শপিং করার জন্য মার্কেটে একটু ঘোরাঘুরি করছি আমার আপুর সাথে।একটা কাপড়ের দোকানে গেলাম সেখানে আমি আর আপু মিলে থ্রীপিজ দেখছিলাম।পছন্দ হলো তাই দোকানদারের কাছে দাম জানতে চাইলাম।দোকানদার সম্ভবত নামাজ পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত ওনার কপালে দাগ হয়ে গেছে।উনি হেসে আমাদের কথার জবাব দিলেন।
এমন সময় একটা পাগলি দোকানে আসলো।
পাগলিটার পড়নে ময়লা পুরাতন ছেড়া কাপড়,মাথার চুল উশখো খুশকো, যত্নের অভাবে সে ফর্সা থেকে হয়তো কালো হয়ে গেছে,হাত পাও নোংরা লেগে আছে।পাগলিটা দোকানের ভিতরে আমাদের পাশের টুলে বসলো।তার সাথে ৪ বছরের একটা মেয়েও ছিলো।মেয়েটার সৌন্দর্যতা দেখে অনেকে মুগ্ধ হবে।আমি অবাক হয়ে দেখছি দোকানদার পাগলিটাকে ঢুকতে দিলো কেনো?আবার যখন ঢুকলো তখন তাকে বকাঝকা করলো না কেনো?আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।পাগলিটা বলল,
–“ভাই আমার মেয়েটার শীত লাগে আপনি একটা সোয়েটার দেন।” দোকানদার বলল,
–“আচ্ছা দিচ্ছি তুই একটু বস।রতন(কর্মচারী)নতুন ডিজাইনের সোয়েটার আসছে না তার মধ্যে থেকে ভাল একটা দে তো? ” রতন তার মালিকের কথামত সুন্দর একটা সোয়েটার বের করে দিলো।পাগলিটা হাতে সোয়েটার টা পেয়ে সাথে সাথে ওর মেয়েকে পরিয়ে দিলো।রতন তখন শয়তানি করে বলল,
–“পাগলি তোর মেয়েটাকে আমায় দিবি আমি বড় করবো।” পাগলি উত্তর দিলো,
–“তোকে দিবো ক্যান আমার কলিজার টুকরা এটা।”
এ বলে পাগলিটা হেসে চলে গেলো।আমরা দোকানদারের কাছে পাগলিটার ব্যাপারে জানতে চাইলাম তিনি যা জানালেন তাতে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।তার ভাষ্যমতে,পাগলিটা কোনো একটা ছোটবেলায় দূর্ঘটনার জন্য মানসিক ভারসাম্য হারায়।সে তার বাবা মার একমাত্র মেয়ে ছিলো।তার বাবা অনেক চেষ্টা করে মেয়েকে সুস্থ করার কিন্তু অকালে মারা যাওয়ায় পাগলির চিকিৎসা থেমে যায়।বাবা মা হারানোর পর তাদের সম্পত্তিও হারায় নিকট আত্নীয় এর কাছে।সেদিন পাগলির পাশে কেউ দাড়ায়নি।আস্তে আস্তে পাগলি বড় হয় মানুষের লাথি ঝাটা খেয়ে।একদিন কিছু নারীলোলুপ মানুষের শিকার হয়।
পাগলিকে বাঁচাতে কেউ আসেনি।কিছুদিন পর পাগলি বারবার বমি করে।স্থানীয় লোকজন একজন ডাক্তারকে বলল চেকআপ করতে। ডাক্তার চেকাপ করে বলল পাগলি গর্ভবতী।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস পাগলিকে জারজ সন্তান গর্ভে নেওয়ার জন্য মানুষ তাকে ধরে মারে।একবারও তাদের মনে হয়নি পাগলিটার এত বড় ক্ষতি যারা করলো সেই মুখোশধারী লোকদের খুজে বের করা।সেদিন সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো দোকানদার চাচা।তিনি সবার হাত থেকে পাগলিকে বাঁচান।এরপর উনি পাগলিকে উনার সাধ্যযত সাহায্য করেছিলেন।তিনি পাগলিকে বছরে বছরে নতুন শাড়ি দিতেন।
উনার পারিবারিক অবস্থাও ততটা সচ্ছল না। তিনি জানান অসহায় মানুষদের সেবা করলে আল্লাহ খুশি হন।কয়েকমাস পর পাগলিটা বাচ্চা প্রসব করে।সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়।এক বড় পুলিশ অফিসার ও তার স্ত্রীর কোনো সন্তান ছিলো না।তারা পাগলিটার সন্তানকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।পাগলিটাকে অনেক টাকাও দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু পাগলি রাজি হয়নি সে তার মেয়েকে কারো হাতে দিতে রাজি হয়নি।এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন তার মেয়েকে দত্তক নিতে চেয়েছিলো কিন্তু সে রাজি হয়না। আমরা পুরো কাহিনীটা মনযোগ সহকারে শুনি।মা হয়তো এমনি হয় তাদের কাছে তাদের সন্তান সবচেয়ে দামী।পৃথিবীর সবকিছু মূল্যহীন।
দোকান থেকে একটু দূরে আসতে দেখলাম পাগলিটা কারো পুরাতন ছেড়া জুতো তার মেয়েকে পরিয়ে দিচ্ছে আর নিজে এই ঠান্ডা হিম রাস্তায় খালি পায়ে হাটছে।আমার মায়া হলো ওদের কাছে যাবো তখনি আমার বান্ধবী আমাকে ডাকলো।আমি ওর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে পাশে তাকিয়ে দেখি পাগলিটা নেই।বাড়িতে এসে মাকে বললাম সব মা তার দুটা নতুন শাড়ি আর জুতা বের করে দিয়ে বললেন আমি কালকে যেন পাগলিটাকে দিয়ে দেই। পরেরদিন আমি মার্কেটে গিয়ে শুনলাম পাগলির মেয়েটাকে কারা যেন দত্তক নিতে চেয়েছিলো পাগলি মেয়েকে হারানোর ভয়ে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।মন খারাপ করে আমি বাড়িতে চলে আসলাম। আমার মন খারাপ দেখে সবশুনে মা বলল,
–“দেখ মামনি মা এমনই হয় তারা কোনোভাবে তাদের সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেয় না।”
আমি মাকে জাপটে ধরি।মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মা আমাদের দশমাস গর্ভে ধারণ করে বড় করে তোলে।প্রসব ব্যাথা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক হয়।তবু মা আমাদের পৃথিবীতে আনে কিন্তু আমরা বড় হয়ে সেই মাকে ভুলে যাই।তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে হায়রে মানুষ পাঁচতলা বাড়ি অথচ বাবা মাকে থাকতে দেওয়ার মত আমাদের কাছে একটা ঘর নেই।আমরা আসলে কি সভ্য সমাজে বাস করি?