আমার তখন ৮ বছর বয়স,মা ভাইয়ার রুমে যেয়ে কি কি যেন বলতো,আর ভাইয়া মায়ের কথায় শুধু হ্যাঁ হু বলতো,বাহিরে থেকে কান পেতে শুনতে চাইতাম তারা কি বলছে,কিন্তু শুনতে পেতাম না,খুব রাগ হতো আমার তখন ছোট হওয়া নিয়ে,রাগে দুঃখে ভুত সেজে বসে থাকতাম,তখন মা এসে আমার রাগ ভাঙাতো,ভাইয়া আসতো না,আমার ভাইয়া হাসতো না,
শুনেছি বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ভাইয়া এমন,এতো বড় অফিসে চাকরি হবার পরেও সে খুশি হয়নি,তবে সে মায়ের কথা অমান্য করে না,মায়ের ভালো ছেলে,তাইতো কিছুদিনের মাথায় মায়ের কথামতো সে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়,এটা শুনে আমার খুশি আর কে দেখে,স্কুলে যেয়ে বান্ধবিদের বলতাম আমাদের বাসায় বউ আসবে,তোমরা সবাই দেখতে যেও কিন্তু,
হ্যাঁ আমাদের বাসায় একটা বউ আসলো,১৭ বছর বয়সের লক্ষি বউ,গায়ে বেনারসি জড়িয়ে যখন আমাদের বাড়িতে পা দিলো তখন আমার মনে হলো আমাদের ঘরটা অনেকখানি আলোকিত হয়ে গেলো,মা খুব যত্নে করে তাকে সব বুঝিয়ে দিতো,পানি ছাড়ার সময় সে উল্টোদিকে ট্যাপ ঘোরাতো,আমি সেটা দেখে মায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে হেসে কুটিকুটি হতাম,তার কাছে যেতাম না, খুব লজ্জা করতো আমার কেন জানি,তবে তার থেকে দুরেও থাকতে ইচ্ছে হতো না,তাই মায়ের আঁচল ধরে ধরে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম,পাড়া–প্রতিবেশিরা যখন মাকে বলতো.
-ভাবি সোহেল কে কেন গ্রামের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন,এ মেয়ে সোহেলের সাথে যায় না,শহরে কি সুন্দরি মেয়ের অভাব ছিলো নাকি তাদের কথা শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠতো,মনে মনে বলতাম,তাতে তোমাদের কি,ওইটা আমার লক্ষি ভাবি.
মা ও তাদের কথা ধরতো না,বলতো গ্রাম শহরে কি আসে যায়,গুণটাই আমার কাছে বড়,আর আমি জানি রুপার অনেক গুন,ও একদম আমার মতো, মা ঠিক বলছিলো,রুপা ভাবি ঠিক মায়ের মতই,একমাস পরই তা বুঝেছিলাম,সংসারী সব কাজ সে নিজ হাতে সামলাতো,মাঝে মাঝে মা খুব করে বকতো এতো কাজ করতো বলে,বলতো তুমি এখনো ছোট,তোমাকে এতো কাজ করানোর জন্য নিয়ে আসিনি,
তখন ভাবি মাথা নিচু করে সব শুনতো আর কান্না করতো,ভাবির মা ছিলো না,সৎ মায়ের হাতে মানুষ,শুনেছি উনি নাকি ভাবিকে সহ্য করতে পারতো না,গ্রামের বনিয়াদি পরিবারে জন্ম নিয়েও ভাবি কাটাতো যন্ত্রনাময় এক দুর্বিসহ জিবন, ভাবি যখন কাঁদতো মা তখন ভাবিকে আদর করে পাশে নিয়ে বসাতো,এসব দেখে মায়ের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা বেড়ে যেতো আমার,আমাদের বাসা থেকেই ভাবি ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দেয়,মা ভাবিকে রোজ নিয়ে যেতো পরিক্ষা দিতে,টানা ৩ঘন্টা বসে থাকতো মা পরিক্ষার হলের বাহিরে,ভাবিকে আবার সাথে করে নিয়ে আসতো,
সেই সুখের দিনগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ি ছিলো না,মা চলে গেলো আমাদের ছেড়ে বাবার মতো করে,আমি তখন বেশ ভালভাবেই সব বুঝতে শিখেছি,স্কুল ছেড়ে বাড়িতে এসেই দেখি মাকে সাদা কাপড় মুড়িয়ে শুইয়ে রেখেছে,দৌড়ে মায়ের কাছে এসেই সেদিন সেন্স হারাই ওইদিন, ভাবি সেদিন থেকেই আমার ছায়া হয়ে যায়,কিছু খেতে চাইতাম না,সারাদিন কান্না করতাম,ভাবি তখন বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে থাকতো আমাকে,মা চলে যাওয়ার পর ভাইয়া খুব একটা বাসায় সময় দিতো না,দিন রাত অফিসে পড়ে থাকতো,আমাদের দুইভাই বোনের বেহাল দশা,ভাবি তখনো শক্ত হাতে সব করে যাচ্ছে,মাঝে মাঝে অবাক হতাম,মা তো ভাবিকে খুব ভালবাসতো তাহলে ভাবি কেন কাঁদে না,
তাহলে কি ভাবি মাকে ভালোবাসতো না,সেই ভুল আমার ভেঙে যায়,শেষ রাতে যখন মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের ছবি নিয়ে ভাবিকে কান্নায় ভেসে যেতে দেখি, তারপর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে থাকে,আমাকে গোসল করানো খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব করতো ভাবি,রাতে আমাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখতাম ভাবি ই ঘুমিয়ে গেছে,কি করবে,এতে বড় সংসার,তাছাড়া দুটো মানুষের ভার,বয়সই বা কতো ভাবির,
আমি বড় হলাম,ভার্সিটি তে পড়ি,তবে ভাবি এখনো আমায় ভাত খাইয়ে দেয়,নইলে পেট ভরে না আমার,কিন্তু এখন আমার একটা ছোট প্রতিদ্বন্দ্বী আসছে,সেও আমার পাশে বসে ভাবির হাতেই ভাত খায়, আর আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকায় এবং বলে এটা আমার আম্মু,তুমি কেন আমার আম্মুর হাতে খাও হু? আমিও তখন আহ্লাদি হয়ে ভাবিকে জড়িয়ে ধরে বলি তোর আগে এটা আমার আম্মু ভাতিজী নম্বর ওয়ান ভাইয়া দুর থেকে তখন আমাদের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে, আর ভাবি আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলে দুটোই আমার কলিজার টুকরা, আসলেই কিছু ভালবাসার কোন সিমান্ত নেই,এগুলো লাগামহীন ভালবাসা