রাণী না খুনি?

রাণী না খুনি?

রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস সন্ধ্যার সময় আমাদিগের সদর আফিস হইতে কাগজ পত্র আসিবার পর দেখিলাম, অপরাপর কাগজ-পত্রের সহিত একখানি দরখাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেই দরখাঙ্কের সত্যাসত্যের বিষয় অনুসন্ধান করিবার তার আমার উপর ন্যস্ত আছে। দরখাস্তখানি আমি আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। দেখি লাম, বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত-ব্যবসায়ী এই দরখাস্ত করিতেছেন। সেই দরখাস্তের মৰ্ম্ম এইরূপ–

আজ কয়েকদিবস অতীত হইল, কতকগুলি জহরত খরিদ করিকার নিমিত্ত, একজন রাণী আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক একজন লোক ছিল, তিনি জহরতের দালাল, কি রাণীজির লোক, তাহা আমরা অবগত নহি। দালালি করিতে ইতিপূর্বে আমরা কখন তাহাকে দেখি নাই, অথচ রাণীজির সহিত তাহাকে কথা কহিতে শুনি আছি। রাণীজি একখানি গাড়িতে করিয়া আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি গাড়ি হইতে অবতরণ করেন নাই, বা আমাদিগের সহিত কোনরূপ কথাবার্তাও কহেন নাই। তাহার যাহা কিছু বলিবার প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর প্রমুখাৎই তিনি সমস্ত বলিয়াছিলেন। রাণীজি আমাদিগের দোকানে আসিয়া কতকগুলি জহরত খরিদ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং কতকগুলি জহরতও দেখিতে চাহেন। সেই সকল জহরতের মধ্য হইতে প্রায় দশ হাজার টাকার মূল্যবান্ কয়েকখানি জহরত পসন্দ করিয়া বলিয়া যান, সেই সকল জহরত যেন তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। সেই স্থানে জহরত লইয়া কোন ব্যক্তি গমন করিলে, তিনি সেই সকল দ্রব্য নগদ মুল্যে গ্রহণ করিবেন, এবং আরও যদি কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, এরূপ মনে করেন, তাহাও তাহাকে বলিয়া দিবেন। এই কথা বলিয়া রাণীজি প্রস্থান করেন। কিন্তু তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক যে লোকটা আগমন করিয়াছিলেন, তিনি আমাদিগের ললাকে রাণীজির বাড়ীতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার মানসে সেই স্থানেই অপেক্ষা করেন। আমাদিগের দোকানের অতিশয় বিশ্বাসী রামজী লাল নামক যে একজন বহু পুরাতন কৰ্মচারী ছিলেন, তিনি সেই জহরত লইয়া কালীবাবুর সহিত একখানি গাড়িতে প্রস্থান করেন। সেই সময় হইতে আর রামজীলাল প্রত্যাবর্তন করেন নাই, বা জহরত কি তাহার মূল্যও এ পর্যন্ত পাঠাইয়া দেন নাই। আমরা এ পর্যন্ত নানা স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাঁহার্য দেশে পৰ্য্যন্ত টেলিগ্রাফ করিয়াছি; কিন্তু কোন স্থান হইতেই তাহার কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই। এখন আমরা বুঝিতে পারিতেছি না যে, রামজীলালের ও তাহার নিকটস্থিত সেই বহুমূল্য জহরতগুলির অবস্থা এখন কি হইয়াছে। এই নিমিত্ত এই আবেদনপত্রের দ্বারা সরকারের সাহায্য গ্রহণ করিতেছি, তাঁহারা অনুসন্ধান করিয়া, যাহাতে রামজীলাল ও জহরতগুলির অনুসন্ধান হয়, তাহার চেষ্টা করুন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধান করিতে যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমরা প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

এই দরখাস্তের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত হইলে, আমি কিন্তু সেই রাত্রিতে উহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম না। পরদিবস হইতে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম; কিন্তু কালীবাবু ও রামজীলাল সম্বন্ধে নানাপ্রকার তর্ক আসিয়া মনে উপস্থিত হইতে লাগিল।

একবার ভাবিলাম, রামজীলাল নিশ্চয়ই একজন সামান্য বেতনের কৰ্ম্মচারী হইবেন, দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত তাহার হস্তে একবারে পতিত হইয়াছে, এ লোভ সম্বরণ করা তাহার পক্ষে কতদুর সম্ভব? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, রামজীলাল যে ধনীর কাৰ্য করিয়া থাকেন, তিনি নিজেই বলিতেছেন যে, রামজীলাল একজন। বহু পুরাতন ও অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী। যদি তাহার কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে অনেক সময় তাহার হস্তে যে অনেক অর্থ আসিয়া পড়ে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় এই সকল জহরত বা তাহার মুল্য গ্রহণ করিয়া পলায়ন করা রামজীলালের পক্ষে কতদুর সম্ভব, তাহা স্থির করিয়া উঠা নিতান্ত সহজে নহে।

দ্বিতীয়ত, যে রাণীজি জহরত খরিদ করিতে আগমন করিয়া ছিলেন, তিনিই বা কে? এবং তাঁহার সমভিব্যাহারে কালীবাবু নামক যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছিলেন, তিনিই বা কে? রাণীজি যদি প্রকৃতই রাণীজি হইবেন, তাহা হইলে তিনি নিজে বাজারে জহরত খরিদ করিতেই বা আসিবেন কেন? বাড়ীতে বসিয়া সংবাদ পাঠাইলেই ত অনেক বড় বড় জহুরী তাহার নিকট জহরত লইয়া যাইত। আর যদি তিনি নিজেই জহরত খরিদ করিবার মানসে বাজারে আসিলেন, তাহা হইলে কেবলমাত্র এক কালীবাবু ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত আগমন করিল না কেন? আর কালীবাবু তাহার নিজের লোক, কি বাজারের দালাল, তাহারই বা ঠিকানা কি? কালীবাবু যদি তাহার নিজের লোকই হইবেন, তাহা হইলে তাহাকে দোকানে পরিত্যাগ করিয়া তিনি কেবলমাত্র সহিস-কোচবানের সঙ্গেই বা গমন করিলেন কিরূপে? আর যদি কালীবাবু বাজারের দালালই হইবেন, তাহা হইলে রাণীজি তাহার সহিত বাজারে আসিতে কিরূপে সাহসী হইলেন? এরূপ অবস্থায় ইহার ভিতরের কথা অনুমান করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। তবে রাণীজি যদি কোন রাজবংশীয়া দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক হন, তাহা হইলে এইরূপ ভাবে অনায়াসেই তিনি বাজারে আদিতে সমর্থ হইবেন; কিন্তু প্রকৃত রাণী এরূপ ভাবে বাজারে আসিতে কখনই সাহসী হইতে পারেন না। আরও এক কথা, রামজীলাল যদি প্রকৃতই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া প্রস্থান করিয়া পাকেন, এবং কালীবাবু যদি তাহার সহিত এই অসৎকার্যে মিলিত না থাকেন, অথচ কালীবাবু যদি প্রকৃতই একজন দালাল হন, তাহা হইলে দালালী লইবার প্রত্যাশায় কালীবাবু সেই জহরতের দোকানে এ পর্যন্ত আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না কেন? আবার মনে হইল, আজকাল রাজা বা রাণী সাজিয়া যে সকল ভয়ানক ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়া থাকে, ইহা সেই প্রকারের কোন একরূপ জুয়াচুরি নয় ত? যদি তাই হয়, যদি সেইরূপ ভাবে কোনরূপ জুয়াচুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে রামজীলাল কোথায় গমন করিল? ইহার অনুসন্ধানের ভিতর বড়ই গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে; এক কথা ভাবিতে গেলে, অপর আর একটা কথা মনে আসিয়া সমস্ত চিন্তাকেই সন্দেহে পরিণত করিয়া দিতেছে। এ সম্বন্ধে আর কোন কথা ভাবিব না, কল্য প্রাতঃ কাল হইতে ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। অনুসন্ধানে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব, তখন তাহার উপর নির্ভর করিয়া সবিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিব, এই অনুসন্ধান আমার দ্বারা সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারে কি না। যদি কৃতকার্য হইব মনে করি, তাহা হইলে ইহাতে সম্পূর্ণরূপে হস্তক্ষেপ করিব। নতুবা উৰ্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণকে বলিয়া, এই অনুসন্ধানের ভার অপরের  হস্তে প্রদান করিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোন বিষয় চিন্তা করিব না, ইহা স্থির করিলাম; কিন্তু কাৰ্য্যে তাহা পরিণত করিতে পারিলাম না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

পরদিবস প্রত্যূষেই আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। থানা হইতে বহির্গত হইয়া, প্রথমেই দরখাস্তকারী জহরত-ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমি দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় যাহার দোকান, তিনি দোকানে উপস্থিত ছিলেন না। কয়েকজন কর্ম্মচারী কেবল মাত্র দোকানে উপস্থিত ছিলেন। আমি কে, এবং কি নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তাহা অবগত হইবার পর, দোকানের একজন কর্ম্মচারী আমাকে সঙ্গে করিয়া সেই দোকানের স্বত্বাধি কারীর নিকট লইয়া গেলেন। সেই সময় তিনি আপনার বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন। আমার পরিচয় ও সেই স্থানে আমার গমনের কারণ অবগত হইয়া, সবিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাকে বসা ইলেন, এবং তাহার দোকানের যে কর্ম্মচারী আমার সহিত সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে তাঁহার দোকানে প্রত্যাবর্তন করিতে কহিলেন। আদেশমাত্র কর্ম্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কর্ম্মচারী প্রস্থান করিবার পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি দরখাস্ত করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্যের অনুসন্ধানের ভার কি আপনার উপর অর্পিত হইয়াছে?

আমি। তাহারই অনুসন্ধান করিবার মানসে আমি এই স্থানে আগমন করিয়াছি।

ধনী। আমি যে সকল কথা দরখাস্তে লিখিয়াছি, তাহা আপনি উত্তমরূপে পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?

আমি। আমি উহা বেশ করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছি, এবং বরখাস্তখানি আমার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।

এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই দরখাস্তখানি বাহির করিয়া, আমার সম্মুখে রাখিয়া দিলাম, এবং তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি দরখাস্তে যে সকল বিষয় লিখিয়াছেন,

তদ্ব্যতীত আর কোন কথা আমাকে বলিতে চাহেন কি?

ধনী। যাহা কিছু আমার বলিবার, তাহা আমি এই দরখাস্তে ব্যক্ত করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর কোন বিষয় যদি আপনি অবগত হইতে চাহেন, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যতদূর জানি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

আমি। যে সময় রাণীজি জহরত খরিদ করিবার মানসে কালী বাবুর সমভিব্যাহারে আপনার দোকানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় আপনি নিজে বোধ হয়, দোকানে উপস্থিত ছিলেন না?

ধনী। সেই সময় আমি নিজে দোকানে উপস্থিত ছিলাম। যাহা কিছু হইয়াছিল, তাহার সমস্তই আমার সম্মুখে হইয়াছিল।

আমি। রাণীজিকে কি আপনি দেখিয়াছিলেন?

ধনী। তাহাকে আমরা কেহই দর্শন করি নাই। তিনি গাড়ির ভিতরে ছিলেন, গাড়ি হইতে তিনি বহির্গত হন নাই, বা গাড়ির আবরণও উন্মুক্ত করা হয় নাই।

আমি। যে গাড়ির ভিতর রাণীজি ছিলেন বলিতেছেন, সেই গাড়ির ভিতর কোন লোক যে ছিল, তাহা আপনারা কোনরূপে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন কি?

ধনী। গাড়ির ভিতর যে লোক ছিল, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। যদিও আমরা তাহাকে স্পষ্ট দেখি নাই; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদির কিয়দংশ মধ্যে মধ্যে আমরা দেখিয়াছিলাম, এবং তাঁহার বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথাও আমরা শুনিতে পাইয়াছিলাম।

আমি। আপনারা তাহার কথা শুনিয়া, তাহাকে স্ত্রীলোক বলিয়াই অনুমান করিয়াছিলেন?

ধনী। তিনি যে স্ত্রীলোক, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। তাহা আমরা স্থির করিতে পারি নাই। কারণ, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর সহিত যখন তিনি কথা বলিয়াছিলেন, তখন বাঙ্গালা কথাই বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমরা তাহাকে যে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহার উত্তরে, এবং মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে যে দুই একটী অপর কোন জহরত দেখাইতে বলিয়াছিলেন, তাহা হিন্দী ভাষায় বলিয়াছিলেন। কিন্তু সে হিন্দী বেশ পরিষ্কার হিন্দী নহে, যেন বাঙ্গালার সহিত মিশ্রিত বলিয়া আমার অনুমান হইয়াছিল।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কেহ ছিল?

ধনী। তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কাহাকেও দেখি নাই, বা অপর আর কোন ব্যক্তির কোনরূপ কথাও শুনিতে পাই নাই।

আমি। তিনি কোন স্থানের রাণী, তাহা কিছু আপনাকে বলিয়াছিলেন কি?

ধনী। তিনি আমাকে বলেন নাই; কিন্তু কালীবাবু বলিয়া ছিলেন। যে স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহা আমায় মনে নাই, সেই স্থানের নাম ইতিপূৰ্বে আর কখনও শুনি নাই। সেই নামটী মনে করিবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টাও করিয়াছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করিয়া উঠিতে পারি নাই।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে আগমন করিয়াছিলেন, কালী বাবুও কি সেই গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

ধনী। না, রাণীজি একখানি জুড়িগাড়িতে আসিয়াছিলেন। কালীবাবু আসিয়াছিলেন-একখানি কম্পাস গাড়িতে।

আমি। উহা কি ঘরের গাড়ি বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। না, আমার বোধ হয়, উহা ঘরের গাড়ি নয়; আড়গোড়ার গাড়ি।

আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, উহা আড়গোড়ার গাড়ি?

ধনী। সেই গাড়ির সহিস-কোচবানের পোষাক ও পরিচ্ছদ দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই গাড়ি নিশ্চয়ই কোন এক আড়গোড়ার।

আমি। দুইখানি গাড়িই কি আড়গোড়ার গাড়ি বলিয়া অনু মান হয়?

ধনী। দুইখানিই এক আড়গোড়ার গাড়ি। দুইখানি গাড়ির সহিস-কোচবানদিগের পোষাক-পরিচ্ছদ একই প্রকারের।

আমি। রামজীলাল আপনার কে?

ধনী। রামজীলাল সম্পর্কে আমার কেহই হন না; কিন্তু তিনি আমার জহরতের দোকানের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারী।

আমি। কতদিবস হইতে তিনি আপনার দোকানে কল্প করিতেছেন?

ধনী। রামজীলাল আমার একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী; প্রায় ত্রিশ বৎসর তিনি আমার দোকানে কৰ্ম্ম করিতেছেন।

আমি। তাঁহার স্বভাব-চরিত্র কিরূপ?

ধনী। তাঁহার স্বভাব-চরিত্রও যেরূপ ভাল, তিনি বিশ্বাসীও সেইরূপ। আমার বোধ হয়, আমি আমাকে যতদূর বিশ্বাস করিতে না পারি, তাহা অপেক্ষা অধিক তাহাকে বিশ্বাস করিতে পারি। আমার দোকানের লক্ষ লক্ষ টাকার দ্রব্যাদি সমস্তই তাহার হস্তে, তিনি মনে করিলে ইহার সমস্তই অনায়াসেই আত্মসাৎ করিতে পারেন। কিন্তু তিনি এতদূর বিশ্বাসী যে, আজ পর্যন্ত একটা পয়সাও তাঁহা কর্তৃক অপহৃত হয় নাই।

আমি। রামজীলাল যদি আপনার এতদূর বিশ্বাসী কর্ম্মচারী, তাহা হইলে সেই দশ হাজার টাকার জহরত লইয়া তিনি কিরূপে প্রস্থান করিলেন?

ধনী। রামজীলাল যে সেই জহরত লইয়া পলায়ন করিয়া ছেন, তাহা কখনই সম্ভব হইতে পারে না। এরূপ কথা আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারি না।

আমি। তবে রামজীলাল কোথায় গমন করিলেন?

ধনী। আমিও তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়া প্রত্যাবর্তন করিতে পারিতেছেন না।

আমি। সে যাহা হউক, রামজীলাল যে সকল জহরত লইয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন কি?

ধনী। না, তাহা করি নাই। যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।

আমি। তাহা হইলে অনুগ্রহপূর্বক একটী সবিশেষ বিবরণ যুক্ত তালিকা প্রস্তুত করিয়া এখনই আমাকে প্রদান করুন।

আমার কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ জহরতগুলির সবিশেষ বিবরণ যুক্ত একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া কর্ম্মচারী আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, সেই সকল জহরত যদি অপরাপর জহরতের সহিত একত্র পুনরায় আপনাকে দেখাই, তাহা হইলে চিনিতে পারিবেন ত?

ধনী। জহরতগুলি যেরূপ অবস্থায় আমার এই স্থান হইতে লইয়া গিয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় যদি উহা না থাকে, তাহা হইলে উহার প্রত্যেক পাথরের মতি প্রভৃতি পৃথক পৃথক অবস্থায় অপর প্রস্তর প্রভৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া আমার সম্মুখে আনিবেন, দেখিবেন, আমার দ্রব্য আমি তাহার ভিতর হইতে অনায়াসেই বাছিয়া লইতে সমর্থ হইব।

জহরত-বিক্রেতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেইদিবস আমি তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় আমার মনে হইল, দোকানদার রামজীলালের চরিত্র সম্বন্ধে যেরূপ ভাবে বর্ণন করিলেন, তাহাতে রামজীলালের উপর এই সকল জহরত অপহরণ করা সম্বন্ধে কিরূপে সন্দেহ করিতে পারি? যে ব্যক্তি লক্ষ লক্ষ টাকা লইয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী সমস্ত কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত করেন, অথচ যাহার কার্যের নিমিত্ত মনিব কখনও একবারেরও নিমিত্ত দৃষ্টিপাত করেন না, সেই ব্যক্তি কেবলমাত্র যে দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত লইয়া পলায়ন করিবে, তাহা কিন্তু সহজে মনে স্থান দিতে পারা যায় না।

যাহা হউক, দোকানদারের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। ভাবিলাম, একটু পরেই পুনরায় এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া যাইব; কিন্তু কার্যে তাহা ঘটিল না। সেই সময় কোন একটী সবিশেষ প্রয়োজনীয় রাজ্য-সম্বন্ধীয় সরকারী কাৰ্য আসিয়া আমার হস্তে উপস্থিত হইল। সুতরাং বর্তমান কার্যের অনুসন্ধান সেই সময় আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। আমি সেই কাৰ্য্যের অনুসন্ধান সেই সময় পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু সেই অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইল না। অপর আর একজন কর্ম্মচারীর হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়া, যতদূর আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম। তিনি তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলেন, আমিও সেই সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্যের অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গবর্ণমেন্টের যে কাৰ্য্য সম্বন্ধে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইয়াছিল, সেই কাৰ্য শেষ করিতে আমার প্রায় দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সেই কাৰ্য্য সমাপনান্তে আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিয়া, যে কর্ম্মচারীর হস্তে রামজীলাল সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ভার অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, তাহাকে ডাকিলাম। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি যে কাৰ্য্যের ভার আপনার হস্তে অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য্য আপনি কতদূর সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান প্রায় আমি একরূপ শেষই করিয়া রাখিয়াছি, এখন আসামীকে ধরিতে পারিলেই হইল।

আমি। আসামী কে?

কর্ম্মচারী। রামজীলাল।

আমি। তার অপরাধ?

কর্ম্মচারী। অপরাধ, তাহার মনিবের টাকা আত্মসাৎ করা।

আমি। তাহা হইলে ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছে যে, রামজীলাল সেই সকল জহরত লইয়া পলায়ন করিয়াছে?

কর্ম্মচারী। না, সেই সকল জহরত লইয়া রামজীলাল পলায়ন করে নাই। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য লইয়া রামজীলাল পলায়ন করিয়াছে।

আমি। এ সম্বন্ধে বেশ প্রমাণ পাইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তাহার বিপক্ষে বেশ প্রমাণ আছে; মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কতক প্রমাণ গ্রহণ করিয়া রামজীলালের নামে

ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দিয়াছেন।

আমি। ভালই হইয়াছে। সেই ওয়ারেন্ট এখন কোথায়?

কর্ম্মচারী। আমার নিকটেই আছে।

আমি। সেই ওয়ারেন্ট আমাকে প্রদান করিবেন। তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব; আপনিও আপনার চেষ্টার ত্রুটি করিবেন না।

কর্ম্মচারী। সেই ওয়ারেন্টখানি এখনই আমি আপনাকে প্রদান করিব কি?

আমি। এখনই আমাকে প্রদান করিতে হইবে না; কিন্তু আপনি কিরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং রামজীলালের বিপক্ষে কিরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বে একবার জানিতে ইচ্ছা করি।

কর্ম্মচারী। উত্তম কথা। আমি যাহা যাহা করিয়াছি, তাহা আপনাকে বলিতেছি। আমি প্রথমতঃ কালীবাবুর নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া তাহার পর অপরাপর লোকের নিকট অনুসন্ধান করি।

আমি। কালীবাবুর সন্ধান করিয়া, তাহাকে কিরূপে বাহির করিতে সমর্থ হইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর অনুসন্ধান করিতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই। আমি প্রথমতঃ দরখাস্তকারীর দোকানে গমন করি। কালীবাবুকে দেখিলে চিনিতে পারিবে, এইরূপ একটী লোক সঙ্গে করিয়া কালীবাবুর অনুসন্ধান করিবার মানসে, সেই স্থান হইতে আসিতেছিলাম, সেই সময় পথিমধ্যে হঠাৎ কালীবাবুকে দেখিতে পাইয়া সেই ব্যক্তি আমাকে দেখাইয়া দেয়।

আমি। কালীবাবু কি কাৰ্য্য করিয়া থাকেন?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি দালালী কাৰ্য্য করিয়া থাকেন।

আমি। কালীবাবু প্রকৃতই দালালী কাৰ্য্য করেন কি না, সে সম্বন্ধে আপনি কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। না।

আমি। তিনি থাকেন কোথায়?

কর্ম্মচারী। তিনি যেখানে থাকেন, তাহা আমি জানি; আমি নিজে গিয়া তাঁহার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি।

আমি। কিরূপ বাড়ীতে তিনি থাকেন?

কর্ম্মচারী। দোতালা পাকা বাড়ী।

আমি। তিনি সেই বাড়ীতে একাকী বাস করিয়া থাকেন কি?

কর্ম্মচারী। না, সেই বাড়ীতে অনেকগুলি স্ত্রীলোক থাকে, তাহাদিগের মধ্যে একখানি ঘরে তিনিও বাস করেন।

আমি। সেই স্ত্রীলোক কি প্রকারের, গৃহস্থ, না বেশ্যা?

কৰ্ম্মচারী। বেশ্যা।

আমি। তাহা হইলে যে গৃহে কালীবাবু থাকেন, সেই গৃহেও বোধ হয়, একজন বেশ্যা বাস করিয়া থাকে?

কর্ম্মচারী। হাঁ, একটী বেশ্যাকে লইয়া কালীবাবু সেই বার্সীতেই থাকেন।

আমি। কালীবাবুর সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে তিনি আপনাকে কি বলিলেন?

কর্ম্মচারী। আমি তাঁহাকে দেখিয়াই তাহাকে একবারে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি রামজীলাল নামক এক ব্যক্তির মারফত যে সকল জহরত আনিয়াছিলেন, তাহা এখন আপনার নিকট আছে, কি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন? উত্তরে তিনি কহিলেন, যাহার নিমিত্ত সেই সকল জহরত আনা হইয়াছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, এবং সেই প্রেরিত লোক মারফত সমস্ত টাকাও প্রদান করিয়াছেন। টাকা লইয়া রামজীলাল তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া আমার ন্যায্য যে কিছু দালালী প্রাপ্য হয়, তাহার কিয়দংশ তিনি আমাকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন, এবং বলিয়া গিয়াছেন, দুই একদিবসের মধ্যে আরও কতকগুলি জহরত লইয়া তিনি আসিবেন, সেই সময় আমার দালালীর অবশিষ্ট যাহা প্রাপ্য আছে, তাহা প্রদান করিয়া যাইবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না, বা আমার ন্যায্য পাওনাগুলিও পাঠাইয়া দিলেন না; আমিও নানা ঝঞ্চাটে আর সেই দোকানে গমন করিতে পারি নাই।

আমি। আপনি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি যে, সেই সকল জহরত কালীবাবু নিজে খরিদ করিয়াছিলেন, কি অপর কোন লোক খরিদ করিয়াছিল?

কর্ম্মচারী। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। উত্তরে কালীবাবু আমাকে এই বলিয়াছিলেন যে, রাজার মত কোন একজন জমিদার সেই জহরত খরিদ করিয়াছেন।

আমি। সেই রাজা বা জমিদার কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু তাহা আমাকে বলেন নাই।

আমি। তিনি যে বাড়ীতে থাকেন, সেই বাড়ী আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। না, তাঁহার বাড়ীও আমাকে দেখাইয়া দেন নাই।

আমি। তাহা হইলে জহরতগুলি কোন্ স্থানে তিনি গ্রহণ করেন, এবং উহার মূল্যই বা কোন্ স্থানে তিনি প্রদান করেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু আমাকে কেবল ইহাই বলেন যে, যে বাড়ীতে কালীবাবু থাকেন, সেই বাড়ীর কোন একটী স্ত্রীলোকের গৃহে সেই জমিদার মহাশয় আগমন করিতেন। সেই স্থানে কালী বাবুর সহিত তাহার পরিচ হয়, এবং কতকগুলি জহরত আনিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়াই কালীবাবুকে আদেশ করেন। তাঁহারই আদেশ মত কতকগুলি জহরত আনা হয়। সেই সকল জহরতের সঙ্গে রামজীলাল আগমন করেন, এবং সেই স্ত্রীলোকের গৃহে বসিয়াই তিনি সেই সকল জহরত খরিদ করেন, ও রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করেন।

আমি। একজন রাণী যে জহরত খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা হইলে সেই রাণী কে?

কর্ম্মচারী। রাণী যে কে, তাহা কালীবাবু আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। কেবল তিনি আমাকে এইমাত্র বলিয়াছিলেন, যে স্ত্রীলোকটার গৃহে তিনি আগমন করিতেন, সেই স্ত্রীলোকটীকে সঙ্গে লইয়া তিনি জহরত খরিদ করিতে বাজারে গমন করেন। তিনি যে জুড়িতে ছিলেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই জুড়িতে ছিলেন বলিয়া, লাক-লজ্জার ভয়ে তিনি গাড়ির ঘেরাটোপ ফেলিয়া সেই স্ত্রী লোকটীর সহিত বাজারে আগমন করেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি নিজে দোকানে বসিয়া জহরতগুলি দেখিয়া শুনিয়া পসন্দ করিয়া লইবেন; কিন্তু দোকানে গমন করিয়া, গাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় দেখিতে পান, সেই দোকানে একটী লোক বসিয়া আছেন। বোজ হয়, সেই লোকটীই সেই দোকানের মালিক। সেই লোকটীকে তিনি পূর্ব হইতে চিনিতেন। কারণ, সেই ব্যক্তির সহিত তাঁহার পিতার সবিশেষরূপ পরিচয় আছে। তিনি পাছে তাহার চরিত্রের কথা তাঁহার পিতার নিকট বলিয়া দেন, এই ভয়ে তিনি আর গাড়ি হইতে নামিতে সাহসী হন নাই, এবং সেই স্থানে আত্মপ্রকাশ হইয়া পড়িবে, এই ভয়ে সেই স্ত্রীলোকটীকে রাণী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে কালীবাবুকে বলিয়া দেন, ও তাহাকেই জহরতগুলি দেখা ইয়া খরিদ করিতে বলেন। কালীবাবু, নামে জহরতগুলি রাণীজিকে দেখান; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেই জমিদার-পুত্রই সেই গাড়ির ভিতর হইতে জহরতগুলি দেখিয়া পসন্দ করেন, এবং পুনরায় ভাল করিয়া দেখিয়া উহার মূল্য প্রদান করিবেন, বিবেচনা করিয়া, জহরতগুলি কালীবাবুর বাসায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত কালীবাবুকে সেই স্থানে রাখিয়া তাঁহারা প্রস্থান করেন। কালীবাবু সেই সকল জহরত রামজীলালের মারফত তাহার বাড়ীতে লইয়া যান। সেই স্থানে জমিদার-পুত্র পুনরায় জহরতগুলি ভাল করিয়া দেখেন, এবং পরিশেষে রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করিয়া জহরতগুলি গ্রহণ করেন।

আমি। কালীবাবু যে সকল কথা বলেন, তাহাদের পোষকতায় আর কোন প্রমাণ পাইয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। পাইয়াছিলাম।

আমি। কি?

কর্ম্মচারী। যাহার গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত গ্রহণ করা হয়, এবং তাহার মূল্য প্রদান করা হয়, সেই স্ত্রীলোকটীও ঠিক সেই কথাই বলে।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটী কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু যে গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই গৃহে থাকে।

আমি। তাহা হইলে কালীবাবু যে স্ত্রীলোকটীর গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীই কালীবাবুর কথার পোষকতা করিতেছে?

কর্ম্মচারী।

আমি। রাণীজিও বোধ হয়, তিনিই হইয়াছিলেন?

কর্ম্মচারী। হাঁ।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটীর নাম কি?

কর্ম্মচারী। তাহার নাম ত্রৈলোক্য।

আমি। বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ কি বলে?

কর্ম্মচারী। তাঁহারা সবিশেষ কিছুই বলিতে পারে না। তাঁহারা কেবল এইমাত্র বলে যে, কাহার গৃহে কে আসিতেছে, কে যাইতেছে, তাহার খবর কে রাখে? বিশেষতঃ এরূপ সংবাদ রাখা তাহাদিগের নীতি-বিরুদ্ধ।

আমি। পশ্চিমদেশীয় একটী লোক যে সেই বাড়ীতে কতক গুলি জহরত লইয়া গমন করিয়াছিল, তাহা কেহ বলে?

কর্ম্মচারী। সবিশেষ কিছু বলিতে পারে না, তবে এইমাত্র বলে যে, কালীবাবুর সহিত সময় সময় বঙ্গদেশীয়, পশ্চিমদেশীয় প্রভৃতি অনেক লোক প্রায়ই তাঁহার গৃহে আসিয়া থাকে, এরূপ তাঁহারা দেখিতে পায়।

আমি। কত টাকার জহরত খরিদ করা হয়?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু কহেন, দশ হাজার টাকায় সেই সকল জহরত খরিদ করা হইয়াছিল।

আমি। টাকাগুলি কিরূপ অবস্থায় রামজীলালকে প্রদান করা হয়,নগদ টাকা দেওয়া হয়, না নোট দেওয়া হয়?

কর্ম্মচারী। সমস্তই নোট, নয়খানি হাজার টাকার হিসাবে নয় হাজার, এবং একশতখানি দশ টাকা হিসাবে এক হাজার টাকা।

আমি। সেই হাজার টাকা হিসাবের নোটগুলির নম্বর পাই বার কোনরূপ উপায় আছে কি?

কর্ম্মচারী। সমস্ত নম্বরই আমি পাইয়াছি।

আমি। কিরূপে সেই সকল নোটের নম্বর পাইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর নিকট হইতে। যে সময় নোটগুলি রামজীলালকে দেওয়া হয়, সেই সময় কালীবাবু সেই সকল নোটের নম্বর টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে সেই সকল নম্বর

প্রদান করিয়াছেন।

আমি। সেই নোটগুলি সম্বন্ধে করেনসি আফিসে একবার অনুসন্ধান করা উচিত।

কৰ্ম্মচারী। সে অনুসন্ধানও আমি করিয়াছি। সেই সকল নোটের টাকা দেওয়া স্থগিত (Stop) করিবার মানসে করেসি আফিসের বড় সাহেবের নামে একখানি পত্র লেখা হয়। সেই পত্রের জবাবে তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতেই রামজীলালের উপর আরও সবিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

আমি। পত্রের উত্তরে তিনি কি লিখিয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তিনি লিখিয়াছেন যে, সমস্ত নোটগুলিই রামজী লাল নামক এক ব্যক্তি সেই স্থানে প্রদান করিয়া তাহার পরিবর্তে দশ টাকার হিসাবে নোট বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে।

আমি। এটী সবিশেষ সন্দেহের কথা?

কর্ম্মচারী। এই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছি।

আমি। সেই জমিদার-পুত্ৰটী কে, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি এ পর্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই। কালীবাবু কোনরূপেই তাহার নাম বলিতে সম্মত নহেন, বা তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিতে বলায়, তিনি বলেন যে, কোথায় যে তাহার বাড়ী, তাহা তিনি অবগত নহেন। বাড়ীর ঠিকানা তিনি কখনও কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই, নামও বলেন নাই; রাজাসাহেব বলিয়াই সকলে তাহাকে ডাকিয়া থাকেন।

আমি। জহরত খরিদ করিবার পর, রাজাসাহেব ত্রৈলোক্যের গৃহে আর আগমন করিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহার পর দুই একদিবস আসিয়াছিলেন মাত্র; কিন্তু আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আর তিনি সেই স্থানে আগমন করেন নাই।

আমি। কেন আসেন নাই, সেই সম্বন্ধে কেহ কোন কথা বলিতে পারে না কি?

কর্ম্মচারী। ত্রৈলোক্য ও কালীবাবু ইহাই বলেন যে, রাজা সাহেব শেষদিবস যখন সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বলিয়া যান যে, কোন সবিশেষ কাৰ্য্য উপলক্ষে তাহাকে তাহার দেশে গমন করিতে হইতেছে। বোধ হয়, সেই স্থানে তাহাকে মাসাবধি অবস্থান করিতে হইবে। সুতরাং এক মাসের মধ্যে তিনি আর এখানে আগমন করিবেন না।

আমি। রামজীলাল সম্বন্ধে আপনি কি অনুসন্ধান করিয়াছেন?

কৰ্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। কেবল কলিকাতার ভিতর যে যে স্থানে তাহার দেশের লোক বা আত্মীয়-স্বজন আছে, কেবল তাহারই কোন কোন স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সকল স্থানে গমন করিতে পারি নাই। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কলিকাতায় নাই। কারণ, কোন দিক হইতে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। আমার বোধ হয়, সে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে।

আমি। নিতান্ত অসম্ভব নহে; কিন্তু রামজীলাল তাহার মনিবের এতদুর বিশ্বাসপাত্র হইয়া এরূপ অবিশ্বাসের কাৰ্য্য করিবে? যাহা হউক, এ বিষয় একবার উত্তমরূপে দেখা আবশ্যক। অর্থের লোভে সময় সময় মনুষ্যগণ যে কি না করিতে পারে, তাহা বলা সহজ নহে। অর্থই যে অনর্থের মূল তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

কর্ম্মচারী। এখন এ সম্বন্ধে আমাকে আর কিছু করিতে হইবে কি?

আমি। হইবে বৈকি?

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। রামজীলালকে সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধরিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। আর কিছু?

আমি। সেই জমিদার-পুত্র যে কে, অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। এই সকল বিষয় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এখন প্রস্তুত হইতে পারি কি?

আমি। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখন যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন। কিন্তু আপনি বহির্গত হইয়া যাইবার পূর্বে আর একটা কাৰ্য্য আপনাকে করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। আমার সহিত কালীবাবুর বাড়ীতে একবার গমন করিয়া কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিতে হইবে। কারণ, তাঁহারা যে কে, এবং কি চরিত্রের পোক, সেই সম্বন্ধে আমি সময় মত একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখি; এবং সেই বাড়ীর অপর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যদি কেহ সেই জমিদার-পুত্রের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারও সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব।

আমার কথায় কর্ম্মচারী মহাশয় সম্মত হইলেন। আমার অবকাশ মত তিনি আমার সহিত গমন করিয়া, কালীবাবু ও তাহার উপপত্নী ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিবেন, ইহাই স্থিরীকৃত হইল।

আমি অতিশয় ক্লান্ত ছিলাম; সুতরাং সেই দিবসেই আমি আর কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে পারিলাম না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্য উভয়েই সেই সময় তাহাদিগের গৃহে উপস্থিত ছিল। কালীবাবু আমাকে দেখিয়া, সম্পূর্ণরূপে চিনিতে পারিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু আমি তাঁহাকে অতি উত্তমরূপে চিনিতে পারিলাম। কালীবাবু যে চরিত্রের লোক, ত্রৈলোক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত অসৎবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে একাল পর্যন্ত তাহাদের উভয়ের জীবিকা নির্বাহ করিয়া আসিতেছিল, তাহা অতি উত্তমরূপেই অবগত ছিলাম। আমি জানিতাম, দশ হাজার টাকার মূল্যের জহরত খরিদ করিবার ক্ষমতা কালীবাবুর নাই। আরও জানিতাম, কালীবাবুকে যে জানিত, সে দশ হাজার টাকা ত দূরের কথা, দশ পয়সাও দিয়া কালীবাবুকে সহজে বিশ্বাস করিত না।

আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া কেবল রামজীলাল সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র। সবিশেষ কোন কথা তাহার নিকট ভাঙ্গিলাম না, বা তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে, এরূপ কোন কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কথায় কালীবাবু, যে কোন উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হইয়া, রামজীলালের অনুসন্ধান করি বার ভান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

যে সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের সহিত আমার দুই চারিটী কথা হইয়াছিল, সেই সময় উঁহারা যদি সবিশেষ মনোযোগের সহিত আমার দিকে লক্ষ্য রাখিত, তাহা হইলে উঁহারা সেই সময় আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, সেই সময় যেরূপ সতর্কতার সহিত আদি উহা দিগের আপাদমস্তক দর্শন করিতেছিলাম, উঁহারা যদি ঘূণাক্ষরেও আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ বুঝিতে পারি, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সেই সময় উঁহারা আমার সম্মুখীন হইয়া কখনই আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইতে পারি?

না। তাহাদিগের পাপরাশীর ভয়ানক অবস্থা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, সেই ভাবিয়া কখনই তাঁহারা কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।

আমার অভিসন্ধির বিষয় যদিও তাঁহারা পূৰ্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাঁহারা আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অথ সবিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিল।

উঁহাদিগকে যে দুই চারিটী কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং তাহার উত্তরে উঁহারা আমাকে যাহা কিছু বলিয়াছিল, তাহার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। অধিকন্তু উঁহাদিগের উপর নানারূপ সন্দেহ আসিয়া আমার মনে উদয় হইল। বস্তুতঃ আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া রামজীলালের উপর ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই অনুসন্ধানে আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না।

এ সম্বন্ধে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিলাম। কিন্তু কোন উপায় অব লম্বন করিলে, সেইরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি, ভাবিয়া। চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমরা উভয়েই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

থানায় আসিবার প্রায় দুই তিনঘন্টা পরে হঠাৎ একটা বিষয় জানিবার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হইল। এ সম্বন্ধে আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া করেপি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্বে যে কয়েকখানি নম্বরি নোট করেনসি আফিসে ভাঙ্গাইয়া লইয়া রামজীলাল প্রস্থান করিয়াছে—সাব্যস্ত হইয়াছিল, করেসি অফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সেই নোট কয়েকখানি একবার দেখিতে চাহিলাম। তিনি তাহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, সেই কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধান-পূৰ্ব্বক সেই নোট কয়েকখানি বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই নোট দেখিয়া আমি যে কতদুর বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই নোটগুলি দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইল। ইতিপূর্বে অনুসন্ধানে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, রামজীলাল একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, বঙ্গদেশে থাকিয়া ব্যবসা-কাৰ্য্য করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু বঙ্গ ভাষার সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই। তিনি না পারেন বাঙ্গালা কহিতে-না পারেন বাঙ্গালা লিখিতে। এখন দেখিলাম, সেই নোটগুলির উপর রামজীলালের নাম স্বাক্ষর আছে সত্য; কিন্তু উহা হিন্দীভাষায় নাই, বাঙ্গালা ভাষায়। রামজীলাল যখন বাঙ্গালা ভাষা একবারেই অবগত নহেন, তখন তিনি বাঙ্গালা ভাষায় আপনার নাম কিরূপে স্বাক্ষর করিলেন, তাহার কিছুই বুঝি উঠিতে পারিলাম না। আরও ভাবিলাম, রামজীলাল যখন সেই সকল অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে, তখন সে যে আপনার নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া তাহার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া যাইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?

মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই নোটগুলি করেনসি আফিসে প্রত্যর্পণ-পূৰ্ব্বক আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

কালীবাবুর অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তাহার নিজের গাড়ি-ঘোড়া নাই, অথচ আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে চড়িবার ক্ষমতাও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় কাহার গাড়িতে চড়িয়া সে বাজারে আগমন করিয়াছিল, ক্রমে তাহা জানি বার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। রাণীজিই বা কে? সেই জুড়িই বা কাহার? এবং কেইবা সেই জুড়ি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া চড়িয়াছিল, তাহা জানিতে পারিলেই কালীবাবুর কথা যে কতদূর সত্য, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। কালীবাবু যে জমিদার-পুত্রের কথা বলিতেছে, তিনি যে কে, তাহা কালীবাবুর জানিতে না পারার কোনরূপ অসম্ভাবনা দেখিতেছি না। যে ব্যক্তি তাহারই রক্ষিতা স্ত্রীলোকের গৃহে আসিয়া আমোদ প্রমোদ করে, যে ব্যক্তি তাহারই গৃহে বসিয়া এত টাকা মূল্যের জহরতাদি খরিদ করে, তাহার পরিচয় কালীবাবু যে একবারেই জানে না, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হইতে পারে না। অন্ততঃ তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা কালীবাবু বা ত্রৈলোক্য যে একবারেই অবগত নহে, তাহাও আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। আমার অনুমান হইতেছে, কালীবাবু যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই মিথ্যা কথা। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাকে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে হইবে।

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। থানার মধ্যে সেই সময় যে সকল ডিটেকটিভ-কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্য হইতে পশ্চিমদেশীয় এরূপ এক কর্ম্মচারীকে আমি আমার সঙ্গে লইলাম যে, তাঁহাকে সহিসের বেশ পরিধান করাইলে, ঠিক সহিসের মতই বোধ হয়।

সেই কর্ম্মচারীকে আমি সামান্য সহিসের বেশে সজ্জিত হইয়া আমার সহিত আসিতে কহিলাম। তিনি আমার আদেশ মত সহিসের বেশ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

বড়বাজারের যে দোকানে রাণীজির জুড়ি এবং কালীবাবুর কম্পাস পাড়ি গমন করিয়াছিল, সেই দোকানের লোজনদিগের নিকট হইতে সেই গাড়ির সহিস-কোচবানগণের পোযাকের বিবরণ শুনিয়া আমি সেই সময়েই স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই দুইখানি গাড়ি কোন আড়গোড়া হইতে আনীত হইয়াছে। কারণ, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, কলিকাতার প্রত্যেক আড়গোড়ার সহিস-কোচবানদিগের পরিচ্ছদ এক এক প্রকার।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া আমি থানা হইতে বহির্গত হইলাম। সহিস-কোচবানের পোষাক পরিচ্ছদের বিবরণ শুনিয়া আমি মনে মনে যে আড়গোড়া স্থির করিয়াছিলাম, সেই আড়গোড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমি সেই আড়গোড়ার ভিতর একটী ঘোড়া ক্রয় করিবার ছলে প্রবেশ করিয়া আড়গোড়ায় যে সকল ঘোড়া ছিল, তাহাই দেখিবার ভানে এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিলাম; কিন্তু সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীর দৃষ্টিপথের বাহির হইলাম না। অধিকন্তু অপরাপর সহিস-কোচবানদিগের সহিত সেই কৰ্মচারীর যে সকল কথা হইতে লাগিল, তাহার দিকেও সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারী আমার উপদেশ মত আড়গোড়ার ভিতর প্রবেশ করিয়া যে স্থানে কয়েকজন সহিস-কোচবান বসিয়া ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং আপনাকে একজন সহিস বলিয়া পরিচয় দিয়া তাহাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। তাহাকে দেখিয়া একজন কোচবান্ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কাহার অনুসন্ধান করিতেছ?

কৰ্ম্মচারী। কাহারও অনুসন্ধান করিতেছি না।

কোচবান্। তবে এখানে আসিয়াছ কেন?

কর্ম্মচারী। আমি বরাবর সহিসী কৰ্ম্ম করিতাম; কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, আমি আমার দেশে গমন করিয়াছিলাম, এবং কিছু দিন পূর্বে আমি দেশ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। এখন কোন স্থানে কোনরূপ চাকরী যোগাড় করিতে না পারায়, সবিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছি। তাই একটা চাকরীর অনুসন্ধানে আপনাদিগের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।

কোচবান। এখানে তোমার চাকরী হইতে পারে, একথা তোমাকে কে বলিল?

কর্ম্মচারী। একথা আমাকে কেহ বলে নাই। আড়গোড়ায় অনেক সহিস কাৰ্য্য করে; সুতরাং সময় সময় অনেক চাকরী প্রায়ই খালি খাকার সম্ভাবনা। তাই আপনাদিগের এখানে আগমন করিয়াছি। এখন বলুন, কিরূপ উপায়ে আমি একটা চাকরী যোগাড় করিতে সমর্থ হই?

কোচবান্। আমাদিগের এখানে যদি কোন কৰ্ম্ম খালি থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগের সাহেবকে বলিয়া যাহাতে তুমি কোন একটী কৰ্ম্ম পাইতে পারিতে, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিতাম; কিন্তু আজকাল সহিসের কাৰ্য খালি থাকা দূরে থাকুক, দুই একজন সহিস আমাদিগের এখানে ফালতু পড়িয়া আছে।

কর্ম্মচারী। এখানে বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সে আশা এখন কার্যে পরিণত হওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইল।

কোচবান্। এখানে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সহিসী কাৰ্য্য খালি হইয়া থাকে। তুমি দুই একদিবস অন্তর এক একবার আসিও, খালি হইলেই আমি তোমার জন্য একটী যোগাড় করিয়া দিব।

কর্ম্মচারী। তাহাই হইবে। আমি মধ্যে মধ্যে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আজ কয়েকদিবস হইল, বড়বাজারে একখানি জুড়ি গাড়ি এবং একখানি কম্পাস গাড়ি আপনাদিগের এখান হইতে গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন সহিস কোচবানের সহিত একবার সাক্ষাৎ হয় কি?

কোচবান্। কেন?

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে বোধ হয়, আমার একটী চাকরীর যোগাড় হইতে পারে।

কোচবান্। সেই সহিস কোচবানের নাম কি?

কর্ম্মচারী। আমি তাহাদিগের কাহারও নাম অবগত নহি।

কোচবান্। নাম না জানিলে, তুমি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে?

কর্ম্মচারী। দুইজন কোচবান্ এবং তিনজন সহিস দুইখানি গাড়িতে ছিল। তাহাদিগের মধ্যে একজনের সহিত সাক্ষাৎ হইলেই আমার কাৰ্য শেষ হইতে পারে।

রাণী না খুনী?

কোচবান্। প্রত্যহই গাড়ি ভাড়ায় যাইতেছে; বড়বাজারে কে গিয়াছিল, তাহা এখন কিরূপে স্থির করিব?

কর্ম্মচারী। দুইখানি গাড়ি গিয়াছিল। একখানি জুড়ি গাড়ি, তাহাতে একজন রাণী ছিলেন। সেই রাণী বড়বাজারে একজন জহরত-বিক্রেতার দোকানে গমন করিয়া অনেকগুলি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন। আর একখানি কম্পাস গাড়ি; বড়বাজারে গমন করিবার সময় উহাতে কেবলমাত্র একটী লোক গমন করিয়াছিল, কিন্তু আসিবার সময় তাহাতে দুইজন আগমন করেন, এবং তাহাদের সহিত সেই জহরতের বাক্সও আনা হয়। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি এইখানকার সহিস-কোচবানগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে বোধ হয়, তাহাদিগের সন্ধান নিশ্চয়ই অনা মাসে হইতে পারে।

কোচবান্। সে আজ কয়দিবসের কথা?

কর্ম্মচারী। প্রায় আট দশদিবস হইবে।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচবান সেই স্থানে যে সকল সহিস-কোচবান্ উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিলেন। উঁহাদিগের মধ্যে একজন সহিস কহিল, আজ আট দশদিবস হইল, কোন রাণীকে সোয়ারী দিবার নিমিত্ত লাল বড় জুড়িতে হোসেনী কোচবান্ যেন গমন করিয়াছিল, এইরূপ আমার মনে হইতেছে।

কোচবান্। হোসেনী, কোন্ হোসেনী?

সহিস। বড় লাল জুড়ি যে হোসেনী হাঁকাইয়া থাকে।

কোচবান। দেখ দেখি, হোসেনী এখন আছে, কি সোয়ারীতে বাহির হইয়া গিয়াছে।

সহিস। সে এখন নাই। অনেকক্ষণ হইল, সে সেই জুভি লইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।

কোচবান্। তাহার সহিত যে দুইজন সহিস ছিল, তাহাদের মধ্যে কেহ আছে কি?

সহিস। না, তাঁহারাও হোসেনীর সহিত বাহির হইয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে। যাহা হউক, আমি গিয়া আস্তাবলের ভিতর তাহাদিগের একবার অনুসন্ধান করিয়া আসিতেছি। উহা দিগের মধ্যে যদি কেহ থাকে, তাহা হইলে আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া আনিতেছি।

এই বলিয়া সেই সহিদ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, এবং অতি অল্পক্ষণ মধ্যেই আর একজন লোককে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, জুড়ি গাড়ির কোচবান্ ও সহিসগণ সকলেই বাহির হইয়া গিয়াছে। সেই জুড়ির সহিত যে একখানি কম্পাস গাড়ি গমন করিয়াছিল, তাহার কোচবান্ এই–আবদুল।

কোচবান্। আবদুল! তুমিই কি কম্পাস গাড়ি লইয়া হোসেনীর জুড়ির সহিত কোন রাণীকে লইয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলে?

আবদুল। আমি গাড়ি চড়াইয়া রাণীকে লইয়া যাই নাই। রাণী গিয়াছিলেন-জুড়িতে; আমি জুড়ির পিছু পিছু গিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। আচ্ছা, রাণী জুড়িগাড়িতে করিয়া গিয়াছিলেন; কিন্তু তোমার গাড়ি ত খালি যায় নাই, তাহাতে একটী বাবু গমন করিয়াছিলেন না?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। আসিবার সময় দুইজন বাবু তোমার গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। যে বাবু তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়া ছিলেন, তাহার সহিত বড়বাজারে আমার সহিত সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, তুমি আমার বাড়ীতে যাইও, সেই স্থানে গেলে, আমি তোমাকে একটা চাকরীর যোগাড় কুরিয়া দিব। তাহার নাম ও ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু ভাই, দুঃখের কথা আর কি বলিব, আমি তাঁহার নাম ও ঠিকানা উভয়ই ভুলিয়া গিয়াছি বলিয়া, আর সেই স্থানে গমন করিতে পারি নাই, এবং এখন কোন স্থানে চাকরীর ও যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার নাম ও ঠিকানা ভুলিয়া যাইবার পরে, এই কয়দিবস পৰ্য্যন্ত যে কত স্থানে চাকরীর উমেদারীতে ঘূরিয়া বেড়াইয়াছি, তাহার আর তোমাকে কি বুলিব?

সহিস। আমাকে এখন কি করিতে হইবে?

কর্ম্মচারী। ভাই, অনেক কষ্ট করিয়া যখন আমি তোমার অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছি, তখন আর আমি তোমাকে সহজে ছাড়িতেছি না; এখন তোমার প্রতি আমার এই অনুরোধ যে, হয় কোন স্থানে আমার একটী চাকরীর যোগাড় করিয়া দেও, না হয়, সেই বাবুর বাড়ী, যাহা তোমার দেখা আছে, একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া তাহা আমাকে দেখাইয়া দিয়া আমাকে সবিশেষরূপে উপকৃত কর।

সহিস। আমার হাতের কাৰ্য আমি এখন পর্যন্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারি নাই। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে আপনার সঙ্গে এখন গমন করিতে পারি?

কর্ম্মচারী। আমার যতদূর সাধ্য, আমি না হয়, তোমার কার্য্যের কতক সাহায্য করিতেছি, তাহা হইলে তোমার কাৰ্য্য শীঘ্রই সম্পন্ন হইয়া যাইবে। তাহা হইলে ত তুমি আমার সহিত গমন করিতে পারিবে?

ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচ প্রথমতঃ তাঁহার সহিত যাইতে অস্বীকার করিল। পরিশেষে অনেক তোষামোদের পর তাহার সহিত যাইতে স্বীকৃত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র আপনার নিয়মিত কৰ্ম্ম সমাধা করিয়া লইবার মানসে সেই ছদ্ম বেশী-কর্ম্মচারীকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। কখন বা তাহাকে ঘোড়ার সাজ সরাইয়া দিতে কহিল, কখন বা ঘোড়ার থাকিবার স্থানে পাতিয়া দিবার খড় গুলি যাহা রৌদ্রে শুখাইতে দেওয়া হইয়াছিল, তাহা সেই স্থান আনিতে কহিল। এইরূপে তাহাকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারী কি করেন, কোন গতিতে তাঁহার কাৰ্য-উদ্ধার করিতেই হইবে; সুতরাং সেই কোচবানকে তিনি সর্ব প্রকার সাহায্য করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তামাক সাজিয়াও তাহাকে খাওয়াইতে হইল। এইরূপে প্রায় দুইঘণ্টাকাল অতীত হইলে আবদুল সেই কর্ম্মচারীর সহিত বহির্গত হইল। আমিও ঘোড় দেখা শেষ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎসেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম।

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আড়গোড়া হইতে বাহির হইয়া কর্ম্মচারী আবদুলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। আমিও একটু দুরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

গমন করিতে করিতে কর্ম্মচারী আবদুলকে জিজ্ঞাসা করি লেন, কেমন ভাই, তোমার গাড়িতে যে বাবুটী বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনি একাকী গমন করিয়াছিলেন, কি তাহা সহিত অপর আর কোন ব্যক্তি ছিল?

আবদুল। তিনি একাকীই আমার গাড়িতে গমন করিয়া ছিলেন।

কর্ম্মচারী। বড়বাজার হইতে যখন প্রত্যাবর্তন করেন, তখনও কি তিনি একাকী ছিলেন?

আবদুল। না, বড়বাজার হইতে আসিবার সময় অপর আর একটা লোক তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি তোমার গাড়িতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া তোমার অনুমান হয়?

আবদুল। তিনি বাঙ্গালি।

কর্ম্মচারী। আর যে ব্যক্তি বড়বাজার হইতে তাহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তিনিও কি বাঙ্গালি?

আবদুল। না, তিনি বাঙ্গালি নহেন। তাহাকে মাড়োয়ারী বা ক্ষেত্র বলিয়া আমার অনুমান হয়। তিনি বাঙ্গালি নহে, ইহা আমি বেশ বলিতে পারি।

কর্ম্মচারী। যিনি তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, তিনি যে বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন, বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াও কি তিনি সেই বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, কি অপর কোন বাড়ীতে গিয়াছিলেন?

আবদুল। অপর কোন বাড়ীতে তিনি গমন করেন নাই। যে বাড়ী হইতে আসিয়াছিলেন, পুনরায় সেই বাড়ীতেই গমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। তোমার গাড়ি ও জুড়িগাড়ি, উভয় গাড়িই কি এক সময় যাইয়া সেই বাড়ীতে উপস্থিত হয়?

আবদুল। আমাদিগের উভয় গাড়িই এক সময় সেই বাড়ীতে গিয়াছিল, এবং সেই স্থান হইতে উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার গমন করে।

কর্ম্মচারী। আর বড়বাজার হইতে যখন তোম প্রত্যাবর্তন কর, সেই সময়েও বোধ হয়, তোমাদের উভয় গাড়িই একত্র ফিরিয়া আইসে?

আবদুল। না, জুড়িগাড়ি অগ্রে চলিয়া আইসে; আমার গাড়ি তাহার অনেক পশ্চাৎ আসিয়াছিল।

কর্ম্মচারী। জুড়িগাড়িতে কে ছিল?

আবদুল। কে ছিল তাহা আমি জানি না। কেবল একটী মাত্র স্ত্রীলোককে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটীর পোয়াক-পরিচ্ছদ কিরূপ ছিল?

আবদুল। পোষাক-পরিচ্ছদ খুব ভাল ছিল। শুনিয়াছি, উনি নাকি কোন স্থানে যাণী। তা রাণীর পোষাক আর ভাল হইবে না?

কর্ম্মচারী। যে বাড়ী হইতে সেই বাবুটা তোমার গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে বাড়ীতে গমন করেন, সেই রাণীও কি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া জুড়িতে আরোহণ করিয়াছিলেন?

আবদুল। হাঁ, তিনিও সেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া জুড়িতে উঠিয়াছিলেন, ইহা আমি দেখিয়াছি; কিন্তু কোন্ বাড়ীতে যে তিনি নামিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি বলিতে পারি না।

কর্ম্মচারী। কয়দিবসের নিমিত্ত উঁহারা গাড়ি দুইখানি ভাড়া করিয়াছিলেন?

আবদুল। কেবলমাত্র একদিবসের জন্য। যে দিবস উঁহারা বড়বাজার গমন করিয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেই দিবসই আমরা আসিয়াছিলাম, উহার পূর্বে বা পরে আর কখনও আমরা তাঁহাদিগের নিকট গাড়ি লইয়া যাই নাই।

কর্ম্মচারী। তোনরা কি সেই বাবুকে, কি রাণীকে পূর্ব হইতে চিনিতে।

আবদুল। না।

কর্ম্মচারী। তাহাদিগের বাড়ী?

আবদুল। তাহাও আমরা পূর্ব হইতে জানিতাম না।

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে কিরূপে তোমরা তোমাদিগের গাড়ি লইয়া তাহাদিগের বাড়ীতে যাইতে পারিলে?

আবদুল। আমাদিগের আফিসের সাহেবগণের সহিত উহা দিগের কিরূপ বন্দোবস্ত ছিল, তাহা আমি জানি না; কিন্তু সে দিবস আমরা গাড়ি লইয়া গিয়াছিলাম, সেই দিবস যে বাবু আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনিই আমাদিগের আফিসে আসিয়াছিলেন, এবং তিনিই আমার গাড়িতে চড়িয়া আড়গোড়া হইতে আমাদিগের গাড়ি তাঁহার সেই বাড়ীতে লইয়া যান। পরিশেষে তিনিই আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, এবং সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের গাড়ির যে ভাড়া হইয়াছিল, তাহা তাঁহারা তোমাদিগের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন কি?

আবদুল। না, ভাড়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিবেন কেন?

কৰ্ম্মচারী। তবে কি গাড়ির ভাড়া পরিশেষে তাহার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হয়? আবদুল। গাড়ির ভাড়া পূৰ্ব্বে জমা দিয়া গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, কি পরিশেষে তাহাদিগের নিকট হইতে ভাড়া আদায় করা হয়, কি একবারেই ভাড়া লওয়া হয় নাই, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি।

আবদুলের সহিত এইরূপে কর্ম্মচারীর কথাবার্তা হইতে হইতে উভয়েই গিয়া একখানি দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে গমন করিয়াই, আবদুল সেই রাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই বাড়ী। আবদুলের এই কথা শুনিয়াই কর্ম্মচারী সেই স্থানে একটু দাড়াইলেন; দেখিলেন, উহা বড়গোছের একটী দ্বিতল বাটী; কিন্তু সেই বাটীর দরজা খোলা নাই। বাহির হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ। সেই বাটর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, উহা একখানি খালি বাড়ী। সেই বাড়ীর দরজায় একখানি কাগজ মারা ছিল, উহাতে লেখাছিল, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। সম্মুখের মুদীর দোকানে অনুসন্ধান করিলে, এই বাড়ীর অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন।

আমাদিগের উদ্দেশ্য কিয়ৎ পরিমাণে সিদ্ধ হইল। তখন কর্ম্মচারী আবদুলকে কহিলেন, ভাই, তুমি আমার নিমিত্ত যে এত পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিলে, কিন্তু তাহার ফল কিছুই ফলিল না।

আবদুল। কেন?

কর্ম্মচারী। আমার আজকাল এমনই দুরদৃষ্ট হইয়াছে যে, যে ব্যক্তি নিজে আমাকে একটী চাকরী দিবেন বলিয়া, আমাকে তাঁহার বাড়ীতে আসিতে কহিলেন, আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ তিনি সেই বাটী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন! যাহা হউক ভাই, তোমাকে আমি আর অধিক কষ্ট দিতে চাহি না, তুমি এখন আপন স্থানে গমন কর। কিন্তু ভাই, সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিও, যদি তোমাদিগের ওখানে আমার একটী কাৰ্য্যের যোগাড় হয়। আমি মধ্যে মধ্যে গিয়া তোমার এবং কোচবানজির সহিত সাক্ষাৎ করিব।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কৰ্ম্মচারীও অপর আর একটী গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন।

এ পর্যন্ত আমি তাহাদিগের সন্নিকটেই ছিলাম। আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, কর্ম্মচারী আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, এ পর্যন্ত সহিসের সহিত আমার যে সকল কথা হইয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত আপনি শুনিয়াছেন ত?

আমি। সমস্তই শুনিয়াছি।

কর্ম্মচারী। উঁহারা যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সে বাড়ীও দেখিয়াছেন?

আমি। তাহাও দেখিয়াছি। উহা এখন তালাবদ্ধ।

কর্ম্মচারী। এখন আর কি করিতে হইবে?

আমি। এখন দেখিতে হইবে, এই বাড়ী ভাড়া কে লইয়া ছিল। যে রাণী এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি কোন রূপ সন্ধান করিতে পারি, তাহা হইলে অনেক কথা বাহির হই বার সম্ভাবনা।

কর্ম্মচারী। কিরূপ উপায়ে রাণীর সন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে?

আমি। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তিনি যদি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন।

কর্ম্মচারী। তবে চলুন, কাহার বাড়ী, অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা যাউক।

আমি। অদ্য রাত্রি হইয়া আসিয়াছে, রাত্রিকালে এ কার্যের সুবিধা হইবে না; কল্য প্রাতঃকালে ইহার বন্দোবস্ত করিব। তদ্ব্যতীত আরও একটী কাৰ্য্য আমাদিগের বাকী থাকিল, যে ব্যক্তি আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া এই বাড়ীতে আসিয়া ছিল, সেই ব্যক্তি কালীবাবু কি না। তাহাও আবদুল প্রভৃতির নিকট হইতে আমাদিগকে জানিয়া লইতে হইবে।

এইরূপ পরামর্শ করিয়া আমরা সে দিবস আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিলাম না। পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া যে বাড়ী রাণীজি ভাড়া করিয়াছিলেন, সেই বাড়ীর উদ্দেশে গমন করিলাম। দিবাভাগে সেই বাড়ীটী আর একবার দেখিয়া লইলাম, দরজার উপর যে কাগজ লাগান ছিল, তাহা হইতে বাড়ীর অধিকারীর নাম এবং তাঁহার ঠিকানা লিখিয়া লইলাম। সেই বাড়ীর সন্নিকটে যে একটা মুদীর দোকান ছিল, সেই মুদী এই বাড়ী সম্বন্ধে কোন কথা অবগত আছে কি না, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার নিকটেও একবার গমন করিলাম, এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই বাড়ীটী কি ভাড়া দেওয়া যাইবে?

মুদী। এই বাড়ীতে প্রায়ই ভাড়াটিয়া থাকে, যদি উহা খালি থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহা ভাড়া দেওয়া হইবে।

মামি। সেই বাড়ী এখন খালি আছে, কি অপর কোন ব্যক্তি উহা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত আছেন কি?

মুদী। আমার বোধ হয়, এই বাড়ী খালি নাই, উহা ভাড়া হইয়া গিয়াছে।

আমি। আপনি জানেন, কে উহা ভাড়া লইয়াছে?

মুদী। তাহা আমি জানি না।

আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিলেন যে, সেই বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে?

মুদী। আজ কয়েকদিবস হইল, আমি এই বাড়ীর দরজা খোলা দেখিতে পাই। আরও দেখিতে পাই, সেই দরজার সম্মুখে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি দাড়াইয়াছিল। তাহাতেই আমি অনুমান করিতেছি, কোন বড়লোক এই বাড়ী ভাড়া লইয়া থাকিবে।

আমি। আমি এই বাড়ীর সম্মুখে গিয়াছিলাম, দেখিলাম, উহার দরজায় লেখা আছে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। এবং সদর দরজা তালা দ্বারা বন্ধ করাও আছে।

মুদী। তাহা হইলে বোধ হয়, এই বাড়ী এখনও খালি আছে।

আমি। আপনি জানেন, এই বাড়ীর ভাড়া কত?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি।

আমি। এই বাড়ীর চাবি কাহার নিকট থাকে, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি জানি না। দরজায় যে কাপজ মারা আছে, তাহাতে লেখা নাই?

আমি। যে স্থানে এই বাড়ী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা লেখা আছে; কিন্তু কোন্ স্থানে এই বাড়ীর চাবি আছে, তাহা লেখা নাই। তাহাই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ছিলাম।

মুদী। তাহা হইলে মালিকের বাটীতে গমন করিলেই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন, এবং বাড়ীর চাবিও পাইবেন।

আমি। সেই ভাল, তাহা হইলে আমি সেই স্থানেই গমন করি।

এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া সেই বাটীর মালিকের উদ্দেশে চলিলাম। বাটীর দরজার উপর যে ঠিকানা লেখা ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া একটু অনুসন্ধান করাতেই সেই বাটীর মালিকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি তাহার বাটী হইতে বাহিরে আসিয়াই আমাকে জিজ্ঞাসা করি লেন, আপনি কি নিমিত্ত আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?

আমি। আপনার যে একখানি বাটী খালি আছে, তাহা আপনি ভাড়া দিবেন কি?

মালিক। হাঁ, আমার বাটী খালি আছে, এবং উহা ভাড়াও দেওয়া যাইবে; কিন্তু আজকাল নহে। দিনকতক পরে আসিলেই সেই বাটী আপনি পাইতে পারিবেন।

আমি। আপনার সেই বাটীর ভাড়া কত? মালিক। পঞ্চাশ টাকা।

আমি। এখন সেই বাটী ভাড়া দিতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ প্রতিবন্ধক আছে কি?

মালিক। না থাকিলে আর আমি আপনাকে বলিব কেন?

আমি। কি প্রতিবন্ধক আছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

মালিক। অপর কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। আজ কয়েক দিবস হইল, একটী বাবু, একমাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়া একমাসের নিমিত্ত সেই বাটী ভাড়া লন, এবং আমার নিকট হইতে সেই বাটীর চাবি লইয়া যান। যখন তিনি সেই বাটী ভাড়া লন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, পশ্চিমদেশ হইতে একজন রাণী কলি কাতা দেখিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, এবং তিনিই সেই বাড়ীতে দশ বারদিন থাকিবেন মাত্র। সেই বাবুটী আমাকে এই কথা বলিয়া আমার বাড়ী ভাড়া লন, এবং বাড়ীর চাবি লইয়া যান। দুই তিনদিবস পরেই সেই বাড়ীর চাবি তিনি আমাকে ফিরাইয়া দিয়া যান, ও বলিয়া যান যে, রাণীজির বোধ হয়, এখন আসা হইল না। তবে যদি ইহার মধ্যে তিনি আইসেন, তাহা হইলে আমি আসিয়া পুনরায় চাবি লইয়া যাইব। একমাসের মধ্যে যদি তিনি আসেন, তাহা হইলে সেই বাড়ী আপনি অপরকে একমাস পরে অনায়াসেই ভাড়া দিতে পারেন। এখন বলুন দেখি মহাশয়! একমাসের মধ্যে আমি সেই বাড়ী অপরকে কিরূপে ভাড়া দিতে পারি? প্রকৃত প্রস্তাবে বলিতে হইলে, সেই বাড়ী আমার হইলেও একমাসের মধ্যে উহাতে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।

আমি। একমাস পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আপনার বোধ হয়, আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

মালিক। কিছু না। একমাস কেন, একমাসের প্রায় অর্ধেক গত হইয়া গেল, যে কয়দিবস বাকী আছে, তাহার পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আর কোনরূপ আপত্তি নাই।

আমি। এই কয়দিবসের মধ্যে আপনি বাড়ী ভাড়া না দিন। কিন্তু উহা একবার দেখিতে বোধ হয়, আপনার কোনরূপ আপত্তি নাই?

মালিক। তাহাতে আর আপত্তি কি? আপনার যখন ইচ্ছা হয়, তখনই আপনি গিয়া আমার বাড়ী দেখিতে পারেন।

আমি। আপনার যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে এখনই গিয়া আমি আপনার বাড়ী দেখিয়া আসিতে পারি। বাটী দেখিয়া যদি আমার মনমত হয়, তাহা হইলে সেই বাট ভাড়া লইয়া কথাবার্তা শেষও হইয়া যাইতে পারে।

মালিক। আপনাকে বাটী দেখাইতে আমার কিছুমাত্র আপতি নাই; কিন্তু আপনার সহিত গমন করিতে পারে, এরূপ কোন লোক এখন এ স্থানে উপস্থিত নাই। আমারও কোন একটা সবিশেষ প্রয়োজনে এখনই বাহির হইয়া যাইতেছি। সুতরাং আমিও এখন আপনার সহিত গমন করিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহপূর্বক অপর কোন সময়ে আগমন করিবেন, সেই সময় হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, না হয়, অপর কোন লোককে আপনার সঙ্গে পাঠাইয়া দিব। আমি এখনই সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতাম; কিন্তু মহাশয়! মার্জনা করি বেন, আপনি আমার নিকট একবারে অপরিচিত বলিয়া, সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতে পারিলাম না। কলি কাতা সহর, অনেক দেখিয়া শুনিয়া চলিতে হয়।

আমি। আচ্ছা মহাশয়! তাহাই হইবে। অপর আর এক সময় আসিয়া আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং সেই সময় চাবি লইয়া গিয়া আপনার বাটী দেখিয়া লইব।

মালিক। তাহা হইলে আমি এখন আমার কাৰ্য্যে গমন করিতে পারি?

আমি। আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

মালিক। আর কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

আমি। যে বাবুটা আপনার নিকট হইতে একমাসের জন্য বাটী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে আপনি চিনেন কি?

মালিক। তিনি আমার নিকট পরিচিত নহেন।

আমি। তিনি কোথায় থাকেন, তাহা আপনি বলিতে পারেন?

মালিক। না।

আমি। আমি যদি অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে আপনার নিকট আনিতে পারি, এবং এখন হইতে আমাকে সেই বাটী ভাড়া দিতে যদি তাঁহার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে সেই বাটী আপনি আমাকে ভাড়া দিতে পারিবেন কি?

মালিক। তাহা পারিব না কেন, তাহার কোনরূপ আপত্তি না থাকিলেই হইল।

সেই বাটীর মালিকের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, অপর আর কোন সময়ে পুনরায় তাহার নিকট আগমন করিব, এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; তিনিও আপন কার্যে গমন করিলেন।

রাণী না খনি?
(শেষ অংশ)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

বাড়ীওয়ালার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রথমতঃ আমার খানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থান হইতে পূৰ্ব-কথিত কর্ম্মচারীদ্বয়কে সঙ্গে লইয়া পুনরায় কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমরা কালীবাবুর নিকট গিয়া উপ স্থিত হইলাম, সেই সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়েই তাহা দিগের গৃহে বসিয়াছিল। আমাদিগকে দেখিয়া ত্রৈলোক চিনিতে পারিল, এবং সেই স্থানে উপবেশন করিতে কহিল। আমরা তিনজনেই সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া কালীবাবু কহিল, কি মহাশয়! পুনরায় কি মনে করিয়া? আসামী ধরা পড়িয়াছে না কি?

আমি। আসামী এখনও ধরা পড়ে নাই, ধরিবার চেষ্টাতেই খুরিয়া বেড়াইতেছি। যে মোকদ্দমায় রামজীলালের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, সেই মোকদ্দমার বিষয় আমি এখনও সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তাই পুনরায় আপনার নিকট আসিয়াছি।

কালী। বলুন, আমাকে কি সাহায্য করিতে হইবে। আমাকে যেরূপ ভাবে সাহায্য করিতে বলিবেন, আমি সেইরূপ ভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।

আমি। সবিশেষ কোনরূপ সাহায্য করিবার সময় এখনও সময় উপস্থিত হয় নাই। যখন বুঝিতে পারি, আপনার সাহায্যের সবিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে, তখন আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিব। এখন কেবল দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি মাত্র।

কালী। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা আপনি অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

আমি। আপনি ঠিক বলুন দেখি, সেই জহরতগুলি কাহার নিমিত্ত আপনি দোকান হইতে খরিদ করিয়া আনিয়াছিলেন?

কালী। সেই সকল জহরত আমি আমার নিজের জন্য খরিদ করিয়াছিলাম না। যাঁহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলাম, সে কথা ত আমি পূৰ্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি। যাহার নিমিত্ত, জহরত খরিদ করা হইয়াছিল, তাঁহাকে রামজীলালও স্বচক্ষে দেখিয়া গিয়াছিল।

আমি। তাহাকে রামজীলাল দেখিয়াছিল, তুমি দেখিয়াছিলে, এবং ত্রৈলোক্যও দেখিয়াছিল, এ কথা ত আমরা পূর্বেই শুনিয়াছি। এখন ত আর রামজীলালকে পাইতেছি না যে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব। সেই নিমিত্তই তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন, তিনি কে?

রাণী না খুনী?

কালী। তিনি একজন জমিদার। একথাও পূর্বে আমরা আপনাকে বলিয়াছি।

আমি। পূৰ্ব্বে যাহা বলিয়াছ, তাহাও শুনিয়াছি, এখন যাহা বলিবে তাহাও শুনিব। তিনি কোন্ দেশীয় জমিদার?

কালী। পশ্চিমদেশীয় জমিদার।

আমি। তুমি পূর্বে বলিয়াছিলে, তিনি বাঙ্গালি। এখন বলিতেছ, তিনি পশ্চিমদেশীয়। তোমার কোন কথা প্রকৃত, তাহা এখন আমাকে সবিশেষ করিয়া বলিতে হইতেছে। তুমি জানিও, আমি জানিতে পারিয়াছি, সেই জমিদার কে?

কালী। যদি আপনি জানিতে পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি?

আমি। প্রয়োজন সবিশেষরূপ আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করি তেছি। এখন তুমি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কি না?

কালী। প্রকৃত কথা কেন বলিব না? আপনি আমাকে প্রতারণা করিতেছেন কেন? আমি এত চেষ্টা করিয়া পরিশেষে যাহার আর সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, তাহাকে আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিবেন কি প্রকারে?

আমি। আমি কিরূপে তাহার সন্ধান করিয়াছি, তাহা তুমি জানিতে চাও?

কালী। যদি অনুগ্রহ করিয়া বলেন।

আমি। কালীবাবু! তুমি মনে করিতেছ যে, তোমার সদৃশ চতুর লোক আর কেহই নাই; কিন্তু তোমার মনে করা কর্তব্য যে, তোমা অপেক্ষা অধিক চতুর লোক, বোধ হয়, অনেক থাকিতে পারে। আচ্ছা আমি কিরূপে সেই জমিদারের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিতেছি; একটু মনোযোগ দিয়া শুনিলেই অনা য়াসেই তাহা বুঝিতে পারিবে। তুমি রামজীলালকে যে সকল নোট প্রদান করিয়াছিলে, সেই সকল নোট তুমি সেই জমিদার অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট হইতে পাইয়াছ, কেমন একথা প্রকৃত কি না?

কালী। তদ্ভিন্ন সেই সকল নোট আর আমি কোথায় পাইব?

আমি। সেই সকল নোটের মধ্যে অনেকগুলি নম্বরী-নোট আছে?

কালী। আছে, তাহার নম্বর ত আমি আপনাদিগকে দিয়াছি।

আমি। আমাদিগের দেশে যাহার হাতে নম্বরী-নোট পড়ে, তিনি সেই সকল নম্বরী-নোটের নম্বর রাখিয়া থাকেন, একথা বোধ করি তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করিবে?

কালী। নতুবা আমি আপনাকে সেই সকল নোটের নম্বর কিরূপে দিতে পারিলাম?

আমি। তুমি জান, যে সকল নোট সরকার বাহাদুর এদেশে চালাইতেছেন, তাহা কোথা ছাপা হয়, এবং কোথা হইতে প্রথম আমাদিগের দেশে প্রচারিত হয়?

কালী। শুনিয়াছি, সমস্ত নোট বিলাত হইতে ছাপা হইয়া এদেশে আইসে, এবং করেসি আফিস হইতে প্রথমতঃ সেই নোট বাহির হইয়া, ক্ৰমে এদেশীয় লোকের নিকট গিয়া উপস্থিত হয়।

আমি। করেসি আফিস হইতে যে সকল নোট বাহির হয়, তাহার নম্বর করেসি আফিসে থাকে কি না, তাহা তুমি বলিতে

কালী। করেনসি আফিসে নিশ্চয়ই নম্বর রাখিয়া থাকে।

আমি। আর যে সকল নম্বরী-নোট সেই স্থান হইতে যাহাকে দেওয়া হয়, তাহার নাম ও ঠিকানা সেই স্থানে লেখা থাকে; তাহাও বোধ হয়, তুমি অবগত আছ?

কালী। তাহাও রাখিবার খুব সম্ভাবনা।

আমি। তাহা হইলে এখন তুমি বুঝিতে পারিলে যে, আমি তোমার সেই জমিদারের ঠিকানা করিতে পারিয়াছি কি না?

কালী। না মহাশয়! আপনার এই কথায় আমি কিরূপে জানিতে পারি যে, আপনি কিরূপে জমিদার মহাশয়ের ঠিকানা করিতে পারিয়াছেন?

আমি। আমি যাহা বলিলাম, তাহা অপেক্ষা আরও স্পষ্ট করিয়া না বলিলে যে তুমি বুঝিতে পারিবে না, ইহাই আশ্চর্য্য। যাহা হউক, আরও স্পষ্ট করিয়া আমি তোমাকে বলিতেছি। তোমার সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে তুমি যে সকল নোট পাই মাছ, তাহার নম্বর তুমিই আমাদিগকে প্রদান করিয়াছ। ইহার পরই আমি করেসি আফিসে গিয়া জানিতে পারি, কোন তারিখে সেই সকল নোট সর্বপ্রথমে করেসি আফিস হইতে বাহির হয়, এবং কাহাকে প্রদান করা হয়। পরে তাহার নিকট গিয়া জানিতে পারি, সেই নোট তিনি কাহাকে প্রদান করেন। এইরূপে অ সন্ধান করিতে করিতে সেই সকল নোট তুমি যাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ, তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই, এবং তাহার প্রমুখাৎ জানিতে পারি, যাহা যাহা ঘটিয়াছিল। তিনি আমাকে আরও বলিয়াছেন, যে সকল জহরতের পরিবর্তে তোমাকে সেই সকল নোট প্রদান করা হয়, আবশ্যক হইলে সেই সকল জহরতও তিনি আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন। এখন বুঝিতে পারিলে, অনুসন্ধানের কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া এই সকল বিষয় আমি জানিয়া লইয়াছি?

কালী। তাহা এখন বুঝিতে পারিয়াছি।

আমি। এখনও তুমি আমাদিগের নিকট মিথ্যা কথা বলিতেছ কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করি তেছি, সেই জমিদার কে? কারণ, ইতিপূর্বে তুমি আমাদিগের নিকট কয়েকটা কথা মিথ্যা বলিয়াছ।

কালী। আমি সেই জমিদার মহাশয়ের নাম জানি না।

আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?

কালী। পশ্চিমদেশীয়।

আমি। পূর্বে কেন বলিয়াছিলে যে, তিনি একজন বঙ্গদেশীয় জমিদার-পুত্র?

কালী। একথা কি আমি পূর্বে বলিয়াছিলাম?

আমি। বলিয়াছিলে।

কালী। যদি বলিয়া থাকি, তাহা হইলে ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।

আমি। তুমি যে সময় তাঁহার বাসায় গিয়া জহরত সকল প্রদান কর, সেই সময় সেই স্থানে আর কে ছিল?

কালী। আর কেহ ছিল বলিয়া, আমার মনে হয় না।

আমি। রামজীলাল?

কালী। রামজীলাল ত ছিলই। কিন্তু মহাশয়! রামজীলাল ঠিক সেই সময় তাহার নিকট গমন করেন নাই, তিনি বাহিরে ছিলেন।

আমি। রামজীলালকে বাহিরে রাখিয়া তুমি একাকীই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছিলে?

কালী। হাঁ।

আমি। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা আনিয়া তুমিই রামজীলালের হস্তে প্রদান কর?

কালী। হাঁ। আমি। জমিদার মহাশয় এখন সেই বাড়ীতে আছেন কি?

কালী। আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আমি সেদিকে যাই নাই। বোধ হয়, থাকিতে পারেন।

আমি। সেই বাড়ীটা তুমি এখন আমাকে দেখাইয়া দিতে পার?

কালী। পারিব না কেন? তবে জিজ্ঞাসা করি, যখন আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তখন আপনি ত তাহার সেই বাড়ী জানেন।

আমি। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই। অপর আর একজন কর্ম্মচারীকে আমি তাঁহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। সেই কর্ম্মচারীকে তিনি যাহা বলিয়াছেন, কেবল তাহাই আমি অবগত আছি মাত্র। আমি নিজে সেই বাড়ী চিনি না, এই নিমিত্তই সেই বাড়ী দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি। যে কর্ম্মচারী সেই বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও এখন এখানে নাই। অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন।

কালী। তাহা হইলে চলুন, আমি আপনার সহিত গমন করিয়া সেই বাড়ী আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি।

কালীবাবুর কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর কালবিলম্ব করিলাম না। তাহাকে লইয়া তখনই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, আড়গোড়ার সহিসের সাহায্যে আমরা যে বাড়ীর অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ীই আমাদিগকে দেখাইয়া দিবেন; কিন্তু পরে দেখিলাম, আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া না দিয়া, অন্য স্থানে অপর একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিল। সেই বাড়ীর দরজায় একজন দ্বারবান্ বসিয়া আছে দেখিয়া, তাহাকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, তাহার মনিব পশ্চিমদেশীয় একজন জমিদার সেই বাড়ীতে ছিলেন; কিন্তু কয়েকদিবস হইল, তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, কালীবাবু সেই দ্বারবানের নিকট পরিচিত। দ্বারবান তাহার মনিবের নিকট অনেকবার কালীবাবুকে দেখিয়াছে। দ্বারবান্ ইহাও বলিল যে, কালীবাবুর নিকট হইতে তাহার মনিব অনেকগুলি মূল্যবান, কাপড় ও জহরত খরিদ করিয়াছেন।

দ্বারবানের নিকট আমি এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি পুনরায় কালীবাবুর সঙ্গে তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

কালীবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কালীবাবু! তুমি পূর্ব হইতে এ সম্বন্ধে এত মিথ্যা কথা বলিয়া আসিতেছ কেন?

কালী। কেন মহাশয়! আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম?

আমি। আবার বলিতেছ, আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম? যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছেন, তিনি পূর্বে বঙ্গদেশীয় একজন জমিদার-পুত্র ছিলেন। কিন্তু এখন দেখিতে দেখিতে তিনি একজন পশ্চিমদেশীয় জমিদার হইয়া পড়িলেন?

কালী। উনি বাঙ্গালি কি পশ্চিমদেশীয় লোক, তাহা আমি সেই সময় ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।

আমি। ভাল, ইহাই যেন বুঝিতে না পারিয়াছিলে; কিন্তু যাহার বাড়ী তুমি পূৰ্ব্বে জানিতে না, এখন তাহার বাড়ী তুমি কিরূপে আমাকে দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইলে?

কালী। তাহার বাড়ী আমি চিনি না, একথা যদি পূর্বে আমি আপনাকে বলিয়া থাকি, তাহাও ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।

আমি। ইহাও যদি তুমি ভুল-ক্রমে বলিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি পূর্বে কিরূপে বলিয়াছিলে যে, জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয় রামজীলালের নিকট হইতে ত্রৈলোকের ঘরে বসিয়া খরিদ করেন, অথচ এখন দেখিতেছি, তুমি তাহার বাড়ীতে গিয়া তাহার নিকট সেই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া আসিয়াছ? ইহার কোন কথা প্রকৃত?

কালী। ইহার উভয় কথাই প্রকৃত। আমি পূর্বেও বলিয়া ছিলাম, এখনও বলিতেছি যে, আমার কথা সমস্তই প্রকৃত। ইহার মধ্যে একটীও মিথ্যা কথা নাই। আমি জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বিক্রয় করিয়া আসি সত্য; কিন্তু টাকা গুলি ত্রৈলোক্যের এই গৃহে বসিয়া আমি রামজীলালের হস্তে প্রদান করি। তিনি উহা উত্তমরূপে গণিয়া-গাথিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া যান।

আমি। একথা ত ঠিক নহে, তুমি প্রথমে বলিয়াছিলে, জমিদার-পুত্র ত্রৈলোকের গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত খরিদ করেন, এবং সেই স্থানেই তিনি তাহার মূল্য রামজীলালের হস্তে প্রদান করেন।

কালী। এরূপ কথা বলিয়াছি বলিয়া ত এখন আমার স্মরণ হইতেছে না।

আমি। তাহা হইলে আমাদিগের শুনিবারই ভুল হইয়া থাকিবে। সে যাহা হউক, রাণীজির কথাটা কি?

কালী। রাণীজি আবার কে?

আমি। যে রাণীজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন?

কালী। আমার জানিত কোন রাজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করেন নাই। জমিদার মহাশয় গিয়াছিলেন, সে কথা ত আমি পূর্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি।

আমি। জমিদার মহাশয় বলেন, তিনি জহরত খরিদ করি বার নিমিত্ত বড়বাজারে একবারেই গমন করেন নাই। ইহাতে বোধ হইতেছে, জমিদার মহাশয় মিথ্যা কথা কহিতেছেন?

কালী। তিনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন, একথা আমি বলিতে পারি না; তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। বড় মানুষের সকল সময় সকল কথা মনে থাকে না।

আমি। জমিদার মহাশয় যে জুড়িতে করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, সেই জুড়ি তুমি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে কেন?

কালী। আমি জুড়িগাড়ি ভাড়া করিয়া আনিব কেন?

আমি। কেবল জুড়িগাড়ি নহে, একখানি কম্পাস গাড়িও যে তুমি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে?

কালী। মিথ্যা কথা।

আমি। মিথ্যা কি সত্য, তাহা পরে জানিতে পারিবে। যে বাড়ীটী তুমি একমাসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়াছিলে, তাহাতে কোন রাণীজি আসিয়া বাস করিয়াছিল?

কালী। আমি বাড়ী ভাড়া করি কেন?

আমি। কেন বাড়ী ভাড়া করিবে, তাহা তুমিই জান। তোমার বাড়ী ভাড়া করিবার কারণ আমি জানি না বলিয়াই আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

কালী। আপনারা এ সকল নূতন মিথ্যা কথা কোথা হইতে বাহির করিলেন? মহাশয়! আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি; আপনি আমার কথায় রাগ করিবেন না। আপনাদিগের তদারকের গতিই কি এইরূপ? কাজের কথার দিকে আপনারা একবারের নিমিত্ত দৃষ্টিপাত না করিয়া, কেবল বাজে বিষয় অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছেন। কোথায় আপ

ফেরারী আসামীর অনুসন্ধান করিবেন, তাহা না করিয়া কেবল কতক বাজে বিষয় লইয়া মিথ্যা মিথ্যা ঘূরিয়া বেড়াইতেছেন। এরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিলে, এতক্ষণ ত আসামী ধরা পড়িল!

আমি। আমার কথায় তুমি রাগ করিও না। এই কার্যে যে আমি নূতন ব্রতী, তাহা বোধ হয়, তুমি অবগত আছ। সেই কারণেই সকল কথা সহজে আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না বলিয়াই, ইহার ব্যাপার উত্তমরূপে জানিয়া লইবার নিমিত্তই তোমাকে এতগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং আরও দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছাও আছে। এই সকল বিষয় প্রথমতঃ আমি ভালরূপ অবগত হইয়া, তাহার পর, আসামীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, ইহা আমার সম্পূর্ণরূপ ইচ্ছা। এতগুলি টাকা লইয়া রামজীলাল যে এখনও কলিকাতায় আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। আমার বিশ্বাস, সে তাহার নিজের দেশে প্রস্থান করিয়াছে। সে বাহা হউক, আমিও তাহাকে অল্পে ছাড়িতেছি না। তাহার নিমিত্ত যদি তাহার দেশে পর্যন্তও আমাকে গমন করিতে হয়, তাহাতেও আমি প্রস্তুত আছি।

আমার এই কথা শুনিয়া কালীবাবু মুখে অতিশয় সন্তোষের ভাব প্রকাশ করিয়া আমাকে কহিলেন, আপনার যদি আর কোন কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন থাকে, তাহা একটু শীঘ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া লউন। কারণ, কোন কাৰ্যান্তরে এখনই গমন কারবার আমার সবিশেষ প্রয়োজন আছে।

কালীবাবু আমাকে এই কথাগুলি বলিল সত্য; কিন্তু সেই সময় তাহার অবস্থা এরূপ পরিবর্তিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল যে, যেন সে কোনমতেই আমার সম্মুখে দাড়াইতে আর সমর্থ হইতেছে না।

আমি। তোমাকে আমি এখন কেবলমাত্র একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।

কালী। কি?

আমি। যে পশ্চিমদেশীয় জমিদার তোমার নিকট হইতে জহরত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার সমভিব্যাহারে তুমি আর কোন বাড়ীতে গমন করিয়াছিলে কি?

কালী। গিয়াছিলাম বৈকি। ত্রৈলোকের গৃহে তাহাকে কয়েকবার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। ত্রৈলোক্য ত আপনার সম্মুথেই বসিয়া আছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন না কেন; তাহা হইলেই ত জানিতে পারিবেন, আমার কথা সত্য কি না।

আমি। ত্রৈলোক্যকে আমি আর কি জিজ্ঞাসা করিব? তুমি যাহা বলিতেছ, সেও তাহাই বলিবে। তুমি যদি সেই জমিদারকে অপর কোন বাড়ীতে লইয়া না গিয়া থাক, তাহা হইলে আর এক খানি বাড়ী কাহার নিমিত্ত এবং কিসের জন্য ভাড়া করিয়াছিলে?

আমার এই কথা শুনিবামাত্রই ত্রৈলোকের যেন হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। সে একবার আমার মুখের দিকে তাকাইয়া কালীবাবুর মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। দেখিলাম, ত্রৈলোকের সঙ্গে সঙ্গে কালীবাবুরও মুখ শুখাইয়া উঠিয়াছে। আরও তাহার মুখ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, সে তাহার মনের ভাব গোপন করিতে বিধিমতে চেষ্টা করিতেছে; কিন্তু কোনরূপেই যেন কৃতকার্য হইতে পারিতেছে না।

আমার কথা শুনিয়া কালীবাবু যেন একটু রাগ ভাব প্রকাশ করিল ও কহিল, কি মহাশয়! আপনি আমার সহিত ঠাট্টা করিতেছেন, না বসিয়া বসিয়া স্বপ্ন দেখিতেছেন?

আমি। একরূপ স্বপ্নই বটে; নূতন বাড়ী ভাড়া করার নাম শুনিয়া তোমরা একবারেই চমকাইয়া উঠিলে যে! কোন রাণীজি আসিয়া একমাসকাল বাস করিবেন বলিয়া, একমাসের জন্য কোন বাড়ী তুমি ভাড়া কর নাই?

কালী। না।

আমি। আমি যদি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারি?

কালী। যখন আমি বাড়ী ভাড়া করি নাই, তখন আপনি আমাকে কিরূপে দেখাইয়া দিবেন? আর অপর কোন ব্যক্তির নিমিত্ত যদি একখানি বাড়ী ভাড়াই করিতাম, তাহা হইলেই বা কি ক্ষতি হইত? অপরের নিমিত্ত আমি বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম, কি না করিয়াছিলাম, তাহার সহিত এ মোকদ্দমার কি সংব আছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। এই মোকদ্দমার সহিত বাড়ী ভাড়ার কোনরূপ সংস্রব থাকুক, আর না থাকুক, তুমি অপর কোন বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলে কি না, তাহাই আমি জানিতে চাই।

কালী। না।

আমি। তাহা হইলে তুমি ও ত্রৈলোক্য, তোমরা উভয়েই আমার সহিত আগমন কর। তুমি আমাকে দেখাইয়া দেও, আর না দেও, আমি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছি।

কালী। আমার একটী সবিশেষ প্রয়োজন আছে, এখন আমি আপনার সহিত গমন করিতে পারিব না।

আমি। আমার সহিত যাইতেই হইবে। সহজে তুমি আমার সহিত না যাও, অসহজে যাইবে।

এই বলিয়া আমি কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। তাঁহারা উভয়েই আমার সহিত গমন করিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল; কিন্তু আমি তাহা না শুনিয়া একরূপ বলপ্রয়োগ করিয়াই তাহাদিগকে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমার সমভিব্যাহারী কেবল একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে রহিলেন মাত্র।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

যাহার নিকট হইতে কালীবাবু বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, তাহাকে সেই বাড়ীতে আনিবার নিমিত্ত আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্যকে একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া, যখন আমি সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন আমার বেশ অনুমান হইল যে, উভয়েরই হিতাহিত জ্ঞান যেন তিরোহিত হইয়াছে, এবং উহার আমাকে কি বলিবার নিমিত্ত যেন প্রস্তুত হইতেছে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারা তাহাদিগের মনের ভাব কতক পরি মাণে পরিবর্তিত করিয়া লইল; যাহা বলিতে যাইতেছিল, তাহা আর বলিল না।

আমাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার একটু পরেই আর একখানি গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। উহার মধ্য হইতে দুইজন আরোহী বহির্গত হইলেন। একজন আমারই অধীনস্থ কর্ম্মচারী; অপর ব্যক্তি সেই বাড়ীর অধিকারী। তিনি কালীবাবুকে দেখিয়াই কহিলেন, এই বাবুটাই একমাসের নিমিত্ত আমার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন। কালীবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন মহাশয়! এখন আমি এই বাড়ী অপর আর কাহাকেও ভাড়া দিতে পারি?

কালীবাবু তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া নিতান্ত স্থিরভাবে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল।

বাড়ীর অধিকারী চাবি হস্তে সেই বাড়ীর দরজা খুলিতে গিয়া দেখেন, সেই বাড়ীর সম্মুখে দ্বারবানবেশে একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? আমার বাড়ীর দরজায় রসিয়া রহিয়াছ? সেই ব্যক্তি তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আমার ইঙ্গিত অনুসারে সেই স্থান হইতে উঠিয়া একটু দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। বলা বাহুল্য, সেই ব্যক্তিও আমাদিগের একজন কর্ম্মচারী। আমাদিগের অবর্তমানে কেহ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে, এই নিমিত্তই তাঁহাকে সেই স্থানে পূর্ব হইতেই রাখা হইয়াছিল।

বাড়ীর অধিকারী সেই বাড়ীর চাবি খুলিয়া দিলেন। আমরা সকলেই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।

আমরা সকলে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ উপরের, এবং পরিশেষে নীচের সমস্ত ঘরগুলি উত্তমরূপে দেখি লাম। দেখিলাম, সমস্ত ঘরগুলিই খালি, কোন ঘরে কিছুই নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সকলেই সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময়ে নিম্নের একখানি ঘরের দিকে

আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। বলা বাহুল্য, সেই ঘরের ভিতর আমরা পূৰ্বেই গমন করিয়াছিলাম। আমি পুনরায় সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের মেয়ের প্রস্তরের একস্থানে কতকগুলি মক্ষিকা ঘন ঘন বসিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই বাড়ীর অপরাপর গৃহগুলি পুনরায় সবিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানে মক্ষিকা বসিতে দেখিতে পাইলাম না। সেই বাড়ীটী নুতন প্রস্তুত হইয়াছিল, উহাতে বে সকল নর্দমা বা ময়লা জল প্রভৃতি ফেলিবার স্থান আছে, সেই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানেই মক্ষিকা প্রভৃতি বসিতে দেখিতে পাইলাম না। তখন স্বভাবতই আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। আমি আমার মনের ভাব অপরাপর কর্ম্মচারীগণকেও কহিলাম। সকলেই আমার মতে মত দিয়া কহিলেন, এই স্থানটী একবার ভাল করিয়া দেখি বার প্রয়োজন হইয়াছে। সুতরাং সেই স্থানের প্রস্তর কয়েকখানি একবারে উঠাইয়া ফেলিবার প্রয়োজন হইল।

সেই বাড়ীর অধিকারী মহাশয়কে সেই কথা বলাতে তিনি প্রথমতঃ আমাদিগের প্রস্তাবে অসম্মত হইয়া গৃহের প্রস্তর গুলি উঠাইয়া ফেলিতে নানারূপ আপত্তি করিতে লাগিলেন; কিন্তু আমরা কেহই তাহার আপত্তিতে কর্ণপাত না করিয়া, কোদালি ও সাবল প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিতেও আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই বাড়ীর একটী গৃহের ভিতর কতকগুলি চুন, সুরকি, বালী এবং সাবল, কোদালি প্রভৃতি রাখা ছিল। সেই স্থান হইতে সাবল ও কোদালি প্রভৃতি আনাইয়া, সেই স্থানের প্রস্তর উঠাইয়া ফেলা হইল। উঠাইবার সময় বেশ অনুমান হইল, উহা যেন একটু আঙ্গা ভাবে বসান রহিয়াছে, এবং যেন নূতন বসান বলিয়া বোধ হইল। সেই স্থানের দুই তিনখানি প্রস্তর উঠাইতে উঠাইতে সেই স্থান হইতে প্রথমে অল্প, এবং পরিশেরে অধিক পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতে আরম্ভ হইল। যখন সেই স্থান হইতে ক্রমে পচাগন্ধ বাহির হইতে লাগিল, সেই সময় আমাদিগের মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। সেই সময় আমরা সকলে মিলিয়া শীঘ্র শীঘ্র সেই স্থানের মাটী ক্ৰমে উঠাইয়া ফেলিতে লাগিলাম। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে আমাদিগের সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হইল না; মাটী যতই উঠাইতে লাগিলাম, ততই যেন উহা আপ্পা বোধ হইতে লাগিল।

কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য আমাদিগের সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের বাক্যালাপ বন্ধ হইল, মুখ কালিমা বর্ণ ধারণ করিল, চক্ষু যেন ঈষৎ রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতে লাগিল। সেই স্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া, আর তাঁহারা দাড়াইতে পারিল না; নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

সেই স্থান হইতে অধিকাংশ মাটী এইরূপে উঠাইতে উঠা ইতে ক্রমে একটী গলিত মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল, উহা কোন পুরুষের মৃতদেহ। কিন্তু উহা এতদূর বিকৃত ভাব ধারণ করিয়া ছিল যে, উহা কাহার দেহ, তাহা চিনিতে পারা গেল না; কিন্তু আমরা সকলেই অনুমান করিয়া লইলাম, সেই দেহ রামজীলালের দেহ ভিন্ন আর কাহারও দেহ নহে।

মৃত্তিকাগৰ্ভ হইতে সেই মৃতদেহী আমরা সবিশেষ সতর্কতার সহিত উঠাইলাম; দেহ হইতে গলিত মাংস ঋলিত হইতে দিলাম না। সেই দেহ গলিত অবস্থা ধারণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু তাহার পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহার একখানিও কোনরূপে নষ্ট হইয়াছিল না।

সেই স্থান হইতে মৃতদেহ বাহির করিবার পর, কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের অবস্থা যে কিরূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার যথাযথ বর্ণনার ক্ষমতা আমার নাই। উঁহাদিগকে দেখিয়া, সেই সময় সহজে অনুমান করা কঠিন হইল যে, উঁহারা জীবিত কি মৃত। দশ বিশ ডাকের কম উঁহাদিগের মুখ হইতে প্রায়ই বাক্য উচ্চারিত হইল না, সহজে কোন কথার উত্তর আর একবারেই পাইলাম না। আমাদিগের প্রশ্নের উত্তরে কেবল উঁহারা বলিতে লাগিল যে, আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি। সেই সময়ে আমাদিগের মধ্যে কোন কোন কর্ম্মচারী ত্রৈলোক্যকেই রাণীজি বলিয়া সম্বোধন করিতে লাগিল; কিন্তু ত্রৈলোক্য সেই সকল কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।

সেই মৃতদেহ বাহির করিবার পরই একজন কর্ম্মচারীকে বড় বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রামজীলালের মনিব এবং তাহার দোকানের আর কয়েকজন কৰ্ম্ম চারীর সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করিলেন। মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহারা রামজীলালের দেহ বলিয়া কোনরূপেই চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদি দেখিয়া তাঁহাদিগের আর চিনিতে বাকী থাকিল না। সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, এই মৃতদেহ রামজীলালের।

যখন সেই মৃতদেহ রামজীলালের বলিয়া স্থিরীকৃত হইল, তখন যেরূপ ভাবে আমরা এ পর্যন্ত কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে রাখিয়াছিলাম, এখন আর তাহাদিগকে সেইরূপে রাখিলাম না। এখন তাঁহারা খুনী মোকদ্দমার আসামীরূপে পরিগণিত হইল। এখন উভয়কেই আমরা বন্ধনাবস্থায় রাখিলাম, এবং উভয়কে পৃথক পৃথক স্থানে রাখিয়া পৃথক পৃথকরূপে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু ত্রৈলোকের নিকট হইতে কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না। যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারই উত্তরে সে কহিল, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

কালীবাবুকে আমরা অতিশয় চতুর বলিয়া মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু পরিশেষে দেখিলাম, কালীবাবু অপেক্ষা ত্রৈলোক্যই অতিশয় চতুর। তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার কোন রূপই উত্তর পাইলাম না; কিন্তু কালীবাবু পরিশেষে আমাদিগের নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিল। আমি তাহাকে কহিলাম, দেখ কালীবাবু! যেরূপ অবস্থায় তোমরা এখন পতিত হইয়াছ, ইহাতে আর তোমাদিগের কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। তোমার বিপক্ষে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহাতে তুমি নিশ্চয়ই বেশ বুঝিতে পারিতেছ যে, এ যাত্রা তোমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। এখন ও তুমি আমার পরামর্শ শুন, এখনও তুমি প্রকৃত কথা-বল। তাহা হইলে তুমি কতদুর দোষী, তাহার যথার্থ অবস্থা আমরা অবগত হইব। নতুবা নিতান্ত অন্ধকারে থাকিয়া আমাদিগকে এই মোকদ্দমা চালাইতে হইবে। দায়ে পড়িয়া এরূপ অনেক বিষয়ের প্রমাণ হয় ত আমাদিগকে করিতে হইবে যে, বাস্তবিক তুমি হয় ত তাহা কর নাই, বা জান না। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বার বার বলিতেছি, তুমি যাহা যাহা করিয়াছ, তাহা আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া বল।

কালী। আচ্ছা মহাশয়! যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এ যাত্রা যখন কোনরূপেই আমার নিষ্কৃতি নাই, যে কোন উপায়েই হউক, আপনারা আমাদিগকে ফাঁসিতে ঝুলাইবেন, তখন আমি এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্যন্ত বলিতেছি।

আমি। এ নিতান্ত ভাল কথা।

কালী। কিছু দিবস অতীত হইল, পশ্চিমদেশীয় সেই জমিদার মহাশয় কলিকাতায় আগমন করেন।

আমি। কোন্ জমিদার?

কালী। যে জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম।

আমি। তাহার পর?

কালী। আমি শুনিয়াছিলাম, তাহার বাড়ীতে একটা বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইবে। সেই বিবাহের নিমিত্ত কতকগুলি ভাল ভাল কাপড় এবং কিছু জহরত ক্রয় করিবার মানসে এবার তিনি কলি, কাতায় আসিয়া উপস্থিত হন। সেই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে উপযুপরি কয়েকদিবস পর্যন্ত তিনি নিজেই বাজারে গমন করেন, এবং বাজারে ঘূরিয়া ঘূরিয়া তিনি নিতান্ত তক্ত হইয়া পড়েন। বাজারে গমন করিলেই, বাজারে যে সকল দালাল আছে, তাঁহারা আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হয়, ও তিনি যে দ্রব্য ক্রয় করিতে চাহেন, সেই দ্রব্য ক্রয় করিয়া দেওয়াইবার মানসে তাহাদিগের পরিচিত যে সকল দোকানে সেই সকল দ্রব্য পাওয়া যায়, সেই সকল দোকানে তাঁহাকে লইয়া গিয়া তাহাকে সেই সকল দ্রব্য দেখায়। সেই সকল দ্রব্যের মধ্যে তাহার যে কোন দ্রব্য পসন্দ হয়, তাহার মূল্য চতুগুণ করিয়া বলিয়া দেয়। এইরূপে কয়েকদিবস পর্যন্ত অনবরত তিনি দালাল গণের সহিত বাজারে বাজারে ঘুরিয়া বেড়ান; কিন্তু কোন দ্রব্যই তিনি খরিদ করিয়া উঠিতে পারেন না।

আমি এই সংবাদ জানিতে পারিয়া একদিবস তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং তাহার সহিত আমি সাক্ষাৎ করি লাম। আমি বড়বাজারের একজন প্রধান দোকানদার এই কথা বলিয়া আমি সঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলাম ও কহিলাম, আজ কয়েকদিবস পৰ্য্যন্ত দেখিতেছি, আপনি কতক গুলি দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে দালালগণের সহিত দোকানে দোকানে ঘূরিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন দ্রব্যই আপনি ক্রয় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। আমার বিশ্বাস, যে পৰ্য্যন্ত সেই দালালগণ আপনাকে পরিত্যাগ না করিবে, সেই পৰ্যন্ত আপনি কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে পারিবেন না। কারণ, উঁহারা আপনাকে সঙ্গে করিয়া যে কোন দোকানে লইয়া যাইবে, দোকানদার আপনার নিকট তাহারই চতুগুণ মূল্য চাহিয়া বসিবে। কারণ, সেই দ্রব্য যদি আপনার ক্রয় করা হয়, তাহা হইলে যে সকল দালাল আপনার সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই পৃথক পৃথক্‌রূপ দালালী সেই দোকানদারকে দিতে হইবে। দোকানদার পূর্বেই সেই অর্থ যদি আপনার নিকট হইতে গ্রহণ না করিবেন, তাহা হইলে তিনি দালালগণকে সন্তুষ্ট করিবেন কোথা হইতে?

আমার নিজের সকল প্রকার দ্রব্যের দোকান আছে বলিয়াই, আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। আমি যেরূপ অল্প মূল্যে আপনাকে দ্রব্যাদি দিতে পারিব, বাজারের অপর কোন ব্যক্তিই তাহা পারিবে না। আমার কথায় যদি আপনার বিশ্বাস

হয়, তাহা হইলে দুই একটী দ্রব্যের ফরমাইস আমাকে দিন, সেই দ্রব্য আনিয়া আমি আপনাকে প্রদান করি। আপনি বাজারে যাচাইয়া দেখুন, সেই দ্রব্যের মূল্য কত। তখন আপনি উহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন। দেখিবেন, বাজার হইতেও কত কম মূল্যে আমি আমার দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া থাকি।

আমার কথায় তিনি প্রথমতঃ সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিলেন বলিয়া অনুমান হইল। কিন্তু পরিশেষে আমাকে কহিলেন, আচ্ছা, আপনি আমার নিমিত্ত এক থান ভাল কিংখাপ কাপড় আনিবেন।

জমিদার মহাশয়ের এই কথা শুনিয়া আমি সেই দিবস আমার বাসায় চলিয়া আসিলাম; এবং কিছু অর্থ সহ বড়বাজারে গমন করিয়া এক থান অতি উৎকৃষ্ট কিংখাপ কাপড় ক্রয় করিয়া সেই দিবস সন্ধ্যার সময় পুনরায় সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার আনীত কিংখাপ দেখিয়া তাহার বেশ পসন্দ হইল, তিনি উহার দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।

উত্তরে আমি কহিলাম, এ কাপড়ের দাম আমি এখন বলিব না। এই কাপড় অদ্য আপনার নিকট রহিল, আপনি ইহা একবার বাজার যাচাইয়া দেখুন, দোকানদারগণ ইহার কি দাম বলিয়া দেয়। আমি কল্য সন্ধ্যার সময় পুনরায় আপনার নিকট আসিব, সেই সময় ইহার দাম আপনাকে বলিব।

আমার প্রস্তাবে জমিদার মহাশয় সম্মত হইলেন, আমিও সেই কাপড় সেই স্থানে রাখিয়া আপনার বাসায় প্রত্যাবর্তন করিলাম।

পরদিবস বৈকালে আমি পুনরায় জমিদার মহাশয়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সেই কাপড়ের দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।

তাহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, মহারাজ! ইহার দাম আমি প্রথমে বলিব না, পশ্চাতে বলিব। এই কাপড় বাজারে যাচাইয়া ইহার কি দাম আপনি জানিয়াছেন, বা আপ নিইবা ইহার কি দাম দিতে ইচ্ছা করেন, তাহা আমি পূৰ্বে জানিতে ইচ্ছা করি। আপনি ইহা মনে করিবেন না যে, আপনি ইহার দাম আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা অধিক প্রদান করিলে, আমি গ্রহণ করিব। সেই কাপড়ের দাম এই কাগজে লিখিয়া আমি এই স্থানে রাখিয়া দিলাম, আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা যদি আপনি অধিক দাম প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি অধিক গ্রহণ করিব না। আমার ন্যায্য দামই আমাকে আপনি প্রদান করিবেন।

এই বলিয়া যে দামে আমি সেই কিংখাপ ক্রয় করিয়া আনিয়া ছিলাম, তাহার অর্ধেক দাম একখানি কাগজে লিখিয়া আমি সেই স্থানে রাখিয়া দিলাম। আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তাঁহার কথার ভাবে অনুমান হইল, কি করে সেই কাপড় লওয়া যাইতে পারে, তাহা তিনি যাচাইয়া রাখিয়াছেন। তিনি আমার কথায় আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করিয়া যে দরে তিনি সেই কাপড় ক্রয় করিতে পারেন, তাহা আমাকে বলিলেন। আমি দেখিলাম, যে দরে আমি উহা ক্রয় করিয়াছিলাম, তাহার অপেক্ষাও প্রায় এক-চতুর্থ অংশ কম করিয়া উহার দাম বলিলেন।

তাহার কথা শুনিয়া আমি একটু কপট আনন্দ প্রকাশ করিলাম ও কহিলাম, আমি আজ প্রকৃতই একজন খরিদ্দার পাইছি। যে ব্যক্তি দ্রব্যের উপযুক্ত দাম না জানেন, তাহার সহিত কেনা-বেচা করা যে কতদুর কষ্টকর কাৰ্য্য, তাহা যিনি করিয়া ছেন, তিনিই বলিতে পারেন। আপনি যে দাম বলিয়াছেন, তাহা এই বন্ত্রের প্রকৃত দাম; কিন্তু এই দ্রব্য কোন কারণ বশতঃ আমার কিছু কম মূল্যে ক্রয় করা ছিল বলিয়াই, আমি আপনাকে আরও কম মূল্যে দিতে পারিতেছি।

এই বলিয়া যে কাগজে আমি উহার খরিদ মূল্যের অর্ধেক দাম লিখিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই কাগজখানি তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। আমার লিখিত দর দেখিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হই লেন, এবং আমার লিখিত মত সেই দ্রব্যের মূল্য তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত গাড়ি ভাড়া বলিয়া আর দুই টাকা আমাকে দিয়া, অন্য আর একটা দ্রব্যের ফরমাইস দিলেন। পরদিবস সেই দ্রব্য বাজার হইতে ক্রয় করিয়া তাহার নিকট লইয়া গেলাম, এবং আমার খরিদ মূল্য অপেক্ষাও কিছু কম মূল্যে উহা আমি তাহার নিকট বিক্রয় করিলাম। ইহাতে তিনি আমার উপর আরও সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, আপনি কেবলই কি বস্ত্রের কারবার করিয়া থাকেন, না জহরত-আদিও বিক্রয় করেন?

উত্তরে আমি কহিলাম, বস্ত্রাদি আমি অতি অল্প পরিমাণেই বিক্রয় করিয়া থাকি। আমার অধিক কারবার জহরতের। কেন মহাশয় আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

জমিদার। আমার কিছু জহরতের প্রয়োজন হইয়াছে; সেই নিমিত্তই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কত টাকার জহরতের প্রয়োজন হইবে? তাহার উত্তরে তিনি কহি লেন, প্রায় দশ হাজার টাকার জহরতের প্রয়োজন।

আমি কহিলাম, এ অতি সামান্য কথা। আপনার কি কি দ্রব্যের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আপনি আমাকে প্রদান করুন, আমি সেই তালিকা অনুযায়ী জহরত আনিয়া আপনাকে প্রদান করিব। আপনি সেই সকল জহরত প্রথমে যাচাই করিয়া দেখিবেন, এবং পরিশেষে তাহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন।

আমার এই কথা শুনিয়া কি মূল্যের কি কি জহরতের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা গ্রহণ করিয়া তাঁহার একজন কর্ম্মচারীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। সেই কর্ম্মচারী সর্বদা জমিদার মহাশয়ের নিকট থাকিতেন, এবং তিনি যাহা বলিতেন, তাহা প্রায়ই তিনি শুনিতেন। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, জমিদার মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্বেই আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার সহিত একরূপ বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়াছিলাম। যে দিবস জমিদার মহাশয়ের নিকট কোন দ্রব্য বিক্রয় করিয়া কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিতাম, সেই দিবস তাহা হইতে তাহাকেও কিছু অর্থ প্রদান করিতাম। সুতরাং জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে সৰ্ব্বদা যাহাতে আমি কিছু প্রাপ্ত হই, তিনি তাহাই করিতেন।

জমিদার মহাশয় আমাকে জহরতের ফরমাইস দিলে পরই, তিনি জমিদার মহাশয়কে কহিলেন, যে ব্যক্তি এত টাকার জহরত আপনার নিকট আনয়ন করিবেন, তাঁহাকে উহার নিমিত্ত কিছু অগ্রিম টাকা দেওয়া কর্ত্তব্য। কারণ, অগ্রিম কিছু টাকা প্রদান করিলে যতশীঘ্ন পারিবেন, জহরত লইয়া ইনি আপনার নিকট উপস্থিত হইবেন।

কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় একখানি হাজার টাকার নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, সেই স্থান হইতে আসিবার সময় আমি কর্ম্মচারীকে কিছু প্রদান করিয়া আসিলাম। সেই কৰ্ম্মচারীকে আমি মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু প্রদান করিতাম বলিয়াই যে তিনি আমার উপর এতদুর অনুগ্ৰহ করিতেন, তাহা নহে। সময় সময় তাহাকে সঙ্গে করিয়া আমার বাসায় আনিতাম ও তাহাকে লইয়া আমি ও ত্রৈলোক্য নানারূপ আমোদ-আহলাদ করিতাম।

সেই টাকা লইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, এবং আপন বাসায় আসিয়া সেই টাকা ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। এতগুলি টাকা আমি একবারে কোথায় পাইলাম, জিজ্ঞাসা করায়, আমি ত্রৈলোক্যকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য কহিল, তাহা হইলে সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট আর গমন করিবার প্রয়োজন কি? এই হাজার টাকায় এখন অনেক দিবস আমাদিগের চলিবে।

ত্রৈলোক্যের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, তাহা কি কখনও হইতে পারে। কারণ, জমিদার মহাশয়ের কর্ম্মচারী আমাদিগের বাসা পর্যন্ত অবগত আছেন। বিশেষতঃ যখন তাঁহারই কথায় বিশ্বাস করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে এই টাকা প্রদান করিয়াছেন, তখন তাহাদিগের নিকট আর গমন না করিলে, সেই কর্ম্মচারীই নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হইবেন। সুতরাং তাঁহাকে অবমানিত করিয়া আমার সবিশেষ কোন ফল লাভ হইবে না। অধিকন্তু যদি তাহাদিগের সহিত প্রণয় রাখিয়া চলিতে পারি, তবে এক সহস্র কেন, এরূপ কত সহস্র টাকা আমি তাহাদিগের নিকট হইতে ক্ৰমে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইব। তুমি যেরূপ প্রস্তাব করিতেছ, সেই প্রস্তাবে আমি কোনরূপেই সম্মত হইতে পারি না। কিন্তু আমি এক উপায় মনে মনে স্থির করিয়াছি। যাহা ভাবিতেছি, তাহা যদি কার্যে পরিণত করিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগের লাভও যথেষ্ট হইবে, এবং সেই কৰ্ম্ম চারী প্রভৃতি কাহার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। অথচ সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমার খুব পসার থাকিবে।

এই বলিয়া আমি মনে মনে যাহা স্থির করিয়াছিলাম, তাহা ত্রৈলোক্যকে বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য প্রথমতঃ একবারে হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল ও কহিল, এরূপ কাৰ্য আমার দ্বারা কখনই হইবে না। কিন্তু সে কি করিবে? আমার প্রস্তাবে পরিশেষে তাহাকে সম্মত হইয়া আমাকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে হইল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। সহরের ভিতর নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়া সুবিধা মত একটা বাড়ী দেখিতে পাইলাম। কোন গতিতে সেই বাড়ী ভাড়া করিতে পারিলে, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিব, এই ভাবিয়া খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেই বাড়ীর মালিককে বাহির করিলাম। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কেবলমাত্র সাতদিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া লইতে চাহিলাম। কিন্তু সামান্য দিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া দিতে তিনি অসম্মত হওয়ায়, পরিশেষে একমাসের নিমিত্তই আমাকে সেই বাড়ী ভাড়া লইতে হইল। কিন্তু যাঁহার বাড়ী, তিনি যে ইহাতেও ন্যায্য ভাড়া গ্রহণ করিলেন, তাহা নহে; নিয়মিত ভাড়া অপেক্ষা প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আমার নিকট হইতে অগ্রিম গ্রহণ করিয়া, তাহার পর তিনি আমার হস্তে সেই বাড়ীর চাবি অর্পণ করিলেন। চাবি আনিয়া আমি সেই বাড়ী খুলিলাম, এবং কতকগুলি আসবাব ভাড়া করিয়া সেই দিবসেই উহার বৈঠকখানা সাজাইয়া ফেলিলাম। গৃহ সাজান হইয়া গেলে, আমি আড়গোড়ায় গমন করিলাম। সেই স্থানে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি একদিবসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়া তাহার অগ্রিম ভাড়া তাহা দিগকে প্রদান করিলাম। তাহাদিগের সহিত আমার এইরূপ বন্দোবস্ত রহিল যে, পরদিবস আমি আড়গোড়ায় গমন করিয়া গাড়ি দুইখানি সঙ্গে করিয়া আনিব।

এই সকল কার্য সম্পন্ন করিতে আমার সমস্ত দিবস অতীত হইয়া গেল। সমস্ত দিবসের মধ্যে আমি আমার বাসায় আর ফিরিতে পারিলাম না। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, দেখিতে দেখিতে ক্রমে রাজি নয়টাও বাজিয়া গেল। রাত্রি নয়টার পর আমি আমার বাসায় ফিরিয়া গেলাম, এবং ত্রৈলোক্যকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, আমি যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত অদ্য প্রাতঃকালে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই ঠিক করিয়া আসিয়াছি। ঘর ভাড়া হইয়া গিয়াছে, এই দেখ তাহার চাবি। ঘর দ্রব্যাদিতে সুসজ্জিত করিয়া রাখিয়াছি। এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই বাড়ীর চাবি বাহির করিয়া তৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম।

আমার কথার উত্তরে ত্রৈলোক্য কহিল, চাবি ত দেখিলাম; কিন্তু কিরূপ স্থান ঠিক করিয়াছেন, চলুন একবার যাইয়া দেখিয়া আসি।

ত্রৈলোক্যের সেই কথায় আমি তখন সম্মত হইলাম না, তাহাকে সেই রাত্রিতে আমি সেই স্থানে লইয়া গেলাম না। কহিলাম, আজ রাত্রি অধিক হইয়াছে। বিশেষতঃ সেই স্থান নিকটেও নহে, অনেক দূরে। সে স্থানে গিয়া ফিরিয়া আসিতে আজ রাত্রি কাটিয়া যাইবে, অতএব এখন আর সে স্থানে যাইবার প্রয়োজন নাই। কল্য প্রাতঃকালে একবারে সুসজ্জিত হইয়া আমার সহিত গমন করিও, সেই স্থানে তোমাকে রাখিয়া আমি গাড়ি প্রভৃতি আনিবার নিমিত্ত গমন করিব।

আমার কথায় ত্রৈলোক্য সম্মত হইল, এবং আমার পূর্ব পরামর্শ অনুসারে সে যাহাতে উত্তমরূপে সজ্জিত হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত উত্তম উত্তম অলঙ্কার ও বস্ত্রাদি সংগ্রহ করিতে তখন প্রবৃত্ত হইল।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া স্নান আহারের কাৰ্য্য শীঘ্র শীঘ্র সমাধা করিয়া লইলাম। অন্য স্থান হইতে বস্ত্র-অলঙ্কার প্রভৃতি যে সকল উত্তম উত্তম দ্রব্য ত্রৈলোক্য চাহিয়া আনিয়া ছিল, তাহার দ্বারা সেও উত্তমরূপে সজ্জিত হইল। তাহার পর আমি একখানি ঠিকা গাড়ি ডাকাইয়া আনিলাম, এবং আমরা উভয়েই উহাতে আরোহণ করিয়া আমাদিগের বাসা হইতে বহির্গত হইলাম। নানাপথ ও গলির ভিতর দিয়া অনেক দূর গমন করি বার পর, একটী গলির ভিতর আমি যে নূতন বাড়ী ভাড়া করিয়া ছিলাম, সেই বাড়ীর দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দরজার সম্মুখে গাড়ি লাগিলে, আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করি লাম। উহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে, গাড়িবান্ তাহার গাড়ি লইয়া

প্রস্থান করিল। আমার নিকট সেই বাড়ীর যে চাবি ছিল, তাহার দ্বারা সেই বাড়ীর দরজা খুলিয়া আমরা উভয়েই তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর অবস্থা এবং সুসজ্জিত গৃহের অবস্থা দেখিয়া, ত্রৈলোক্য অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। পরিশেষে ত্রৈলোক্য সেই বাড়ীর সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া সেই সুসজ্জিত গৃহের একখানি চেয়ারের উপর বসিয়া রহিল। আমি গাড়ি আনিবার মানসে সেই আড়গোড়ায় গমন করিলাম।

আড়গোড়ার গমন করিবামাত্রই একখানি প্রকাণ্ড জুড়ি ও একখানি অতিশয় দ্রুতগামী কম্পাস গাড়ি আমি প্রাপ্ত হইলাম। সেই কম্পাস গাড়িতে উপবেশন করিয়াই জুড়ির সহিত আমি পূর্বোক্ত বাড়ীর দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমরা সেই স্থানে আগমন করিবামাত্রই ত্রৈলোক্য ভিতর হইতে সেই বাড়ীর দরজা খুলিয়া দিলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। গাড়ি দুইখানি বাড়ীর সম্মুখেই দাড়াইয়া রহিল।

আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া প্রথমতঃ ত্রৈলোক্যের সহিত উত্তমরূপে পরামর্শ আঁটিয়া লইলাম। কিরূপ ভাবে আমাদিগকে কি কি করিতে হইবে, তাহার সমস্ত ঠিক হইয়া গেলে, আমি জুড়িগাড়ির সহিসদ্বয়কে সেই গাড়ির পরদা উত্তমরূপে ঢাকিয়া দিতে কহিলাম। সহিসদ্বয় আমার কথা শুনিয়া উহার পরদা সকল এরূপ ভাবে ফেলিয়া দিল যে, উহার ভিতর বসিলে বাহিরের কোন লোক যে আরোহীকে কোনরূপে দেখিতে পাইবে তাহার আর কোনরূপ সম্ভাবনা রহিল না। ইহার পরই ত্রৈলোক্য বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া সেই জুড়িগাড়ির ভিতর গিয়া উপ বেশন করিল। আমি বাড়ীর চাবি বন্ধ করিয়া দিয়া সেই চাবি ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। আমিও সেই কম্পাস গাড়িতে উঠিয়া বড়বাজার অভিমুখে উঁহাদিগকে গমন করিতে বলিলাম। আমার নির্দেশ মত উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার অভিমুখে গমন করিল।

ক্রমে গাড়ি গিয়া বড়বাজারে উপস্থিত হইল, এবং রামজী লাল যে দোকানের কর্ম্মচারী ছিল, সেই দোকানের সম্মুখে গিয়া উভয় গাড়িই থামিল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম, ত্রৈলোক্য গাড়ির ভিতরেই বসিয়া রহিল।

আমি দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া দোকানদারকে কহিলাম, একজন রাণী কতকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন, আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, তিনি দোকানের সম্মুখে গাড়ির ভিতর বসিয়া আছেন। তাঁহাকে ভাল ভাল কতকগুলি জহরত দেখাও, যদি কোন জহরত তাহার পসন্দ হয়, তাহা হইলে উনি তাহা নিশ্চয়ই গ্রহণ করিবেন। ইহার নিকট কিছু বেচিতে পারিলে, আপনাদিগের বেশ দুই পয়সা লাভ হইবে, আমারও কিছু উপার্জন হইবে। আমার বোধ হয়, উনি নিজে কোন দ্রব্যের মূল্য আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন না, কেবল দ্রব্য পসন্দ করিয়া দিবেন। দ্রব্য পসন্দ হইলে আমরা তাহার মূল্য যাহা বলিব, তাহাতেই উনি তাহা গ্রহণ করিবেন। কিন্তু আপনাকে আমি পূর্ব হইতেই সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, যদি কোন দ্রব্যের মূল্য উনি জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে উহার মূল্য সেই সময় যেন খুব অধিক করিয়া বলা হয়।

দোকানদারকে এইরূপ শিখাইয়া দিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি দোকানের বাহিরে আসিলাম, এবং সেই জুড়িগাড়ির নিকট দাঁড়াইয়া কহিলাম, এই গাড়িতে রাণীজি আছেন, তিনি অনেকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন। আপনি এক একটী করিয়া জহরতের বাক্স তাহার হস্তে প্রদান করুন, ইহার মধ্যে যদি কোন দ্রব্য রাণীজির পসন্দ হয়, তাহা হইলে তাহার দর স্থির করিয়া দিয়া উহার মূল্য গ্রহণ করিবেন। আমার প্রস্তাবে দোকানদার সম্মত হইলেন, এবং এক একটী করিয়া নানা প্রকার জহরতের বাক্স রাণীজির হস্তে প্রদান করিতে লাগিলেন। সেই সকল জহরতের মধ্যে যে সকল জহরত রাণীজি পসন্দ করিলেন, বা যে সকল জহরত আমাদিগের লইয়া যাইবার পরামর্শ ছিল, সেই সকল জহরত ত্রৈলোক্য একটা একটা করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিতে লাগিল। এইরূপে কতকগুলি জহরত আমার হস্তে প্রদান করিবার পর আমাদিগের পূর্ব পরামর্শ অনুযায়ী ত্রৈলোক্য আমাকে কহিল, আমি এখন বাসায় যাইতেছি। আপনি এই সকল জহরতের উপযুক্ত দাম দোকানদারের সহিত স্থির করিয়া আমার বাসায় লইয়া আসিবেন। আর হয় দোকানদারকে, না হয় তাহার দোকানের অপর কোন একজন লোককে সেই সঙ্গে লইয়া যাই বেন। আমার বাসায় গেলেই, আমি হয় ইহার নগদ মূল্য প্রদান করিব, না হয় কোন ব্যাঙ্কের উপর একখানি চেক প্রদান করিব। আমার বোধ হয়, এই সকল জহরতের মূল্য আট দশ হাজার টাকার অধিক হইবে না। সুতরাং এই সকল সামান্য দ্রব্যের মূল্য বাকী রাখিবার কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না। আমাদিগকে কেবল এই মাত্র বলিবার পরই রাণীজি তাহার গাড়ি চালাইতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড জুড়ি বড়বাজার অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল।

ত্রৈলোক্য গমন করিবার পর আমি সেই দোকানদারের সহিত একত্র বসিয়া যে সকল দ্রব্য ত্রৈলোক্য পসন্দ করিয়া গিয়াছিল, তাহার মূল্যের একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকা প্রস্তুত হইলে, সেই জহরতগুলি লইয়া দোকানদারকে রাণীজির বাসায় গমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিলাম; কিন্তু তিনি নিজে না আসিয়া তাঁহার একজন অতিশয় বিশ্বাসী কর্ম্মচারী রামজীলালকে আমার সহিত পাঠাইয়া দিলেন। তিনি সেই সকল গহনার সহিত আমার গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন।

ত্রৈলোক্য বড়বাজার হইতে প্রত্যাগমন করিলে প্রায় একঘণ্টা পরে আমি জহরতগুলির সহিত রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের সেই নূতন বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াই আমি আমার সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। ইতিপূর্বে ত্রৈলোক্যও প্রত্যাবর্তন করিবার পর তাহার জুড়ি বিদায় করিয়া দিয়াছিল।

রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমি একবারে উপরে উঠিলাম। যে ঘরটী উত্তমরূপে সাজান ছিল, সেই গৃহে তাহাকে বসাইয়া তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিতেছি, এরূপ সময় রাণীজি বা তৈলোক অন্য ঘর হইতে আসিয়া সেই গৃহে প্রবেশ করিল। আমি রামজীলালের সম্মুখে ত্রৈলোক্যকে কহিলাম, সমস্ত জহরতের দাম প্রায় দশ হাজার টাকা হইয়াছে। দোকানদার মহাশয় নিজে আসিতে পারেন নাই, তিনি তাঁহার এই বিশ্বাসী লোককে জহরতের সহিত আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন; কিন্তু ইহার মনিব ইহাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, অগ্রে টাকা না পাইলে এই সকল জহরত যেন কাহারও হস্তে প্রদান করা না হয়। কারণ, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ।

আমার এই কথা শুনিয়া রাণীজি সেই স্থানে উপবেশন করিয়া রামজীলালের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। সেই অব কাশে আমি একবার নিয়ে গমন করিয়া বাড়ীর ভিতর দিক হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া পুনরায় উপরে উঠিলাম। পরে যে স্থানে রামজীলাল বসিয়াছিলেন, তাহার এক পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, ত্রৈলোক্য ওরফে বাণীজি, রামজীলালের নাম জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে রামজী লাল কহিল, রাণজি! আমার নাম রামজীলাল।

ত্রৈলোক্য। আমি যে সকল জহরত পসন্দ করিয়া দিয়া ছিলাম, তুমি সেই সকল জহরতই আনিয়াছ ত?

রামজীলাল। আমি তাহাই আনিয়াছি।

ত্রৈলোক্য। উহার দাম কত হইয়াছে?

রামজীলাল। প্রায় দশ হাজার টাকা।

ত্রৈলোক্য। তুমি কি কি দ্রব্য আনয়ন করিয়াছ দেখি? রামজীলাল। রাণীজি! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমার মনিবের আদেশ আছে যে, অগ্রে দাম না পাইলে এই সকল দ্রব্য কাহারও হস্তে প্রদান করিতে পারিব না।

ত্রৈলোক্য। এত সামান্য টাকার নিমিত্ত তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস।

রামজীলাল। আপনাকে আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। আমার অপরাধ লইবেন না, আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি সামান্য চাকর হইয়া কিরূপে মনিবের আদেশ লঙ্ঘন করিব?

ত্রৈলোক্য। তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস করিবার কারণ?

রামর্জীলাল। কয়েকবার জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া তিনি ঠকিয়াছেন, তাহাতেই আমাকে এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়াছেন। আপনি ত সবিশেষ জানেন যে, কলিকাতা সহর জুমাচোরগণের দ্বারা পরিপূর্ণ।

আমি এতক্ষণ পর্যন্ত স্থির ভাবে সেই স্থানে বসিয়াছিলাম, রামজীলালের এই সকল কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। রাগের ভাব প্রকাশ করিয়া রামজীলালকে কহিলাম, তুমি জান না, কাহার সহিত কিরূপ ভাবে তুমি কথা কহিতেছ। তুমি জান, রাণীজি একটু রাগ করিলে তোমার মস্তক সহ এই বাটী হইতে প্রস্থান করা কঠিন হইবে?

আমার এই কথা শুনিয়া রামজীলাল যেন একটু ভীত হইল; কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া মুখে একটু সাহস দেখাইয়া কহিল, কেন, আমি কি অন্যায় কথা বলিয়াছি যে, আমার এই বাটী হইতে মস্তক সহ বাহির হওয়া কঠিন হইয়া উঠিবে? আমি কি চোর? ইহা কি ইংরাজের রাজত্ব নহে? অরাজকের মুলক যে, যাহার যাহা ইচ্ছা হইবে, অনায়াসেই তিনি তাহা করিবেন? দশ হাজার টাকার জহরত বিক্রয় না হইলে আমার মনিব এক বারে গরিব হইয়া যাইবেন না! আমি জহরত বিক্রয় করিব না, চলিলাম। এই বলিয়া রামজীলাল উঠিয়া দাঁড়াইল। এক

রামজীলালের কথা শুনিয়া এবং তাহার অবস্থা দর্শন পুলিস আমি নিতান্ত রাগের ভাব দেখাইয়া বলিলাম, কি! ছোট মুরিবে, কথা! রাণীজিকে এইরূপ ভাবে অবমাননা! এ অবমাননা হবে। স্বচক্ষে দেখিয়া কোনরূপেই সহ করিতে পারি না। এই বলিয়া আমার জুতা সহিত রামজীলালের বক্ষে সবলে এক পদাঘাত করিলাম। আমার লাথি খাইয়া হতভাগ্য রামজীলাল চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং সেই স্থানেই পড়িয়া গেল। পড়িবামাত্রই আমি দ্রুতগতি তাহার বুকের উপর উঠিয়া বলপূর্বক তাহাকে ধরিলাম।

আমি তখন কি করিলাম? আপনারা যাহা কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। কেবলমাত্র একজন শ্রীলোকের সাহায্যে যে কাৰ্য্য কখনও হইতে পারে বলিয়া আপ নারা একবারও মনে স্থান দেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। জন্য বা তস্করেরাও যে কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিতে মনে মনে ঘৃণা বোধ করে, আজ আমি তাহাই করিলাম। রাক্ষস বা পিশাচ গণও যে কার্যের কথা শুনিলে আপনাপন কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান করে, আমি আজ তাহাই করিলাম। উঃ! যে কথা বলিতে এখন আমার কণ্ঠবোধ হইয়া আসিতেছে, যে কথা বলিতে এখন আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে, যে কথা বলতে কোনরূপেই এখন আমি আমার চক্ষুজল সম্বরণ করিতে পারিতেছি না, সেই সময় আমি তাহাই কাৰ্যে পরিণত করিয়াছিলাম। যে মহাপাপের আদি নাই, অন্ত নাই, যে মহাপাপের কথা শুনিলেও মহাপাপ না, আমি সেই সময় সেই মহাপাপে লিপ্ত হইতে কোনরূপেই জুখ হইলাম না। বিনা-কারণে ও বিনা-দোষে সেই নিরীহ, প, নিঃসহায় ব্যক্তির উপর সবলে পা দিয়া দাড়াইলাম, য পৰ্য্যন্ত তাহার প্রাণবায়ু একবারে শেষ না হইয়া গেল,–পৰ্যন্ত আর পা উঠাইলাম না। ত্রৈলোক্যও বলপূর্বক তাহার পা দুইখানি চাপিয়া ধরিয়া আমার এই মহাপাপের সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিল। সামান্য টাকার লোভে দেখিতে দেখিতে এই ভয়ানক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমাধা করিলাম।

এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা হইবার পর, রামজীলালের মৃতদেহের উপর আমার দৃষ্টি একবার পতিত হইল। সেই দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনের ভাবও সবিশেষরূপে পরিবর্তিত হইয়া গেল। চক্ষু দিয়া বিন্দুপাত হইল, সামান্য টাকার উপর ঘৃণা জন্মিল; পরকালের ভীষণ ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল। কিন্তু অধিকক্ষণ পর্যন্ত এভাব আমার হৃদয়ে স্থান পাইতে দিলাম না। পরক্ষণেই আবার সে ভাব দূরে পলায়ন করিল। রামজীলালের সমভিব্যাহারে যে সকল জহরত ছিল, তাহার সমস্তগুলি তখন আমরা অপহরণ করিলাম।

রামজীলালের মৃতদেহ লইয়া তখন আমরা কি করিব, মনে সেই ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, রাত্রি কালে উহার মৃতদেহ টানিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দিব; কিন্তু তাহা বিপদ-জনক বলিয়া মনে হইল। পুনরায় ভাবিলাম, একমাস পর্যন্ত খালি-বাড়ীর ভিতর এই মৃতদেহ আবদ্ধ থাকিলেই সকল গোল মিটিয়া যাইবে; একমাস পরে উহা দেখিয়া কেহই বুঝিতে পারিবে না যে, উহা কাহার মৃতদেহ। সুতরাং আমাদিগের বিপদের সম্ভাবনা অতি অল্পই থাকিবে। কিন্তু পরিশেষে মনে হইল, দুই চারিদিবসের মধ্যেই এই মৃতদেহ পচিয়া যখন ভয়ানক দুর্গন্ধ চতুর্দিকে বহির্গত হইতে আরম্ভ হইবে, তখন পুলিস আসিয়া নিশ্চয়ই এই বাড়ী খুলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে, এবং সম্মুখেই মৃতদেহ দেখিতে পাইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে। এরূপ অবস্থায় সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িষরই সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। মনে মনে এইরূপ নানা বিষয়ের কল্পনা করিয়া পরি শেষে একটা উপায় বাহির করিলাম। আমি ও ত্রৈলোক্য উভয়ে মিলিয়া রামজীলালের মৃতদেহ উপর হইতে নীচে নামাইলাম, এবং নীচের একখানি গৃহের মেঝের উপর যে সকল পাথর বসান ছিল, অনেক কষ্টে তাহার তিন চারিখানি উঠাইয়া ফেলি লাম। পরে সেই স্থান হইতে মৃত্তিকা উঠাইয়া ক্ৰমে একটা প্রশস্ত গহ্বর খনন করিলাম। তখন রামজীলালের মৃতদেহ সেই গর্তের ভিতর উত্তমরূপে পুতিয়া ফেলিলাম। তাহার উপর যতদুর মৃত্তিকা ধরিতে পারে, তাহা উত্তমরূপে দুরমুস করিয়া বসাইয়া দিয়া, যে প্রস্তর চারিখানি উঠাইয়া ফেলিয়াছিলাম, তাহাও উত্তমরূপে তাহার উপর বসাইয়া দিলাম। এই সকল কার্য সম্পন্ন করিতে আমাদিগের অতিশয় পরিশ্রম হইল সত্য; কিন্তু এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিবার উপযোগী দ্রব্যাদির নিমিত্ত আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট পাইতে হইল না। চুন, সুরকি, সাবল, কোদালী, দুরমুস প্রভৃতি আমাদিগের যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইল, তাহার সমস্তই আমরা সেই বাড়ীর একখানি গৃহের ভিতর প্রাপ্ত হইলাম। সেই বাড়ী প্রস্তুত করিবার সময় যে সকল যন্ত্রাদি ব্যবহৃত হইয়াছিল, এবং চুন, সুরকি, বালী প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহার সমস্তই সেই গৃহের ভিতর রক্ষিত ছিল। কলেও সমস্ত দিবস জল ছিল। সুতরাং কোন দ্রব্যই আমাদিগের অপর কোন স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে হইল না। কিন্তু সেই কাৰ্য্য সমাধা করিতে করিতে আমাদিগের সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। মৃতদেহ প্রােথিত হইবার পর, যে সকল মৃত্তিকা প্রভৃতি উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহা সেই গৃহ হইতে বাহির করিয়া স্থানান্তরে রাখিয়া দিলাম। সেই গৃহখানি এরূপ ভাবে পরিষ্কার করিয়া রাখিলাম যে, উহার অবস্থা দেখিয়া কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহ না হয়।

রামজীলালের মৃতদেহ এইরূপে মৃত্তিকার ভিতর প্রােথিত করিয়া, ঘর সাজাইবার যে সকল দ্রব্য যে স্থান হইতে ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছিল, সেই সকল দ্রব্য ভাড়া সমেত সেই স্থানে পাঠাইয়া দিলাম, এবং সেই বাড়ীর সদর দরজায় তালাবদ্ধ করিয়া একখানি ঠিকা গাড়ি আনিয়া আমরা সে দিবস সেই স্থান হইতে আপন বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। বলা বহুল্য, যে সকল জহরত আমরা রামজীলালের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহা আমাদিগের সঙ্গে আনিতে ভুলিলাম না।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি সেই জহরতগুলি এবং সেই বাড়ীর চাবি লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলাম, তাহাকে যাহা বলিয়া চাবি ফিরাইয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই সেই বাড়ীওয়ালার নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন। বাড়ীর চাবি ফিরাইয়া দিয়া সেই জহরতগুলি সেই পশ্চিমদেশীয় জমিদার মহাশয়ের নিকট লইয়া গেলাম। তিনি যেরূপ ভাবের জহরত আনিবার নিমিত্ত আমাকে ফরমাইস করিয়া ছিলেন, ঠিক সেই মত জহরত দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। সমস্ত দ্রব্যই তাঁহার পসন্দ হইল। তিনি সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া তাহার দাম আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, এই সকল দ্রব্য দশ বার হাজার টাকার কম আমরা কাহারও নিকট বিক্রয় করি না; কিন্তু আপনার নিকট আমাদিগের অনেক দ্রব্য বিক্রয় হইবার আশা আছে, অথচ কোন্ দ্রব্যের কি মূল্য, তাহাও আপনি উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় এ সামান্য বিষয় লইয়া আমার আর কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। বিবেচনা করিয়া আপনি আমাকে যে মূল্য বলিয়া দিবেন, আমি সেই মূল্যেই উহা আপনাকে প্রদান করিব।

আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় সেই জহরতগুলি আর একবার উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, আমার বিবেচনায় এই সকল দ্রব্যের মূল্য নয় হাজার টাকার অধিক বলিয়া অনু মান হয় না।

তাহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, আপনি যে দাম বলিয়া ছেল, তাহা প্রায় ঠিকই হইয়াছে। এই সকল দ্রব্য আমার নয় হাজার টাকায় খরিদ। সেই মূল্যেও আমি উহা আপনাকে বিক্রয় করিতে পারি। ইহাতে আমার আর এক পয়সাও লাভ হয় না।

আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আর কোন কথা কহিলেন না। আমাকে এক হাজার টাকা পূর্বেই প্রদান করিয়া ছিলেন, এখন বক্ৰী আট হাজার টাকার নোট আনিয়া আমার হস্তে সেই দ্রব্যের মূল্য বলিয়া প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত আমার লাভ ও পারিশ্রমিক বলিয়া আরও দুইশত টাকা আমাকে দিলেন।

তিনি আমাকে যাহা প্রদান করিলেন, তাহা নগদ টাকা নহে; নম্বরী-নোট। কতকগুলি হাজার টাকা করিয়া, ও কতক গুলি একশত টাকার হিসাবে। আমি সেই নোটগুলি গ্রহণ করিয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম, এবং সমস্তই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম। সে দিবস আর কোন স্থানে গমন করিতে বা অপর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা হইল না। মনে কেমন একরূপ দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সকল কথা যদি কোনরূপে প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমাকে কি বলিতে হইবে, বা কোন উপায়ই বা অবলম্বন করিতে হইবে। এইরূপে নানা প্রকার পরামর্শ করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।

পরদিবস দিবা দশটার সময় সেই নোটগুলি সঙ্গে লইয়া, পুনরায় আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইলাম, এবং করেনসি আফিসে গমন করিয়া সেই স্থানে সেই নোট গুলি প্রদান করিয়া, তাহার পরিবর্তে কতকগুলি দশ টাকার নোট ও কতক গুলি নগদ টাকা গ্রহণ করিলাম। নোটের পৃষ্ঠে নাম লিখিয়া দিতে বলায়, আমি রামজীলালের নাম ও বড়বাজারের ঠিকানা লিবিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমি আমার নাম ও ঠিকানা না দিয়া রামজীলালের নামেই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম। যাহা হউক, উক্ত সমস্ত টাকাই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম।

আমি। ত্রৈলোক্য সেই সকল টাকা কোথায় রাখিয়াছে?

কালী। তাহা আমি বলিতে পারি না। সেই সকল টাকা একটা পিত্তলের কলসীর মধ্যে পুরিতে আমি দেখিয়াছি; কিন্তু পরিশেষে উহা যে কোথায় রাথিয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমি শুনিয়াছিলাম যে, ত্রৈলোক্য উহা কোন স্থানে মৃত্তিকার মধ্যে পুতিয়া রাখিয়াছে।

আমি। তাহার পর?

কালী। ইহার পর কয়েকদিবস পর্যন্ত আর কোনরূপ গোল যোগ শুনিতে পাইলাম না। তাহার পর পুলিসের লোক আসিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগকে আমি যাহা বলিয়া ছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই জানিতে পারিয়াছেন। যে সকল নোট আমি জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে পাইয়া, করেসি আফিস হইতে ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম, সেই সকল নোট রামজীলাল লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, এই কথাই কৰ্মচারী গণকে বলিয়াছিলাম। তাহাও করেনসি আফিসে অনুসন্ধান করিয়া আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন যে, রামজীলালই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার পরই রামজীলালের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হয়।

যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব রামজীলালের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বাহির করিবার আদেশ প্রদান করেন, তিনি কেবলমাত্র আমার সাক্ষ্য ও করেসি অফিসের একটী বাবুর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াই সন্তুষ্ট হন, অপর কোন বিষয় অনুসন্ধান না করিয়াই ওয়ারেন্ট প্রদান করেন। তাহার পর আর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি স্বহস্তেই করিয়াছেন।

কালীবাবুর কথা শুনিয়া এই মোকদ্দমার অবস্থা আমরা অতি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম। তখন আমরা কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়কেই এই মোকদ্দমার আসামী করিলাম। পূর্বোক্ত সেই সকল টাকা ত্রৈলোক্য কালীবাবুর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া যে কোথায় রাখিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ত্রৈলোক্যকে লইয়া সবিশেষরূপে পীড়াপীড়ি করিলাম, তাহার ঘর বাড়ী খুড়িয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই টাকা বাহির করিতে পারিলাম না। কালীবাবুও সেই সম্বন্ধে আর কোন কথা বলিতে পারিল না, বা বলিল না।

মোকদ্দমা প্রথমতঃ মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। কেবলমাত্র কালীবাবুর কথা ব্যতীত ত্রৈলোক্যের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। কালীবাবু যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার অধিকারীকে যখন বলিলাম, আপনি আপনার এই ভাড়াটিয়া বাটীতে এই ত্রৈলোক্যকে কখনও আসিতে দেখিয়াছিলেন? তখন তিনি তাহার কিছুই বলিতে পারিলেন না। কেবলমাত্র ইহাই বলিলেন, আমার নিকট হইতে কালীবাবু আমার বাটীর চাবি লইয়া আসিলে, আমার বাটীতে কেহ আসিয়া বাস করিয়াছিল কি না, তাহা জানি না, বা দেখি নাই। জহরতের দোকানেরও কোন ব্যক্তিই রাণীজিকে দেখে নাই; সুতরাং কেহই ত্রৈলোক্যকে সেনাক্ত করিতে পারিল না। সহিস-কোচবান্ দোকানদার প্রভৃতিও কেহই ত্রৈলোক্যকে রাণীজি বলিয়া চিনিতে পারিল না। সুতরাং মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে সে যাত্রা ত্রৈলোক্য নিষ্কৃতি লাভ করিল।

কালীবাবুর নিষ্কৃতির উপায় রহিল না। প্রথমতঃ কালী বাবু বাড়ীওয়ালার নিকট একমাসের বন্দোবস্তে বাটী ভাড়া লইয়া চাবিটা লইয়া আসিয়াছিল বটে; কিন্তু দুই তিনদিবসের মধ্যেই বাটীর প্রয়োজন হইল না বলিয়া, সেই চাবি প্রত্যর্পণ করিয়াছিল। সেই দুই তিনদিবসের মধ্যেই সেই বীভৎস-কাণ্ড সকলের অজ্ঞাত সারে কালীবাবু কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছিল, একথা ত দোষী নিজ মুখেই ব্যক্ত করিয়াছিল। অধিকন্তু বাড়ীওয়ালা, সহিস-কোচবান। প্রভৃতির সাক্ষ্যে ও সেনাক্তে তাহা একরূপ প্রমাণীকৃত হইল; চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকিলেও, ঘটনা-পরম্পরায় অবিবোধী সমবায়ত্ব প্রমাণে কালীবাবু দোষ-মুক্ত হইতে সমর্থ হইল না। আড়গোড়ায় গিয়া যাহার নিকট গাড়ি ভাড়া করিয়া ভাড়ার টাকা জমা দিয়া ছিল, কালীবাবু তাহা কর্তৃকও পরিচিত হইল; সহিস-কোচবান্ ত চিনিয়াই ছিল। জহরতের দোকানের মালিক ও আমলাগণ কালীবাবুকে সবিশেষরূপেই চিনিয়াছিলেন; করেসি অফিসে তাঁহার নিকট হইতে নম্বরী-নোট বাইয়া কালীবাবু খুচরা নোট ও নগদ টাকা লইয়া রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিয়া ছিল, তিনিও কালীবাবুকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন যে, এই ব্যক্তিই রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া আট হাজার টাকার নম্বরী-নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়াছিল। এইরূপে বিধাতার চক্রে পড়িয়া আজ কালীবাবু আর উদ্ধার পাইল না।

যথাক্রমে কালীবাবুর মোকদ্দমা মাজিষ্ট্রেট সাহেব দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে জুরির বিচারে কালীবাবু হত্যাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইল, এবং তাহার কাৰ্য্যের উপযুক্ত দণ্ডই প্রাপ্ত হইল। বিচারে তাহার ফাঁসির হুকুম হইল।

[সম্পূর্ণ]

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত