রাত তিনটা ছুঁইছুঁই। এম্বুল্যান্সে করে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে প্রাণপনে ছুটছেন রায়হান মোহাম্মদ। রাতের শেষদিক হওয়াতে পুরো রাস্তাই ফাঁকা। মাঝে মাঝে রাস্তার ঠিক মাঝ’খানে দু’চারটা কুকুরের দেখা মিলে। যদিও এম্বুল্যান্সের তীব্র হর্নে কুকুর গুলো নিজের প্রান বাঁচাতে এম্বুলেন্সকে জায়গা দিয়ে কিনারায় সরে যাচ্ছে।’
স্ত্রীর পাশে মা বোন থাকাতে, এম্বুল্যান্সের সামনে জায়গা হয়েছে রায়হানের। সামনে বসলেও পুরো মন, চোখ সব পিছনেই বারবার ছুটে যাচ্ছে। মা কয়েকবার চিন্তুা মুক্ত থাকতে আশ্বাস দিলেও মাথা থেকে চিন্তা সরাতে পারছে না রায়হান। পুরো শহরের মানুষের মাথার চিন্তা আজ যেনো রায়হানের মাথায় ভর করে আছে।’
মা’কে উদ্দেশ্য করে সামিয়া হঠাৎ বললো, আপনার ছেলেকে একটু আমার পাশে বসতে বলবেন।’ স্ত্রীর আবদার মেটানোর জন্য এম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে চোখের পলক পড়ার আগেই সামিয়ার কাছে বসলো রায়হান। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে এম্বুলেন্স। আমার হাতটা একটু শক্ত করে ধরবা’ সামিয়ার কথাটুকু শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মায়ের মুখের দিকের তাকালো রায়হান। চিন্তিত মুখে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি দিয়ে সায় দিলো মা। সায় পেয়ে সাথে সাথেই স্ত্রীর হাতদুটো শক্ত করে ধরলো রায়হান। সামিয়ার মুখে কিছুটা হাসি ফুটেছে। সামিয়ার মুখের কোনে লুকানো হাসি দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো রায়হান।
“আমার যেদি কিছু হয়ে যায়, যদি আমি ওপারে চলে যাই, চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাই তাহলে কি আমাকে মনে রাখবে? সামিয়ার মুখে কথটা শুনে এক দমকা কাঁপন দিয়ে গেলো রায়হানের বুকটা। মুহুর্তেই এক অজানা ভয় মাথায় সাড়া দিলো। সামিয়াকে কি সত্যি হারিয়ে ফেলবো, আমাকে রেখে কি ও দূরে যেতে পারবে। কথাগুলো নিয়ে ভাবনার শহরে ডুব দিয়ে আবার বাস্তবে ফিরে এসে, এসব কি ভাবছি আল্লাহ যা লিখে রাখছে তাই হবে বলে নিজেই নিজেকে শাসাচ্ছে রায়হান।
“তোমার কিচ্ছু হবেনা, কিচ্ছু হতেই দিবো না। সামিয়ার হাত দু’টি খুব শক্ত ধরে রায়হান কথাগুলো বললো। সামিয়া কিছুটা আশ্বাস পেলো, আশ্বাস পেলো বেঁচে থাকার। মা বোন, দুজনের সামনে দ্বিধা থাকা সত্বেও সামিয়ার কপালে এক আদর মাখা চুমো দিয়ে সবসময়ই পাশে আছি বলে আশ্বাস দিলো রায়হান।’
ত্রিশ মিনিট আগে অপারেশন থিয়েটারে সামিয়া কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চিন্তিত শরীর মন নিয়ে পায়চারি করছে রায়হান। অনেকক্ষণ আগেই বউয়ের নামে মানত করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে গেছে মা। আর, এক কোনে বোন বসে আছে। কোন মতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না রায়হান। অপারেশনের আগে ডাক্তার একটা কথাই বলে গেছেন, রোগীর অবস্থা খুবই সিরিয়াস আল্লাহ কে ডাকুন। যার কারনে চিন্তা আরো ভয়ানক রুপ ধারন করেছে রায়হানের নরম মনে।’
পুরোনো কিছু স্মৃতি রায়হানকে হাত বাড়াচ্ছে। কত খুনসুটি কত ভালোবাসা জন্মানো রয়েছে দু’জনের মধ্যে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও সময়ের পরিবর্তনে দু’জন দু’জনের মন বুঝে নিয়েছে। মুখ থেকে কথা ফুটার আগেই বুঝে নিতো পারতো কথা। একদিন মাঝরাতে হঠাৎ সামিয়ার বায়না জাগে আকাশ দেখার। সামিয়ার আবদার রাখতে ওকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাড়ায়। চাঁদের পাশে তিনটা তাঁরা দেখিয়ে তখন সামিয়া বললো, একটা তাঁরা আমি, একটা তুমি আর একটা আমাদের নতুন সদস্য। রায়হান তখন সামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো হ্যা’রে পাগলী, তুই আমি আর আমাদের নতুন সদস্য। স্মৃতি গুলো চেখের পানি ভাসিয়ে দিয়ে গেলো রায়হানের। শার্টের এক কোন টেনে চোখ মুছে ফোনের গ্যালারিতে থাকা সামিয়ার ছবি গুলো মনযোগে দেখতে লাগলো।’
রায়হানের একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান পৃথিবীর বুকে জন্ম দিয়েছে সামিয়া। কিন্তু, একজন পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পৃথিবী স্বার্থপরের মতো আরেকজন কে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিলো। সামিয়া বাঁচতে পারেনি। আল্লাহ হয়তো নিজের হাতেই সামিয়ার করুন ভাগ্যটা লিখেছেন। নিজের মেয়ের নিষ্পাপ মুখটা ভালো করে দেখে যেতে পারলো না। রায়হানের মা এক কোনে নাতনি কে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় পাগলের রুপ ধারন করে পাগলের মতো বিলাপ করে যাচ্ছে রায়হান। এই বিলাপ মায়ার, এই বিলাপ জন্মান্তরের ভালোবাসার।”