আওয়াজ পেতেই ধীর পায়ে বারান্দায় এলেন অমিতা দেবী,আজকাল খুব একটা বারান্দায় আসেননা,তবে এমন ভাবে গাড়ির শব্দ হলো যে,মনে হলো অরুনাভর গাড়ি! যাঃ ,কি সব ভুলভাল ভাবছেন,অরুনাভর মৃত্যু বছর দুই পূর্ণ হলো,তবু এখন তার মাথা থেকে এসব যায়নি। বাড়ির সামনে গাড়ি থামার আওয়াজ পেলেই মনে হয় এই বুঝি অরুনাভ গাড়ি থেকে নেমে হাসতে হাসতে বাড়ি ঢুকছেন।
বারান্দায় এসে ভালো করে চারদিকটা তাকিয়ে নিলেন,নাহ্ কেউ নেই,রাস্তার কোনো গাড়ির আওয়াজ হয়তো!
বেতের চেয়ারটায় এসে বসলেন অমিতা। এই চেয়ারটা একবার অরুনাভ তাকে জন্মদিনে উপহার দিয়ে বলেছিলেন তোমার অবসরে এখানে বোসে আমাদের কথা ভেবো। এখন তার অখণ্ড অবসর, সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটতেই চায়না।মাঝে মাঝে নিজের জীবনটা নিজের কাছেই দুর্বিসহ লাগে, কতগুলো যন্ত্র মানবের মাঝে থাকতে থাকতে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন,কারো সাথে বসে যে দুদন্ড কথা বলবেন তো কারও সময় থাকলে তো!
সকাল দশটার আগে শুভ মানে তার ছেলে অফিসে চলে যায়, তার পরে বৌমা রিমা চলে যায় নার্সিং হোমে, সে সেখানকার সিনিয়র নার্স। অপূর্বা তার নাতনী কলেজে পড়ে, সে চলে যাওয়ার পর কাজের বৌটিও কাজ সেরে চলে যায়। সকাল সকাল স্নান সেরে পুজোটা সেরে নেন অমিতা। তারপর খাওয়া আর ওষুধ খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। দুপুরে একটু ঘুমের ভাব থাকলেও তিনি ঘুমোন না, কারণ দুপুরে ঘুমোলে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনা । সারাটা দিন একা একা। নাতনী অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলে, কোনো একটা মিষ্টি মধুর সম্পর্কে জড়িয়েছে এটা তিনি বেশ বুঝতে পারেন। একদিন সুযোগ পেয়ে জিগ্যেস করেছিলেন তিনি।
অপূর্বা বলেছে আজকাল কি আড়ি পাতো নাকি ঠাম্মা! তোমারও কি ছিল নাকি বয়ফ্রেন্ড, থাকলে বলনা, খুঁজে বের করি তাহলে আর একা লাগবে না তোমার! তবে রে দুষ্টু মেয়ে, চালাকি করে কথা ঘোরানো হচ্ছে তাই না! অপূর্বা বলে, তাকে একদিন নিয়ে আসবো তোমার কাছে, তুমি আগে পছন্দ করলে তবেই আমরা বিয়ে করবো, তবে একটু দেরী আছে বিয়ের! সবে চাকরি পেয়েছে অনির্বাণ, একটু গুছিয়ে নিতে নিতে আমিও কলেজ পেরিয়ে যাবো। অমিতা বলেন তুমি চাকরি করবে না দিদিভাই? মোটেই না ঠাম্মা, চাকরি করলে সংসার করবো কখন! দুজনেই নাকে মুখে গুজে ছুটবো নাকি! বাবা মায়ের মতো ক্লান্ত হয়ে ফিরবো, ছোট ছোট কাজের ভাগাভাগি করবো, কমবেশি খরচ নিয়ে ঝগড়া করবো, ওসব আমার মোটেই ভালো লাগে না। তোমার মতো জীবন আমার ভালো লাগে।
অমিতার আবার জীবন! সেই কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে এসেছিলেন, জমজমাট ছিল তখন বাড়ি, শাশুড়ি মায়ের সাথে হাতে হাতে ঘরকন্না করতে করতে কবে যে সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন নিজেরই আর মনে পড়ে না।
বেশীরভাগ সময় পুলিশের চাকরি নিয়ে বাইরে বাইরে কেটেছে অরুনাভর, অমিতা থেকে গেছে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে। শুভর ছোট বেলায় বছরে কয়েক মাস যেতেন স্বামীর কাছে, তার চাকরি স্থলে, তবে যখন থেকে স্কুলে ভর্তি হোলো শুভ তার পর থেকে আর যাওয়া হয়নি তার, শুভর পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে। শেষের চার বছর অরুনাভ কলকাতায় পোষ্টিং পেয়ে চলে এসেছিলেন।তাঁর চাকরি শেষ হওয়ার আগে শুভ চাকরি পেয়ে গেছিলো। তারপর একদিন হঠাৎ তাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে রিমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। অমিতা মেনে নিলেও অরুনাভ মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। বলতেন সারাজীবন বাইরে থেকে টাকা রোজগার করে সব সুখ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে কি লাভ হলো বলতো, আমাদের কোনো মূল্য থাকলোনা।
অমিতা বললো ওভাবে ভাবছো কেন? ভাবো তো ওরা সুখী হলে কি আমরা হবো না? থাক না আমরা ভালোবাসা দিয়ে সবটা আমাদের মনের মতো করে নেব! কার কথা বলছো তুমি, ছেলেই যখন নিজের হোলোনা তখন বৌমা! তুমি তাকে কাছে পেলে তো! সে তো আবার চাকরি করে,তার ঘরকন্না শেখার উৎসাহ থাকবে? অরুনাভর কথাটা মিলেই গেল, রিমা কতটুকু সময় পায়! বিয়ের সময় টাটার একটা বড় হাসপাতালে চাকরি করতো, ওখানে ছিল প্রথম তিন বছর। তারপর অপূর্বা মানে অপু হওয়ার আগ দিয়ে তাদের কাছে চলে এসেছিল, তবে ঐ আসাই সার! কোনদিন সেভাবে মেশার চেষ্টাই করেনি, ফাঁক থেকে গেছিলো তাদের সম্পর্কের।
বছর তিনেক পর আবার একটা হাসপাতালে জয়েন করে রিমা, অরুনাভ বলেছিল থাক না, আর কিছুদিন পর না হয় চাকরি রিমা বলেছিল অনেক দিন তো আরাম করলাম, মেয়ের সবকিছুই তো ঠাম্মা সামলে নিচ্ছে, আমি শুধু শুধু অমিতা জোর করে কোনো মতামত চাপিয়ে দেননি রিমাকে, আসলে তাদের মধ্যে তেমন কোনো বন্ডিং তৈরী হয়নি কখনো। সে সময় মতো গেছে, এসেছে এসব নিয়ে শুভ যখন কিছু বলেনি তো তিনি কেন? ছয় বছর পর অন্তু তার নাতি হওয়ার পর অরুনাভ বলেছিলেন এবার চাকরিটা ছেড়ে দাও বৌমা, বাচ্চারা মায়ের সঙ্গ পাবে! রিমা বলেছে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে প্রবলেম তো, লোক রেখে দেবো, ওরাই সামলে নেবে। বাচ্চা রাখার জন্য ট্রেন্ড আয়া রাখা হয়েছিল।
মাঝে মাঝে শুভ ও রিমা পার্টিতে যেতো, মাঝরাতে ফিরতো ড্রিংক করে, সেদিন ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতো, চাপা গলায়, তবু ওদের আওয়াজ চার দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসতো। দু একবার অরুনাভ বলেছিলেন তোমরা এভাবে ঝগড়া কর, তোমাদের ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে, ওদের মনে তাকে থামিয়ে দিয়ে রিমা বলেছিল, একটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এটুকুই হতেই পারে, আর আমি ছেলেমেয়েদের ঐ সেকেলে মানসিকতার তৈরী করবো না, যাতে ওদের মনে তার কোনো এফেক্ট পড়ে। অমিতা ইশারায় থামিয়ে দিয়েছিলেন অরুনাভকে। কি দরকার! যদি তারা আলাদা করে সংসার পাতে, সেই ভয়টা পেয়ে বসেছিলো অমিতাকে। অন্তুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছয় বছর বয়েসে তাকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিয়ছিল রিমা, শুভর কোনো বারণ ছিলোনা, অরুনাভ বলেছিল যারা বোডিংএ যায়না, তারা কি মানুষ হয়না!
রিমা বলেছিল ছেলে আমার হলেও বংশধর তো আপনাদের, আপনারা কি চান না ও মানুষ হোক? এখনি আমার কোনো কথা শোনেনা ও, আপনাদের আদরে আদরে চলে গেছিলো সে ছেলেকে টেনে নিয়ে সেখান থেকে। অরুনাভ আর কিছু বলেন নি। অরুনাভ চলে গেল হার্ট অ্যাটাকে, চিকিৎসার জন্য সময় পাওয়া যায়নি। অমিতা নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। তারপর থেকে প্রায় বাড়িতেই পার্টি হতো, ভালমন্দ পদ বাইরে থেকে আনানো হতো, তার সাথে চলতো বিদেশী নানান মদের ফোয়ারা। রিমাকে অন্য পুরুষদের কোমর জড়িয়ে নাচতে দেখেছেন কতবার, প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গেছেন, শুভ যখন কিছু বলেনা তো তিনি বলে কি করবেন!
এগুলো নাকি এখনকার ট্রেন্ড! বড্ড বেমানান তিনি এই পরিবারে।তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন ধীরে ধীরে।
অপু ফিরলো কলেজ থেকে, কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দিলেন অমিতা। সে ঢুকেই বললো সুন্দর করে সেজে নাও তো ঠাম্মা, তোমায় নিয়ে একটু ঘুরে আসি! সারাদিন ঘরে বসে থেকে বোর হয়ে যাও না তুমি! সে কি কোথায় যাবে গো, আমায় নিয়ে টানাটানি কেন? বন্ধুরা সব কোথায় তোমার! মা বাবা জানতে পারলে উফফ্ ঠাম্মা, আজ শুধু তুমি আর আমি, মায়ের ফিরতে রাত হবে, বাবা তো দশটার আগে ফেরেই না। আর তুমি ওদের এতো ভয় পাও কেন, ওরা ভাবে কখনো তোমার কথা;চল আমরা একটু ঘুরে আসি আজ। আর তোমায় আমি সাজিয়ে দেব, দাঁড়াও বলে নিজের ঘরে ঢুকলো অপু। খানিক পরে অমিতার ঘরে এসে এক সেট কুর্তি সালোয়ার দিয়ে বললো জলদি পরে নাও, দেখি তোমায় কেমন লাগে!
পাগল হলে দিদিভাই, এসব বেশ মানাবে, চুপচাপ পরে নাও।
অমিতা আর না করলেন না, অনেক দিনকার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল মনে, বৌমার প্যান্ট সার্ট পরা ছবি গুলো দেখে একদিন বাড়িতে কেউ না থাকা অবস্থায় পরে নিয়েছিলেন কর্তার পোষাক, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে চুপচাপ আবার খুলে রেখেছিলেন। এরকম অনেক ছোটখাটো ইচ্ছের পাহাড় জমেছিল মনে। বাহ্ ঠাম্মা ইউ আর লুকিং সো প্রিটি! তন্ময় হয়ে ছিলেন নিজের মধ্যে, লজ্জা পেলেন নাতনীর কথায়, বললেন যাঃ! হায় হায় আমার ছম্মক ছল্ল বলে জড়িয়ে ধরলো তাকে অপু। ক্যাব ডেকে উঠে পড়লেন তারা, ভাগ্যিস কেউ ছিলোনা বাইরে তাহলে আরো লজ্জায় পড়তে হতো অমিতাকে। একটা নামী কফি ক্যাফের সামনে থামতে বলে অপু, ভাড়া মিটিয়ে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে সে! টেবিলে গুছিয়ে বসতেই একটা সৌম্যকান্তি ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়, অপু পরিচয় করিয়ে দেয় এ হলো অনির্বাণ যার কথা তোমায় বলেছিলাম, প্রণাম করে অনির্বাণ অমিতাকে।
তিনি হা করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, অপু বলে পছন্দ হয়েছে তোমার ঠাম্মা, যদি না হয় তো বলে দাও, আজই রিজেক্ট করে দি! অনির্বাণ বলে প্লিজ ঠাম্মা, আমাকে বাঁচান! আপনি যদি না বলেন তো… তার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলেন অমিতা। বললেন অপুকে খুব জব্দ করেছো না এভাবে আমায় নিয়ে এসে, ছিঃ ছিঃ এই পোষাকে ঠাম্মা একটা কথা বলি, আপনাকে না আপনার নাতনীর চেয়ে এই পোষাকে বেশী কিউট লাগছে, অনির্বাণের কানটা ধরে মৃদু নেড়ে দিয়ে তিনি বললেন তুমিও তো দুষ্টু কম না! ক্যাফেতে জমে উঠলো তাদের আড্ডাটা! এই একটা সন্ধ্যার আড্ডাটা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল অমিতার।