গা-বর্ণ

গা-বর্ণ

আমি আর আমার বৌ তিন বছর ইতালির রোমে ছিলাম। আমার ব্যবসা ছিলো সেখানে। আর ইরা সেখানে চাকরী করতো। আমি দেখতে একদম কালো। আর ইরা দেখতে পাক্কা পরী, পরীর মতো নয়। সেখানে যখন আমরা হাতে হাত রেখে হাঁটতাম। কেউ বলতো না, “ ওয়াও, সো সুইট কাপল। ” সেখানে তা মিষ্টিজাতীয় কিছুই নয়। একদম স্বাভাবিক। পানির মতো।

ইরা চেয়েছিলো বাংলাদেশে এসেই বিয়েটা করতে। আমাদের সম্পর্ক আট বছরের। কিন্তু আমার তাগিদে সেখানেই বিয়ে করে ফেলেছিলাম। দেশে এসে বিয়ে করার কারণটা ছিলো ইরার৷ বাচ্চাকাচ্চার জন্য সারাদিন একজনকে থাকতেই হয় বাসায়৷ আর সেখানে দুজনে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বাকি আর কেউই থাকলো না। আমি তাঁর কথা রেখেই বলেছিলাম। বাচ্চাটা আমরা দেশে গিয়েই নেবো। সেখানে প্রেমিকা বা বৌ বিহীন থাকা খুব কষ্টের! দিনশেষে আমি ইরার সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে চেয়েছিলাম সুতরাং বিয়ে ছাড়া কোনো গতি নেই।

আমি বরাবরই ফুটবলের একজন গভীর ভক্ত আর তাঁর দুনিয়া আঁকা-আঁকিতেই সীমাবদ্ধ। তিনটে বছর, ছত্রিশ মাস আর কতো কতো দিনের স্মৃতি। আলাদাভাবে টাকা পয়সার কথা বলা যাক। ইরার যে টাকা বেতন পেতো। তা আমার সাতাশ জন সহকর্মীর মধ্যে সবচেয়ে কম যে বেতন পেতো। তারচেয়েও কম। যদি টাকা পয়সা দিয়ে হিসেব করি এখন। ইরার গোষ্ঠী মিলে যে সম্পদ হবে। তা আমার চার ভাগের এক ভাগেরও সমান হবে না। হঠাৎ তাঁর সেখানে মনে হলো ভালো লাগছে না। দিনশেষে একটা মানুষের অভাব। একটা বাবু থাকলে মন্দ হয় না।

সে কারণেই দেশে আসা৷ এখানে তাঁর পরিবার আছে৷ আমার আছে। তাই এই ব্যাপারে কোনো চিন্তা নেই৷ সমস্যা হলো, দেশে আসার পরে অনেককেই বলতে দেখেছি, দেখ কালো ভাম কতো সুন্দর বৌ পেয়েছে। সবই টাকার খেলা! মুখের উপর কতোজন বলে দিয়েছে। কানাঘুষা যারা করেছে দেখছি, বেশিরভাগই আত্মীয়স্বজন! ইরাকে নিয়ে বাইরে বের হলে কিছু মানুষ মৃদু হেসে বলে, “ এতো সুন্দর একটা মেয়ে। এতো কালো ছেলেকে বিয়ে করলো? ” পাশ থেকে আরেকজন বলে দেয়, “ ছেলে টাকাওয়ালা ভাই। টাকা থাকলে মেয়েরা গায়ের রঙ দেখে না। ”

এসব যে ইরার কানে আসে না তা না। সে আমার দিকে তাকায়। মুচকি হাসে। সেই কতো বছর পুরনো একটা শার্ট আমার। গায়ে দিয়ে বসে থাকে। মন খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখলেও। আমি তাঁদের উত্তরে কিছু বলি না। মাথা নাড়াই। চুপ থাকি। কারণ তাঁরা জানে না। মেয়েটা তখন আমার হাত ধরেছিলো। যখন একটা সিগারেট কিনে টানার পয়সাও আমার কাছে ছিলো না। সে তখনই আমায় বকতো। যখন রাতে এক প্লেট ভাতের জন্য কোনো বন্ধুর মেসে গিয়ে রোজ বেহায়ার মতো উপস্থিত হতাম। সে তখনই আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলতো, এভাবে জীবন চলে না। একটা কিছু করা দরকার।

যখন এক শার্টে আমার ছমাস পার হতো। মেয়েটা তখনই টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট, দুটো একশো টাকার নোট। এক জোড়া জুতো আমার জন্য আনতো। যখন ঢাকা শহরে আমার ঘুমানোর জায়গা ছিলো না। মেয়েটা তখনই অসহায় হয়ে কাঁদতো। যখন আমি অসহায় ছিলাম। মেয়েটার রাতের ঘুম তখনই হতো না। যখন দশ টাকার কার্ড ভরে মোবাইলে তাঁকে একটা ফোন দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিলো না। মেয়েটা যখন প্রথম আমাকে ভালোবাসি বলে। তখন ঢাকা শহরের ধুলোবালিরও আমার চেয়ে বেশি মূল্য ছিলো।

সে যখন প্রথম জড়িয়ে ধরে কাঁদে, তখন আমি আত্মহত্যার যাত্রী ছিলাম। তারপরে খুব কষ্টে গার্মেন্টসে একজনকে হিসাবনিকাশে সাহায্য করার চাকরী হলো। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলো৷ তিনি ইতালি চলে গেলেন। সেখানে আমাকেও নিলেন। বাকিটা আমি নিজে করে নিয়েছি। তিনি মারা যাওয়ার পর। লম্বা কাহিনী সেসব কথা তাঁরা জানে না। তখন কেউ আমার গায়ের রঙ দেখতো না।

কেউ বলতো না, “ ওয়াও, একটা সুন্দরী মেয়ে আর কালো ছেলের কী সুন্দর সম্পর্ক! ” যখন আমার সামার্থ হলো। তাঁকে বিয়ে করলাম। তাঁর পরেও মেয়েটা বসে থাকতে নারাজ। আমাকে কিছু দিতে মন চাইলে কেনো আমার টাকা থেকেই কিনে দিবে? কেনো তাঁর পরিবারকে শুধু আমিই দেখবো? কেউ তাঁর চোখের নিচের দাগ হয়ে যাওয়ার গল্পটা শুনতে চায় না। তাঁদের চোখে এখন আমার টাকা আর সে খুব সাধারণ ঘরের একটা মেয়ে। যে শুধু টাকার জন্য আমাকে বিয়ে করেছে!

সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন আত্মীয়স্বজন কথাগুলো বলে। মেয়েটার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। এটা অনেক বছর আগেই শিখেছি যে। আপন কেউ কিছু বললে। উল্টে জবাব দিতে হয় না। নিজের মতো থাকো। তাঁরা এমনিই জবাব পেয়ে যাবে। তারপরেও সে কাঁদে। এখনো সে কখনোই আমাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে না। রোজ বাড়ি ফিরলে বলে, কজনের ক্ষতি করেছো? তাঁর মতে একটা মানুষ একদিন কতটুকু সুখে থাকবে সেটা নির্ভর করবে সে কতোজন মানুষকে সেদিন ঠকিয়েছে। আর কতোজন মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।

যদি তাঁকে খুশি দেখতে চাই। তবে যেন কাউকে না ঠকাই। তাঁর এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমার রোজই হতে হয়। এর সঠিক জবাব দেয়ার চেষ্টা করি বলেই হয়তো আজও আমাদের সম্পর্কটা টিকে আছে। চলতে, ফিরতে, ঘুরতে মানুষের এই চোখ আমি দেখেছি। সবাই তাঁর দিকে চেয়ে এটাই ভাবে! তাতে আমি আশ্চর্য হই না। ইরাও হয় না। সে খুব শক্ত একজন মেয়ে। তবুও মাঝেমধ্যে কান্না করে দেয়। আর তাঁর কান্না পেলেই আমার পুরনো কোনো শার্ট গায়ে দিয়ে বসে থাকবে।

নিজেকে মনে করাবে। এই শার্টগুলোকে সে কবে জড়িয়ে ধরেছিলো। এই শার্টগুলোতে এখনো তাঁর চোখের পানি লেগে আছে। বাংলাদেশের মানুষজনের এই মনোভাবকে আমি অগ্রাহ্য করছি না। আমরা তা দেখে এসেছি। যদি কারো টাকা থাকে। তাঁর একজন সুন্দরী বৌ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। সমাজের চারদিকটা দেখে বিবেচনা করলে এটাই হয় দেখি। কিন্তু সবার গল্পটা এক নয়। চারটে হাত এক হওয়ার পিছনে একটা গল্প থাকে। তা কেউই আমরা জানি না। পরশুদিনের কথাই বলি।

ইরা গর্ভবতী হয়েছে কদিন হলো। অনেকদিন ধরে সে বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে পারে না। ভাবলো এই খুশির খবরে তাঁদেরকে আমন্ত্রণ করা যাক। আমি বাইরে ছিলাম। আসতে একটু দেরি হলো। সন্ধার দিকে সবার সাথে যোগ দিলাম। যাবার আগে সবাই ইরাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে গেলো একেক করে। “ বাবুটা তোর মতোই যেন হয়। ” “ বাবুটা তোর মতো মিস্টি হবে৷ ” আমার আবডালে একজন বলেই ফেললো, “ দোস্ত তুই টাকাই দেখলি। বাবুটা যদি বাপের মতো হয় এখন?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত