রকম রকম (অর্থাৎ জুয়াচুরির অদ্ভুত অদ্ভুত বৃত্তান্ত!)
সূচনা:
এই কলিকাতা শহর জুয়াচোরে পূর্ণ, একথা প্রায়ই সর্বদা সকলের মুখেই শুনিতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে কলিকাতা একবারে জুয়াচোরে পরিপূর্ণ না হইলেও, ইহা যে অনেক জুয়া চোরের আবাস স্থল, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এখানে অনেক জুয়াচার অনেকরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া নিত্য যে কত নিরীহ লোকগণকে প্রতারিত করিতেছে, তাহার সংখ্যা কে করে? কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যে সকল পুরাতন জুয়াচুরির কৌশল অবলম্বন করিয়া জুয়াচোরগণ নিত্য লোকগণকে ঠকাইয়া থাকে, সেই সকল পুরাতন কৌশল-জালে এখনও নিত্য অনেক লোক পতিত হইতেছেন। আপনা হইতে সতর্ক হইতে না পারিলে, জুয়াচারগণ কর্তৃক প্রতারিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। এই নিমিত্তই আমি মধ্যে মধ্যে বিস্তর জুয়াচুরির বিবরণ এই দারোগার দপ্তরে বর্ণন করিয়া সৰ্বসাধারণকে সতর্ক করিয়া দিয়া থাকি। আমার লিখিত জুয়াচুরির বিষয় পাঠ করিয়া, অনেক পাঠক মধ্যে মধ্যে জুয়াচোরগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া থাকেন, একথাও অনেক সময় আমি সেই সমস্ত পাঠকগণের প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়াছি। তথাপি নিরীহ মফঃস্বল-বাসীগণের মধ্যে অনেকেই কলিকাতায় আসিয়া জুয়াচোরগণ কর্তৃক এখনও প্রতারিত হইতেছেন! তাহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিবার অভিলাষে, যে সকল জুয়াচুরি সর্বক্ষণ কলিকাতায় চলিতেছে, তাহার মধ্য হইতে কয়েকটীমাত্র এই স্থানে বর্ণনা করিলাম। এই সকল বিষয় সবিশেষরূপ সুখ-পাঠ্য না হইলেও, আশা করি, পাঠক মহাশয়গণ জুয়াচোরগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার মানসেই অন্ততঃ একবার ইহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিবেন। কেবল এগুলিই বা কেন, এ পর্যন্ত আমি জুয়াচুরির যে সকল কৌশল ইতিপূৰ্বে বর্ণন করিয়াছি, এবং ভবিষ্যতে আরও যে সকল বর্ণন করিব, সেই সকল বিষয় উত্তমরূপে অবগত থাকিলে জুয়াচোরগণ সহজে তাহাদিগের নিকট আসিতে সমর্থ হইবে না। অথচ এই সকল বিষয় পাঠ করিয়া যত লোক জুয়াচোরের হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিবেন, আমি ততই আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করিব।
(১) ডাকের চুরি।
ডাকঘরে আজকাল অনেক প্রকারের চুরি ও জুয়াচুরি আরম্ভ হইয়াছে, তাহার মধ্যে এই প্রবন্ধে আমি দুইটা বিষয় আজ পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি। এই দুইটী বিষয় আইন অনুসারে চুরি হইলেও, ইহাকে জুয়াচুরির শ্রেণীভুক্ত করাই কৰ্ত্তব্য। উভয়কেই এক কথায় ডাকের চিঠি চুরি বলা যাইতে পারে; কিন্তু আমি উহার নাম এইরূপ প্রভেদ করিলাম যথা;—(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি। (খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।
(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি।
গোবিন্দচন্দ্র একজন পুরাতন জুয়াচোর। অনেক সময় অনেক জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া সে মফঃস্বলের অনেক লোককে একাল পর্যন্ত ঠকাইয়া আসিয়াছিল; কিন্তু নিজে কিছুমাত্র সংস্থান করিয়া উঠিতে পারে নাই। সে অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া যাহা কিছু উপার্জন করে, তাহার ব্যয়ও প্রায় সেই রূপেই হইয়া থাকে। তবে তাহার লাভের মধ্যে কেবল এইমাত্র দেখিতে পাই যে, কোন কোন সময় দুই বেলা অন্নের সংস্থান হয়; কিন্তু কোন কোন সময় আবার তাহাও হয় না। কখন কখন গাড়ি ঘোড়ায় চড়িয়া, কথন বা টমটম হাঁকাইয়া, কলিকাতার রাস্তায় সে ছুটাছুটী করিয়া থাকে, কখন বা মলিন বস্ত্রে শরীর আবৃত করিয়া চটিজুতা পরিয়া রাস্তায় গমন করিবার কালীন, পূর্ব্ব নিয়োজিত সহিস-কোচবানগণের বেতন বাকী থাকা প্রযুক্ত, তাহাদের নিকট সুমধুর বাক্য শ্রবণ করিয়া থাকে, বা কখন কখন তাহাদিগের আদরের চড় চাপড় সহ্য করিয়া ধীরে ধীরে আপন পৃষ্ঠে হস্ত বুলাইতে থাকে। কখন বা বেশ্যা-পল্লীর ভিতর গমন করিয়া সুরাদেবীর প্রকট-শিষ্য হইয়া বার-নারীদিগের সুমধুর আদরের প্রেম-সাগরে সন্তরণ করিয়া থাকে, কখন বা তাহা দিগের দেনা পরিশোধ করিতে না পারিয়া হাসিতে হাসিতে তাহাদিগের আদর-মিশ্রিত পাদুকার ধূলি সকল আপন মস্তক হইতে ঝাড়িতে বাড়িতে স্থানান্তরে প্রস্থান করে। গোবিন্দ চন্দ্র এইরূপে কলিকাতার ভিতর অনেক দিবস পর্যন্ত আপনার লীলা খেলা করিয়া আসিতেছে। তাহার এইরূপ লীলা খেলা করিতে যে সকল অর্থ ব্যয়িত হয়, তাহার সমস্তই জুয়াচুরি-লব্ধ। সে অনেকরূপ জুয়াচুরির নূতন উপায় বাহির করিয়া অনেক লোককে ঠকাইয়াছে, এবং ক্রমে সেই সকল জুয়াচুরির বিষয় অনেকে অবগত হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহা পরিত্যাগ করিয়া অপর উপায় অবলম্বন করিয়াছে। আজকাল সে যে জুয়াচুরির উপায় অবলম্বন করিয়া আপনার খরচ-পত্রের সংস্থান করিতেছে, তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।
গোবিন্দ যে স্থানে বাস করে, সেই স্থানে পোষ্টাফিসের বে পিয়ন চিঠি-পত্র বিলি করিয়া থাকে, তাহার সহিত একটু আলাপ করিবার মানসে সে প্রথমতঃ সুযোগ অনুসন্ধান করে। ক্রমে ক্রমে এক একজন করিয়া দুইজন পিয়নের সহিত উত্তমরূপ আলাপ করিয়া লয়। কোন স্থান হইতে তাহার পত্ৰ আসিলে যে পিয়ন সেই পত্র তাহাকে প্রদান করিতে যাইত, তাহাকে প্রায়ই দুই চারি আনা পারিতোষিক না দিয়া গোবিন্দ ছাড়িত না। তদ্ব্যতীত পূজা-পার্বণে প্রায়ই তাহাদিগকে ডাকিয়া বসি বলিয়া কিছু না কিছু প্রদান করিত। এইরূপে কিছু দিবসের মধ্যেই পিয়নদ্বয়কে এরূপ ভাবে আপনার বশীভূত করিয়া লইল যে, গোবিন্দ যাহা বলিত, তাঁহারা তাহাই শুনিত। পিয়নদ্বয় কোন পত্রাদি তাহার নিকট বিলি করিতে আসিলে, তখন প্রায়ই তাহাদিগের নিকট অপরের যে সকল পত্ৰ থাকিত, তাহার শিরোনামা, ও পোষ্টকার্ড হইলে তাহাতে যাহা লেখা থাকিত, গোবিন্দ তাহা পড়িয়া লইত। কেন যে সে এইরূপ ভাবে চিঠি পত্র পড়িয়া দেখিত, ডাকপিয়নদ্বয় তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। পাঠ সমাপ্ত হইলে কিছু পারিতোষিকের সহিত সেই সকল পত্র পুনরায় ডাকপিয়নের হস্তে প্রদান করিত। তাঁহারা সেই সকল পত্ৰ লইয়া, যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্যক, পরে সেই সেই স্থানে তাহা বিলি করিত। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, একদিবস গোবিন্দ উঁহাদিগের একজন পিয়নকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা যে সকল পত্র বিলি করিয়া থাক, তাহাদের মধ্যে যদি কোন পত্ৰ তোমাদিগের হস্ত হইতে হারাইয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদিগকে কি কোনরূপ দণ্ড গ্রহণ করিতে হয়?
পিয়ন। পোষ্টকার্ড বা যে সকল পত্রে টিকিট দেওয়া আছে, তাহা হারাইয়া গেলে, আমাদিগকে কোনরূপ দণ্ড লইতে হয় না; কারণ, সেই সকল পত্রের কোনরূপ হিসাব থাকে না। উহাদের মধ্যে কোন পত্র যদি আমরা হারাইয়া ফেলি, তাহা হইলে আমরা উহা হারাইয়া ফেলিয়াছি, কি বিলি করিয়াছি, তাহা। কিরূপে জানিতে পারা যাইবে? কারণ, সে সকল বিলি হইলে, তাহার জন্য কেহ সহিও করেন না, বা কেহ পয়সাও দেন না।
গোবিন্দ। আর যে সকল পত্ৰ বেয়ারিং?
পিয়ন। তাহা হারাইয়া গেলেও সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। সেই পত্রের মাশুল চারি পয়সা ঘর হইতে দিলেই সকল গোল মিটিয়া যায়।
গোবিন্দ। এরূপ অবস্থায় একজনের পত্র অনায়াসেই তোমরা অপরকে প্রদান করিতে পার?
পিয়ন। পারি। দুই একখানা অপরকে বিলি করিলে, সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। ধরা পড়িলে, এই বলিয়া বুঝাইতে পারি যে, ভুল-ক্রমে একজনের পত্ৰ অপরের নিকট বিলি করা হইয়াছে।
গোবিন্দ। অনেক হইলে?
পিয়ন। তাহাতে আমাদিগের সবিশেষ বিপদের সম্ভাবনা। এই সকল কথা যদি কোন গতিতে আমাদিগের উপরওয়াল জানিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমাদিগের নাম কাটিয়া দিতে পারেন, এবং ইচ্ছা করিলে, আমাদিগকে জেলেও পাঠা ইতে পারেন।
গোবিন্দ। যাহাতে এরূপ বিপদের সম্ভাবনা, সেইরূপ কার্যে কোন কোন পিয়ন হস্তক্ষেপ করিতে কিরূপে সমর্থ হয়, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না।
পিয়ন। কেন মহাশয়! আপনি এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
গোবিন্দ। তোমরা যে সকল চিঠি বিলি কর, সেই সকল চিঠি আমি মধ্যে মধ্যে যেরূপ দেখিয়া লই, ইতিপূর্বে একজন পিয়নের নিকট হইতে আমি সেইরূপে চিঠি সকল দেখিয়া লই তাম, এবং তাহার মধ্যে আমার আবশ্যক মত দুই একখানি পত্র গ্রহণও করিতাম। তাহার পরিবর্তে প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত আমি তাহাকে চারি আনা করিয়া প্রদান করিতাম। এইরূপে সময়ে সময়ে সে আমার নিকট হইতে প্রত্যহ এক টাকা দুই টাকার কার্য করিয়া যাইত।
পিয়ন। সেই সকল পত্র লইয়া আপনি কি করিতেন?
গোবিন্দ। আমি প্রথমে উহা পড়িয়া দেখিয়া পরিশেষে ছিড়িয়া ফেলিয়া দিতাম।
পিয়ন। সেইরূপ পত্র আপনার নিকট দুই একখানি আছে কি?
গোবিন্দ। আমার নিকট এখন আর উহা কোথা হইতে থাকিবে? উহা আমি সেই সময়েই পড়িয়া ছিড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।
পিয়ন। আপনার কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, যদি আপনি উহা ছিড়িয়া ফেলিয়া দেন, তাহা হইলে অনায়াসেই আপনাকে ওরূপ পত্র আমরাও প্রদান করিতে পারি। কারণ, সেই পত্র আপনি লইলে পরে যদি অপর কাহারও হস্তে পতিত না হয়, তাহা হইলে তাহা লইয়া কোন গোলযোগের সম্ভাবনা বা আমাদিগের আর কোনরূপ বিপদের আশঙ্কা থাকে না।
গোবিন্দ। সে ভাবনা আর তোমাদিগকে ভাবিতে হইবে। আমার কাৰ্য শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব। যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি সেই সকল পত্র গ্রহণ করিব, সেই কাৰ্য্য শেষ করিতে অধিক বিলম্বও হইবে না। সেই পত্রগুলি একবার উত্তমরূপে পড়িয়া লইতে বোধ হয়, অর্ধ ঘণ্টার অধিক সময় লাগিবে না। অর্ধঘণ্টার মধ্যেই আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব।
পিয়ন। তাহা হইলে আপনার যে সকল পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা সেই পিয়নের ন্যায় আমরাও আপনাকে প্রদান করিব। কিন্তু সাবধান! সঙ্গে সঙ্গে পত্রগুলি বিনষ্ট করিয়া ফেলিবেন।
গোবিন্দ। তাহার আর কোনরূপ সন্দেহ আছে? আমার কাৰ্য শেষ হইবামাত্রই আমি উহা নষ্ট করিয়া ফেলিব। তুমি এই বিষয় অপর পিয়নকেও বলিয়া দিও। বিলি করিবার নিমিত্ত পত্র পাইলেই প্রথমতঃ পত্র গুলি আমাকে দেখাইয়া লইয়া যাইও। উহার মধ্যে যে কোন পত্র আমি লইবার প্রয়োজন বিবেচনা করিব, তাহা লইয়া, তখন আমি প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত, চারি আনা হিসাবে প্রদান করিব।
গোবিন্দের কথায় পিয়ন সম্মত হইল, এবং সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, সমস্ত কথা অপরাপর পিয়নকেও বলিয়া দিল। সেই দিবস হইতেই বিলি করিবার নিমিত্ত উঁহারা যে সকল পত্র ডাকঘর হইতে প্রাপ্ত হইত, তাহার একখানিও বিলি
করিয়া, সর্বপ্রথমে সেই পত্রগুলি লইয়া গোবিন্দের নিকট গিয়া উপস্থিত হইত। উহার মধ্য হইতে যদি কোন পত্র গোবিন্দ গ্রহণ করিত, তাহা হইলে তাহাদের প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত চারি আনা হিসাবে গ্রহণ করিয়া অবশিষ্ট পত্রগুলি যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্যক, সেই সেই স্থানে বিলি করিত।
গোবিন্দ যে কেন এইরূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করিত, তাহার কিছু অর্থ পাঠকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন কি? যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমি আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতেছি।
কলিকাতা সহর আজকাল ঔষধের বিজ্ঞাপনে পরিপূর্ণ। ইহার মধ্যে সকলই যে নিতান্ত অসার ঔষধ, তাহা নহে; তাহার মধ্যে কতকগুলি ঔষধ ভাল বলিয়া লোকে অবগত আছে, এবং সেই সকল ঔষধ একরূপ বিক্রয়ও হইয়া থাকে। পাঠকগণ ইহাও অবগত আছেন যে, মফঃস্বলের লোকই সেই সকল ঔষধ অধিক পরিমাণে ক্রয় করিয়া থাকেন। আরও অবগত আছেন, যে নামে ও ঠিকানায় সেই সকল ঔষধের বিজ্ঞাপন বাহির হয়, সেই সকল নামে ও ঠিকানায় মফঃস্বলের গ্রাহকগণ সেই সকল ঔষধ ভেলুপেয়েবল পোষ্টে পাঠাইবার নিমিত্ত অনুবোধ করিয়া পত্র লিখিয়া থাকেন।
যে সকল পত্রে উক্তরূপে ঔষধ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত লেখা থাকিত, গোবিন্দচন্দ্র সেই সকল পত্র অন্যান্য পত্রের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া প্রত্যহ দুই চারিখানি গ্রহণ করিত, এবং মফঃস্বল বাসী সেই সকল নিরীহ পোকদিগের নামে সেই ঔষধ বলিয়া অন্য কিছু ভেলুপেয়েবল ডাকে পাঠাইয়া দিয়া তাহার যথেষ্ট মূল্য আদায় করিয়া লইত। বলা বাহুল্য, যিনি প্রকৃত মূল্য দিয়া সেই ঔষধ গ্রহণ করিতেন, তাহার রীতিমত অর্থ ব্যয় হইত; কিন্তু ঔষধের উপকার কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইতেন না। সুতরাং অর্থ নষ্টই হইত মাত্র। এইরূপে গোবিন্দচন্দ্র মফঃস্বলবাসী অনেক লোকের সর্বনাশ করিয়া অনেক অর্থ উপার্জন করিয়াছে, এবং এখনও সময় সময় কিছু কিছু করিতেছে।
তিন চারি বৎসর অতীত হইল, এই জুয়াচুরি-কাণ্ড আমা কর্তৃক প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং অপরের পত্র চুরি করা অপরাধে কয়েকজন পিয়নকেও শ্রীঘরে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সেই জুয়াচুরি কলিকাতা সহর হইতে যে একবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে, তাহা পাঠকগণ মনে করিবেন না। বিশেষতঃ যে সকল মফঃস্বলের লোক ভেলুপেয়েবল পোষ্টে ঔষধাদি গ্রহণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা একটু বিশেষ সতর্ক হইবেন, ইহাই এই প্রবন্ধ-লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য; এবং তজ্জন্যই এই ঘটনা-বৰ্ণনার অবতারণা।
.
(খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।
যেরূপ ভাবে চিঠি লইয়া পূর্ব্ব-বর্ণিত জুয়াচুরি হইয়া থাকে, হুণ্ডির জুয়াচুরি তাহা অপেক্ষা অধিক ভয়ানক। কিরূপ ভাবে হুণ্ডির জুয়াচুরি হয়, তাহা পাঠকগণকে বলিবার পূর্বে হুণ্ডি যে কি, তাহা বোধ হয়, অনেক পাঠককে বুঝাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন হইবে। হুণ্ডি একরূপ বরাতচিঠি মাত্র। মনে করুন, আপনার এলাহাবাদে একটা ব্যবসার স্থান আছে, এবং কলিকাতাতেও একটা স্থান আছে। অপর এক ব্যক্তির এলাহাবাদ হইতে দুই হাজার টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইবে। মনি-অর্ডার বা অপর কোন উপায়ে সেই টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইলে, কিছু অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে। কিন্তু ইণ্ডির দ্বারা পাঠাইতে হইলে ব্যয় অপেক্ষাকৃত অনেক অল্প হয়। এই নিমিত্ত যে দুই হাজার টাকা তাহার কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার প্রয়োজন, সেই টাকা লইয়া গিয়া তিনি আপনার এলাহাবাদস্থিত গদিতে জমা করিয়া দিলেন, এবং নিয়মিত কমিশনও প্রদান করিলেন। সেই টাকা গ্রহণ করিয়া, আপনি আপনার কলি কাতার গদির নামে একখানি হুণ্ডি লিখিয়া তাহার হস্তে প্রদান করিলেন। আপনি যেমন তাহাকে এলাহাবাদে হুণ্ডি প্রদান করিলেন, অমনি আপনি এই সংবাদ আপনার কলি কাতার গদিতে লিখিয়া পাঠাইলেন। এদিকে যাহার নিকট টাকা পাঠাইবার প্রয়োজন, তাহার নামীয় একখানি পত্রের ভিতর সেই হুণ্ডিখানি তিনি পূরিয়া তাহার নামে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন। যাহার নামে সেই হুণ্ডিখানি:আসিল, তিনি সেই হুণ্ডিসহ আপনার কলিকাতার গদিতে গমন করিবামাত্র হুণ্ডির লেখা অনুযায়ী টাকা গুলি তিনি প্রাপ্ত হইলেন। হুণ্ডি সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বলিবার আছে; কিন্তু এস্থানে মোটামুটি যাহা বলা হইল, তাহাতেই পাঠকগণ, আলোচ্য ঘটনার অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন।
যাহা হউক, কিরূপ ভাবে সেই হুণ্ডি সম্বন্ধে নিত্য জুয়াচুরি হইতেছে, তাহাই এখন পাঠকবর্গকে বলিব।
গোবিন্দচন্দ্র যেরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়া ডাকপিয়নের যোগে জুয়াচুরি ব্যবসা চালাইয়া আসিতেছিল, বড়বাজারের ভিতর সেই প্রকার কয়েকজন লোক আছে, তাঁহারা প্রায় হুণ্ডির জুয়াচুরি ব্যবসা করিয়া, আপন আপন সংসার প্রতিপালন ও বাবুগিরি করিয়া থাকে, মধ্যে মধ্যে জেলে গিয়াও বাস করিয়া থাকে।
বড়বাজার অঞ্চলে যে সকল পিয়ন পত্র বিলি করিয়া থাকে, সেই সকল পিয়নের সহিত উঁহাদিগের প্রণয় অধিক। কারণ, এমন দিনই নাই, যে দিবস সেই অঞ্চলে শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি না হয়। গোবিন্দচন্দ্র যেমন সামান্য চারি আনা দিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করে, ইহারা পিয়নদিগকে সেইরূপ ভাবে সামান্য অর্থ প্রদান করে না। গোবিন্দের লভ্য অংশের সহিত তুলনায় ইহাদিগের লভ্য অংশ অনেক অধিক। সুতরাং ইহা দিগের সহিত যে সকল পিয়ন মিলিত আছে, তাহাদিগের উপার্জনও অনেক অধিক।
যে পিয়নের সহিত উঁহাদিগের পরামর্শ আছে, সে বিলি করিবার নিমিত্ত ডাকঘর হইতে পত্র পাইবার পরই, একটা নির্দিষ্ট স্থানে গমন করে। সেই স্থানে তাহাদিগের দলস্থিত কোন
কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাহার হস্তে সেই পিয়ন তাহার নিজের নির্বাচন অনুসারে দুই একখানি পত্ৰ দিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।
যাহার হস্ত দিয়া প্রত্যহ শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি হয়, তাহার হস্তে হুণ্ডি-পূরিত ধাম আসিয়া উপস্থিত হইলেই, সে অনায়াসেই অনেকটা উপলব্ধি করিয়া লইতে পারে যে, ইহার ভিতর হুণ্ডি আছে, কি না। সুতরাং সেইরূপ ভাবের দুই তিনখানি পত্র বাছিয়া লইয়া পূর্বোক্ত দলস্থিত কোন ব্যক্তির হস্তে প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। পিয়ন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, সেই ব্যক্তি সেই পত্র গুলি সবিশেষ সতর্কতার সহিত খুলিয়া দেখে যে, উহার ভিতর প্রকৃতই হুণ্ডি আছে কি না, এবং যদি হুণ্ডি থাকে, তাহা হইলে যে গদি হইতে উহার টাকা আনিতে হইবে, সেই স্থান হইতে সেই টাকা সহজেই প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা কি না। এ সকল বিষয় বিবেচনা করা, আমাদিগের পক্ষে যেরূপ দুরূহ বলিয়া অনুমান কইতেছে, উঁহাদিগের পক্ষে কিন্তু সেরূপ নহে। কারণ, বড় বাজারের ভিতর যত মহাজনের হুণ্ডির কারবার আছে, তাহাদের সমস্তই তাঁহারা অবগত আছে, এবং কাহার গদিতে তাহাদিগের পরিচিত লোক আছে, ও কাহার গদি হইতে সহজেই সেই টাকা বাহির হইবার সম্ভাবনা, তাহাও তাঁহারা অনায়াসেই বুঝিতে পারে। পিয়ন প্রদত্ত পত্র খুলিয়া যদি তাহার ভিতর তাহাদিগের মনের মত হুণ্ডি প্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে তাহা উঁহারা গ্রহণ করিয়া সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলে। অন্যথা সেই সকল পত্র পূর্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া পরিশেষে সেই পিয়নের হস্তেই প্রত্যর্পণ করে। তৎপরে পিয়নও সেই পত্র গুলি যথাস্থানে বিলি করিয়া দেয়।
পূৰ্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি বাছিয়া লইতে পারিলেই, তাহাদিগের একমাস বা সময় সময় দুই তিনমাসের কার্য্য হইয়া যায়। সুতরাং সেই সময়ের মধ্যে তাহাদিগকে সেইরূপ কার্যে আর হস্তক্ষেপ করিতে হয় না।
পূর্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি তাহাদিগের হস্তগত হইলে সেই হুণ্ডি যে কত টাকার, কেবল যে তাহাই তাহার অবগত হইতে পারে, তাহা নহে। কারণ, সেই হুণ্ডির সহিত বে পুত্ৰ থাকে, তাহা পড়িয়া উহা কে পাঠাইতেছে, কোথা হইতে আসিতেছে, কোন্ স্থানে ও কয়দিবস পরে ইহার টাকা পাওয়া যাইবে, তাহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া সেই দলস্থিত একটা লোক সেই হুণ্ডিসহ সেই গদিতে গিয়া উপস্থিত হয়। পরে সেই জুণ্ডি সেই স্থানে প্রদান করিলে, তথাকার নিয়ম অনুযায়ী যে টাকা পাইবার কথা, তাহা অনায়াসেই পাইয়া থাকে। এইরূপ উপায়ে একখানি হুণ্ডির টাকা প্রাপ্ত হইতে পারিলে, তাহাদিগের মনো বা উত্তমরূপে পূর্ণ হইয়া থাকে। কারণ, এক একখানি হুণ্ডিতে সময় সময় দশ হাজার পর্যন্ত টাকাও পাওয়া যায়। এইরূপে অসৎ উপায়ে জুয়াচোরগণ যে টাকা বাহির করিয়া লয়, তাহা তাহাদিগের মধ্যে নিয়ম অনুসারে সকলে মিলিয়া বণ্টন করিয়া লয়। ডাকঘরের পিয়নের অংশ, প্রায় অপর সকলের অংশ হইতে অধিক পরিমাণে হইয়া থাকে। এইরূপে একখানি হুণ্ডির টাকা তাহার হস্তগত করিলে পর, কিছু দিবস পৰ্য্যন্ত আর এরূপ কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করে না। যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে হুণ্ডি পাঠাইয়াছেন, যখন তিনি জানিতে পারেন, তাঁহার মুণ্ডির টাকা বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ যাহার পাইবার কথা, তিনি পান নাই, তখন ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়, এবং ক্রমে এই জুয়াচুরির বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে। কিন্তু প্রায়ই প্রকৃত দোষী ধরা পড়ে না। এইরূপে হুণ্ডির জুয়াচোর কয়েকজন, কয়েকজন পিয়নের সহিত কয়েকবার আমা কর্তৃক ধৃত হয়, এবং দীর্ঘকালের নিমিত্ত কারা বাসে প্রেরিত হইয়াছে; কিন্তু অদ্যাপিও এই জুয়াচুরি বন্ধ হয় নাই।
.
নিলামে জুয়াচুরি।
মফঃস্বলবাসী প্রায় সমস্ত লোকেরই বিশ্বাস যে, সময় সময় কলিকাতায় নিলামে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে অনেক মাল বিক্রীত হইয়া থাকে। বাস্তবিক সময়ে সময়ে কোন কোন দ্রব্য নিলামে প্রকৃতই সুলভ মূল্যে বিক্রীত হয়!
জুয়াচুরিই যাহাদিগের ব্যবসা, তাঁহারা কি উপায়ে লোক ঠকাইতে পারিবে, রাত্রিদিন কেবল সেই চিন্তাতেই ঘূরিয়া বেড়ায়। সুলভ মূল্যে নিলামে মাল বিক্রয় হয়, ইহাই মফঃস্বলবাসীগণের বিশ্বাস। এই কথা যেমন জুয়াচোরগণ জানিতে পারিল, অমনি তাঁহারা সহরের মোড়ে মোড়ে এক একটী নিলামের দোকান খুলিয়া বসিল। এইরূপ নিলামের দোকান সহরের মধ্যে এক সময় অনেক গুলি স্থাপিত হইয়াছিল; আজকাল যে সে সমস্ত গুলি একবারে অন্তর্হিত হইয়াছে, তাহা নহে। এই সহরের স্থানে স্থানে এখনও সেইরূপ এক একটী নিলামের দোকান বর্তমান আছে, এবং প্রায়ই তাঁহারা মফঃস্বলবাসী কোন ব্যক্তিকে দেখিতে পাইলে, তাহার নিকট হইতে কিছু না কিছু গ্রহণ করিয়া থাকে। উঁহাদিগের কার্যপ্রণালী এইরূপ;–
রাস্তার ধারে একটা দোকানের মধ্যে অনেকরূপ উত্তম উত্তম দ্রব্যাদি সজ্জিত থাকে। সেই দোকানের সম্মুখে একজন বসিয়া অনবরত ঘণ্টাধ্বনি করিতেছে। দোকানের মধ্যে এক ব্যক্তি সেই সকল দ্রব্যের মধ্যস্থিত কোন একটা দ্রব্য হস্তে লইয়া অপরে যে মূল্য বলিয়াছে, সেই মূল্য বারে বারে উচ্চারণ করিয়া উহার মূল্য-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছে। অর্থাৎ একজন কহিল, এক টাকা যে ব্যক্তি সেই দ্রব্য বিক্রয় করিতে বসিয়াছে, সে উহার দাম এক টাকা এক টাকা বলিয়া, যে পর্যন্ত অপর কোন ব্যক্তি উহার অধিক দাম না বলিল, সেই পৰ্য্যন্ত অনবরত সেইরূপেই চীৎকার করিতে লাগিল। অপর কোন ব্যক্তি যেমন তাহার দাম কিছু বাড়াইয়া বলিল, বিক্রেতার সুরও সেইরূপ পরি বর্তিত হইল। এইরূপে যাহার দরের উপর অপর আর কেহ অধিক দাম প্রদান করিতে স্বীকৃত না হয়, সেই দ্রব্য তখন সেই ব্যক্তি তাহার কথিত মূল্যেই পাইয়া থাকে। ইহাই নিলামের পদ্ধতি। কিন্তু এ নিলাম সেই প্রকারের হইলেও, ইহার উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র। এই স্থানে প্রকৃত ক্রেতা একজনও নাই, ক্রেতারূপে যে সকল ব্যক্তি দোকানের ভিতর দাঁড়াইয়া বিক্রেয় দ্রব্যের দাম বর্ধিত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাঁহারা সকলেই একদল-ভুক্ত-জুয়াচোর, কেহবা জুয়াচোরের চাকর। উঁহারা যেমন দেখিল, একজন পল্লীগ্রাম-নিবাসী নিরীহ লোক সেই দোকানের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে, অমনি তাঁহারা চীংকারস্বরে নিলাম আরম্ভ করিয়া দিল। সেই আগন্তুক ব্যক্তি নিলামের প্রলোভনে ভুলিয়া যেমন দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি দেখিতে পাইল, একটী লোক প্রয়োজনীয় দ্রব্য—যাহার দাম পাঁচ টাকার কম নহে, তাহা পচ পয়সায় বিক্রয় করিতে বসিয়াছে। এক ব্যক্তি ডাকিল, ছয় পয়সা, অপরে কহিল, নয় পয়সা আগন্তুক ডাকিল, দশ পয়সা। তাহার পর হয় ত আর কেহই ডাকিল না, যদি ডাকিল, কেবল উহার দাম আর এক পয়সা বাড়াইয়া দিল। সেই ব্যক্তি যেমন বার পয়সা ডাকিল, অমনি সকলে চুপ করিল। সুতরাং সেই দ্রব্য যিনি সৰ্বশেষে ডাকিয়াছেন, তাহারই হইল। আগন্তুক সবিশেষ হৃষ্ট অন্তঃকরণে সেই দ্রব্যটী আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া তাহার ব্যাগ হইতে বারটা পয়সা বাহির করিয়া দিল। ব্যাগ হইতে সেই পয়সা বাহির করিবার কালীন জুয়াচোরগণ দেখিয়া লইল, তাহার নিকট আর কত গুলি টাকা আছে। তাহার পরই উহার সহিত গোলযোগ আরম্ভ করিল, যদি উহার নিকট আর সাত টাকা থাকে, তাহা হইলে সেই দ্রব্য-বিক্রেতা বলিয়া উঠিল, কি মহাশয়! কেবল পয়সা বারটী দিলেন, টাকা কয়েকটা দিলেন না? আগন্তুক বিস্মিত হইয়া কহিল, সে কি মহাশয়। টাকা কিসের? উত্তরে বিক্রেতা কহিল, কেন, ওই দ্রব্য যে আট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়া গেল। আপনি কি ভাবি তেছেন যে, কেবল তিন আনায় আপনি ওই দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন? দোকানদারের এই কথা শুনিয়া, আগন্তুক একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িল। দেখিল, ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণও সেই দোকানদারে কথা সমর্থন করিয়া কহিল, দোকানদার মহাশয় যাহা কহিতেছেন, তাহা প্রকৃত। ওই দ্রব্যের বিট প্রথমেই আটটাকা হইতে আরম্ভ হইয়া আট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়াছে।
এই কথা শুনিয়া আগন্তুক চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং উঁহাদিগের সকলের ভাব-গতি দেখিয়া অনন্যোপায় হইয়া সেই দ্রব্য গ্রহণ করিতে অসম্মত হই; কিন্তু যখন দেখিল, সেই দ্রব্য গ্রহণ না করিলে তাহার আর উপায় নাই, তখন তাহার নিকট যে সাত টাকা ছিল, তাহা প্রদান করিয়া পরিশেষে অব্যাহতি পাইল। আর যদি সে একটু উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া সেই টাকা প্রদান করিতে অসম্মত হইলে, তাহা হইল সেই দোকানের সমস্ত লোক একত্র হইয়া বল-পূৰ্ব্বক তাহার নিকট যে কিছু অর্থ পাইল, তাহা কাড়িয়া লইয়া তাহাকে সেই স্থান হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিল। অনন্যোপায় হইয়া সে তখন আস্তে আস্তে আপন দেশ অভিমুখে প্রস্থান করিল। আর এইরূপে ঠকিয়া কোন ব্যক্তি যদি কলিকাতাবাসী কোন লোকের পরামর্শ মত থানায় গিয়া নালিশ করিলেন, তাহা হইলে পুলিস-কর্ম্মচারীও তাহার অভিযোগ শ্রবণ করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন বটে; কিন্তু কাৰ্যে কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই পল্লীগ্রাম-নিবাসী লোকটীর সপক্ষে একটীমাত্র ও প্রমাণ সংগৃহীত হইল না। অধিকন্তু জুয়াচোরগণ এক মিলিত হইয়া সেই নিলাম-কার জুয়াচোরের পক্ষ সমর্থন করিয়া, ফরিয়াদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল, ও ইহাই প্রতিপন্ন করিয়া দিল যে, দোকানদারের কিছুমাত্র অপরাধ নাই; সমস্ত দোষই সেই মফঃস্বল-বাসীর।
এইরূপে কত নিরীহ মফঃস্বলবাসী-লোক সুলভ মূল্যে নিলামে দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে গিয়া নিত্য যে কত জুয়াচোরের হস্তে পড়িতে ছেন, তাহার আর সংখ্যা নাই।
ইহা ব্যতীত মফঃস্বলবাসীগণকে ঠকাইয়া লইবার নিমিত্ত কোন কোন জুয়াচার নিলামের ন্যায় আর এক প্রকার জুয়াচুরির দোকান খুলিয়া বসিয়া আছে, এবং দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া নিত্য কত লোককে যে ঠকাইতেছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। এই দোকানও নিলামের দোকান-সদৃশ; দোকানের সম্মুখে নিলামের ন্যায় ঘন্টা বাজিয়া থাকে। সেই দোকানে নিলাম হইতেছে ভাবিয়া, মফঃস্বলবাসীগণ প্রায়ই সেই দোকানে প্রবেশ করিয়া থাকেন। সেই দোকানের মধ্যভাগে পাতিত একটা টেবিলের উপর বা দোকানের মধ্যস্থিত গ্লাসকেসের মধ্যে নানা প্রকারের বহুমূল্য দ্রব্য সকল সাজান আছে। উঁহাদিগের কোন দ্রব্যেরই দাম পচিশ টাকার কম নহে, বরং একশত দুইশত টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। সেই সকল দ্রব্যের প্রত্যেকগুলিরই উপর কাগজের টিকিটে একটী একটী নম্বর লেখা আছে। যিনি দোকানের অধিকারী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন, তাহার সম্মুখে একটী খোলা বাক্সের মধ্যে কতকগুলি সাদা কার্ড আছে, উহাতেও একটী একটী নম্বর লেখা আছে। তাহার সম্মুখে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত নিলামের দোকানের ন্যায় সেই দলের অপর কতকগুলি জুয়াচোর ক্রেতারূপে দণ্ডায়মান হয়। ইহাদিগের মধ্যে আছে-এমন জাতিই নাই। সাহেব আছেন, ইহুদি আছেন, মুসলমান আছেন, বাঙ্গালি আছেন, এক কথায় অনেক জাতির অনেক লোক সেই স্থানে এরূপ ভাবে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাহাদিগের অবস্থা বা চালচলন দেখিয়া, তাহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া, কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারেন না যে, উহার জুয়াচোর।
আগন্তুক দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্রই একজন নিজের পকেট হইতে একটী টাকা বাহির করিয়া সেই দোকানদারের হস্তে প্রদান করিল। দোকানদার তাহার সম্মুখস্থিত সেই খোলা কার্ডের বাক্সটী দেখাইয়া দিয়া কহিল, উহার ভিতর হইতে আপনি একখানি কার্ড বা টিকিট গ্রহণ করুন। তিনি তাহার ভিতর হইতে একখানি টিকিট গ্রহণ করিয়া সেই দোকানদারের হতে প্রদান করিলেন। দোকানদার সেই টিকিটের দিকে একবার লক্ষ্য করিয়া কহিল, আপনার টিকিটের নম্বর এক হাজার দুইশত দুই। এই নম্বর সংযুক্ত যে দ্রব্য এই দোকানে সাজান আছে, তাহা আপনার। এই কথা শুনিয়া তিনি দোকানের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে লাগিলেন, কোন্ দ্রব্যের উপর এক হাজার দুইশত দুই নম্বর আছে। অমনি দোকানদারের আর একজন সাহায্যকারী সেই টেবিলের উপর হইতে একটা সুবর্ণ-নির্মিত একটী ঘড়ি বাহির করিয়া দিল ও কহিল, ইহাই এক হাজার দুইশত দুই নম্বরের দ্রব্য। এই কথা বলিয়া সেই ঘড়িটী তাহার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, আপনার অদৃষ্ট খুব ভাল, এক টাকায় আপনি দুইশত টাকা মূল্যের ঘড়িটা পাইলেন।
ইহার পরই আর একজন আর একটা টাকা দিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিল। সেও একখানি বড়গোছের গেলাস বা আয়না পাইল; তাহার মূল্যও চল্লিশ টাকার কম নহে।
আগন্তুক ব্যক্তি ইহা দেখিয়া, এবং মধ্যে মধ্যে ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণের প্রলোভন-যুক্ত বাক্য শুনিয়া তিনিও একটী টাকা বাহির করিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি মূল্যবান্ দ্রব্যের পরিবর্তে এক পয়সা মূল্যের একটা পেসিল পাইলেন। জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া পুনরায় আর একটী টাকা বাহির করিলেন, সে বারে-পাইলেন এক বাণ্ডিল সুচি। তাহার নিকট আঠারটী টাকা ছিল, এইরূপে তাহার অনিচ্ছাসত্বে, অথচ জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া ক্রমে ক্রমে তিনি তাহার সেই আঠার টাকাই সেই স্থানে অর্পণ করিলেন; কিন্তু তাহার পরিবর্তে তিনি আঠার পয়সা মূল্যের দ্রব্য পাইলেন কি না, সন্দেহ। যে দোকানে এইরূপ কাণ্ড সকল অহরহ চলিতেছে, জুয়াচোরগণ সেই দোকানের নাম দিয়াছে–মনোরম সখের বাজার। (Fancy Bazar.)।
এইরূপে মফঃস্বলের কত লোক কলিকাতায় আসিয়া যে জুয়া চোরগণের হস্তে পতিত হইতেছে, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে।
.
বিবাহে জুয়াচুরি।
আজকাল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণের মধ্যে কন্যার বিবাহ যে কি ভয়ানক ব্যাপার হইয়া দাড়াইয়াছে, তাহা আমার সবিশেষ করিয়া বর্ণন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কারণ, পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে সবিশেষরূপে ভুক্ত-ভোগী।
একটী কন্যার বিবাহ দিতে হইলে সময় সময় কন্যা-কর্তাকে তাহার ভদ্রাসন বাটী পৰ্যন্ত বিক্রয় করিতে হয়। সমাজের এরূপ অবস্থা যে পূর্বাপর ছিল, তাহা নহে; পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যে ইহা আমাদিগের দেশে প্রচারিত হইতেছে, তাহা কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্যগণের কন্যার বিবাহে একটী পন্থসামাত্রও ব্যয় নাই, ইহা যখন সৰ্ব্ব-বিদিত, তখন পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কেন এরূপ প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত হইল, ইহাই আশ্চর্য্য!
যাহারা পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত, তাঁহার সেইরূপ বা ততোধিক শিক্ষিত ব্যক্তির হস্তে তাহাদিগের কন্যাগণকে প্রদান করিতে যত্নশীল হন। সুতরাং যে সকল বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত হন, সেই সকল বালকের উপরই তাহাদিগের প্রধান লক্ষ্য হয়। এইরূপে দুই চারিজনের লক্ষ্য একটী বালকের উপর পতিত হইলেই সেই বালকের পিতা মাতাও সেই সুযোেগ অবলম্বন করিয়া আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় অর্থের প্রতিযোগিতা ভিন্ন কেহই সেই বালককে হস্তগত করিতে পারেন না। এই সকল কারণেই যে বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেরূপ উচ্চ পদবী প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার বিবাহে সেইরূপ পরিমাণে অর্থ গ্রহণ করা হইয়া থাকে। এইরূপ অবস্থা হইতেই ক্রমে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকল বালকেরই প্রায় একরূপ মূল্য (?) স্থির হইয়া পড়িয়াছে, এবং সময় সময় ইহার মধ্যে অনেক প্রকার জুয়াচুরি হইতেও আরম্ভ হইয়াছে। এ সম্বন্ধে পাত্র ও কন্যা উভয় পক্ষেরই একটা একটী জুয়াচুরির বিষয়, পাঠকগণকে সতর্ক করিবার নিমিত্ত নিম্নে বর্ণিত হইল।
(ক) কন্যাপক্ষের জুয়াচুরি।
কন্যার পিতা রামরতন, এই কলিকাতার একজন গৃহস্থ। টাকা-কড়ি অধিক নাই, কোনরূপে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিয়া থাকেন মাত্র। নিজের একখানি বাড়ী আছে, তাহার কন্যার বয়ঃক্রম প্রায় বার বৎসর হইল; কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার বিবাহের কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। অথচ তাহার ইচ্ছা যে, একটী শিক্ষিত, বা পিতামাতার কিছু সংস্থান আছে, এরূপ একটী পাত্রের হস্তে তাহাকে অর্পণ করেন। তিনি অনেক দিবস পর্যন্ত এইরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া নিতান্ত জালাতন হইয়া পড়িয়াছিলেন। কারণ, সুবিধা মত সেরূপ পাত্র তিনি জুটাইতে পারিতেছিলেন না। যদিও দুই একটীর সন্ধান পাইতেছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে তাহার পিতামাতার নিকট তিনি অগ্রসর হইতে সমর্থ হইতেছিলেন না। সেইরূপ পাত্রের পিতা মাতার নিকট গমন করিয়া বিবাহের কথা পাড়িতেন সত্য; কিন্তু টাকার ফর্দ দেখিয়া আস্তে আস্তে তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতেন। পাত্রের পিতামাতা যে পরিমিত অর্থ প্রার্থনা করিতেন, তাহার ভদ্রাসন বাটী পৰ্যন্ত বিক্রয় করিয়া দিলেও, তাহাতে কুলাইত না।
রামরতন যখন বুঝিতে পারিলেন, সৎপথ অবলম্বন করিয়া কোনরূপেই আপন কন্যার নিমিত্ত পাত্রের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না, তখন অসৎপথ অবলম্বন করিতেও তিনি আর কোনরূপে কুণ্ঠিত না হইয়া একটা ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
এইরূপে দিন কয়েক অনুসন্ধানের পর, তিনি জানিতে পারি লেন যে, তিনি যেরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহা অপেক্ষাও একটী উৎকৃষ্ট পাত্র এক স্থানে আছে; কিন্তু সেই পাত্রের পিতামাতা যেরূপ ভাবে অলঙ্কার-পত্র প্রার্থনা করিয়া থাকেন, তাহাতে কোন পাত্রীরই পিতামাতা সেই অলঙ্কারাদি দিতে স্বীকৃত হইতে পারেন না। সেই জন্যই আজ পৰ্য্যন্ত তাহার বিবাহ হয় নাই।
রামরতন এই সংবাদ পাইয়া সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহার কন্যার বিবাহের কথার উল্লেখ করিয়া কহিলেন, আমি শুনি আছি, আপনি আপনার পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত একটী সুরূপা পাত্রীর অনুসন্ধান করিতেছেন। আমার একটী কন্যা আছে, আমার ইচ্ছ, আমি আমার সেই কন্যাটীকে আপনার পুত্রের হস্তে প্রদান করি।
পিতা। উত্তম কথা। আপনার কন্যাটী কেমন? কারণ, আমি সুরূপা কন্যা না পাইলে, আমার পুত্রের বিবাহ দিতে অভিলাষী নহি।
রামরতন। একথা আমি পূৰ্বেই শুনিয়াছি। তাই আমি সাহস করিয়া আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। পিতার নিকট তাহার কন্যামাত্রই সুশ্রী; আমার মেয়ে ভাল একথা সকলেই বলিয়া থাকেন। অতএব আপনি আমার কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন, তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কন্যা আপনার পুত্রের উপযুক্ত কি না?
পিতা। দেখুন মহাশয়! কন্যা দেখিতে দেখিতে আমি জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছি। সকলেই আসিয়া বলেন, তাঁহার কন্যা খুব সুশ্রী; কিন্তু যখন দেখিতে যাই, তখন দেখি তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এইরূপে এ পর্যন্ত আমি যত কন্যা দেখিয়াছি; তাহাদের একটীও প্রায় আমার মনোমত হয় নাই। দুই একটী যাহা মনোমত হয়, তাহার পিতামাতা আমার পুত্রের উপযুক্ত অর্থ প্রদান করিতে চাহেন না। এত ব্যয় করিয়া আমি আমার পুত্রের লেখা পড়া শিখাইয়াছি, সে এবার বি-এ, পাস করিয়া এম-এ, পড়িতেছে। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতা শহরে আমার এত বড় বাড়ী, চাকরী না করিলেও রাজার হালে তাহার দিন অতিবাহিত হইবে। এরূপ পাত্রের হস্তে কন্যা দান করা কি যাহার তাহার অদৃষ্টে ঘটিয়া উঠে? কন্যার যে কখনই কষ্ট হইবে না, রাণীর মত সে দিন অতিবাহিত করিতে পারিবে, ইহা কি কন্যার পিতামাতার কম আনন্দের বিষয়? এরূপ অবস্থা অবগত হইয়াও তাঁহারা কিছুমাত্র খরচ করিয়া কন্যা দান করিতে চাহেন না, ইহা কি কম দুঃখের বিষয়!
রামরতন। আপনার কথা প্রকৃত; কিন্তু সকলে কি অর্থের সংকুলান করিয়া উঠিতে পারে?
পিতা। আমি কাহারও নিকট এরূপ অধিক অর্থ চাহি নাই যে, তিনি তাহা দিতে না পারেন। মূল কথা, আজকাল সকলেই ফাকি দিয়া আপন আপন কাৰ্য উদ্ধার করিতে চাহেন। তাহ কি কখন হয়? কিছু খরচ না করিলে, বড় মানুষের বাড়ীতে কি কন্যার বিবাহ দেওয়া যায়?
রামরতন। আপনি কত টাকা প্রার্থনা করিয়াছিলেন?
পিতা। অতি সামান্য। আমি নগদ এক পয়সাও চাহি নাই, তবে কি না, বিবাহে আমাকে যে কিছু সামান্য খরচ করিতে হইবে, তাহা আমি আপন ঘর হইতে করিব কেন? কেবল মাত্র সেই খরচের টাকাটা প্রদান করিলেই হইতে পারিত। তবে গহনা, তাহা ত তাহার কন্যারই থাকিবে।
রামরতন। খরচের নিমিত্ত কত টাকা হইলে হইতে পারে? পি। চারি হাজার টাকার অধিক নহে। রামরতন। অলঙ্কার বলিয়া কি দিতে হইবে?
পিতা। আমি হীরামতি চাহিতেছি না। কন্যাটীর গাত্রে যাহা কিছু সোণার অলঙ্কার পরিবে, তাহার সমস্তই দিতে হইবে।
রামরতন। কত ভরি সোণা হইলে সেই সমস্ত গহনা প্রস্তুত হইতে পারে?
পিতা। অধিক নহে। বোধ হয়, তিনশত ভরি সোেণা হইলেই সকল গহনা হইয়া যাইবে।
রামরতন। মহাশয়! আমি আপনার মনোভাব কতক পরিমাণে অবগত হইলাম। এখন আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া একবার আমার কন্যাটীকে অগ্রে স্বচক্ষে দর্শন করুন। কন্যাটী দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে তখন দেনা পাওনার বন্দোবস্ত করিব; কিন্তু আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহার মধ্যে কোন কোন বিষয় কিছু কিছু বিবেচনা করিতে হইবে।
পিতা? আপনি কি করিয়া থাকেন? রামতন। সামান্য চাকরী। পিতা। সামান্য চাকরী করিয়া আপনি কিরূপে এত টাকা প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন?
রামরতন। সে ভাবনা আমার। যে ব্যক্তি সামান্য চাকরী করে, তাহার কি পৈত্রিক বা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত কোন রূপ অর্থ থাকিতে নাই?
পিতা। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য প্রাতঃকালে এখানে আগমন করিবেন। আপনার সহিত গমন করিয়া আমি আপনার কন্যাটীকে দেখিয়া আসি।
পাত্রের পিতার কথা শুনিয়া রামরতন বাবু তাহাতে সম্মত হইলেন, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে তিনি আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এইরূপ স্থির করিয়া সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
রামরতন বাবুর কন্যাটী বেশ সুরূপা। এই নিমিত্তই তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, কোন বড়লোক তাহার কন্যাটী পাইলে অর্থ না চাহিয়াই তাহাকে গ্রহণ করিবে। এই নিমিত্তই তিনি ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, একটী ভাল পাত্র পাইলে, তাহার নিমিত্ত তিনি সর্বপ্রকারে দুই তিন সহস্র পর্যন্ত টাকা প্রদান করিবেন। এই টাকা যে তিনি সহজে অর্পণ করিতে পারিবেন তাহা নহে, তাহার নিমিত্ত তাহাকে ঋণ-জালে আবদ্ধ হইতে হইবে।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে রামরতন বাবু সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহার পিতাকে সঙ্গে করিয়া আপন বাড়ীতে আনিলেন। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ পূর্ব্ব হইতেই কন্যাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন। গাত্রের পিতার সহিত আরও দুই তিন জন লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই কন্যাটীকে উত্তম রূপে দেখিলেন, কন্যা দেখিয়া সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন, সকলেরই মনোমত হইল। তাহার মধ্যে একজন প্রকাশ্যে পাত্রের পিতাকে বলিয়াও ফেলিলেন, আমরা আপনার পুত্রের নিমিত্ত এ পর্যন্ত যত পাত্রী দেখিয়াছি, তাহার মধ্যে একটী ও এরূপ সুশ্রী নহে। এই পাত্রীটীর সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিতে হইবেই হইবে। আপনি অর্থের নিমিত্ত এই পাত্রীকে যেন কোন রূপেই হস্তান্তর করিবেন না।
কন্যা দেখা সমাপ্ত হইলে সকলেই প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় পাত্রের পিতা বলিয়া গেলেন, কল্য বৈকালে আপনি আমার নিকট গমন করিবেন। সেই সময় দেনা পাওনা সম্বন্ধে কথা বার্তা হইবে। পাত্রী আমার মনোনীত হইয়াছে। ইনি খুব সুরূপা না হউন, ইহাকে আমার পুত্রবধূ করিতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই।
পরদিবস কথিত সময়ে রামরতন পাত্রের পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহাকে কহিলেন, মহাশয়ের যদি পাত্রীটী পসন্দ হইয়া থাকে এবং আমার কন্যার সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিবার মতও যদি আপনার পরিবারবর্গের হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাকে কি কি আয়োজন করিতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন; যদি আমার বাধ্য হয়, তাহা হইলে আমি তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হই।
রামরতনের কথা শুনিয়া পাত্রের পিতা কহিলেন, আমি আপ নাকে ত একরূপ পূৰ্বেই বলিয়া দিয়াছি। যদি চাহেন, তাহা হইলে আমি একটী ফর্দ করিয়া আপনাকে দিতেছি। আপনি যদি তাহাতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি যাহা জানিতে চাহিতেছেন, তাহার সমস্তই স্থির হইয়া যাইবে।
এই বলিয়া তিনি তাহার বাক্স হইতে একটা ফর্দ বাহির করিয়া রামরতনের হস্তে প্রদান করিলেন। সেই ফর্দখানির মৰ্ম্ম এইরূপ;
বরাভরণ–
সোণার ঘড়ি একটী – ৩০০টাকা
সোণার চেন এক ছড়া – ৩০০টাকা
হীরার আংটী একটী – ৫০০টাকা
গার্ডচেন এক ছড়া ২৫ ভরি – ৬২৫টাকা
বেণারসী চেলী এক জোড় – ১০০টাকা
কন্যাভরণ–
সুবৰ্ণ ৩০০ ভরি ২৫টাকা হিসাবে – ৭৫০০ টকা
রৌপ্য ১০০ ভরি – ১০০টাকা
দানসামগ্রী পিত্তল-কাসা এক প্রস্থ – ১০০টাকা
ঐ চাঁদির এক প্রস্থ ১০০০ ভরি – ১০০০টাকা
খাট বিছানা – ২০০টাকা
ফুলশয্যা, নমস্কারী ইত্যাদি – ৫০০টাকা
নগদ – ৪০০১টাকা
মোট – ১৫২২৬টাকা
ফর্দখানি হস্তে পাইবামাত্রই রামরতন বাবু একবারে অবাক্। যদি তিনি তাহার যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে তিনি উহার অর্ধেক টাকার সংগ্রহ করিতে পারেন, কি না সন্দেহ। কিন্তু এবার রামরতন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পাত্রের সহিত তিনি তাহার কন্যার বিবাহ দিবেনই, মনে মনে তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা।
রামরতন বাবু সেই ফর্দখানি হস্তে করিয়া পাত্রের পিতাকে কহিলেন, মহাশয়! ফর্দটী কিছু অধিক হইয়াছে। আমি আপনাকে যেরূপ বলিতেছি, সেইরূপ নগদ ও সুবর্ণ আদি প্রদান করিতে সম্মত আছি; ইহাতে যদি আপনি সম্মত হয়েন, দেখুন; নতুবা আমাকে আপনার আশা পরিত্যাগ করিতে হয়।
বরাভরণের নিমিত্ত আপনি যে তিনশত টাকা মূল্যের ঘড়ি চাহিয়াছেন, তাহা আমি প্রদান করিতে সম্মত আছি।
সোণার চেন এক ছড়া তিনশত টাকা মুল্যের, তাহাও দিব।
হীরার আংটী পাঁচশত টাকা মুল্যের তাহাও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।
গার্ডচেন এক ছড়া পঁচিশ ভরি ওজনের কমে যদি না হয়, তাহা হইলেও উহা আমাকে প্রদান করিতে হইবে। কিন্তু বেনারসী চেলী আমি প্রদান করিতে পারিব না।
কন্যাভরণের নিমিত্ত সুবর্ণ তিনশত ভরি আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। উহাতে যে যে অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিবেন, আমি সেই সকল গহনা প্রস্তুত করিয়া দিব। কেবল সুবর্ণ বা তাহার মূল্য বলিয়া নগদ কোন অর্থ আমি আপনাকে প্রদান করিব না।
রৌপ্য একশত ভরি আমি প্রদান করিব না। চল্লিশ ভরি দিয়া কেবলমাত্র মল প্রস্তুত করিয়া দিব।
পিত্তল-কাসার দানসামগ্রী এক প্রস্থ আমি প্রদান করিব; কিন্তু তাহার মূল্য চল্লিশ পঞ্চাশ টাকার অধিক হইবে না।
চাঁদির বাসন এক প্রস্থ এক হাজার ভরি প্রদান করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে যদি আপনি একান্তই না ছাড়েন, তাহা হইলে কাজেই আমাকে উহা প্রদান করিতে হইবে।
খাট বিছানা আমি প্রদান করিতে পারিব না। উহা দিবার রীতি আমাদিগের নাই।
নমস্কারী ও ফুলশয্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকা প্রদান করা আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। সেই সকল খরচের নিমিত্ত জোর আমি একশত টাকা প্রদান করিতে পারি।
নগদ যে চারি হাজার এক টাকা চাহিয়াছেন, উহা আমাকে একবারেই ছাড়িয়া দিতে হইবে। নগদ টাকা আমি একবারেই প্রদান করিতে পারিব না। নিতান্ত না ছাড়েন, চারিশত এক টাকা প্রদান করিব।
বরের পিতা দেখিলেন, তিনি যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, রামরতন প্রায় তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন, অপরাপর দ্রব্যের মধ্য হইতে কেবল কমাইলেন—একশত টাকা মূল্যের চেলী, রৌপ্য ষাট টাকা, পিত্তল-কাসা পঞ্চাশ টাকা, খাট বিছানা দুইশত টাকা ও নমস্কারী প্রভৃতি চারিশত টাকা, মোট আটশত দশ টাকা। কিন্তু নগদ টাকা প্রায় দিতে চাহিতেছেন না। অপরাপর দ্রব্যের নিমিত্ত তিনি একরূপ সম্মত হইলেন। কিন্তু নগদ টাকা একবারে পরিত্যাগ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অনেক কসা-মাজার পর চারি হাজার এক টাকার পরিবর্তে এক হাজার পাঁচশত এক টাকায় তিনি সম্মত হইলেন।
দেনা-পাওনার বিষয় স্থির হইয়া গেলে, কত ওজনের কি কি অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, রামরতন তাহার একটী তালিকা লইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। বিবাহের দিন স্থির হইল। উভয়পক্ষেই বিবাহের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। রামরতন অলঙ্কার-পত্ৰ সকলের বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন।
যাহার এত টাকার সঙ্গতি নাই, তিনি কিরূপে এই সকল অলঙ্কার-পত্রের সংগ্রহ করিলেন, তাহা কি পাঠকগণ অবগত হইতে চাহেন?
সোণার ঘড়ির পরিবর্তে চল্লিশ টাকা মূল্যের একটী রৌপ্য ঘড়ি ক্রয় করিয়া তাহাতে সুবর্ণের গিটি করিয়া লইলেন। চেন, গার্ডচেন, অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা যাহ, সুবর্ণের দ্রব্য দেওয়ার কথা ছিল, তাহার সমস্তই পিত্তলের ক্রয় করিয়া, তাহা ভাল করিয়া সোণার গিলটি করাইলেন। হীরার আংটীর পরিবর্তে একটী উৎকৃষ্ট পোকরাজের বা নকল হীরার আংটী ক্রয় করি লেন। রৌপ্যের দানসামগ্রীর বন্দোবস্তও সেইরূপ করিলেন, কম মূল্যে জৰ্ম্মণ সিভারের বাসন সকল প্রস্তুত করিয়া লইলেন। প্রকৃত দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রদান করিলেন, চল্লিশ ভরির মল, চল্লিশ টাকা মুল্যের পিত্তল-কাঁসা, এবং নগদ এক হাজার ছয়শত এক টাকা। পিত্তলের দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া তাহাতে গিটি প্রভৃতি করাইতেও প্রায় তাহার দুইশত টাকা ব্যয়িত হইল। ইহার উপর বরযাত্রীদিগকে আহার-আদি করাইতে তাহার যে টাকা ব্যয়িত হইল, তাহার সৰ্ব্বশুদ্ধ হিসাব করিলে, একুশ শত কি বাইশ শত টাকার মধ্যেই তাহার সমস্ত খরচ সম্পন্ন হইয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে শুভ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। বিবাহের পর নববধূ লইয়া বরের পিতা আপন স্থানে গমন করিলেন। ক্রমে তাঁহার সাধ্যমত পাকস্পর্শ প্রভৃতি কাৰ্য্য সকলও শেষ হইয়া গেল। এই সকল কাৰ্য শেষ হইয়া যাইবার প্রায় একমাস পরে বরের পিতা জানিতে পারিলেন যে, রামরতন বাবু তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ঠকাইয়াছেন। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়াই তিনি ক্রোধে একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন, ও রামরতন বাবুকে ডাকাইয়া তাঁহাকে কহিলেন, এরূপ ভাবে আমাকে প্রতারণা করা কি আপনার কর্তব্য হইয়াছে? উত্তরে রামরতন বাবু কহিলেন, এরূপ প্রতারণা না করিলে, আপনার পুত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ কি কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারিত? অত টাকা আমি কোথায় পাইব যে, কন্যার সহিত অত টাকা আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি? আপনার সহিত এরূপ জুয়াচুরি করিয়াও, আমাকে যে টাকা ব্যয় করিতে হইয়াছে, তাহাতেও আমি অপরের নিকট ঋণগ্রস্ত। এখন যাহা হইবার হই আছে, যাহা করিবার করিয়াছি! এখন আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে আপনাকে আর একটীমাত্র পয়সাও এখন প্রদান করিতে পারি, সে ক্ষমতা আমার নাই। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, এই আমার প্রার্থনা।
উত্তরে পাত্রের পিতা কহিলেন, ক্ষমা! তাহা আমার দ্বারা কখনই হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকাগুলি এখন আপনি আমাকে প্রদান করুন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্ষমা করিতে পারি। নতুবা কখনই আমি আপনাকে ক্ষমা করি না।
রামরতন। আমি ত আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি যে, আর একটা মাত্র পয়সাও আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি না। ইহাতে চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আর নাই করুন।
উত্তরে বৈবাহিক পুনরায় কহিলেন, ক্ষমা ত কিছুতেই আম। হইতে হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকা প্রদান না করিলে আপনার উপর নালিশ করিয়া, আমি আপনাকে কারাগারে প্রেরণ করিব; এবং পরিশেষে আপনার কন্যাকে পরিত্যাগ করিয়া আমার পুত্রের পুনরায় বিবাহ দিব।
আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। এই বলিয়া রামরতন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
বরের পিতা বড় মানুষ হইলেও, অর্থ-লালসা তাঁহার অতিশয় বলবতী। সুতরাং তিনি সেই অর্থের আশা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। মুখে যাহা বলিয়াছিলেন, কার্যেও তাহাই করিলেন। রামরতন বাবু তাহাকে প্রতারণা করিয়াছেন বলিয়া, তিনি তাহার নামে এক ফৌজদারী মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন। রামরতন বাবু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত একে ত জুয়াচুরি করিয়া ছিলেন; যখন দেখিলেন, তাহার বিপক্ষে ফৌজদারী মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইয়াছে, তখন তিনি মিথ্যা বলিতে আরম্ভ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তিনি কহিলেন, ধর্মাবতার! আমি আমার যথা-সৰ্বস্ব বিক্রয় করিয়া স্বর্ণ-অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা কিছু আমার দিবার কথা ছিল, তাহা আমি সমস্তই প্ৰদান করিয়াছি। বিবাহের পর দিবস আমার বাড়ী হইতে আমার কন্যাকে লইয়া যাইবার পূর্বে, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার প্রদত্ত সমস্ত অলঙ্কার গুলি উত্তম রূপে স্বচক্ষে দেখিয়া লন; কিন্তু তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া পরিশেষে একজন স্বর্ণকারকে ডাকাইয়া সকলের সম্মুখে গহনাগুলি ওজন ও যাচাই করিয়া লন। সেই স্বর্ণকার এখন পর্যন্ত বর্তমান আছে। বিশেষতঃ যাহাদিগের সম্মুখে সেই সকল গহনা যাচান হইয়াছিল, তাঁহারাও এখন পর্যন্ত বর্তমান। আবশ্যক হইলে তাঁহারা সকলেই আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে প্রস্তুত। মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার নিকট হইতে আরও কিছু অর্থ প্রার্থনা করেন। সেই অর্থ প্রদানে আমি অসমর্থ হওয়ায়, আমার সহিত উহার মনান্তর উপস্থিত হয়; এবং পরিশেষে আমি আমার মেজাজ ঠিক রাখিতে না পারিয়া, অনেকের সম্মুখে উহাকে গালি প্রদান করি। উহার প্রতিশোধ লইবার মানসে, আজ তিনি আপনার নিকট আমার নামে এই মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন।
রামরতন বাবু মুখে যাহা কহিলেন, কাৰ্যেও তাহাই করিলেন। আর কিছু অর্থ ব্যয় করিয়া একজন স্বর্ণকার ও অপর কয়েকজন ভদ্রবেশী লোক দিয়া, সেইরূপ ভাবেই সাক্ষ্য প্রদান করাইলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কথা বিশ্বাস করিয়া তাহাকে অব্যা হতি প্রদান করিলেন। রামরতন হাসিতে হাসিতে আপন গৃহে গমন করিলেন।
রামরতন বাবুর বৈবাহিক মোকদ্দমা হারিয়া নিতান্ত দুঃখিত মনে আপন বাড়ীতে গমন করিলেন, এবং মনে মনে স্থির করি লেন, রামরতন বাবু যদি তাঁহাকে সেই সকল অর্থ প্রদান না করেন, তাহা হইলে তিনি তাহার কন্যাকে আর আনিবেন না; এবং পুনরায় অন্য স্থানে আপনার পুত্রের বিবাহ দিবেন।
মনে মনে এই কথা স্থির করিয়া, একদিবস তিনি তাঁহার মনের ভাব তাহার স্ত্রীর নিকট কহিলেন। কিন্তু বালিকাটী অতিশয় সুরূপা ছিল বলিয়া, তাঁহার স্ত্রী তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। ক্রমে সেই কথা তাহার পুত্রেরও কর্ণগোচর হইল; পুত্রীও পুনরায় বিবাহ করিতে অসম্মত হইলেন। কাজেই তাহার মনের দুঃখ মনেই রাখিয়া রামরতন বাবুর কন্যাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করিতে হইল। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইলে পর, রামরতন বাবু আপন বৈবাহিকের সহিত কিছুদিবস পর্যন্ত তোমোদ করিয়া চলিতে লাগিলেন। পরিশেষে সকল গোলযোগ মিটিয়া গেল। রামরতন বাবু এইরূপে জুয়াচুরি করিয়া আপন কাৰ্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়াছিলেন।
(খ) বরপক্ষের জুয়াচুরি।
সনাতন বাবু দালালী করিয়া চিরকাল আপন জীবিকা নিৰ্বাহ করিয়া আসিয়াছেন। এখন তাহার বয়স একটু অধিক হওয়া-প্রযুক্ত, আর অধিক পরিশ্রম করিতে পারেন না। সুতরাং তাঁহার আয় পূর্ব্ব হইতে অনেক কমিয়া আসিয়াছে। তাহার তিন পুত্র। প্রথমটীর বয়ঃক্রম প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে, তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, একটী পুত্র ও জন্মিয়াছে। কোন একটা সওদাগরি আফিসে মাসিক সত্তর টাকা বেতনে তিনি কৰ্ম্ম করিয়া থাকেন। অধিক পরিমাণে লেখাপড়া শিক্ষা করা তাহার ভাগ্যে পটিয়া উঠে নাই। এন্টেন্স পাস করিয়া কিছুদিবস এল-এ, পৰ্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ লেখাপড়া পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে হয়।
সনাতন বাবুর দ্বিতীয় পুত্রের নাম সতীন্দ্রনাথ। তাহার বয়ঃক্রম প্রায় সাতাশ বৎসর। লেখাপড়া কিছুমাত্র শিক্ষা করে নাই। কোন কাষ কৰ্ম্মের চেষ্টা যে করিতে হয়, তাহা তাহার মনে একদিবসের নিমিত্তও কখন উদিত হয় নাই। বাড়ী হইতে কোনরুপে অর্থ সংগ্রহ করিয়া সুরাপান ও বেশ্যালয়ে গমন করাই তাহার জীবনের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহার বিবাহ হয় নাই। সনাতন বাবু তাহার বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া, বা তাহার বিষয় লোক মুখে শুনিয়া এ পর্যন্ত কেহই তাহাকে আপন কন্যা প্রদান করিতে সম্মত হন নাই। সতীন্দ্রের গুণের মধ্যে এই ছিল যে, সে অতিশয় মিষ্টভাষী, সকলের সহিত বেশ মিলিতে পারিত, ও ভদ্ৰ-বাবহারে সকলকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিত।
সনাতনের তৃতীয় পুত্রের নাম শচীন্দ্রনাথ। অতিশয় বুদ্ধিমান্, এখনকার কালে লেখাপড়ায় যতদূর উৎকৃষ্ট হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। এণ্টেন্স হইতে আরম্ভ করিয়া, এল-এ, বি-এ, এম-এ প্রভৃতিতে সর্বোচ্চ হইয়া আসিয়াছে। এবার স্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হওয়াতে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পারিতোষিক দিবার জন্য শিক্ষা বিভাগ আদেশ প্রদান করিয়াছেন।
এই সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইবার পরই শচীন্দ্রের সহিত নিজ নিজ কন্যার বিবাহ দিবার নিমিত্ত চারিদিক হইতে কন্যাকৰ্ত্তাগণ সনাতনের বাটীতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। কেহবা বংশের প্রলোভন দেখাইয়া, কেহবা অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, এবং কেহ সুশ্রী বালিকার প্রলোভন দেখাইয়া, সনাতন বাবুর নিকট শচীন্দ্রের বিবাহের কথা উত্থাপন করিতে লাগিলেন। সনাতন বাবু পুরাতন দালাল। তিনি কাহাকেও কোনরূপে অসন্তুষ্ট না করিয়া, বা কাহাকেও কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর না দিয়া, সকলকেই হাতে রাখিলেন।
পূর্বে তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এখন শচীন্দ্রনাথের বিবাহের উপলক্ষে তাহার মনে নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রথম চিন্তা, এই সময় পুনৰ্বার সতীন্দ্রনাথেরও বিবাহের চেষ্টা করেন। একটী বড় বালিকার সহিত তাহার বিবাহ দিতে না পারিলে, উহার চরিত্র সংশোধনের আর কোনরূপ উপায় নাই। দ্বিতীয় চিন্তা, শচীন্দ্র নাখের বিবাহের সময় উপস্থিত হইয়াছে। এই সময়ে তাহার বিবাহ দেওয়াও সম্পূর্ণরূপে কৰ্তব্য; কিন্তু তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সতীন্দ্রনাথের বিবাহ অগ্রে না হইলে কনিষ্ঠের বিবাহই বা হিন্দু হইয়া কিরূপে প্রদান করিতে পারেন।
এইরূপ ও অন্যান্য নানা চিন্তায় তিনি একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন; কিন্তু আপনার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে, চারিদিক বজায় রাখিতে পারেন, কোন দিকে কোন গোলযোগ না হইয়া, সুশৃঙ্খলার সহিত তাহার মনের অভিলাষ সফল করিতে পারেন, কেবল সেই চিন্তাতেই আপন মন নিযুক্ত করিলেন।
সনাতন অনেকরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিলেন যে, জুয়াচুরি ভিন্ন কোনরূপেই তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারেন না। সুতরাং পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত জুয়াচুরি-ব্যবসা অবলম্বন করিতেও তিনি কোন প্রকারেই কুষ্ঠিত হইলেন না। বিশেষতঃ তিনি মনে মনে যেরূপ জুয়াচুরির উপায় স্থির করিলেন, তাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে পারিলে যে, কেবলমাত্র তিনি তাঁহার দুশ্চরিত্র পুত্র সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারিবেন, তাহা নহে; সেই সঙ্গে সঙ্গে কন্যাপক্ষীয় লোকের নিকট হইতে তিনি কিছু অর্থও সংগ্রহ করিতে পারিবেন। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এখন হইতে যে কোন ব্যক্তি শচীন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব করিতে তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন, তাহাদিগের মধ্যে কন্যাকৰ্ত্তার অবস্থা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব বিবেচনায় শচীন্দ্রনাথের পরিবর্তে সতীন্দ্রনাথকে দেখাইয়া, তাহারই বিবাহের কথা ঠিক করিতে লাগিলেন।
বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিবার পূর্বে সনাতন যে কন্যাকর্তা দিগকে একটু চালাক-চতুর বিবেচনা করিলেন, বা যাহারা আইন-কানুন অবগত আছেন, এরূপ বুঝিলেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে বড়লোক বলিয়া জানিতে পারিলেন, তাহা দিগের নিকট তাহার স্থিরীকৃত জুয়াচুরি-সংশ্লিষ্ট বিবাহের প্রস্তাব করিতে সাহসী হইলেন না। যে মধ্যবিত্ত লোকদিগকে নিতান্ত নিরীহ বলিয়া তাহার বিশ্বাস হইল, তাহাদিগের সহিতই সেই জুয়াচুরি-বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
সনাতন মনে মনে যেরূপ ভাবিতেছিলেন, কার্যেও ঠিক সেইরূপ জুটিয়া গেল। একদিবস তিনি আপন বাড়ীতে বসিয়া আছেন, এরূপ সময় একটী লোক আসিয়া তাহার বাড়ীতে উপ স্থিত হইলেন। সনাতনকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, মহাশয়! আপনার একটী পুত্র এবার ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হইয়াছে, একথা কি প্রকৃত?
সনাতন। হাঁ। কেন মহাশয়!!
আগন্তুক। আপনি নাকি তাহার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন?
সনাতন। হাঁ, অনেকেই তাহার বিবাহের নিমিত্ত আমার নিকট আসিতেছেন।
আগন্তুক। আপনার সেই পুত্রের নাম কি?
সনাতন। শচীন্দ্রনাথ।
আগন্তুক। আপনি বলিলেন, শচীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেকেই আপনার নিকট আগমন করিতেছেন; কিন্তু তাহার বিবাহের স্থির হইতেছে না কেন?
সনাতন। আমি মনোমত কন্যা পাইতেছি না বলিয়া, এ পর্যন্ত বিবাহের ঠিক হয় নাই।
আগন্তুক। আপনি কিরূপ কন্যা চাহেন? সনাতন। কন্যাটী বড় চাহি, এবং বেশ সুশ্রী চাহি।
আগন্তুক। পুত্রবধূ করিতে সুশ্রী কন্যা পিতা মাত্রই অনু সন্ধান করিয়া থাকেন; কিন্তু বড় কন্যা চাহিতেছেন কেন?
সনাতন। আমার পুত্রটীর বয়ঃক্রম একটু অধিক হইয়াছে, তাহাতেই একটী বড়গোছের বালিকার অনুসন্ধান করিতেছি। নতুবা মানাইবে কেন?
আগন্তুক। আপনার পুত্রটীর বয়ঃক্রম কত হইয়াছে?
সনাতন। পঁচিশ বৎসর।
আগন্তুক। এ অধিক বয়স কি? আপনি কত বড় বালিকা চাহেন?
সনাতন। হিন্দুর ঘরে যত বড় সেয়ানা কন্যা থাকিতে পারে।
আগন্তুক। বার বৎসরের অধিক বয়স্কা কন্যা হিন্দুর ঘরে কখনই আপনি পাইবেন না।
সনাতন। বার বৎসর হইলেই যথেষ্ট হইল; কিন্তু কন্যাটা বেশ সুশ্রী হওয়া আবশ্যক। কেন মহাশয়! আপনি এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
আগন্তুক। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত বলিয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।
সনাতন। আপনার কন্যাটা কেমন? এবং তাহার বয়সই বা এখন কত হইয়াছে?
আগন্তুক। আপনি যেরূপ চাহিতেছেন, তাহাই। আমার কন্যা এগার বৎসর অতিক্রম করিয়া, বার বৎসরে উপনীত হই আছে। দেখিলে জানিতে পারিবেন, এরূপ সুশ্রী কন্যা এক হাজার কন্যার মধ্যে একটী পাওয়া যায় কি না। এই নিমিত্ত আমার প্রার্থনা, আপনি আমার সেই কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন।
সনাতন। আপনার নিবাস কোথায়?
আগন্তুক। বর্ধমান জেলার অন্তর্গত * * গ্রামে।
সনাতন। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য আমার নিকট আগমন করিবেন, হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, হয়, অপর কোন এক ব্যক্তিকে আপনার সহিত যাইতে বলিব, তিনি গিয়া দেখিয়া আসিলেই হইবে।
আগন্তুক। আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি, আমার কন্যা যিনি দেখিবেন, তাহারই মনোনীত হইবে। কিন্তু পূর্বে একবার দেনা-পাওনার কথাটী বলিলে হইত না? তাহা হইলে আমি জানিতে পারিতাম, সেই পরিমিত টাকার সংস্থান করিবার ক্ষমতা আমার আছে কি না।
সনাতন। কন্যা মনোনীত হইলে, দেনা-পাওনার নিমিত্ত ততটা বাধা রহিবে না। তবে কি না, যেরূপ বিদ্বান্ বালকের হস্তে আপনি কন্যাদান করিতে প্রবৃত্ত হইতেছেন, তাহাতে একবারেই যে কিছু লাগিবে না, তাহা নহে। অগ্রে কন্যা মনোনীত হউক, তাহার পর সকল বিষয় সহজেই মিটিয়া যাইবে।
আগন্তুক। আচ্ছা মহাশয়? তাহাই হইবে। আমি কল্য অতি প্রত্যূষে আপনার নিকট আগমন করিব; কিন্তু আমার ইচ্ছা, আপনি নিজে গিয়া আমার কন্যাটীকে স্বচক্ষে দর্শন করেন।
সনাতন। আচ্ছা দেখিব, পারি যদি আমি নিজেই যাইব।
আগন্তুক। মহাশয়! আমি আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
সনাতন। কি?
আগন্তুক। আপনার পুত্রটী এখন কোথায়?
সনাতন। বাড়ীতেই আছে।
আগন্তুক। তাহাকে একবার আমি দেখিতে পাই কি?
সনাতন। কেন পাইবেন না? আপনি যাহাকে জামাতা করিতে চাহিতেছেন, তাহাকে দেখিতে পাইবেন না, একথা কি হইতে পারে? আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহাকে আপনার সম্মুখে এখনই আনিতেছি।
এই বলিয়া সনাতন বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং কিছু পরেই তাঁহার সেই মূখ ও বেশ্যাসক্ত পুত্র সতীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া, তাহাকে কহিলেন, মহাশয়! ইনিই আমার পুত্র। আমি অনেক কষ্টে ইহাকে লেখা পড়া শিখাইয়াছি। ইনিই এবার দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছেন।
সনাতনের এই কথা শুনিয়া আগন্তুক একবার তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, বাবা! তোমার নাম কি?
সতীন্দ্রনাথ অবলীলাক্রমে কহিল, আমার নাম শচীন্দ্রনাথ। সে যে এই মিথ্যা কথা আপনার ইচ্ছানুযায়ী কহিল, তাহা নহে। পিতার শিক্ষামতই সে তাহার মিথ্যা নাম বলিয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিল।
আগন্তুক পাত্র দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন, বেশ ছেলে। সনাতনকে কহিলেন, আপনি বলিতেছিলেন, আপনার পুত্রের বয়স কিছু অধিক হইয়াছে। কৈ, আমার বিবেচনায় ইহার বয়ঃক্রম কিছুমাত্র অধিক হয় নাই; বিবাহের উপযুক্ত বয়সই এখন হইয়াছে। আমার কন্যার সহিত ইহাকে বেশ মানাইবে। এই বলিয়া তিনি সতীন্দ্রকে কহিলেন, যাও বাবা। তুমি এখন বাড়ীর ভিতর গমন কর। সতীন্দ্রনাথ সেই স্থান হইতে উঠিয়া অন্য স্থানে প্রস্থান করিল।
সতীন্দ্রনাথ দেখিতে নিতান্ত মন্দ ছিল না। তাহাকে দেখিয়া আগন্তুকের বেশ পসন্দ হইল। তাহার উপর সে যেরূপ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শুনিলেন, তাহাতে এরূপ পাত্রকে কে পসন্দ না করিয়া থাকিতে পারে?
পরদিবস সনাতন কন্যার পিতার সহিত বর্ধমানে গমন করিয়া কন্যাটী দেখিয়া আসিলেন। দেখিলেন, কন্যাটী অতি সুরূপা, ও বয়ঃক্রম প্রায় তের বৎসর। কন্যাটা দেখিয়া সনাতন তাহার পিতাকে কহিলেন, আপনার কন্যাটী সুশ্রী, ইহাকে আমি আমার পুত্রবধূ করিতে পারি। কিন্তু এখন দেনা-পাওনার বিষয়টা কি হইবে?
কন্যার পিতা। আমার অবস্থা ত আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া গেলেন। আপনাকে এখানে আনিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য, আমার অবস্থা আপনাকে দেখান। এখন বিবেচনা-মত আপনি যাহা কহিবেন, তাহাই আমি আপনাকে প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। কারণ, আপনার পুত্রের সদৃশ বিদ্বান্ পাত্রের হস্তে কন্যা সমৰ্পণ করিতে কোন ব্যক্তি পরাজুখ হয়েন? তবে আমার প্রতি একটু অনুগ্রহ করিবেন, এই প্রার্থনা।
সনাতন। দেখুন মহাশয়। আমার পুত্র নিজেই দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে। কনটী যখন আমার একরূপ পসন্দ হইয়াছে, তখন টাকার নিমিত্ত আমি তত পীড়াপীড়ি করিব না। তবে এখন বিবেচনা মত আপনি নিজেই বলিয়া দিন, আপনি অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যের জন্য মোট আমাকে কত টাকা দিতে পারিবেন?
কন্যার পিতা। মহাশয়! সৰ্ব্ব শুদ্ধ আমি এক হাজার পাঁচশত টাকা আপনাকে প্রদান করিব। ইহাতেই অনুগ্রহ করিয়া আমার উপর আপনাকে সদয় হইয়া, কন্যাদায় হইতে আমাকে উদ্ধার করিতে হইবে।
সনাতন। অত কম টাকায় কিরূপে আপনি এইরূপ সুপাত্র পাইতে পারেন? আমি অধিক টাকা চাহিতেছি না, সর্ব শুদ্ধ আমাকে দুই হাজার পাঁচশত টাকা প্রদান করিবেন।
সনাতনের এই কথা শুনিয়া কন্যার পিতা অনেক তোষামোদ করিয়া পরিশেষে সনাতনকে দুই হাজার টাকায় সম্মত করাইলেন।
ক্রমে বিবাহের সমস্ত ঠিক হইয়া গেল। সনাতন কন্যাকর্তার জাতি-কুল সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন, জাত্যাদির বিষয়ে কোনরূপ গোলযোগ নাই। কন্যার পিতাও সে সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিলেন, তিনিও জাতি-কুল সম্বন্ধে কোনরূপ দোষ বাহির করিতে পারিলেন না। কন্যাপক্ষীয়গণ আরও একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারি লেন যে, সেই বৎসর সনাতনের পুত্র শচীন্দ্রনাথ প্রকৃতই স্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে।
উভয় পক্ষের ভিতরের অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল। তখন উভয় পক্ষের মতানুসারে বিবাহের দিন স্থিরীকৃত হইল। সনাতন উদ্যোগ করিয়া যাহাতে অতি শীঘ্র এই বিবাহ দেওয়াইতে পারেন, তাহাই করিয়া আসিতেছিলেন। কারণ, বিলম্ব হইলে, পাছে তাহার জুয়াচুরির কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে; সেই ভয়ে, তিনি বত নিকটে বিবাহের দিন পাইলেন, তত নিকটেই দিনস্থির করিলেন। দুইদিন পরেই দিন হইল। বিবাহের পূৰ্ব্ব-দিবসেই আয়ুবৃদ্ধান্ন প্রভৃতি সমস্ত কাৰ্য শেষ হইয়া গেল। বিবাহের দিবস সকাল সকাল বর লইয়া গিয়া বিবাহ-কাৰ্য্য সম্পন্ন করাই লেন। দূর-পথের ভান করিয়া সনাতন নিজের নিতান্ত নিকট অর্ক্সীয় অর্থাৎ যাহাদের না পাইলে কাৰ্য উদ্ধার হইবে না, তাহাদের দুই চারিজনমাত্রকে বরযাত্রী স্বরূপে লইয়া গিয়াছিলেন। যাহা হউক, যথানিয়মে বিবাহ শেষ হইয়া গেল।
এখানে বলা বাহুল্য যে, সনাতনের তৃতীয় পুত্র ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষোত্তীর্ণ শচীন্দ্রনাথের সহিত এ বিবাহ হইল না; সেই দুশ্চরিত্র মধ্যম পুত্র সতীন্দ্রনাথের সহিত হইয়া গেল।
এখন পাঠক! বুঝিতে পারিলেন যে, এইরূপ জুয়াচুরি করিয়া সনাতন আপনার মূখ, লম্পট ও সুরাপায়ী পুত্রের বিবাহ দিয়া দুই সহস্র টাকা গ্রহণ করিলেন।
বিবাহের সময় কন্যার পিতা প্রকৃত কথা কিছুই জানিতে পারিলেন না। বিবাহের প্রায় দুই তিনমাস পরে তিনি যে কিরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া চিরদিবসের নিমিত্ত আপন কন্যার সর্বনাশ-সাধন করিয়াছেন, তাহা অবগত হইতে পারি লেন। কিন্তু হিন্দুর বিবাহ! সুতরাং সমস্তই তাহাকে সহ করিয়া থাকিতে হইল।
সনাতনের ভাগ্যবলেই হউক, বা কন্যার পিতার মনোকষ্টের নিমিত্তই হউক, অথবা সুকুমারী বালিকার অদৃষ্টক্রমেই হউক, বিবাহের পর হইতেই সতীন্দ্রনাথের চরিত্রের পরিবর্তন আরম্ভ হইল। সে সুরা পরিত্যাগ করিল, বেশ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করিয়া বৈষয়িক কার্যে আপনার মন নিযুক্ত করিল, এবং একটা ব্যবসা। আরম্ভ করিয়া তাহা হইতেই বেশ দশ টাকা উপার্জন করিতে লাগিল।
কিছুদিবস পরে প্রকৃত শচীন্দ্রনাথেরও বিবাহ হইয়া গেল। এই বিবাহে কন্যার্তার নিকট হইতে সনাতন প্রায় ছয় সাত হাজার টাকা গ্রহণ করিলেন।
———-
* ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষার পারিতোষিক, কোম্পানীর কাগজের সুদ কমিয়া যাওয়ার নিমিত্ত এখন আট হাজার টাকা হইয়াছে; কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় উক্ত পরীক্ষার পারিতোষিক দশ হাজার টাকা ছিল।
সম্পূর্ণ।