খেলা

খেলা

সাদা ধবধবে লম্বা করিডোর; ডেটল আর ফিনাইলের গন্ধ আসছে ভেসে। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে কাতর চিৎকার, কোথাও থেকে আসছে ভেসে বিপ বিপ শব্দ, কোথাও থেকে বা টুঁ টুঁ করে ভেসে আসা বিভিন্ন যন্ত্রের ধাতব আওয়াজ। লম্বা করিডোরের মাঝে কিছু জায়গাতে রয়েছে বসার টানা বেঞ্চ , তার ওপরে বসে রয়েছে কিছু মানুষ। সবারই চোখে মুখে উদ্বেগ, চাপা যন্ত্রনা, কাতর আর্তি। কেউ কেউ মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে ওপরের দিকে, চোখ বন্ধ করে কোনো এক অজানা শক্তির কাছে করছে বিড়বিড় করে প্রার্থণা। কেউ কেউ বসে আছে শুকনো মুখে,হাতে ধরে রেখেছে পাশে বসে থাকা কোনো প্রিয়জনের হাত। তবুও চাপা কোনো উত্তেজনায় ওনার হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক করে। ফিসফিস – খসখস কথা বলার আওয়াজ আসছে ভেসে ওদের মুখ থেকে।

আমিও সেদিন বসেছিলাম ওনাদের সাথে, একা, শূন্য , ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে। আমার আর মাথা কাজ করছিলো না সেদিন। সাথেও কেউ ছিলো না আমার। সেদিন, সেই রাতে আমার একাকিত্ব ছিলো আমার সঙ্গী। আর আমার জীবনসঙ্গী, তখন ভেতরে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলো মেয়েটা। হঠাৎ করেই রাতে প্রচন্ড ব্লিডিং, গাড়ি ডেকে ওকে নিয়ে এসেছি হসপিটালে। পাশে বসে থাকা সাতজনের পরিবারের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে একটু কষ্ট হচ্ছিলো আমার – আমাদের সাথে কেউ নেই আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো ! জোরে কথা বলা নিষেধ ‘মাল্টিস্পেশালিটি’ প্রাইভেট হসপিটালের এই অংশে। সময় এখন রাত আড়াইটে। বাইরে ঘন অন্ধকার। সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছে , সুখে শান্তিতে। শুধু এখানে অপেক্ষারত মানুষগুলোর চোখে নেই কোনো ঘুম। ভেতরে রয়েছে অপারেশন থিয়েটার। সেখানে আজ চলছে দুটো সার্জারি, পাশাপাশি দুটো অপারেশন থিয়েটারে।

আসার সময় দেখেছিলাম, হসপিটালের রিসেপশন এরিয়াতে অপেক্ষা করছে আরো অনেক মানুষ। হয়তো তাদের বাড়ির লোকজন ভর্তি বিভিন্ন ওয়ার্ড এ। জীবন মরণ সমস্যা নিয়ে ভর্তি অনেক পেশেন্ট , তাদেরই বাড়ির লোকজন করেছে ভিড় সামনে। নার্স আর অন্যান্য ষ্টাফ এসে বারবার বলে যাচ্ছে কেউ যেন চিৎকার চেঁচামিচি না করে। সাদা ধবধবে পোশাক পরে ডক্টররা ভেতরে যাচ্ছেন আর বেরোচ্ছেন। চিন্তা ওঁদের মুখে খেলা করছে, সাথে গভীর রাতের অনিদ্রার বিরক্তি ওদের কপালের ভাঁজে। ওনাদের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে জুনিয়র ডক্টর বা নার্সেরা।

অপেক্ষারত পরিবার থেকে এক ভদ্রলোক হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ভদ্রলোকের বয়স হবে চল্লিশের কাছাকাছি। ওনাকে কাঁদতে দেখে বসে থাকা এক ভদ্রমহিলা, কোলের ওপরে ঘুমিয়ে থাকা ছোট বাচ্চাটাকে সরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে দাঁড়ালেন ওনার পাশে। ওনার মাথা টেনে নিলেন নিজের বুকে, বলে উঠলেন, “চিন্তা কোরোনা পরাগ , বাবার কিছু হবে না। আমরা শহরের বেস্ট হসপিটালে এসেছি, সবথেকে ভালো ভালো ডক্টররা দেখছে ওনাকে। কিচ্ছু হবে না ওনার। ”

পরাগ নামের ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, :তুমি কি করে বলছো কিছু হবে না ! তিন তিনবার হার্ট অ্যাটাক, আর এটা তো ডক্টররা বললেন খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কি করে বাঁচবো আমি মধু ! বাবা, বাবাকে ছাড়া কিছুই যে ভাবতে পারছি না আমি। আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার কথা ! নিজে ঘোড়া হয়ে আমাকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো , আমাকে হাত ধরে বাজারে নিয়ে যাওয়া, সবকিছু চেনানো। আমার হিরো, আমার বাবা আজ ওভাবে , আমার চোখের সামনে ! আর আমি কিছুই করতে পারলাম না ! অপদার্থ আমি। সন্তান হিসেবে আমি অপদার্থ মধু। ”

মধু , পরাগের মুখ নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে ওর কাঁদতে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমিও তো সব জানি পরাগ। আমিও তো সব জানি। কিন্তু কি করবে বলো ! আমাদের বিয়ের পরে যখন কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায় নি, তখন ও তো তোমার বাবা-ই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। সবার সাথে একা লড়াই করেছিলো। কি করে আমি সেসব কথা ভুলবো বলোতো ! আমার কি কষ্ট হচ্ছে না একটুও ? আমার ও যে খুব কষ্ট হচ্ছে পরাগ। কিন্তু এখন-ই এতো ভেঙে পড়লে চলবে কি করে। ডক্টররা তো আছেন ভেতরে।

ওনারা ওনাদের কাজ করছেন। আমি, আমি কি করে ভুলি বলোতো পরাগ, আমাদের যখন ছেলে হলো , ওকে কোলে নিয়ে কি খুশি হয়েছিলো বাবা ? তোমার মনে আছে ? আর তারপর প্রতিদিন ওকে সাথে নিয়ে খেলা, কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইতো না বাবা ! আমাকে বৌমা নয়, নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছে তোমার বাবা। কিন্তু, কিন্তু “কিন্তু কিছুই না মধু, আমি সত্যি ছেলে হিসেবে খুব খারাপ। আমি কিরকম ভাবে দূরে চলে গিয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। কাজ আর টাকার পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে বাবার শরীরের দিকে নজর দিতে পারিনি। আর তাই তো বাবার আজ…..বাবার কিছু হয়ে গেলে আমি আর নিজেকে পারবো না ক্ষমা করতে মধু। আজ বাবার এই অবস্থার জন্য আমি-ই দায়ী। ”

পাশ থেকে আরো দু তিনজন এসে পরাগকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে বোঝাতে লাগলেন, ওনার কাঁধে হাত রেখে আরো কিছু বলতে শুরু করলেন। ভেতরে থেকে দৌড়োতে দৌড়োতে নার্স এসে বললেন, “সাইলেন্স প্লিজ। এরকমভাবে চিৎকার করলে আপনারা বাইরে যান। আর বি + গ্রুপের ব্লাড লাগবে , তাড়াতাড়ি জোগাড় করুন। বা আপনাদের কারোর যদি থাকে যে ভদ্রলোক ওপরের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু প্রার্থণা করছিলেন উনি উঠে বললেন, “আমার বি + , প্লিজ চলুন। ” নার্স ওনাকে নিয়ে চলে গেলেন তাড়াতাড়ি ভেতরে কোথাও। আমি বসে দেখছিলাম ওনাদের সবাইকে। ওনাদের ভেঙে পড়া, ওনাদের কান্না, ওনাদের একজনের আরেকজনের পাশে থাকা , সহমর্মিতা, স্নেহ, ভালোবাসা….সব কিছুই আমি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ! আমার পাশে যে কেউ নেই, আমি কি নিয়ে ভাববো ? আমার ও কি টেনশন করা উচিত ?

টেনশন হচ্ছিলো আমার ও , কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না। পরাগ নামের ওই ভদ্রলোকের কান্নায় ভেঙে পড়া দেখে , ওনার সাথে ওনার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে আমি ফিরে এলাম বর্তমানে। কি হবে আমার মিনুর ? আর আমাদের আগত সন্তানের ? যখন ওকে ভেতর নিয়ে যায়, আমি দেখেছিলাম ডক্টরের মুখ – একদম ছোট হয়ে গিয়েছিলো কোনো এক অজানা ভয়ে। তাড়াতাড়ি নার্সকে ডেকে কোনো এক যন্ত্রের সাহায্যে, গর্ভের সন্তানের হার্টবিট নিচ্ছিলেন উনি। মিনুর কোমর থেকে নিচের অংশ ভিজে গিয়েছিলো রক্তে।

আমার মিনুর চোখে ছিলো জল। আমি ছিলাম দাঁড়িয়ে পাশে, আমার হাতের মুঠোর মধ্যে ছিলো, ওর ঠান্ডা ঘামে ভেজা হাত। ডক্টর একটু পরেই আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে, অপেক্ষা করতে। আমি বাইরে যেতে জেরে শুনলাম, ডক্টর নার্স কে বলছেন, “বাচ্চার হার্টবিট কমে গেছে। তাড়াতাড়ি সিজার করতে হবে। ‘ও টি’ রেডি করো আর আমার পেছনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো দরজা। একটু পরে নার্স এসে বলেছিলো , মিনুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সিজার করতে হবে। আর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন বয়স্কা নার্স, “কিচ্ছু ভাববেন না ! সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

কি হবে যদি বাচ্চার কিছু হয়ে যায় ? কি হবে যদি মিনুর কিছু….কি হবে যদি দুজনেরই কিছু…না, না আমি আর ভাবতে পারছি না কিছুই। উঠে দাঁড়াই আমি , ভেতরে ভিতরে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠছিলাম আমি। কেন ভেতর থেকে কেউ আসছে না বেরিয়ে , কেন কেউ কিছু বলছে না ? আমার মনের ভেতর থেকে কেউ হঠাৎ বলে উঠলো – এই এক খেলা – জীবন আর মৃত্যুর খেলা। মৃত্যু , অমোঘ সত্য, সবার জীবনেই আসবে কখনো না কখনো। তবুও তাকে আমরা পারি না মানতে। আর জন্ম ? সে তো ঘেরা অনিশ্চয়তায় , তবুও তাকে ঘিরে এতো উল্লাস , আনন্দ। আশ্চর্য্য এই খেলা , চলছে প্রতিনিয়ত সারা বিশ্ব জুড়ে।

হঠাৎ ভেতর থেকে এক নার্স দৌড়ে বেরিয়ে আসে। আমি তাকাই ঘুরে ওর দিকে। পরাগ , মধু উঠে দাঁড়ায় তাড়াতাড়ি , একজন এগিয়ে যায় ওর দিকে। কাউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবাইকে অতিক্রম করে দৌড়ে চলে যায় নার্স অন্যদিকে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসে আরেকজনকে নিয়ে ; বড়ো একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে ঢুকে যায় ওরা দুজনেই। আবার শুরু হয় এক অপেক্ষা। দুরু দুরু বুকে আমরা সবাই অপেক্ষা করতে শুরু করি। পরাগ আরো ভেঙে পড়েন কান্নায়, উনি বসে পড়েন মেঝের ওপরে কাঁদতে কাঁদতে। বলে ওঠেন, “সব শেষ ! আমি জানি সব শেষ হয়ে গেলো। ”

আমি কি করবো ? আমার ও কি দুঃখ পাওয়া উচিত ওদের মতো ? কিছুই বুঝতে পড়সি না। সব কিরকম যেন ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে। সব কিছু দুলছে আমার চোখের সামনে। মাথা নিচু করে, চোখ বন্ধ করে বসে পড়লাম আমি। কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না , হঠাৎ ঘোর কাটলো ভেতরের দরজা খোলার শব্দে। দুজন ডক্টর বেরিয়ে এলেন, এসেই ওনারা গেলেন অন্য পরিবারের সামনে। আমি শুনতে পেলাম ওদের কথোপকথন।

“আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। আপনার বাবা এখন কোমাতে। আসলে এই বয়সে, আবার একটা হার্ট অ্যাটাক , সেই ধাক্কাটা নেওয়া খুব কষ্টের। উনি এখন লাইফ সাপোর্টেই আছেন। তবে বেশি কিছু আশা করবেন না, যে কোনো দিন , যে কোনো মুহূর্তে…আপনারা রেডি থাকুন, প্রস্তুত করুন নিজেদের। ” সিনিয়ার ডক্টর পরাগের কাঁধে হাত রেখে , ধীরে ধীরে চলে গেলেন বাইরে। পরাগ ভেঙে পড়লো কান্নায়। ওকে জড়িয়ে ধরলো আরো দুজন। বাকি চারজন ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারের ওপরে। কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ওদের মধ্যে থেকে একজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আমি, আমি একটা কথা বলবো ? জানি, তোমরা হয়তো আমাকে খারাপ ভাববে, তবুও ! ”

পরাগ চোখের জল মুছে তাকালেন ওনার দিকে। “ডক্টর বলেই দিয়েছে যে কোনো চান্স নেই। এই অবস্থায় দাদাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা মানে ধরেই নেওয়া যায় যে দাদা আর কোনোদিন চোখ খুলবে না। একরকম ভাবে মারাই গেছে। তাই আর কষ্ট দিয়ে কি লাভ ? যদি তোমরা সবাই রাজী থাকো চেঁচিয়ে উঠলেন পরাগ, “কি বলছো কি তুমি কাকু ? কি করে বলতে পারলে এই কথা ? তোমার, তোমার লজ্জা করলো না ? একটুও বুক কাঁপলো না ? তুমি, তুমি তো বাবাকে মার্ডার করার কথা ওদের এই কথার মাঝেই হঠাৎ করে একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এলো ভেতর থেকে, একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ – ট্যাঁট্যাঁ ট্যাঁট্যাঁট্যাঁট্যাঁ। আমি উঠে দাঁড়ালাম এক ভীষণ উত্তেজনায়। পরাগ আর ওর পরিবার ও চুপ করে গেছে এই চিৎকারে। আরো কিছুক্ষণ পরে ভেতর থেকে নার্স বেরিয়ে এলেন। আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তোয়ালে দিয়ে মোড়া একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে।

বাচ্চাটার চোখ বন্ধ, লাল হয়ে আছে সারা শরীর , মাথার চুল ভেজা , সারা শরীর ভেজা কোনো এক তরলে, আর লেগে সাদা সাদা চামড়ার মতো কিছু। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কংগ্র্যাচুলেশনস, আপনার মেয়ে হয়েছে। আমি বলেছিলাম না, সব ঠিক হয়ে যাবে ! আর আপনার স্ত্রী ও ভালো আছে। একটু বেশি ব্লাড বেরিয়েছে , তবে এখন স্টেবল। এই, এই নিন , না না এইভাবে ধরুন ! ” আমি কোলে তুলে নিলাম আমাদের সন্তানকে। ওর গালের ওপরে স্পর্শ করলাম আমার ঠোঁট দিয়ে। নড়ে উঠলো মেয়েটা । নার্স ওকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আমাকে বললেন আরো আধঘন্টা অপেক্ষা করতে , তারপরে মা আর মেয়ে দুজনকেই বেডে দেওয়া হবে।

আমি প্রচন্ড খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম , আনন্দে – আমার খুব ইচ্ছে করছিলো নাচতে । কিন্তু হঠাৎ আমার চোখ পড়ে গেলো পাশে। পরাগ, মধু আর ওদের পরিবারের ওপরে। মুখ থেকে হাসির রেশ মুছে ফেলে, মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম বাইরে আমি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত