মা যখন লাগেজ গুছিয়ে চলে যাচ্ছিলো আমি পা ধরে বলেছিলাম,
– আমার কথাটা একবার শুনো, প্লিজ যেওনা।
মা আমার গালে হাত বুলিয়ে চলে গেলো। তখন আমার বয়স কত? সবে ক্লাশ সেভেনে উঠেছি।কান্না করতে করতে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি ফোনে কথা বলতে বলতে অন্যরুমে চলে গেলেন। আমার কথা কেউ শুনলোই না। এর আগেও তাদের ঝগড়ার মাঝে কিংবা অন্য কোন সময়ে অনেক কথাই বলতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। কোনদিন অবশ্য ভাবিওনি, ঝগড়া করতে করতে একদিন তারা দু’জন আলাদা হয়ে যাবে।
মা চলে যাবার পর ফ্লোরে গড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো কেঁদেছি, আমার কান্না থামানোর জন্য কেউ ছিলো না, রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি, চোখে কেবল ভেসে উঠতো বাবা মায়ের ঝগড়া আর মারামারির দৃশ্য, মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়নি। আসলে আমার বাবা মা নিজের পার্সোনালিটি, ক্যারিয়ার, ফ্রিডম এসব নিয়ে এতো বেশি সচেতন ছিলো যে, আমাকে নিয়ে ভাববার কোন সময়ই ছিলো না তাদের। ধীরে ধীরে আমি হয়ে গেলাম একা। আমার হাতে দামি ডিভাইস তুলে দেয়া হলো আর সাথে ব্যাগ ভর্তি টাকা।
স্কুলের প্যারেন্টস মিটিং এ তারা বরাবরই অনুপস্থিত। রেজাল্ট খারাপ, বাবা মায়ের অবহেলা সব মিলিয়ে স্কুল থেকে বিদায়। নতুন করে আবার অন্য স্কুলে এডমিশন। এভাবে বছর বছর স্কুল পাল্টাতে গিয়ে ভালো কোন বন্ধুও হয়ে উঠেনি আমার। পাশ, ফেইল, স্কুল বদল এসব করতে করতে এস.এস.সি পাশ করলাম। এই বয়সেই আমার অবশ্য নিজের ফ্ল্যাট হয়েছে, একাই থাকি সেই ফ্ল্যাটে। বাবা মা মাসে একবার আসে, দেখে যায়, সেলফি তুলে, মিডিয়ায় পোস্ট দেয়, ব্যাস..হয়ে গেলো আমার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ৷ নতুন কলেজে এক ক্লাশমেট তার বাবা মাকে নিয়ে অভিযোগের সুর তুলে বলেছিলো,
– এই বাবা মাকে নিয়ে না আর পারিনা। সারাক্ষণ আমার পেছনে বডি গার্ডের মতো লেগে থাকে, কতোটুকু হাসবো, কতোটুকু কাঁদবো, খাবো কি, পরবো কি সব তাদের পছন্দ মতো করতে হবে, আমার ইচ্ছের কোন দামই নেই।
ওর অভিযোগ শুনে আমার আফসোস হচ্ছিলো। বললাম,
– তোরতো তাও বডিগার্ডের মতো বাবা-মা আছে, অভিযোগ করার সুযোগ আছে, আর আমার কথা ভাব, তাদের নিয়ে অভিযোগ করাতো দূর থাক, মাঝে মাঝেতো এ নিয়েই সন্দেহ হয় যে, তারা সত্যি আমার বাবা মা কিনা!
মাস খানেক পর সেই ক্লাশমেট একটা চিরকুট লিখে বাড়ি ঘর ছেড়ে কোথায় যেনো চলে গেলো। চিরকুটে লিখা ছিলো,
– এই পৃথিবীতে আমি নিজ ইচ্ছায় আসিনি বলেই কি আমার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই? সারাক্ষণ এটা কর, ওটা করিস না শুনতে শুনতে আমি মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই, আমার করণীয় ঠিক কি? আমি কেন জন্মেছি? নিজের ঘরে মরার মতো পরে থাকার চাইতে রাস্তায় মরে পড়ে থাকা অনেক ভালো। অনার্সে ভর্তি হয়ে রঙ নাম্বারে আলাপ হলো এক ছেলের সাথে। মনে হলো, এতো বছরে একটা নিজের লোক পেলাম। প্রথম কয়দিন ভালোই কথা হয়েছিলো, সবে মাত্র নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখছিলাম, কথা হলো দেখা করবো। যেদিন দেখা করতে গেলাম, আমার থেকে সব টাকা ধার হিসেবে নিয়ে নিলো, নিজের মোবাইলটা নষ্ট বলে আমার মোবাইলটাও নিয়ে নিলো। তারপর আর কোনদিন ছেলেটিকে পেলাম না, কোথাও না। মাকে ফোন দিয়ে বললাম,
– আমার কথাটা একটু শুনবে?
– আমি মিটিং এ। বাবাকে ফোন দিলাম,
– আমার কথাটা একটু শুনবে?
– আমি মিটিং এ।
আমি কোনদিনই আমার কথা বলতে পারিনি তাদের। যখনি বলতে গিয়েছি তখনি শুনেছি, আমি মিটিং এ কিংবা মা বলতো, “তোমার বাবাকে ফোন করো” আর বাবা বলতো, “তোমার মাকে ফোন করো”। নিরুপায় আমি আল্লাহকে বলতাম, “কাকে বলবো? কাকে রেখেছো আমার কথা শুনার জন্য?”
জীবনের তেইশটি বছর পার হয়ে গেছে আমার, এতোটুকু বয়সে ফ্ল্যাট, গাড়ি, ডিভাইস, টাকা সবই পেয়েছি যা পাওয়ার মতো প্রাপ্ত বয়স্ক আমি মোটেই নই। শুধু পাইনি মন খুলে কথা বলার মতো একজন মানুষ, যা আমার জন্য ছিলো অপরিহার্য। আমার জন্য কারও সময় হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসা থেকে অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে যাবো, যেখানে মানুষ থাকবে কিন্তু কথা বলার ইচ্ছে থাকবে না, আমার কথা শুনার ভয়ে কেউ আমার থেকে পালিয়ে বেড়াবে না। ঢাকা টু সিলেট হাইওয়েতে আজ যে মেয়েটা ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে, উপরের কথাগুলো সেই মেয়ের ডায়রিতে লিখা ছিলো। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাবা মা দু’জনেই মর্গে এসেছে। লাশ ধরে বলছে,
– কথা বল মা। ডিউটিরত পুলিশ অফিসার বললেন,
– এতোকাল জ্যান্ত মেয়েটাকে লাশ বানিয়ে রেখে এখন লাশকে বলছেন কথা বলতে। আপনাদের হাই সোসাইটির দেয়া হাইপার টেনশন নিয়ে না সত্যি আর পারিনা! ওসব ন্যাকা কান্না বন্ধ করে ফরমালিটিস গুলো সারুন। আচ্ছা, মেয়ের শেষ কীর্তি করার জন্য সময় হাতে নিয়ে এসেছেন নাকি সেটাও আমাদের কাঁধেই ফেলে দেবেন ওই মিটিং মিছিলের বাহানা দিয়ে?