আমি জানিনা কেন আমার সংগে বিয়েতে অমত করছে রিফাত। আমি ওর পিছনে দাঁড়িয়ে। ও এখনো বাসে চড়েনি। টিকিট কাটা শেষ। হঠাৎ ঘুরলো আমার দিকে।
: আপনি আমার পিছু ছাড়বেন?
: কেন?
: কেন আবার, হাজারবার বলেছি আপনাকে আমি বিয়ে করবনা।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রিফাত। আমি অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। রিফাত গটগট করে বাসে উঠে গেল। আমি আমার ব্ল্যাক এলিয়নটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম হাভাতের মতন। এছাড়া আমার করার কিইবা আছে! আমার মনরানী বাসে ঝুলে ঝুলে হয়ত বা কারও পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কোন দুষ্টলোক ওর গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করছে। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। কি ভাবছি আমি! ঢাকার নীলক্ষেত। কতইবা বয়েস তখন। খালামনির সাথে যাওয়া।
খালামনি তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রী। বিয়ে হয়নি। গাউছিয়া মার্কেট তার যাওয়া চাই-ই চাই। ম্যাচিং ওড়না, কাপড়ের লেইছ, আরও কতকি! প্রায়ই সংগী হতাম। চোখে পড়ল নোংরা অসভ্যতা। নীলক্ষেত পেরোতেই বলাকা। এর কাছে আসতেই এক লোককে দেখলাম এক আন্টির শরীর ঘেসটে যাচ্ছেন। খানিক বাদে বাদেই শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি খালামনিকে দেখালাম। খালামনি লোকটার কাছে যেতেযেতেই চলে গেল লোকটা। সে ঘটনা আজ পর্যন্ত ভুলিনি আমি। পরে শুনেছিলাম সেখানে শুধু মেয়েদের ধাক্কা দেয়ার জন্য অনেক ছেলে যায়। শুনে ঘেন্নায় গা কুঁকড়ে উঠেছিল। আজও আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। আমার বোনকে নিয়ে অনেক টেনশনে থাকি। কখন কি হয়! একাএকা চলে। এখন রিফাতকে নিয়েও টেনশন হচ্ছে। একাএকা চলে মেয়েটা। বড্ড সাহসী, একগুয়ে, আর জেদী। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিনা।
সেই ছোট্টবেলার ক্রাশ আমার। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কতইবা প্রেম বোঝার বয়েস। ভাল লাগতো। ওর ঢেউ খেলা চুল। পটলচেরা আঁখি। উদ্দাম হাসি। গোলাপী আভায় ঘোরলাগা গাল। মনে হত আমি ডুবে গেছি। আজও ডুবে আছি। ডুবে আছি ওর প্রেমে। অনেকবার ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। পারিনি। বারবার ব্যর্থ হয়েছি। যখন বিদেশ চলে যাই,তার আগে। চিঠি দিলাম। উত্তর পাইনি। গেলাম ওর সাথে দেখা করতে। ও তখন সবে অনার্স ভর্তি হয়েছে। ঢাকা ভার্সিটিতে রসায়ন। কিন্তু ওর সাথে রসায়নটা আমার জমেনি। কলাভবনে চত্বরে ডেকেছিলাম। হালকা গোলাপী কামিজে অপূর্ব লাগছিল। বিন্দু বিন্দু ঘাম ওর নাকের ডগায়। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটা টিস্যু দিয়ে মুছে দেই। কিন্তু সে অধিকার আমার নাই। শুনেছি নাকে যাদের ঘাম জমে তারা স্বামীর দুলালী হয়। হুম। ওতো আমার দুলালীই বটে! এগিয়ে দাঁড়ালাম। ও ঠিক আমার পাশটিতে এসে দাঁড়াল।
: জ্বি, ডেকেছিলেন?
প্রথম প্রশ্ন ওর্ সরাসরি তাকিয়ে আছে আমার মুখপানে। কোন সংকোচ নেই। যেন উত্তর চাইতেই এসছে ও, আমার রিফাত।
: হুম।
: বলুন। আমি খেই হারালাম। বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। খানিক চুপ করে রইলাম।
: আমি চলে যাচ্ছি, রিফাত।
: তো!
: তুমি জানতে চাইবেনা কেন তোমাকে বলতে এসেছি?
: বিদায় নিতে।
: আর কিছু নয় রিফাত?
রিফাত চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। যেন ও জানতে চায় না আরকিছু। কিন্তু আমি জানি রিফাত আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চায়। আর জানতে না চাইলেও ও অনেককিছু জানে আমার। আমার মনের সবটুকুন রিফাতই জানে। ওছাড়া আমাকে কেউ বুঝবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আর আমার বিশ্বাস ভুল হতে পারে না।
: রিফাত, আমি তোমাকে ভালবাসি।
: আর?
: আর তোমাকে আমার জীবনসংগী করে পেতে চাই।
: আর?
: আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করবে এটা আমি চাই।
রিফাত কোন কথা বলেনি। চুপ করে আমার সামনে থেকে গটগট করে চলে গেল। একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি। আমি অসহায় হয়ে সেদিনও ওর যাবার পানে তাকিয়ে ছিলাম। আজও আছি। সেদিনের পর অনেকবার ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি আমি। একদিন ফোন করেছিলাম। রাত সাড়ে তিনটেয়।
: হ্যালো।
: হ্যালো, আমি ফাহিম বলছি রিফাত। রিফাতের গলা হঠাৎই যেন আমার নাম শুনে রুঢ় হয়ে উঠল।
: আপনি জানেন বিডিতে কটা বাজে!
: রাত তিনটা।
: আপনার লজ্জা করলনা এত রাতে আমাকে ফোন করতে!
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। বিপরীত পাশ হতে খট করে লাইনটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কত কষ্ট করে এ মোবাইল নাম্বারটা জোগার করেছিলাম, ও যদি জানত। আর দু দন্ডও কথা বলতে পারলাম না। এরপর আর ও পাশের মোবাইল ওঠেনি আমার কলে।
মার কাছে শুনলাম। রিফাতের বিয়ে হয়েছে। হুট করেই নাকি বিয়ে হয়েছে। তবে এক বন্ধুর মুখে শুনলাম আরও বহুবছর আগেই নাকি রিফাতের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। ছেলে ব্যবসায়ী। ওর মামার অনেক আগেই পছন্দ করা ছিল পাত্র। মামার সুমন্দীপুত্র। আমি বুঝলাম রিফাত কেন আমাকে এড়িয়ে চলত। রিফাত কেন বারবার আমাকে কষ্ট দিত। রিফাতের বিয়ের খবর শুনে আমি দু’দিন দ’রাত অচেতন ছিলাম। আমি নাকি বাচ্চাদের মতন কেঁদেছি। রুমমেটদের মুখে তাই শুনেছি। তারা আমাকে অনেক কষ্ট করে সামলেছে। এরপর আমি আর আমার মধ্যে কমই থেকেছি। ভাবনায় প্রতিনিয়ত রিফাতই স্থান পেত। আমি যখন বাড়ি ফিরলাম ততদিনে মা আমার বিয়েটা স্থির করেই ফেললেন। একবারও আমার মত নিলেননা। তিনিও জানতেন আমার রিফাতপ্রেমের খবর। বাড়ির সব লোকেই জানে।
বাড়ি এসে দেখলাম বেশ তোড়জোড় আমার বিয়ের। কেউ একবারও রিফাতের বিষয় আমাকে মনে করায় না। হঠাৎ করেই দাদুর মুখে শুনলাম। আমার ভাবনা ওলটপালট হয়ে গেল। ভেবেছিলাম রিফাত সংসারে ব্যস্ত। শুনলাম অন্য গল্প। রিফাত বাবার সংসারে হাল ধরে চলেছে আজ দুবছর। চুকিয়ে ফেলেছে এক বড় হিসাব।
: দাদু, তোর রিফাত ভাল নেইরে…
: কি বলছ দাদু?
: ওর ডিভোর্স হল আজ তিন বছর। ও বাড়িতেই থাকে।
: মানে…
আর শুনতে চাইনি কিছু। ছুটে গেছি দু’গলি পর রিফাতের দুয়ারে। রিফাত, আমার রিফাত, আমার শৈশবের আবেগ, কৈশোরের প্রেম। কিন্তু আজও রিফাত পাথর। শুনলাম কাকীমার মুখে।
: বাবা, শেষ অব্দি মেয়েটা সংসার টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। অমানুষ একটা। পারেনি রিফু। আমি শুনলাম। মাথা নিচু করে শুনলাম। অনেকিছু বরতে চাইলাম। পারলামনা। কাকীমা মানবেন না। তিনিও এ সমাজের সুরে সুর মিলিয়ে বলবেন।
: বাবা, রিফাতকে ভুলে যাও। নতুন করে জীবন গড়।
আর রিফাততো সারাজীবনই নিশ্চুপ ছিল। মেয়েটা একটা কথাও বলেনি কখনও কারও বিরুদ্ধে। না পরিবার, না সমাজ। চেপে গেছে নিজের মনের খবর। একবার বেশ রাগ হল মেয়েটার ওপর। কেন? ও কি প্রতিবাদ করতে পারেনা! দেখলাম তাকিয়ে, বাংলাদেশের মেয়েগুলো মুখ বুজে সইতেই শিখেছে। হায়, কবে জ্বলে উঠবে তারা। প্রতিবাদ করতে শিখবে। পালিয়ে যাবে না রিফাতের মতন। তারপর?
মার কাছে গেলাম। ভিক্ষা চাইতে। জানি, মা মানবে না। অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী ছিল রিফাত। রিফাত ভার্জিন নয় সমাজের কাছে। এ দোষটাই মার কাছে বড়। মাওতো একটা মেয়ে! ছেলেরা যদি দু’তিনটা বিয়ে করতে পারে, মেয়েরা কেন মা পারবে না! ওরা কেন অবিবাহিত পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে পারবে না!এ অধিকার শুধু ছেলেদের! শরীর কি পঁচে যায় মেয়েদের, নাকি শরীর হতে ভার্জিন না হবার জন্য আলাদা গন্ধ বের হয়! ওরা কি অষ্পৃশ্য হয়। তবে পুরুষ রা কেন হয় না! আমি মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। বলতে চাইছিলাম অনেক কথা। পারিনি। শুধু বললাম একটি কথা।
: মা, আমি রিফাতকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
মা, আমার জন্মদাত্রী মা। আমার কথা কেন বুঝতে চাননা! জানিনা। সব মা কি এমনই হয়। সন্তানের চেয়ে সমাজকে মূল্য দেয়! আর সমাজ! তারা কেন মেয়েদেরকে অযথাই এমন কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দেয়, সচেতনভাবে, অন্যায়ভাবে! কেউ কি বলবে আমাকে!
এরপর এখানে নির্বাক হয় গল্পরা। হাসপাতালে মর্গে নিথর পড়ে থাকে একটা দেহ। মায়ের অপেক্ষায়। কারণ কিছুক্ষণ পরে দিলারা বানু ছেলের লাশ গ্রহণ করতে আসবেন। আর বিপরীত পাশে রয়েছে আরেকটি লাশ। একটি মেয়ের রিফাত রশীদ নামের একটি মেয়ের। ভৈরবের বাঁক ঘুরতে রাস্তা পার হতে গিয়ে আনমনে চলতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। রাস্তা পাড় হবার সময় হয়ত ভাবছিল তার কপালের কথা। হয়ত ভাবছিল ফাহিমকে ফিরিয়ে দেবার যুক্তিগুলো! আর কিশোরগঞ্জ হতে খবর পেয়ে আরেটটি কার স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত করতে গিয়ে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা ছেড়ে খাদে পড়ে। সে হয়ত ভাবছিল কেন রিফাত এমন করল? কে এর পেছনে দায়ী? রিফাত নিজে? নাকি সমাজ! তবে দুটি মরণের দায়ভার কার! মেনে না নেয়া পরিবারের, নাকি সমাজের, নাকি ওদের নিজেদের!