“দিশা গতকাল বিকেলে গুরুদেব ফোন করেছিলেন কাশীধাম থেকে।উনি আগামী সপ্তাহের বুধবার আমাদের বাড়ি পদধূলি দিতে আসছেন সঙ্গে ওনার দুজন শিষ্য। এদিকে মতির মাও দেশের বাড়ি যাবে বলে দিন দশেকের ছুটি নিয়েছে।গুরুদেবের যা বাদবিচার তাতে আমাদের আমিষ খাবারের সাথে ওনার নিরামিষ মিশে গেলে অনর্থ হবে।আর উনি ক্ষেপে গেলেই অমঙ্গল।তুমি বরং ওদিন তোমার অফিস ছুটি নিয়ে নাও নইলে আমি একা হাতে সবটা করে পারব না”,সকালে প্রাতরাশ টেবিলে বৌমা দিশার উদ্দেশ্যে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ওর মুখের ভাবটা লক্ষ্য করার জন্য আড়চোখে তাকান শাশুড়ি মীনাক্ষীদেবী।
অফিসে বেরোনোর জন্য তৈরি হতে থাকা দিশা এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনলেও এবার আর চুপ করে না থাকতে পেরে বলে,”আচ্ছা মা গুরুদেব আসছেন বলে তো আপনার ছেলে তার অফিস ছুটি নিচ্ছেনা। তাহলে আমার বেলা কেন এই নিয়ম বলতে পারেন?” এমন একটা উত্তরের জন্য বোধয় তৈরি ছিলেন না মীনাক্ষী,চমকে তাকান পুত্রবধূ দিশার দিকে।গোটা ঘর জুড়ে নেমে আসে একরাশ নিস্তব্ধতা।
মেয়ে মানেই যখন যে কোনো দরকারে খেয়াল,খুশিমত ডাকলেই পাওয়া যাবে(always available) এমনটা নয়। ইসস গতকাল অনেক রাতে ফিরে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ট্যাক্সি নিয়ে এখনও লর্ডসের মোড়ে স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে যে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? কোনমতে নাকেমুখে গুজে খেয়ে উঠে কলতলায় দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে মিউমিউ করতে থাকা বিড়ালছানাটার দিকে কাঁটাগুলো ছুঁড়ে দিতে গিয়েই বুকের বা দিকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন শোভনবাবু। তারপর সব অন্ধকার। হাসপাতালের বেডে যখন জ্ঞান ফেরে তাকিয়ে দেখেন ওনার স্ত্রী আর মেয়ে জ্যোতিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে।ডাক্তার বলেছেন কোনো কথা বলা বারণ, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে ওনার।চোখের কোণ বেয়ে অজান্তে জল নেমে আসে শোভনবাবুর।বাড়িতে অসুস্থ মা,বাবা,মেয়ের কলেজে পড়ার খরচ কোথা দিয়ে জোগাড় হবে এত টাকা?
হটাৎ বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে জ্যোতিকা বলে,”বাবা কেন এত চিন্তা করছ তুমি? এবার থেকে তোমার ট্যাক্সিটা আমিই চালাব।ছোট থেকে ছুটির দিনে তোমার পাশে স্টিয়ারিংয়ে বসে থেকে কিছু তো শিখেছি,বাকিটা শিখে নেব।” মেয়ে হয়ে পথেঘাটে ট্যাক্সি চালিয়ে বেড়াবি মা?”বাবা হিসেবে শোভনবাবুর কণ্ঠে ঝরে পড়ে একরাশ উৎকণ্ঠা। ওনাকে আশ্বস্ত করে জ্যোতিকা বলে,”মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষ্মী সেজে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকা নয়(always passive) বাবা বরং দরকার পড়লে বাইরে বেরিয়ে যাতে লক্ষ্মীলাভ হয় সেই চেষ্টাই করতে হবে।”
চার বাজ গ্যায়ে লেকিন পার্টি আভি বাকি হ্যায়”প্রতিদিনের মত আজও অফিসের গাড়ি থেকে আতাবাগানের মোড়ে নামতেই নয়নিকার কানে আসে চ্যাংড়া ছেলেগুলোর কন্ঠস্বর। কলকাতায় একটি কলসেন্টারে রাতের শিফটে কাজ করে ও।বাড়ি বর্ধমান। আসা যাওয়ার অসুবিধা থাকায় এদিকেই ঘরভাড়া নিয়েছে ও মাসখানেক হল।সেইথেকেই ছেলেগুলো ওকে উদ্দেশ্য করে নানারকম টিকাটিপ্পনী ছুঁড়ে দেয়।তবু পাশ কাটিয়ে চলে যেত নয়নিকা।
কিন্তু ওদের সাহস বাড়তে থাকায় আজ সোজাসুজি ওর ওড়নায় টান পড়ে।ওমনি পিছন ঘুরে ওদের ক্যারাটের মারপ্যাঁচে জব্দ করে নয়ন।ছোটবেলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে শেখাটা আজ সত্যিই কাজে আসল।মেয়ে মানেই যে সবসময় সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে নেবে(always tolerant)সেটা নয়।
ইসস দেখ স্কার্টটায় যেন লাল রঙের আলপনা এঁকে রেখেছে।সত্যি কি যে দিনকাল পড়ল এসব রাস্তার লোককে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে”নেতাজি ভবন মেট্রো স্টেশনে বছর বারোর তানিশাকে লক্ষ্য করে উড়ে আসতে থাকে অতি উৎসাহী আমজনতার কথাগুলো। অথচ অন্যদিকে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রথম ঋতুমতী হবার জন্য তলপেটে ব্যথা যন্ত্রণায় কুকরে যাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটা সেদিকে কারুর হুশ নেই। ঠিক এইসময় ওর পাশে এসে দাঁড়ায় এক তরুণী। মৃদু হেসে বলে,”কোনো ভয় বা লজ্জা নেই তোমার। কারণ এই দাগটা লজ্জার দাগ নয়। আমি অনুমিতা।নাও আমার এই ওড়নাটা জড়িয়ে নাও ভালো করে।”
ভরসা পেয়ে তানিশা এবার একটু স্বাভাবিক হয়।অনুমিতা এবার এগিয়ে যায় সেইসব জনতার দিকে।কাটাকাটাভাবে বলে,”যে লাল রংটা নিয়ে এত মস্করা সেই রংটা না থাকলে যে সৃষ্টি,জন্ম বলে কিছুই থাকতনা।আর তোমাকেও বলছি তানিশা লজ্জা না পেয়ে, হাল না ছেড়ে কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।মেয়ে মানেই যে সবসময় নম্র,লাজুক(always introvert)হতে হবে তা একেবারেই নয়।” উপযুক্ত জবাব পেয়ে পাতলা হয়ে যায় ভিড়টা। “কলি মা বলে দিয়েছে পরশু রবিবার। আসানসোলে ছোটকাকাদের বাড়ি যেতে হবে। ওনার নাতির মুখেভাত আছে। পরিবারের সকলেই আসবে ওখানে। তোমার মনে আছে কিনা তাই বললাম আর কি!” অফিস যাবার আগে টাইয়ের নট বাঁধতে বাঁধতে স্ত্রী কলির দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় রাজর্ষি।
ওমনি ভেসে আসে কলির উত্তর,”আমি মাকেও বলেছি আর তোমাকেও বলছি দুঃখিত আমি যেতে পারব না। ওখানে গেলেই লক্ষ প্রশ্ন ধেয়ে আসবে আমার দিকে,”বিয়ের সাতবছর পরেও কেন বাচ্চা হচ্ছেনা আমার?আমাদের পরে বিয়ে হয়েও অনেকের বাচ্চা হয়ে গেল। আসলে সমস্যাটা কার আমার নাকি তোমার?পরিবারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান মানে যদি সেটা পরনিন্দা,পরচর্চার আসর হয় তাহলে ওখানে না গিয়ে বরং তার থেকে বাড়িতে থাকা অনেক শান্তির কারণ একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই যে অপমান সত্বেও পরিবারের সব অনুষ্ঠানে(always family centric) তাকে উপস্থিত থাকতে হবে সেটা নয়। মা তোমার জন্য দই মাছ কোথায়? শুধুশুধু ডাল দিয়ে মেখে খাচ্ছ যে?”রাতে কোচিং ক্লাস থেকে ফিরে খেতে বসে নবম শ্রেণীতে পাঠরতা দোয়েল জিজ্ঞাসা করে ওর মা ঝর্ণাদেবীকে। মৃদু হেসে উনি বলেন,”আমি ওবেলা খেয়ে নিয়েছি রে আমার ভাগেরটা। তাছাড়া রাত্রে মাছ,মাংস খেলে ইদানিং খুব অম্বল হচ্ছে। নে ওত কথা না বলে তুই খা দেখি এবার..”
অথচ দোয়েল ভালোমতই জানে মধ্যবিত্ত পরিবারে একদিন মাছ হলে মা নিজে না খেয়ে সেটা যত্ন করে তুলে রাখে পরদিন ওর বা ওর ভাইয়ের জন্য। কিন্তু আজ উঠে যায় ও।মিটকেস থেকে বের করে আনে অতিরিক্ত মাছের টুকরো। তারপর মায়ের পাতে তুলে দিয়ে বলে,”ঘরের বউ বা মা হওয়া মানেই যে সবকিছু এমনকি খাবারের সাথেও আপোস করে মানিয়ে(always compromising)চলতে হবে এমনটা নয়।সবার আগে নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা উচিত।
“নিজের ফিগারটা কমাও নীতা।দিনদিন যা ঢেপসি হয়ে যাচ্ছ।বাইরে কোথাও বেরোতে লজ্জা করে তোমাকে নিয়ে।আমার বন্ধুর বউদের দেখ।পার্টি বা ড্যান্স ফ্লোর মাতিয়ে রেখেছে দারুণ দারুণ আধুনিক পোশাকে আর দুরন্ত শরীরের বিভাজিকায়।তুমি সেখানে নেহাতই বেমানান।তোমাকে সেভাবে ভালোবাসাতেও ইচ্ছে করে না “পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই স্ত্রী নবনীতাকে শুরু হয় দীপনের বাক্যবাণ।
বেশ কিছুদিন ধরে নবনীতা শুনে আসছে কথাগুলো কিন্তু আজ ধৈর্য্য হারিয়ে শেষমেশ ও বলে,”ভালোবাসা বোধয় বয়স, ওজন,উচ্চতা, দামী পোশাক বা আদব কায়দা দিয়ে বিচার করা যায়না। এটা সম্পূর্ণ দুটি মানুষের মানসিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। আর সেটা তোমার আর আমার মধ্যে সম্ভব হচ্ছেনা।তুমি ফিরে যাও।আমি আর ও বাড়ি ফিরবনা।আইনি বিচ্ছেদের নোটিশ সময়মত পেয়ে যাবে। চলি।”
দীপনের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায় নবনীতা।বোবা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ও মেয়ে মানেই যে সবসময়(taken for granted) তাকে নিশ্চিতভাবে নিজের সম্পত্তি মনে করে যা খুশি আচরণ করা যায় সেটা নয়। আচ্ছা আর একটা কথা জানিয়ে রাখি বিয়ের পর কিন্তু আমাদের বাড়ি ওসব প্যান্ট ফ্যান্ট পরে ঘোরাফেরা করা যাবেনা।সেইমত শাড়ি পরা শিখে ফেল।আর মনে রেখ বিয়ের পর কিন্তু ঘনঘন বাপের বাড়ি আসা চলবে না। আমরা রক্ষণশীল পরিবার, একটা সুনাম আছে বলে কথা!”পাত্রী বিয়াসকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলেন পাত্রের পিসিমা অনুরূপাদেবী।
একটু চমকে ওনাদের দিকে তাকায় বিয়াস।এ কোন যুগে পড়ে আছেন ওনারা। ওখানে বিয়ে হওয়া মানে তো নিজের সত্তা বিসর্জন দেওয়া। যে বাড়িতে এতদিন ধরে বড় হল একনিমেষে কি করে সম্ভব ভুলে যাওয়া সব?”কিন্তু চুপ করে থাকা মানে তো সম্মতির লক্ষণ। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিয়াস বলে,”ক্ষমা করবেন মেয়ে মানেই কিন্তু সর্বদা রক্ষণশীল(always traditional) হতে হবে এমন কোনো ব্যাপার নেই। আমার এই বিয়েতে কোনো মত নেই। আপনারা আসুন।”
আসলে উপরের আটটি ঘটনা আমাদের জানিয়ে দিয়ে যায় বর্তমান সমাজে নারীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে নানা রূপ।তাই রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী হবার দৌড় এখন শেষ।জীবনভোর প্রথাগত ধ্যানধারণা আগলে বসে না থেকে বরং সোচ্চার কণ্ঠে ধ্বনিত হোক সীমাহীন বাঁধভাঙার উল্লাস। শুধু পুজোর পাঁচ দিন মাতৃশক্তির আরাধনা না করে বছরের প্রতিটা দিন হোক দেবীপক্ষ। মরাগাঙে জীবনতরী ভাসিয়ে সবাই মিলে বলি,”ভাঙো,বাঁধ ভেঙে দাও,বাঁধ ভেঙে দাও,বাঁধ ভেঙে দাও/বন্দী প্রাণমন হোক উধাও/শুকনো গাঙে আসুক/জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক।।।”