গল্প হলেও সত্যি

গল্প হলেও সত্যি

খিটখিটে স্বভাবের রতনবাবু – বাজারের মুদি দোকানদার। মুদি দোকানদার অথচ বাবু, কেন? নিশ্চয় বাবু সুলভ চেহারা! গৌরবর্ণ, শরীরের মধ‍্যভাগ কিঞ্চিৎ স্ফীত, মস্তকে গোলাকার চাঁদ? একেবারেই নয়, বরং উল্টো। শীর্ণকায় চেহারা, মাঝারী উচ্চতা, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল,সরু গোঁফ, নাকের ওপরে চশমা। বাবু হওয়ার কারণ অন‍্য। আদর্শবান স্কুল শিক্ষকের আদর্শবান পুত্র তিনি। পড়াশোনা করেছেন প্রচুর। ভূগোলে অগাধ জ্ঞান। তবে বই পড়া জ্ঞান নয়, ভ্রমন করা জ্ঞান। দোকানের সাটার বন্ধ দেখলেই খরিদ্দাররা বুঝে যায় রতনবাবু সপরিবারে ভ্রমনে গিয়েছেন, কোথায় গিয়েছেন সেটা অবশ‍্য একান্তই ব‍্যক্তিগত। এক সময় সরকারী চাকরীর জন‍্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, অবশেষে অজানা কারণে হাল ছেড়ে দিয়ে এই দোকান খুলেছেন।

‘রতনবাবু একশো গ্রাম বাদাম দিন তো, ভালো হবে তো’? রতনবাবুর চাঁছাছোলা উত্তর ‘দেখে নিন’। ‘রতনবাবু দুহাজার টাকার নোটটা ভাঙিয়ে দিন না’! ‘এখন হবেনা, পরে আসবেন’। ‘কিন্তু দরকারটা যে এখন’। ‘আপনার টাকা ভাঙাতে আমি তো আর দোকান ছেড়ে মন্দিরের প্রণামী বাক্স আনতে যাবনা’!

‘মাত্র দুটো জিনিস, একটু তাড়াতাড়ি দিন না’। দাঁড়াতে হবে’। এইসব শোনার পরেও খরিদ্দাররা কিন্তু অন‍্য দোকানে যায়না। বাধ‍্য ছাত্র-ছাত্রীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এর অবশ‍্য অনেক গুলো কারণ আছে। প্রধান কারণ হলো দোকানদার খিটখিটে হলেও দোকানের জিনিস কিন্তু একদম খাঁটি। চোখ বন্ধ করে নেওয়া যায়। এই ভরসাটুকুর জন‍্যই তো চেনা খরিদ্দাররা ভুল করেও কখনো রতন বা রতনদা বলে ফেলেনা, রতন বাবুই বলে।

কিছুদিন ধরে একদল বখাটে ছেলে আসে রতনবাবুর দোকানে। এ পাড়ায় নতুন বলেই মনে হয়।একদিন দলবল নিয়ে এসে লম্বা ছেলেটা বলে “কাকু!একটা ডার্ক চকোলেট”। রতনবাবু তখন একজন মহিলা খরিদ্দারকে হেয়ার কালার দেখাচ্ছিলেন। ছেলের দলের মধ‍্যে থেকে একজন চাপাস্বরে বলে “কাকু মনে হয় কাকীমাদের প্রায়োরিটি বেশী দেয় তাই আমাদের দিতে দেরী করছে”। চাপাস্বরে বললেও কথাটা রবিবাবুর কানে যায়। আর একদিন এসে বলে “কাকু! ডার্ক ফ‍্যান্টাসী”। তারপর চলে যেতে যেতে বলে “আমাদের সাথে দু-একটান ওড়ালে তো সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়”! রতনবাবুর চোখে চোখ পড়তেই ছেলের দল চোখ নামিয়ে নেয়। রতনবাবুর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সেদিন, যেদিন লম্বা ছেলেটা বলে “গরমকালে কোল্ডড্রিংক থাকে, শীতকালে একটু অন‍্য কিছুর ব‍্যবস্থা করলে তো আর রতনবাবুর মনে হয় টেনে একটা থাপ্পড় মারেন ছেলেটার গালে। নিজের ছেলের কথা মনে পড়তেই হাত মুঠো করে নেন। কত আর বয়স হবে ছেলেটার? বড় জোর উনিশ কুড়ি।

আজ সকালে রতনবাবু দোকান খুলে প্রত‍্যেক দিনের মতো স্বর্গীয় বাবার ছবিতে রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে ধূপ দেখাচ্ছেন। সেই লম্বা ছেলেটা হন্ত দন্ত হয়ে আসে। আজ তার সাথে কেউ নেই। অনেক উৎকন্ঠার সাথে জিজ্ঞাসা করে “কাকু তুমি কি কিছু পেয়েছো? আমার মনে হচ্ছে কাল রাত্রে আমি এখানেই ফেলে গেছি। জানতে পারলে বাবা খুব মারবে। ওতে শুধু আমারই না, বন্ধুদেরও লাইব্রেরী ফীজ ছিল। কাকু প্লীজ! যদি তুমি পেয়ে থাকো কাল যখন সাটার বন্ধ করে রতনবাবু বাড়ী যাচ্ছিলেন তখন দোকানের ঠিক সামনেই একটা পার্স কুড়িয়ে পান।

সারারাত তার ঘুম হয়নি। টাকাটা যার, তার যদি রাত্রেই দরকার থাকে! কিন্তু রতনবাবু তো জানেননা কার টাকা যে গিয়ে দিয়ে আসবেন! ধূপ ঘোরাতে ঘোরাতেই জিজ্ঞাসা করেন ‘কত ছিলো’? ছেলেটি বলে ‘সাত হাজার’। রতনবাবু ড্রয়ার থেকে একটা মানিব‍্যাগ বার করে এগিয়ে দিয়ে বলে ‘গুনে নাও’। ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে বলে “হ‍্যাঁ কাকু, এটাই তো আমার পার্স! থ‍্যাংক ইউ কাকু, থ‍্যাংক ইউ। আগের দিনগুলোর জন‍্য সরি”। রতনবাবু নির্লিপ্ত হয়ে বলেন ” কাকুর কাছে কার প্রায়োরিটি বেশী সেসব না দেখে নিজের মা-বাবাকে প্রায়োরিটি দিতে শেখ। বাবার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা টাকা বন্ধুদের নামে উড়িয়োনা, সঞ্চয় করতে শেখ। ভবিষ‍্যতে কাজে লাগবে”। ছেলেটি আবারো হাতজোড় করে থ‍্যাংক ইউ বলে রতনবাবুকে।

ঘটনাটি যখন ঘটেছিল দোকানে কোন খরিদ্দার উপস্থিত ছিলনা। রতনবাবুও কাউকে কিছু বলেননি। কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। দোকানেরও দেওয়াল আছে তাই ঘটনাটা পাঁচকান হতে সময় লাগেনি। এখন খিটখিটে রতনবাবু, সবার কাছে সৎ রতনবাবু বলে পরিচিত। বলা বাহুল‍্য ছেলেটি এখনো দোকানে আসে তবে একদল বখাটে ছেলেকে সাথে নিয়ে নয়, মায়ের দেওয়া ফর্দ আর বাজারের ব‍্যাগ হাতে নিয়ে। রতনবাবু ছেলেটির পরিবর্ত্তনে খুশী হয়ে কখনো কখনো ছেলেটিকে ডার্ক চকোলেট, ডার্ক ফ‍্যান্টাসী খাওয়ান।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত