আমি সানজিদা। বয়স আটত্রিশ বছর। বিবাহিতা, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ক্লাসমেট ও বন্ধুকে। পড়াশুনা শেষ করে আর দেরি করিনি আমি আর সজল। পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করে নিজেদের মতো করে জীবন সাজিয়ে নিয়েছি। প্রথমে শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবারে ছিলাম। ভাসুর, ননাশ, দেবর, ননদ সবাইকে নিয়ে বেশ হেসেখেলেই দিন কেটে যাচ্ছিল আমাদের। শ্বশুর মারা যাবার পর ভাসুরের ইচ্ছেতে আর অন্য সবার সম্মতিতে আমরা যে যার মতো আলাদা হয়ে যাই। শাশুড়ি মা রয়ে গেলেন একা।
অবশ্য উনার সাথে অনেক দিনের পুরোনো কাজের মানুষ ছিল। আমরা সবাই তাকে পরিবারেরই একজন ভাবতাম। তার উপর শাশুড়ি মায়ের অগাধ ভরসা আর বিশ্বাস ছিল। আমাদেরও তাই। আমাদের যৌথ পরিবারটা ভেঙ্গে গেলেও প্রতি শুক্রবার আর শনিবারে আমরা ভীড় জমাতাম শ্বশুরবাড়িতে। যে যেখানেই থাকি না কেন, সবাই চলে যেতাম ওই বাড়িতে। সপ্তাহের এই দুটো দিন শাশুড়ি মায়ের সান্নিধ্যে বেশ ভালোই কেটে যেত। হাসিখুশিতে ভরপুর আর উচ্ছ্বল ছিল সেই দিনগুলো। মনের মতো স্বামী আর শ্বশুরবাড়ি পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হতো আমার। সজলের ভাইবোনেরা কোনোদিনও আমাকে পর করে দেখেনি। কখনো আমাকে তাদের বাড়ির বউ মনে করেনি। শাশুড়ি মায়ের চোখে আমরা বউ-ঝিয়েরা সবাই সমান ছিলাম।
শাশুড়ি বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত আমাদের জীবনে সুখ ছিল, শান্তি ছিল। জীবনে কোনো অভাব থাকলেও আমরা সেটা টের পাইনি তখন। এখন পাচ্ছি; হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সময় গড়াচ্ছে, একই সাথে যৌথ পরিবারের বন্ধনটা শিথিল হতে শুরু করেছে। সবার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে তরতরিয়ে। তাদের নিয়ে তাদের বাবা-মায়েদের ব্যস্ততা আর উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছে। ব্যস্ততা নেই শুধু আমাদের, আমার আর সজলের। আমাদের ছোট্ট সংসারে কোনো কলকাকলী নেই, হৈ-হল্লা নেই। প্রায় নয় বছর হয়ে গেল আমাদের কোল আলো করে একটা ছোট্ট বাচ্চা আসেনি এখনো। পুরো বাসায় আমরা দুজন মানুষ।
সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় সজল। ফেরে সন্ধ্যের পর। আর আমি সারাটা দিন নিশাচরের মতো ঘুরে বেড়াই পুরো বাসায়। সাজানো, গোছানো সংসারটাকে নতুন করে সাজাই, গুছাই। কিছুতেই সময় কাটে না আমার। সজল বলেছিল জব করতে। করতাম হয়তো কিন্তু কপালে শিকে না ছিঁড়লে যা হয়, আমারো তাই। এই পর্যন্ত অনেকবার জব শুরু করেছি। অনেকবার ছেড়েছি। কখনো কনসিভ করার পর, আবার কখনো প্রেগন্যান্সির জটিলতার কারণে। চারবার কনসিভ করেছিলাম, মা হতে পারিনি। আমার খালি বুকটা কখনো ভরে উঠেনি। বুকের মধ্যে সবসময়ই চাপা হাহাকার চলে। সময় গড়াচ্ছে আর হাহাকার বাড়ছে। একটা বাচ্চার জন্য তড়পাচ্ছি আমি।
আর সজল? ওকে আমার কাছে একটা যান্ত্রিক মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। নিয়ম করে অফিসে যায়, কাজ করে, বাসায় ফেরে, নাস্তা খায়, টিভি দেখে, সাংসারিক কথাবার্তা বলে, তারপর ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ে। অথবা ঘুমের ভান করে। আমার কেন যেন মনে হয়, সজল ঘুমায় না রাতে। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে বিছানার একপাশে। কখনো কাছাকাছি আসে। ভালোবাসা হয় আমাদের মধ্যে। তারপর আবার সেই ঘুমের অভিনয়! সজলের মধ্যে কোনো অনুভুতি খুঁজে পাই না আমি।
ওর সবকিছুই মেকি বা লোক দেখানো লাগে আমার দৃষ্টিতে। ছুটির দিনে আমরা কোথাও ঘুরতে যাই। কোনো পার্টিতে অথবা কারো জন্মদিনে, এনিভারসারিতে কোনো বন্ধুর বাসায়। কখনোবা কোনো রিসোর্টে। মাঝে মাঝে লং ড্রাইভেও যাওয়া হয়। যেদিন লং ড্রাইভে যাই, সেদিন ফেরার সময় কোনো একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে নিই। ছবি তুলি, সেলফি তুলি আর ফেসবুকে আমাদের সুখী কাপল ফটো আপলোড করি। সবাই আমাদের দুজনকে দেখে হিংসে করে। সাধারণত প্রায় প্রতিটা দাম্পত্য সম্পর্কেই এক পর্যায়ে একঘেয়েমি চলে আসে কিন্তু আমাদের সম্পর্কে কোনো একঘেয়েমি নেই। বাচ্চা মিসক্যারেজ হবার ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে কখনোই ইস্যু হয়ে উঠেনি।
দ্বিতীয়বার মিসক্যারেজ হবার পর আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সজলকে হারানোর ভয় আমার মনে গেড়ে বসেছিল। সেই সময়টায় কেবলই মনে হতো, সজল আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হয়তো অফিসে বা রাস্তাঘাটে কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। প্রচন্ড ইনসিকিউরিটিতে ভুগতাম তখন। ওকে কোনো মেয়ের সাথে একটু হেসে কথা বলতে দেখলেই আমি খুব ঝগড়া করতাম ওর সাথে। উনিশ থেকে বিশ হলেই তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলতাম। প্রতিবারেই আমার ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে সজল আমাকে আগলে রেখেছে। আমার রাগারাগি, চেঁচামেচিটাকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছে। কানের কাছে ফিস ফিস করে বলেছে, “ভালোবাসি তোমাকে।”
সত্যিই কি আমাকে ভালোবাসে সজল? কেন যেন বিশ্বাস করতে পারি না। সবই ঠিকঠাক চলছে আমাদের। তবু কোথায় যেন সুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা ঠিকঠাক চলছে কিন্তু কোনো উষ্ণতা নেই। ভালোবাসা আছে কিন্তু তাতে কোনো জোয়ার নেই। প্রেম আছে কিন্তু উচ্ছ্বলতা নেই। হ্যাঁ, সজল আমাকে ভালোবাসে। এক বাক্যেই বলতে পারি সেই কথা। ভালো না বাসলে নয়টা বছর ধরে আমাকে আগলে রাখত না বুকের মধ্যে কিন্তু মনের মধ্যে সারাক্ষণই একটা প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায় আমাকে।
সজলের ভালোবাসা কি আদৌ সত্যি নাকি লোক দেখানো? মন থেকে আমাকে কতটুকু ভালোবাসে সজল? এই প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই পাইনি। বিয়ের পর প্রথম দিনগুলোতে সন্দেহ আর অবিশ্বাস ছিল না আমার মনে। আমরা দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবেসেছি। ভালোবাসার জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছি। দুজন মিলে আমাদের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছি। বাচ্চার জন্য স্বপ্ন বুনেছি। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল কিন্তু বিয়ের মাস ছয়েক পর যেদিন সজলের কাগজপত্রের মধ্যে ইরার সাথে একটা যুগল ছবি পেলাম, সেদিন থমকে গিয়েছিলাম আমি, থমকে গিয়েছিল আমার পুরো দুনিয়া।
ইরা, আমার প্রাণের বান্ধবী, আমার সখী। সজল, ইরা, আমি… আমরা একই ব্যাচে, একই ক্লাসে পড়তাম। ইউনিভার্সিটিতে পা দেবার প্রথম দিনেই আমাদের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছিল। বছরখানেক পর আমি টের পেলাম, আমি সজলকে ভালোবাসি। মনপ্রাণে, সমস্ত সত্ত্বা আর অনুভুতি দিয়ে আমি ওকে ভালোবাসি। টের পাবার সাথে সাথেই মনস্থির করলাম, ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানাব। তার আগে কিছু কাজ বাকি ছিল আমার। কারো কাছে কনফেস করার দরকার ছিল। কলেজে পড়াকালীন সময়ে রানার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, তারপর সম্পর্ক। সিলেটে ওসমানী মেডিকেলের ছাত্র ছিল সে। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পা রাখলাম, তখন সে পড়াশুনা শেষ করে ওখানেই জয়েন করেছে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে। সে থাকত সিলেটে আর আমি থাকতাম ঢাকায়। ভৌগোলিক দুরত্ব ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে মানসিক দুরত্বও তৈরী করে ফেলেছিল।
তাই সজলের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করার সাথে সাথেই রানাকে সবকিছু জানিয়ে ওই সম্পর্ক থেকে সরে আসাটা গুরুদায়িত্ব মনে করেছিলাম। রানাও মেনে নিল। হয়তো আমাকে, আমার মনের ভেতরকার অসহায়ত্বটা বুঝতে পেরেছিল সে। তাই কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই ব্রেকাপ হয়ে গেল আমাদের। তারপরই আমি ছুটে গেলাম সজলের কাছে। গিয়ে দেখি, ইরার খোঁপায় লাল গোলাপ গুঁজে দিচ্ছে সে। গোলাপটা গুঁজেই পেছন থেকে ইরাকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “ভালোবাসি ইরা, অনেক ভালোবাসি তোমাকে।” দূর থেকে সেই কথা শুনতে পাবার কথা নয় আমার। ইরার মুখে বিশ্বজয়ী হাসিটা দেখেই বুঝে নিলাম কথাগুলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ইরা ঘাড় ফেরাতেই তার লাজুক গোলাপী ঠোঁটজোড়া বিলীন হয়ে গেল সজলের পুরুষালী ঠোঁটের মাঝে।
জমে গিয়েছিলাম সেদিন। পাথরের মুর্তির মতো নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিলাম আমার সজলের বাহুডোরে ইরাকে দেখে। তিনজনই হলে থাকার সুবাদে দিনের বেশিরভাগ সময় একসাথে কাটত আমাদের। ইরা আর আমি রুমমেট ছিলাম। আর সজল শুধুমাত্র রাতটুকুর জন্য হলে ফিরত। এর মধ্যেই কখন যে আমার অগোচরে ওদের প্রেম জমে উঠেছে, আমি টেরই পাইনি! তারপর থেকে তিনটা বছর আমি নরকের আগুনে জ্বলেপুড়ে মরেছি। মনের মধ্যে দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে সর্বক্ষণ জ্বলে পুড়তে থাকা আমি হাসিমুখে সজল-ইরার প্রেম উপভোগ করতাম। ওদের গোপন অভিসারের লাজুক বর্ণনা শুনতাম ইরার মুখ থেকে। সেই সময়টায় খুব ইচ্ছে করতো ইরাকে সজলের বুক থেকে সরিয়ে আমি মাথা রাখি ওখানটায়। আকুল দৃষ্টিতে আমার ভালোবাসার কথা জানাই। কয়েকবার যে চেষ্টা করিনি, তা নয় কিন্তু কোনোবারেই বলতে পারিনি। আর সজলও ইরাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, আমার চোখের ভাষা পড়ার সময় হয়নি তার।
তারপর একদিন পেয়ে গেলাম সুযোগটা। আমরা তখন ফোর্থ ইয়ারে পড়তাম। ফাইনাল এক্সামের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সজল আর ইরা তাদের প্রেমের জাল গুটিয়ে এনেছে ততদিনে। জীবন নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে দুজনই বেশ সিরিয়াস। এর মধ্যেই সজল একটা পার্ট টাইম চাকুরি জুটিয়ে ফেলেছে। ক্লাস শেষ করেই সে চাকুরিতে ছোটে। আর ইরা টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন সময়ে ইরার সাথে পরিচয় হলো আজাদের। ইরার বড় বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে ওকে দেখে পারিবারিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আজাদ। বিশাল ব্যবসায়ী সে। ঢাকার গুলশানে বিশাল প্রাসাদ তার। দেখতেও সুদর্শন আর হ্যান্ডসাম। বিলেত থেকে পড়াশুনা করে এসেছে। সজল কোনোদিক থেকেই আজাদের সমকক্ষ নয়। তবুও ইরা তার অবস্থান থেকে নড়ল না। সে আজাদকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, সে সজলকে ভালোবাসে। বিয়ে করলে সজলকেই করবে।
আজাদের চোখে আমি ইরার প্রতি অসীম ভালোলাগা দেখেছিলাম। সেই সুযোগটা নিয়েই সজলের মনে বিষ ঢোকাতে শুরু করলাম। একদিকে আজাদের সাথে গোপনে দেখা করে পরামর্শ দিলাম বিভিন্ন বাহানায় ইরাকে নিজের দিকে টানার, অন্যদিকে সজলকে ইরা আর আজাদের সমস্ত খুঁটিনাটি আপডেট দিতাম। ইরার ফ্যামিলি আজাদকে খুব পছন্দ করেছিল। আজাদের মতো পাত্রকে রিজেক্ট করে ফ্যামিলির কাছে সজলের কথা বলার মতো সাহস ওর ছিল না। সে শুধু সময় চেয়েছিল কিছুটা। অনার্স এক্সামের রেজাল্ট বেরোবার পর তার সিদ্ধান্ত জানাবে এমনটাই বলেছিল। ওই সময়টুকুই ছিল আমার শেষ ভরসা।
ফাইনালি আমি সফল হয়েছিলাম ইরার প্রতি সজলকে বিষিয়ে দিতে। তারই জের ধরে একদিন ইরাকে পাঠিয়ে দিলাম আজাদের সাথে কিছুটা সময় ঘুরতে। পুর্বপরিকল্পনা অনুসারে আজাদ ইরাকে হোটেল সোনারগাঁয়ে নিয়ে গেল। আর সজলকে জানিয়ে দিলাম ইরার অবস্থান। আমার কথা সহজে বিশ্বাস করতে চায়নি সজল। হাতেনাতে প্রমাণ দেখাতে আমি ওকে নিয়ে গেলাম সেখানে। সজল নিজের চোখে দেখল তার প্রিয়তমা অন্যকারো বাহুডোরে বন্দী। স্বজ্ঞানে ছিল না ইরা। লাঞ্চের সময় কায়দা করে আজাদ ওর গ্লাসে অ্যালকোহল মিশিয়ে দিয়েছিল। সজলের চোখদুটো জ্বলে উঠেছিল সেদিন। পাবলিক প্লেসে সবার সামনেই ইরার চুলের মুঠি ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সে। সবার সামনেই ইরাকে চড়-থাপ্পড় মেরেছিল।
ওদের সম্পর্কে সেদিনই চিড় ধরেছিল আজীবনের জন্য। তিনদিন ইরা হলের রুমে প্রায় বেহুঁশ ছিল অ্যালকোহলের প্রভাবে। ওর মাথা কাজ করছিল না ঠিকমতো। তারপর যখন ধাতস্থ হলো, তখন সজলের সাথে দেখা করে জানাল সে প্রেগন্যান্ট। সজলের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে সে। সেদিন ওকে চুড়ান্ত অপমান করেছিল সজল। যা নয়, তাই মুখে চলে এসেছিল ওর। এত বাজে গালাগালি আমি আর কোনোদিনও শুনিনি সজলের মুখে। সেদিনই প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম, আর সেদিনই শেষ।
অপমানিত হবার পর ইরা চলে গিয়েছিল চুপচাপ। এক্সামের আগে যে কয়টা দিন সে ক্যাম্পাসে ছিল, সজল ওকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ইরাও তেমন চেষ্টা করেনি। ক্লাসের সময়টা বাদ দিয়ে বাকিটা সময় সে হলেই থাকত। মনমরা হয়ে সারাদিন শুয়ে বসে থাকত বিছানায়। এমনিতেও শরীর ভালো ছিল না ওর। কিচ্ছু খেতে পারত না। যা খেত, তাই বমি করে ফেলত। ওই সময়টায় আমাকে পাশে চেয়েছিল ইরা। ওর হয়ে সজলকে বুঝাতে অনুরোধ করেছিল। আমি ওর সেই অনুরোধ রাখিনি। উল্টো ওর সাথে প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করেছি। এক্সামের পর হল ছাড়ল ইরা। তারপর আর দেখা হয়নি ওর সাথে। এতগুলো বছর ধরে কখনো আমার বা সজলের সামনে আসেনি সে।
সেই ঘটনার পর মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছিল সজল। সারাক্ষণ বাচ্চাদের মতো কাঁদত। আমি ওকে আগলে রাখতাম। ওকে সান্ত্বনা দিতাম। আমিই ওকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হেল্প করেছিলাম। মাস্টার্স শেষ হতে দুই বছর লেগে গেল আমাদের। ততদিনে আমি ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি। প্রথমদিকে সজল তেমন সাড়া না দিলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আমার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে সে। তারপর বিয়ে করে ফেললাম আমরা। বিয়ের রাতেই সজল বলল, ওর একটা বাচ্চা চাই। একটা মেয়ের বাবা হবার খুব শখ ছিল ওর। সজলকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার আনন্দে আমি বিভোর ছিলাম তখন। তাই আপত্তি করিনি ওর আবদারে। বিয়ের তিন মাসের মাথায় আমি পিরিয়ড মিস করলাম।
প্রথমবারের মতো কনসিভ করলাম যেদিন, সজল পাগল হয়ে গিয়েছিল একদম। বাবা হবার খবরটা শুনে তার সে কী উচ্ছ্বাস! পরদিন থেকে সে পাগলামি শুরু করে দিল। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় তার অনাগত মেয়ের জন্য কিছু না কিছু কিনে আনত। তিন মাসের মধ্যেই বাচ্চাদের জিনিসপত্রে আমাদের রুম ভরে গেল। তারপর একদিন হুট করেই সজলের জিনিষপত্রের মধ্যে পেয়ে গেলাম ইরার সাথে যুগল ছবি। সত্যি বলতে কি, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল সেদিন ছবিটা দেখে। সজল আমাকে বলেছিল, বিয়ের আগেই সে ইরার সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করে ফেলেছে। অথচ বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে যাবার পরেও ওর কাগজপত্রের আড়ালে ইরার ছবি! তাও আবার যুগল!
সেদিন বিকেলে সজল বাসায় ফিরতেই ওকে ছবিটা দেখালাম। ছবিটা ওর কাগজপত্রের ভেতর কীভাবে এলো সেটার কারণ জানতে চাইলাম। মুহূর্তের মধ্যেই ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ধরা পড়ে যাবার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইল সে। আমি যতই গলা চড়াই না কেন, টু শব্দ করল না। শুধু নিচু গলায় একবার বললো, “স্যরি।” রাগে, ক্রোধে ছবিটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করলাম আমি। পুরো বাসা কাঁপিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলাম। চিৎকার শুনে আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা দৌড়ে এলো। রুমের দরজা বন্ধ থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারল না তারা। দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে সজল তাদের নিরস্ত করল। আমাকে আরো একবার নিচু গলায় “স্যরি” বললো।
রাগারাগি করে শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তাই কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে গিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছি আমি। রক্ত দেখেই চিৎকার দিল সজল। তারপর আমাকে নিয়ে হুড়মুড় করে হাসপাতালে ছুটল সে। ইমারজেন্সিতে ডাক্তার ওকে জানালেন আমাদের বাচ্চাটা আর নেই। খবরটা শুনে ওর কী যে কান্না!! কান্না দেখে মনে হচ্ছিল ওর জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকেই থমকে গেল সে। থেমে গেল ওর উচ্ছ্বাস। আমার প্রতি কেয়ারনেস আর ভালোবাসা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেলেও ওর যান্ত্রিক জীবনের শুরুটা তখন থেকেই। বাচ্চার জন্য যা কিছু কিনে এনেছিল, এক এক করে সেগুলো সব একটা লাগেজে ভরে রাখল। লাগেজটা আমাদের আলমারির উপর রেখে দিল।
বাচ্চা হারাবার শোকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ইরার ছবির কথা। সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় আমি আবিস্কার করলাম ওর অফিসের ব্যাগে ইরার কাঁকড়া ক্লিপ। ক্লিপটা আমি বেশ ভালোভাবেই চিনতাম। একদিন দুষ্টুমি করে ইরার চুল থেকে ক্লিপটা খুলে নিয়েছিল সজল। আর ফিরিয়ে দেয়নি। দ্বিতীয়বারের মতো থমকে গিয়েছিলাম সেদিন। তবে চিৎকার চেঁচামেচি করিনি সজলের সাথে। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে সজলকে ক্লিপটা দেখালাম। সজল কোনো কথা বললো না। আমার হাত থেকে ক্লিপটা নিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে ভাঙ্গল সেটা। তারপর ভাঙ্গা টুকরোগুলো ঝাড়ু দিয়ে ময়লার বিনে ফেলে দিল। এ নিয়ে আর দ্বিতীয়বার কথা বাড়াইনি আমি, সজলও না। তারপর থেকেই এটা সেটা আবিস্কার করতাম আমি। কখনো সজলের মোবাইলে ইরার ছবি, কখনো ল্যাপটপের কোথাও পড়ে থাকা ইরার গানের অডিও রেকর্ডিং। নাহ, আমি আর চিৎকার চেঁচামেচি করিনি ওর সাথে। যৌথ পরিবারে চিৎকার চেঁচামেচি করাটা এমনিতেও শোভা পায় না। তবে এক এক করে আবিস্কার করেছি ইরার কোনো স্মৃতিই সজল ফেলে দেয়নি বা নষ্ট করেনি। বরং খুঁটিনাটি প্রতিটা স্মৃতি যত্ন করে রেখে দিয়েছে এখানে সেখানে।
সেগুলো পাওয়া মাত্রই আমি ফেলে দিয়েছি, নষ্ট করেছি। কখনো সজলকে জানিয়ে, আবার কখনো সজলের অজান্তেই। সজল কখনো এই নিয়ে টু শব্দ করেনি আমার সাথে। আমিও ভেবেছিলাম, এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে বরং সজলকে ইরার স্মৃতি ভুলতে সাহায্য করা উচিত। আমি ওকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করলাম। বিনিময়ে আরো বেশি ভালোবাসা পেলাম। ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে ভাসতেই দ্বিতীয়বারের মতো কনসিভ করলাম আমি। সজলকে খবরটা জানাতেই সে খুশি হলো খুব। নিজেই আগ বাড়িয়ে সবাইকে জানাল খবরটা। গাড়ি ড্রাইভ করে মিষ্টির দোকানে নিয়ে একগাদা মিষ্টি কিনে আনল। প্রচন্ড খুশি ছিল সে কিন্তু আগেরবারের মতো সেই উচ্ছ্বাসটা ছিল না ওর মধ্যে।
তখনই প্রথমবারের মতো আমি ওর যান্ত্রিক আচরণ টের পাই। আতঙ্কের সাথে অনুভব করি ওর মুখের হাসিটা, চোখের ঝিলিক সবকিছুই আসলে লোক দেখানো!! আমি মনকে প্রবোধ দিই। হয়তো বা আমার দেখার ভুল, মনের ভুল, বুঝার ভুল। হয়তো আমিই সজলের আচরণটাকে নেগেটিভলি দেখছি। কিন্তু না। আমার আশঙ্কাটা মিথ্যে ছিল না। সময়ের সাথে সাথে আমার একেকটা মিসক্যারেজ ওকে আরো বেশি যান্ত্রিক করে তুলল। আমি ভেবেছিলাম, সজলের জীবন থেকে ইরাকে মুছে ফেলেছি চিরতরে।
আমি ভুল ছিলাম। যতই দিন পেরোচ্ছে, আমি অনুভব করতে পারছি আমি কতটা ভুল ছিলাম। আমি কখনোই ইরাকে সজলের মন থেকে, সজলের জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। যতবারই বাবা হয়েছে সে, ততবারই বলেছে তার মেয়ে হবে এবং মেয়ের নাম রাখবে “সই”। এই নামটার বিশেষত্ব আমার জানা ছিল না। সেটা ছিল সজল আর ইরার মধ্যকার গোপন চ্যাপ্টার। আর এই গোপন চ্যাপ্টার একদিন চলে এলো আমার সামনে। পুরোনো কাগজপত্রের ক্যাবিনেট গুছাতে গিয়ে এক কোণায় লুকানো একটা ডায়েরি পেয়ে গেলাম। ডায়েরিটা ছিল ইরার দেয়া। সজল তাতে তার নিজের জীবনের কিছু কথা লিখে রেখেছিল কোনো এক সময়। সেই লেখাগুলোর মধ্যেই জানা গেল, সই হচ্ছে সজলের স আর ইরার ই মিলিয়ে রাখা একটা নাম। ওরা দুজন যখন তাদের প্রেমের নৌকায় চড়ে বেড়াত, তখনই কোনো এক মুহূর্তে দুজন মিলে এই নামটা ঠিক করেছিল।
শুধু তাইই নয়, জ্বরের ঘোরে সজলের ইরা…ইরা… ইরা… বলে প্রলাপ বকাটাও আমাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমি কোনোভাবেই ইরাকে মুছে ফেলতে পারিনি সজলের মন থেকে, ওর জীবন থেকে। তবু আমি হার মানিনি, হার মানতে চাইনি। মনকে বারবার প্রবোধ দিয়েছি, সজল আমার… শুধুমাত্র আমার কিন্তু আজ বিকেলে ইরা আর ওর মেয়েকে দেখে বুঝলাম কতটা ভুল ছিলাম আমি, কতটা বোকা ছিলাম। এতগুলো বছর ধরে আমার মনের মধ্যে একটা চাপা অহংকার ছিল। আমি সজলকে ইরার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। সারাজীবনের জন্য ওদের দুজনকে আলাদা করতে পেরেছি। আজ জানলাম, আমি কখনোই সজলকে ইরার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারিনি।
সজল কোনোদিনই ইরার কাছ থেকে আলাদা হয়নি। সজলের একটা সত্ত্বা ইরা নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। জন্ম দিয়েছে সজলের মেয়েকে। সজলের বহু আকাঙ্ক্ষিত “সই”য়ের মা সে। অথচ এই বাচ্চার মা, সজলের মেয়ের মা হবার কথা ছিল আমার। চার চারটে বার কনসিভ করেছিলাম। একটা বারও সজলের মেয়ের মা হতে পারিনি। কী করে পারব? সজলের মেয়ে তো সেই কবেই ইরার গর্ভে জম্ম নিয়েছে। সজলকে হারিয়েও সারাজীবনের জন্য পেয়ে গিয়েছে ইরা। আর আমি, আমি সজলকে পেয়েও পাইনি। আমার পাশে শুয়ে ঘুমের ঘোরে বা জ্বরের প্রকোপে সজল ইরা ইরা বলে চিৎকার করে। সজলের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মধ্যে ইরার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। সবকিছু একে একে সরিয়েছি আমি। ধৈর্য ধরে এক এক করে ইরার স্মৃতিচিহ্ন এই পৃথিবী থেকে বিলীন করেছি। অথচ সবথেকে বড় আর মুল্যবান স্মৃতিটাই ইরা সযত্মে নিজের কাছে রেখেছে!
আজ এতগুলো বছর পর আমি উপলব্ধি করতে পারছি, আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি। যে পাপ আমি কোনোদিন করিনি, সেই পাপের শাস্তিই পেতে হয়েছে আমাকে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, আমিই কুটচাল করে, আজাদের হেল্প নিয়ে ইরা আর সজলের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করেছিলাম কিন্তু তাতে তো কোনো পাপবোধ বা অন্যায় ছিল না। আমি আমার ভালোবাসাকে নিজের থেকে পেতে যা কিছু করার, তাই করেছি। আমি বিশ্বাস করি, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। তাহলে আমি কেন পাপ না করেও সেই পাপের শাস্তি পাচ্ছি? কেন?”
এই পর্যন্ত লিখে থামল সানজিদা। ডায়েরিটা বন্ধ করে বালিশের তলায় রাখল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত আড়াইটার মতো বাজে। এত রাতেও সজল নেই বেডরুমে। ডিনারের পর আর রুমে আসেনি সে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। যদিও সানজিদা সবকিছু জেনেও না জানার ভান করেছে। বিকেল থেকে এই পর্যন্ত সে অপেক্ষায় ছিল সজল তাকে ইরার সাথে দেখা হবার খবরটা দেবে। সইয়ের কথা বলবে ওকে কিন্তু সজল টু শব্দ করেনি। বরাবরের মতোই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। যেন কিছুই হয়নি ডাক্তারের চেম্বারে। ইরা আর সইয়ের সাথে দেখা হবার ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়েছে সে। এবারে সানজিদার মনে হচ্ছে ওকেই এই প্রসঙ্গ তুলতে হবে। ইরার সাথে ওর দেখা হবার এবং কথাবার্তার ব্যাপারটা সবকিছু খুলে বলতে হবে। এগার বছর আগের কোনো এক কুটচালের কথা বলতে হবে। কনফেস করতে হবে সজলের সামনে কিন্তু ডিনারের পর থেকেই লাপাত্তা হয়ে আছে সজল। কোথায় গেল সে?
রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে দাঁড়াল সানজিদা। গলা চড়িয়ে বেশ কয়েকবার ডাকল সজলকে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ধীর পায়ে পুরো বাসাটা চক্কর দিল সে। অবশেষে সজলকে পাওয়া গেল গেস্ট রুমের বারান্দায়। বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে সে। মাথাটা একপাশে হেলানো। চোখজোড়া বন্ধ। হয়তো এই নির্জনে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করছিল। তারপর হুট করে ঘুমিয়ে গিয়েছে। ওকে ডাকতে যেতেই ফ্লোরে পড়ে থাকা চকচকে কিছু নজরে পড়ল সানজিদার। চাঁদের আলোয় চারপাশটা আলোকিত হয়ে আছে।
সেই আলোয় দেখল ফ্লোরে পড়ে আছে চকচকে নতুন একটা ব্লেড। তারপরই লক্ষ করল বারান্দার ফ্লোরের অনেকখানি লাল রক্তে সয়লাব হয়ে আছে। ঝট করে সজলের মুখের দিকে তাকাল সানজিদা। আবছা আলোয় একবার তাকিয়েই বুঝতে পারল, তার সজল তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে আজীবনের জন্য। তাকে এই পৃথিবীতে একা ফেলে ওপারে পাড়ি দিয়েছে। কোনো এক আত্মদহনের তাড়নায় নতুন চকচকে ব্লেড দিয়ে সে তার হাতের রগ কেটে ফালা ফালা করেছে। তার বন্ধ চোখের কোণে চিক চিক করছে এক ফোঁটা অশ্রু।