ময়দানের বিকেল বেলার দৃশ্যটা অসাধারণ। সেটাই দেখছিলাম প্রতিদিনকার মতোই , এক ঝাঁক পাখি প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে উড়ে যায় এদিক থেকে সেদিক । বড্ড পরিচিত এই দৃশ্য তবুও যেন ভালোলাগে এটা খুব , মনে হয় যেন একখান থেকে বার্তা সংগ্রহ করে অন্য এক প্রান্তে সেটাকে বহন করে নিয়ে চলছে , ঠিক যেন মনে হচ্ছে ওদের সাথে দূর দুরান্তরের কোনো সংযোগ রয়েছে এক নিবিড় বন্ধনের মাধ্যমে।
এই দৃশ্যের প্রতিটা ছবি আমার মনের জানালার মতোই ডাইরির প্রতিটা পাতার ভাঁজেও লুকানো থাকে , প্রতিটা ছবির এক জীবন্ত রূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি আর কি । সারাদিনের অফিস ফিরে ক্লান্ত হয়েও ডাইরি লিখি রাত্রে , না না সেটাতে আর কোনো ক্লান্তি থাকে না আমার বরং বেশ ভালোই লাগে । আসলে ওই ডাইরির পাতার ভাঁজে ভাঁজে থাকে আমার প্রশান্তির সুখ যেটা শুধুমাত্রই আমি ঐ ডাইরিটা লিখেই পাই।
আমি মনে করি আমার মতই সবারই একটা করে ডাইরি থাকা দরকার যেখানে সে তার আবেগ গুলো , কষ্ট গুলো জমিয়ে রাখতে পারবে , আবার যার সাথে কষ্ট গুলোকে ভাগও করে নিতে পারবে । আমার ডাইরিটা আমার কাছে ঠিক তেমনই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যাকে আমি আমার সব কষ্ট গুলো বলি কিন্ত সেগুলো শুনে সে কখনো হাসে না , আবার আমি তার সাথে আমার দুর্বলতার গুলো ভাগ করে নেয় কিন্তু সে কখনো দুর্বলতার সুযোগ নেয় না , আমি কথা বলতে ভালোবাসি খুব সে জন্য সে সব কথা শোনে কিন্তু কখনো বিরক্ত হয় না ।
সেদিন থেকেই ডাইরিটা আরও অনেক বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছিল যেদিন থেকে আমার শরীরটা কারোর চাহিদা হয়ে উঠেছিল । কর্পোরেট সেক্টরে কর্মরতা আমি , প্রথম দিকে বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো ।আমাদের বস মিস্টার সৃজন ঘোষ ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব । প্রথম প্রথম কাজ করতে বেশ ভয় লাগত কিন্তু মিস্টার ঘোষ এর সহায়তায় খুব তাড়াতাড়ি ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম । অফিসের অনেকের সাথেই কম সময়ে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল , কিন্তু বিধাতা বোধহয় নীরবে হেসেছিলেন ।
মাস দুই আগে ব্যাপারটা প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম । অফিসের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সের তরুণী ছিলাম আমি তাই বাকিদের মধ্য বয়সের ছাপ আসলেও সেটা এখনো আমাকে ছুঁতে পারেনি , আমি ছিলাম এক কথায় সুন্দর , স্লিম ফিগারের মেয়ে কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো সময়ের নাগপাশে। স্যার মানে সৃজন ঘোষ আমাকে মাঝে মধ্যেই ডেকে পাঠাতেন তার কেবিনে কাজের জন্য , কখনো কখনো তার ফাঁকে বেশ গল্প জুড়ে দিতেন বেশ মজার ছিলেন সৃজন বাবু কিন্তু কতটা ভুল ছিলাম আমি সেদিন যদি তার চোখের দিকে না তাকাতাম বুঝতেই পারতাম না ।
তখন অফিসে টিফিনের পর আনমনে বসে কম্পিউটার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম এক ভাবে হঠাৎই একজন এসে বললো যে সৃজন স্যার ডাকছে ভেতরে, গেলাম টুকটাক কিছু কথা বলার পরই হঠাৎই জিজ্ঞেস করল এখনো বিয়ে করোনি কেন? মনের মানুষ পাওনি নাকি বেশ অদ্ভুত লেগেছিল আমার প্রশ্নটা শুনে । এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম তারপর আচমকাই বলল মনের মানুষ তো সামনেই আছে বুঝতে পারছো না ? জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি আপনি কি সব বলছেন বুঝতেই পারছি না আর তখনই দেখলাম তার চোখ আমার শাড়ির ফাঁকে বেরিয়ে থাকা পেটের দিকে , উফফ কি বাজে দৃষ্টি , একটা বাজে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তখন , কিন্তু কিচ্ছু করতে পারলাম না বেরিয়ে চলে এলাম । এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রায় রোজ হত তারপর শাড়ি ছেড়ে চুড়িদার পড়তাম কিন্তু সেখানেও তার সেই লালসাময় চোখ থেকে রেহাই পেতাম না। একটু ঝুকে কথা বললেই তার চোখ চলে যেত আমার বক্ষযুগলের খাঁজের মাঝে। বাড়ি এসে রোজ কাঁদতাম আর সেই কষ্ট গুলো লুকানো থাকত ডাইরির পাতার ভাঁজে , সেই ছিল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ।
কিন্ত না গতকাল আর থেমে থাকিনি সেই ঘটনার আবারও যখন পুনরাবৃত্তি হল তখন তাকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার মিস্টার সৃজন ঘোষ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বেশ আমি তাহলে খুলে দেখিয়ে দেই সবটা , দেব নাকি । আপনার ঘরে বউ থাকা সত্তেও যে নোংরামো গুলো করেন সেগুলো ওরা জানে তো আরেকটা কথা আমাদের মেয়েদের সবকিছু তো একই শুধু সাইজের পার্থক্য কি মশাই কত সাইজ আপনার বউয়ের । কালকের ঘটনাটাতে বেশ লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল উনার কেবিনের সামনে বেশ লজ্জিত হয়েছিলেন তিনি এবং সবার সামনে হাত জোড় করে ক্ষমাও চেয়েছিলেন । জিতে গেছিলাম আমি। এক একসময় মনে হত চাকরিটা ছেড়ে দেই কিন্ত পরক্ষণেই ভাবতাম নিজের যোগ্যতায় সেটা পেয়েছি একটা বাজে মানুষের জন্য কেনই বা ছাড়ব সেটা ।
নতুন করে আবার সবটা শুরু করলাম। যে ডাইরিটার মধ্যে আমার মনের সবকথা বিশ্বাস করে লিখি সে কখনও সেগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা করে না । যখন হেরে যাই তখন সে আমাকে এক নতুন পৃষ্ঠা দেয় নতুন ভাবে শুরু করার আজ অনেকদিন পর একটা নতুন পৃষ্ঠায় থাকবে আমার জেতার গল্প ।
সত্যি সবার সবসময় খারাপ যায় না , সময়ের অপেক্ষা করলে সত্যিটা সবাইকে বুঝিয়ে দেয় । মাথা উঁচু করে অফিস যেতাম এরপর থেকে , সবাই আলাদা ভাবে সম্মানের চোখে দেখত । অফিসের কয়েকজন মহিলা কর্মী এটাও বলেছেন আমাকে তুমি আমাদের গর্ব অদ্বিতীয়া, তোমার নামের সাথে কাজেরও বেশ মিল তুমি এমন একজন যে কি না অন্যায়ের সাথে তাল না মিলিয়ে সেটার প্রতিবাদ করে ।
আমি জানতাম জীবনের চাকা ঘুরবেই শুধু তার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে আমাদের তাহলেই নিজেদের ক্ষেত্রে জিততে পারব। আর আমাদের ডাইরি থাকা খুব দরকার যেখানে আমরা দুঃখ-কষ্ট , ভালোলাগা – মন্দলাগা ভাগ করে নিতে পারব ।