দায়ে খুন

দায়ে খুন

দায়ে খুন (অর্থাৎ যেমন জুয়াচুরি তেমনই সাজা!)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস প্রাতঃকালে কেবলমাত্র আমি আমার আফিসে আসিয়া বসিয়াছি, এরূপ, সময়ে একজন মাড়োয়ারী আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। ইহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অনধিক। ইহাকে দেখিয়া, বেশ একজন চালাক ব্যবসায়ী লোক বলিয়া অনুমান হয়। আমাকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, মহাশয়! আমি আপনার সহিত একটী সবিশেষ পরামর্শ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি। যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা অতি সামান্য বিষয় হইলেও, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বলিয়া, আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। যদি অনুগ্রহপূর্ব্বক আপনি আমার কথা গুলি শ্রবণ করেন, এবং আমার কি করা কৰ্তব্য, সে সম্বন্ধে একটু পরামর্শ প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি সবিশেষরূপ বাধিত হইব।

মাড়োয়ারীর কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, আপনি যাহা বলিতে চাহেন, অনায়াসেই তাহা আমাকে বলিতে পারেন। আপনার সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, যদি বুঝিতে পারি, আমার দ্বারা কোনরূপে আপনার উপকার হইবার সম্ভাবনা, তাহা আমি করিতে প্রস্তুত আছি।

আমার কথা শুনিয়া সেই মাড়োয়ারী বলিতে আরম্ভ করিল, মহাশয়! আমার নাম বালমুকুন্। আমি বাল্যকাল হইতে ব্যবসা-কাৰ্য ব্যতীত অপর কোন কাৰ্য শিক্ষা করি নাই। এ পৰ্য্যন্ত ব্যবসা-কাৰ্যেই নিজের দিন অতিবাহিত করিয়া আসি তেছি; কিন্তু আপন দুরদৃষ্ট বশতঃ এ পর্যন্ত নিজে কোনরূপ কারবার করিতে সমর্থ হই নাই, চিরকালই পরের অধীনেই কাৰ্য্য করিয়া আসিয়াছি। এই কলিকাতা সহরে অনেক দিবস হইতে অবস্থিতি করিয়া কোন একটা প্রধান মাড়োয়ারীর সমস্ত কাৰ্য আমি নিজে নির্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম। আমি যতদিন পর্যন্ত তাঁহার কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, সেই পৰ্যন্ত কোনরূপেই তাহার একটামাত্র পয়সাও লোকসান হয় নাই; বরং দিন দিন আমি তাহার কাৰ্য্যের উন্নতি করিয়াই আসিতে ছিলাম। আমি কলিকাতায় থাকিতাম সত্য; কিন্তু ভারতবর্ষের নানাস্থানে তাহার এক একটী ফারম ছিল। আমি কলিকাতায় থাকিয়া, সেই সমস্ত ফারমের কার্য নির্বাহ করিয়া আসিতে ছিলাম। এই সকল ফারম হইতে আমার মনিব যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করিয়া তাহার দেশে তিনি এখন একজন বড়মানুষের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছেন। তিনি অর্থের যথেষ্ট সংস্থান করিয়া ছেন সত্য; কিন্তু তাহার অবর্তমানে সেই অর্থ ভোগ করিতে পারিবে, তাহার এরূপ আর কেহই নাই। একমাত্র পুত্র ছিল, তিনি বড় হইয়া ইদানীং মধ্যে মধ্যে নিজের ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, হঠাৎ তাঁহারও মৃত্যু হইয়াছে। এই কারণে আমার মনিব মনের দুঃখে তাহার যে স্থানে যে কোন কারবার ছিল, তাহার সমস্ত কাৰ্য্য উঠাইয়া দিয়াছেন। যখন আমার মনিব তাহার সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করিয়া দিলেন, তখন আর আমার চাকরী থাকিবে কি প্রকারে? পারিতোষিক বলিয়া, আমাকে নগদ দুই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়া আমাকে তাঁহার চাকরী হইতে জবাব দিলেন।

নগদ দুই সহস্র মুদ্রা হস্তে পাইয়া আমি একবার মনে করি লাম, এতদিবস পরের নিকট চাকরী করিয়া দিন যাপন করি য়াছি, এখন আর কাহার নিকট পুনরায় উমেদারী করিয়া বেড়াইব? এই মূলধন অবলম্বন করিয়া কোন একটা কারবার আরম্ভ করি, তাহাতেই কোনরূপে আপনার দিন অতিবাহিত করিব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কারবারে প্রবৃত্ত হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময় জানিতে পারিলাম যে, বোম্বাই সহরের কোন একটা প্রধান মাড়োয়ারী ফারমের মনিব গোমস্তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায়, সেই চাকরী খালি হইয়াছে। বোম্বাই সহরের সেই ফারমের নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম। আমার পূর্ব্বতন মনিবের ফারমের সহিত সেই ফারমের সৰ্ব্বদা কারবার চলিত; কিন্তু আমাদিগের পরস্পরের মধ্যে কাহারও সহিত কাহারও চাক্ষুষ দেখা-শুনা ছিল না। আমি জানিতাম, বোম্বায়ের সেই ফারম অতিশয় পুরাতন, কারবার বহু-বিস্তৃত ও সর্বজনবিদিত।

সেই ফারমের মনিব-গোমস্তার পদ শূন্য হইয়াছে জানিতে পারিয়া, সেই পদ-প্রার্থী হইয়া, আমি সেই স্থানে একখানি দরখাস্ত করিলাম। আমি যে ফারমে কাৰ্য্য করিতাম, এবং যে কারণে এখন আমার কৰ্ম্ম নাই, দরখাস্তে তাহারও সমস্ত অবস্থা আমি বিস্তৃতরূপে লিখিয়া দিলাম। যে পদের প্রার্থী হইয়া আমি দরখাস্ত করিলাম, সেই পদ যে আমি প্রাপ্ত হইব, সে আশা আমার অতি অল্পই ছিল। কারণ, বোম্বাই-প্রদেশে সেই কার্যের উপযোগী অনেক লোক বর্তমান থাকিতে তাঁহারা একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে কেন সেই পদে নিযুক্ত করিবেন? সে যাহা হউক, আমার মনে যতদূর আশা ছিল, তাহার অধিক কাৰ্য্যে পরিণত হইল। দরখাস্ত প্রেরণ করিবার এক সপ্তাহ পরেই আমি সেই ফারম হইতে একখানি পত্ৰ পাইলাম। পত্রখানি পাঠ করিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। দেখিলাম, আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইয়াছে, বাৎসরিক ছয়শত টাকা বেতনে আমাকে সেই কার্যে নিযুক্ত করা হইয়াছে। উহাতে আরও লেখা আছে যে, এই পত্র পাইবার পর দশদিবসের মধ্যেই সেই স্থানে গমন করিয়া আমাকে আমার নূতন কার্যে নিযুক্ত হইতে হইবে।

সেই পত্র পাইয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। ইতিপূর্বে যাহার নিকট আমি কাৰ্য্য করিতাম, তাহার নিকট হইতে আমি বাৎসরিক চারিশত আশী টাকা বেতন পাইতাম। এখন তাহা অপেক্ষা আমার একশত কুড়ি টাকা অধিক বেতন হইল। সুতরাং নূতন চাকরী সম্বন্ধে আমি আর কোনরূপ ইতস্ততঃ না করিয়া ব্যবসা করিবার যে ইচ্ছা করিতেছিলাম, তাহা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাই সহরে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।

যে দিবস আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাইয়ে গমন করিবার মনস্থ করিয়াছিলাম, তাহার তিন চারিদিবস পূৰ্বে একটী লোক আসিয়া হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি যে কি করিয়া আমার বাসা চিনিলেন, তাহা আমি বলিতে পারিলাম, বা বুঝিতেও পারিলাম না। ইতিপূর্বে আর কখনও যে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি, তাহাও আমার বোধ হইল না। তিনি হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইয়াই কহিলেন, মহাশয়ের নামই কি বালমুকুন্?

আমি। হ মহাশয়! আমারই নাম বালমুকুন্। আগন্তুক। আপনি যে ফারমে কাৰ্য্য করিতেন, সেই ফারম এখন উঠিয়া গিয়াছে?

আমি। ধনী ইচ্ছা করিয়া তাহার দেনা-পাওনা মিটাইয়া দিয়া তাহার কারবার উঠাইয়া দিয়াছেন।

আগন্তুক। তাহা হইলে বোধ হয়, আপনি এখন বেকার বসিয়া আছেন?

আমি। বেকার বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু এখন বেকার বসিয়া আছি, তাহা আর বলিতে পারি না।

আগন্তুক। আপনার একথার অর্থ আমি বেশ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

আমি। চাকরী যাওয়ার পর, আমি কিছুদিবস বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু সম্প্রতি একটী চাকরীর যোগাড় হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছি, এখন আর আমি বেকার অবস্থায় বসিয়া নাই। কেন মহাশয়! আপনি আমাকে এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিবার সবিশেষ কারণ আছে বলিয়াই, জিজ্ঞাসা করিতেছি। আপনাকে একটা চাকরীতে নিযুক্ত করি বার মানসেই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।

আমি। আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিবার মানসেই আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, একথার অর্থ আমি সবিশেষরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আগন্তুক। ইহার অর্থ এমন সবিশেষ কিছু নহে যে, আপনি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আমি যে মহাজনের অধীনে কৰ্ম্ম করি, তিনি একজন প্রসিদ্ধ ধনী। তিনি জাতিতে মাড়োয়ারী ব্রাহ্মণ; কিন্তু কেবল বঙ্গদেশ ব্যতীত এমন কোন স্থান নাই যে, সেই সকল স্থানে তাহার ফারম বা কারবার নাই। মাদ্রাজ হইতে হিমালয়, বোম্বাই, এবং গুজরাট হইতে বেনারস প্রভৃতি স্থানের মধ্যে যে যে স্থানে প্রধান প্রধান নগর আছে, সেই সেই স্থানেই তাঁহার একটী একটী শাখা ফারম আছে। আমার বোধ হয়, বঙ্গদেশ ব্যতীত এক ভারতবর্ষের মধ্যে অল্প-বিস্তর তিনশত স্থানে তাহার কারবার হইয়া থাকে। এখন তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা যে, তিনি বঙ্গদেশের মধ্যেও আপনার কারবার বিস্তৃত ভাবে স্থাপন করেন, এই নিমিত্তই আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। কলিকাতার মধ্যে একটী প্রধান ফারম স্থাপন করিয়া, ক্রমে বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান সমস্ত নগরীতে তাহার এক একটী শাখা ফারম স্থাপন করিয়া আমি আমার স্থানে অর্থাৎ মান্দ্রাজ সহরে গমন করিব। কলিকাতার ফারমের অধীনে অনেকগুলি শাখা ফারম থাকিবে; সুতরাং কলিকাতার নিমিত্ত একজন অতি উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন। আমি আমার একজন বন্ধুর পত্রে অবগত হইতে পারিয়াছি যে, যেরূপ কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি উপযুক্ত লোকের অনুসন্ধান করিতেছি, আপনি সেই কাৰ্য্যের ঠিক উপযুক্ত লোক।

তাহার এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার সম্বন্ধে আপনাকে কে বলিয়াছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

উত্তরে তিনি আমাদিগের দেশস্থ এক ব্যক্তির নাম করিলেন। দেখিলাম, তাঁহার সহিত আমার সবিশেষরূপ আলাপ-পরিচয় না থাকিলেও, তিনি যে একবারে আমার নিকট অপরিচিত, তাহা নহে। সুতরাং আমি মনে ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইলে হয় ত প্রকৃতই তিনি আমার কথা বলিয়া থাকিবেন।

তাহার পর তিনি কহিলেন, মহাশয়! এখন আমি আপনার নিকট কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছি, তাহা এখন বোধ হয়, বেশ বুঝিতে পারিলেন?

আমি। তাহা ত বুঝিয়াছি, কিন্তু আপনি যে প্রকার কার্যের কথা আমাকে কহিলেন, সেই সকল কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোন প্রকারেই সম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর নহে। সমস্ত বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান নগরীতে এক একটী কাৰ্য্যস্থান স্থাপন করিয়া, সেই সকল কার্যের উত্তমরূপে তত্ত্বাবধান করিতে হইলে, আমাদিগের সদৃশ বুদ্ধিজীবি লোকের দ্বারা সে কাৰ্য্য হইবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। আপনি যদি আমার পরামর্শ শ্রবণ করেন, তাহা হইলে আমা-অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান ও কার্যক্ষম অপর কোন ব্যক্তির অনুসন্ধান করুন।

আগন্তুক। সে অনুসন্ধান করিবার আমার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। যদি আমার বিশ্বাস না হইত, বা অপরের নিকট হইতে আমি উত্তমরূপে অবগত হইতে না পারিতাম যে, আপনার দ্বারা আমাদিগের প্রস্তাবিত কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে বোধ হয়, আমি কখনই আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতাম না। সেই কাৰ্য্য আপনার দ্বারা নির্বাহ হইবে না, একথা আপনি ত বলিবেনই। কারণ, যে ব্যক্তির কোন কাৰ্যে উত্তমরূপে পারদর্শিতা থাকে, তিনি কখনই আপনার গুণ আপন মুখে স্বীকার করেন না; অধিকাংশ সময়ে বরং তিনি তাহার বিপরীতই বলিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, সেই কাৰ্য্য আপনার দ্বারা সুচারুরূপে নিৰ্বাহ হইতে পারুক আর না পারুক, তাহা আমরা বুঝিতে পারিব। আপনি কোন সময় হইতে আমাদিগের কাৰ্যে নিযুক্ত হইবেন, তাহা এখন আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিন।

আমি। আমি যদি আপনাদিগের কার্য সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারি, তাহা হইলেও কি আপনি সেই কাৰ্য্যে আমাকে নিযুক্ত করিতে চাহেন?

আগন্তুক। তাহা হইলেও চাহি।

আমি। এরূপ অবস্থাতেও যদি আপনি আপনাদিগের কাৰ্য্যে নিযুক্ত করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমাকে সবিশেষ দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে যে, এখন আমি অপর কোন স্থানে চাকরী গ্রহণ করিতে অসমর্থ।

আগন্তুক। কেন?

আমি। আমি ইতিপূর্বে অপর আর এক স্থানে চাকরী, স্বীকার করিয়াছি, এবং সেই স্থানে শীঘ্রই গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছি।

আগন্তুক। সে কোথায়?

আমি। বোম্বাই সহরে। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! আমি কিরূপে আপনার চাকরী করিতে সম্মত হইতে পারি?

আগন্তুক। আপনি একটী কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই স্থানে গমন বা সেই কাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করেন নাই। বাল্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া পরের নিকট চাকরী করিতে করিতে আপনি এখন এত বড় হইয়া ছেন। বলুন দেখি, কোন লোক কোন স্থানে কৰ্ম্ম করিতে করিতে যদি অপর কোন স্থানে কিছু সুবিধা বিবেচনা করেন, তাহা হইলে তিনি সেই কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন কাৰ্য্যে গমন করেন কি না? আমার বোধ হয়, আপনার পরি চিত যত লোক এইরূপ ভাবে এক স্থান হইতে কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে গমন করিয়াছেন, তাহার একটী দুইটা তালিকা আপনি এখন হঠাৎ প্রস্তুত করিয়া দিতে পারেন। মূল কথা, এরূপ লোকের সংখ্যা জগতে এত অধিক যে, তাহা ঠিক করা সহজ নহে। আপনি যখন অপর কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন নাই, তখন সেই কাৰ্য্যে আপনাকে যে গমন করিতেই হইবে, তাহার অর্থ নাই। যে স্থানে আপনি আপনার নুতন চাকরী প্রাপ্ত হইতেছেন, সেখানে তাঁহারা আপনাকে কিরূপ বেতন দিতে স্বীকার করিয়াছেন, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

আমি। তাহা বলিতে আমার কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নাই। তাঁহারা আমাকে যে বেতন দিতে সম্মত হইয়াছেন, তাহা কিছু অধিক নহে; বরং একরূপ সামান্য। বাৎসরিক তাঁহারা আমাকে ছয়শত টাকা প্রদান করিবেন।

আগন্তুক। একথা আপনাকে আমার পূর্বে বলা উচিত ছিল। কারণ, তাহা হইলে এতগুলি বাজে কথা লইয়া আমাদিগের সময় নষ্ট করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন হইত না। যখন চাকরীই আপনার উপজীবিকা, তখন আপনাকে চাকরী করিতেই হইবে। যখন চাকরীই করিতে হইল, তখন ভাল ঘরে অধিক বেতন পাইলে সে সুযোগ কে পরিত্যাগ করিতে চাহে?

আমি। আপনারা আপনাদিগের প্রস্তাবিত কৰ্ম্মের নিমিত্ত যে লোক নিযুক্ত করিতে ইচ্ছা করিতে চাহিতেছেন, তাহার নিমিত্ত তাহাকে কিরূপ বেতন দিতে ইচ্ছা করিতেছেন?

আগন্তুক। আমি নিজে ধনী নহি, বা আমার নিজের কারবার নহে। আমার মনিব আছে, আমিও আমার মনিবের একজন বেতন-ভোগী চাকর। আমাদিগের মনিবের নিয়ম আছে, তিনি তেঁাহার কোন লোকজনকে বাৎসরিক হিসাবে বেতন প্রদান করেন না। কারণ, তিনি বেশ জানেন, যিনি যেরূপ বেতনের চাকরই হউন না কেন, সেই বেতন হইতে তাহাকে তাহার পরিবার প্রতিপালন করিতে হয়। সুতরাং বৎসরান্তে বেতন পাইলে, কোন ব্যক্তিই তাঁহার পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হন না। এই নিমিত্ত আমার মনিবের আদেশ যে, তাহার চাকমাত্রেই মাসিক হিসাবে বেতন প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহের ভিতরেই পাইবে। আপনার নিমিত্ত প্রথমেই আমার মনিবের সহিত কথা হইয়াছিল। তিনি আমাকে বলিয়া দিয়া ছিলেন যে, সেই কার্য্যের নিমিত্ত যদি তিনি কোন একজন ভাল লোক প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে তাহার মাসিক বেতন তিনি তিনশত টাকা পর্যন্ত ক্রমে প্রদান করিবেন। এখন কিন্তু একশত টাকার অধিক দিবেন না। ভাল করিয়া তাহার মনোমত কাৰ্য্য করিতে পারিলে, প্রত্যেক বৎসরে পচিশ টাকা হিসাবে বাড়াইয়া দিবেন। এইরূপে ক্রমে তাঁহার বেতন মাসিক তিনশত টাকায় আসিয়া উপস্থিত হইবে, তাহার পর তাহার বেতন আর অধিক বাড়িবে না। এখন মহাশয়! দেখুন দেখি, মাসিক একশত টাকা হিসাবে বেতন হইলেও, বাৎসরিক হিসাবে আপনার বেতন হইল—বারশত টাকা, অর্থাৎ যাহা এখন আপনি পাইবেন বলিয়া ঠিক হইয়াছিল, তাহার দ্বিগুণ। এরূপ অবস্থায়ও আপনি আমার প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মত হইতে পারিবেন কি না, সেই বিষয়ে একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন।

তাহার এই কথা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, এই ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা ত প্রকৃতই। যখন পরাধীনতা স্বীকার করিয়া চাকরী করিতেই প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন যে স্থানে অধিক অর্থ পাওয়া যাইতেছে, সেই স্থান পরিত্যাগ করি কেন? বিশেষতঃ যে ব্যক্তি আমার বাড়ীতে আসিয়া আমাকে তোমোদ করিয়া, অধিক বেতনে আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিতেছে, তখন সেই চাকরীই বা আমি হেলায় পরিত্যাগ করি কেন? মাসিক পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে একশত টাকাই বা গ্রহণ না করি কেন? আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এরূপ অবস্থায় এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করা, কোন ক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নহে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই ব্যক্তিকে কহিলাম, মনে করুন, আমি যদি আমার চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপনা দিগের কাৰ্য্য করিতেই প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে কোন্ তারিখ হইতে আমাকে সেই কার্যে নিযুক্ত হইতে হইবে?।

আগন্তুক। এখন হইতেই আমি আপনাকে নিযুক্ত করিব, আজ হইতেই আপনি আমাদিগের কাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করিবেন।

আমি। দেখুন মহাশয়! আমি যে ফারমে চাকরী স্বীকার করিয়াছি, সেই ফারম জগদ্বিখ্যাত ও বহুদিবসের পুরাতন ফারম। আপনার পরামর্শে সেই স্থান হইতে চাকরী পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্থানে গমন করা কি যুক্তিসঙ্গত?

আগন্তুক। আমাদিগের ফারম যদি সামান্য ফারম হইত, তাহা হইলে আপনার চাকরী পরিত্যাগ করিতে আমি কখনই পরামর্শ প্রদান করিতাম না। আপনি যে কারমের কথা বলিতে ছেন, সেই ফারম অপেক্ষা ধনবান্ ও উৎকৃষ্ট ফারম এ দেশে যদি কাহারও থাকে, তাহা আমাদিগের। যে ফারমের শাখা ভারতবর্ষের সমস্ত প্রধান প্রধান নগরীতে আছে, সেই স্থানে চাকরী করা শ্লাঘার বিষয়। বিশেষতঃ আপনি আমাদিগের ফরমের নিয়ম প্রভৃতি অবগত নহেন বলিয়াই, এইরূপ কথা বলিতেছেন। আমাদিগের ফারমের কর্ম্মচারীগণ তাহাদের কার্যদক্ষতা দেখাইয়া আপনাদের কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিলে, মূল ফারমের লভ্য অংশ হইতে কমিশন বলিয়া বাৎসরিক একটী অংশও পাইয়া থাকেন। সে অংশ শুনিতে অতি সামান্য হইলেও, কাৰ্য্যে কিন্তু সামান্য নহে। এমন কি, এক একজন কর্ম্মচারী বৎসর বৎসর তাহার বেতনাদি বাদে পাঁচ ছয় সহস্র পৰ্য্যন্ত টাকা পাইয়া থাকেন। তদ্ব্যতীত আমাদিগের কাৰ্য্যের আর একটী প্রধান সুবিধা আছে, যে সুবিধা কেবলমাত্র আমাদিগের ফারম ব্যতীত এ পর্যন্ত অপর কোন স্থানেই পরিলক্ষিত হয় নাই। যিনি যে স্থানেই চাকরী করুন না কেন, একমাস চাকরী পূর্ণ না হইলে সেই মাসের বেতন কেহই প্রাপ্ত হন না; কিন্তু আমাদিগের নিয়ম সেরূপ নহে। আমরা সকলেই অগ্রিম বেতন পাইয়া থাকি, অর্থাৎ যেমন মাস পড়িবে, অমনি আমরা সেই মাসের বেতন অগ্রিম প্রাপ্ত হইব। এরূপ অবস্থায় আপনি সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, আপনি আমাদিগের সরকারে কাৰ্য্য করিতে প্রস্তুত আছেন কি না? যদি আপনি আমাদিগের প্রস্তাবিত চাকরী গ্রহণ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি কল্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। এখন আমি আপন স্থানে প্রস্থান করিতেছি।

এই বলিয়া তিনি প্রত্যাগমন করিতে উদ্যত হইলে, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মহাশয়! আমি কল্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া, কাহার অনুসন্ধান করিব? মহাশয়ের নাম ত আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই।

আগন্তুক। আমার নাম মাণিক চাঁদ। আপনি আমার নাম করিয়া অনুসন্ধান করিলেই আমাকে দেখিতে পাইবেন।

আমি। কোন্ স্থানে গমন করিলে, আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হইব?

মাণিক। আমার বাসায়।—না, আমার বাসায় যাইবার প্রয়োজন নাই, বেলা দশটা হইতে পাঁচটা পর্যন্ত আমি আমার বাসায় থাকিব না। নির্জনে একটী ঘর লইয়াছি, সেই স্থানে বসিয়া আমি কি প্রণালীতে কার্যের বন্দোবস্ত করিব, তাহাই ঠিক করিতেছি। আপনি সেই স্থানে গমন করিবেন, সেই স্থানেই আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে।

আমি। সে স্থান কোথায়?

মাণিক। বড়বাজার রাজার কারা। রাজার কাটরায় দোতালার উপর পচিশ ছাব্বিশ নম্বরের ঘর।

আমি। আচ্ছা মহাশয়অদ্য আমি এ বিষয় একটু সবিশেষ রূপে বিবেচনা করিয়া দেখি, এবং আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিয়া দেখি। পরামর্শ করিয়া আমি যেরূপ সাব্যস্ত করিব, তাহা আমি আপনার নিকট গমন করিয়া বলিয়া আসিব। যদি আপনাদিগের নিকট চাকরী করি, তাহাও গিয়া বলিয়া আসিব, আর না করি, তাহাও আপনাকে জানাইব।

আমার সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, মাণিকবাবু আমার বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলেন। সেই চাকরী গ্রহণ করা আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছিলাম। তথাপি দুই একজন বন্ধু বান্ধবকে একবার জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য মনে করিলাম।

সেই দিবস রাত্রিতেই আমি আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিলাম, সকলেই আমাকে মাণিকচাঁদের প্রস্তাবিত কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইতে পরামর্শ প্রদান করিলেন। আমিও তাহাই স্থির করিয়া পরদিবস মাণিকবাবুর নিকট গমন করিয়া তাহাদিগের ফারমেই কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম।

পরদিবস বেলা আন্দাজ এগারটার সময় আমি রাজার কাটুরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজার কাটার প্রত্যেক ঘরই আমি পূৰ্ব্ব হইতে জানিতাম। দোতালার উপর গমন করিয়া পঁচিশ ছাব্বিশ নম্বরের গৃহের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দুইটা ঘর অনেকদিবস হইতে খালি ছিল। সেখানকার প্রত্যেক ঘরেরই বারান্দার দিকে দুইটী করিয়া দরজা আছে মাত্র। কোন কোন ঘরের মধ্যে এক ঘর হইতে অপর ঘরে যাতায়াত করিবার নিমিত্ত একটী একটী দরজা আছে। কোন ব্যক্তি দুইটী ঘর একত্র গ্রহণ করিলে উভয় ঘরের মধ্য দিয়া যাতায়াতের নিমিত্ত প্রায়ই সেই দরজা খুলিয়া রাখেন। আর যদি কেবলমাত্র একটী ঘর গ্রহণ করেন, তাহা হইলে সেই দরজা বন্ধ থাকে।

আমি পঁচিশ নম্বরের ঘরের সম্মুখে গিয়া দেখিলাম, উহার বাহিরের দুইটী দরজাই ভিতর হইতে বন্ধ। ছাব্বিশ নম্বরের ঘরেরও একটী দরজা ভিতর হইতে বন্ধ; কিন্তু একটা দরজা খোলা। সেই দরজার উপর একখানি পরদা বোলান আছে। সেই পরদার বাহিরে দ্বারবান সদৃশ একটী লোক বসিয়া আচ্ছে। আমি সেই স্থানে গমন করিয়া প্রথমেই সেই দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মাণিকচাঁদ বাবু নামে কোন ব্যক্তি এই স্থানে আছেন কি? তখন সেই দ্বারবান্ সেই ঘর দেখাইয়া দিয়া উত্তরে আমাকে কহিল, হ মহাশয়! বাবুসাহেব এই ঘরেই থাকেন, তিনি এখন ইহার ভিতরেই আছেন।

দ্বারবানের এই কথা শুনিয়া সেই পরদা ঠেলিয়া আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, মাড়োয়ারীগণ সর্বদা যেরূপ স্থানে বা যেরূপ ভাবে বসিয়া আপন আপন কার্য নির্বাহ করিয়া থাকেন, ইনি কিন্তু সেরূপ ভাবে বসিয়া আপন কার্যে প্রবৃত্ত নহেন। ঘরের মেঝের উপর কোনরূপ বিছানা বা যেরূপ ভাবে মাড়োয়ারীগণ গদি বিছাইয়া তাহার উপর উপবেশন করেন, সেই ঘরের ভিতর সেইরূপ ভাবের কোন দুবাই নাই। যাহা আছে, তাহা মাড়োয়ার-পদ্ধতির সম্পূর্ণরূপ বিপরীত। সেই ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একখানি টেবিল রহিয়াছে, একখানি চেয়ারে বসিয়া মাণিকচাঁদ সেই টেবিলের উপর কাগজ-পত্র বিছাইয়া লেখাপড়া করিতেছেন, এবং তাহার বাম ও দক্ষিণ দুই পার্শ্বে দুইখানি খালি চেয়ার রাখা আছে।

টেবিলের উপর যে সকল কাগজ-পত্ৰ ছড়ান রহিয়াছে, তাহার মধ্যে মাডােয়রীদিগের ব্যবহার-উপযোগী কোনরূপ খাতা পত্র নাই, কতকগুলি সাদা ও লেখা ফুলিকেপ কাগজ।

আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকচাঁদ বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তখন তিনি সবিশেষ অভ্যর্থনা করিয়া আমাকে তাঁহার বামপার্শ্বের চেয়ারের উপর বসাইলেন। তাহার নির্দেশানুসারে আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কতক্ষণ এখানে আগমন করিয়াছেন?

আমি। এখনই আসিতেছি।

মাণিক। আমার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হয় নাই ত?

আমি। কোন কষ্ট হয় নাই; কারণ, এই স্থান আমি উত্তমরূপে চিনি। সুতরাং আপনার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই।

মাণিক। আপনি এ পর্যন্ত কিছু ঠিক করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?

আমি। আমার চাকরী করা সম্বন্ধে?

মাণিক। হাঁ।

আমি। স্থির না করিলে আর আমি এ স্থানে আসিব কেন?

মাণিক। কি স্থির করিলেন, আমাদিগের নিকট চাকরী করা স্থির করিলেন, কি পূৰ্ব্ব হইতে যে স্থানে চাকরী পাইয়াছেন, সেই স্থানেই গমন করাই স্থির হইল?

আমি। না মহাশয়! আমি আর সেই স্থানে গমন করিতেছি। আপনাদিগের অধীনেই চাকরী করাই আমি স্থির করি য়াছি। এখন কোন্ সময় হইতে এবং কোথায় আমাকে কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইতে হইবে, তাহা আপনি আমাকে বলিয়া দিন, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হই।

মাণিক। আমি পূৰ্বেই বলিয়াছি, কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া আপাততঃ আপনাকে কোন স্থানেই গমন করিতে হইবে না। এই স্থান হইতেই সমস্ত কাৰ্য্য নিৰ্বাহ হইবে; কেবলমাত্র মফঃস্বলের যখন যে স্থানে আমাদিগের মনিব একটী করিয়া শাখা-ব্যবসায় স্থাপন করিবেন, সেই সময় কেবলমাত্র একবার সেই স্থানে গমন করিলেই চলিবে। তৎপরে সেই স্থানের কার্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, পুনরায় আপনি এই কলিকাতায় আগমন করিবেন।

আমি। কোন্ তারিখ হইতে আমি এই কার্যে নিযুক্ত হইব?

মাণিক। অদ্য হইতেই আপনি আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইলেন। বেতন অদ্য হইতে আপনি পাইবেন; কিন্তু নিয়োগ পত্র আজ আমি আপনাকে প্রদান করিতেছি না। আপনি কল্য এই সময় একবার এখানে আগমন করিবেন, সেই সময়ে আমাদিগের কার্যের নিয়ম অনুসারে আমি আপনাকে একমাসের অগ্রিম বেতন সহ আপনার নিয়োগ-পত্র আপনাকে প্রদান করিব, এবং আপাততঃ আপনাকে কি কি কাৰ্য্য করিতে হইবে, তাহাও আপনাকে বলিয়া দিব। বোম্বাই সহরের যে মহাজনের নিকট আপনি চাকরী পাইয়াছিলেন, তাহার লিখিত যে সকল চিঠিপত্র আপনার নিকট আছে, এবং নূতন কার্যে নিযুক্ত হইবার যে নিয়োগ-পত্ৰ আপনি প্রাপ্ত হইয়াছেন, কল্য যে সময় আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, সেই সময় সেই সকল আপনার সঙ্গে করিয়া আনিবেন।

আমি। সে গুলিতে আপনার প্রয়োজন?

মাণিক। প্রয়োজন আছে বলিয়াই বলিতেছি। আনিলেই দেখিতে পাইবেন।

আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে।

এই বলিয়া আমি সে দিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, আপন স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একবার মনে করিলাম, আমার নিয়োগ-পত্ৰ বা চিঠিপত্রে উহার প্রয়োজন কি? কেন আমি সেই সকল দ্রব্য তাহার নিকট লইয়া যাইব। আবার ভাবিলাম, আমি যে অপর স্থানে চাকরী সংগ্রহ করিতে পারি য়াছি, তাহা হয় ত তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করেন নাই, এই নিমিত্তই সেই কাগজ দেখিতে চাহিয়াছেন। আমি তাঁহার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছি, তাহা প্রকৃত, কি মিথ্যা, তাহাই মাণিকচাঁদ বাবু, বোধ হয়, জানিতে চাহেন। সে যাহাই হউক, সেই সকল কাগজ-পত্র তাহাকে দেখাইতে আমি কোনরূপ অনিষ্ট-জনক বলিয়া বুঝিতে পারিতেছি না।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পরদিবস আমি আমার নিয়োগ পত্রের সহিত পুনরায় সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, দ্বারবান্ সেইরূপ ভাবেই বসিয়া আছে, মাণিকচাঁদ বাবু সেই স্থানে সেইরূপ ভাবে বসিয়া সবিশেষ মনোযোগর সহিত আপন কাৰ্যে নিযুক্ত আছেন।

পূৰ্ব দিবসের ন্যায় আমি মাণিকচাঁদ বাবুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলে, তিনি আমাকে সেই চেয়ারের উপর উপবেশন করিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি তাহার হস্তস্থিত লেখনী সেই টেবিলের উপর রাখিয়া আমার দিকে একটু ঘূরিয়া বসিলেন ও আমাকে কহিলেন, কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন ত?।

আমি। হাঁ মহাশয়! সে কথা আমি গত কল্যই ত আপনাকে বলিয়াছি।

মাণিক। আমি যে সকল কাগজ-পত্ৰ আনিতে বলিয়া ছিলাম, তাহা আপনি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন, না ভুল-ক্রমে আপনার বাসায় রাখিয়া আসিয়াছেন?

আমি। না মহাশয়! আমি ভুল-ক্রমে উহা রাখিয়া আসি নাই, সঙ্গে করিয়াই আনিয়াছি। উহা আমি আপনার হস্তে এখনই প্রদান করিব কি?

মাণিক। না, এখন নয়, একটু অপেক্ষা করুন। যখন আমার প্রয়োজন হইবে, তখনই আপনি উহা আমাকে প্রদান করিবেন। এখন আপনি আপনার অগ্রিম বেতন গ্রহণ করিয়া আপনার কাৰ্যে নিযুক্ত হউন।

এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ তাহার টেবিলের দেরাজ হইতে দশখানি দশ টাকা হিসাবের নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, এই নিন্ মহাশয়! আপনার অগ্রিম বেতন।

আমি। নোট দশখানি আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া কহিলাম, ইহার নিমিত্ত আমার কোনরূপ রসিদ দিতে হইবে কি?

মাণিক। না, বেতনের টাকা পাইলেন, তাহার আর রসিদ কি? দেখি, আপনি কি কাগজ-পত্ৰ আনিয়াছেন।

মাণিকচাঁদের এই কথা শুনিয়া আমার নিয়োগ-পত্ৰখানি ও একখানি চিঠি যাহা আমি বোম্বাই হইতে কয়েকদিবসমাত্র অগ্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা তাহার হস্তে প্রদান করিলাম।

মাণিকচাঁদ নিয়োগ-পত্রখানি ও চিঠিখানি একবার পড়িয়া দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, আপনি এই পত্রের উত্তর লিখিয়াছেন কি?

আমি। না।

মাণিক। নিয়োগ-পত্রখানি পাইবার পর, কোন পত্র লিখিয়াছেন?

আমি। না, সর্বপ্রথমে আমি যে একখানি দরখাস্ত করিয়া ছিলাম, তদ্ব্যতীত আমি আর কোন পত্রাদি সেই স্থানে লিখি নাই।

মাণিক। এখন এই পত্রের উত্তর আপনাকে প্রদান করা। কৰ্ত্তব্য।

আমি। উত্তর আর কি লিখিব?

মাণিক। কেন, আপনি সেই চাকরী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক নহেন, একথা লিখিয়া দেওয়া উচিত নয় কি?

আমি। না লিখিলেই বা ক্ষতি কি? আমি সেই স্থানে গমন না করিলেই, তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আমি সেই কাৰ্য করিতে প্রস্তুত নহি। তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিয়া লইতে পারিবেন।

মাণিক। না, উহা কৰ্তব্য বা ভদ্রোচিত ব্যবহার নহে। কাগজ, কলম প্রভৃতি সমস্তই আপনার সম্মুখে পড়িয়া রহিয়াছে, এখনই একখানি পত্র লিখিয়া ডাকে ফেলিয়া দিন। আপনার পত্র পাইয়া যখন তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আপনি তাহাদিগের চাকরী করিতে অভিলাষী নহেন, তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হইবেন। নতুবা তাহাদিগের কার্যের সবিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা।

মাণিকচাঁদের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, তিনি যাহা বলিতে ছেন, তাহা নিতান্ত যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং এ সম্বন্ধে তাহাকে আর কিছু না বলিয়া, তাহারই টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ লইয়া, সেই স্থানেই বসিয়া আমি একখানি পত্র লিখিলাম। সেই পত্রে অধিক কোন কথা লিখিলাম না, কেবল এইমাত্র লিখিলাম, আপনারা অনুগ্ৰহ করিয়া আপনাদিগের ফারমে যে একটী চাকরী প্রদান করিয়াছিলেন, আমি আপাততঃ সেই চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছি না। আপনারা আমাকে যে বেতন প্রদানে সম্মত আছেন, তাহায় দ্বিগুণ বেতনে আমি এই স্থানেই একটা চাকরী প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং আপনা দিগের প্রদত্ত চাকরী গ্রহণ করিতে পারিলাম না বলিয়া, আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন।

পত্র লেখা সমাপ্ত হইলে মাণিকষ্টাদ একখানি অর্ধ আনা মূল্যের খাম আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই খামের ভিতর আমার লিখিত পত্রখানি পূরিয়া উহাতে শিরোনাম লিখিয়া সেই টেবিলের উপর রাখিলাম। টেবিলের উপর একটা পাত্রে একটু জল রাখাছিল, মাণিকচাঁদ নিজে তাঁহার অঙ্গুলিতে একটু জল লইয়া আমার সম্মুখে উহা বন্ধ করিয়া দিলেন, এবং আমাকে কিছু না বলিয়া তাহার দ্বারকে ডাকিলেন। সে পূর্ব্ব হইতে সেই ঘরের বাহিরে বসিয়াছিল, ডাকিবামাত্র সে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। মাণিকচাঁদ বাবু আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই পত্রখানি সেই দ্বারবানের হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, এই পত্রখানি এখনই তুমি ডাকঘরে দিয়া আইস।

দ্বারবান্ দ্বিরুক্তি না করিয়া, সেই পত্র হস্তে দ্রুতপদে সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সে দিবস আর যতক্ষণ আমি সেই স্থানে ছিলাম, তাহার মধ্যে সেই দ্বারবানকে আমি আর দেখিতে পাইলাম না।

দ্বারবান্ প্রস্থান করিলে পর, মাণিকচঁদ বাবু আমার প্রদত্ত সেই নিয়োগ-পত্র ও বোম্বাইয়ের যে পত্রখানি আমি তাহার হস্তে প্রদান করিয়াছিলাম, তাহা তিনি তাঁহার টেবিলের দেরাজের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন, এবং আমাকে কহিলেন, এগুলি এখন আমার নিকট রহিল।

মাণিকচাঁদ বাবুর এই কথার কোনরূপ উত্তর দিবার পূর্বেই তিনি কহিলেন, এখন আমি অতিশয় ব্যস্ত; আপনি এখন আপনার বাসায় গমন করিতে পারেন। আপনাকে আমি একটা কাৰ্য্য প্রদান করিতেছি, যে কয়দিবসে পারেন, সেই কাৰ্য্যটা আপনি সম্পন্ন করুন। চারিদিবস পরে একবার আপনি এই স্থানে আসিয়া আমাকে বলিয়া যাইবেন যে, সেই কাৰ্য কতদূর পর্যন্ত আপনি সম্পন্ন করিতে পারগ হইয়াছেন। সবিশেষ তাড়াতাড়ি করিবার প্রয়োজন নাই।

আমি। কি কাৰ্য্য করিতে হইবে?

মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ নগরে আমাদিগের শাখা-কাৰ্য্যস্থান করিবার প্রয়োজন, তাহারই একটা তালিকা প্রস্তুত করুন। তাহার পর আর যাহা যাহা করিতে হইবে, তাহা আমি পরে বলিব।

আমি। আমি কিরূপে সেইরূপ তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইব?

মাণিক। কেন, আপনি বহুদিবস পৰ্য্যন্ত কলিকাতায় থাকিয়া। একটী ভাল ফারমেই কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছিলেন। সেই ফারমের সহিত বঙ্গদেশের যে যে স্থানের ফারমের কাৰ্য্য ছিল, তাহা আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। সুতরাং একটু চিন্তা করিয়া, আপনি সেই সকল স্থানের একটা তালিকা অনায়াসেই প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইবেন। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতায় আরও অনেক ফারমের কর্ম্মচারীগণের সহিত যে আপনার সবিশেষরূপ আলাপ পরিচয় আছে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আবশ্যক হইলে আপনি তাহাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।

আমি। আচ্ছা তাহাই হইবে। আপনার আদেশানুযায়ী একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া, চারিদিবস পরে আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

মাণিক। আমি আপনার উপর যে কাৰ্য করিবার ভার অর্পণ করিলাম, তাহা শুনিতে যেরূপ সহজ বোধ হইতেছে, কার্যে কিন্তু ততদূর সহজ নহে। চারিদিবসের মধ্যেই যে আপনি সেই কাৰ্য্য শেষ করিতে পারিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি যতদূর সম্ভব, সেই কাৰ্য্য করিয়া, চারিদিবস পরে পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। অপর আর কোন্ কোন্ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবার আপাততঃ প্রয়োজন হইবে, তাহাও আমি সেইদিবস আপনাকে বলিয়া দিব।

এই বলিয়া মাণিকচাঁদ আপন কার্যে তাঁহার মন নিযুক্ত করিলেন।

তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমি মনে মনে ভাবিলাম, এ সম্বন্ধে তিনি এখন আর অধিক সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছুক নহেন। সুতরাং তাঁহাকে আর কিছু না বলিয়া, আমি আস্তে আস্তে সেইদিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম, এবং ক্রমে আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

চারিদিবসকাল অনবরত ভাবিয়া-চিন্তিয়া এবং অপর ফারমের আমার পরিচিত অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গদেশের যতগুলি প্রধান প্রধান নগরের নাম সংগৃহীত হইবার সম্ভাবনা, তাহা সংগ্রহ করিয়া, তাহার একটী তালিকা প্রস্তুত করি লাম। চারিদিবস পরে, অর্থাৎ পঞ্চমদিবসে আমি সেই তালিকা সহ পুনরায় রাজার কাটুরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে ইতিপূর্বে মাণিকচাঁদকে আমি যেরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইয়া ছিলাম, আজও দেখিলাম, তিনি সেই স্থানে সেইরূপ অবস্থায় বসিয়া কাৰ্য্য করিতেছেন। তাহার দ্বারবানও সেইরূপে ঘরের বাহিরে বসিয়া রহিয়াছে।

আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই তিনি আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি কহিলেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার হাতের কাৰ্যটী শেষ করিয়া, আপনার সহিত কথোপকথনে নিযুক্ত হইতেছি। এই বলিয়া তিনি আপনার কাৰ্য্যে মনোনিবেশ করিলেন, আমি সেই স্থানে স্থিরভাবে বসিয়া রহিলাম। এইরূপে প্রায় একঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইলে পর, তিনি আপনার হস্তস্থিত কলম সেই স্থানে রাখিয়া আমার দিকে চাহিলেন ও কহিলেন, এখন আমি আপনার কথায় মনোনিবেশ করিতে প্রস্তুত; বলুন, এখন আমাকে কি করিতে হইবে?

আমি। আপনাকে এখন কিছুই করিতে হইবে না। আপনি আমাকে একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন, তাই আমি অদ্য আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।

মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের শাখা-কাৰ্যালয় খুলিতে হইবে, তাহারই তালিকা?

আমি। হাঁ।

মাণিক। প্রস্তুত হইয়াছে?

আমি। একরূপ প্ৰস্তুত করিয়া আনিয়াছি।

মাণিক। এত অল্প সময়ের মধ্যে এরূপ একটী কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন? অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া না দেখিলে, এরূপ তালিকা সহজে কোনরূপে প্রস্তুত হইতে পারে না। সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে আমি আপনাকে দশদিবস সময় প্রদান করিয়াছিলাম না?

আমি। না মহাশয়! আপনি আমাকে চারিদিবসমাত্র সময় প্রদান করিয়াছিলেন। তাহারই মধ্যে যতদূর সম্ভব, আমি একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি। আপনি একবার দেখিলেই জানিতে পারিবেন যে, সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইতে পারিয়াছি কি না?

এই বলিয়া আমার আনীত তালিকাখানি মাণিকদের হস্তে প্রদান করিলাম।

মাণিকচাঁদ সেই তালিকাখানি একবার আদ্যোপান্ত দেখিয়া কহিলেন, এই তালিকায় আপনি অনেকগুলি নাম লিখিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমার বিশ্বাস, বঙ্গদেশের মধ্যে ইহা অপেক্ষাও কারবারের অনেক ভাল ভাল স্থান আছে, সেই স্থানগুলিও আপনি যদি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই ভাল হয়। আমি আপনাকে আরও দশদিবসের সময় প্রদান করিতেছি, একটু সবিশেষ চেষ্টা করিয়া সেই দশদিবসের মধ্যে যাহাতে আপনি এই কাৰ্যটী সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিবেন। আর অন্য হইতে একাদশ দিবসের দিন আপনি পুনরায় আমার নিকট আগমন করিয়া, আপনার প্রস্তুত করা তালিকাখানি আমাকে প্রদান করিবেন। সেইদিবস হইতেই সেই সকল স্থানে শাখা-কাৰ্য্যালয় সকল স্থাপন করিতে যেরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা আমি করিব। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা কাৰ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহা স্থির করিবার নিমিত্ত আর যেন অধিক সময় ব্যয় না হয়। এই দশদিবসের মধ্যেই যেন সমস্ত কাৰ্য শেষ হয়।

আমি। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করিলে চলিতে পারে, অনেক ভাবিয়া এবং অনেক অনুসন্ধান কধিয়া, তাহা ত আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর যে সকল কারবার-উপযোগী স্থান আছে, তাহা জানিয়া লইতে দশদিবসের প্রয়োজন হইবে না, দুই চারিদিবসের মধ্যেই আমি উহা স্থির করিয়া লইতে পারি।

মাণিক। সে উত্তম কথা। যে কাৰ্য্য আপনি আর চারিদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে পারিবেন বলিয়া আপনার বিশ্বাস, সেই কাৰ্য্য দশদিবসের মধ্যে যে সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিবেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি এত কার্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, দশদিবসের মধ্যে আমি কোনরূপেই অপর কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইব না। একাদশ দিবসে ঠিক এই সময় আপনি এখানে আগমন করিবেন, সেইদিবস আমি সমস্ত স্থির করিয়া লইব।

যেরূপ আদেশ পাইলাম, কাৰ্যেও আমি সেইরূপ করিলাম। দেখিয়া শুনিয়া আরও কতকগুলি ভাল ভাল স্থানের নাম বাহির করিয়া দুই তিনদিবসের মধ্যে একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকাখানি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেলে, আমি ভাবিলাম, একবার রাজার কাটুরায় গিয়া মাণিকচাঁদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসি। দেখি, তিনি সেই তালিকা সম্বন্ধে আর কোনরূপ নূতন কথা বলেন কি না?

এই ভাবিয়া আমি পঞ্চমদিবসের দিন পুনরায় সেই রাজার কায় গমন করিলাম; কিন্তু সে দিবস মাণিকচাঁদ বা তাহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইলাম না। দেখিলাম, ঘর তালাবদ্ধ। পুনরায় তাহার পরদিবস গমন করিলাম, সে দিবসেও সেইরূপ তালাবন্ধ দেখিলাম। এইরূপে দশমদিবস পর্যন্ত প্রত্যহ একবার করিয়া সেই স্থানে গমন করিতে লাগিলাম; কিন্তু একদিবসের নিমিত্তও মাণিকচাঁদ বা তাহার দ্বারবানের সহিত সাক্ষাৎ হইল না। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া মনে করিলাম, কোন কাৰ্যবশতঃ হয় ত মাণিকা স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন, অথবা তাঁহার কোনরূপ শারীরিক অসুস্থতা উপস্থিত হইয়াছে।

একাদশ দিবসের দিন পুনরায় সেই স্থানে গমন করিলাম। পূর্বে যেরূপ ভাবে মাণিকচাঁদ এবং তাহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইয়াছিলাম, আজ উভয়কেই সেইরূপ ভাবে দেখিলাম। দেখি লাম, দ্বারবান্ সেই ঘরের দরজায় বসিয়া আছে, আর মাণিকচাঁদ ঘরের ভিতর বসিয়া লেখাপড়ায় নিযুক্ত আছেন।

আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকচাঁদ পূর্বের ন্যায় আমাকে বসিবার স্থান প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে উপ বেশন করিলে, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন মহাশয়! আপনার উপর আমি যে কাৰ্যের ভার অর্পণ করিয়াছিলাম, তাহা শেষ করিতে পারিয়াছেন কি?

উত্তরে আমি কহিলাম, সে কাৰ্য্য আমার অনেকদিবস শেষ হইয়া গিয়াছে। আমি তাহার একটা সম্পূর্ণ তালিকাও প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি। এই বলিয়া আমি যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া একবার আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, আমার বোধ হইতেছে, আপনি যে তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহাতেই আপাততঃ আমাদিগের কাৰ্য্য চলিতে পারিবে। অছ এই তালিকাখানি আমার নিকট থাকুক, সময়মত আমি উহা একবার আদ্যোপান্ত দৈখিয়া রাখিব। আপনি কল্য পুনরায় আগমন করিবেন, সেই সময় উভয়ে পরামর্শ করিয়া, যে যে স্থানে শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করা বিবেচনা-সিদ্ধ হয়, সেই সেই স্থানে কাৰ্যালয় স্থাপন করিবার বন্দোবস্ত করা যাইবে। এই বলিয়া, সেই তালিকাখানি মাণিক্তচাদ আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন। আমিও আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম।

পরদিবস পুনরায় রাজার কাটায় গমন করিয়া দেখিলাম, মাণিকটা পূর্বের ন্যায় আপন আফিসে বসিয়া কৰ্ম্ম-কাৰ্য্য করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তিনি নিতান্ত দুঃখভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, আমি বড়ই দুঃখের সহিত আপনাকে বলিতেছি যে, আপনি এত পরিশ্রম ও এত সময় নষ্ট করিয়া যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়াছেন, এবং যাহা গত কল্য আমার নিকট রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা যে আমি কোথায় ফেলিয়াছি, আমি তাহার কিছুই সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হই তেছে, আপনাকে পুনরায় সেইরূপ আর একখানি তালিকা প্রস্তুত করিতে হইবে।

মাণিকদের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, তালিকাখানি দৈবাৎ হারাইয়া গিয়াছে বলিয়া আপনাকে সবিশেষ চিন্তিত হইতে হইবে না। আমি যে তালিকাখানি আপনাকে প্রদান করিয়া ছিলাম, তাহার একখানি নকল আমার নিকট আছে; যদি অনু মতি করেন, তাহা হইলে এখনই আনিয়া আমি উহা আপনাকে প্রদান করিতে পারি।

আমার কথার উত্তরে মাণিকচাঁদ কহিলেন, আপনি যে সেই তালিকার একটী নকল রাখিয়াছেন, ইহা শুনিয়া আমি সবিশেষ রূপে সন্তুষ্ট হইলাম। আপনাকে পরিশ্রম করিয়া উহা এখনই আনি বার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কল্য আপনি উহা লইয়া আমার নিকট এই সময় আসিবেন। এই বলিয়া মাণিকচাঁদ, সেই দিবসও আমাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিলেন।

আমার নিকটে যে তালিকাখানি ছিল, তাহার একটী নকল প্রস্তুত করিয়া মাণিকচাঁদের আদেশ-অনুযায়ী সেই তালিকাখানি সঙ্গে লইয়া পরদিবস পুনরায় তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই লাম। সেই দিবস তিনি আমার সহিত উত্তমরূপে কোন কথা কহিলেন না, কেবলমাত্র আমার নিকট হইতে তালিকাখানি গ্রহণ করিলেন, এবং এইমাত্র কহিলেন, অন্ত আমার শরীর একটু

অসুস্থ বোধ হইতেছে। তালিকাখানি এখন আমার নিকট থাকিল, আমি সময়মত উহা দেখিয়া রাখিব। আপনি চারিদিবস পরে পুনরায় আসিবেন, সেই দিবস সমস্ত কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিব।

আমি তাহারই আদেশ-অনুযায়ী চারিদিবস পরে, অর্থাৎ গত কল্য তাহার নিকট পুনরায় গমন করিয়াছিলাম। কল্যও তিনি আমাকে এই বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছেন, আমি সেই তালিকাখানি এখন পর্যন্তও উত্তমরূপে দেখিয়া উঠিতে পারি নাই। আপনি পরশ তারিখে পুনরায় আগমন করিবেন, সেই দিবস উল্লিখিত কাৰ্য্যের সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব।

মহাশয়! আমি আমার এই চাকরীর অবস্থা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমি প্রতিদিন মাণিকচাঁদ কর্তৃক কার্যে নিযুক্ত হইতেছি, বা কোনরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইবার পথ প্রসারিত করিতেছি; তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই নিমিত্ত মামি আপনার পরামর্শ লইবার মানসে আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, এবং এ পর্যন্ত যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা যতদূর সম্ভব আমি মনে করিতে পারিয়াছি, তাহা আপনার নিকট আমি বিবৃত করিলাম। এখন মাণিকচাঁদের আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে, অর্থাৎ আগামী কল্য পুনরায় আমাকে সেই স্থানে যাইতে হইবে। এরূপ অবস্থায় আপনি আমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, সেই উপদেশই আমি শিরোধার্য করিয়া, আপনার আদেশমত কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

বালমুকুনের কথাগুলি আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাহার কথাগুলি শেষ হইয়া গেলে, আমি সমস্ত অবস্থাগুলি একবার উত্তমরূপে ভাবিয়া দেখিলাম; কিন্তু ভাবিয়া চিত্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, যে ব্যক্তি অগ্রিম বেতন একশত টাকা প্রদান করিয়াছে, অথচ বালমুকুনের নিকট হইতে একটামাত্র পয়সাও গ্রহণ করে নাই, সে যে উহার সহিত জুয়াচুরি করিতেছে, একথা কিরূপেই বা বিশ্বাস করিতে পারি? অথচ যে ব্যক্তি নিজ হইতে অগ্রিম বেতন দিয়া বালমুকুনকে তাহার কার্যে নিযুক্ত করিয়াছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহাকে কোন কার্যে নিযুক্ত না করিয়া সামান্য সামান্য কাৰ্য্যের ভান করিয়া কেবলমাত্র সময় অতিবাহিত করি তেছেন, তাঁহার মনে একবারেই যে কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই, তাহাও সহজে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে না। অথচ ইহার ভিতর একটী নূতন কথাও শুনিতেছি। এ পর্যন্ত আমি কখন শুনি নাই যে, সরকারী বা ব্যবসাদারী কোন আফিসে কি কোন ফারুমে প্রত্যেকমাসে অগ্রিম বেতন দেওয়ার নিয়ম আছে। এরূপ অগ্রিম বেতন প্রদান করার অর্থই বা কি, তাহাও বুঝিয়া উঠা নিতান্ত সহজ নহে। যে ব্যক্তি মাণিকচাঁদ নামে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিতেছে, সে লোকটাই বা কে, তাহা একবার দেখিলে কোন ক্ষতি নাই। তাহাকে স্বচক্ষে দেখিলে ও তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও, সে যে কি চরিত্রের লোক, অথবা ইহার মধ্যে তাহার কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহাও বোধ হয়, অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারিবে।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি বালমুকুকে কহিলাম, আপনি যাহা যাহা কহিলেন, তাহার সমস্ত আমি শ্রবণ করিয়াছি। কিন্তু কি নিমিত্ত যে, এইরূপ বন্দোবস্ত হইতেছে, তাহার কিছুই আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, আমি যদি স্বচক্ষে তাহাকে একবার দেখিতে পাই, এবং তাহার সহিত দুই চারিটী কথাবার্তা কহিতে পাই, তাহা হইলে তাহার সম্বন্ধে আমি অনেকটা মতামত প্রকাশ করিতে সমর্থ হইব।

বালমুকুন্। আমি ত কল্য পুনরায় সেই স্থানে গমন করিব। আপনি কেন একবার সেই সময় আমার সহিত চলুন না? তাহা হইলে ত তাহার সহিত আপনার অনায়াসেই সাক্ষাৎ হইতে পারিবে?

আমি। আমি কি বলিয়া সেই স্থানে গমন করিব? আর যদি আমাকে তাহার সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে না দেয়?

বালমুকুন। প্রবেশ করিতে না দিবার ত কোন কারণ দেখি তেছি না। আজকাল আমি বিনা-সংবাদে যেমন একবারে তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করি, কল্যও সেইরূপ ভাবে একবারে তাহার সেই ঘরের ভিতর চলিয়া যাইব। আপনিও কাহাকেও কিছু বলিয়া, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবেন। তাহা হইলেই তাহার সেই ঘরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত নিষেধ করিতে সে আর কোনরূপে সময় পাইবে না। সুতরাং অনায়াসেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।

আমি। আচ্ছা, যেন তাহাই হইল, আমি আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মাণিকচাঁদের ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তাহার পর, যখন সে জিজ্ঞাসা করিবে, আমি কে, এবং কি নিমিত্তই সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তখন আমি তাহাকে কি উত্তর প্রদান করিব?

বালমুকুন্। উত্তর করিবার আর ভাবনা কি? আপনাকে কোন কথা কহিতে হইবে না, আমিই তাহার কথার উত্তর প্রদান করিব। আমি কহিব, ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু। তাই ইনি আমার নূতন মনিবের সহিত আলাপ-পরিচয় করিবার মানসে আমার সহিত আগমন করিয়াছেন।

আমি। এরূপ পরিচয় প্রদান করিলে চলিবে না। কারণ, তাহার মনে যদি প্রকৃতই কোনরূপ দুরভিসন্ধি থাকে, এবং আমার সহিত কথাবার্তা কহিতে তাহার আন্তরিক ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে এক কথাতেই তিনি আমাকে বিদায় করিয়া দিতে পারেন। তাহা হইলে আমরা কিরূপে আমাদিগের অভিসন্ধি পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব?

বালমুকুন্। এক কথায় তিনি আমাদিগকে কিরূপে বিদায় করিবেন?

আমি। তিনি অনায়াসেই বলিতে পারেন, এখন আমি নানানরূপ কাৰ্যগতিতে অতিশয় ব্যস্ত; সুতরাং এই সময় আপনার বন্ধুর সহিত যে দুইদণ্ডকাল কথাবার্তা কহিব, বা তাহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিব, সে সময় ত এখন আমার নাই। আমার অবকাশমত সংবাদ পাঠাইয়া দিলে, তিনি যেন অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক একবার আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় আমি অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত ইহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিতে সমর্থ হইব। এরূপ প্রথমেই যদি তিনি বলিয়া ফেলেন, তাহা হইলে বলুন দেখি, আমি আর কতক্ষণ সেই স্থানে দাড়াইতে পারিব? তখনই আমাকে তাহার সেই ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে হইবে।

বালমুকুন্। তাহা ত প্ৰকৃত। তাহা হইলে এখন অন্য কি উপায় অবলম্বন করিলে, আপনাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারি? আপনি সে বিষয়ে কিরূপ পরামর্শ দেন?

আমি। আমার বোধ হয়, এক উপায় অবলম্বন করিলে, তাহার সহিত দুই চারিটী কথা হইলেও হইতে পারে।

বালমুকু! কি উপায়?

আমি। আপনি যেরূপ কহিলেন, সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, আমি আপনার সহিত তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিব। আমি কে, জিজ্ঞাসা করিলে, আপনি তাহাকে এই বলিতে পারেন, ইনি আমার একজন বন্ধু, এবং ব্যবসা-কাৰ্যে ইনি অতিশয় পারদর্শী; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন। বঙ্গদেশের নানাস্থানে যে সকল শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহার নিমিত্ত যে অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহারই নিমিত্ত আমি ইহাকে আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি, ইহাকে আপনি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখুন, এবং ইহার দ্বারা কাৰ্যনিৰ্বাহ হইতে পারিবে, এরূপ যদি আপনি বিবেচনা করেন, তাহা হইলে ইহাকে আপনি অনায়াসেই নিযুক্ত করিতে পারেন। ইহাকে বিশ্বাস করা, বা ইহার হস্তে অর্থাদি প্রদান করা সম্বন্ধে কোনরূপ চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই, সে সম্বন্ধে আমি নিজেই উহার জামিন থাকিতে প্রস্তুত আছি।

আমার বিবেচনায় যদি আপনি তাহাকে এইরূপে আমার পরিচয় প্রদান করেন, তাহা হইলে হয় ত তিনি আমার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও কহিতে পারেন। আর যদি ইহাতেও তিনি আমার সহিত কোনরূপ আলাপ-পরিচয় না করেন, তাহা হইলে তখন উপস্থিত মত যেরূপ বিবেচনা হয়, সেইরূপই করা যাইতে পারিবে।

আমার কথা শুনিয়া বালমুকুন্ কহিল, আচ্ছা মহাশয় তাহাই হইবে; আপনি যেরূপ বলিলেন, আমি সেইরূপই করিব। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনাকে কল্য আমার সহিত গমন করিতেই হইবে। কল্য যে সময় আমি তাহার নিকট গমন করিব, তাহার পূর্বে আমি আপনার নিকট আসিয়া, আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আপনার ন্যায় কোন ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য না করেন, তাহা হইলে ইহার প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়া লওয়া আমাদিগের ন্যায় ব্যক্তির কাৰ্য্য নহে।

এরূপ কাৰ্য যদিও আমাদিগের কর্তব্য কাৰ্যের মধ্যে পরিগণিত নহে; তথাপি ইহার ভিতর কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহা জানিয়া লইবার নিমিত্ত আমারও ইচ্ছা হইল। যাহা হউক, পরদিবস তাহার সহিত গমন করিয়া, তাহাকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

পরদিবস সময় মত বালমুকুন্ আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন, আমিও তাঁহার সহিত রাজার কাটায় গমন করিলাম। বালমুকুন পূর্বে আমার নিকট যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, সেই স্থানে গমন করিয়া আমিও সেইরূপ দেখিতে পাইলাম। দেখি লাম, বাস্তবিকই তাহার ঘরের সম্মুখে পরদার বাহিরে দ্বারবান্ বেশী একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। বালমুকুন পূর্বের পরামর্শানু যায়ী সেই দ্বারবানকে কিছু না বলিয়া, সেই পরদা উঠাইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর গমন করিলাম। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, যে ব্যক্তি মাণিকচঁদ বলিয়া পূর্বে বালমুকুনকে আত্ম-পূরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তিনি সেই গৃহের মধ্যে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত অবস্থায় আপন কার্যে অতি মনোযোগের সহিত রত রহিয়াছেন। টেবিলের উপর কতকগুলি কাগজ-পত্ৰ ছড়ান রহিয়াছে; কিন্তু তিনি সেই সকল কাগজ-পত্র সইয়া যে কোনরূপ কাৰ্য্য করিতেছেন, তাহা আমার বোধ হইল না। আমার বোধ হইল, তিনি একখানি পত্র লিখিতেছেনমাত্র। পত্র লিখিতেছেন সত্য; কিন্তু মধ্যে মধ্যে তাঁহার সম্মুখস্থিত একখানি সংবাদপত্রের দিকে এক একবার লক্ষ্য করিতেছেন। সংবাদপত্রখানি দেখিয়া বোধ হইল, উহা এদেশীয় সংবাদপত্র নহে, বোম্বাই প্রদেশের কোন একখানি সংবাদপত্র; কিন্তু ইংরাজীতে লেখা।

আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, যে পত্রখানি তিনি লিখিতেছিলেন, তাহা নিতান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ছিড়িয়া সেই স্থানে ফেলিয়া দিলেন, এবং সংবাদপত্রখানির উপর অপর কতক গুলি কাগজ-পত্র স্থাপিত করিয়া আমাদিগের দিকে একবার লক্ষ্য করিলেন ও কহিলেন, কে? বালমুকুন্ আসিয়াছ? তোমার সঙ্গে এই যে বাবুটী আসিয়াছেন, ইনি কে?

মাণিকদের কথার উত্তর করিবার পূর্বেই বালমুকুন্ সেই স্থানে একখানি চৌকির উপর উপবেশন করিলেন, এবং আমাকে আর একখানি চৌকি দেখাইয়া দিয়া, সেই স্থানে আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, বালমুকুন্ মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে কহিলেন, আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু, এবং ব্যবসা-কার্যে ইনি সবিশেষ নিপুণ; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন, ইহার হস্তে কোন কৰ্ম্ম-কাৰ্য নাই। বঙ্গদেশের নানাস্থানে আমাদিগের শাখা-কাৰ্যালয় খুলিতে হইলে, অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, তাই আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। আমি ত ইহাকে সবিশেষ উপযুক্ত লোক বলিয়া জানি। এখন আপনি ইহার সহিত প্রয়োজন মত কথাবার্তা কহিয়া দেখুন, আপনার বিবেচনায় যদি ইনি আমাদিগের কার্যোপযোগী মনে করেন, তাহা হইলে ইহাকেও আপনাদিগের কার্যে নিযুক্ত করিতে পারেন।

বালমুকুনের এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের ব্যবসা কাৰ্য্যে আমাদিগের সহিত মিলিত হইতে ইচ্ছা করেন কি?

মাণিকচাঁদ আমাকে এই কয়েকটী কথা কহিলেন সত্য; কিন্তু আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি তাঁহার অন্তরের ভাব আমার নিকট প্রকাশ করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার মুখ দিয়া তাহার কথা বেশ স্পষ্টরূপে বাহির হইতেছে না, মুখশ্রী যেন বিবর্ণ হইয়া আসিয়াছে, চক্ষুতে যেন স্বাভাবিক জ্যোতিঃ নাই, হস্তপদ যেন অল্প অল্প কাঁপিতেছে। মাণিকচাঁদের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার বেশ প্রতীয়মান হইল, তাহার অন্তরে যেন কোন একটী ভয়ানক ভাবের উদয় হইয়াছে। তিনি মনের সেই ভাব গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু কোনরূপে পারিয়া উঠিতেছেন না।

মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, যখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে প্রতিপালন করিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন, তখন আপনাদিগের নিকট কাৰ্য্য না করিব কেন? আমাকে কি কাৰ্য্য করিতে হইবে আদেশ করুন, অদ্য হইতেই আমি আপনা দিগের কৰ্ম্মে নিযুক্ত হই।

আমার কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি আমাকে কিছু বলিতে চাহিতেছেন, অথচ বলিতে পারিতেছেন না; তাহার মুখ দিয়া তাহার মনের এরূপ ভাব বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে।

একটু চিন্তা করিয়া পরিশেষে তিনি আমাকে কহিলেন, আচ্ছা, আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে এখন আপনি গমন করিতে পারেন। কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের কাৰ্যালয় স্থাপিত করিতে হইবে, তাহা স্থির হইবামাত্রই আমি বালমুকুনের দ্বারা আপনাকে সংবাদ প্রদান করিব। সেই সময় আপনি আসিয়া আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইতে পারিবেন। কেমন বালমুকুন! ইহাই উত্তম পরামর্শ নহে?

বালমুকুন্। আপনি যেমন বিবেচনা করেন।

মাণিক। অদ্য আমি আপনাকে গোপনে দুই চারিটী কথা কহি।

বালমুকুন্। তাহা বলিতে পারেন। ইহার নিকট আমার কোন কথা গোপনীয় নাই, ইনি আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। ইহার সম্মুখেই আমাকে সমস্ত কথা বলিতে পারেন।

মাণিক। ইনি আপনার অতিশয় বিশ্বাসী সত্য; কিন্তু আমার সহিত ইহার সবিশেষরূপ পরিচয় নাই। সুতরাং অদ্য প্রথম দিবসের আলাপের পরই, আমি ইহার সম্মুখে আমাদিগের ব্যবসার সকল কথা বলিতে পারি না।

বালমুকুন্। ইহার সম্মুখে যদি আপনি একান্তই কোন কথা বলিতে সম্মত না হন, তাহা হইলে ইনি একটু এই স্থানে অপেক্ষা করুন, আমি আপনার সহিত কোন নির্জন স্থানে গমন করিতেছি, সেই স্থানে সকল কথা হইতে পারিবে। আপনার পার্শ্বের এই ঘরের ভিতর চলুন না কেন?

এই বলিয়া বালমুকুন্ তাহার কথার উত্তর পাইবার অগ্রেই সেই ঘরের ভিতর গমন করিলেন। মাণিকচাঁদ আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিয়াই তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

মাণিকচাঁদকে দেখিয়াই তাহার উপর অনেক বিষয়ে আমার পূৰ্বেই সন্দেহ হইয়াছিল; আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রথম প্রবেশ করিবার সময় সংবাদপত্রখানি লুকাইয়া রাখায় আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। তিনি বালমুকুনের সহিত অপর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, আমি তাহার টেবিলের উপর হইতে তাহার সেই লুক্কায়িত সংবাদপত্রখানি বাহির করিলাম, এবং উহার দুই একস্থানে লক্ষ্য করিবামাত্রই একটা বিষয়ের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল।

সংবাদপত্রের এই স্থানটী পাঠ করিয়াই আমার মস্তক ঘূরিয়া গেল, আমি যেন চতুর্দিক অন্ধকার দেখিলাম। মনে হইল— আমি যাহার সহিত এই স্থানে আসিয়াছি, তাহার নামই ত বানমুকুন, তিনিই বোম্বাই সহরে সেই প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীর কৰ্ম্মে প্রথমে নিযুক্ত হন। কিন্তু মাণিকচাঁদের কথায় ভুলিয়া তিনি সেই কাৰ্য পরিত্যাগ করেন। আমার আরও মনে হইল, বোম্বাই সহরের এই ভয়ানক চুরি ও হত্যাকাণ্ডের সহিত মাণিক চাদের কোনরূপ সংস্রব নাই ত?

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি যেস্থানে বসিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে নিঃশব্দে গাত্ৰোথান করিলাম, এবং যে ঘরের ভিতর মাণিকচাঁদ ও বালমুকুন্ প্রবেশ করিয়াছিলেন, যতদূর সম্ভব সেই ঘরের নিকটে গমন করিয়া তাঁহাদের মধ্যে কিরূপ কথোপকথন হইতেছিল, তাহা শুনিবার মানসে তাহাদিগের অলক্ষিতে দ্বারের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইলাম।

আমি যেস্থানে দাড়াইলাম, সেই স্থান হইতে উহাদের কথোপকথন উত্তমরূপে শুনা যাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথন আমি যতদূর শুনিতে পাইলাম, তাহার সারমর্ম এইরূপ;–

মাণিক। তুমি আমাকে কেন মিথ্যা বলিতেছ? উনি আমাকে চিনুন বা না চিনুন, আমি উহাকে চিনি; উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী।

বালমুকুন্। না মহাশয়! আমি মিথ্যা বলিব কেন, উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের কর্ম্মচারী নহেন; কিন্তু অনেক পুলিস কর্ম্মচারীর সহিত উহার আলাপ-পরিচয় আছে, এবং অনেক সময় উনি তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া থাকেন। কোন সময় তাহা দেখিয়া বোধ হয়, আপনার এইরূপ ধারণা হইয়াছে।

মাণিক। আমি বুঝিতে পারিতেছি, তুমি প্রকৃত কথা বলিবে, এবং তোমাদিগের মনে যে কি দুরভিসন্ধি আছে, তাহাও প্রকাশ করিবে না। দেখ বালমুকুন্! আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়াছি, আমার সাধ্যমত কিছু উপকারও করিয়াছি, এবং যাহাতে তোমার ভাল হয়, সে বিষয়ও চেষ্টা করিতেছি। এরূপ অবস্থায় ইহা তোমার কর্তব্য কাৰ্য্য যে, আমার নিকট কোন কথা গোপন করিবে না।

বালমুকুন্। আমি আপনার নিকট কি কথা গোপন করিব? আমি আপনার কোন কথাই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনি আমার অন্নদাতা, আপনি আমাকে আপনাদিগের অধীনে একটী কৰ্ম্ম করিয়া দিয়া আমাকে যেরূপ উগকৃত করিয়া ছেন, তাহা কি আমি সহজে ভুলিয়া গিয়া আপনার অনিষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হইব? আর যাহাতে আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হয়, তাহার নিমিত্তই বা আমি কিরূপে চেষ্টা করিতেছি? যে ব্যক্তি কৰ্ম্ম-প্রার্থী, তাহাকে আমি সঙ্গে করিয়া আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি। বিশেষতঃ আপনি অনেক লোকও নিযুক্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আপনার মনে যদি কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয়, তাহা হইলে আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, এখনই আমি উহাকে এই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দিতেছি, এবং উহাকে বলিয়া দিতেছি, এই স্থানে আপনার চাকরী হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।

মাণিক। তুমি এখনও আমাকে এই বলিয়া বুঝাইতে চাই যে, উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী নহেন, এবং আমার কোনরূপ অনিষ্ট করিবার মানসে এখানে আগমন করেন নাই? আমি কিন্তু তাহা বুঝিতে পারি না।

বালমুকুন। ডিটেকটিভ-পুলিস-কর্ম্মচারীগণের সহিত উহার আলাপ-পরিচয় আছে, তাহা আমি জানি; কিন্তু উনি স্বয়ং কৰ্ম্ম চারী কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আপনার কোনরূপ অনিষ্ট-সাধন করিবার মানসে উনি এখানে আগমন করেন নাই। আর যদিই উনি ডিটেটিভ-কর্ম্মচারী হয়েন, তাহা হইলে আপনি এমন কি দুষ্কাৰ্য্য করিয়াছেন যে, উহার দ্বারা আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা?

মাণিক। আচ্ছা, আপনি আপনার বন্ধুর সহিত ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসিতেছি।

মাণিকচাঁদের এই শেষ কথা শুনিয়া, আমি নিঃশব্দে আসিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলাম। বসিবামাত্রই বালমুকুন সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া যেমন আমার নিকট আগমন করিলেন, অমনি আমি তাহাকে কহিলাম, ইহারা হত্যাকারী। আমি মাণিকচাঁদকে যেমন ধৃত করিব, অমনি আপনি দ্বারবানকে ধরিবেন, কোনরূপে যেন আপনার হাত ছাড়াইয়া সে পলায়ন করিতে না পারে। ইহার সমস্ত ব্যাপার পরে আমি আপনাকে বলিতেছি।

বালমুকুনকে এই কথা বলিয়াই আমি সেই গৃহ হইতে দ্রুতপদে বাহির হইলাম। দেখিলাম, আমি মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, মাণিকচাঁদ ঠিক তাহাই করিতেছে। পূৰ্ব্ব-কথিত ঘর, যাহার দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তাহার একটী দরজা খুলিয়া মাণিকচাঁদ সেই স্থান হইতে সবেগে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিতেছে। ইহা দেখিয়াই দ্রুতবেগে আমি গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম, এবং আমার অঙ্গস্থিত উড়ানিদ্বারা তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহারই আফিস-ঘরের ভিতর তাহাকে আনিলাম। বালমুকুনের সাহায্যে দ্বারবানও ধৃত হইল, তাহাকেও উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহার মনিবের নিকট রাখিলাম।

তখন উভয়কেই উত্তমরূপে বাঁধিয়া আমি মাণিকচাঁদকে কহি, লাম, দেখ মাণিকচাঁদ! তুমি যাহা অনুমান করিয়াছিলে, তাহা প্রকৃত; আমি তোমাকে প্রকৃতই ধৃত করিতে আসিয়াছি। সুতরাং এখুন যে কেন তোমাকে ধৃত করিলাম, তাহা তুমি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছ। এখন তুমি আমাকে সমস্ত প্রকৃত কথা বলিতে প্রস্তুত আছ কি না?

মাণিক। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি তেছি না, এবং কেনইবা আপনি আমাদিগকে এরূপে ধৃত করি লেন, তাহারও কিছু অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। যে ব্যক্তি হত্যা করিবার সহায়তা করিতে পারে, ও চুরি করিবার নিমিত্ত নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করিয়া অপরের দ্বারা সেই কাৰ্য্য সমাধা করিয়া লইতে পারে, সে যে কেন ধৃত হইল, তাহা তাহার বুঝিতে না পারিবারই কথা। সে যাহা হউক, তুমি এখন প্রকৃত কথা বলিবে, কি না?

আমার এই প্রকার কথা শুনিয়া বালমুকুন কেবল আমার মুখের দিকেই একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবগতি দেখিয়া অনুমান হইতে লাগিল, আমার এই অবস্থা দেখিয়া বালমুকুন যেন একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছেন, ভালমন্দ কিছুই যেন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। বালমুকুনের এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, আপনি এরূপ বিস্মিত হইতেছেন কেন? ইহারা আপনাকে মধ্যে রাখিয়া একটী ভয়ানক চুরি করিয়াছে, এবং আপন প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে একটী হত্যা করিতেও পরাজুখ হয় নাই।

মাণিক। এ মিথ্যা কথা। ইহা আপনাকে কে বলিল?

আমি। আমাকে অপরে যাহা কিছু বলুক, বা অপর কোন স্থান হইতে আমি যেরূপে সংবাদ পাই, আর না পাই, তোমারই

সংবাদপত্রে কি সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাই কেন একবার পড়িয়া দেখ না। তাহা হইলেই ত আমাকে তোমার আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইবে না। এই বলিয়া মাণিক চাদের টেবিলের উপর যে সংবাদ-পত্ৰখানি আমি প্রাপ্ত হইয়া পাঠ করিয়াছিলাম, সেই সংবাদপত্র হইতে সেই বিষয়টা আমি পাঠ করিলাম। উহার সারমর্ম এইরূপ —

ভয়ানক হত্যা ও অদ্ভুত চুরি।

অপরাধী ধৃত হইয়াছে; কিন্তু কে যে তাহার এই বিষয়ে সবিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছে, তাহার সন্ধান এখনও পর্যন্ত হয় নাই।

বালমুকুন নামক এক ব্যক্তি কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, বোম্বাই সহরের একজন প্রধান ধনীর অধীনে একটী কার্যে নিযুক্ত হয়। চাকরী করা তাহার উদ্দেশ্য ছিল না, তাহার ইচ্ছা, চাকরের ভানে কিছুদিবস সেই স্থানে কাৰ্য্য করিয়া, ধনীর ধনভাণ্ডার প্রভৃতির উত্তমরূপ অনুসন্ধান লয়। এইরূপে সেই মহাজনের কোন্ কোন্ স্থানে কিরূপ অর্থ আছে, তাহা যেমন জানিতে পারিল, অমনি সুযোগমত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালার দ্বারা বন্ধ থাকে, একে একে তাহার সমস্ত চাবি প্রস্তুত করিয়া লয়, এবং সুযোগমত একদিবস রাত্রিকালে সেই সমস্ত তালা খুলিয়া নোট, টাকা, সুবর্ণ-অলঙ্কার ও জহরত আদিতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা অপহরণ করিয়া সমস্ত তালা পুনরায় আবদ্ধ-পূৰ্ব্বক যেমন বাহির হইবার চেষ্টা করে, সেই সময় একজন দ্বারবান্ উহা জানিতে পারিয়া বালমুকুনকে ধরিবার চেষ্টা করে, এবং চোর চোর বলিয়া ভয়ানক গোলযোগ করে। বালমুকুন সেই সময় অনন্যোপায় হইয়া আপনার প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে সেই দ্বারবানের উপর সবিশেষরূপ বলপ্রয়োগ করে; কিন্তু যখন কোনরূপেই তাহার হস্ত হইতে পরিত্রাণ না পায়, সেই সময় একখানি অস্ত্র দ্বারা বালমুকুন্ তাহাকে সাংঘাতিকরূপ আঘাত করিয়া পলায়নের চেষ্টা করে। সেই অস্ত্রখানি বোধ হয়, বালমুকুন সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল। দ্বারবান সেই অস্ত্রাঘাতেই হতজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে পতিত হয়, এবং পরিশেষে ইহজীবন সম্বরণ করে। দ্বারবানকে হত্যা করিয়াও বালমুকুন্ সেই স্থান হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয় নাই, অপরাপর কতকগুলি লোক সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিল, পরিশেষে বালমুকুন তাহাদিগের দ্বারা ধৃত হইয়াছে। বালমুকুন যে কে, তাহা এ পর্যন্ত সবিশেষরূপে স্থিরীকৃত হয় নাই। পুলিস সবিশেষরূপ যত্নসহকারে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। কেহ কেহ বলিতেছেন, বালমুকুন অপর আর কেহই নহে; বোধ হয়, মধ্যপ্রদেশীয় সেই ভয়ানক দস্যু হীরালাল। যাহা হউক, এ বিষয়ের সমস্ত রহস্য বাহির হইয়া পড়িলে, ইহার আনুপূর্বিক সংবাদ আমরা পাঠকগণকে প্রদান করিতে চেষ্টা করিব।

সংবাদপত্রখানি পাঠ করা সমাপ্ত হইলে আমি মাণিকচাঁদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মাণিকচাঁদ! তোমার এখন আর কোন কথা জিজ্ঞাস্য আছে?

তখন মাণিকচাঁদ আমার কথার আর কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না; মস্তক নত করিয়া কেবলমাত্র একটী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিল।

বালমুকুন কহিলেন, কি মহাশয়! আমি এই হত্যা করি আছি? দোহাই মহাশয়! আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, এই কলিকাতা আমি পরিত্যাগ করি নাই। সেই ফারমে আমার কৰ্ম্ম হইয়াছিল সত্য; কিন্তু সেই কৰ্ম্ম আমি পরিত্যাগ করিয়াছি। যখন আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, তখন সেই চুরি ও হত্যা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইবে কি প্রকারে?

আমি। বালমুকুন্! ইহাতে তোমার ভীত হইবার কোন কারণ নাই। যে ব্যক্তি তোমার নাম গ্রহণ করিয়া, সেই স্থানে কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, তাহার প্রকৃত নাম বোধ হইতেছে হীরালাল। মাণিকচাঁদ এখন সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া আমাদিগকে বলিবে, এবং তাহারই বা প্রকৃত নাম কি, তাহাও বোধ হয়, এখন আর সে গোপন করিবে না।

আমার কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ কহিল, মিথ্যা আপনি আমাকে লইয়া পীড়াপীড়ি করিতেছেন। হীরালাল যে কে, তাহা আমি জানি না, বা এই সংবাদপত্রে বর্ণিত চুরি বা হত্যার বিষয় আমি কিছুমাত্র অবগত নহি।

অবগত আছ কি না, তাহা পরে জানিতে পারিবে। এই বলিয়া আমি সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিলাম, এবং মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে লইয়া আমি আমার থানায় গমন করি লাম। থানা হইতে একটী পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া পাঠাইয়া দিলাম। যে পর্যন্ত সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া না গেল, সেই পৰ্য্যন্ত সেই গৃহের উপর পাহারা রহিল।

থানায় গিয়া মাণিকচাঁদ ও সেই দ্বারবানকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখিলাম, এবং সমস্ত বিষয় সবিশেষরূপে বিবৃত করিয়া বোম্বাই পুলিসের নিকট একখানি জরুরি টেলিগ্রাম পাঠাইয়া দিলাম। পরদিবস সেই টেলিগ্রামের উত্তর আসিল; তাহার সারমর্ম এইরূপ :–

আপনার টেলিগ্রাম পাইয়াছি। যে বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমরা এখানে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, এবং কিরূপ উপায়ে হীরালাল বালমুকুন পরিচয়ে এই স্থানে কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহার কিছুই এ পর্যন্ত ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতে ছিলাম না। আপনা-কর্তৃক তাহার সমস্তই প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং আপনি হীরালালের সহায়তাকারীগণকে ধৃত করিয়া আমাদিগের যে কি উপকার করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। আপনি তাহাদিগকে যেন কোনরূপেই ছাড়িয়া দিবেন না। আমরা আপনার নিকট গমন করিতেছি, সাক্ষাৎ হইলে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। আমরা অদ্যই মেল ট্রেণে রওনা হইব।

এই সংবাদ পাইয়া মনে মনে অতিশয় আনন্দিত হইলাম। কেবলমাত্র সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া যে কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহার সুফলই ফলিয়াছে।

সময় মত দুইজন পুলিস-কর্ম্মচারী বোম্বাই হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই চোর ও হত্যাকারী হীরা লালকেও তাঁহাদিগের সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিলেন। হীরালাল প্রথমতঃ কোন কথাই বলিয়াছিল না; কিন্তু কলি কাতায় আসিয়া মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে বন্ধনাবস্থায় দেখিতে পাইবার পরই সমস্ত কথা স্বীকার করিল। সে যাহা কহিল, বোম্বাই-পুলিস-কর্ম্মচারীদ্বয় তাহা লিখিয়া লইলেন। উহা আমার লিখিবার প্রয়োজন না থাকিলেও, আমার অভ্যাসের দোষে আমি তাহা লিখিয়া লইলাম। হীরালাল যাহা বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম এইরূপ :–

আমার নাম হীরালাল। আমার জন্মস্থান মধ্য ভারতে; কিন্তু আমার থাকিবার নির্দিষ্ট কোন স্থান নাই। ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান সহরমাত্রেই আমার একটা না একটী আজ্ঞা আছে। যখন যে স্থানে গমন করি, তখন সেই স্থানেই দুই চারিদিবস অতিবাহিত করিয়া থাকি। আমি বাল্যকালেই আমাদিগের ভাষায় একরূপ শিক্ষিত হইয়াছিলাম, এবং সকল প্রকার কৰ্ম্ম কাৰ্য্যই আমি করিতে জানি। কিন্তু চুরি ভিন্ন কখনও অপর কোন কাৰ্য্য করি নাই। চুরি করিয়াই এতকাল কাটাইয়া আসি মাছি, ও অনেকবার ধরা পড়িয়া জেলেও গিয়াছি সত্য; কিন্তু কখনও কোন গরিবের দ্রব্য অপহরণ করি নাই, বা অল্প মূল্যের দ্রব্যে কখনও হস্তাৰ্পণ করি নাই। যখন যে স্থানে যে কাৰ্য্যে হস্তাৰ্পণ করিয়াছি, তখন সেই কাৰ্যে দশ বিশ হাজারের কম লইয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করি নাই; কিন্তু একটামাত্র পয়সাও কখনও রাখিতে পারি নাই। যেরূপ ভাবে আয় করি য়াছি, ব্যয় করিয়াছিও সেইরূপে।

বোম্বাইয়ের যে মহাজনের গদিতে আমি চুরি করিয়া ধৃত হইয়াছি, অনেকদিবস হইতে সেই গদিতে চুরি করিবার আমার মিতান্ত ইচ্ছা ছিল; কিন্তু এ পর্যন্ত কোনরূপেই সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। কিরূপ অবস্থায় ও কোথায় যে উহার ধনভাণ্ডার স্থাপিত, তাহা এ পর্যন্ত জানিতে পারিয়া ছিলাম না বলিয়াই, এতদিবস আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি নাই। যে সময় উহার গদিতে একজন গোমন্তার প্রয়ো জন হইল, সেই সময় আমি অন্তরালে থাকিয়া, যাহাকে আপনার এখন মাণিকচাঁদ বলিয়া জানিতে পারিয়াছেন, তাহাকে সেই কার্যে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত অনেকরূপ চেষ্টা করিয়া ছিলাম; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারি নাই। লাভের মধ্যে মাণিকচাঁদ সেই স্থানে দুই চারির যাতায়াত করাতে তাঁহারা উহাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। নতুবা আমি নিজে প্রকাশ্যরূপে এই কাৰ্যে কখনই খাকিতাম না। মাণিকচাঁদ যে কাৰ্য্য করিয়াছিল, আমি তাহাই করিতাম, আমার কাৰ্য মাণিকদের দ্বারা সম্পন্ন হইত।

যখন মাণিকচাঁদকে কোনরূপেই সেই কাৰ্য্যে নিযুক্ত করা ইতে পারিলাম না, তখন সেই কার্ষে যে নিযুক্ত হইতেছে, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এবং পরিশেষে জানিতে পারিলাম যে, কলিকাতা হইতে বালমুকুন নামক এক ব্যক্তি সেই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন, ও শীঘ্রই তিনি কলিকাতা হইতে আগমন করিয়া সেই কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইবেন। কর্ম্মচারী হইয়া উঁহাদিগের কার্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারিলে, কোন্ স্থানে উঁহাদিগের অর্থাদি রক্ষিত হয়, তাহা জানিতে পারিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই দেখিয়া, সেই দিবসেই মাণিক চাদকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। কলিকাতায় আসিয়া তাহার প্রধান কাৰ্য্য এই হইল যে, যেরূপ উপায়েই হউক, বালমুকুনের সন্ধান করিয়া তাহাকে হস্তগত করিতে হইবে, এবং যাহাতে বালমুকুন সেই কার্যে নিযুক্ত হইতে না পারে, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। অথচ এদিকে যে পর্যন্ত আমি আপন কাৰ্য উদ্ধার করিয়া না লইতে পারি, সেই পর্যন্ত বালমুকুনকে আপন হস্তে রাখিয়া যাহাতে সে বোম্বাই সহরে আসিতে পারে, তাহার বন্ধোবস্তও করিতে হইবে। মাণিক চাদকে এইরূপ উপদেশ দিয়া, তাহাকে দ্রুতগতি কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। মাণিকটা বড় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কৌশলী। তিনি কলিকাতায় আসিয়া অনায়াসেই বালমুকুনকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন, এবং তাহাকে অধিক বেতন প্রদান পূর্ব্বক প্রলোভিত করিয়া যে কার্যে তিনি নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সেই কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইতে তাঁহাকে স্থগিত করিলেন। তিনি সেই কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিতেছেন, এই মর্মে একখানি পত্র তাঁহার নিকট হইতে লিখাইয়া লইয়া মাণিকচাঁদ সেই ফারমে পাঠাইয়া দিবার ভানে কোনরূপে হস্তগত করিয়া পরিশেষে উহা আমার নিকট প্রেরণ করিলেন। যে টেলিগ্রামে বালমুকুন তাহার কাৰ্য্যে নিয়োজিত হইবার আদেশ পাইয়াছিলেন, সেই টেলিগ্রাম খানি পর্যন্ত হস্তগত করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিলেন, এবং কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করিয়া বালমুকুন যাহাতে বোম্বাই সহরে আসিয়া উপস্থিত হইতে না পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এদিকে আমি সেই টেলিগ্রাম দেখা ইয়া, আমাকে বালমুকুন নামে পরিচয় দিয়া, অনায়াসেই সেই কার্যে নিযুক্ত হইয়া সবিশেষ মনোযোগের সহিত নির্দিষ্ট কাৰ্য্য করিতে লাগিলাম। এইরূপে ক্রমে দশ বারদিবস অতি বাহিত হইতে না হইতেই যে যে স্থানে অর্থাদি বা বহুমূল্য অলঙ্কারাদি রক্ষিত থাকে, তাহা জানিতে পারিলাম, এবং সুযোগ মত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালা দ্বারা আবদ্ধ ছিল, তাহার চাবি প্রস্তুত করাইয়া লইলাম। আমার ইচ্ছা ছিল, সুযোগমত একদিবস রাত্রিতে চাবি খুলিয়া সমস্ত অর্থাদি, অপহরণ করিব, এবং পূর্বের ন্যায় তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া সেই স্থানেই কাৰ্য করিতে প্রবৃত্ত থাকি। চুরির বিষয় প্রকাশ হইয়া পড়িলে, এবং পুলিসের অনুসন্ধান ক্রমে শেষ হইয়া গেলে, চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে গমন করিব ও সেই স্থানে সেই সকল অর্থ ব্যয় করিয়া কিছুদিবস বাবুগিরি করিয়া কাটাই। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঈশ্বর কিন্তু তাহা হইতে দিলেন না। চুরি করিয়া বহির্গত হইবার কালীনই সমস্ত অপহৃত দ্রব্যের সহিত ধৃত হইলাম, এবং পরিশেষে আত্মরক্ষা করিবার মানসে নরহত্যা পর্যন্ত করিতেও কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হইলাম না! এখন আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা হইবেই হইবে। তাহার নিমিত্ত আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি, বা আমার প্রধান সঙ্গী, যিনি এখন আপনাদিগের নিকট মাণিকচাঁদ নামে পরিচিত, তাহার নিমিত্তও আমি দুঃখিত নহি। কারণ, আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া যেরূপ কাৰ্য্যে হস্তাৰ্পণ করিয়াছি, তাহার ফল ভোগ করাই আমাদিগের কর্তব্য। কিন্তু এই দ্বারবানের নিমিত্ত আমি আন্তরিক দুঃখিত। কারণ, এ ব্যক্তি আমাদিগের সহিত কখনও কোন অসৎ কাৰ্যে প্রবৃত্ত হয় নাই, বা এ আমাদিগের নিকট পরিচিতও নহে। সামান্য অর্থের লোভে যে এইবার এই ব্যক্তি মাণিকচাঁদকে কিছু সাহায্য করিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু সে যে ইহার ভিতরের বিষয় অবগত আছে, তাহা আমার বোধ হয় না।

দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, মহাশয়! আমি পূর্ব্ব হইতে মাণিকচাঁদকে বা এখন যিনি বোম্বাই সহর হইত ধৃত হইয়া আসিয়াছেন, উঁহাদিগের কাহাকেও চিনিতাম না। মধ্য ভারতে বা বোম্বাই সহরে আমি কখনও গমন করি নাই। আমার বাসস্থান আরা জেলার অন্তর্গত কোন একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। আমি কয়েকবার আয় গিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে পেটের দায়ে কলিকাতায় আসিয়াছি। এই দুইটী স্থান ব্যতীত অপর কোন সহরে আমি আর গমন করি নাই। মাণিকচাঁদের সহিত এই কলিকাতা সহরেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি আট টাকা। বেতনে আমাকে চাকুরী প্রদান করেন, এবং আমাকে এক মাসের বেতনও অগ্রিম দেন। তিনি যে জুয়াচোর, তাহা আমি জানিতাম না। আমাকে যখন যেরূপ কাৰ্য্য করিতে তিনি আদেশ প্রদান করিতেন, আমি সেই আদেশ অনুযায়ী সমস্ত কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিয়া যাহাতে আপন মনিবকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখিতে পারি, কেবল তাহারই চেষ্টা করিতাম। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

দ্বারবান্ এবং হীরালালের এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদও পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করিল। বোম্বাইয়ের কর্ম্মচারীদ্বয়, এখানকার আর যে সকল অনুসন্ধান করিবার বাকী ছিল, তাহা সম্পন্ন করিয়া, সেই তিনজনকেই সঙ্গে লইয়া বোম্বাই সহরে প্রস্থান করিলেন।

সেই স্থানে বিচারে হীরালালের যাবজ্জীবন, এবং মাণিক চাদের দশ বৎসরের নিমিত্ত কারাবাসের আজ্ঞা হয়; দ্বারবান পরিত্রাণ পায়।

সম্পূর্ণ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত