ঘুড়ি এবং সুতা

ঘুড়ি এবং সুতা

বসন্তকাল, ধান কাটা শেষ। পাড়ার বন্ধু-বান্ধব সবাই খোলা মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। আব্বাকে বললাম, আব্বা আমারে একটা ঘুড়ি বানায়ে দাও না। উত্তরে আব্বা বললেন, কয়েকদিন দেরি কর বাপ। বাঁশ কাইটা তোরে ভালো একখান ঘুড়ি বানায়ে দেবো।

এদিকে আমার আর তর সইছে না। রাতে ঘুমানোর সময়, সকালে ঘুম থেকে উঠে, দুুপুরে খেতে বসে, সবসময় আব্বাকে জ্বালাতন করি। আব্বা বরাবরের মতোই বলেন, কয়েকদিন দেরি কর। সন্ধ্যায় সাগর এসে বললো, রাব্বি আমার ঘুড়িডা কাইটা গেছেরে। আমি বললাম, ক্যামনে কাটলো? কার সাথে কাটাকাটি করছিস? সে বললো, কারো সাথেই কাটাকাটি করিনি। হঠাৎ কইরা বাধনের ঘুড়ির সুতার সাথে আমার ঘুড়ির সুতার প্যাঁচ লাইগা যায়। তারপর ছাড়াইতে যাইয়া ঘুড়িডা অনেকদূর চইলা গেছে। আমি বললাম, তাইলে এহন কী করবি?

সে সিক্ত কণ্ঠে বললো, কী আর করবো? দেহি আরেকটা কিইনা আনি। কাইলকে আবার উড়াইবো। তিন দিন চলে গেলো। অথচ আব্বার ঘুড়ি বানানোর কোনো নামগন্ধও দেখছি না। সবাই মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছে আর আমি মাঠের পাশে থাকা আমাদের পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছি। মাঝে মাঝে ভাবছি, ইশ! আব্বা যদি একটু তাড়াতাড়ি বানায়ে দেয়। তাইলে আমিও ওদের সাথে উড়াইতে পারবো। হঠাৎই আম্মুর ডাক শুনতে পেয়ে পুকুর পার থেকে উঠে বাড়ির মধ্যে গেলাম। দেখলাম, আব্বা বাঁশ কেটে এনেছেন। আমাকে দেখে বললেন, বাপ তুই দোকানে যাইয়া কটের সুতা কিইনা আনবি। ততক্ষণে আমি সবকিছু রেডি কইরা রাহি।

আমি প্রলোভিত কণ্ঠে বললাম, আজকেই হইয়া যাইবে? আব্বা আমার হাতে টাকা দিয়ে বললেন, আগে সুতা কিইনা আন, যা। আমি টাকা নিয়ে দৌঁড় দিলাম দোকানের দিকে। বাড়ির পাশেই মামাদের বাড়ি। মেজো মামা পথের ধারে দাঁড়িয়ে কী যেন করছিলেন। আমাকে দৌঁড়াতে দেখে তিনি বললেন, কই যাইস? আস্তে আস্তে দৌঁড় দে। না হলে পইড়া যাবি। আমি দোঁড়াতে দৌঁড়াতেই বললাম, পড়বো না  সুতা কিনতে যাই। দোকান থেকে সুতা কিনে এনে আব্বাকে বললাম, আজকের মদ্যি হবি তো? আব্বা বললেন, কাল বিকালে উড়াবি তুই। মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। আবার কাল! অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সকালে ঘুম ভাঙলো আম্মুর ডাকে। তিনি বললেন, ওঠ ওঠ। উইঠা খাইয়া নে। আমি বললাম, আইজ এত সকাল সকাল রান্না শেষ? আম্মু হেসে বললেন, উইঠা দেখ বেলা কত হইছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি বেলা দশটা বাজে। প্রাতরাশ শেষে আব্বা বললেন, তোর ঘুড়ি বানানো শেষ। এহন উড়াইতে পারিস। আমি বললাম, কই? কই আমার ঘুড়ি? তিনি বললেন, দ্যাখ বাইরে রাখছি। আমি এক প্রকার দৌঁড় দিয়েই বাইরে গেলাম। দেখলাম, আব্বা চিলের মতো একটা ঘুড়ি বানিয়েছেন। আমি ফিরে এসে আব্বাকে বললাম, এটা আবার কি ঘুড়ি? তিনি বললেন, এটা ঢাউস। যহন আহাশে উড়বে, তহন চিলের ল্যাহান দেহা যাইবে।

আমি ঘুড়ি নিয়ে ছুটলাম মাঠের দিকে। পাড়ার বন্ধুরা দুপুরে উড়াতে আসবে। ততক্ষণ একা একা উড়ানো যাবে। তারা চলে এলে আবার ঘুড়ির সুতা কেটে গেলে তখন সমস্যা হবে। আব্বা এতো কষ্ট করে বানিয়ে দিয়েছেন, কেটে গেলে তো সব যাবে। পরক্ষণেই মনে হলো, আরে এটা তো কটের সুতা। এই সুতা তো হাত দিয়েই টেনে ছেঁড়া যায় না।
নির্ভয়ে ঘুড়ি উড়াতে লাগলাম। বিকেলে বাড়ি ফিরে আব্বাকে বললাম, আব্বা সবার তো অন্যরহম সুতা। আমারডা এইরহম ক্যা? আব্বা বললেন, এই সুতা কহনো ছিঁড়বে না। এই সুতা একটা সম্পর্কের ল্যাহান। একটা সম্পর্ক যেইরহম মজবুত। ঠিক সেইরহম এই সুতাটাও। তয় হ্যাঁ, সম্পর্কে যেইরহম ভাঙন আছে। ঠিক সেইরহম এই সুতারও ভাঙন আছে।
আমি বললাম, মানে?

আব্বা বললেন, একটা সম্পর্কে যহন এ্যাকে অন্যের প্রতি আসক্তি কইমা যায়, তহন সেই সম্পর্কে ভাটা পড়ে। ঠিক একইভাবে এই ঘুড়ি যদি কোনোকালে অবহেলায় গড়াগড়ি খায়। তহন ঘুড়ির সুতাটা পঁইচা যাইবে। আমি অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমার তাকিয়ে থাকা দেখে বললেন, তুই ভাবছিস তাইলে এই সুতা আর ঘুড়ি ঠিক রাহার উপায় কী? আমি “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়লাম। অতঃপর আব্বা বললেন, এর উপায় হইতাছে “এই ঘুড়িটার সাথে থাহা তোর সম্পর্ক।” আমি বললাম, মানে? তিনি বললেন, যদ্দিন তুই ঘুড়িটা উড়াইবি। তদ্দিন এটা ঠিক থাকবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত