জামদিঘির পাশের মাঠটা তে খেলছিল ঘূর্ণি বন্ধুদের সাথে । এক্কা দোক্কা। লব এসে পেছন থেকে দিল মাথায় এক গাঁট্টা।
– কিরে বারবার পচ্চা যাচ্ছিস কেন? মন কোথায় তোর।
_ যেখানেই থাক তোর কি? তুই নিজের টা দেখ।
বলল বটে কথাটা ঘূর্ণি, কিন্তু নিজেই বুঝতে পারল সত্যি তার মন আজ খেলায় নেই। ওই যে দূরে টিলাটা দেখা যাচ্ছে, যার সামনে একটা কালো মিশমিশে ঘোড়া বাধা আছে ওখানেই ওর মন পড়ে আছে। একটুপরেই চারিদিকে ঘনকালো অন্ধকার নেমে আসবে। ওদের গ্রামের ছোট্টছোট্ট কুঁড়ে গুলোতে সন্ধ্যেবাতি জ্বলে উঠবে, তার আগেই ফিরতে হবে ঘরে। তবু ওই টিলার রাক্ষুসে মুখ ওয়ালা গুহাটা ওকে চুম্বকের মত টানছে। সেই যে সাদা চুল দাঁড়িতে ঢাকা মুখ, একটা যুদ্ধের পোশাক পড়া মজবুত শরীর আর কালো উজ্জ্বল দুটো চোখ কিছুতেই ভুলতে পারছে না ঘূর্ণি। লোকটা গুহার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।
রাতে ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ঘুমোনোর আগে জিজ্ঞাসা করল বাবা মার কথা। প্রতিদিন ই শোনে বাবা বীর সিং কতটা বীর যোদ্ধা ছিল। ঠাম্মা বলে তার বাবা ছিল শোনপুরের রাজার সেনাবাহিনী তে এক অশ্বারোহী সেনা । কত যুদ্ধ জয় করেছিল …
ওই যে বছর, শেষ ওর বাবা যুদ্ধে গেল, কিন্তু আর ফিরল না, সেই বছর ই ঘূর্ণির জন্ম হল। জন্ম দিয়ে মা ও মরে গেল। বুড়ি ঠাকুমাই তো কোলে পিঠে মানুষ করেছিল। বাবা মা কাউকেই আর চোখে দেখা হল না। ও জানে, বুড়ির ছোট্ট লোহার সিন্দুকে একফালি কাপড়ের টুকরো আছে, ওতেই আঁকা আছে একটা ঘোড়া, যার পাশে দাঁড়ানো এক সৈনিক, পরনে লোহার বর্ম হাতে তরবারী। মা এর আঁকা। ঠাম্মার মুখে শুনেছে মা সারাক্ষন ওই কাপড়টা বুকে জড়িয়ে বসে থাকতো উদাস চোখে। এই কাপড়টাকেই বারবার ছোঁয় ঘূর্ণি, বাবা মা দুজনেই যেন কাপড়ের টুকরো তে লুকনো আছে।
নীল জোছনা ধোয়া বিছানায় ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে দেখতে পায় দূর থেকে একদল সৈন্য ধুলোয় অন্ধকার করে ছুটে আসছে তরবারী হাতে। শুনতে পায় ঘোড়ার খুরের শব্দ। খুঁজতে থাকে বাবার মুখ। চিনতে পারে না, দেখে নি যে বাবার মুখ কখনো। তবু বাবাকে দেখার কি অদম্য আকুলতা,বাবাকে জানার অসম্ভব ইচ্ছে তোলপাড় করে ছোট্ট ঘূর্ণির মন।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে। গুটি গুটি পায়ে কখন যেন পৌছে গেছে টিলার সামনে। কালো ঘোড়াটা একটা মাটির পাত্রে মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে। একপা একপা করে এগিয়ে টিলার পেছন দিকটা চলে এল ঘূর্ণি। ভারি সুন্দর জায়গাটা, কত রকম নাম না জানা ফুল ফুটে আছে। ওপর থেকে একটা ঝর্ণার ক্ষীণ ধারা নিচে নেমে এসেছে। এর আগে কখনো এদিক টায় আসে নি ঘূর্ণি। কেমন তন্ময় হয়ে দেখছিল চারিদিক। হটাৎ ঘোর কাটলো পেছনে একটা গম্ভীর গলা শুনে ।
– খুকি এখানে কি করছ।
খুব অবাক হল পেছনে তাকিয়ে । আরে এটা তো সেই যুদ্ধের পোষাক পরা দাড়িগোঁফ ওয়ালা লোক টা। সে এখানে কি করছে? ভয় পেল না।বলল,
– আমি ঘূর্ণি, তুমি কে? কোথায় বাড়ি তোমার?
– আমি একজন সৈনিক। দুউউউর রাজ্যে বাড়ি। কিছুদিন বিশ্রাম নেব বলে এসেছিলাম। আজ ই ফিরে যাব। তা তুমি এখানে কি করছ ঘূর্ণি। চোখজুড়ে শুধু বিস্ময় তখন। একদম সেই ছবির মত, যা সেই কাপড়ের টুকরোতে আঁকা আছে। লৌহবর্ম পরিহিত,হাতে তরবারী। একটু এগিয়ে গিয়ে বলল ঘূর্ণি,
– তুমি কি যুদ্ধে যাবে? আমার বাবাও সৈনিক।
– নিশ্চই । কোথায় তোমার বাবা? আনমনা চোখে বলল,
– বাবা যুদ্ধে গেছে সেই কবে? আর ফেরেনি।
তুমি খুঁজবে আমার হারিয়ে যাওয়া বাবা কে? ছোট্ট মেয়ের করুন মুখ দুই হাতের তালুতে নিয়ে সৈনিক সব বুঝল, কেন হারিয়ে গেছে তার বাবা। অনেক্ষন নীরব চোখের ভাষায় নিজেকে ভিজিয়ে নিতে নিতে বলল, বাবারা কখনো হারায় না ঘূর্ণি। তোমার মধ্যেই আছে । তোমার ভাবনায়, তোমার বড় হওয়ায় ,কল্পনায়, খেলায় , সব জায়গায় আছে। তোমার আনন্দে , মন খারাপে চোখ বন্ধ করলে যে ছবিটা দেখতে পাবে সেটাই তোমার বাবা। আজ আসি ? দূরে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে ধুলোয় মিলিয়ে যেতে দেখল ঘূর্ণি কালো ঘোড়াটাকে যার পিঠে বসে ছিল সেই যোদ্ধা যে পেছন ফিরে তাকায় নি আর। হটাৎ চোখটা বন্ধ হয়ে গেল যেন, আর তখুনি দেখতে পেল ধূসর কুয়াশার মধ্যে থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে আসছে তরবারী হাতে একটা আবছা অবয়ব ।