা কখন শুতে গিয়েছে–

কোথায় তুমি শোও?

নিচের তলায় একটা ঘরে।

অতঃপর শম্ভুচরণের ডাক পড়ল। এই বাড়িতে সেই-ই সবচাইতে বেশিদিন ধরে কাজ করছে।

দাদাবাবু দিদিমণি যখন বলতে গেলে বাচ্চা, তখন থেকে।

সে শোয় উপরে একটা ঘরে।

দত্তরায় প্রশ্ন করে, তুমি কখন কাল রাত্রে শুতে যাও?

রাত বারোটা।

অত রাত হল কেন?

শুয়ে পড়েছিলাম, দিদিমণি ডেকে কফি দিতে বলল। কফি দিয়ে শুতে শুতে রাত বারোটা হয়ে যায়।

দিদিমণির বন্ধুরা কখন যায় জান? কত রাত হয়েছিল তখন?

ঠিক বলতে পারব না হুজুর, তবে কফি খাবার কিছু পরেই।

তখন তুমি কি করছিলে? শুয়ে পড়েছিলে কি আবার?

আজ্ঞে না। বসে একটা বিড়ি খাচ্ছিলাম। দিদিমণি ওদের বিদায় দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে তার ঘরে গেল।

তারপর?

আজ্ঞে আমার মনে পড়ছে একটা কথা, দিদিমণি বোধ হয় উপরে এসে আবার নিচে গিয়েছিল।

কখন?

মনে হয় ঘণ্টাখানেক পরে।

কি করে বুঝলে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসবার পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম।

সে যে তোমার দিদিমণিই কি করে বুঝলে? অন্য কেউ তো হতে পারে?

তা হতে পারে। কিন্তু আর কে হবে? মাসীমা তো কখন শুয়ে পড়েছেন-মানদাও শুয়ে পড়েছিল। আমিও আমার ঘরে ছিলাম। তাই মনে হয় দিদিমণিই।

দত্তরায় অতঃপর আরও কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করে শম্ভুচরণকে নিষ্কৃতি দিলেন।

প্রতুল, সুভাষ ও কুণাল ঐ ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে তাদের কয়েকটা প্রশ্ন করলেন।

একটা প্রশ্ন বিশেষ করে তিনজনকেই জিজ্ঞাসা করলেন, গীতার সঙ্গে তো তাদের অনেক দিনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা, সুইসাইড করবার মত কোন কারণ ছিল কিংবা ঘটেছিল কিনা গীতার?

তিনজনেই বলে, না।

প্রতুল বললে, গীতা সুইসাইড করতে পারে কথাটা যেন এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ দত্তরায়। She was full of life and energy—তার কোন অভাব ছিল না বা কোন problem ছিল না, তবে কেন সে সুইসাইড করতে যাবে।

মিঃ দত্তরায় তখনকার মত মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে বিদায় নিলেন।

০২.

পরের দিন সকালেই জরুরী তার পেয়ে গীতার দাদা শান্তনু প্লেনে কলকতায় ফিরে এল। গীতার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা যেন তাকে কেবল মর্মাহতই নয়, যেন বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। আইলোশনের শিশিটা গীতারই চোখে দেবার জন্য ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেছিল।

সবাই বলছে, গীতা সুইসাইড করেছে ঐ বিষাক্ত লোশন খেয়ে। কিন্তু কেন? কোন্ দুঃখে সে সুইসাইড করতে যাবে? বোনকে তো সে কোনদিন এতটুকু অনাদর করেনি, তার কোন কাজে কোনদিন বাধা দেয়নি, কখনও ভুলেও এতটুকু তিরস্কার করেনি তবে?

তাছাড়া গীতার মত বুদ্ধিমতী, বিবেচক, প্রাণচঞ্চল মেয়ে আত্মহত্যা করেছে কথাটা যেন ভাবাও যায় না।

নিজের ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসেছিল শান্তনু। দত্তরায় এলেন।

শান্তুনবাবু, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আজ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু রিপোর্টটা সম্পূর্ণ অন্য রকম বলছে।

অন্য রকম!

হ্যাঁ, cause of death—বিষ নয়।

তবে? উৎকণ্ঠিত শান্তনু দত্তরায়ের মুখের দিকে তাকায়।

গীতা দেবী সুইসাইড করেননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যা! কি বলছেন আপনি?

তাই। গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যা করা হয়েছে তাকে? কে–কে তাকে হত্যা করল?

আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। মনে হচ্ছে বাড়ির কেউ। কারণ সে-সময় তো বাইরের কেউ ছিল না। আচ্ছা, আপনাদের ঐ চাকর শম্ভুচরণ–

না না, এ আপনি কি বলছেন! শম্ভু একপ্রকার গীতাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে।

তাহলেও পুরনো চাকরবাকরের অমন দুষ্কৃতির নজিরেরও অভাব নেই।

কিন্তু কেন—কেন সে গীতাকে হত্যা করবে?

সে কথা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না আরও ইনভেসটিগেশন না করে। শম্ভুকে একবার আমি থানায় নিয়ে যেতে চাই। তাকে এরবার ডাকুন।

কিন্তু আশ্চর্য!

শম্ভুকে ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না এবং খোঁজ করে জানা গেল, গত রাত থেকেই নাকি শম্ভু নেই।

কোথায় গেল শম্ভু?

মানদা বললে, তা তো জানি না।

আমাকে এ কথা এতক্ষণ জানাওনি কেন? শান্তনু প্রশ্ন করে।

ভেবেছিলাম আপনিই হয়ত তাকে কোন কাজে কোথাও পাঠিয়েছেন দাদাবাবু। মানদা বলে।

০৩.

শম্ভুচরণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। দুদিন ধরে সারা কলকাতা শহরে তোলপাড় করেও তার কোন সন্ধান করা গেল না। পুলিস হন্যে হয়ে যেন শম্ভুচরণকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার গ্রামের বাড়িতেও ধাওয়া করেছিল পুলিস, কিন্তু সেখানেও তার কোন সন্ধান পায়নি।

পুলিসের একপ্রকার ধারণাই হয়ে গিয়েছে, ওই শম্ভুচরণই দোষী। সে-ই গীতাকে হত্যা করছে।

শান্তনু কিন্তু এখন বলছে, শম্ভু গীতাকে হত্যা করতে পারে, কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। তবে শম্ভুচরণ গীতাকে না হত্যা করলেও, কেউ-না-কেউ হত্যা করেছে। তাকে ঠিকই কিন্তু সে কে? কে হত্যা করতে পারে গীতাকে? আর কেনই বা হত্যা করল? গীতার মৃত্যু হয়েছে, কথাটা যেন এখন কিছুতেই ভাবতে পারছে না শান্তনু।

হঠাৎ মনে পড়ে শান্তনুর একজনের কথা। প্রেসিডেন্সিতে একসঙ্গে বছর-দুই পড়েছিল। তারপর দুজন দুদিকে চলে যায়। তাহলেও মধ্যে মধ্যে দেখা হয়েছে।

তার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর দেরি করে না শান্তনু, সেইদিনই সন্ধ্যার দিকে সোজা তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়।

বাইরের ঘরেই ছিল সে, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল। শান্তনুকে দেখে বলে, এস শান্তনু, বস।

শান্তনু বসল। একটু পরে ভদ্রলোককে বিদায় করে দিয়ে সে তাকাল শান্তনুর মুখের দিকে। বললে, অনেক দিন পরে দেখা তোমার সঙ্গে। কিন্তু কি ব্যাপার? মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে, you are very much worried—খুব চিন্তিত!

কিরীটী!

শান্তনুর ডাকে কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল, বস, একটু চায়ের কথা বলে আসি।

ওসব এখন থাক ভাই। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই আমার এক বোন ছিল—ওই একটি মাত্রই বোন গীতা, তাকে গলা টিপে গত শনিবার রাত্রে কে যেন হত্যা করেছে।

হত্যা করেছে।

হ্যাঁ। প্রথমে সবার ধারণা হয় ব্যাপারটা বুঝি সুইসাইড, কিন্তু পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, না গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কোথায়?

তার শোবার ঘরে।

কিরীটীর অনুরোধে তখন শান্তনু সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া বলে যায়, তারপর বলে, কিন্তু কে-কে হত্যা করতে পারে গীতাকে? কেনই বা হত্যা করল? পুলিসের ধারণা বাড়িরই কেউআর ঐ শম্ভুচরণই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।

কিরীটী জবাবে কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একসময় বলে, ওই যে তিনটি ছেলের নাম করলে, গীতার সহকর্মী ও বিশেষ পরিচিত-কুণাল, প্রতুল ও সুভাষ—ওরা কি বলছে?

ওরা তো রীতিমত shocked!

ওদের তো তুমি সকলকেই চেন?

হ্যাঁ, খুব চিনি।

কি রকম মনে হয় ওদের?

কালচার্ড, সভ্য—আর যতদূর মনে হয় ওরা গীতাকে সত্যিই ভালবাসত।

They are all bachelors? কেউই বিয়ে করেনি?

না।

কে কি করে?

সুভাষের অবস্থাই ওদের মধ্যে সবচাইতে ভাল। কোন রকম চাকরিবাকরি করে, পার্টি নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। লেখাপড়া বোধহয়—বি. এ. পর্যন্ত পড়েছিল। কুনাল প্রফেসারি করে, তাছাড়া একজন কবি। অবস্থা মোটামুটি। প্রতুল একটা সংবাদপত্রের অ্যাসিসটেন্ট এডিটর। ওদের পার্টির একজন প্রচণ্ড উৎসাহী পাণ্ডা। সুভাষকে মনে হয়েছে আমার একটু অহংকারী ও উদ্ধত প্রকৃতির, কুনাল খুব শান্ত ও নিরীহ, প্রতুল ভীষণ বদরাগী ও অস্থির প্রকৃতির; একসময় কলেজজীবনে নামকরা একজন অ্যাথলেট ছিল।

কাল সন্ধ্যার দিকে ওদের একটিবার তোমার বাড়িতে ডাকতে পার? ওদের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলতে চাই আমি।

বেশ তো।

.

পরের দিন সন্ধ্যায়—নিরালায়। এক এক করে প্রশ্ন করছিল ওদের কিরীটী।

প্রথমেই প্রতুল। দু-চারটে কথাবার্তার পর কিরীটী প্রতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে, এবারে একটা কথার শুধু স্পষ্ট জবাব চাই প্রতুলবাবু, আপনি গীতাকে ভালবাসতেন এবং গীতাও আপনাকে ভালবাসত জানি। আপনাদের পরস্পরের ওই ভালবাসার মধ্যে কি কোন কারণে চিড় ধরেছিল?

চিড়।

হ্যাঁ, কারণ ওই ধরনের ভালবাসা যেমন selfish তেমনি blind—অন্ধ। কখনও কখনও তাই সামান্যতম কারণে ও সামান্য সন্দেহে–

না, সেরকম কিছু ঘটেনি। কারণ সামনেই জানুয়ারিতেই আমরা বিয়ে করব স্থির ছিল–

এ কথাটা কুনাল ও সুভাষবাবু জানতেন?

স্পষ্ট করে আমরা না বললেও, ওরা বোধ হয় সন্দেহ করেছিল।

কীসে বুঝলেন?

মধ্যে মধ্যে ওদের কথাবার্তায় ইদানীং মনে হত।

আপনারা তিনজন সহকর্মী ও বন্ধু জানি, দীর্ঘদিনের পরিচিতও-ওদের দুজনার মধ্যে কাকে আপনি বেশি পছন্দ করেন?

সুভাষ অত্যন্ত selfish—আত্মসর্বস্ব, আর একটু অহংকারীও। I like কুনাল more than সুভাষ।

আচ্ছা সে-রাত্রে কখন ঠিক—মানে কত রাত্রে আপনারা বের হয়ে যান এই নিরালা থেকে মনে আছে?

হুঁ, মনে আছে-রাত বারোটা বেজে পনেরো মিনিট।

সে-সময় গীতাকে আপনার কি রকম মনে হয়েছিল?

অত্যন্ত স্বাভাবিক, হাসিখুশি।

আর একটা কথা প্রতুলবাবু, গীতার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার ঐ দুই বন্ধুর মধ্যে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

না, না। এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়!

প্রেম মানুষকে যেমন দুর্বল অসহায় ভীরু করতে পারে, তেমনি অন্ধ অবিবেচক হিংস্রও করে তুলতে পারে। কথাটা আরও একটু স্পষ্ট করে বলি, এই প্রেম-যার অন্য সংজ্ঞা পুরুষ বা নারীর একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ, যেটাকে মানুষের আদিম রিপুও বলতে পারেন।..আচ্ছা ঠিক আছে, আপাতত আর আপনার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। আপনি যেতে পারেন।

০৪.

বসুন কুনালবাবু!

কিরীটীর আহ্বানে কুনাল সামনাসামনি সোফাটার উপর বসল। মামুলী কয়েকটা প্রশ্নের পর তাকেও কিরীটী ঐ একই প্রশ্ন করে।

চিড় ধরেছিল কিনা জানি না, কুনাল বলে, তবে প্রতুলের সঙ্গে যে আড়ালেআবডালে একটা ব্যাপার ওর চলেছে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেটা। আর তাই নিয়ে। দুজনের মধ্যে আমাদের কথা-কাটাকাটিও হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। আমি সবটাই গীতাকে বলেছিলাম। তার মনের মধ্যে যদি অন্য কিছু থাকে সে আমাকে যেন স্পষ্টই বলে দেয়। আমি একটি বোকা বনতে চাই না।

কি বলেছিল তাতে গীতা?

বলছিল, আমার পছন্দমত কাউকে বিয়ে করারও কি আমার অধিকার নেই, তুমি বলতে চাও কুনাল!

কেন থাকবে না? কিন্তু বিট্রে করবার নিশ্চয়ই তোমার কোন যুক্তি নেই!

তাতে কি জবাব দিয়েছিল গীতা?

মৃদু হেসেছিল কেবল।

কুনালবাবু, আর একটা কথা, গীতার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার ঐ দুই বন্ধুকে কোন রকম সন্দেহ করেন?

কুনাল চুপ করে থাকে।

কি, জবাব দিচ্ছেন না যে।

জানি না। তবে প্রতুল-ওকে আমি বিশ্বাস করি না, রাগলে ওর আসাধ্য কিছু নেই।

.

সর্বশেষ এল সুভাষ।

কিরীটীর সেই একই প্রশ্ন।

প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলে, রাত ঠিক বারোটা পনেরো।

আপনার গাড়ি করেই তো সকলকে আপনি পৌঁছে দেন?

হ্যাঁ। রাত কটায় আপনি বাড়ি ফিরে যান?

তা একটা হবে।

কি রকম speed-এ আপনি গাড়ি চালান?

বেশ একটু speed-এ চালাই।

আচ্ছা সুভাষবাবু, আপনি কি জানতেন যে আপনার বন্ধু প্রতুলবাবুর সঙ্গে গীতা দেবীর বিয়ের ব্যাপারটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল।

জানব না কেন?

জানতেন। তারাই বুঝি আপনাকে জানিয়েছিল—গীতা ও প্রতুলবাবু?

হ্যাঁ-না they were coward; সোজা কথা স্পষ্ট করে যারা বলতে পারে না, বলবার courage রাখে না—তাদের আমি ঘৃণা করি। সুভাষের কণ্ঠস্বরে যেন একটা বিরক্তি, ঘৃণা ঝরে পড়ল। অথচ ব্যাপারটা নিয়ে লুকোচুরি করবার কিছুই ছিল না, আর জানালেও যে আমরা কেউ ভেঙে পড়তাম হতাশায় তা নয়।

আপনি কি করে কবে প্রথম জানতে পারলেন ব্যাপারটা? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে।

কি করে জানলাম সেটা বলব না, তবে মাসখানেক আগে জানতে পারি প্রথম।

আপনি যে জানতে পেরেছেন সেটা ওদের জানিয়েছিলেন?

না।

কেন? ওসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা আমার রুচি ও শিক্ষায় বেধেছিল বলে।

নোংরা ব্যাপার।

তাছাড়া কি? যারা ভালবাসার নাম করে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের দেহ নিয়ে টানাটানি করে তাদের সবটাই নোংরামি। যাদের রুচি আছে, শিক্ষা আছে-তাদের অতখানি বিকৃতি কখনও হয় না।

কিরীটী একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, মনে হচ্ছে আপনি গীতাকে ভালবাসতেন—if I am not wrong!

ক্ষেপেছেন? ভালবাসতে যাব আমি ঐ মনোবৃত্তির একটা তুচ্ছ মেয়েছেলেকে? গীতা জানত না যে তাকে আমি কতখানি ঘৃণা করতাম, তার চরিত্রের ওই দুর্বলতা আর হ্যাংলামির জন্য!

তাহালেও বুঝতে পারছি, কখনও সে কথা গীতাকে আপনি জানতে দেননি নচেৎ সব কিছু জানবার পরও আপনি তার সঙ্গে মিশতেন না বা হেসে কথা বলতেন না।

বরং বলুন অতখানি নিচে কখনও আমি নামতে পারিনি!

আপনি বোধ হয় শুনেছন, গীতার মৃত্যুর কারণ বিষ নয়?

বিষ নয়!

না, কেউ তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করছে সে-রাত্রে।

না, না,-তা কেন হবে—

তাই। ময়নাতদন্তেও তাই বলেছে। আচ্ছা কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

না।

অতঃপর সেদিনকার মত কিরীটী সকলকে বিদায় দিল।

.

দিন-দুই পরে।

সন্ধ্যারাত্রি তখন! কিরীটী হঠাৎ গিয়ে হাজির হয় সুভাষের গৃহে। সুভাষ তখন গৃহে। ছিল না।

সীতারাম বললে, দাদাবাবু তো বাড়িতে নেই!

কোথায় গিয়েছেন জান?

না।

কখন ফিরবেন, তা জান না?

না।

তোমার নাম কি?

আজ্ঞে সীতারাম।

কতদিন এ বাড়িতে আছ?

তা দশ-বারো বছর হবে।

তুমি শুনেছ বোধ হয় গীতা দিদিমণি মারা গিয়েছেন?

শুনেছি বৈকি বাবু। আহা, দিদিমণি বড় ভাল ছিল। হাসি ছাড়া কখনও দেখিনি।

এখানে আসত না?

হ্যাঁ, প্রায়ই আসত।

তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল, তাই না?

আজ্ঞে। আমি তো ভেবেছিলাম দাদাবাবু গীতা দিদিমণিকেই বিয়ে করবে।

আচ্ছা সেদিন রাত্রে কখন তোমার দাদাবাবু ফিরেছিল মনে আছে?

রাত তখন একটা হবে। না—ঠিক তা নয় বোধ হয়, রাত প্রায় দেড়টা হবে।

একবার বলছ রাত একটা, আবার বলছ রাত দেড়টা—

হ্যাঁ  বাবু, ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ছে আমার—

ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয় গিয়েছিল কি রকম?

হ্যাঁ, পরের দিন দেখি—দাদাবাবু গীতা দিদিমণির বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঘড়িটা ঠিক করছে। আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলে দেখলাম।

কোন্ ঘড়িটা?

সীতারাম ঘড়িটা দেখিয়ে বলে, ঐ ঘড়িটা।

ওটা স্লো-ফাস্ট থাকে নাকি?

কখনও না। একেবারে ঠিক ঠিক টাইম দেয়। কখনও আগে-পিছে হতে গত দশ বছর দেখিনি।

আচ্ছা সীতারাম, আমি চলি।

কিন্তু আপনি কোথা থেকে আসছেন, কি নাম আপনার—বললেন না তো?

আমি আবার আসব। কথাটা বলে বের হয়ে এল কিরীটী।

সেখান থেকে বের হয়ে কিরীটী সোজা গেল নিরালায়।

শান্তনু গৃহেই ছিল।

শান্তনু!

বল?

তুমি সেদিন বলেছিলে না, তোমার মাসী গীতার পাশের ঘরেই শোন।

হ্যাঁ, কেন বল তো?

তাকে একটিবার ডাকবে? তার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।

শান্তনু তখনি গিয়ে সৌদামিনীকে ডেকে নিয়ে এল।

বসুন মাসীমা। কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করব।

কি বাবা?

রাত্রে আপনার ঘুম হয় কেমন?

ঘুম কি আর চোখে আছে—

সে-রাত্রে তো আবার বাতের ব্যথাটা আপনার বেড়েছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, সাড়ে বারোটা পৌনে একটার সময় কোনরকম শব্দ বা চেঁচামেচি শুনেছিলেন পাশের ঘরে?

চেঁচমেচি নয়, তবে—

বলুন—থামলেন কেন?

দেখ বাবা—সেদিন আমি দারোগাবাবুকে বলিনি, তবে আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। সে-রাত্রে গীতা যেন কার সঙ্গে কথা বলছিল—

আর কিছু শোনেননি?

না।

ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন।

মাসী চলে যাবার পর কিরীটী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে, ব্যাপারটা আমার কাছে। স্পষ্ট হয়েছে শান্তনু।

কি? কিছু জানতে পেরেছ?

হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি কে তোমার বোনকে হত্যা করেছে।

কে? শম্ভু?

না। ভাল কথা, শম্ভুকে পাওয়া গেছে, জান না?

না তো! কোথায়? কখন?

মেদিনীপুর এক গাঁয়ে তার আত্মীয়-বাড়িতে।

সে পালিয়েছিল কেন?

ভয়ে।

ভয়ে!

হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা তুমি কি জানতে, গীতা প্রতুলকে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছিল?

জানতাম।

And that is the cause—

কি বলছ তুমি?

তাই। প্রতুল সুভাষ ও কুনাল তিনজনই গীতাকে ভালবাসত—সবাই মনে মনে গীতাকে চাইছিল, কিন্তু গীতা যখন প্রতুলকে বেছে নিল জীবনে, ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠল। যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে ওই নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। প্রেম যেমন সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে, তেমনি প্রচণ্ডতম নিষ্ঠুর ও হিংস্রও হতে পারে। আর এক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই–

কিন্তু কে?

গীতার তিন বন্ধুরই মধ্যে একজন।

কে?

কাল বলব। তুমি ওদের তিনজনকে কাল সন্ধ্যায় ডেকে পাঠাও।

.

পরের দিন সন্ধ্যায়।

ঘরের মধ্যে সকলেই উপস্থিত। শান্তনু, কিরীটী, দত্তরায়, সুভাষ, কুনাল ও প্রতুল।

কিরীটী বলছিল, আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হবেন শুনলে, গীতাকে আপনাদের তিনজনের মধ্যে একজন খুন করেছেন।

প্রতুল বলে, কি আবোল-তাবোল বকছেন মশাই?

আবোল-তাবোল নয়, নিষ্ঠুর সত্য–

সুভাষ বলে, কিন্তু আমরা তো কেউ সে-রাত্রে ছিলামই না। একসঙ্গে তিনজন বের হয়ে যাই।

গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আবার সে-রাত্রে ফিরে আসা তো অসম্ভব কিছু ছিল না।

তার মানে? সুভাষ বলে।

তার মানে ভেবে দেখুন, কে এবং আপনাদের তিনজনের মধ্যে কার পক্ষে সে রাত্রে আবার ফিরে আসা সম্ভবপর ছিল!

কার?

কেন—আপনি সুভাষবাবু! আপনার গাড়ি ছিল, আপনি বন্ধুদের পৌঁছে দিয়ে এখানে সোজা আবার চলে আসতে অনায়াসেই পারতেন না। আর তাই হয়েছিল, আপনি সে-রাত্রে আবার ফিরে আসেন নিরালায়?

আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি!

মাথা যে আমার খারাপ হয়নি, আপনার চাইতে সে-কথা আর কেউ ভাল জানে সুভাষবাবু। আর আপনি যে ফিরে এসেছিলেন তার প্রমাণও আছে।

প্রমাণ! প্রশ্নটা প্রতুল করে এবার।

হ্যাঁ। এক নম্বর সে-রাত্রে গীতার ঘরে কথাবার্তা শুনেছিলেন মাসীমা, আপনারা তো কেউ সে-রাত্রে উপরে গীতার ঘরে আসেননি, নিচ থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। শান্তনুও বাড়ি ছিল না। তবে সে কে? দুই-নম্বর, সে-রাত্রে গীতা ওপরে আসবার পরও শম্ভুচরণ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেছিল। সে কার পায়ের শব্দ? তিন-নম্বর, আপনার বাড়ি ঘড়ির কাটা আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছিলেন, সময়ের ব্যবধানটা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। এর পরও অস্বীকার করত চান সে-রাত্রে আবার আপনি আসেননি?

হঠাৎ সুভাষ হো হো করে হেসে ওঠে—চমৎকার! যদি ধরুন আমিই–প্রমাণ কি তার?

হ্যাঁ, চার নম্বর, এই রুমালটা আপনার-কোণে আপনার নামের মনোগ্রাম করা আছে। দেখুন।

সুভাষ একেবারে বোবা। যেন পাথর।

এটা কোথায় পাওয়া গেছে জানেন? গীতার ঘরে। এটাই শম্ভুচরণ পাঠিয়েছে। আপনাকে–

শম্ভু!

হ্যাঁ, তাকে আপনি ভয় দেখিয়ে কলকাতা ছাড়া করবার চেষ্টা করেছিলেন, কারণ আপনার সন্দেহ হয়েছিল সে কিছু জানে। বেচারী ভয় পেয়ে পালিয়ে না গেলে হয়ত শেষ পর্যন্ত এই মোক্ষম প্রমাণটা তার কাছ থেকে পেতাম না—আপনি হয়ত তাকেও হত্যা করতেন। শুনুন সুভাষবাবু, সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যে প্রচণ্ড ঘৃণা ও আক্রোশ আপনার কথাবার্তায় প্রকাশ পেয়েছিল গীতা সম্পর্কে, সেটাই আমাকে সর্বপ্রথম অনুসরণের আলো দেখায়।

সুভাষ নির্বাক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত