১২. প্রায় পাঁচ মিনিট চলার পর
প্রায় পাঁচ মিনিট চলার পর দেখা গেল আবার একটা সিঁড়ি।
সুব্রত অগ্রগামী লোকটাকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
সিঁড়িটা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা টানা বারান্দায়। বারান্দা দিয়ে খানিকটা এগুবার পর। সামনে দেখা গেল দুটো দরজা। একটা ভোলা, অন্যটা বন্ধ। লোকটা খোলা দরজাটার দিকে না গিয়ে বন্ধ দরজাটা দিকে এগিয়ে চলল।
সুব্রত হঠাৎ থামল। বললে, ঐ খোলা দরজাটা দিয়ে চল।
লোকটা ফিরে দাঁড়িয়ে আগের মতই খনখনে গলায় বললে, না।
সুব্রত ভ্রূ দুটো কুঁচকে সন্দিগ্ধ স্বরে বললে, কেন, না?
লোকটা বললে, এইটাই বাইরে যাবার রাস্তা। বলে সে বন্ধ দরজাটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
খোলা দরজাটা দিয়ে তাহলে কোথায় যাওয়া যায়?
লোকটা ভারী গলায় জবাব দিলে, অত খোঁজে তোমার দরকার কী? এ বাড়ির বাইরে যেতে চাও—চল বাইরে নিয়ে যাচ্ছি।
উঁহু, আগে আমাকে বলতে হবে ঐ দরজাটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়! সুব্রত কঠোর স্বরে প্রশ্ন করলে।
বলতে পারব না। লোকটা সমান গলায় জবাব দিলে।
সুব্রত পিস্তলটা উচিয়ে লোকটার দিকে আরও একটু এগিয়ে এল। তারপর তীক্ষ্ণ আদেশের। স্বরে বললে, দেখ সোনার চাঁদ, গোলমাল করে লাভ হবে না। পাশার দান উলটে গেছে। আমার হাতের মুঠোর মধ্যে তোমার মরণ-বাঁচন। আমার কথা না শুনলে মুহূর্তে তোমাকে কুকুরের মত গুলি করে মারতে পারি, তা জান? এসো, ভাল চাও তো লক্ষ্মী ছেলের মত দরজাটা খুলে এগোও।
না।
কিন্তু আমি বলছি, হ্যাঁ। তোমাকে খুলতেই হবে।
খুলব না। তোমার হাতের পিস্তলকে আমি ডরাই না। তাছাড়া মরার থেকে আমরা বেশী ডরাই নেকড়ের থাবা-কে।
সুব্রত ক্ষণকাল যেন কি ভাবলে। হঠাৎ মনে হল, তার মাথার ওপরে কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
এমনি করে প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত ভাবে আসন্ন বিপদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সময়ক্ষেপ করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বললে, বেশ চল, যে রাস্তা দিয়ে যেতে চাও।
লোকটা তখন অগ্রসর হয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বার করে একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খট্ করে খুলে ফেললে।
দরজাটা খুলতেই একটা ঠাণ্ডা শীতল হাওয়ার ঝলক এসে সুব্রতর চোখেমুখে যেন শান্তি ও আরামের ঝাপটা দিল।
আঃ! সুব্রত একটা আরামের নিঃশ্বাস নিল।
লোকটা দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বললে, চলে যাও—সামনেই রাস্তা।
সুব্রত একটু মৃদু হেসে বললে, ধন্যবাদ। কিন্তু বন্ধু, একা একা যেতে আমি রাজী নই। তোমাকেও আমার সঙ্গে কিছুটা পথ যেতে হবে।
আমি আর এক পাও যেতে পারব না। লোকটা দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল।
কিন্তু আমার হুকুম, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে।
যদি না যাই?
তবে যাতে যেতে বাধ্য হও সেই চেষ্টাই করা হবে।
লোকটা সুব্রতর কথায় সহসা বাজখাই গলায় হো হো করে হেসে উঠল। তারপর হাসতে হাসতে বললে, কোথায় যেতে হবে কর্তা?
এই খানিকটা রাস্তা—
নিশ্চয়ই থানায়?
খুব সম্ভব।
যাঃ, তুমি কিন্তু ঠাট্টা করছ।
তাহলে তুমি যাবে না?
না।
সহসা আর বাক্যব্যয় না করে সুব্রত বাঘের মত লোকটার ওপরে লাফিয়ে জাপানী যুযুৎসু প্যাচ দিয়ে চেপে ধরল—এইবার।
উঃ, ছাড়ছাড় লাগে। কী ইয়ারকি করছ।
সুব্রত ততক্ষণে পকেট থেকে একটা সিল্কের কর্ড বের করে বেশ করে লোকটার হাত দুটো বেঁধে ফেললে। তারপর উঠে দাঁড়াল—এইবার লক্ষ্মী ছেলের মত চল চাঁদ!
লোকটা সুব্রতর নির্দেশমতো উঠে দাঁড়াল। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই সুব্রত লোকটার কোমর থেকে চাবির গোছাটা কেড়ে নিয়ে পকেটে রাখল।
তরপর লোকটার ঘাড়ে জোরে জোরে দুটো ঘুষি মেরে বললে, চল বেটা।
লোকটাকে ধাক্কা দিতে দিতে সুব্রত এগিয়ে নিয়ে চলল।
সামনেই রাস্তা, কিন্তু অন্ধকার।
চারিদিকে একবার চোখ বুলোতেই ও বুঝতে পারলে, এটা চিৎপুর রোড।
তবে যেখান দিয়ে ও ঐ বাড়িতে প্রবেশ করেছিল, এটা সে অংশ নয়। অন্য একটা অংশ।
রাত্রি তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পূর্বাশার প্রান্ত ঘেঁষে রাত্রির বিলীয়মান অন্ধকার। প্রথম ভোরের উদীয়মান অস্পষ্ট আলোর চাপা আভাস দিচ্ছে।
রাস্তাঘাট এখনও নির্জন। লোকজনের চলাচল এখনও শুরু হয়নি।
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে লোকটাকে নিয়ে এগুতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ ও পিছন ফিরতেই দেখতে পেলে একটু আগে যে দরজাপথে ওরা বের হয়ে এসেছে, সেই দরজার সামনে চারজন লোক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
ও বুঝতে পারলে না যে, লোকগুলো ওদেরই অনুসরণকারী কিনা? কেননা লোকগুলো সহসা অদৃশ্য হয়ে গেল বাড়ির মধ্যে অন্ধকারে।
সুব্রত বোধ হয় সেখান থেকে দশ পাও এগোয়নি, সে আবার কি ভেবে লোকটাকে নিয়ে ফিরে এসে সেই চাবিটা দিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে আবার অগ্রসর হল।
সুব্রতর এখন প্রধান লক্ষ্য আশেপাশে কোন পুলিশ দেখা যায় কিনা। কিন্তু কাউকেই ও দেখতে পেল না।
এমন সময় হঠাৎ একটা ট্যাক্সি ঐদিকে আসছে দেখা গেল। সুব্রত হাতের ইশারায় ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করালে।
ট্যাক্সিটা দাঁড়াতেই সুব্রত লোকটাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে বসল এবং ড্রাইভারকে লালবাজার থানার দিকে চালাতে বললে।
ট্যাক্সি তীব্রগতিতে ছুটল লালবাজারের দিকে।
কিন্তু হঠাৎ সুব্রতর নজরে পড়ল, ট্যাক্সিটা লালবাজার থানার দিকে না গিয়ে উল্টোপথে ছুটছে!
ব্যাপার কি! ড্রাইভারটা কোথায় গাড়ি নিয়ে চলেছে।
সুব্রত একবার বন্দীর দিকে তাকাল। লোকটা নিঝুমভাবে গাড়ির সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে। সম্পূর্ণ নির্বিকার সে।
লোকটাকে কোথাও দেখেছে বলে সুব্রতর মনে হয় না।
আবার সুব্রত রাস্তার দিকে তাকাল। বুঝলে, গাড়ি আবার চিৎপুর রোডের দিকেই চলেছে।
ও তাড়াতাড়ি ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে বললে, এই, কোথায় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিস্? তোকে না লালবাজার থানার দিকে যেতে বলেছিলাম!
ড্রাইভার গাড়ির স্পিড় আরও বাড়িয়ে দিল, সুব্রতর কথায় সে কানই দিল না।
সুব্রত ক্ষিপ্রগতিতে পকেট থেকে পিস্তল বার করে ড্রাইভারের মুখের কাছে নিয়ে বললে, এই ভাল চাস তো গাড়ি থামা। নাহলে তোকে কুকুরের মত গুলি করে মারব শয়তান!
ড্রাইভার গাড়ির গতি আরও দ্রুত করে দিল। কী করবে এখন সুব্রত? এই স্পীডের ওপর। যদি সত্যি সত্যিই ও ড্রাইভারকে গুলি করে, তবে গাড়ি উলটে ওরা সবাই এখুনি মারা যাবে।
এমন সময় হঠাৎ গাড়িটা আবার ধীরে ধীরে থেমে গেল।
সুব্রত গাড়ির ব্যাট থেকে নেমে পিস্তল হাতে ড্রাইভারের সামনে এসে দাঁড়াল।–বেটা শয়তান! এখন তুই যদি আমার কথামত গাড়ি না চালা তো তোকে গুলি করে তোর মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!
এমন সময় হঠাৎ সুব্রত দেখলে চারজন যা-যা লোক গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুব্রত দেখলে, আর দেরি করা উচিত নয়। এক লাফে গাড়ির সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসে, হাতের পিস্তলটা ড্রাইভারের কপালে চুঁইয়ে বললে, শিগগির চল লালবাজারের দিকে।
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি আবার তীব্রগতিতে ছুটে চলল।
এবারে আর ড্রাইভার উলটোপথে না গিয়ে সোজা লালবাজার থানার দিকেই চলল।
গাড়ি যখন লালবাজার থানার গেটের মধ্যে এসে ঢুকল, সুব্রত গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দিকের দরজা খুলতে গিয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সিট খালি! বন্দী নেই!
গভীর উত্তেজনায় ও গাড়ির মধ্যে উপবিষ্ট বন্দীর দিকে তাকাবারও এতক্ষণ অবকাশ পায়নি।
ও বুঝতে পারলে গাড়ি যখন একটুক্ষণের জন্য থেমেছিল, সেই লোকগুলোই বন্দীকে নিয়ে পালিয়েছে।
রাগে সুব্রতর সর্বশরীর তখন ফুলছে। ড্রাইভারের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললে, চল্ বেটা থানায় চল, আজ তোর শয়তানির আমি শেষ করব।
ড্রাইভারকে নিয়ে সুব্রত সোজা তার অফিসঘরে এসে ঢুকল। চেয়ারের ওপরে বসে ও লোকটার মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটার বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। জাতিতে শিখ। লম্বা দোহারা চেহারা। মাথায় পাগড়ি। ঢিলে পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরনে।
কি নাম তোর?
বলবন্ত সিং।
লোকটা কি করে পালাল?
আমি কি করে বলব সাহেব! আমি তো সামনের সীটে বসেছিলাম!
শোন, এখন আমি তোকে যা-যা জিজ্ঞাসা করব, তার ঠিক ঠিক জবাব যদি না দিস, তবে তোকে এখুনি হাজতে বন্দী করব। আর যাতে দশ বছর তোর শ্রীঘর-বাস হয় তার ব্যবস্থা করব।
সাহেব, আমি কিছু জানি না–গরিব লোক।
এখন বল, ঐ লোকগুলোকে আগে থাকতে তুই চিনতিস কিনা?
আজ্ঞে না সাহেব।
তুই উলটোপথে গাড়ি চালিয়েছিলি কেন?
সাহেব, আমার কোন কসুর নেই। আমি ঐ পথে গাড়ি নিয়ে আসছিলাম, এমন সময় সেই বাড়ি থেকে চারজন লোক বের হয়ে এসে আমাকে দশটা টাকা দিয়ে বললে, এখুনি একজন লোক একটা বন্দীকে নিয়ে ওই পথে আসবে। ওদের নিয়ে উলটোপথে আবার এখানে আসবি। আমি ভেবেছিলাম আপনি ওদেরই লোক। সেই ভেবে আমি গাড়ি উলটোপথে নিয়ে গেছি। আমার কোন কসুর নেই সাহেব।
লোকগুলো দেখে তোর মনে কোন সন্দেহ হয়নি?
না।
ওদের কাউকেই তুই কোনদিন দেখিসনি? চিনতিস্ও না?
না, সাহেব। যে লোকটা আমার সঙ্গে গাড়িতে ছিল তাকেও না?
না, সাহেব।
বেশ, আজ সন্ধ্যাবেলা আবার তোকে আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে, পারবি?
কেন পারব না সাহেব—খুব পারব!
তোর গাড়ির নং, লাইসেন্স নং, ঠিকানা সব আমাকে দিয়ে হ্যাঁ। আর আজ সারাদিন তুই হাজতে থাকবি। ওখানে আমাকে পৌঁছে দিলে তোর ছুটি।
সুব্রত কলিংবেল টিপল। একজন সার্জেন্ট এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল।
এই লোকটাকে হাজতে বন্দী করে রাখ। আর এই গাড়ির লাইসেন্সের নাম্বার আমাকে দিয়ে যাও।
সার্জেন্ট লোকটাকে নিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
***
সুব্রত যখন আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ফিরে এল, বেলা তখন প্রায় সাতটা।
ভৃত্যকে ডেকে এক কাপ চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রত সোজা গিয়ে তার শয়ন-ঘরে প্রবেশ করল।
বড় ক্লান্ত সে। পরিশ্রমের ক্লান্তিতে সর্বশরীর তখন তার নেতিয়ে পড়েছে।
প্রথমেই সে কাপড়-জামা ছেড়ে স্নানঘরে গিয়ে বেশ ভাল করে মান-পর্ব শেষ করল। তারপর এক কাপ চা খেয়ে সোজা গিয়ে সে শয্যায় আশ্রয় নিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।