বন্ধু

বন্ধু

আমার যে বন্ধুটি আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছিল। সে মাদারীপুর জেলার এক মেয়ের সাথে প্রেম করে তাকে বিয়ে করেছিল। মারা যাবার আগে তার একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানও ছিল। ২০ শে এপ্রিল ২০০৬ সাল। রাত এগারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। নরসিংদী শাপলা চত্ত্বর বাজারের কাছে সমবায় সমিতির সামনের খালি মাঠে বাউল গানের অনুষ্ঠান। আমি সে অনুষ্ঠানের সাউন্ড অপারেটর। বাউল শিল্পী লাল মিয়া বয়াতী ও শংকর দাস উক্ত পালা গানের শিল্পী। হঠাৎ আমার বন্ধু আজিজ আমার পিছনে উপস্থিত। তার হাতে একটি মোম বাতি ও একটি বারো টাকা দামের অবাল্টিন কেক। আমি দেখেই অবাক হয়ে বলছি, “দোস্ত তাড়াতাড়ি দে খাই, ক্ষিধে লাগছে।”

-আর দশ মিনিট পর।
-দূর, ক্ষিধা লাগছে এখন। আর খাব দশ মিনিট পর? মোমবাতি কি বাড়ির জন্য?
-তুই সব কিছুতেই এত তাড়াহুড়া করিস কেন? একটু অপেক্ষা কর।

রাত এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট। আজিজ আমার সামনে থাকা আটশত ওয়াটের মেশিনের উপর মোমবাতি ধরাল। বারোটা বাজার পর বলছে, “তুই মোমের আগুনটা এক ফুঁ দিয়ে নিভাতে পারবি?” বলতে দেরী, আমি সাথে সাথে ফুঁ দিয়ে মোমের আগুন নিভিয়ে দিলাম। আজিজ হাতে তালি দিয়ে বলছে, “হ্যাপী বার্থ ডে টু ইউ মাম্মা” শংকর দাস গানের ফাঁকে জিজ্ঞেস করছে, “তোমার নাম কী?” আমি জবাব দিলাম, “ওমর ফারুক শ্রাবণ” শংকর দাস মাইকে বলছে, “আজকে আমাদের এই বাউল গানের অনুষ্ঠানের সাউন্ড অপারেটর ওমর ফারুক শ্রাবণের শুভ জন্মদিন। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। আমি এত আনন্দ নেবার মত প্রস্তুত ছিলাম না। খুশিতে চোখে আনন্দ অশ্রু। একুশে এপ্রিল আমার জন্মদিন। তবে বিশ এপ্রিল রাত বারোটার পর কেউ শুভেচ্ছা জানাবে ভাবতে পারিনি। আমি আজিজকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আবারো গান শুরু হল। আজিজ কেক ভেঙ্গে আমার মুখে দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। তখনো আমার চোখে খুশির জোয়ার।

সেই যে শুরু, প্রতি বছর আজিজের আগে কেউ আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারে না। ২০০৭ সাল। অনেকেই বলাবলি করে, ‘আজিজের সাথে জ্বীন আছে। সবাই দূরত্ব বজায় রাখিস।’ আমার খুব রাগ হত। যে ছেলেটা আমার এত ঘনিষ্ট। সম্পর্কে মামা ভাগিনা। তবুও একসাথে ছোট থেকে বড় হয়েছি কাছের বন্ধু হিসেবে। আর লোকে কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলে তার নামে। তবুও লক্ষ করলাম আজিজের হাতে একটি তাবিজ। সে নিজেই বলছে আমাকে, ‘তাবিজটি যত্ন করে রাখতে হবে।’ আমি যেমন শুনেও না শুনার ভান করি। কী বলে উল্টা পাল্টা।

২০০৮ সাল। গাজীপুর জেলার ভবানীপুর নামক এক জায়গায় বিশাল রেক্সিন ফ্যাক্টরী আছে। পুরো ফ্যাক্টরী রং করার কন্ট্রাক নেয় আজিজ। সে গাড়ীর প্রিন্টিং মাস্টার। পঁচানব্বই হাজার টাকা কাজের মুজুরী। আমরা তেরো জন সমবয়সী ছেলে গেলাম সে কাজে। কাজ শুরু করার প্রায় দেড় মাস পর একদিন আজিজ উল্টাপাল্টা কাজ শুরু করল। ভোরে আমরা সবাই ঘুমাচ্ছি। আজিজ এক পাকা কাঠাল নিয়ে এসে সবাইকে ডাকছে খাওয়ার জন্য। আমরা উঠে দেখি অনেক বড় একটি পাকা কাঠাল, কিন্তু কাঠালের ডাটা (ভিতর অবধি সে শক্ত অংশ থাকে) নেই। জানতে চাইলাম, ‘কিরে ডাটা কই?’

-আগে খেয়ে নে তারপর দেখাচ্ছি।

খাওয়া শেষ হবার পর আমাদের একটি কাঠাল গাছের নিচে নিয়ে গেল। গাছে অন্যান্য কাঠালের সাথে একটি খালি ডাটা আছে কিন্তু কাঠাল নেই। ভেবে নিলাম এটা কোন অস্বাভাবিক কাজ না। ফ্যাক্টরী রং করার সময় একজন বলছে, ‘আজিজের চোখে রাতে আগুন দেখা যায়। লাল আগুন, নীল আগুন।’ আমি হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। আজিজ খুব রেগে গেল। বলছে, ‘তোরে আজ রাতে লাল আগুন আর নীল আগুন দেখাব।’ আমি আরো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছি।

রাত সাড়ে বারোটা। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা আড্ডা দিচ্ছি চার পাঁচজন। হঠাৎ আজিজ বলল চুপ থাক সবাই, আমি শ্রাবণকে আগুন দেখাব। আমি এবারও হাসলাম। আজিজ নিজের হাত দুটো পিছনে নিয়ে দাড়িয়ে গেল। একটু নুয়ে খোলা পানির বোতল দাঁতে কামড়ে ধরে বোতলটি উপর করল। ডগডগ করে অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে দাড়োনো অবস্থায় বোতলটি ছেড়ে দিল। বোতলটি কাত হয়নি। একটু পানিও পড়েনি। ভেবে নিলাম এটাও স্বাভাবিক ঘটনা।

আজিজ বাতি নিভালো। দরজা জানালা বন্ধ। বেন্টিলিটারের ছিদ্র দিয়ে বাইরের বাতির আলো এসে পড়ছিল ঘরে। দুটা কাঠ দিয়ে সে ছিদ্র বন্ধ করে দিল। কে বন্ধ করল জানিনা, কারণ আজিজ আমার সামনে বসা। রুম পুরোটাই অন্ধকার। আমার কাছ থেকে নোকিয়া ১২০০ মডেলের মোবাইলটি আজিজ নিয়ে বন্ধ করে দিল। হঠাৎ আজিজ বলছে, ‘তোর ফোনে ত্রিশটা সেট রিংটোন আছে। শুনে দেখতো রিংটোনগুলো তোর মোবাইলের কিনা?’
আমি রুমের পাশের কাঠাল গাছে আমার মোবাইলের রিংটোন শুনছি একটার পর একটা। অথচ আমার মোবাইল বন্ধ করে রাখা হয়েছে আমার সামনে। তেরোটি রিংটোন বাজার পর আমি সরি বললাম আজিজকে। “দোস্ত আমার ভুল হইছে, বন্ধ কর এসব।”

আজিজ বাতি জ্বালিয়ে আমার বন্ধ মোবাইল চালু করল। শেষে বলল, “তোর ভাগ্য ভালো যে ত্রিশটি রিংটোন বাজার আগেই সরি বলেছিস।” পরেরদিনই আজিজ আমাদের রেখে বাড়িতে আসল। কারল তার হাতের তাবিজটি হারিয়ে গেছে দুদিন হল। পরবর্তিতে আমি এই ঘটনা অনেকের কাছে বলেছি। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। ২০১১ সালে আজিজ সাথে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরল। পরে জানতে পারলাম ফোনে প্রেম ছিল অনেকদিনের। দেখা করতে গিয়ে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তবে তাদের সংসার জীবন ছিল অনেক সুখের।

২০১২ সালে ভাগদী গ্রামীন ফোন টাওয়ারের কাছের এক রাস্তায় আজিজ শুয়ে আছে। হঠাৎ একা সে তিন চারজনকে ধাক্কা দিচ্ছে। অবশ্য সবাই বন্ধু। তবুও একসময় তিন চারজনই রেগে গিয়ে আজিজকে ধরলাম। কিন্তু সে মনে হয় হালকা হাত উঁচু করে আমাকে সবাইকে ঝাটকা দিয়ে ফেলে দেয়। ছয়জনে মিলে আজিজকে তার বাড়ি নিয়ে সব খুলে বললাম। আজিজের মা আরেকটি তাবিজ এনে হাতে বাঁধতে চাইল। আজিজ ধাক্কা মেরে তার মা’কে ফেলে দিল। বুঝতে পারলাম এসব আজিজ করছে না, করছে অন্য কেউ। কবিরাজ আনা হল। আজিজ বসে থাকা কবিরাজের বুকে এমন এক লাথি দিল যে কবিরাজ নলকূপে গিয়ে পানি খেয়ে চলে গেল, আর আসেনি। দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা পর আজিজ স্বাভাবিক। এবং এই ঘটনার কিছুই সে জানে না।

২০১২ সালের শেষের দিকে শনিবার দুপুর একটায়, আজিজ দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বড় ইউ কালেক্টার গাছের আগায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সে ডাল অনেক চিকন। তার সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না। সে সেখান থেকে বলছে তাকে একদামে একুশ কেজি শিকল আর তিনটি তালা কিনে দিলে সে গাছ থেকে নামবে নয়তো লাফ দিবে।
তার কথামত সব আনা হল। আজিজ রুমে গিয়ে সারা শরীরে একুশ কেঁজি শিকল পেঁচিয়ে তিনটি তালা লাগাল। তালার তিনটি চাবি এলাকার তিনটি কবরে ফেলে আসল। ততক্ষনে এলাকার ছোট বড় সবাই জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে। কেউ বলছে আজিজ পাগল হয়ে গেছে। কেউ বলছে নেশা করছে। তবে আমি জানি এসব আজিজ করছে না, অন্য কেউ করছে। বেলা আড়াইটা। আজিজ পুকুরপাড়ে গিয়ে ওযূ করল। বলছে, “গোসল করে নামাজ পড়তে হবে। তোরা সবাই গোসল কর, নামাজ পড়তে হবে। ” বলেই পুকুরে লাফ দিল। বাচ্চারা মজা পাচ্ছে বিষয়টা নিয়ে।

তিন মিনিটের মত হয়ে যাচ্ছে। এবারতো সবাই নড়েচড়ে উঠল। আজিজতো তিন মিনিট ডুব দিয়ে থাকার কথা নয়। কী হল আজিজের? চার পাঁচজন পানিতে নেমে ডুব দিয়ে আজিজকে খুঁজছে। প্রায় দশ মিনিট পর আজিজের সন্ধান পাওয়া গেল। তবে শিকলের জন্য তুলতে পারছে না। শেষে দড়ি দিয়ে মৃত আজিজকে টেনে তোলা হল। আজিজের গলা পর্যন্ত পানির তলার মাটির নিচে ছিল। নাকে মুখের ভিতর কাঁদা।

সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। চোখের সামনে কী হয়ে গেল। দুই হাসপাতাল ঘুরানোর পর নিশ্চিত হলাম আজিজ আর নেই। তার ফুটফুটে একটি মেয়ে সন্তান আছে। আমরা বন্ধুরা আছি তবে আজিজ নেই। আজিজের স্ত্রী আজও অন্য কাউকে বিয়ে করেনি। মেয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই কাটিয়ে দিচ্ছে বাকিটা জীবন। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছে, সে মেয়েটি তার ভালোবাসাকে স্বার্থক করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আজিজ, সেই ২০১২ থেকে এখনো ২০ এপ্রিল রাতে অপেক্ষা করি। হয়তো সামনে এসে বলবি, “আমি তো এতটা বছর মজা করছি, তোর বার্থডে আমিই তো সবার আগে জানাব। তাই চলে এসেছি। ভালো থাকিস আজিজ, আল্লাহ যেন তোকে ভালো রাখে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত