ঘর-পোড়া লোক।
(প্রথম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অদ্য যে বিষয় আমি পাঠকগণকে উপহার দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা অতি ভয়ানক ও লোমহর্ষণ-জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব নাই, অর্থাৎ আমি নিজে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার সহিত যে পুলিস কর্ম্মচারীর সংস্রব ছিল, তিনি আমার পরিচিত। এই ঘটনার মধ্যে যেরূপ অস্বাভাবিক দুবুদ্ধির পরিচয় আছে, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠকেই মনে করিতে পারেন যে, এরূপ দুঃসাহসিক কাৰ্য মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু যখন আমি এই ঘটনার আনুপূর্বিক সমস্ত ব্যাপার জানি, এবং অনুসন্ধানকারী পুলিস কর্ম্মচারীও, আমার পরিচিত, তখন এই ঘটনার সত্যাসত্য সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাঠকগণও ইহা সম্পূর্ণ। রূপ সত্য ঘটনা বলিয়া অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পারেন।
এই ঘটনা আমাদিগের এই প্রদেশীয় ঘটনা নহে, পশ্চিম দেশীয় ঘটনা। হিন্দু পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, নৈমিষারণ্য নামে একটা স্থান আছে, উহা আমাদিগের একটা প্রধান তীর্থ স্থান। পশ্চিমদেশবাসীগণ সেই স্থানকে নিমরণ কহিয়া থাকে।
কথিত আছে, ভগবান্ বেদব্যাস এই স্থানে বসিয়া ভগবদবাক্য সৰ্ব্বপ্রথমে মর্ত্যলোকে প্রকাশ করেন। যে বেদীর উপর উপবেশন করিয়া তিনি ভগবাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, নিবিড় ও নিস্তব্ধ আয় কাননের ভিতর সেই বেদী এখন পর্যন্ত বর্তমান। সেই বেদীর কিছু দূর অন্তরে চক্রপাণি নামক প্রসিদ্ধ স্থান। প্রসিদ্ধি আছে যে, যে সময় ভগবান্ বেদব্যাস ভগব প্রকাশ করিতেন, সেই সময় দেবতাগণ ও ঋষি গণের আবির্ভাব হইত। সেই স্থানে তখন একটা সামান্য স্রোতস্বতী থাকা স্বত্বেও সেই স্থানে যাহারা আগমন করিতেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই অত্যাধিক জল-কষ্ট সহ করিতে হইত। ভগবান্ বিষ্ণু এই ব্যাপার দেখিয়া জল-কষ্ট নিবারণ করিবার মানসে আপনার চক্র দ্বারা পৃথিবী ভেদ করিয়া দেন, সেই স্থান হইতে সতেজে অনবরত জল উখিত হইয়া সকলের জল-কষ্ট নিবারণ করে। সেই সময় পৃথিবী ভেদ করিয়া যে স্থান হইতে জল উঠিয়াছিল, এবং এখন পর্যন্ত যে স্থান হইতে অনবরত জল উখিত হইয়া সন্নিকটবর্তী সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতে গিয়া মিলিতেছে, সেই স্থানকে চক্রপাণি। কহে। নৈমিষারণ্য তীর্থে যাহারা গমন করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে চক্রপাণি জলে স্নান করিতে হয়।
দশ বার বৎসর পূর্বে কোন সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাকে সেই নৈমিষারণ্যে গমন করিতে হইয়াছিল। যে কাৰ্য্যে আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য শেষ হইবার পর, একদিবস আমি সেই চক্রপাণি জলে স্নান করিতে যাই। সেই স্থানে আমি স্নান করিতেছি, এরূপ সময় একজন লোক আসিয়া স্নান করিবার মানসে সেই চক্রপাণি জলে অবতরণ করেন। কথায় কথায় তাহার সহিত আমার পরিচয় হয়। ইহার নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। কিন্তু ইহার সহিত আমার কখন চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় ছিল না। ইহার নাম শুনিয়াই আমি কহিলাম, আপনি এই প্রদেশীয় পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেন না?
উত্তরে তিনি কহিলেন, হাঁ মহাশয়!
তখন আমি তাহার সম্বন্ধে যাহা যাহা অবগত ছিলাম, তাই তাহাকে কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মহাশয়! এই অপ রাধের জন্য পুলিস বিভাগ হইতে আপনার চাকরী গিয়াছে না?
উত্তরে তিনি কহিলেন, আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন?
আমি। আমি যেরূপেই অবগত হইতে পারি না কেন; কিন্তু ইহা প্রকৃত কি না?
যখন অনুসন্ধান করিয়া আমার দোষ সাব্যস্ত হইয়াছিল, এবং সেই দোষের উপর নির্ভর করিয়া সরকারী চাকরী হইতে আমাকে তাড়িত করা হইয়াছে, তখন উহা যে সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা কথা, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে?
আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিছিলেন?
যে ইনস্পেক্টারের দ্বারা তাহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইম্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব। যে ভূত-পূৰ্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার বাসায় গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি বার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।
ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জন করিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটী চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।
নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধানকার্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও হত্যা-হরণ প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিল। ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটা ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।
যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজ, পত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত আফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্ৰ আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দু ভাষাবিদ একজন মুসির সাহায্যে সেই সকল কাগজপত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কৃতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে
যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফুর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইহার জমি দারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটা কপর্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গোফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি শটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে জাসিয়া প্রথমে তাহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কার্যক্ষম ছিলেন। সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কাৰ্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্ধিত হইতেছিল।
সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুলের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।
গোফুর খাঁর কেবল একটামাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওসমান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওসমানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওসমানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সৰ্ব্বদা আপন কার্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওসমান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহলাদ করিয়া দিন অতি বাহিত করিতে লাগিল।
গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কাৰ্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।
ওসমান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।
গোফুর সর্বদা সৎকার্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।
ওমানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত।
ওসমানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাঁহার পিতা গোফুর খা তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওসমারের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্তে ক্রমে আরও বর্ধিত হইতে লাগিল।
গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্যের ভার তিনি তাহার পুত্র ওসমান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাহাকে সৰ্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওসমান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওমানের হক হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।
ওমানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর ধার কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।
এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাঁহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।
এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওসমানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সু যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।
এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে। বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জনা করেন। ওসমান একজন মধ্যবিদ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওসমানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে?
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে গোর খাঁর বাড়ী, সেই গ্রামের নিকটবর্তী একখানি গ্রামে পুলিসের থানা আছে; সেই থানার ভার প্রাপ্ত কর্ম্মচারী একজন মুসলমান দারোগা। দারোগা সাহেব একজন খুব উপযুক্ত কর্ম্মচারী। জেলার ভিতর তাঁহার খুব নাম আছে, সরকারের ঘরেও তাঁহার বেশ খাতির আছে। কিন্তু তাহার নিজের চরিত্র সাধারণত দারোগা-চরিত্রের বহিত নহে।
দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসরের কম নহে, বরং দুই এক বৎসর অধিক হইবারই সম্ভাবনা। পুলিশ বিভাগে প্রথম প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহার যেরূপ চরিত্ৰ-দোষ ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং দিন দিন বর্ষিত হইয়াই চলিয়া যাইতেছে।
কোন গ্রামে কোন একটী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া, একটা রূপবতী যুবতী তাঁহার মজয়ে পতিত হয়। পরিশেষে কোন-না-কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, ক্রমে দারোগা সাহেব তাহাকে গৃহের বাহির করেন, এবং থানার সন্নিকটবর্তী কোন এক স্থানে একখানি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিয়া, তাহাকে সেই স্থানে রাখিয়া দেন। সেই স্ত্রীলোকটা দুই বৎসরকাল সেই স্থানে বাস করিয়া দারোগা সাহেবের মনস্তুষ্টি সম্পাদিত করে।
সেই যুবতী যে সবিশেষ রূপবতী, এ কথা শোক-মুখে ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে ওসমানের জনৈক পারিষদ এ কথা জানিতে পারিয়া, ওসমানের কর্ণগোচর করিয়া দেয়। যুবতী-রূপবতীর কথা শুনিয়া ওসমান আর তাহার মন স্থির করিতে পারিল না; কোন উপায় অবলম্বন করিলে, সে সেই যুবতীকে হস্তগত করিতে পারিবে, তাহারই চিন্তায় অতিশয় ব্যগ্র হইয়া পড়িল, ও ক্রমে আপন মনোভাব প্রকাশ করিয়া সেই যুবতীর নিকট তোক প্রেরণ করিল।
যুবতী তাহার প্রস্তাবে প্রথমে স্বীকৃত হইল না; কিন্তু ওসমানও তাহার আশা পরিত্যাগ করিল না। যে কোন উপায়েই হউক, তাহাকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে লাগিল।
যে স্ত্রীলোক একবার তাহার কুলে জলাঞ্জলি দিয়া পর পুরুষের সহিত চলিয়া আসিয়াছে, এবং এতদিবস পর্যন্ত পরপুরুষেয় সহিত অনায়াসে কালযাপন করিতেছে, সেই স্ত্রীলোককে প্রলোভনে ভুলাইতে আর কতদিন অতিবাহিত হয়? দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম অধিক, ওসমানের বয়ঃক্রম তাহ অপেক্ষা অনেক অর। দারোগা সাহেব পরাধীন, ওসমান স্বাধীন। দারোগা সাহেবকে চাকরীর উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত খরচ-পত্ৰ নিৰ্বাহ করিতে হয়, আর ওসমান জমিদার-পুত্র, গোফুর খাঁর মৃত্যুর পর সেই অগাধ জমিদারীর তিনি একমাত্র অধিকারী। যেস্থলে দারোগা সাহেবকে শত মুদ্রা খরচ করিতে হইলে তাহাকে অন্ধকার দেখিতে হয়, সেই স্থলে ওসমান সহস্র মুদ্রা অকাতরে ব্যয় করিতে সমর্থ। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটীকে ওসমানের করায়ত্ব করা নিতান্ত দুরূহ কাৰ্য্য নহে। বলা বাহুল্য, ক্রমে যুবতী ওমানের হস্তগত হইয়া পড়িল; দারোগা সাহেবকে পরি ঊ্যাগ করিয়া সে ওসমানের অনুবর্তিনী হইল। ওসমান তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, কোন লুকা য়িত স্থানে তাহাকে রাখিয়া দিল।
সুন্দরী যে কাহার সহিত কোথায় গমন করিল, এ কথা দারোগা সাহেব প্রথমত জানিতে পারিলেন না; কিন্তু ক্রমে এ সংবাদ জানিতে তাহার বাকী রহিল না। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ওসমান তাঁহার মুখের পথে কণ্টক হইয়া তাঁহার যকের ধন অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাহার উপর যেরূপ ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন, তাহা বর্ণন করা এ লেখনীর কাৰ্য্য নহে। দারোগা সাহেব প্রথমত সেই সুন্দরীকে পুনরায় আপনার নিকট আনয়ন কয়বার নিমিত্ত সবিশেরূপ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এমন কি, দারোগা সাহেব এই কথা জমে ওসমানের পিতার কর্ণ গোচর পর্যন্ত করাইলেন। তাহাতেও কোনরূপ সুফল ফলিল না। ওসমানের পিতা এ বিষয়ে কোনরূপে দারোগা সাহেবকে সাহায্য নিলেন না।
এই সকল কারণে দারোগা সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধের সামান্যমাত্রও উপশম হইল না। কিরূপে তিনি ওসমান ও তাহার পিতাকে ইহার প্রতিশোধ দিতে পারিবেন, তাহার চেষ্টাতেই দিনরাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং অনবরত প্রতিশোধের সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
এইরূপে ক্ৰমে এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এই এক বৎসরের মধ্যে দারোগা সাহেব সেই সুন্দরীর আশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, বা প্রতিহিংসার প্রবল চিন্তাকেও হৃদয় হইতে তাড়িত করিতে সমর্থ হইলেন না।
এইরূপে আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিবস প্রাতঃকালে দারোগা সাহেব থানায় বসিয়া আছেন, এরূপ সময়ে একটা লোক গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, ও কাঁদিতে দিতে আমোগার সম্মুখীন হইয়া কহিল, বর্ষাবতার। আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আপনি রক্ষা না করিলে, আর কেই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।
দারোগা। কি হইছে?
আগন্তুক। ওসমান আমার সর্বনাশ করিয়াছে।
দারোগা। ওসমান! কোন ওসমান, গোর ধীর পুত্র ওসমান?
আগন্তুক। মহাশয়!
দারোগা। সে তোমার কি করিয়াছে?
আগন্তুক। সে আমার একমাত্র কন্যাকে জোর করিয়া আমার ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। কেন সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল?
আগন্তুক। কু-অভিপ্রায়ে সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। তোমার কন্যার বয়ঃক্রম কত?
আগন্তুক। সে বালিকা, তাহার বয়ঃক্রম এখনও আঠার বৎসরের অধিক হয় নাই।
দারোগা। তাহার বিবাহ হয় নাই?
আগন্তুক। বিবাহ হইয়াছে বৈ কি। তাহার স্বামী এখনও বর্তমান আছে।
দারোগা। এ সংবাদ তাহার স্বামী শুনিয়াছে?
আগন্তুক। এ সংবাদ তাহার স্বামীকে আমরা দেই নাই। তাহার স্বামী বিদেশে থাকেন। সুতরাং এ সংবাদ তিনি এখনও জানিতে পারেন নাই। তিনি না জানিতে জানিতে যদি আমার কন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে পারি, তাহা হইলে এ লজ্জার কথা আমি তাহাকে আর জানিতে দিব না।
দারোগা। তোমার কন্যা ইচ্ছা করিয়া ওসমানের সহিত গমন করে নাই ত?
আগন্তুক। মা মহাশয়! তাহাকে জোর করিয়া ওসমান। ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। তুমি ইহার প্রমাণ করিতে পারিবে।
আগন্তুক। খুব পারিব, গ্রামশুদ্ধ সব লোক দেখিয়াছে। তাঁহারা সকলেই সত্য কথা কহিবে। আপনি সেই স্থানে গমন করিলেই, দেখিতে পাইবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না?
দারোগা। কতক্ষণ হইল, ওসমান তোমার কন্যাকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
আগন্তুক। মহাশয় আজ ছয় দিবস হইল।
দারোগা। ছয় দিবস। মিথ্যা কথা। ছয় দিবস হইল, তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, আর আজ তুমি থানায় সংবাদ দিতে আসিলে; তোমার এ কথা কে বিশ্বাস করিবে?
আগন্তুক। মহাশয়! আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি কিন্তু প্রকৃত কথা কহিতেছি। আমার অনুপস্থিতিতে এই কাৰ্য্য হইয়াছে। আমার বাড়ীতে আমার সেই একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কেহই ছিল না; সুতরাং সুযোগ পাইয়া দুবৃত্ত এই কাৰ্য্য করিয়াছে। তাহার ভয়ে পাড়ার লোক আমাকে পর্যন্ত সংবাদ দিতে সমর্থ হয় নাই। অঙ্গ আমি বাড়ীতে আসিয়া যেমন এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিলাম, অমনি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। এখন আপনি রক্ষা না করিলে, আমার আর উপায় নাই।
দারোগা। তোমার বাড়ী যে গ্রামে, সেই গ্রাম হইতে ওসমানের বাড়ী কতদুর?
আগন্তুক। খুব নিকটে, পার্শ্ববর্তী গ্রামে।
দারোগা। তোমার জমিদার কে।
আগন্তুক। সেই হতভাগাই আমার জমিদার।
দারোগা। জমিদারীর খাজানা তোমার কিছু বাকী আছে।
আগন্তুক। বাকী আছে। মিথ্যা কথা কহিব না, আমি আজ তিন বৎসর খাজানা দিতে পারি নাই।
দারোগা। ফি বৎসর তোমাকে কত টাকা করিয়া খাজান দিতে হয়?
আগন্তুক। সালিয়ানা আমাকে পনর টাকা করিয়া খাজানা দিতে হয়। পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজানা আমার বাকী পড়িয়াছে।
দারোগা। সেই খাজানার নিমিত্ত তাঁহারা তাগাদা করে না?
আগন্তুক। তাগাদা কমে বৈ কি, কিন্তু দিয়া উঠিতে পারি না।
দারোগা। যখন তোমার কন্যাকে ওসমান ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সময় তাহার সতে আর কোন লোক ছিল?
আগন্তুক। তাহার সহিত আরও চারি পাঁচজন লোক ছিল।
দারোগা। ওসমানের পিতা গোয় খ সেই সঙ্গে ছিলেন?
আগন্তুক। না মহাশয়। তিনি ছিলেন না।
দারোগা। তুমি জান না; তিনি না থাকিলে, কখনও এইরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে না। গ্রামের যে সকল ব্যক্তি এই ঘটনা দেখিয়াছে, তাহাদিগকে তুমি ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছ কি?
আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু কেই সে কথা কহে না। আরও ভাবিয়া দেখুন না কেন, পুল বদি কোন যুবতী রমণীর সতীত্ব নষ্ট করিবার চেষ্টা করে, পিতা কি কখনও তাহার সহায়তা করিয়া থাকেন?
দারোগা। ওসমান শেষে উহার সতীত্ব নষ্ট করিতে পারে; কিন্তু প্রথমতঃ সেই কাৰ্যের নিমিত্ত যে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা তোমাকে কে বলিল? অপর কোন কারণে সে কি তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে না?
আগন্তুক। আর তা কোন কারণ দেখিতে পাইতেছি না, বা শুনিতেও পাইতেছি না।
দারোগা। ওমানের পিতা গোফুর খাঁ এখন কোথায় আছেন, বলিতে পার?
আগন্তুক। তিনি এখন বাড়ীতেই আছেন।
দারোগা। কানপুর হইতে তিনি কবে আসিয়াছেন।
আগন্তুক। পাঁচ ছয় দিবস হইবে।
দারোগা। তাহা হইলে যে দিবস ওসমান তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই দিবস গোয় কান পুর হইতে বাড়ীতে আসিয়াছেন।
আগন্তুক। হাঁ মহাশয়! হয় সেই দিবসই আসিয়াছেন, না হয়, তাহার পরদিন আগমন করিয়াছেন।
দারোগা। তাহা হইলে ঠিক হইয়াছে। তোমার কন্যার ধর্ম নষ্ট করিবার নিমিত্ত ওসমান তোমার দুহিতাকে ধরিয়া লইয়া যায় নাই। গত তিন বৎসর পর্যন্ত তোমার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, সেই খাজনা আদায় করিবার মানসে ওমানের পিতা গোফুর খাঁ আপন পুত্র ওসমান ও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া তোমার বাড়ীতে আগমন করেন। তুমি বাড়ীতে ছিলে না; সুতরাং তাঁহারা তোমাকে বাড়ীতে দেখিতে পান নাই। কিন্তু তুমি যে এতই বাড়ীতে নাই, ইহা না ভাবিয়া, খাজানা দিবার জয়ে তুমি লুকায়িত পাই, এই ভাবিয়া তোমাকে ভয় দেখাইয়া খাজনা আদায় করিয়া লইবার মানসে তোমার একমাত্র কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত গোফুর খাঁ তাঁহার পুত্রকে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। পিতার আদেশ পাইয়া ওসমান কয়েকজন লোকের সাহায্যে তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। খাঁ সাহেবও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিয়াছেন। কেমন, ইহাই প্রকৃত কথা কি না?
আগন্তুক। না মহাশয়। ইহা এত কথা নহে। ওসমানের পিতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন না, বা তিনি আদেশ প্রদান করেন নাই। আমার বাকী থানায় নিমিত্তও এটনা ঘটে নাই।
দারোগা। যা ব্যাটা, তবে তোর মোক গ্রহণ করিব। তুই বাড়ীতে হিলি নি, এত কথা যে কি, তাহার তুই কি জানি? আমরা ইতিপূর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, কেবল কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া নালিশ করে নাই বলিয়া, আমি এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। আমি যেরূপ কহিলাম, সেইপের সাক্ষী সকল সংগ্রহ করিয়া রাখ গিয়া। আমি একজন মাদারকে সঙ্গে দিতেছি, যাহা তুই বুঝতে না পাবি, তিনি তাহা হতাকে বুঝাইয়া দিবেন। তাঁহারা আমি গিন্ধ আসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
আগন্তুক। দোহাই ধৰ্মবতায়! যাহাতে আমি আমার কাটীকে পাই, আপনাকে সেই উপায় করতে হবে।
দারোগা। তাহাই হইবে। এখন তুই আমার জমা দারের সহিত গমন করিয়া সাক্ষী-সাবুদের সংগ্রহ করিয়া দে। তুই লেখা-পড়া জানিস্ কি? আগন্তুক। আমরা চাষার ছেলে, লেখাপড়া শিখি নাই।
দারোগা। নিজের নাম লিখিতে পারি?
আগন্তুক। না মহাশয়! আমি আমার নাম পর্যন্ত লিখিতে পারি না।
দারোগা। তোর নাম কি?
আগন্তুক। আমার নাম শেখ হেদায়েৎ।
দারোগা। আচ্ছা হেদায়েৎ, তুমি আমার জমাদারের সহিত তোমার গ্রামে গমন কর। আহারান্তে আমি নিজে গিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। সাক্ষীগণ যেন উপস্থিত থাকে।
হেদায়েৎকে এই কথা বলিয়া, দারোগা সাহেব তাহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী জমাদারকে ডাকিলেন, এবং নির্জনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া পরি শেষে তাহাকে কহিলেন, এই মোকদ্দমায় বিশেষরূপে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। যে সুযোগ পাইয়াছি, সে সুযোগ কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমার কোন ক্ষমতা কাছে কি না, এবং আমার ঘর ওসমান ও তার পিতার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটতে পারে কি না, তা তাহা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখাইতে হইবে। যেরূপ উপায়েই হউক, উঁহাদিগের উভয়কেই জেলে দিয়া আমার এতদিসের মনের যন্ত্রণা নিবারণ করিতে হইবে।
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার কহিল, আপনি যত শীঘ্র হয়, আগমন করুন। আমি সেই স্থানে গমন করি মাত্রই সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না
এই বলিয়া হেদায়েৎকে সঙ্গে লইয়া জমাদার তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেল ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।
আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান * * * গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, * * * গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *-র নিকট আমি আমার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহ নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা * * *-কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অন্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ তাহার পুত্র ওসমান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজনা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহবিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না। সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। মে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধাবিত হইলেন ও কহিলেন, হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজনা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুক্কায়িত আছে। যা হক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তাহা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজনা মিটাইয়া দিবে। এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওসমান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ে নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশ প্রায় দুই ঘণ্টা তাহাকে সেই স্থানে বসাইয়া রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমির মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁর পুত্র ওসমান ও অপরাপর কৰ্ম্ম চারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত ওসমান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগেয় বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যায় আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেই রূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি–
নিশানসহি-সেখ হেদায়েৎ।
দারোগা সাহেব প্রথম এতো পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্ৰমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সন্ধ্যায় একটু পূর্বে দারোগা সাহেব তাহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।
দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র; কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যুষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যুষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।
গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওমানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওসমান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হোয়েতের কন্যাকে লাইক করিয়া রাখিলেই খাজনা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোরখা তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওসমান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেবে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহা দিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
ওসমান ও তাহার পিতাকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে দারোগা সাহেব যাহা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, কাৰ্য্যেও তাহা পরিণত হইতেছে দেখিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।
সেই স্থানে অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত রাখিয়া হেদায়েৎ ও গ্রামের দুই চারিজন লোককে সঙ্গে লইয়া গোফুর খাঁন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
গোফুর খাঁ সেই সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওসমান সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। গোফুর খাঁর সহিত দারোগা সাহেবের কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তা হইলে পর, ওসমান আসিয়া সেই স্থানে কোথা হইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনার উপর একটা ভয়ানক নালিশ হইয়াছে। যে পর্যন্ত আমি অনুমতি প্রদান না করি, সেই পৰ্যন্ত আপনি আমার সম্মুখ হইতে গমন করিবেন না।–
ওসমান। আর যদি আমি চলিয়া যাই?
দারোগা। তাহা হইলে আপনার সহিত ভদ্রোচিত ব্যবহার করিতে আমি কোনরূপেই সমর্থ হইব না। সামান্য লোককে যেরূপ ভাবে আমরা রাখিয়া থাকি, বাধ্য হইয়া আপনাকেও সেইরূপ ভাবে আমাকে রাখিতে হইবে।
গোফুর। আমার উপর অভিযোগ কি?
দারোগা। আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার গ্রামবাসী আপনারই প্ৰজা হেদায়েতের যুবতী কন্যাকে অন্যায়রূপে আজ কয়েকদিবস হইতে আপনার বাটীতে আনিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।
গোফুর। আমার আদেশ অনুযায়ী?
দারোগা। প্রমাণে সেইরূপ অবগত হইতে পারিতেছি।
গোফুর। আমি তাহাকে আবদ্ধ করিতে আদেশ প্রদান করিব কেন?
দারোগা। বাকী খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে।
গোফুর। মিথ্যা কথা।
দারোগা। সত্য মিথ্যা আমি অবগত নহি; প্রমাণে যাহা পাইতেছি, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আর সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে।
গোফুর। আপনি প্রমাণ পাইতেছেন, আমার আদেশে এই কাৰ্য্য হইয়াছে?
দারোগা। হাঁ।
গোফুর। আমার আদেশ প্রতিপালন করিল কে? অর্থাৎ কে তাহাকে ধরিয়া আনিল?
দারোগা। আপনার পুত্র, এবং আর তিন চারিজন নোক।
গোফুর। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আপনি এখন কি করিতে চাহেন?
দারোগা। আপনি যদি সহজে সেই স্ত্রীলোকটীকে বাহির করিয়া না দেন, তাহা হইলে প্রথমতঃ আপনার বাড়ী আমি উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব। দেখিব, উহার ভিতর সেই স্ত্রীলোকটা পাওয়া যায়, কি না।
গোফুর। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কি হইবে?
দারোগা। সে পরের কথা; যাহা হয়, পরে দেখিতে পাইবেন।
ওসমান। কার হুকুম মত আপনি আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাহেন? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি বার কোন ওয়ারেন্ট আছে কি?
দারোগা। কাহার হুকুম মত আমি তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাই, তাহা তুমি বালক, জানিবে কি প্রকারে? আমি আমার নিজের হুকুমে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব।
ওসমান। যদি প্রবেশ করিতে না দি?
দারোগা। তোমার কথা শোনে কে?, আমি জোর করিয়া প্রবেশ করিব। তাহাতে যদি তুমি কোনরূপ প্রতি বন্ধকতা জন্মাও, তাহা হইলে তোমায় অপর আর এক মোকদ্দমায় আসামী হইতে হইবে।
ওসমান। যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবেন, তাহাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে জবাবদিহি কে করিবে? আপনি করিবেন কি?
দারোগা। যাহাকে জবাবদিহিতে আনিতে পারিবে, সে-ই জবাবদিহি করিবে।
ওসমান। আর যদি সে আপন ইচ্ছায় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?
দারোগা। সে উত্তম কথা; সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই কথাই বলুক। তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে।
গোফুর। তবে কি স্ত্রীলোকটা আমাদের বাড়ীতে আছে?
ওসমান। না, সে আমাদের এখানে আসেও নাই, বা আমাদিগের এখানে নাইও।
দারোগা। মহাশয়! আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। এখন কি করিতে চাহেন, বলুন। স্ত্রীলোকটাকে কি আমার সম্মুখে আনিয়া দিবেন, না আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া থানাতল্লাসি করিতে আরম্ভ করিব?
গোফুর। আমি ত বলিতেছি, সেই স্ত্রীলোকটা আমা দিগের বাড়ীতে নাই। আমার কথায় আপনি বিশ্বাস না করেন, আপনার যাহা অভিরুচি হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। কিন্তু, আমি পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, যাহা করিবেন, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া করিবেন।
দারোগা। আমার কাৰ্য আমি বুঝি, তাহার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট উপদেশ গ্রহণ করিতে আসি নাই। আমি লোকজনের সহিত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, ইচ্ছা করেন যদি, তাহা হইলে আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে কোন একটা গৃহের ভিতর গমন করিবার নিমিত্ত বলিতে পারেন। আর ইচ্ছা না করেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার সমভিব্যাহারী লোকজনের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার অভিপ্রায়ে উথিত হইলেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া গোফুর খাঁ, ওসমান, এবং সেই সময় সেই স্থানে গোফুরের বন্ধু-বান্ধব গণের মধ্যে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও সকলে দারোগা সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবার নিমিত্ত উথিত হইলেন।
দারোগা সাহেব প্রথমেই অন্দরমহলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না। সদর বাড়ীর ভিতর যে সকল গৃহ ছিল, প্রথমেই সেই সকল গৃহের মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক একখানি করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে সমস্ত খোলা ঘরগুলি দেখিলেন। তাহার ভিতর কিছু দেখিতে না পাইয়া, পরি শেষে যে ঘরগুলিতে চাবি বদ্ধ ছিল, চাবি খুলিয়া সেই ঘর গুলিও একে একে দেখিতে লাগিলেন।
গোফুর খাঁর প্রকাণ্ড বাড়ী; সুতরাং সদরে ও অন্দরে অনেক ঘর। বাহিরের ঘরগুলি দেখিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে তালাবদ্ধ কতকগুলি ঘর দেখিবার পর এক পার্শ্বের এক নির্জন গৃহের তালা খুলিলেন। সেই গৃহের ভিতর অপর দ্রব্য-সামগ্রী কিছুই ছিল না, কেবল গৃহের মধ্যে একখানি পালঙ্কের উপর একটা বিছানা আছে মাত্র।
সেই বিছানার সন্নিকটে গিয়া বা দেখিলেন, তাহাতে সমস্ত লোকেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। ইতি পূর্বে দারোগা সাহেব যাহা স্বপ্নেও একবার মনে ভাবেন নাই, তিনি তাহা দেখিয়াই যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত যেন তাহার সংজ্ঞাও বিলুপ্ত হইল। একটু পরেই দারোগা সাহেব কহিলেন, কি মহাশয়। এ কি দেখিতেছি?
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া আর কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল হেদায়েৎ সেই বিছানার সঙ্গিক বৰ্ত্তী হইয়া কহিল, মহাশয়! এই আমার কন্যা।
এই বলিয়া হেদায়েৎ তাহার কন্যার গাত্রে হস্তাপণ করিয়া বার বার তাহাকে ডাকিতে লাগিল; কিন্তু সে নড়িল না, যা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন সকলেই জানিতে পারিল যে, সে আর জীবিত নাই।
দারোগা। প্রথমতঃ বড় লম্বা লম্বা কথা কহিতেছিলে যে, এখন আর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না কেন?
গোফুর। ইহার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
দারোগা। এখন ত কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এই তালাবন্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিল?
গোফুর। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। (ওসমানের প্রতি) কিগো ওসমান মিঞা, আপনিও বোধ হয়, ইহার কিছুই জানেন না?
ওসমান। না মহাশয়! আমিও ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। সদর বাড়ীর ভিতর তালাবদ্ধ গৃহে, পালঙ্কের। উপর মৃত স্ত্রীলোকের লাস রহিয়াছে। আর আপনারা বলিতেছেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না। দ্বারে যে দ্বারবান বসিয়া আছে, সেও বলিবে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু কিরূপে এই স্থানে লাস আসিল, ইহার যদি সন্তোষ জনক প্রমাণ আমাকে আপনারা প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের উভয়কেই আমি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাই।
দারোগার কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, এবং এই অবস্থায় কি করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করতে না পারিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন।
দারোগা। কি মহাশয়। আপনি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন যে? এই লাস কিরূপে আপনার বাড়ীর ভিতর আসিল, সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছেন না কেন?
গোফুর। আপনার কথায় আমি যে কি উত্তর প্রদান করিব, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যখন ইহার কিছুই আমি অবগত নহি, তখন আমি আপনাকে আর কি বলিব?
দারোগা। কিগো দ্বারবান্ সাহেব! এ সম্বন্ধে তুমি কি বলিতে চাই?
দ্বারবান্। দোহাই ধর্মাবতার! আমি ইহার কিছুই জানি না।
দারোগা। তুমি দ্বারবান, সর্বদা তুমি দরজায় বসিয়া থাক, অথচ তুমি বলিতেছ, তুমি ইহার কিছুই জান না। এ কথা কি কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে?
দ্বারবান্। আপনি বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি প্রকৃত কথাই বলিতেছি। আমি প্রকৃতই জানি না যে, এই মৃতদেহ কিরূপে বা কাহা কর্তৃক এই বাড়ীর ভিতর আসিল।
গোফুর খাঁ, ওসমান ও দ্বারা যখন কোন কথা বলিল না, তখন সেই সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, নিজের ইচ্ছামত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন।
লাশের সুরতহাল করিয়া পরীক্ষার্থ উহ জেলার ডাক্তার সাহেবের নিকট প্রেরণপূর্বক ঘটনাস্থলে বসিয়া দারোগা সাহেব কয়েকদিবস পর্যন্ত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এখনকার অনুসন্ধান আসামীগণকে লইয়া নহে; এখনকার অনুসন্ধান, ফরিয়াদী ও সেই স্থানের প্রজাগণের সাহায্যে এবং জমাদার সাহেবের আন্তরিক যত্নের উপর নির্ভর করিয়াই হইতে লাগিল। অর্থাৎ গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্রের বিপক্ষে এই হত্যা সম্বন্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইতে পারে, এখন সেই অনুসন্ধানই চলিতে লাগিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
পাঠকগণ পূর্ব হইতেই অবগত আছেন যে, গোফুর খাঁ একজন নিতান্ত সামান্য লোক নহেন। দেশের মধ্যে তাঁহার মান-সন্ত্রম যেরূপ থাকা আবশ্যক, তাহার কিছুরই অভাব নাই। অর্থও যথেষ্ট আছে। কিন্তু এই সকল থাকা স্বত্বেও প্রজাগণ কেহই তাহার উপর সন্তুষ্ট নহে; সকলেই তাঁহার বিপক্ষ। প্রজাগণ গোর খার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবার একমাত্র কারণ, তাঁহার পুত্র ওসমান। ওসমানের অত্যাচারে সকলেই সবিশেষরূপ জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছে। যখন ওমামের অত্যাচার তাঁহারা সময় সময় সহ করিয়া উঠিতে সমর্থ হয় নাই, তখন তাঁহারা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট পর্যন্ত গমন করিয়া, ওসমানের অআচারের সমস্ত কথা তাহার নিকট বিবৃত করিয়াছে। তথাপি গোফুর তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করেন নাই, বা তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন নাই। এই সকল কারণে প্ৰজামাত্রেই পিতা-পুত্রের উপর অস। সুতরাং আজ তাঁহারা যে সুযোগ পাইয়াছে, সেই সুযোগ পরিত্যাগ করিবে কেন? তাহার উপর দারোগা সাহেব সহায়।
প্রজাগণ এক বাক্যে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র ওসমানের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে লাগিল। অনুসন্ধান সমাপ্ত হইলে, দারোগা সাহেব দেখিলেন, নিম্নলিখিত বিষয় সম্বন্ধে উপস্থিত মোকদ্দমায় উত্তমরূপে প্রমাণ হইয়াছে।
১ম। সেখ হেদায়েতের যে গ্রামে বাড়ী, সেই গ্রামের প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁ ও ওসমান বকেয়া খাজানা আদায় করিতে সেই গ্রামে গমন করেন। হেদা য়েতের নিকট কয়েক বৎসরের খাজানা বাকী পড়ায়, এবং হেদায়েৎ সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত না থাকায়, ওসমান গোফুর খাঁর আদেশমত কয়েকজন পাইকের সাহায্যে, হেদা যেতের একমাত্র যুবতী কন্যাকে বলপূর্বক তাহার বাড়ী হইতে সৰ্ব্বসমক্ষে ধরিয়া আনে, এবং তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে গোফুর খাঁর আদেশমত সৰ্ব্ব সমক্ষে তাহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করে। কিন্তু তাহার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, গোয় খ ও ওসমান অপরাপর লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে বলপূর্বক ধরিয়া আপন গৃহাভিমুখে লইয়া যান।
২য়। অপরাপর গ্রামের কতকগুলি প্ৰজার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে হেদায়েতের গ্রাম হইতে ধৃত অবস্থায় গোফুর খাঁর গ্রামে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র কর্তৃক লইয়া যাইতে অনেকেই দেখিয়াছে।
৩য়। গোফুর খাঁর গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী প্রজাবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে গোয় খা ও ওসমান তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছে।
৪র্থ। গোফুর খাঁর কয়েকজন ভৃত্য ও তাহার সেই পূর্ব বর্ণিত দ্বারবানের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁর আদেশমত ওসমান হেদায়েতের সেই কন্যাকে আপনাদের গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, এবং যে পর্যন্ত সে জীবিত ছিল, তাহার মধ্যে ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সে নিতান্ত অস্থির হইলেও, তাহাকে একমুষ্টি অন্ন বা এক গণ্ডুষ জল প্রদান করিতে বারণ করিয়াছিল। এমন কি, সাক্ষিগণের মধ্যে কেহ দয়াপরবশ হইয়া উহাকে এক গণ্ডষ পানীয় প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, গোফুর ও তাঁহার পুত্র ওসমান খ। তাহাকেও উহা প্রদান করিতে দেন নাই।
এতদ্ব্যতীত আরও প্রমাণিত হইল যে, যে দিবস পুলিস কর্তৃক লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহার দুই কি তিন দিবস পূর্বে একজন ভৃত্য কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, ওসমান খার নিকট হইতে সেই গৃহের চাবি অপহরণ করে, এবং ওসমান ও গোফুর খাঁর অসাক্ষাতে সেই গৃহের চাবি খুলিয়া দেখিতে পায় যে, ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার আর বাঁচিবার কিছুমাত্র আশা নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই সামান্য ভৃত্যেরও অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং দ্বারধানের সহিত পরামর্শ করিয়া, সে ইহা স্থির করিল যে, তাহার অদৃষ্টে যাহাই হউক, সে আজ সেই হতভাগিনীকে কিছু আহারীয় ও পানীয় প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে কিছু আহারীয় ও পানীয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করে। কিন্তু উহা সংগ্রহ করিয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া দেখিতে পায় যে, ওসমান খাঁ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভূতের অভি সন্ধির কথা জানিতে পারিয়া, ওসমান তাহার উপর সবিশেষ রূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার হস্ত হইতে আহাৰীয় ও পানীয় কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে, সেই স্ত্রীলোকটী আহারীয় ও পানীয় প্রার্থনা করিয়াছে, এই ভাবিয়া ওসমান সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, ও সেই মহা অপরাধের জন্য সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ভৃত্যাদি উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সম্মুখে সেই মৃত্যুশয্যা-শায়িত স্ত্রীলোকটীকে পদাঘাত করেন। সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার কথা কহিবার বা রোদন করিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা ছিল না; সুতরাং সেই পদাঘাত সে বিনা-বাক্যব্যয়ে অনায়াসেই সহ করে। পরিশেষে ওসমান সেইরূপ অবস্থাতেই সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া, পুনরায় সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দৈন, এবং চাবি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ভৃত্য গোয় খার নিকট গমন করিয়া তাহার নিকট এই সমস্ত ঘটনা বর্ণন করে। গোর খ ইহার প্রতিবিধানের পরিবর্তে, সেই ভৃত্যের উপরই বরং অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহাদিগের বিনা-অনুমতিতে সেই স্ত্রী লোকটীকে আহারীয় ও পানীয় দিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া, তাহাকে কটুক্তি করিয়া গালি প্রদান করেন, ও চাকরী হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন।
৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওসমান খাঁর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।
৬ষ্ঠ। একজন পাইক,যে গোর খার পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করি বার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁন বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সৰ্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।
৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।
৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।
এই মোকদ্দমায় গোফুর খা ও তাঁহার পুত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিষ্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্র বাহির করিয়া জানায়, এবং দারোগা সাহেব তাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন না বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্ৰজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাহার পুত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাহার জ্ঞাতসারে এ কাৰ্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কাৰ্য্য পৰ্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া ছেন। তাহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রি কালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
দারোগা সাহেব তাহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?
হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?
দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?
হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।
দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিক-পুত্রকে?
হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?
দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।, হোসেন। যে পর্যন্ত মোকমার চুড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।
দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্যন্তু ওসমান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওসমানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্বপ্রধান-ধৰ্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কাৰ্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কাৰ্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাচাই বার কথা দুরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওসমানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?
দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওসমান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপ। যে পিতা পুত্রের দুস্কাৰ্য্য সকল জানিতে পারি, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপ স্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।
হোসেন। ওসমান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওসমান এতদুর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।
দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওসমান কর্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?
হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কাৰ্য্য তাহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কাৰ্য্য তখন ওসমান বা তাঁহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কাৰ্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।
দারোগা। যে কাৰ্য্যের সহিত আমার সংশ্রব আছে, সে কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?
হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওসমান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।
দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়া ছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। উর্দ্ধতন কর্ম্ম চারীগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?
হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারি না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর রূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোক হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।
দারোগা। প্রসঙ্গ না হইলেও, যখন আপনি এতদুর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।
হোসেন। ওসমান সহ দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোরও পুত্র-মেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু
মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদম উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহ আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।
দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ কিরূপে আসিল?
হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।
দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?
হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।
দারোগা। আমি ত কোন দোষ দেখিতেছি না।
হোসেন। মনে করুন, যে সকল কথা আমি প্রকৃত বলিয়া এখন বিশ্বাস করিতেছি, ও আপনি জানিতে চাহেন বলিয়া, আপনাকে যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সে সকল কথা আবশ্যকমত অস্বীকার করিলেও, আমি নিষ্কৃতি পাইব না।
দারোগা। আপনার নিষ্কৃতি না পাইবার কারণ কি?
হোসেন। আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে যে সকল লোকের সম্মুখে আমি এখন সেই সকল কথা বলিতেছি, আবশ্যক হইলে সেই সকল লোকের দ্বারা আপনি উহা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন।
দারোগা। সেই সকল কথা আইনমত, ওরূপে প্রমাণ হইতে পারে না।
হোসেন। প্রমাণ হউক, বা না হউক, যদি আপনি নিতান্তই অবগত হইতে চাহেন, তাহা হইলে কাহারও সম্মুখে আমি সেই সকল কথা কহিব না। একাকী শুনিতে চাহেন, ত আমি বলিতে প্রস্তুত আছি।
দারোগা। আর যদি আমি আবশ্যকমত আপনাকে সাক্ষী স্থির করি, তাহা হইলে আপনি কি করবেন? আপনি এখন আমাকে যাহা বলিবেন, তখনও আপনাকে তাহাই বলিতে হইবে।
হোসেন। তাহা বলিব কেন? আবশ্যক হয়, সমস্ত কথা আমি অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারিব।
সম্পূর্ণ।
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত। All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। জ্যৈষ্ঠ।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.
ঘর-পোড়া লোক।
(প্রথম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অদ্য যে বিষয় আমি পাঠকগণকে উপহার দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা অতি ভয়ানক ও লোমহর্ষণ-জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব নাই, অর্থাৎ আমি নিজে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার সহিত যে পুলিস কর্ম্মচারীর সংস্রব ছিল, তিনি আমার পরিচিত। এই ঘটনার মধ্যে যেরূপ অস্বাভাবিক দুবুদ্ধির পরিচয় আছে, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠকেই মনে করিতে পারেন যে, এরূপ দুঃসাহসিক কাৰ্য মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু যখন আমি এই ঘটনার আনুপূর্বিক সমস্ত ব্যাপার জানি, এবং অনুসন্ধানকারী পুলিস কর্ম্মচারীও, আমার পরিচিত, তখন এই ঘটনার সত্যাসত্য সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাঠকগণও ইহা সম্পূর্ণ। রূপ সত্য ঘটনা বলিয়া অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পারেন।
এই ঘটনা আমাদিগের এই প্রদেশীয় ঘটনা নহে, পশ্চিম দেশীয় ঘটনা। হিন্দু পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, নৈমিষারণ্য নামে একটা স্থান আছে, উহা আমাদিগের একটা প্রধান তীর্থ স্থান। পশ্চিমদেশবাসীগণ সেই স্থানকে নিমরণ কহিয়া থাকে।
কথিত আছে, ভগবান্ বেদব্যাস এই স্থানে বসিয়া ভগবদবাক্য সৰ্ব্বপ্রথমে মর্ত্যলোকে প্রকাশ করেন। যে বেদীর উপর উপবেশন করিয়া তিনি ভগবাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, নিবিড় ও নিস্তব্ধ আয় কাননের ভিতর সেই বেদী এখন পর্যন্ত বর্তমান। সেই বেদীর কিছু দূর অন্তরে চক্রপাণি নামক প্রসিদ্ধ স্থান। প্রসিদ্ধি আছে যে, যে সময় ভগবান্ বেদব্যাস ভগব প্রকাশ করিতেন, সেই সময় দেবতাগণ ও ঋষি গণের আবির্ভাব হইত। সেই স্থানে তখন একটা সামান্য স্রোতস্বতী থাকা স্বত্বেও সেই স্থানে যাহারা আগমন করিতেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই অত্যাধিক জল-কষ্ট সহ করিতে হইত। ভগবান্ বিষ্ণু এই ব্যাপার দেখিয়া জল-কষ্ট নিবারণ করিবার মানসে আপনার চক্র দ্বারা পৃথিবী ভেদ করিয়া দেন, সেই স্থান হইতে সতেজে অনবরত জল উখিত হইয়া সকলের জল-কষ্ট নিবারণ করে। সেই সময় পৃথিবী ভেদ করিয়া যে স্থান হইতে জল উঠিয়াছিল, এবং এখন পর্যন্ত যে স্থান হইতে অনবরত জল উখিত হইয়া সন্নিকটবর্তী সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতে গিয়া মিলিতেছে, সেই স্থানকে চক্রপাণি। কহে। নৈমিষারণ্য তীর্থে যাহারা গমন করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে চক্রপাণি জলে স্নান করিতে হয়।
দশ বার বৎসর পূর্বে কোন সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাকে সেই নৈমিষারণ্যে গমন করিতে হইয়াছিল। যে কাৰ্য্যে আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য শেষ হইবার পর, একদিবস আমি সেই চক্রপাণি জলে স্নান করিতে যাই। সেই স্থানে আমি স্নান করিতেছি, এরূপ সময় একজন লোক আসিয়া স্নান করিবার মানসে সেই চক্রপাণি জলে অবতরণ করেন। কথায় কথায় তাহার সহিত আমার পরিচয় হয়। ইহার নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। কিন্তু ইহার সহিত আমার কখন চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় ছিল না। ইহার নাম শুনিয়াই আমি কহিলাম, আপনি এই প্রদেশীয় পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেন না?
উত্তরে তিনি কহিলেন, হাঁ মহাশয়!
তখন আমি তাহার সম্বন্ধে যাহা যাহা অবগত ছিলাম, তাই তাহাকে কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মহাশয়! এই অপ রাধের জন্য পুলিস বিভাগ হইতে আপনার চাকরী গিয়াছে না?
উত্তরে তিনি কহিলেন, আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন?
আমি। আমি যেরূপেই অবগত হইতে পারি না কেন; কিন্তু ইহা প্রকৃত কি না?
যখন অনুসন্ধান করিয়া আমার দোষ সাব্যস্ত হইয়াছিল, এবং সেই দোষের উপর নির্ভর করিয়া সরকারী চাকরী হইতে আমাকে তাড়িত করা হইয়াছে, তখন উহা যে সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা কথা, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে?
আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিছিলেন?
যে ইনস্পেক্টারের দ্বারা তাহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইম্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব। যে ভূত-পূৰ্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার বাসায় গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি বার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।
ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জন করিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটী চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।
নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধানকার্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও হত্যা-হরণ প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিল। ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটা ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।
যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজ, পত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত আফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্ৰ আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দু ভাষাবিদ একজন মুসির সাহায্যে সেই সকল কাগজপত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কৃতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে
যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফুর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইহার জমি দারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটা কপর্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গোফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি শটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে জাসিয়া প্রথমে তাহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কার্যক্ষম ছিলেন। সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কাৰ্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্ধিত হইতেছিল।
সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুলের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।
গোফুর খাঁর কেবল একটামাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওসমান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওসমানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওসমানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সৰ্ব্বদা আপন কার্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওসমান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহলাদ করিয়া দিন অতি বাহিত করিতে লাগিল।
গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কাৰ্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।
ওসমান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।
গোফুর সর্বদা সৎকার্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।
ওমানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত।
ওসমানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাঁহার পিতা গোফুর খা তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওসমারের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্তে ক্রমে আরও বর্ধিত হইতে লাগিল।
গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্যের ভার তিনি তাহার পুত্র ওসমান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাহাকে সৰ্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওসমান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওমানের হক হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।
ওমানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর ধার কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।
এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাঁহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।
এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওসমানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সু যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।
এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে। বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জনা করেন। ওসমান একজন মধ্যবিদ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওসমানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে?
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে গোর খাঁর বাড়ী, সেই গ্রামের নিকটবর্তী একখানি গ্রামে পুলিসের থানা আছে; সেই থানার ভার প্রাপ্ত কর্ম্মচারী একজন মুসলমান দারোগা। দারোগা সাহেব একজন খুব উপযুক্ত কর্ম্মচারী। জেলার ভিতর তাঁহার খুব নাম আছে, সরকারের ঘরেও তাঁহার বেশ খাতির আছে। কিন্তু তাহার নিজের চরিত্র সাধারণত দারোগা-চরিত্রের বহিত নহে।
দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসরের কম নহে, বরং দুই এক বৎসর অধিক হইবারই সম্ভাবনা। পুলিশ বিভাগে প্রথম প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহার যেরূপ চরিত্ৰ-দোষ ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং দিন দিন বর্ষিত হইয়াই চলিয়া যাইতেছে।
কোন গ্রামে কোন একটী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া, একটা রূপবতী যুবতী তাঁহার মজয়ে পতিত হয়। পরিশেষে কোন-না-কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, ক্রমে দারোগা সাহেব তাহাকে গৃহের বাহির করেন, এবং থানার সন্নিকটবর্তী কোন এক স্থানে একখানি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিয়া, তাহাকে সেই স্থানে রাখিয়া দেন। সেই স্ত্রীলোকটা দুই বৎসরকাল সেই স্থানে বাস করিয়া দারোগা সাহেবের মনস্তুষ্টি সম্পাদিত করে।
সেই যুবতী যে সবিশেষ রূপবতী, এ কথা শোক-মুখে ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে ওসমানের জনৈক পারিষদ এ কথা জানিতে পারিয়া, ওসমানের কর্ণগোচর করিয়া দেয়। যুবতী-রূপবতীর কথা শুনিয়া ওসমান আর তাহার মন স্থির করিতে পারিল না; কোন উপায় অবলম্বন করিলে, সে সেই যুবতীকে হস্তগত করিতে পারিবে, তাহারই চিন্তায় অতিশয় ব্যগ্র হইয়া পড়িল, ও ক্রমে আপন মনোভাব প্রকাশ করিয়া সেই যুবতীর নিকট তোক প্রেরণ করিল।
যুবতী তাহার প্রস্তাবে প্রথমে স্বীকৃত হইল না; কিন্তু ওসমানও তাহার আশা পরিত্যাগ করিল না। যে কোন উপায়েই হউক, তাহাকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে লাগিল।
যে স্ত্রীলোক একবার তাহার কুলে জলাঞ্জলি দিয়া পর পুরুষের সহিত চলিয়া আসিয়াছে, এবং এতদিবস পর্যন্ত পরপুরুষেয় সহিত অনায়াসে কালযাপন করিতেছে, সেই স্ত্রীলোককে প্রলোভনে ভুলাইতে আর কতদিন অতিবাহিত হয়? দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম অধিক, ওসমানের বয়ঃক্রম তাহ অপেক্ষা অনেক অর। দারোগা সাহেব পরাধীন, ওসমান স্বাধীন। দারোগা সাহেবকে চাকরীর উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত খরচ-পত্ৰ নিৰ্বাহ করিতে হয়, আর ওসমান জমিদার-পুত্র, গোফুর খাঁর মৃত্যুর পর সেই অগাধ জমিদারীর তিনি একমাত্র অধিকারী। যেস্থলে দারোগা সাহেবকে শত মুদ্রা খরচ করিতে হইলে তাহাকে অন্ধকার দেখিতে হয়, সেই স্থলে ওসমান সহস্র মুদ্রা অকাতরে ব্যয় করিতে সমর্থ। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটীকে ওসমানের করায়ত্ব করা নিতান্ত দুরূহ কাৰ্য্য নহে। বলা বাহুল্য, ক্রমে যুবতী ওমানের হস্তগত হইয়া পড়িল; দারোগা সাহেবকে পরি ঊ্যাগ করিয়া সে ওসমানের অনুবর্তিনী হইল। ওসমান তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, কোন লুকা য়িত স্থানে তাহাকে রাখিয়া দিল।
সুন্দরী যে কাহার সহিত কোথায় গমন করিল, এ কথা দারোগা সাহেব প্রথমত জানিতে পারিলেন না; কিন্তু ক্রমে এ সংবাদ জানিতে তাহার বাকী রহিল না। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ওসমান তাঁহার মুখের পথে কণ্টক হইয়া তাঁহার যকের ধন অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাহার উপর যেরূপ ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন, তাহা বর্ণন করা এ লেখনীর কাৰ্য্য নহে। দারোগা সাহেব প্রথমত সেই সুন্দরীকে পুনরায় আপনার নিকট আনয়ন কয়বার নিমিত্ত সবিশেরূপ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এমন কি, দারোগা সাহেব এই কথা জমে ওসমানের পিতার কর্ণ গোচর পর্যন্ত করাইলেন। তাহাতেও কোনরূপ সুফল ফলিল না। ওসমানের পিতা এ বিষয়ে কোনরূপে দারোগা সাহেবকে সাহায্য নিলেন না।
এই সকল কারণে দারোগা সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধের সামান্যমাত্রও উপশম হইল না। কিরূপে তিনি ওসমান ও তাহার পিতাকে ইহার প্রতিশোধ দিতে পারিবেন, তাহার চেষ্টাতেই দিনরাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং অনবরত প্রতিশোধের সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
এইরূপে ক্ৰমে এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এই এক বৎসরের মধ্যে দারোগা সাহেব সেই সুন্দরীর আশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, বা প্রতিহিংসার প্রবল চিন্তাকেও হৃদয় হইতে তাড়িত করিতে সমর্থ হইলেন না।
এইরূপে আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিবস প্রাতঃকালে দারোগা সাহেব থানায় বসিয়া আছেন, এরূপ সময়ে একটা লোক গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, ও কাঁদিতে দিতে আমোগার সম্মুখীন হইয়া কহিল, বর্ষাবতার। আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আপনি রক্ষা না করিলে, আর কেই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।
দারোগা। কি হইছে?
আগন্তুক। ওসমান আমার সর্বনাশ করিয়াছে।
দারোগা। ওসমান! কোন ওসমান, গোর ধীর পুত্র ওসমান?
আগন্তুক। মহাশয়!
দারোগা। সে তোমার কি করিয়াছে?
আগন্তুক। সে আমার একমাত্র কন্যাকে জোর করিয়া আমার ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। কেন সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল?
আগন্তুক। কু-অভিপ্রায়ে সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। তোমার কন্যার বয়ঃক্রম কত?
আগন্তুক। সে বালিকা, তাহার বয়ঃক্রম এখনও আঠার বৎসরের অধিক হয় নাই।
দারোগা। তাহার বিবাহ হয় নাই?
আগন্তুক। বিবাহ হইয়াছে বৈ কি। তাহার স্বামী এখনও বর্তমান আছে।
দারোগা। এ সংবাদ তাহার স্বামী শুনিয়াছে?
আগন্তুক। এ সংবাদ তাহার স্বামীকে আমরা দেই নাই। তাহার স্বামী বিদেশে থাকেন। সুতরাং এ সংবাদ তিনি এখনও জানিতে পারেন নাই। তিনি না জানিতে জানিতে যদি আমার কন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে পারি, তাহা হইলে এ লজ্জার কথা আমি তাহাকে আর জানিতে দিব না।
দারোগা। তোমার কন্যা ইচ্ছা করিয়া ওসমানের সহিত গমন করে নাই ত?
আগন্তুক। মা মহাশয়! তাহাকে জোর করিয়া ওসমান। ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। তুমি ইহার প্রমাণ করিতে পারিবে।
আগন্তুক। খুব পারিব, গ্রামশুদ্ধ সব লোক দেখিয়াছে। তাঁহারা সকলেই সত্য কথা কহিবে। আপনি সেই স্থানে গমন করিলেই, দেখিতে পাইবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না?
দারোগা। কতক্ষণ হইল, ওসমান তোমার কন্যাকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
আগন্তুক। মহাশয় আজ ছয় দিবস হইল।
দারোগা। ছয় দিবস। মিথ্যা কথা। ছয় দিবস হইল, তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, আর আজ তুমি থানায় সংবাদ দিতে আসিলে; তোমার এ কথা কে বিশ্বাস করিবে?
আগন্তুক। মহাশয়! আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি কিন্তু প্রকৃত কথা কহিতেছি। আমার অনুপস্থিতিতে এই কাৰ্য্য হইয়াছে। আমার বাড়ীতে আমার সেই একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কেহই ছিল না; সুতরাং সুযোগ পাইয়া দুবৃত্ত এই কাৰ্য্য করিয়াছে। তাহার ভয়ে পাড়ার লোক আমাকে পর্যন্ত সংবাদ দিতে সমর্থ হয় নাই। অঙ্গ আমি বাড়ীতে আসিয়া যেমন এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিলাম, অমনি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। এখন আপনি রক্ষা না করিলে, আমার আর উপায় নাই।
দারোগা। তোমার বাড়ী যে গ্রামে, সেই গ্রাম হইতে ওসমানের বাড়ী কতদুর?
আগন্তুক। খুব নিকটে, পার্শ্ববর্তী গ্রামে।
দারোগা। তোমার জমিদার কে।
আগন্তুক। সেই হতভাগাই আমার জমিদার।
দারোগা। জমিদারীর খাজানা তোমার কিছু বাকী আছে।
আগন্তুক। বাকী আছে। মিথ্যা কথা কহিব না, আমি আজ তিন বৎসর খাজানা দিতে পারি নাই।
দারোগা। ফি বৎসর তোমাকে কত টাকা করিয়া খাজান দিতে হয়?
আগন্তুক। সালিয়ানা আমাকে পনর টাকা করিয়া খাজানা দিতে হয়। পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজানা আমার বাকী পড়িয়াছে।
দারোগা। সেই খাজানার নিমিত্ত তাঁহারা তাগাদা করে না?
আগন্তুক। তাগাদা কমে বৈ কি, কিন্তু দিয়া উঠিতে পারি না।
দারোগা। যখন তোমার কন্যাকে ওসমান ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সময় তাহার সতে আর কোন লোক ছিল?
আগন্তুক। তাহার সহিত আরও চারি পাঁচজন লোক ছিল।
দারোগা। ওসমানের পিতা গোয় খ সেই সঙ্গে ছিলেন?
আগন্তুক। না মহাশয়। তিনি ছিলেন না।
দারোগা। তুমি জান না; তিনি না থাকিলে, কখনও এইরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে না। গ্রামের যে সকল ব্যক্তি এই ঘটনা দেখিয়াছে, তাহাদিগকে তুমি ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছ কি?
আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু কেই সে কথা কহে না। আরও ভাবিয়া দেখুন না কেন, পুল বদি কোন যুবতী রমণীর সতীত্ব নষ্ট করিবার চেষ্টা করে, পিতা কি কখনও তাহার সহায়তা করিয়া থাকেন?
দারোগা। ওসমান শেষে উহার সতীত্ব নষ্ট করিতে পারে; কিন্তু প্রথমতঃ সেই কাৰ্যের নিমিত্ত যে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা তোমাকে কে বলিল? অপর কোন কারণে সে কি তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে না?
আগন্তুক। আর তা কোন কারণ দেখিতে পাইতেছি না, বা শুনিতেও পাইতেছি না।
দারোগা। ওমানের পিতা গোফুর খাঁ এখন কোথায় আছেন, বলিতে পার?
আগন্তুক। তিনি এখন বাড়ীতেই আছেন।
দারোগা। কানপুর হইতে তিনি কবে আসিয়াছেন।
আগন্তুক। পাঁচ ছয় দিবস হইবে।
দারোগা। তাহা হইলে যে দিবস ওসমান তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই দিবস গোয় কান পুর হইতে বাড়ীতে আসিয়াছেন।
আগন্তুক। হাঁ মহাশয়! হয় সেই দিবসই আসিয়াছেন, না হয়, তাহার পরদিন আগমন করিয়াছেন।
দারোগা। তাহা হইলে ঠিক হইয়াছে। তোমার কন্যার ধর্ম নষ্ট করিবার নিমিত্ত ওসমান তোমার দুহিতাকে ধরিয়া লইয়া যায় নাই। গত তিন বৎসর পর্যন্ত তোমার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, সেই খাজনা আদায় করিবার মানসে ওমানের পিতা গোফুর খাঁ আপন পুত্র ওসমান ও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া তোমার বাড়ীতে আগমন করেন। তুমি বাড়ীতে ছিলে না; সুতরাং তাঁহারা তোমাকে বাড়ীতে দেখিতে পান নাই। কিন্তু তুমি যে এতই বাড়ীতে নাই, ইহা না ভাবিয়া, খাজানা দিবার জয়ে তুমি লুকায়িত পাই, এই ভাবিয়া তোমাকে ভয় দেখাইয়া খাজনা আদায় করিয়া লইবার মানসে তোমার একমাত্র কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত গোফুর খাঁ তাঁহার পুত্রকে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। পিতার আদেশ পাইয়া ওসমান কয়েকজন লোকের সাহায্যে তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। খাঁ সাহেবও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিয়াছেন। কেমন, ইহাই প্রকৃত কথা কি না?
আগন্তুক। না মহাশয়। ইহা এত কথা নহে। ওসমানের পিতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন না, বা তিনি আদেশ প্রদান করেন নাই। আমার বাকী থানায় নিমিত্তও এটনা ঘটে নাই।
দারোগা। যা ব্যাটা, তবে তোর মোক গ্রহণ করিব। তুই বাড়ীতে হিলি নি, এত কথা যে কি, তাহার তুই কি জানি? আমরা ইতিপূর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, কেবল কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া নালিশ করে নাই বলিয়া, আমি এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। আমি যেরূপ কহিলাম, সেইপের সাক্ষী সকল সংগ্রহ করিয়া রাখ গিয়া। আমি একজন মাদারকে সঙ্গে দিতেছি, যাহা তুই বুঝতে না পাবি, তিনি তাহা হতাকে বুঝাইয়া দিবেন। তাঁহারা আমি গিন্ধ আসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
আগন্তুক। দোহাই ধৰ্মবতায়! যাহাতে আমি আমার কাটীকে পাই, আপনাকে সেই উপায় করতে হবে।
দারোগা। তাহাই হইবে। এখন তুই আমার জমা দারের সহিত গমন করিয়া সাক্ষী-সাবুদের সংগ্রহ করিয়া দে। তুই লেখা-পড়া জানিস্ কি? আগন্তুক। আমরা চাষার ছেলে, লেখাপড়া শিখি নাই।
দারোগা। নিজের নাম লিখিতে পারি?
আগন্তুক। না মহাশয়! আমি আমার নাম পর্যন্ত লিখিতে পারি না।
দারোগা। তোর নাম কি?
আগন্তুক। আমার নাম শেখ হেদায়েৎ।
দারোগা। আচ্ছা হেদায়েৎ, তুমি আমার জমাদারের সহিত তোমার গ্রামে গমন কর। আহারান্তে আমি নিজে গিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। সাক্ষীগণ যেন উপস্থিত থাকে।
হেদায়েৎকে এই কথা বলিয়া, দারোগা সাহেব তাহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী জমাদারকে ডাকিলেন, এবং নির্জনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া পরি শেষে তাহাকে কহিলেন, এই মোকদ্দমায় বিশেষরূপে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। যে সুযোগ পাইয়াছি, সে সুযোগ কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমার কোন ক্ষমতা কাছে কি না, এবং আমার ঘর ওসমান ও তার পিতার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটতে পারে কি না, তা তাহা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখাইতে হইবে। যেরূপ উপায়েই হউক, উঁহাদিগের উভয়কেই জেলে দিয়া আমার এতদিসের মনের যন্ত্রণা নিবারণ করিতে হইবে।
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার কহিল, আপনি যত শীঘ্র হয়, আগমন করুন। আমি সেই স্থানে গমন করি মাত্রই সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না
এই বলিয়া হেদায়েৎকে সঙ্গে লইয়া জমাদার তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেল ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।
আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান * * * গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, * * * গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *-র নিকট আমি আমার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহ নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা * * *-কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অন্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ তাহার পুত্র ওসমান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজনা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহবিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না। সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। মে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধাবিত হইলেন ও কহিলেন, হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজনা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুক্কায়িত আছে। যা হক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তাহা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজনা মিটাইয়া দিবে। এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওসমান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ে নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশ প্রায় দুই ঘণ্টা তাহাকে সেই স্থানে বসাইয়া রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমির মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁর পুত্র ওসমান ও অপরাপর কৰ্ম্ম চারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত ওসমান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগেয় বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যায় আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেই রূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি–
নিশানসহি-সেখ হেদায়েৎ।
দারোগা সাহেব প্রথম এতো পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্ৰমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সন্ধ্যায় একটু পূর্বে দারোগা সাহেব তাহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।
দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র; কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যুষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যুষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।
গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওমানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওসমান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হোয়েতের কন্যাকে লাইক করিয়া রাখিলেই খাজনা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোরখা তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওসমান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেবে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহা দিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
ওসমান ও তাহার পিতাকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে দারোগা সাহেব যাহা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, কাৰ্য্যেও তাহা পরিণত হইতেছে দেখিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।
সেই স্থানে অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত রাখিয়া হেদায়েৎ ও গ্রামের দুই চারিজন লোককে সঙ্গে লইয়া গোফুর খাঁন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
গোফুর খাঁ সেই সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওসমান সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। গোফুর খাঁর সহিত দারোগা সাহেবের কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তা হইলে পর, ওসমান আসিয়া সেই স্থানে কোথা হইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনার উপর একটা ভয়ানক নালিশ হইয়াছে। যে পর্যন্ত আমি অনুমতি প্রদান না করি, সেই পৰ্যন্ত আপনি আমার সম্মুখ হইতে গমন করিবেন না।–
ওসমান। আর যদি আমি চলিয়া যাই?
দারোগা। তাহা হইলে আপনার সহিত ভদ্রোচিত ব্যবহার করিতে আমি কোনরূপেই সমর্থ হইব না। সামান্য লোককে যেরূপ ভাবে আমরা রাখিয়া থাকি, বাধ্য হইয়া আপনাকেও সেইরূপ ভাবে আমাকে রাখিতে হইবে।
গোফুর। আমার উপর অভিযোগ কি?
দারোগা। আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার গ্রামবাসী আপনারই প্ৰজা হেদায়েতের যুবতী কন্যাকে অন্যায়রূপে আজ কয়েকদিবস হইতে আপনার বাটীতে আনিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।
গোফুর। আমার আদেশ অনুযায়ী?
দারোগা। প্রমাণে সেইরূপ অবগত হইতে পারিতেছি।
গোফুর। আমি তাহাকে আবদ্ধ করিতে আদেশ প্রদান করিব কেন?
দারোগা। বাকী খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে।
গোফুর। মিথ্যা কথা।
দারোগা। সত্য মিথ্যা আমি অবগত নহি; প্রমাণে যাহা পাইতেছি, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আর সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে।
গোফুর। আপনি প্রমাণ পাইতেছেন, আমার আদেশে এই কাৰ্য্য হইয়াছে?
দারোগা। হাঁ।
গোফুর। আমার আদেশ প্রতিপালন করিল কে? অর্থাৎ কে তাহাকে ধরিয়া আনিল?
দারোগা। আপনার পুত্র, এবং আর তিন চারিজন নোক।
গোফুর। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আপনি এখন কি করিতে চাহেন?
দারোগা। আপনি যদি সহজে সেই স্ত্রীলোকটীকে বাহির করিয়া না দেন, তাহা হইলে প্রথমতঃ আপনার বাড়ী আমি উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব। দেখিব, উহার ভিতর সেই স্ত্রীলোকটা পাওয়া যায়, কি না।
গোফুর। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কি হইবে?
দারোগা। সে পরের কথা; যাহা হয়, পরে দেখিতে পাইবেন।
ওসমান। কার হুকুম মত আপনি আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাহেন? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি বার কোন ওয়ারেন্ট আছে কি?
দারোগা। কাহার হুকুম মত আমি তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাই, তাহা তুমি বালক, জানিবে কি প্রকারে? আমি আমার নিজের হুকুমে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব।
ওসমান। যদি প্রবেশ করিতে না দি?
দারোগা। তোমার কথা শোনে কে?, আমি জোর করিয়া প্রবেশ করিব। তাহাতে যদি তুমি কোনরূপ প্রতি বন্ধকতা জন্মাও, তাহা হইলে তোমায় অপর আর এক মোকদ্দমায় আসামী হইতে হইবে।
ওসমান। যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবেন, তাহাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে জবাবদিহি কে করিবে? আপনি করিবেন কি?
দারোগা। যাহাকে জবাবদিহিতে আনিতে পারিবে, সে-ই জবাবদিহি করিবে।
ওসমান। আর যদি সে আপন ইচ্ছায় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?
দারোগা। সে উত্তম কথা; সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই কথাই বলুক। তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে।
গোফুর। তবে কি স্ত্রীলোকটা আমাদের বাড়ীতে আছে?
ওসমান। না, সে আমাদের এখানে আসেও নাই, বা আমাদিগের এখানে নাইও।
দারোগা। মহাশয়! আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। এখন কি করিতে চাহেন, বলুন। স্ত্রীলোকটাকে কি আমার সম্মুখে আনিয়া দিবেন, না আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া থানাতল্লাসি করিতে আরম্ভ করিব?
গোফুর। আমি ত বলিতেছি, সেই স্ত্রীলোকটা আমা দিগের বাড়ীতে নাই। আমার কথায় আপনি বিশ্বাস না করেন, আপনার যাহা অভিরুচি হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। কিন্তু, আমি পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, যাহা করিবেন, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া করিবেন।
দারোগা। আমার কাৰ্য আমি বুঝি, তাহার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট উপদেশ গ্রহণ করিতে আসি নাই। আমি লোকজনের সহিত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, ইচ্ছা করেন যদি, তাহা হইলে আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে কোন একটা গৃহের ভিতর গমন করিবার নিমিত্ত বলিতে পারেন। আর ইচ্ছা না করেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার সমভিব্যাহারী লোকজনের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার অভিপ্রায়ে উথিত হইলেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া গোফুর খাঁ, ওসমান, এবং সেই সময় সেই স্থানে গোফুরের বন্ধু-বান্ধব গণের মধ্যে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও সকলে দারোগা সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবার নিমিত্ত উথিত হইলেন।
দারোগা সাহেব প্রথমেই অন্দরমহলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না। সদর বাড়ীর ভিতর যে সকল গৃহ ছিল, প্রথমেই সেই সকল গৃহের মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক একখানি করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে সমস্ত খোলা ঘরগুলি দেখিলেন। তাহার ভিতর কিছু দেখিতে না পাইয়া, পরি শেষে যে ঘরগুলিতে চাবি বদ্ধ ছিল, চাবি খুলিয়া সেই ঘর গুলিও একে একে দেখিতে লাগিলেন।
গোফুর খাঁর প্রকাণ্ড বাড়ী; সুতরাং সদরে ও অন্দরে অনেক ঘর। বাহিরের ঘরগুলি দেখিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে তালাবদ্ধ কতকগুলি ঘর দেখিবার পর এক পার্শ্বের এক নির্জন গৃহের তালা খুলিলেন। সেই গৃহের ভিতর অপর দ্রব্য-সামগ্রী কিছুই ছিল না, কেবল গৃহের মধ্যে একখানি পালঙ্কের উপর একটা বিছানা আছে মাত্র।
সেই বিছানার সন্নিকটে গিয়া বা দেখিলেন, তাহাতে সমস্ত লোকেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। ইতি পূর্বে দারোগা সাহেব যাহা স্বপ্নেও একবার মনে ভাবেন নাই, তিনি তাহা দেখিয়াই যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত যেন তাহার সংজ্ঞাও বিলুপ্ত হইল। একটু পরেই দারোগা সাহেব কহিলেন, কি মহাশয়। এ কি দেখিতেছি?
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া আর কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল হেদায়েৎ সেই বিছানার সঙ্গিক বৰ্ত্তী হইয়া কহিল, মহাশয়! এই আমার কন্যা।
এই বলিয়া হেদায়েৎ তাহার কন্যার গাত্রে হস্তাপণ করিয়া বার বার তাহাকে ডাকিতে লাগিল; কিন্তু সে নড়িল না, যা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন সকলেই জানিতে পারিল যে, সে আর জীবিত নাই।
দারোগা। প্রথমতঃ বড় লম্বা লম্বা কথা কহিতেছিলে যে, এখন আর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না কেন?
গোফুর। ইহার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
দারোগা। এখন ত কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এই তালাবন্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিল?
গোফুর। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। (ওসমানের প্রতি) কিগো ওসমান মিঞা, আপনিও বোধ হয়, ইহার কিছুই জানেন না?
ওসমান। না মহাশয়! আমিও ইহার কিছুই অবগত নহি।
দারোগা। সদর বাড়ীর ভিতর তালাবদ্ধ গৃহে, পালঙ্কের। উপর মৃত স্ত্রীলোকের লাস রহিয়াছে। আর আপনারা বলিতেছেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না। দ্বারে যে দ্বারবান বসিয়া আছে, সেও বলিবে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু কিরূপে এই স্থানে লাস আসিল, ইহার যদি সন্তোষ জনক প্রমাণ আমাকে আপনারা প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের উভয়কেই আমি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাই।
দারোগার কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, এবং এই অবস্থায় কি করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করতে না পারিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন।
দারোগা। কি মহাশয়। আপনি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন যে? এই লাস কিরূপে আপনার বাড়ীর ভিতর আসিল, সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছেন না কেন?
গোফুর। আপনার কথায় আমি যে কি উত্তর প্রদান করিব, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যখন ইহার কিছুই আমি অবগত নহি, তখন আমি আপনাকে আর কি বলিব?
দারোগা। কিগো দ্বারবান্ সাহেব! এ সম্বন্ধে তুমি কি বলিতে চাই?
দ্বারবান্। দোহাই ধর্মাবতার! আমি ইহার কিছুই জানি না।
দারোগা। তুমি দ্বারবান, সর্বদা তুমি দরজায় বসিয়া থাক, অথচ তুমি বলিতেছ, তুমি ইহার কিছুই জান না। এ কথা কি কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে?
দ্বারবান্। আপনি বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি প্রকৃত কথাই বলিতেছি। আমি প্রকৃতই জানি না যে, এই মৃতদেহ কিরূপে বা কাহা কর্তৃক এই বাড়ীর ভিতর আসিল।
গোফুর খাঁ, ওসমান ও দ্বারা যখন কোন কথা বলিল না, তখন সেই সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, নিজের ইচ্ছামত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন।
লাশের সুরতহাল করিয়া পরীক্ষার্থ উহ জেলার ডাক্তার সাহেবের নিকট প্রেরণপূর্বক ঘটনাস্থলে বসিয়া দারোগা সাহেব কয়েকদিবস পর্যন্ত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এখনকার অনুসন্ধান আসামীগণকে লইয়া নহে; এখনকার অনুসন্ধান, ফরিয়াদী ও সেই স্থানের প্রজাগণের সাহায্যে এবং জমাদার সাহেবের আন্তরিক যত্নের উপর নির্ভর করিয়াই হইতে লাগিল। অর্থাৎ গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্রের বিপক্ষে এই হত্যা সম্বন্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইতে পারে, এখন সেই অনুসন্ধানই চলিতে লাগিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
পাঠকগণ পূর্ব হইতেই অবগত আছেন যে, গোফুর খাঁ একজন নিতান্ত সামান্য লোক নহেন। দেশের মধ্যে তাঁহার মান-সন্ত্রম যেরূপ থাকা আবশ্যক, তাহার কিছুরই অভাব নাই। অর্থও যথেষ্ট আছে। কিন্তু এই সকল থাকা স্বত্বেও প্রজাগণ কেহই তাহার উপর সন্তুষ্ট নহে; সকলেই তাঁহার বিপক্ষ। প্রজাগণ গোর খার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবার একমাত্র কারণ, তাঁহার পুত্র ওসমান। ওসমানের অত্যাচারে সকলেই সবিশেষরূপ জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছে। যখন ওমামের অত্যাচার তাঁহারা সময় সময় সহ করিয়া উঠিতে সমর্থ হয় নাই, তখন তাঁহারা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট পর্যন্ত গমন করিয়া, ওসমানের অআচারের সমস্ত কথা তাহার নিকট বিবৃত করিয়াছে। তথাপি গোফুর তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করেন নাই, বা তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন নাই। এই সকল কারণে প্ৰজামাত্রেই পিতা-পুত্রের উপর অস। সুতরাং আজ তাঁহারা যে সুযোগ পাইয়াছে, সেই সুযোগ পরিত্যাগ করিবে কেন? তাহার উপর দারোগা সাহেব সহায়।
প্রজাগণ এক বাক্যে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র ওসমানের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে লাগিল। অনুসন্ধান সমাপ্ত হইলে, দারোগা সাহেব দেখিলেন, নিম্নলিখিত বিষয় সম্বন্ধে উপস্থিত মোকদ্দমায় উত্তমরূপে প্রমাণ হইয়াছে।
১ম। সেখ হেদায়েতের যে গ্রামে বাড়ী, সেই গ্রামের প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁ ও ওসমান বকেয়া খাজানা আদায় করিতে সেই গ্রামে গমন করেন। হেদা য়েতের নিকট কয়েক বৎসরের খাজানা বাকী পড়ায়, এবং হেদায়েৎ সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত না থাকায়, ওসমান গোফুর খাঁর আদেশমত কয়েকজন পাইকের সাহায্যে, হেদা যেতের একমাত্র যুবতী কন্যাকে বলপূর্বক তাহার বাড়ী হইতে সৰ্ব্বসমক্ষে ধরিয়া আনে, এবং তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে গোফুর খাঁর আদেশমত সৰ্ব্ব সমক্ষে তাহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করে। কিন্তু তাহার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, গোয় খ ও ওসমান অপরাপর লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে বলপূর্বক ধরিয়া আপন গৃহাভিমুখে লইয়া যান।
২য়। অপরাপর গ্রামের কতকগুলি প্ৰজার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে হেদায়েতের গ্রাম হইতে ধৃত অবস্থায় গোফুর খাঁর গ্রামে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র কর্তৃক লইয়া যাইতে অনেকেই দেখিয়াছে।
৩য়। গোফুর খাঁর গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী প্রজাবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে গোয় খা ও ওসমান তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছে।
৪র্থ। গোফুর খাঁর কয়েকজন ভৃত্য ও তাহার সেই পূর্ব বর্ণিত দ্বারবানের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁর আদেশমত ওসমান হেদায়েতের সেই কন্যাকে আপনাদের গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, এবং যে পর্যন্ত সে জীবিত ছিল, তাহার মধ্যে ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সে নিতান্ত অস্থির হইলেও, তাহাকে একমুষ্টি অন্ন বা এক গণ্ডুষ জল প্রদান করিতে বারণ করিয়াছিল। এমন কি, সাক্ষিগণের মধ্যে কেহ দয়াপরবশ হইয়া উহাকে এক গণ্ডষ পানীয় প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, গোফুর ও তাঁহার পুত্র ওসমান খ। তাহাকেও উহা প্রদান করিতে দেন নাই।
এতদ্ব্যতীত আরও প্রমাণিত হইল যে, যে দিবস পুলিস কর্তৃক লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহার দুই কি তিন দিবস পূর্বে একজন ভৃত্য কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, ওসমান খার নিকট হইতে সেই গৃহের চাবি অপহরণ করে, এবং ওসমান ও গোফুর খাঁর অসাক্ষাতে সেই গৃহের চাবি খুলিয়া দেখিতে পায় যে, ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার আর বাঁচিবার কিছুমাত্র আশা নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই সামান্য ভৃত্যেরও অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং দ্বারধানের সহিত পরামর্শ করিয়া, সে ইহা স্থির করিল যে, তাহার অদৃষ্টে যাহাই হউক, সে আজ সেই হতভাগিনীকে কিছু আহারীয় ও পানীয় প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে কিছু আহারীয় ও পানীয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করে। কিন্তু উহা সংগ্রহ করিয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া দেখিতে পায় যে, ওসমান খাঁ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভূতের অভি সন্ধির কথা জানিতে পারিয়া, ওসমান তাহার উপর সবিশেষ রূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার হস্ত হইতে আহাৰীয় ও পানীয় কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে, সেই স্ত্রীলোকটী আহারীয় ও পানীয় প্রার্থনা করিয়াছে, এই ভাবিয়া ওসমান সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, ও সেই মহা অপরাধের জন্য সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ভৃত্যাদি উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সম্মুখে সেই মৃত্যুশয্যা-শায়িত স্ত্রীলোকটীকে পদাঘাত করেন। সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার কথা কহিবার বা রোদন করিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা ছিল না; সুতরাং সেই পদাঘাত সে বিনা-বাক্যব্যয়ে অনায়াসেই সহ করে। পরিশেষে ওসমান সেইরূপ অবস্থাতেই সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া, পুনরায় সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দৈন, এবং চাবি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ভৃত্য গোয় খার নিকট গমন করিয়া তাহার নিকট এই সমস্ত ঘটনা বর্ণন করে। গোর খ ইহার প্রতিবিধানের পরিবর্তে, সেই ভৃত্যের উপরই বরং অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহাদিগের বিনা-অনুমতিতে সেই স্ত্রী লোকটীকে আহারীয় ও পানীয় দিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া, তাহাকে কটুক্তি করিয়া গালি প্রদান করেন, ও চাকরী হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন।
৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওসমান খাঁর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।
৬ষ্ঠ। একজন পাইক,যে গোর খার পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করি বার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁন বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সৰ্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।
৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।
৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।
এই মোকদ্দমায় গোফুর খা ও তাঁহার পুত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিষ্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্র বাহির করিয়া জানায়, এবং দারোগা সাহেব তাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন না বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্ৰজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাহার পুত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাহার জ্ঞাতসারে এ কাৰ্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কাৰ্য্য পৰ্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া ছেন। তাহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রি কালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
দারোগা সাহেব তাহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?
হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?
দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?
হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।
দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিক-পুত্রকে?
হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?
দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।, হোসেন। যে পর্যন্ত মোকমার চুড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।
দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্যন্তু ওসমান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওসমানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্বপ্রধান-ধৰ্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কাৰ্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কাৰ্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাচাই বার কথা দুরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওসমানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?
দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওসমান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপ। যে পিতা পুত্রের দুস্কাৰ্য্য সকল জানিতে পারি, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপ স্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।
হোসেন। ওসমান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওসমান এতদুর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।
দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওসমান কর্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?
হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কাৰ্য্য তাহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কাৰ্য্য তখন ওসমান বা তাঁহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কাৰ্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।
দারোগা। যে কাৰ্য্যের সহিত আমার সংশ্রব আছে, সে কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?
হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওসমান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।
দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়া ছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। উর্দ্ধতন কর্ম্ম চারীগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?
হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারি না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর রূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোক হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।
দারোগা। প্রসঙ্গ না হইলেও, যখন আপনি এতদুর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।
হোসেন। ওসমান সহ দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোরও পুত্র-মেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু
মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদম উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহ আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।
দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ কিরূপে আসিল?
হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।
দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?
হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।
দারোগা। আমি ত কোন দোষ দেখিতেছি না।
হোসেন। মনে করুন, যে সকল কথা আমি প্রকৃত বলিয়া এখন বিশ্বাস করিতেছি, ও আপনি জানিতে চাহেন বলিয়া, আপনাকে যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সে সকল কথা আবশ্যকমত অস্বীকার করিলেও, আমি নিষ্কৃতি পাইব না।
দারোগা। আপনার নিষ্কৃতি না পাইবার কারণ কি?
হোসেন। আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে যে সকল লোকের সম্মুখে আমি এখন সেই সকল কথা বলিতেছি, আবশ্যক হইলে সেই সকল লোকের দ্বারা আপনি উহা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন।
দারোগা। সেই সকল কথা আইনমত, ওরূপে প্রমাণ হইতে পারে না।
হোসেন। প্রমাণ হউক, বা না হউক, যদি আপনি নিতান্তই অবগত হইতে চাহেন, তাহা হইলে কাহারও সম্মুখে আমি সেই সকল কথা কহিব না। একাকী শুনিতে চাহেন, ত আমি বলিতে প্রস্তুত আছি।
দারোগা। আর যদি আমি আবশ্যকমত আপনাকে সাক্ষী স্থির করি, তাহা হইলে আপনি কি করবেন? আপনি এখন আমাকে যাহা বলিবেন, তখনও আপনাকে তাহাই বলিতে হইবে।
হোসেন। তাহা বলিব কেন? আবশ্যক হয়, সমস্ত কথা আমি অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারিব।
সম্পূর্ণ।