আমার প্রেমিকার খুব কষ্ট। বাড়িতে তাঁর বিয়ে নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তাঁর বড় আরো তিন বোন আছে। সবাই অবিবাহিত! একজন পরীক্ষায় আন্ডা পায় কিন্তু ডাক্তার হওয়ার আগে বিয়ে বসবে না! আরেকজন মানুষ আঁকলে গরু হয়ে যায়। সে চিত্রশিল্পে পদক পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিয়ে বসবে না! আর তিন নাম্বার মেয়েটির মাথায় একটু সমস্যা আছে। তাঁর মতে বিয়ে বসলে কবিত্ব ছুটে যাবে! তবে সে ভালোই লিখে। এর পরে আসে ইরা নামের মেয়েটা, যে গত তিন বছর ধরে বিয়ের জন্য বেকুল হয়ে আছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। তিন বোনের মতো তাঁরও একটা স্বপ্ন আছে। যমজ বাবুর আম্মি হবে!
ইরার রুমে কেউ যদি যায়। সে ভাববে এই রুমে কমপক্ষে আঠারোটি বাচ্চা থাকে! ছোট্ট ছোট্ট হাফপ্যান্ট, শার্ট, মোজা, টুপি, খেলনা ইত্যাদিতে রুমে পা ফেলার মতো জায়গা নেই! অথচ পুরো বাড়িতে একটিও বাবু নেই। আশেপাশের কোনো ভাবীর বাচ্চার যদি জ্বর হয়। তাঁর চিন্তার শেষ থাকে না! ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে শিখিয়ে দেয় স্কুলে গিয়ে আম্মির নাম ইরা বলতে। সে চকলেট দিবে। একবার ইরাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সে দিনের কথা কোনোদিনও ভুলবো না৷ ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম আমরা। পাশেই একজন মহিলা পুলিশ বসে ছিলো। তাঁর কোলে একটা বাচ্চা ছিলো। হঠাৎ তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল করিনি। যখন চোখ খুললাম। পুলিশ মহিলাটা নেই কিন্তু তাঁর বাচ্চা ইরার কোলে।
দুজনে ইলিবিলি করছে৷ ভাবলাম হয়তো বাচ্চার মা আশেপাশে কোথাও আছে। কিন্তু যখন স্টেশনে নামার পরে কয়েকজন পুলিশ আমাদের ঘিরে ধরেছে তখন বুঝতে পারলাম কাহিনী কী! মহিলাটা দৌড়ে এসে তাঁর বাবুকে ইরার কোল থেকে নিয়ে নিলেন। বাচ্চা ধরা হিসেবে আমাদের দুজনকেই জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। সে কী অবস্থা। রোগা রোগা মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। দুদিন পর যখন মহিলা আবার আসলেন। ইরা বললো, “ বাবুর হাত পা খুব গরম, জ্বর মনে হয়। ডাক্তার দেখাবেন। ” মহিলা তখনই বুঝে গিয়েছিলো এই মেয়ে বাচ্চাধরা হতে পারে না।
সে থেকে আর দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে আমি রাজি নই কমপক্ষে। তাছাড়া রাস্তাঘাটে কতোবার কোনো বাচ্চাকে চোখ মারতে গিয়ে বাচ্চার বাবাকে চোখ মেরে ফেলেছে। বাচ্চার মা তা দেখে অনেকবার দৌড়ানি দিয়েছে। এমন ঘটনা শ’খানেক! এই মেয়েটার কথা আর কী বলবো। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোজ ইরার বাপের কাছে বিচার নিয়ে যায়। সে আবার প্রাইমারিতে ভর্তি হবে। বাচ্চাদের সাথে ক্লাস করবে। কলেজ ভালো লাগে না।
এতো বড় একটা মেয়েকে তো আর ধমকও দেয়া যায় না। মারাও যায় না। সে যায়, ক্লাস করে। ছুটি হলে হৈ হৈ করে বাড়িতে আসে। ওদিকে কলেজে পরীক্ষা হচ্ছে না হেলিকপ্টার নামছে। তাতে তাঁর কিছুই আসে যায় না! হবু শ্বশুর মশাই বেশ চিন্তায় চিন্তায় মাঝে মাঝে আমাকে বলেন, “ আমার বড় তিন মেয়ের জন্য কতো মানুষ আসে৷ আর ছোট মেয়েটার জন্য উল্টে আমার চিন্তা হয়। এমন পাগলী মেয়েকে কে নিবে? ” সে সম্পর্কে আমার মামাতো বোন হয়। আমার মা থাকাকালীন সপ্তাহে কমপক্ষে একবার আসতো। তখন আমি লুঙ্গি কোমড়ে বেঁধে ঘুমুতে গেলে সে লুঙ্গি সকালে বারান্দায় পাওয়া যেতো! আর ইরা তো ছিলো কী পিচ্চি!
যখন বড় ভাবীর মেয়ে হয়। সে অনেকদিন থেকেছিলো। একটা সময় জেরিন ভাবীকে আন্টি ডাকতে শুরু করলো আর ইরাকে আম্মি! ইরার সাথে গেলে মেয়েটা মাস গেলেও আসতে চায় না। এদিকে জেরিনের মা একলা। ভালো লাগে না।
এ কারণেই ইরার এখন আসা কম হয়। একেবারে আসা হয় না বললেই চলে। জেরিন সাথে চলে গেলে আর বাড়ি আসতে চায় না! ইরা বৌ হয়ে কবেই আসতে পারতো। সমস্যা দুটো। এক, ইরার বড় তিন বোনের বিয়েতে এলার্জি বললেই চলে।
দুই, মামা মানে আমার হবু শ্বশুর মশাই আত্মীয়ের মাঝে মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। তাহলে নাকি ঝগড়া বেশি হয়। কিছু বলাও যায় না। সহ্য করাও যায় না! এমন কেনো মনে করেন আমি বুঝি না। গত হওয়া ইরার মাকে যতোদিন দেখেছি। চমৎকার মহিলা ছিলেন। আমি গেলে সবার আগে দু’তিনটে লুঙ্গি জোগাড় করে রাখতেন। ইরার মায়ের ফুফাতো ভাই ছিলো ইরার বাবা। উনি গত হওয়ার পর আমি আর নানু বাড়ি যাই না। তাছাড়া বাকি সব কটা মামার স্ত্রীরা আমাদের দেখলে যেন ভূত দেখার মতো করে। এজন্য আমি, বাবা, রবিন কেউই যাই না।
মাঝে মাঝে ভাবী একাকী অনুভব করেন। সারা বাড়িতে উনি একলাই মেয়ে মানুষ। কতো কাজ একলা করেন। ক্লান্ত হয়ে বসে থাকেন। কিন্তু কোনোদিন কারো সাথে নাখোশ হয়ে কথা বলেন না। কখনো কখনো আমার সাথে ঝগড়া হয়। আমি চুপ হয়ে থাকলে বলেন, “ আমি না থাকলে জেরিনকে তোরই দেখতে হবে। ”
তখন আমি পুরো দুনিয়া ভুলে যাই। এই নারীকে ছাড়া এই ঘরটা কল্পনাও করা যায় না। জেরিনের মুখ তাঁর বাবা দেখতে পারেনি। জেরিন হওয়ার কদিন আগেই তিনি মারা যান! সে কবেকার কথা। আজও তিনি সংসারটা একাই আগলে রেখেছেন। মাঝে মাঝে লুকিয়ে ভাবীর পায়ে সালাম করি। মাথা গুঁজে রাখি। দশ বছর আগে আম্মাজানকে হারিয়েছি। ভাই বিয়ে করার পর। কখনো মনে হয়নি এ ঘরে আমার মা নেই! ঘুম থেকে উঠে দেখতাম সব তৈরি। আমার ঘরি, শার্ট, জুতো আর মোবাইল। সাথে আলাদা করে নাশতা। সবার জন্য সবকিছু করে আবার আমার জন্য কীভাবে যে এতো কিছু করেন আমি বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাবী এই ঘরে দুটো আছে।
একজন সে নিজে। আরেকজন তাঁর আত্মা। যে তাঁকে সবসময় সাহায্য করে। একটা মেয়ে কতো পরিশ্রম করে পাইলট হয়? কতো ত্যাগ করে? আকাশে উড়ার স্বপ্ন নিয়ে কতো রাত জেগে জেগে বইয়ের পাতা উল্টিয়েছে। বিয়ের পরেও দেখেছি। জেরিন পেটে থাকা অবস্থায়। রাত আটটার আগে রান্নাবান্না শেষ করে সে পড়ার টেবিলে! রাতে কখন খেতো আমি আল্লাহ্ জানে। ভাই গত হওয়ার পরে মেয়েটা আকাশে আর উড়েনি। পাইলট হওয়ার পরে চারদিন তিনি বিমানে চড়ে ছিলেন। আলমারির উপরে পাইলটের ক্যাপটা আমি যখনই দেখি। শান্ত হয়ে যাই। ভাবীকে তখন আর বলতে পারি না।
আমার শার্টটা খুঁজে পাচ্ছি না। নিজে খুঁজি, এক ঘন্টা হয়ে যায়। পাই না। ভাবী খুঁজে, চোখের সামনে থেকে বের করে ফেলেন! তাঁর কপালের ঘাম দেখলে আমি বের হতে পারি না ঘর থেকে। ইরাকে ফোন দেই। কদিন এসে বেড়িয়ে যাও। দেখো রান্না করতে কতো ভালো লাগে। সারাদিন তো দৌড়াদৌড়ি করো। সে আসে না। বৌ হয়েই আসবে এবার। নাহলে কোনোদিন আসবে না! আমি কী করবো বুঝি না। ছোট ভাই নবন শ্রেণীতে পড়ে। ভাবীকে রোজই বলে। আমাকে একটা বিয়ে করিয়ে দাও। ভাবী হাসে। চোখের পানি খুব যত্ন করে লুকিয়ে ফেলে। ইরার সাথে ভাবীও একমত। ইরা আসলে বৌ হয়েই আসবে। নাহলে ইরার সাথে জেরিন চলে গেলে তিনি থাকতে পারেন না। ঘুমুতে পারেন না।
আমাদের এই অবস্থাটা ইরার বাবাকে বুঝানো যায় না। তিনিও ভালো মানুষ। বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করো। কিন্তু নিজের মেয়ে দিবেন না। আত্মীয়ের মাঝে কোনোভাবেই দিবেন না। আর আমার পক্ষে ঐ পাগলীটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না তা ভাবী জানে, পুরো দুনিয়া জানে। ভাবীর যখন জ্বর হয়। একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবাই যেন অচল হয়ে পড়ে। জেরিন আর রবিন স্কুলে যেতে পারে না। আমি কাজে যেতে পারি না। বাবা এই বয়সে চিন্তায় মরে। পুরো বাড়িতে হাসপাতালের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যেন কারো হাত নেই, পা নেই, চোখে দেখে না। অথচ একটা মানুষ, পুরো সংসারটা দেখে নেয়।
ইরার বড় বোনকে ব্যাপারটা খুলে বলার পর। সে বললো ইরার বড় মিরাকে পছন্দ হয় কিনা! মিরাকে ব্যাপারটা খুলে বললে সে বলে তাঁর বড় নূরাকে পছন্দ হয় কিনা! নূরাকে বললে সে সবার বড় নীরার দিকে আঙুল তুলে! কেউ আর ইরার কথা বলে না। ইরাকে বলি চলো তোমার যমজ বাবুর আম্মি হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করা যাক। সে আবার বাবার অমতে বিয়ে বসবে না!
বাবা প্রথমে তিন মেয়ের বিয়ে দিবেন তারপর ইরার কথা ভাববেন। যেহেতু সবচেয়ে ছোট মেয়ে। সেও চলে গেলে বাড়িটা খালি হয়ে যাবে। তার উপর তিনি আত্মীয়ের মাঝে আত্মীয় করতে বেদিশায় বিশেষ। সব মিলিয়ে আমি আছি খুব বিপদে। ভাবী অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজ করে! মানা করলে শুনে না। সাহায্য করার জন্য কোনো মেয়েকে রাখতে বললেও রাজি হয় না! ২০১৭, একুশে ডিসেম্বর।
ইরাকে ফোন করে বললাম। আমি তোর ভাই হয়েই থাকতো পারবো। এই জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু হতে পারলাম না। অনেক বাচ্চাদের তো আদর করিস। কদিন পরে আমার বাচ্চাটাকেও করবি আশা করি। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে। আমার সাথে মানাবে বলছে সবাই। কথাটা বলেছিলাম সকাল নটা বেজে চব্বিশ মিনিটে। আমার এখনো পাক্কা মনে আছে। তারপর ইরা আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলো নটা চুয়াল্লিশে! অথচ ইরাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আসতে হলে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগবে! সেদিন সে কীভাবে এক ঘন্টার রাস্তা বিশ মিনিটে চলে এসেছিলো তা আজও আমার কাছে রহস্য! শীতের সকালে সে ঘেমে একাকার! সঙ্গে কিছুই ছিলো না।
সোজা আমার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। চারদিকে জানালা বন্ধ করে দিয়ে সে রুমের ভেতর কী করছিলো কে জানে। তবে আমি যেরকম শব্দ শুনেছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার মতো। সেদিন রাতেই বিয়ে। এমনভাবে কারো বিয়ে হয় তা নিজে না করে জানতাম না। গরুর, খাসির মাংস দূরে থাক। সেদিন একটা মুরগীও জবাই করা হয়নি৷ না পড়েছিলো ইরা শাড়ি, না সে বধূ সেজেছিলো! যা পড়নে ছিলো তখন সেভাবেই।
থ্রী-পিস ছিলো গায়ে আর মাথায় একটা বেন। হাতে চুড়িও পড়েনি। শুধু বড় বড় দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিলো। কবুল বলার আগে কান্না করছিলো। আমি ইরার চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম৷ কতো করে চাচ্ছিলো বাবাকে দেখতে। বাবাকে সামনে রেখে কবুল বলতে। কবুল বলেছিলো সে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো। বিয়ের পরে সে চুল পরিমাণও পরিবর্তন হয়নি! ভেবেছিলাম দুদিন একটু শান্ত থাকবে৷ কথা কম বলবে৷ না তেমন হয়নি। এমনটা হওয়ারই কথা। এই বাড়ি, এই ঘর, এই আমি, রবিন, বাবা, ভাবী আর জেরিনকে সে চেনে। ভালো করেই চেনে৷ বাড়ির আশপাশটাও। মাঝে মাঝে আমি ইরার দিকে চেয়ে চিন্তা করি৷
একটা মেয়ে কীভাবে এতো বাচ্চা হয়। এমন একটা মুখ। সারাক্ষণ হাসি। কোনো চিন্তা নেই। ঘুমানোর সময় হলে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও সজাগ থাকতে পারছে না। আবার ভোর হলেই উঠে যাবে। যেমনটা বাচ্চারা করে। ইরা বৌ হয়ে আসার পরে ভাবীর কাজের ভার হয়তো কমেছিলো। কিন্তু ঝামেলা বেড়েছিলো। রাত-বিরাতে জেরিন আর ইরা গান গাচ্ছে, গলা ফাটিয়ে! ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুজন চেয়ার নিয়ে উঠোনে বসে আছে। ভূতের সাথে বন্ধুত্ব করবে!
মাঝে মাঝেই দুজন উধাও! সন্ধে হলে বাসায় ফিরে! এসব কান্ড ভাবীকেই শুধু চিন্তায় ফেলতো তা নয়। আমিও ভরকে যেতাম। ইরার বিয়েতে তবে তাঁর তিন মহা পন্ডিত বড় বোনেরা নাখোশ হয়নি। তাঁরা আসে, বেড়ায়, চলে যায়। যাবার আগে স্পষ্ট করে বলে যায়। এতো তাড়াতাড়ি তাঁরা বিয়ে করে মরছে না! একটা মেয়ে যখন মন প্রাণ উজার করে আপনাকে ভালোবাসবে। আপনার আশপাশের মানুষগুলোকে ভালোবাসবে। সে মেয়েটাকে আপনি চাইলেও কষ্ট দিতে পারবেন না। আমি কেমন ছেলে।
মাঝে মাঝে বকাঝকা করি। কী কারণে বকি নিজেও জানি না! সে চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি। না পেরে শেষে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। তাতেও কাজ না হলে। দু লঙ্কা ভাত মুখের কাছে তুলে ধরি, সব শেষ! ইরার মতো একটা মেয়ের প্রতি অভিমান করে নিজেকে সামলে রাখা খুব দায়। শ্বশুর মশাইও পারেনি। তিনি যেদিন এসেছিলেন ইরাকে নিতে। ইরা যেভাবে আমাদের বাড়িতে এসেছিলো। সেভাবেই চলে গিয়েছিলো! এক দৌড়ে রিকশায় বসে পড়েছে। বাবার কোলে মাথা রেখেছে। খুব বেশিদিন থাকেনি তবে। জেরিন ছিলো সাথে। এখানে স্কুল আছে জেরিনের। সে কথা ভেবেই চলে এসেছিলো আবার।
যখন ইরা মা হবে। পেটে একজনকে লালনপালন করছে। আমাদের চেয়ে বেশি উত্তেজিত কেউ যদি থাকে, সে হলো জেরিন। সে ইরার পেটে মাথা রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যায়! এতো কথা সে কীভাবে বলে? ২০১৯। জুলাই মাসের সাত তারিখ। সে রাতে আমার ঘুম হচ্ছিলো না। বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। সজাক হলে দেখি ইরা আমার গলায় ঝাপটে ধরে আছে। কপালে ঘাম। আমি ইরার কপালে হাত রাখলাম। খুব জ্বর! আমার ভোর হচ্ছে না আর। আযানের আগেই গাড়ির ব্যবস্থা করলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পরে শুনলাম পেটের মানুষটা আজকেই দুনিয়ার আলোয় আসতে চাইছে!
চিন্তায় চিন্তায় আমি শেষ। জেরিন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না একদম। ভাবী ডাক্তারদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন। আল্লাহ্ এর কাছে বারবার হাত পাচ্ছিলাম। মেয়েটার ইচ্ছে যমজ বাবুর আম্মি হবে। লাগবে না যমজ। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। যমজ হোক বা না হোক। দুজনে যেন সুস্থ থাকে। ইরার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। যমজ হয়নি। ছেলে হয়েছে। ইরার মতোই। ভাবীর নাকটা যেন। তবে ইরা মেয়েটা তাঁর বাবুকে কোলে নিতে পারেনি! হ্যাঁ, কোলে আমরা দিয়েছিলাম। ছেলেকে ইরার বুকে অনেকক্ষণ শুইয়ে রেখেছিলাম। নিজের রক্তের স্পর্শে যদি কিছু হয়।
সে দিনের কথা আমি লিখতে পারবো না। ছোট্ট মেয়েটার কান্না। হা করে ইরার দিকে চেয়ে থাকা। রবিন ছেলেটাকে আমি দেখিনি। নিজের ভাবীর চেহারা এরকম দেখে সে অভ্যস্ত নয়। এই মুখে সারাক্ষণ হাসি থাকে। কিন্তু সেদিন চুপ। একদম চুপ। একবার দেখে কোথায় গিয়েছিলো কে জানে। সে একটু দুঃখ পেলেই দূরে কোথায় চলে যায়। চোখের পানিতে কালো হয়ে যাওয়া ভাবীর দুচোখ। আর তাঁর তিন বড় বোনের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। এর চেয়ে বেশি সেদিনের কথা ব্যাখা করতে পারবো না।
আমি শুধু বারবার চোখ নিভাচ্ছিলাম আর খুলছিলাম। কোনোভাবে যদি এটা দুঃস্বপ্ন যেন হয়! হয়নি, তা সত্যি ছিলো। কঠিন সত্যি। খুব চেষ্টা করেও ঘরির কাঁটা আটকে রাখতে পারিনি। লোকজনদের বলছিলাম। ইরার ছেলেটাকে ইরার থেকে দূরে নিয়ো না। ইরা চোখ খুলবে। নিজের ছেলেটাকে একবার দেখবে। কেউ ততটুকু সময় দিলো না। কতো জলদি করে মাটির ভেতরে রেখে আসলো! এই মেয়েটার সকাল হলেই একটা মানুষ লাগে। একটু হৈচৈ করতে। সেখানে কী সকাল হলে এমন একটা মানুষ ইরা পাবে?
জানি না আমি। ভাবীর দিকে চেয়ে আমি চোখে অন্ধকার দেখি। আগে তো বড় বড় মানুষের খেয়াল রাখতে হতো। সেখানে যোগ হলো আরো এক জোড়া ছোট্ট ছোট্ট হাত পা! রবিন ছেলেটা মাত্র কলেজে পড়ে। প্রত্যেকদিন বিয়ের কথা বলে। বেশি বলে ফেললে, ভাবী গালে একটা থাপ্পড় মারে। তারপর নিজেই আঁচলে চোখ ঢাকে।