বউয়ের সাথে সেলফোনে কথা বলে বলে হাঁটছিলাম ফার্মগেট ওভারব্রিজ দিয়ে। ওভারব্রিজ থেকে নেমে বাসে উঠে বাসায় আসবো। মানুষজনের ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে এগোচ্ছিলাম। বউকে বললাম, ‘লাইনেই থাকো, কল কেটো না। আমি ওভারব্রিজ থেকে নেমে কথা বলছি।’ ফার্মগেট হলো দুনিয়ার মানুষের আখড়া। কেউ যদি শুধু মানুষ দেখতে চায় সে ফার্মগেটের ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে মনের সুখে মানুষ দেখতে পারবে।
চারিদিকে মানুষের ঠেলাঠেলি। এর মধ্যে হকার এবং ভিক্ষুকদের আস্তানাও ওভারব্রিজ। তাড়াহুরো করে নামলাম ওভারব্রিজ থেকে। নেমেই ফোন কানে নিলাম। বউ এতক্ষণ লাইনেই ছিল। ‘হ্যাঁ বলো এবার। কি মানুষ আজ। ধাক্কাধাক্কি করে নামলাম।’ ‘আচ্ছা কি বাঘের খাঁচা বিক্রি করছে একদাম একশো দিয়ে?’ ‘কোথায় কি বিক্রি করছে?’ ‘একটু আগেই তো শুনলাম। আমি তোমাকে বলছিলাম ও দেখো তো কি বাঘের খাঁচা বিক্রি করছে। কিন্তু তুমি তো ফোন হাতে ধরেছিলে মনেহয় তাই শুনো নাই।’
‘তাহলে ওভারব্রিজের ওখানে বিক্রি করছিলো হয়তো।’ ‘প্লিজ একটু গিয়ে দেখো না কেমন বাঘের খাঁচা বিক্রি করছে। একদাম একশো টাকায়।’ ‘আরে মাথা খারাপ নাকি। কে উঠবে আবার ঠেলাঠেলি করে।’ ‘প্লিজ যাও না। আমার জন্য একটা বাঘের খাঁচা নিয়ে আসো। প্লিজ যাও না প্লিজ।’ ‘সম্ভব না। আগামীকাল আসার সময় দেখবো কিসের বাঘের খাঁচা বিক্রি করে।’ ‘যাও কথা নাই তোমার সাথে।’ গোসসাময়ী বউ রাগ করে ফোন কেটে দিলো। এখন আর ফোন করলেও ধরবে না। একবার ভাবলাম গিয়েই দেখি কেমন বাঘের খাঁচা বিক্রি করে। পিছন ফিরে মানুষের ঢল দেখে আর সাহসে কুলালো না। বাসে উঠে শ্যামলীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
বাসায় ঢুকতেই বউ রাগ করে পিছন ফিরে চলে গেলো। কোনো কথাই বলল না। এই রাগ বাঘের খাঁচা না আনা পর্যন্ত আর কমবে না। আগামীকাল পর্যন্ত বউয়ের রাগের ইনিংস চলতে থাকবে। এই এক জ্বালা যন্ত্রণা। বউয়ের মাসে ত্রিশ দিনে একশো ত্রিশ বার রাগ উঠে। বউরা আসলে যত না মেয়ে তারচেয়েও বেশি অভিমানের গোডাউন। এদের গোডাউনে হরেক রকমের অভিমান পাওয়া যায়। হেলাল হাফিজের কষ্টের ফেরিওয়ালা কবিতার মতো এদের নিয়ে একটা কবিতা লেখা দরকার- অভিমানের গোডাউনওয়ালা।
অভিমান নেবে অভিমান হরেক রকম অভিমান আছে পিংক অভিমান পার্পল অভিমান নীল জামার রঙ উঠার অভিমান অভিমান নেবে অভিমান ওজন বাড়ার অভিমান আছে গতমাসে কেনা জামাটা টাইট হয়ে যাওয়ার অভিমান অভিমান নেবে অভিমান ঢংগের অভিমান- রঙের অভিমান এমনি অভিমান তেমনি অভিমান অনেক রকম জানি না অভিমান আছে
বউয়ের অভিমান বলেন আর গোসসাই বলেন সে চায় আমি গিয়ে যেন মান ভাঙ্গাই। ভাঙ্গাতে না গেলে কেন ভাঙ্গালাম না সেটা নিয়ে আরেক অভিমান শুরু হয়। বিয়ে করে মানুষ যে বলে জীবন তেজপাতা হয়ে যায়। বউদের এসব জ্বালা যন্ত্রণাতেই তেজপাতা হয়। এভারগ্রীন আর থাকা হয় না। কিন্তু আমি এখন আর অভিমান টান ভাঙ্গাতে যাই না। আমি জানি ও নিজেই আমার কাছে আসবে। রাতে খাবার খাওয়ার সময়ও দেখলাম বউয়ের মুখ ভার। বললাম, ‘আচ্ছা নিয়ে আসবো আগামীকাল তোমার জন্য বাঘের খাঁচা। প্রমিস নিয়ে আসবো।’ তাও বউয়ের মন গলে না। ঘুমাতে যাওয়ার সময় দেখি বউ অন্য দিকে মুখ ফিরে শুয়ে আছি। আমিও আর কিছু না বলে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে গেলাম।
একটু পরে বউয়ের এপাশ ওপাশ ফেরার শব্দ শুনি। আমি জানি আবছা আলোতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে রাগি রাগি চোখে। হয়তো ভেংচিও দিয়েছে। একটু পরে আমার পিঠে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আমার দিকে ফিরে শোও।’ আমি শুতেই বউ আবার অন্যদিকে পাশ ফিরে শুলো। আমি চুপচাপ হাসি বউয়ের এসব কাণ্ডকারখানা দেখে। একটু একটু করে বউ আমার দিকে আসছে। কাছাকাছি এসে বলল, ‘কোমরে হাত রাখো। খবরদার অন্যকিছু করার চিন্তাও করবে না। আমার রাগ এখনো পরেনি। তুমি কোমরে হাত না রাখলে আমার ঘুম হয় না তাই রাখতে বলছি।’ আমিও হাত রেখে বউয়ের কথা গুলা শুনছিলাম। ফিসফিস করে কি যেন বলছে রেগেমেগে। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না, ‘অসভ্য একটা… সারাদিন আমাকে ক্ষ্যাপাবে অথচ রাগ ভাঙ্গাবে না… ঘাড়ত্যাড়া খাটাস বুড়া বেটা একটা… বিরক্তিকর… এটাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না বলে এক সাথে থাকি। নইলে কবেই বাবার বাড়ি চলে যেতাম।’ বউয়ের এসব শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
অফিস থেকে ফেরার সময় চোখ কান খোলা রেখে ফার্মগেট ওভারব্রিজের উপরে উঠলাম। বাঘের খাঁচা নিয়ে যেতে না পারলে বউ আজ তরকারিতে লবণ দিয়ে ভরিয়ে রাখবে। ভিড়ের মধ্যে এদিক ওদিক দেখছি কোথায় বিক্রি করে বাঘের খাঁচা। তখনই শুনতে পেলাম- বাঘের খাঁচা একদাম একশো। সেদিকে গেলাম। গিয়ে সেই হকারের সামনে গিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। বাঘের খাঁচা বলে এটা কি বিক্রি করছে বদমাইসটা। হকার বলল, ‘স্যার নিয়া যান একটা বাঘের খাঁচা। একদাম একশো। কোনটা লাগবো হাতে নিয়া দেখেন। পছন্দ হইলে নিয়া যাবেন। কোনো মূলামুলি নাই। এক দাম একশো।’ কালো রঙের একটা বাঘের খাঁচা কিনে নিলাম একশো টাকা দিয়ে। বউ কিনা এই বাঘের খাঁচার জন্য রাগ করে আছে আমার উপরে। এই বাঘের খাঁচা দেখার পরে কি হবে সেটাই ভাবছি।
বাসায় ঢুকতেই বউ দেখি হাসি হাসি মুখে কৌতূহলী চোখে আমাকে জিগ্যেস করছে, ‘কই আনো নাই বাঘের খাঁচা?’ আমি সোফায় বসে অফিস ব্যাগটা পাশে রেখে বললাম, ‘এই ব্যাগের ভিতরে।’ বউ ব্যাগ নিয়ে ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে বলল, ‘বাঘের খাঁচা এইটুকু ব্যাগে কি করে ধরবে।’ বললাম, ‘দেখলেই বুঝবা কি করে ধরছে এই ব্যাগে।’
বউ বলল, ‘কই পাচ্ছি না তো।’ বললাম, ‘একদম উপরে কাগজের একটা প্যাকেট আছে। ঐটাতে আছে তোমার বাঘের খাঁচা।’ বউ প্যাকেটটা নিয়ে প্যাকেট থেকে বাঘের খাঁচা বের করে ঠিক আমার মতোই চোখ ছানাবড়া করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমাদের কত মিল। আমরা একই ভাবে চোখ ছানাবড়া করি। জিগ্যেস করলাম, ‘পছন্দ হয়েছে তোমার বাঘের খাঁচা?’ বউ আমার দিকে বাঘের খাঁচা ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ইয়াক! ছেলেদের আন্ডারওয়্যার কে বাঘের খাঁচা বলে বিক্রি করে! ঐ হারামজাদা হকারকে যদি পাইতাম পাটাপুতা দিয়ে ছেচতাম। হামারজাদা আন্ডারওয়্যার কে বলে বাঘের খাঁচা। আর তুমিও কিনা আমার জন্য কিনে আনলা। তুমি তো ঐ হকার হারামজাদার চেয়েও আরো বেশি খারাপ।’










