মনিরুল সেদিন বাড়ি থেকে অন্য দিনের চেয়ে দু ঘন্টা আগে বের হলো | সামনে পুজো আছে, এই সময় একটু বেশি রোজগার হলে, ছেলেটার জন্য কটা ভালো বাজি কিনে আনতে পারবে | মনিরুলরা গত চার পুরুষ ধরে কাপড় ব্যবসায়ী | তাঁতি, হাতের কাজ করা, সব ধরা বাঁধালোক আছে তাদের | সেখানেই অর্ডার যায় আর সেই মতো কাপড় ফেরি হয় | নানান জায়গা আছে ফেরির — কলকাতার বড়বাজারে দোকান আছে, আরো আছে, সোদপুর, কাঁচরাপাড়া, রানাঘাট — অনেক জায়গায় সে কাপড় যায় | এছাড়া মনিরুলের নিজস্ব কিছু বড়সাহেবদের বাড়ি আছে | সেখানকার বৌদিরা শুধু মনিরুলের থেকেই শাড়ি নেয় | দোকানে ফেরির ব্যবসায় ভাগীদার আছে পাঁচজন, তবে বাড়িগুলো মনিরুলের নিজের | সব মিলিয়ে তার ভালোই সংসার চলে |
সংসার বলতে মা, বৌ এবং অনেক মানত করে পাওয়া ওই এক ছেলে | ছেলের জন্য প্রাণ দিতে রাজি মনিরুল | আর বছরে ছেলে সাত বছরে পড়তে ইংরেজি ইস্কুলে ভর্তি করেছে | খরচ সামাল দিতে এখন মনিরুলের বৌ ও ব্লাউস সেলাই এর কাজ ধরেছে | তার মা প্রথমটা আপত্তি করেছিল, তবে নাতির ভালো ভেবে শেষে সব মেনে নিয়েছে | বৌ তো আর বাইরে যাচ্ছেনা, ঘরে থেকে সেলাই করছে | বাড়ি থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনের দিকে ছুট দিল মনিরুল | জানালার ধারে জায়গা পেল, ফাঁকাই কামরা | আস্তে আস্তে তার চোখ ঘুমে ঢলে পড়ল | হাতে নেয়া কাপড়ের বান্ডিলটাকে বালিশ বানিয়ে সে চোখ বুজে এক ঘুম লাগলো | দেড় ঘন্টার রাস্তা |
— “বাবান, এই বাবান, ওঠ! ১০টায় ইন্টারভিউয়ের সময় না? পরে পরে ঘুমোচ্ছিস! ওঠ!”
মায়ের ধমকে ধড়ফড়িয়ে উঠল সুদীপ্ত | সত্যি তো! আরেকটু হলে কি দেরীটাই না হতো! উঠে, কোনোমতে স্নানটা সেরে, সে তৈরী হয়ে নিলো | ঝটপট আরেকবার ব্যাগটা দেখে নিল সব দরকারি কাগজপত্রগুলো আছে কিনা | বেরোতে যাবে, মা ভাতের থালা নিয়ে হাজির! নাকে মুখে দুটো গুঁজে আবার দৌড়তে যাবে, মা ঠাকুরের ফুল প্রসাদ নিয়ে সামনে হাজির ! সুদীপ্ত জানে, এখানে তর্ক করে লাভ নেই, তাই চুপ করে সে দাঁড়িয়ে পরে |
সুদীপ্ত এবং তার মা, একটা ভাড়া বাড়ির এক কামরার সংসার | বাবা গত হয়েছেন, সুদীপ্ত তখন ক্লাস সেভেন কি এইট | রেলের কর্মী ছিলেন, সেই ট্রেনই পিষে প্রাণটি কেড়েছিল! রেল এর পেনশন আর বাকি টাকা পয়সা যা পাওয়া গেছিলো তাই দিয়ে সুদীপ্তদের কোনো মতে চলে যেত| মা অবশ্য পরে রেল এ বাবার চাকরিটা পায় | তবে মা গ্রাজুয়েট ছিল না তাই পিওন পদ পায় | বর্তমানে সুদীপ্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে এবং এক বড় কোম্পানি তে আজ তার ইন্টারভিউ | মাথায় দই এর ফোঁটা নিয়ে এক প্রকার দৌড়ই দিল সে | ৭টার লোকাল না পেলে আর ইন্টারভিউ দিতে হবেনা | UTES এর দৌলতে আর কাউন্টার এ লাইন দিতে হলোনা | তাও ট্রেন প্লাটফর্ম এ প্রায় ঢুকে গেছে | কোনোমতে লাইন ডিঙিয়ে গিয়ে সুদীপ্ত ট্রেন ধরল | ফাঁকা কামরা, একটা সীট নিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল |
— “এ পচা, একটা চা দে রে ! ও বিশুদা, পার্থর খবর শুনেছ ? ”
— ” হুম শুনলাম | ”
— ” মা তো মনে হচ্ছে আর বাচঁবে না গো !”
— ” যত তাড়াতাড়ি গত হয়, পার্থর তত মঙ্গল! ছেলেটার কপালটাই খারাপ |”
— ” সত্যি গো বিশুদা | একে তো চিটফান্ডে সব গেল | তারপর যা কিছু ছিল মা কে সারাতে তাও ভোগে!”
— ” ক্যান্সার তো, না কি রে ?”
— ” না না , ক্যান্সার না | অন্য কিছু জটিল কি একটা নতুন রোগ এসেছে মার্কেটে | কি SARS না swine flu এরম কিছু !
— ” বাড়িঘর সব বেচে দিয়েছে শুনলাম |”
— ” শুধু বাড়ি? গয়না, জমি, যা ছিল সব | আর মা বাঁচবেও না |
— ” কাজ ও তো গেছে শুনলাম | মা কে নিয়ে যা ছুটোছুটি করতে হয়েছে আর তাতে যা কামাই হচ্ছিল, কাজ তার আর টিকলো না |
— খুবই খারাপ ব্যাপার | এই এতো চিনি কেন দিয়েছিস রে ??? পচা, মাথায় এক গাট্টা মারবো!!”
ওভারব্রিজের রেলিং ধরে পার্থ অন্যমনস্ক হয়ে চলছিল | আজ সে একা | মা নেই | কি অদ্ভূত, কেউ সেটা জানেনা | ওর চোখের সামনে মা ওরম বমি করতে করতে শেষ হয়ে গেল ! হাসপাতাল থেকে চারদিন আগে সে মা কে ছাড়িয়ে এনেছিল | মা থাকতে চায়নি, আর সত্যি বলতে কি, টাকাও আর ছিল না | কি দোষ করেছিল তার মা বা সে নিজে ?
পার্থপ্রতিম ঘোষ, এক কালের সেরা ছাত্র, স্যারদের খুব প্রিয় | তার তো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হওয়ার কথা ছিল ! সেখান থেকে হঠাৎ আজ একি হয়ে গেল ? মা নেই | বাবা তো আগেই তাদের ছেড়ে চলে গেছিল | নতুন সংসার আছে তার বাবার | পার্থদের চিনতে অস্বীকার করেন | টাকার দায় স্কুল ছুটলো, ছোট বয়সে সে কাজে ঢুকল | হঠাৎ মা অসুস্থ হল, আর সেখান থেকে আজ সে সম্পূর্ণ একা ! আত্মীয়স্বজন তো অনেক আগেই তাদের ত্যাগ করেছে !
অন্যমনস্ক হয়ে পার্থ চলতে থাকে | নিচ দিয়ে এক এক করে ট্রেন যেতে থাকে | মায়ের সৎকার, কাজ করে আর কি লাভ? দশজন কে আজ ডেকে কি লাভ? প্রয়োজনে কেউ এলোনা — আজকে তো সব শেষ | নিচে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে | অন্যমনস্ক ভাবেই পার্থ তাতে চড়ে বসল | ফাঁকা কামরা | এক কোনে এক যাত্রী একটা কাপড়ের বান্ডিল মাথায় ঘুমোচ্ছে | আরেকদিকে একটা ছেলে, ফিটফাট চেহারা, থেকে থেকে ঠাকুর প্রণাম করছে | নির্ঘাত চাকরির ইন্টারভিউ, মনে মনে ভাবলো পার্থ | এককালে বাবা বলতো পার্থ বড় হয়ে টাই পরে অফিস করবে | এখন নিশ্চই নিজের অন্য ছেলেমেয়েদের বলে | একটা জানালার পাশের ফাঁকা সীটে গিয়ে আনমনা পার্থ বসে পড়ল | জানালার হাওয়ায় তার শীতল মন যেন আরো বরফ হয়ে যেতে লাগলো | ট্রেন ছেড়ে দিল | একটা করে স্টেশন যাচ্ছে, লোক উঠছে দু একজন করে| কামরা ফাঁকাই রইলো | আচ্ছা মা কেন মারা গেল?
হাসপাতাল ছাড়ার সময় ডাক্তারবাবু চারটে ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন | বলেছিলেন , যেভাবে হোক এগুলো যেন মা কে দেওয়া হয় | সামনের সপ্তাহে আবার হাসপাতাল এ আসতে বলেছিলেন | একটা ওষুধের দোকানের নাম ও লিখে দিয়েছিলেন যেখানে গেলে পার্থ সস্তায় ওষুধগুলো পেত | আজকাল কে সামান্য ম্যালেরিয়ায় মারা যায়? কার ম্যালেরিয়া সিধে ব্রেন এ এটাক করে? করে, করে | তার মায়ের করে | কি দোষটা ছিল মায়ের? — কি আবার, সে যে এই পোড়া কপাল পার্থর মা | পার্থ কে জন্ম দেওয়ার সাজা পেল | সেই ওষুধের দোকানটা | পাশে একটা ভাতের হোটেল | পার্থ তিনদিন খৈ মুড়ি খেয়ে ছিল! কি আর করবে? কাজ পেয়েছিলো কারখানায় | তাও মায়ের জন্য ছোটাছুটিতে এতো কামাই, আর কথায় কথায় মাইনে আগাম চাওয়া — মালিক অন্য লোক নিয়ে নিল |
ওষুধের দোকানের দিকে যেতে যেতে পার্থর নাকে সদ্য সিদ্ধ ভাতের গন্ধ আসতে লাগলো | বাসি তেলের গন্ধটাও যেন তার মনে এক অদ্ভূত আলোড়ন খেলিয়ে দিল | পাগল পাগল মন নিয়ে পার্থ একবার ওষুধের দোকানের দিকে আর একবার ভাতের হোটেল এর দিকে তাকাতে থাকলো | সেদিন পার্থ অতি তৃপ্তি করে পেট ভরে ভাত খেয়েছিল | এতো তৃপ্তি তার কখনো হয়নি | আর আজ সকালে বিনা ওষুধে মা মারা গেল | আচ্ছা মা কে কি সে তাহলে খুন করলো? ওষুধ পড়লে কি মা বেঁচে থাকতো? তারপরের সপ্তাহে ডাক্তারের কাছেই বা কি করে নিয়ে যেত টাকা ছাড়া? মা কি তাহলে আজ না মরে পরের সপ্তাহে মারা যেত? সেকি তাহলে মায়ের কষ্ট কম করলো? অদ্ভূত সব খেয়াল পার্থর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে | অন্যমনস্ক ভাবে পার্থ সীট ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে ট্রেন এর দরজার দিকে এগোতে থাকে |
ফাঁকা ট্রেন বলেই হয়তো ছেলেটার দিকে নজর গেছিল সুদীপ্তর | উঠল যখন কেমন ফাঁকা ট্রেনে যেন ধাক্কা খেতে খেতে গিয়ে বসল | যাক্গে মরুকগে, সুদীপ্ত একমনে ভগবান কে ডাকতে থাকলো | একটা চাকরি, এই চাকরিটা যদি কোনোভাবে তার হয়ে যায় | জীবনের সব সমস্যা, সকল হয়রানির অবসান ঘটবে | ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে অদ্ভূত ভাবে জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে | পাগল নাকিরে বাবা! কে জানে ! অদ্ভূত ভাবে সে দরজার দিকে এগোতে থাকলো | সুদীপ্তর হঠাৎ খুব অস্বস্ত্বি হতে লাগলো | কোথা থেকে যেন একটা চাপা ভয়, খুব খারাপ একটা কিছুর আশংকা তাকে গ্রাস করলো | কোনো এক অজানা কারণে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়ে সে ঘামতে থাকলো |
— ” ও দাদা ! ” , অতি কষ্টে ক্ষীণ কণ্ঠে সে কোনোমতে নিজের অজান্তেই যেন ডেকে উঠল, ” ও দাদা কি করছেন ??”
সুদীপ্ত উঠে পড়ে | নিজের অজ্ঞাতসারেই সে কোনোভাবে পার্থ কে ধরতে ট্রেনের মধ্যেই এক লাফ মারে! লাফিয়েই হঠাৎ, সুদীপ্ত নিজেকে সেই কত বছর আগেকার একটা কালো অন্ধকার ঘরের সামনে দেখতে পায় | তার মা একধারে অঝোরে কাঁদছে | আর ঘরটার মধ্যে সাদা চাদরে মোরা, কে ওটা?? কাকু বারবার সবাই কে বলছিলো, ” আরে বাচ্চা ছেলে ওকে এনোনা…! ” তারপর সাদা কাপড়টা তুলতে সেই দৃশ্যটা ! উফফ !! ওটা নাকি বাবা !! কি বীভৎস ছিল ! মুখের একদিক থেঁতলানো, চোখ নেই, শরীরের একটা দিক কিরম পিষে যাওয়া, দলা পাকা একটা মাংস পিন্ড !
ওটা নাকি বাবা !! সেই মাংস পিন্ড কে মুখাগ্নি করেছিল সে !! ওটা নাকি বাবা ! আজ ও সুদীপ্ত মানতে পারেনা !
বহু রাত সে ঘুমোতে পারেনি | মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে, ওই রূপেই সে বাবাকে দেখতো, তাকেই ডাকছে ! বাবার হাত নেই, মুখের একটা অংশ নেই, তাও ডাকছে !! চিৎকার করে উঠতো সে ! মা কোলে চেপে ধরে সান্ত্বনা দিত | সব ঠিক হয়ে যাবে | একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে | সুদীপ্ত সম্বিত ফিরে পেতে নিজেকে ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে | ছেলেটি লাফ মেরেছে ! একি হল! একি হল ! , ভাবতে ভাবতে সুদীপ্তর দু চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো !
বসাক গিন্নি কম করে হলেও একটা বেনারসি তো নেবেই আর ওই নতুন তসরটা সে ঠিক বলে কয়ে গছিয়ে দেবে | তারপরে আছে মল্লিকবাড়ি | ও বাড়ির দুই বৌ আর বড় মেয়েটাও এবছর শাড়ি কিনবে | মনিরুল বাছাই করা সব সিল্ক, হ্যান্ডলুম, লিনেন তুলেছে | সঙ্গে অবশ্য কিছু চুড়িদারের পিস্ ও নিয়েছে, বলা তো যায়না | তারপর আর ও দুটো বাড়ি | আহা ! কম করে হলেও আজ একেবারে লালে লাল হওয়ার দিন !
— ” ও দাদা, ও দাদা, কি করছেন !! ”
একটা আর্তনাদে মনিরুল ধড়ফড়িয়ে উঠল ! তন্দ্রা মতন ছিল, ঘুমায় সে নি | এটাই তার কায়দা | ট্রেনে উঠলে কাপড়ের বান্ডিলটা মাথায় করে পুরো একটা সীট দখল করে সে শুয়ে পড়ে | আসলে দামী শাড়ি, সুট পিস্ থাকে, সে এদিক ওদিক করতে চায়না | আর ট্রেনে লোকজন আজ অব্দি তাকে খুব একটা ঘাটায়নি | সে অবশ্য ফাঁকা দেখেই ট্রেনে চড়ে | আজকের মতন এতো ফাঁকা না হলেও, তাও ওই আর কি | মনিরুল উঠেই পিছন ফিরে দেখলো | একটি ছেলে দরজার সামনে ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে | আর বাকি তিন চারজন যারা ছিল সবাই উঠে এসে দরজার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে | মেঝেতে শোয়া ছেলেটার চোখে জল | মনিরুল আগে গিয়ে তাকে তুলল |
— ” কি হল? কি হয়েছে ? ”
— ” লাফ মারলো, আটকাতে পারলাম না, মরে গেল, পারলাম না !! ”
— ” কে লাফ মারলো? সে কি !! তোমার কেউ হয় নাকি গো? জল খাবে?” পাশের আরেক যাত্রী ততক্ষনে জল এনে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে | জল খেয়ে সুদীপ্ত একটু ধাতস্ত হল|
— “সামনের স্টেশনে তো গাড়ি দাঁড়াবে , দেখবে একবার? যদি বাঁচানো যায়?”
সুদীপ্ত কে ভাবতেও হলোনা , ” হ্যা, চলুন !” বাকি যাত্রীরা GRP কে খবর দেওয়া অব্দি সীমিত থাকতে রাজি হল | স্টেশনে ট্রেন থামলো | সাদামাটা মধ্যবিত্ত চেহারা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, এখন অবশ্য উস্কো খুস্কো, মাড় দিয়ে আইরন করা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট | শার্টে এখন অবশ্য ট্রেনের নোংরা লেগে দাগ হয়ে গেছে | সুদীপ্ত কোনোদিনই খুব একটা পরহিতৈষী ব্যক্তি ছিলনা | তবে ওই সমবয়সী ছেলেটা না জানি তার মনের কোন অংশে দাগ কেটেছিল | ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো সে | চাকরি, ইন্টারভিউ সব ভুলে গেছে সে এখন | মনিরুল কাপড়ের বান্ডিলটা নিলো | কি ভাগ্যি এই স্টেশন এর চা এর দোকানের ছেলেটাকে সে চেনে | বান্ডিলটা তার জিম্মায় রাখতে রাখতে সব বলল |
কানু মিঞা, আজ প্রায় কুড়ি বছর এই দুই নম্বর প্লাটফর্ম এ চা এর ষ্টল দিয়ে সংসার চালাচ্ছে | সে সব শুনে বান্ডিলটাকে ন্যাপার পাহারায় রেখে সঙ্গে চলল| হঠাৎ কি মনে হতে মনিরুল বলে উঠলো, “কানু ভাই, কিছু কাপড় নিয়ে নি গো | বলা তো যায়না, লাগতে পারে |” সুদীপ্ত অবাক হয়ে লোকটাকে দেখছিল | খোঁচা খোঁচা মেহেন্দী করা লাল দাড়ি, একমাথা টাক, লুঙ্গি আর একটা হাফ হাতা গেঞ্জি পড়া বেঁটে লোকটা যেন জেনেই গেছে যে ছেলেটা বেঁচে আছে আর তারা তাকে ফেরত নিয়ে আসবে | কত অনায়াসে সে ওরম দামী চুড়িদারের পিস্ গুলো ছিড়ে নিয়ে চলল |
— ” খুব ভালো মনের মানুষ উনি, তাই না দাদা ?” , কানু কে উদ্দেশ্য করে বলল সুদীপ্ত |
— ” এক নম্বরের হারামজাদা ! এক পয়সা ছাড়েনা ! আজ ভূতে ধরলো কিনা কে জানে !!
মিনিট পাঁচ দশেক ট্রেন লাইন ধরে হাঁটতে হয়েছিল তিনজনকে | অদূরেই তারা পার্থ কে দেখতে পায় | কোনোভাবে লাইন এ না পরে, পার্থ পড়েছিল দুটো লাইনের মাঝের ঢালুতে | আহত ছিল | মাথা ফেটেছে| আরো কিছু পাঁজর, হাত বা পা ভেঙেছে কিনা হাসপাতালে নিয়ে গেলে বোঝা যাবে | মনিরুল হাতের কাপড়গুলো দিয়ে পার্থর মাথা শক্ত করে বেঁধে দিল | রক্তটা কিছুটা হলেও আটকাক ! মাথা ফেটে রক্ত জমাট হয়ে পার্থর চোখমুখ ময় ঢেকেছিল | তার জ্ঞান ছিলনা | তিনজন মিলে ধরাধরি করে কোনোভাবে পার্থকে প্লাটফর্ম অব্দি নিয়ে এলো |
ততক্ষনে ভিড় জমে গেছে | খবর রটেছে — কেউ নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে!! না, না, ভিড় ট্রেন এ ধাক্কাধাক্কি তে কেউ নাকি পড়ে গেছে !!! না, না, না লেডিস থেকে কাউকে নাকি ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে ?!! ইত্যাদি , ইত্যাদি প্লাটফর্ম এ পৌঁছে মনিরুল ছুটলো GRP – র খোঁজে | মনিরুল আর সুদীপ্ত অচেতন পার্থকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল | দুজনেরই জামাকাপড় তখন রক্তে রাঙা | একে ওপরের মুখের দিকে চেয়ে আনমনা হাসি খেলে গেলো তাদের মুখে | সে বেঁচে আছে এখনো! তারা বাঁচিয়ে এনেছে !!
–” আপনি পুজোর আগে কাপড় ফেরি করতে যাচ্ছিলেন বুঝি ?”
–” তা আর হলো কই ? ব্যাটা তো শিরে সংক্রান্তি করে রেখে দিল | এখন কোনোভাবে এটাকে ঘরে ফেরাতে পারলে হয় | তা, তুমি ? তুমি কোন কাজে যাচ্ছিলে?
–” ওই ইন্টারভিউ ছিল একটা চাকরির … “, বলতে গিয়ে সুদীপ্তর গলা আটকে যায় !
–” সেকি!! , আঁতকে উঠলো মনিরুল, ” এই বদ ছেলেটা তো তোমার এক্কেবারে সব্বনাশ করে দিল ! জ্ঞানটা ফিরুক খালি ! একটা ভালো দিনে কত লোকের কত লোকসান করে দিল !” এই কথার মাঝে কানু GRP নিয়ে হাজির হলো | এরপর একের পর এক পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল!! একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিনটা বেরিয়ে গেল |
সেদিন সন্ধে ৭টার দিকে পার্থর জ্ঞান ফেরে | পাঁজর ভেঙেছে, আর ভেঙেছে বাঁ হাত | এছাড়া কোমরে যা চোট পেয়েছে, ডাক্তারের মতে তা সারাজীবন ভোগাবে | মাথায় দু জায়গায় সব মিলিয়ে ১৭টা সেলাই পড়েছে তার |
সে শুধু বলতে পেরেছে যে তার নাম পার্থ আর তার ইহজগতে কেউ নেই ! অন্যদিকে মনিরুলের বাড়িতে তার শালা নাকি ছেলের জন্য প্রচুর বাজি নিয়ে হঠাৎ হাজির হয়েছে | ছেলে খুব খুশি | তার খদ্দের গিন্নিবান্নিরাও সবাই বলেছে কাল বা পরশু এলেও ক্ষতি নেই, মনিরুলের পোয়া বারো থাকবে | তার ওপর এই ছেলেটাও বেঁচে গেল , সব নিয়ে মনিরুল ও বেশ খুশি !
— ” নাও ভাই, চা বিস্কুট খাও দুটো | তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে গো | দস্যি ছেলেটার জন্য তোমার চাকরির একটা সুযোগ গেল ! ”
— ” ও না হয় আবার আসবে কাকা ” , শুকনো গলায় বলল সুদীপ্ত |
মনে যে তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ! ছেলেটা বাঁচলো | হ্যা, ছেলেটা বাঁচলো, তবে সে? সে তো শেষ হয়ে গেল ! মা সেই দুপুর থেকে অনবরত ফোন করে যাচ্ছে, সে শুধু কেটে দিচ্ছে ! কি জবাব দেবে সে মা কে ? নিজে খেতে পায়না, সে ছুটেছে হঠাৎ পরসেবা করতে ! কাল সে মরতে বসলে কি এই ছেলেটা তাকে বাঁচাতে আসবে? এর তো ইহজগতে কেউ নেই, সুদীপ্তর তো মা আছে, আর আছে মায়ের দায়িত্ব !
— ” ফোনটা ধরছনা কেন বলতো ?”, একটু বিরক্ত হয়েই মনিরুল বলল, ” সেই কখন থেকে তো টুং টুং করে চলেছে ! সুদীপ্ত ফোন ধরলো |
— ” হ্যা মা, বলো !”
–” উফফ, ভগবান বাঁচালো আমায় | ফোন কেন ধরছিলিনারে? কে একটা বলল , ওই ট্রেন থেকে নাকি তোর বয়সী একটা ছেলে পড়ে মারা গেছে !! “, প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় তার মা বলে উঠলো |
— ” না, মারা যায়নি, বেঁচে আছে ! আমি তার সাথেই আছি | অনেক বড় গল্প, বাড়ি গিয়ে বলবো | হ্যা রে বাবা , আমি ঠিক আছি ! তুমি কি এই জন্য ফোন করছিলে ? ”
— “হ্যা, এটা তো ছিলই, আরেকটা জিনিস ও আছে | তোর ইন্টারভিউ টা সামনের সপ্তাহে পিছিয়ে গেছে | ওরা তোর ফোন না পেয়ে বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছে | আমি তো সেই জন্যই আরো ভয় পেয়ে গেছিলাম, যে তুই গেলি কোথায়? ফোন ও তুলছিস না … কি রে বাবান? হ্যালো, হ্যালো …”
— ” মা, এখন রাখছি |
সুদীপ্ত জীবনে এতো আনন্দ কখনো অনুভব করেনি যেটা সে তখন সেই মুহূর্তে করল | সত্যি ভগবান আছেন এবং ভালো কাজের মূল্য সবাই পায় ! তাকিয়ে দেখলো কানু মিঞা আর মনিরুল কি একটা আলোচনা করছে |
–” ছেলেটার বলছে কেউ নেই মনি ভাই, তোমার ও তো বয়স বাড়ছে নাকি !”
–” ঠিকই বলছ কানু ভাই … ”
–” কিসের ব্যাপারে বলছেন?”, সুদীপ্ত যোগ দিল |
–” কিগো বিশুদা, অত মন দিয়ে কি পড়ছো ?”
–” কি আবার? এখন তো একটাই খবর ! আমাদের লোকাল হিরোদের — শ্রী শ্রী মহম্মদ মনিরুল ইসলাম এবং শ্রী শ্রী সুদীপ্ত মহাপাত্র | শালা, পার্থটার কপাল ঘুরিয়ে দিল মাইরি ! ”
–” হ্যা, মনি ভাই নিজের একটা দোকান খুলেছে, জানো? পার্থ সব কিছু দেখাশোনার কাজ করে ওখানে!”
–“আরে জানবো না মানে ? ওই যে বীরত্বের জন্য সংবর্ধনা এন্ড টাকা পেলো যে দুজনে | ওই দিয়েই তো সব |”
— “তবে জানো বিশুদা, পার্থ ছেলেটা খুব ভালো | ওর মায়ের সৎকারের জন্য, সেদিন ক্লাব থেকে আমরা সবাই টাকা তুলে বডি দাহ করিয়েছিলাম তো, যা যা খরচ হয়েছিল, সব টাকা মিটিয়ে দিয়েছে ! তারপর ও নিজে মায়ের শ্রাদ্ধ করেছে | লোক খাইয়েছে | সব নিয়ম মেনে করেছে | আমরা সব গেছিলাম ”
— ” কপালপোড়া ছেলে, নিজের মায়ের মুখাগ্নি দিতে পারলোনা | অপর জন্মের পাপ সব |”
–” যা বিশুদা, কি যাতা বলছ !”
–” ওটার কথা বাদ দে | আমাদের শাইনিং ষ্টার তো সুদীপ্ত ! প্রাণ বাঁচানোর গল্পের চোটে ওকে চাকরি দিয়ে দিল , শালা !! ইঞ্জিনিয়ার না হলেও নিয়ে নিতো বোধহয় | একে টাকা তায়ে চাকরি | ”
–” কি যে বলো, ও ইন্টারভিউ দিয়েছিলো |”
–” থাম, থাম ! এসব মিডিয়ার জোর জানিসনা তো তোরা, বুঝিস ও না ! ওকে নিতে বাধ্য !! এই পচা, বিস্কুট দে ! শালা, তোকে গাট্টা না মারলে কিছু কানে যায়না না রে !!”