দুঃখের খবর খালামণী এসেছে। খালামণি আসলে আমার সকালের ঘুমটা হারাম করে দেয়। আনন্দের খবর, খালামণীর সাথে অপরূপা একটা মেয়ে এসেছে! তাঁকে দেখেই আমি একেবারে দায়িত্বশীল হয়ে গেলাম। ব্যাগ পত্র এগিয়ে আনলাম। থাকার ঘর দেখিয়ে দিলাম। বসতে দিলাম। মাকে জোরে জোরে বলছি, “ কই তুমি? বাজারে যেতে হবে না? কতোদিন পর খালামণী এসেছে! ”
মা টাকা দিলো। বাজারে গিয়ে দেখি এই টাকায় হচ্ছে না। নিজের পকেট থেকে আরো এক হাজার টাকা দিয়ে মাংস নিলাম। আমি যতবারই বাজার করি। কয়েকশো টাকা আগে নিজের পকেটে গুঁজে নেই। মাকে কীভাবে হিসাব দিবো সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু আজকে নিজের পকেট থেকে টাকা ভরেছি! বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে মেয়েটার সামনে ঘুরছি। আমি আবার কৃত্রিম জগতে পকপক, বাস্তবে আন্ডা। একটা কথাও বলতে পারি না মেয়েদের সামনে গিয়ে!
অবশেষে মা দেখে ফেললো, “ এসে গেছিস? এতো তাড়াতাড়ি? ” আমি মাথা নাড়ানোর আগেই মা ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো, “ কতো টাকা মেরেছিস বল? টাকা বের কর। ঘরে একদম টাকা নেই এই মুহূর্তে! ” মা কাজটা একদম ভালো করলো না। মেয়েটার সামনে আমাকে বাজারমার করে দিলো! আফসোস করলাম। কেনো যে আরো এক হাজার টাকা নিজের পকেট থেকে ভরতে গেলাম! মেয়েটা মুচকি হেসে চলে গেলো। মা আর খালামণী রান্নাঘরে রান্না করছে। মেয়েটাও দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ কাটছে। মরিচ কাটছে। চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে!
কোনোভাবেই সে মা আর খালামণীর থেকে একটু দূরে আসছে না! আমাকে দেখে ভয় পেলো নাকি? নাকি আমি এমন ছেলেই? যার সাথে কোনো মেয়ে কথা বলতে চায় না! আয়নায় নিজেকে ভালো করে পরিদর্শন করলাম। মুখে দাড়ি আছে। একটু বুড়ো বুড়ো লাগে। কিন্তু ঠিকঠাক আছি। একদিন কেটে গেলো মেয়েটার নামই জানতে পারলাম না। আমি এতো বেহায়াও না। নিজে থেকে কাউকে জিজ্ঞেস করবো, “ আপনার নামটা কী? ” সকালে ভোরে উঠে নিজের ভেতরে শিল্প আছে তা দেখানোর চেষ্টা করলাম। হারমোনিয়াম নিয়ে বসে রবীসঙ্গীত নজরুল সঙ্গীত গাওয়ার চেষ্টা করলাম একটু জোরেই। কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে দরজাটা খুলে কবিতা পড়া শুরু করে দিয়েছি। “ সে তুমি এলে, আমার বাড়িতেই এলে।
আমাকে রাঙালে, কিন্তু নামটা বললে না! কাজটা ঠিক হচ্ছে না! ” অভাগার কবিতা কেউই শুনছে না! ভাবছি খালামণীকে বলেই দিবো। মেয়েটাকে আমার খারাপ লাগেনি। বিয়ের জন্য দেখতে পারো। আমি অজ্ঞান হতে লাগলাম। মেয়েটা যখন পুরনো একটা শাড়ি পড়ে মায়ের সাথে বারান্দায় এলো। শাড়িটা মায়েরই। ভালো করে দেখলাম। গেলো জন্মদিনে আমিই দিয়েছিলাম! আহা, দুজনকে কতো অদ্ভুত মানাচ্ছে!
নাহ, এভাবে আর হচ্ছে না। আমাকেই গিয়ে কথা বলতে হবে। “ লেডিস ফার্স্ট ” বলে কিছু নেই। জিজ্ঞেস করি গিয়ে, “ কীসে পড়েন আপনি? ” দুকদম এগিয়ে চার কদম পিছিয়ে গেলাম। কারণ মেয়েটার প্রতিত্তোরে যদি বলে, “ আপনি কীসে পড়েন? ” তখন আমি তো আর বলতে পারবো না। তিন তিনটা বিষয়ে আন্ডা মেরে বসে আছি! তবে এ তেমন কিছু না। এমন একটা মেয়ে টেবিলের সামনে বসে থাকলে গোল্ডেন হীরা কোনো বিষয়ই না, পরীক্ষায় পাওয়া!
সকালের নাশতার টেবিলে দেখি খিচুড়ি! হায়, আমার আম্মারে আল্লাহ্ যেন হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখে! কথাটা মুখ থেকে শব্দ করেই বলে ফেলেছি মনে হয়! খালামণী, মা আর মেয়েটা সবাই চুপ হয়ে গেলো! মা বললো, “ আমি রান্না করিনি! নিতু রান্না করছে! ” মেয়েটা মুচকি হাসলো। হাইরে, এভাবে হাসলে তো আমার কলিজাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে! নাহ আজ থেকে আমাকে মন দিয়ে পড়তে হবে। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। ফেসবুকের এযাবৎ সম্পর্কের বাত্তিটা একাকী থাকলেও এই মুহূর্তে ‘দুকলা’ করে দিয়েছি।
আমার বন্ধুবান্ধব সব হিংসুটে। বিশ্বাসই করতে পারছে না ব্যপারটা। হাস্যকর বটে। একটা মেয়ের কাছে মোবাইল নাম্বার চেয়েছিলাম। সে দেয়নি। তাঁকে বলে দিয়েছি, তোমার থেকে হাজারগুণ সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, দাওয়াত দিবো। অবশ্যই এসো! ” মেয়েটা হা করে শুধু তাকিয়ে থাকলো। কোনো জবাব দিলো না! বাবাকে মেয়েটার কথা বললে অনেক কথা শুনাবে। বলবে আগে এই করো, ঐ করো। তারপর বিয়ের কথা বলো। মায়ের কাছে বললে সমস্যা নেই। বেলচা দিয়ে দুয়েকবার মারবে। তারপর ব্যাপারটা নিয়ে আসলেই ভাববে।
মোড় থেকে দুটো তাজা গোলাপ ফুল নিয়ে বাড়িতে গেলাম। একটা আগে মাকে দিতে হবে। নাহলে তাঁর মুড শীতল হবে না। মায়ের হাতে গোলাপ ফুলটা দেওয়ার পর সে বললো, “ কোনো মেয়ে আর তোর ফুল নেয় না? এজন্য অবশেষে মায়ের কাছে আসা হলো না? ” “ তুমিও মা, কী যে বলো। তোমার ছেলের হাত থেকে গোলাপ পাওয়ার কোনো মেয়ের ভাগ্য হয়নি! ” “ বাপরে, পরীক্ষায় আন্ডা মেরেও যা ভাব। পাশ করলে তো আল্লাহ্। আচ্ছা শোন, নিতু কালকে চলে যাবে। ভোরে উঠিস, ওদেরকে নামিয়ে দেয়া লাগবে! ”
আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়লো আমার! জীবনে এতো খারাপ লাগেনি আমার! মা আবার বললো, “ না উঠলে তো জানিস তোর খালা কেমন, পানি ঢেলে দিবে। এই শীতে উঠে গোসল করতে ভালো লাগবে না মনে হয়? ” মা আছে গোসল নিয়ে! এদিকে আমি শূণ্য হয়ে যাচ্ছি সে খেয়াল আর করছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বাকি গোলাপটা খালামণীকে দিয়ে বললাম, “ খালামণী আরো কয়েকটা দিন থাকো। তুমি গেলে ভালো লাগবে না! ” খালামণীর চোখেমুখে এতো খুশি আমি কোনোদিন দেখিনি। কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “ ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা সামনে রে। পরীক্ষা শেষ হলে আবার আসবো। ” মুখ ফুটে আর বলতে পারছি না। এই অদ্ভুত খিচুড়ি রান্না করতে পারা মেয়েটাকেও সঙ্গে নিয়ে এসো।
সারা রাত আমি নির্ঘুম। এমন মনে হচ্ছে আমার বৌ আমাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে! আমার এতো একলা লাগছে কেনো? আজকে সূর্য উঠার আগে আমি উঠে গেলাম। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি। খালামণী আর ইতু তৈরি হলো। মেয়েটা বোরকা পড়েছে। চোখটা শীতল। শীতে কাঁপছে। দুয়েকটা কথা বলছে। আমার দিকে তাকালেই আমি চোখ সরিয়ে নিচ্ছি। আমি আবার খুব লাজুক। বাড়ির একটু সামনেই স্টেশন। মেয়েটা কেমন করে ট্রেনে উঠে গেলো। উঠার আগে মায়ের পায়ে সালাম করতে চেয়েছিলো। মা সরে এসে বুকে জড়িয়েছিলো। আমার যে তখন কী সুখ লাগছিলো!
আমি আর মা বাড়ির পথ ধরলাম। খনখনে কুয়াশা, আমাদের গায়ে চাদর। মা বললো, “ মেয়েটাকে তোর কেমন লাগলো? ” সত্যিই আমার মায়ের মতন দুনিয়াতে এমন মা’ই হয় না। আমার মতো একটা ঘরখরগোশের জন্য কতো ভালো একটা মেয়ে দেখেছে! এমন মুহূর্তে লজ্জা সবারই লাগে। মেয়েদেরই লাগে এমন কোনো কথা নয়। “ ভালোই তো। ” আমার কথা শুনে মা আরোও যেন খুশি হয়ে গেলো। “ আমারও অনেক ভালো লেগেছে। ঘরের চাবি এমন মেয়ের হাতেই দেয়া যায়। ” বাহ, আমার মা দেখি আমার চেয়ে আরো সাত ধাপ এগিয়ে! এর মধ্যে ঘরের চাবিও মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছে! “ হ্যাঁ, তা তো দেয়াই যায়! ”
মা বেশ হাস্যজ্বল হয়ে বললো, “ আতিককে বলবো কালকেই ঢাকা থেকে রওনা দিতে। এমন মেয়ের ব্যাপারে দেরি করা ঠিক হবে না! ” শরীরটা আমার পানি শূণ্য হয়ে গেলো! “ চাচ্চু হঠাৎ আসবে কী করতে? ” “ চাচ্চু আসবে না তো কী তোর বাপ আসবে? যার বিয়ে সে আসবে না? ” আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম! পা টা জমে গেছে! মা এটা কী বললো? নাহ, এ হতে পারে না। মা আবার বললো, “ কী হলো দাঁড়িয়ে পড়লি যে? বাড়িতে যাবি না? নাশতা করবি না? ” রাগে, দুঃখে, বেদনায়, যন্ত্রণায়, বিরহে বললাম, “ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, ধ্যুত, এক সপ্তাহ আমি আর ভাত খাবো না। তুমি যাও।