-সায়নী..হলো তোদের?
-হ্যাঁ কাকীমা এই হয়ে এল..
-তাড়াতাড়ি করনা মা। ওরা এলেন বলে
বলেই নিজের কাজে চলে গেল সুমনা। আজ তার একমাত্র মেয়ে সুরভীকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে। দেখতে আসছে বললে ভুল হবে ,এ তো রীতিমতো পাকা দেখার দিন। সুমনার ছোটোবেলার বান্ধবীর মাধ্যমেই বিয়েটা লাগছে। ছেলে কলেজের প্রফেসর । দেখতে শুনতেও ভালো । বড়োলোকের একমাত্র সন্তান । বিয়ের কথাটা অনেক দিন থেকেই হয়ে আছে । আজ ছেলে ও তার মা, ঠাকুমা ,জেঠিমা আসছে।
-কইগো গিন্নি রান্নাবান্না হলো? এদিকে এসো ওরা চলে এলো বলে।
-হলো এতক্ষণে ।
আসছি গো আসছি মাংসটা নামিয়ে রেখে ,ফ্রেশ হতে যায় সুমনা সেন ওরফে সুরভীর মা। কনের ডাক পড়তেই অন্তরমহল থেকে অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা কম্পিত হয় খানিক সুরভীর । পরিস্থিতি সামাল দিতেই সায়নী সুরভীর নরম হাতটাই চাপ দিয়ে আস্বস্ত করে। মায়ের কথা মতো মেপে মেপে পা ফেলে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসে সুরভী। আজ সে আসমানী রঙ্গের জামদানি পরেছে । হাল্কা সাজসজ্জার সাথে ম্যাচিং কসমেটিকসে সুন্দরী সুরভীকে মোহময়ী লাগছে । বিচারকমন্ডলীর সম্মুখে বসতে বসতেই উজানের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায় সুরভীর। মনের গহীনে চরম উত্তেজনার সাথেসাথেই অদ্ভূত একটা ভালোলাগার আবির ছড়িয়ে পড়ে সুরভীর কাজল কালো দুই নয়নে। গোলাপি ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি টেনে উপস্থিত অতিথিবৃন্দকে নমস্কার জানায় সুরভী ।
-আমি তো শুনেছিলাম মেয়ে উজানের ঘাড় বরাবর হবে ,এতো দেখছি তার থেকেও ছোটো মুখে সিঙাড়ার একটা টুকরো ঢুকিয়ে বললো বয়স্ক ঠাকুমা ।
-খুব ছোটো হবেনা.. রুপে,গুনে কোনো দিক দিয়েই কম যাবেনা আমার মেয়ে…
-তা আপনার মেয়ের রুপ যে আছে তা কী আমরা দেখতে পাচ্ছিনা রহস্য করে বলে ছেলের মা।
কথাগুলো দারুণভাবে সুরভীর কোমল হৃদয়টাকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছিলো। দিদির কাছে ফেসবুকে দেখেই প্রেমে পড়েছিল সে উজানের । যদিও এর আগে কখনোই সামনাসামনি দেখেনি তাকে, তবুও তার কথা ভাবলেই টুকটুকে ফর্সা গালে রঙিন ফাগ দাপাদাপি করতো । আজ গাড়ি থেকে উজান যখন নামছিল ,ঘরের জানালা দিয়ে চুপিচুপি দেখেই তার ভীতরটা ওলোট পালোট হয়েছে! এমন একজন রাজপুত্র যে তার মনের উপর রাজত্ব করবে, সেটা ভেবেই গর্বে বুক ফুলেছে তার ।
-একটু উঠে দাঁড়াও তো মেয়ে উজানের ঠাকুমার ডাকে হতচকিয়ে যায় সুরভী। মহিলা কখন তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতেও পারেনি । উঠে দাঁড়াতেই লম্বা কালো চুলগুলো কোমর ছাপিয়ে পড়ে।
-এগুলো আসল, নাকি নকল?
ঠাকুমার প্রশ্নে আবাক ও অপমানিত হয় সুরভী। উজানের দিকে ফিরতেই নিরুত্তাপ মুখবয়বটা দেখে স্বপ্নগুলো ঝনঝন্ করে ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাই সে। বাবা , মাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
-এদিক ওদিক কী দেখছো? কালা নাকি?
-না ঠাকুমা আমি ঠিক কালা নই। আসলে ছোটো তো তাই একটু কম বুঝি…তা আপনার নাতি বুঝি অবলা !! আপনারা এতো কথা বলছেন তবুও সে একটা কথাও বলছেনা…আমি তো উল্টোটা শুনেছিলাম । আমার হাইট নিয়ে এতো সমস্যা যাদের তারা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কী করছে আমি সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি!!
-আঃ..সুরভী কী হচ্ছে এটা? বাবার ধমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুরভী । গটগট করে উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে- এই যে শুনুন, ওপরের চাকচিক্য আমার ঠিক পছন্দ নয়,অন্তরের গভীরতা তার চেয়ে অনেক দামি । আর আপনার মতো ক্যাবলা কান্তের আমার বর হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই..আসতে পারেন সুরভীর নমস্কারের ভঙ্গিমায় উজান উঠে দাঁড়ায়। রাগে অপমানে বেরিয়ে যায় সে । একে একে সবাই পাত্রের দিকেই ধাবিত হয় ।
-এত দেমাক!! বলি টিকবে তো?
বলেই পা বাড়ায় পাত্রের ঠাকুমা । সম্মানিত মানুষগুলোকে অপমান করার অপরাধে সুরভী কাঠগড়ায়। ঢং…ঢং করে সময় জানান দিলেও বাড়ির অভিভাবক রুপী জ্যাঠা, বাবা স্থির। আগুনের স্ফুলিঙ্গর বহিঃপ্রকাশ অনিবার্য বুঝতে পেরেই সুমনা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে,
-এইভাবে মানুষগুলোকে অপমান করলি সু? এ শিক্ষা তো আমি তোকে দিইনি কখনও। এতো ভালো বিয়েটা ভেস্তে দিলি , আর এমন বিয়ে আসবে তোর? সমাজে মুখ দেখাতে পারবো?
-আমাকে বিদায় করতে পারলেই শান্তি তো? যেখানে সেখানে তাড়িয়ে দিলেই দায় মুক্ত তোমরা তাইনা?
সপাটে একটা চড় এসে পড়ে সুরভীর যত্নে লালিত গালে । ঘরের পরিবেশটা থমথমে হয়ে যায় আরও।
-অসভ্য মেয়ে , বড়োদের সামনে কী করে কথা বলতে হয় জানোনা?
-না জানিনা বাবা।
মায়ের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে সে বলতে থাকে- বিয়ের আগেই যারা এইভাবে অপমান করতে পারে ,পরবর্তীতে তারা কেমন হবে বলতে পারো? আর যারা এমন আচরণ করতে পারে তারা আর যাইহোক সম্মানিত কখনোই নয়..আমার ভালোটা আমাকেও বুঝে নিতে দাও..সংসারটা আমি করবো না তোমরা বাবা?
-তুমি কোথায় ভালো থাকবে সেটা তোমার চেয়ে আমরাই ভালো বুঝবো। মেয়েদের একটু মানিয়ে নিতে হয়,সেটা জানোনা? আমি দেখছি কী করা যায়…তুমি ওদের কাছে ক্ষমা চাইবে..
হুংকার করে জানিয়ে দেয় বাবা।
-না..ও মানিয়ে নেবে না। উপযুক্ত কাজ করেছে আজ সু । আর কারও কাছে ক্ষমাও চাইবেনা সু।কেন নারীই মানিয়ে নেবে সারাজীবন? কেন পুরুষ নয়? ও কোথায় ভালো থাকবে সেটা ওকেই বুঝতে দাও। এই ব্যাপারে আর কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা।
সমস্ত রক্ষচক্ষুকে অবজ্ঞা করে নাতনির পাশে দাঁড়ায় ষাটোর্ধ্ব বিমলা দেবী, যে নিজেই এতোদিন সংসারের যাতাকলে নতুন ছাচে গড়েছে নিজেকে। এতদিনের পরিচিত ঠাম্মিকে কেমন অপরিচিত লাগে সুরভীর। অতিরিক্ত বাঁধনে এভাবেই হয়তো বেরিয়ে আসে কিছু মানুষ যারা দিনবদলের পক্ষে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে!! চিরাচরিত প্রথাগুলোর পরিবর্তনে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ…ঠাম্মির হাত ধরে আবার নতুন করে বাঁচবে সুরভী ,যেখানে স্বপ্ন থাকবে তবে বাস্তবের বড্ড কাছে….