জাঁতাকল

জাঁতাকল

বাবা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। বাবার এক মহিলা অফিস কলিগ আমার অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । বড় হয়ে শুনেছি, সেদিন আমাকে আর আমার পরিবারের সকলকে এতো ভালো লেগে গেছিল ওনার, যে আমাকে কোলে নিয়ে এক্কেবারে পাকা কথা দিয়ে ফেলে ছিলেন যে সময় হলেই আমাকে নাকি ওনার ছেলের বৌ করবেন। তারপর অনেকগুলো বছর কাটলো, আমরা বড় হলাম।

দুই পরিবারের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। সকলে মিলে একসাথে বেড়াতে যাওয়া হত বছরে দু’বার কাছে-দুরে । বড়দের মধ্যে যে কথা হয়েছিল সেসব আমরা কিন্তু কিছুই জানতাম না । আমি তাকে দাদা বলতাম আর সে আমাকে ছোট বোনের মত নাম ধরেই ডাকত। দুজনে-দুজনকে তুই-তোকারি করতাম। কোন ভালোবাসার সম্পর্ক কিন্তু ছিলো না আমাদের মধ্যে। ভালো করে কথাই বলতাম না কেউ কারো সাথে। সে আমার থেকে মাত্র বছর দুয়েকের বড়।

আমি বি. এস. সি পাশ করলাম। সেও হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করল। যখন সে গোয়ায় যাবে ট্রেনিং-এ,,তখনই পিসিমনি(ওর মা) নতুন করে আবার প্রস্তাব দিলেন আমার বাবাকে। বাবা,মা তো রাজি হয়েই ছিলেন। জেঠু-কাকারাও শুনেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কানাঘুষো আমার কানেও এসে পৌঁছল। আমার এক জ্যাঠতুতো বৌদি একদিন আমাকে সব বলল।আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, ‘বল কি’!! বৌদি এটাও বলল ‘তিনি’ও নাকি সব শুনেছেন এবং রাজি হয়েছেন। আমার তো গালে হাত!! মনে মনে তার গুষ্ঠির ষষ্ঠী পুজো করলাম,’ওরে ব্যাটা,,গাছেরও খাবি তলারও কুড়োবি! দাঁড়া হচ্ছে তোর।’

আমার এমন ভাবনার কারন,, ওর বোনের মুখেই শুনেছি,, সিটি কলেজে ওর নাকি অবাঙালী একটা মেয়ের সাথে অ্যাফেয়ার’স আছে। ওর সাথে বেশী কথা হতো না।বড্ড রিজার্ভ টাইপের। আমিও তাই ওকে এড়িয়েই চলতাম একটু। ওর বোন শালিনীকেই পাকড়াও করলাম,’কি ব্যাপার বল তো?’ সে তো হেসে লুটোপুটি। বলল, ‘ধুর ওসব খুচরো প্রেম,, কবেই চুকেবুকে গেছে। কেন তুইও তো বলেছিলি সেই যে সেই ছেলেটার কথা,,! আমি চমকে উঠে সাথে সাথে হাত জোর করে বললাম, ‘ক্ষেমা দে মা!! আর কিচ্ছুটি বলব না, কিচ্ছুটি জানতে চাইব না।’ আবার হো হো করে হেসে উঠল শালিনী।

ভেবে দেখলাম, ‘ঠিক ই তো,,ওসব হল গিয়ে বয়সের ধর্ম।আমরা তো আর জানতাম না যে আমরা পরস্পরের বাগদত্তা! তাই প্রকৃতির নিয়ম মেনে টুকটাক আলাদা আলাদা কিছু সম্পর্কে হয়তো জড়িয়ে পড়েছিলাম দুজনেই ।এখন সেসব অতীতের গল্প।আর ও যখন রাজি আছে,,, আমারো রাজি হয়ে যাওয়াটাই উচিত। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা,, সুন্দর বন্ধুত্ব,, এসব নষ্ট করতে মন চাইল না আমার । আর হ্যাঁ আরো একটা ব্যাপার ,, সেটা হল ছোটবেলা থেকেই আমি এমনিতেই ওই সুদর্শন বালকটিকে একটু (বেশী) পছন্দই করতাম আর কি ।’ তো যাই হোক। এর দিনকতক পরে একদিন কম্পিউটার ক্লাস থেকে ফিরে রাতের খাবার খেতে বসেছি,,, মা বললেন,

-শুনেছিস্ তো বৌদির কাছে সব।
-কি সব!

একটু নাটক করার চেষ্টা করলাম। মা বলল কেন বৌদি বলেনি!পিসিমনির ছেলে বাবাই-এর সাথে বিয়ে,, আমি সাথে সাথে রে রে করে মা কে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

-ও হ্যাঁ হ্যাঁ । কিন্তু ও তো দাদা। একবার ফোঁটাও দিয়েছি ।ওই যে গো পুজোর পর যেবার দার্জিলিং গেলাম,, মা বলল,
-ধুর্ ওতে কিচ্ছু না। ও তো খেলাচ্ছলে,,

আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘তাহলে বেশ তো তোমরা যা ভালো বোঝ তাই কর ,আমি আর কি বলবো? তোমরা তো আমার সবচেয়ে ভালোটাই চাইবে,তাই না মা! তার ওপর আমার আর কিছু বলার নেই। আসলে মনে মনে চাইছিলাম বিয়ে টা হোক তাড়াতাড়ি হোক। ছোটবেলা থেকেই পুতুল খেলা ঘর সংসার করার বড় শখ যে আমার। সে স্বপ্ন এবার পূরণ হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

ব্যস্,আর কি,,,সেই মহিলা যিনি আমাকে কোলে নিয়ে আমাকে পছন্দ করেছিলেন মানে আমার শাশুড়ী মাতা,,, মূলত তারই তৎপরতায় সং সেজে সংসার ধর্মে প্রবেশ। দুই সন্তানের জনক -জননী সেজে পরিপূর্ণ গার্হস্থ্য জীবন যাপন । আজ আঠারো বছর হয়ে গেল চাকা ঘুরে চলেছে,ঘুরেই চলেছে সেই জাঁতাকলের ,,চাইলেও আর কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না,, চাক্কি পিসিং অ্যান্ড পিসিং অ্যান্ড পিসিং অ্যান্ড,,

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত