দিশা

দিশা

তীব্র উত্তেজনায় ছেলেটি আমাকে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে আসছে। আমিও মমতাময়ী নারীর মতো দুই হাতে তার মুখটা আলতো করে ধরলাম। সাথে সাথে ছেলেটির গাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু হল। যন্ত্রণায় দু’হাতে গাল চেপে ধরেছে সে। আমিও সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এক হাতে ছেলেটির অন্ডকোষ চেপে ধরলাম। যন্ত্রণায় চিৎকার করে আমাকে ছাড়ানোর জন্য টানাটানি করছে ছেলেটি৷ আমি ডান হাত দিয়ে আলতো করে আবার আরেক গাল ছুঁয়ে দিলাম। এ গালও “হা” হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ছেলেটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। লোকজন আসতে পারে, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। ছেলেটির ঘুষি-টুসি সহ্য করে সর্ব শক্তি প্রয়োগে অন্ডকোষ চেপে ধরলাম। খানিক পরে ঘামতে ঘামতে ছেলেটি গা ছেড়ে মাটিতে লুটে পড়ল।

আমি দিশা। মা-বাবার বড় মেয়ে। আমরা তিন বোন। বাবা-মা ছেলে সন্তানের আশায় এক এক করে তিনটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। তিন বছর আগে একটি সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মারা যান। জমানো টাকা-পয়সা আর জায়গা জমি বিক্রি করে দুই নাম্বার বোনকে বিয়ে দিয়েছি। বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে নিয়ে পিছে লোক জমিয়ে সমালোচনা করেছে। মাসীপিসীদের পানের আড্ডা জমে উঠেছে। চায়ের আড্ডায় বেকার ছেলে-বুড়োরা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে কথা বলেছে। আমি এসব কানে নেইনি। সব ছোট বোনের মাত্র পাঁচ বছর। হাতে অনেক সময় আছে।

আমি দিনরাত হেঁটে হেঁটে টিউশনি করাই৷ বাবা যখন মারা যান তখন আমি অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়তাম। ইংলিশে অনার্স। এখন দিনরাত বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশনি করাই৷ এতেই টেনেটুনে সংসার চলছে। লোকের নানান কথা সহ্য করতে হয়। আশপাশের বিবাহিত পুরুষরা টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে বিছানায় নিতে চায়, সব সহ্য করে যাই প্রতিবাদ করি না। কিন্তু বেশকিছু দিন হল জেল থেকে বের হয়েছে জামাল। লোকে জামাল ভাই ডাকে৷ পাড়ার সবাই বেশ ভয় পায়। যা ইচ্ছে সে করে বেড়ায়। জেলে যায়, কীভাবে জানি আবার বের হয়ে আসে। পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়ায়। সেবার বউ একটু প্রতিবাদ করেছিল। মারধর করে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে।

সেদিন সন্ধ্যায় আমি টিউশনি থেকে ফিরছি। মেইন রাস্তা থেকে পাড়ার গলিতে ঢুকে দেখি টং দোকানের সামনে জামাল ভাই বাইকে বসে সিগারেট টানছে। পাশে আরও কয়েকটি ছেলে। আমার শরীর কেমন জানি শিউরে উঠল। কারণ তাদের সামনে দিয়েই যেতে হবে আমাকে। ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে যাচ্ছি। ওরা কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে এদিকে। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। তারপর কোনোরকম তাদেরকে পাস করে বাড়িতে চলে এলাম। সেদিন রাতে হঠাৎ আমার কাছে একটি ফোন এলো ৷ ভয়েজ শুনেই আমি আঁতকে উঠলাম। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে বললাম, ‘কে আপনি? নাম্বার পেলেন কোত্থেকে?’ লোকটি ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে বলল, ‘কী যে বল দিশা, সামান্য একটি নাম্বার যোগাড় করতে পারবে না জামাল?’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কেন ফোন করছেন, কী দরকার আমার সাথে?’ ‘না, এই দিলাম আরকি, পাড়ার মেয়েদের একটু খুঁজ-খবর তো রাখতে হয় বুঝ না? তাছাড়া শুনলাম তুমি রাত-বিরাতে টিউশনি করে বেড়াও। শিক্ষিত মেয়ে, দেশের অবস্থা তো জান। ছোট ছোট মেয়েরাও ধর্ষিত হচ্ছে আর তুমি তো সুন্দরী যুবতী মেয়ে। তাই ফোন দিলাম কেউ বিরক্ত করে কিনা জানার জন্য।’ আমি খানিক কাঁপা গলায় বললাম, ‘না না আমাকে কেউ বিরক্ত করে না।’ বলেই ফোন রেখে দেই। বিরক্ত করে আমাকে অনেকেই। কিন্তু শিয়ালের কাছে শিয়ালের বিচার দেবার মানে হয় না। পরেরদিন সকালে টিউশনিতে যাবার জন্য বের হয়ে দেখি জামাল ভাই রাস্তার সামনে বাইকে বসে আছে। আমি যথা সম্ভব থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে মাথা নীচু করে হাঁটছি। হঠাৎ জামাল ভাই ডাক দিয়ে বলল, ‘দিশা এদিকে এস।’

আমার সাথে সাথে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল ভীষণ । আমি ভয়ে ভয়ে সামনে গেলাম। জামাল ভাই হাতে ধরে বলল, ‘কোথায় যাবে দিশা, বাইকে উঠ দিয়ে আসছি।’ আমি হেঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে বললাম, ‘ধন্যবাদ, আমি হেঁটে হেঁটেই যেতে পারবো।’ সিগারেট টানতে টানতে বলল, ‘কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে আছে। টিউশনি শেষে বিকেলে কোথাও বেড়াতে চল ভাইয়ের সাথে৷’ আমি কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যাই। দিনকে দিন জামাল ভাইয়ের বাড়াবাড়ি বাড়তেই থাকে৷ সন্ধ্যার সময় টিউশনি করে আসার সময় আমার বড্ড ভয় লাগে৷ বাসা থেকে বের হলেই জামাল ভাইকে সামনে পাই। আসার সময়ও পাই৷ জামাল ভাই একেকদিন একেকটা আবদার করে যাচ্ছে৷

আমাকে নিয়ে পার্কে যেতে চায়, শপিংয়ে যেতে চায়। আমি জানি এসবের শেষ হচ্ছে হয়তো ভালোই ভালোই শরীর দেওয়া না হলে জোরপূর্বক কিছু একটা করবে৷ সেদিন সন্ধ্যায় টিউশনি থেকে ফেরার পথে ডাকছে। আমি ডাকে সাড়া না দিয়ে দিব্যি চলছি, সে বাইক নিয়ে সোজা সামনে এসে ওড়না ধরে বলল, ‘আমার সাথে দেমাগ দেখাও না?’ আমি ওড়না টান দিয়ে ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাসায় চলে আসি। লাগাতার রাতে ফোন আসে রিসিভ করিনা। আম্মুকেও বলিনা দুশ্চিন্তা করবে বলে। এমনিতেই বয়স হয়েছে অসুখ-বিসুখে দিন যায় মায়ের। ছোট বোন স্কুলে ভর্তী হয় নি এখনও। দু’দিন হল টিউশনিতে যাচ্ছি না। বের হওয়া সম্ভবও মনে হচ্ছে না। থানা-পুলিশ করেও লাভ হবে না৷

আজ না হয় কাল বের হয়ে আসবে। তাছাড়া কুকুকে দৌড়ানি দিতে হলে যেমন নিজেও দৌড়াতে হয় এদেশে মামলা সেরকম, নিজেও হয়রানি হতে হয়। কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমি জানি জামাল এখনও আমার সাথে খারাপের কিছুই করেনি। সে চাচ্ছে ভালোই ভালোই পেতে। অন্যান্য মেয়েদের মতো টাকার বিনিময়ে অথবা প্রেমের নামে বিছানা গরম করতে। এভাবে না পেলে রাস্তা থেকে হঠাৎ একদিন তুলে নিতে পারে৷ কেউ খুঁজও পাবে না। আমি অনেক ভাবতে ভাবতে একদিন রাতে জামাল ভাইয়ের ফোন রিসিভ করলাম। সে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বুঝিয়ে হুমকি -ধামকি দিয়ে অনেক কিছু ইঙ্গিত করছে। শেষমেশ আমি সরাসরি বললাম, ‘জামাল ভাই একদিন তোমার কাছে নিজেকে সঁপে দেব। তারপর থেকে আর কখনও আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। বল কত টাকা দিবে?’ এতোটা সরাসরি এমন কথা শুনে বেচারা কী বলবে ভেবে পেল না।

আমি বললাম, ‘কেউ যেন না জানে জামাল ভাই। তুমি কাল রাতে পশ্চিমের জঙ্গলে দেখা কর। আমি কোনো ফ্ল্যাটে বা বাসায় যেতে পারবো না।’ বলেই ফোনটি রেখে দিলাম। আমি জানি জামাল ভাই সেটাই চাচ্ছে। পাড়ার পশ্চিমে পাহাড়-জঙ্গল আছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে এই জঙ্গলে যাওয়া যায়। আবার মেইন রাস্তার দিকেও যাওয়া যায়। আমি দুই টাকা দিয়ে দোকান থেকে মুখ শেভের ধারালো ব্লেড কিনলাম। বাড়িতে এসে ব্লেডের এক পাশের কাগজ কেটে ব্লেডের মাঝের যে ফাক আছে সেদিকে সুই দিয়ে সেলাই করে ব্লেডের সাথে কাগজ আটকে দিলাম। তারপর দুই আঙুলের ফাকে ব্লেড রেখে গালে টান দেবার সমস্ত পদ্ধতি ভেবে রাখলাম।

সন্ধ্যায় জামাল ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম আমার বিকাশে টাকা ছেড়ে রাত বারোটার দিকে ঢালু পাহাড়ে চলে এসো। সন্ধ্যায় বিকাশ চলে এসেছে। টাকার কথা বললাম তার মনে কোনো সন্দেহ না আসার জন্য। রাত বারোটার সময় আমি আগেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। খানিক্ষণ পরেই জামাল ভাই এসে উপস্থিত। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে ভীষণ৷ কিন্তু আমার মাথায় সমস্যা সমাধানের একমাত্র বুদ্ধি এটাই। এই পশুকে শেষ করতেই হবে। আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম সময় বেশী নিলে হবে না।

আমার ভয় করছে এখানে। সেও আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে এলো। আমি মমতাময়ী নারীর মতো দুই হাতে আলতো করে গালটা ছুঁয়ে দিলাম। দুই আঙুলের ফাকের ধারালো ব্লেড নারীর মতো দূর্বল মমতাময়ী না। গালটা ছুঁয়ে দেবার সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। টানটান গাল একদম “হা” হয়ে গেল। আমাকে প্রতিহত করার আগেই অন্ডকোষে চেপে ধরে মারার পর দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে বাসায় চলে এসেছি৷ ভয়ে আমার জ্বর এসে গেছে। সকালে এই জ্বর নিয়েই আবার টিউশনি ক্লাস সব শুরু করেছি৷ আমার বসে থাকলে চলবে না। ঘরে অসুস্থ মা আছে, ছোট একটি বোন আছে। আমার থেমে গেলে চলবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত