সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হাতের কাজ শেষ করিয়া অফিস–ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে পশ্চিমদেশীয় একজন ভদ্র লোক আমার সম্মুখে আসিয়া নমস্কার করতঃ একখানি পত্ৰ দিলেন। পত্ৰখানি গ্ৰহণ করিয়া দেখিলাম, উহা আমারই উপরিতন কৰ্ম্মচারীর লেখা। খুলিয়া পাঠ করিলাম। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে খুন হইয়াছে, আমাকে তখনই পত্রবাহকের সহিত তাহার তদ্বির করিতে যাইতে হইবে।
কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি দাঁড়াইয়া উঠিলাম। আগন্তুক আমার অভিপ্ৰায় বুঝতে পারিয়া পরম আপ্যায়িত হইয়া বলিলেন, আসুন মহাশয়! আমি ধনে প্রাণে মারা গেলাম। সকল কথা গাড়ীতেই শুনিতে পাইবেন।
দ্বিরুক্তি না করিয়া আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইলাম। ফটকের সন্মুখেই তাঁহার গাড়ী ছিল, উভয়েই সেই গাড়ীতে উঠিলাম। কোচমান শকট চালনা করিল।
লোকটীর বয়স প্ৰায় পয়ত্ৰিশ বৎসর, দেখিতে অতি সুপুরুষ। বেশ হৃষ্ট–পুষ্ট দেহ। তাঁহার পরিধানে একখানি পাতলা দেশী কালাপেড়ে ধুতি, একটা আদ্ধির পিরাণ, একখানি মান্দ্ৰাজী জরিপেড়ে উড়ানি, মস্তকে একটা ফিরোজা রঙের পাগড়ী, গলায় গিনি সোণার মোটা হার, কৰ্ণে হীরাবসান ফুল, হস্তে হীরার আংটী, পায়ে বাৰ্ণিশ করা জুতা।
কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি অতি বিমৰ্ষভাবে বলিলেন, মহাশয়, আমার সাৰ্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার ভাবী–পত্নীকে কে খুন করিয়াছে।
ভাবী পত্নীর কথা শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম, তাহার মুখের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিলাম। তিনি আমার মনোগত ভাব বুঝিয়া বলিলেন, দুই বৎসর হইল আমার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁহার মৃত্যুর পরে আমার একমাত্র পুত্রও মারা পড়ে। মনে করিয়াছিলাম, আর সংসারে লিপ্ত হইব না; কিন্তু বিধিলিপি অখণ্ডনীয়। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে শোভন সিং নামে আমার এক বন্ধু বাস করিতেন। আমি প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত কিরিতাম। শোভন সিংএর অবস্থা বড় ভাল ছিল না। তাঁহার একটী কন্যা ছিল। মেয়েটার বিবাহের বয়স উৰ্ত্তীর্ণ হইলেও অর্থঅভাবে তিনি বিবাহ দিতে পারেন নাই। কন্যার নাম রূপসী। তাহার বয়স প্ৰায় চৌদ্দ বৎসর, দেখিতে বেশ সুন্দরী। একদিন কথায় কথায় শোভন সিং কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করেন এবং আমাকে বিবাহ করিবার জন্য অত্যন্ত অনুরোধ করেন। উদ্ধাপসী সুন্দরী যুবতী, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার, দু–পয়সার সঙ্গতিও আছে। আমিও পিতার একমাত্র সন্তান, বিবাহ না করিলেন বংশ লোপ হইবে, এই আশঙ্কায় বিবাহে সন্মত হইলাম। কিন্তু তাহার পর হইতে শোভন সিং আর বিবাহের কথা উত্থাপন করেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে বিবাহের দিন স্থির করিতে বলি। শোভন সিং আমার কথায় যেন বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, পাঁচশত টাকা না দিলে আমি রূপসীকে দান করিতে পারিব না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভন সিং কি পূৰ্ব্বে টাকার কথা বলেন নাই?
তিনি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, টাকার নামও করেন নাই। টাকা দিতে হইবে শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, হয় ত তিনি আর কোথাও পাত্র ঠিক করিয়াছেন। এখন টাকা চাহিয়া আমাকে তাড়াইবার চেষ্টায় আছেন। আমার তখন বিবাহে ইচ্ছা হইয়াছে। রূপসীও জানিতে পারিয়াছে যে, তাহার সহিত আমার বিবাহ হইবে। পূর্বের মত সে ও আর আমার কাছে অসিত না। কাজেই আমি সন্মত হইলাম। বলিলাম, আমি টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি বিবাহের দিন স্থির করুন। তখনই একজন দৈবজ্ঞকে ডাকা হইল। তিনি আসিয়া আমাদের বিবাহের দিন ধাৰ্য্য করিয়া দিলেন। কিন্তু দুরদৃষ্ট বশতঃ সে লগ্নে আমাদের বিবাহ হইল না।
আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন?
তিনি বলিলেন, বিবাহের দুই দিন পূর্বে শোভন সিংএর এক জ্ঞাতি বিয়োগ হয়। কালাশৌচ, কাজেই বিবাহ হইল না। অশৌচান্তে আবার দিন স্থির হইল। কিন্তু সেবারও বিবাহ হইল না। রূপসীর সাংঘাতিক জর হইল। প্ৰায় তিন মাস ভুগিয়া রূপসী আরোগ্যলাড করিল। এইরূপে আরও তিন চারিবার দিন ধার্য্য হইল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তখনও বিবাহ হইল না। কোন না কোনো অছিলা করিয়া শোভন সিং বিবাহের দিন ক্রমাগত পিছাইয়া দিতে লাগিলেন। প্ৰায় আট মাস কাল এইরূপে অতিবাহিত হইল। পরে একদিন শোভন সিং বলিলেন যে, রূপসী ও বাড়ীর অন্যান্য লোকের চিকিৎসায় তাহার অনেক অর্থব্যয় হইয়া গিয়াছে। যদি আমি আরও তিন শত টাকা দিই, তাহা হইলে আমাদের শীঘ্রই বিবাহ হইতে পারে। আমি তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি। কাজেই শোভন সিংএর প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। বোধ হয় তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি আর অধিক টাকা দিতে স্বীকৃত হইব না। কিন্তু যখন আমি তাহাতেও সম্মত হইলাম, তখন তিনি আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। মুখে বলিলেন, সমস্ত টাকা অগ্রিম দিলেই বিবাহ হইবে। আমিও নাছোড় বান্দা, পরদিনই আটশত টাকা আনিয়া শোভন সিংএর হস্তে দিলাম। তিনি আনন্দিত মনে উহা গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কোন রসিদ দিলেন না, আমিও চক্ষু লজ্জায় পড়িয়া কোন রসিদ চাহিলাম না। তবে যখন টাকা, দিই, সেই সময়ে সেখানে তিন চারিজন লোক ছিলেন। তাঁহারাই সাক্ষী স্বরূপ ছিলেন। সে যাহা হউক, টাকা পাইয়া শোভন সিং আবার বিবাহের দিন স্থির করিলেন। আজই সেই দিন। বেলা পাঁচটার সময় আমি কয়েকজন মাত্র বরযাত্ৰ লইয়া কন্যার গৃহে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীতে প্ৰবেশ করিবামাত্র একটা ভয়ানক গোলযোগ আমার কর্ণগোচর হইল। ক্ৰমে চীৎকার, ক্ৰন্দনধ্বনিও শুনিতে পাইলাম। মনে একটা কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হইল। আমার সঙ্গীগণ দেখিয়া শুনিয়া অবাক হইলেন। বর বা বরযাত্র বসিবার স্থান পৰ্য্যন্ত করা হয় নাই। কি করিব, কোথায় বসিব ভাবিতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমাদের নিকটে আসিলেন। বলিলেন, রূপসীকে কে খুন করিয়াছে। ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিয়া প্রতিবেশিগণ ছুটিয়া আসিল, বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য হইল। রূপসীর মৃত্যু–সংবাদে দুঃখ হওয়া দূরে থাক, আমার অত্যন্ত ক্ৰোধ হইল। আমি অতি কৰ্কশ স্বরে বলিলাম, চলুন–আমি মৃতদেহ দেখিতে চাই। কেমন করিয়া কেই বা রূপসীকে খুন করিল, আপনিই বা এখনও থানায় এ সংবাদ দেন নাই কেন? আমি বড় ভাল বুঝিতেছি না। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনরূপ ষড়যন্ত্র আছে। রূপসী যদি সত্য সত্যই খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না। এই দণ্ডে আমার আটশত টাকা চাই।
আমার কথায় শোভন সিং কাতর হইলেন। বলিলেন, আমার কন্যার মৃতদেহ পৰ্যন্ত পাইতেছি না। অগ্ৰে তাহার সন্ধান না করিয়া কেমন করিয়া থানায় সংবাদ দিব। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আপনি এখনই সংবাদ দিতে পারেন। আমি এক কোনদিক দেখিব?
কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল। আমি তখনই সেখান হইতে বিদায় লইলাম এবং তৎক্ষণাৎ বরবেশ ত্যাগ করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। রূপসীকে পাই ভালই, নচেৎ আমার আটশত টুকো ফিরাইয়া চাই। আপনাকে ঐ টাকা আদায় করিয়া দিতে হইবে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? নামই বা কি?
তিনি বলিলেন, আমার নাম লাল সিং, বাড়ি শিয়ালদহের নিকট।
লালসিং–এর টাকার কথায় আমি কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি পুনরায় ঐ কথা তুলিলেন। আমি বলিলাম, টাকা আদায় করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমি কেবল খুনের তদ্বির করিতে পারিব।
এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীখানি একটী ক্ষুদ্র অট্টালিকার সম্মুখে থামিল। লালসিং অগ্ৰে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন। আমিওঁ নামিয়া তাঁহার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া আমরা একটী ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বিবাহোৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য বাড়ীখানি বেশ সাজানো হইয়াছে। চারিদিকে বেলোয়ারি ঝাড় ঝুলিতেছে, একখানি চাঁদোয়া দ্বারা সমস্ত প্রাঙ্গন আচ্ছাদিত রহিয়াছে। তাহারই নিম্নে একটা ঢালা বিছানা পাড়া ছিল। সেই বিছানার এক পার্শ্বে পাত্রের বসিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু একজন লোককে ও সেই শয্যার উপর দেখিতে পাইলাম না। অন্দর হইতে রমণীদিগের রোদনশব্দ আমার কর্ণগোচর হইতে লাগিল। কিন্তু শোভনসিংকে দেখিতে পাইলাম না।
কিছুক্ষণ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় লালসিং অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা একজনকে দেখাইয়া বলিলেন, ইনিই শোভন সিং আমার ভাবী শ্বশুর।
শোভন সিং আমাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিই কি আমার কন্যার মৃতদেহ দেখিতে আসিয়াছেন?
আমি লালসিংকে দেখাইয়া বলিলাম, ইনি বলেন, আপনার কন্যা খুন হইয়াছে। কিন্তু আপনি ইঁহাকে তাহার মৃতদেহ দেখাইতেছেন না। আমি ইঁহার মুখে সমস্তই শুনিয়াছি। এখন লাস কোথায় বলুন?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার কথা শুনিয়া শোভন সিং চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, মহাশয়। আমার একমাত্ৰ সন্তান–ঐ কন্যা ভিন্ন আমার আর কোন সন্তানাদি হয় নাই। তাহার বিয়োগে আমি যে অত্যন্ত কাতর হইয়াছি এ কথা বলাই বাহুল্য।
শোভন সিংএর অবস্থা দেখিয়া এবং তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। তাহার বয়স প্ৰায় বিয়াল্লিশ বৎসর; কিন্তু এই বয়সেই তাহার দেহের মাংস শিথিল হইয়াছে, সম্মুখের, উপর–পাটীর দুইটী দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। গোঁপ শ্মশ্রু ও মস্তকের কেশ পাক ধরিয়াছে। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, তাঁহার দেহ দীর্ঘ ও শীর্ণ, হস্ত প্ৰায় আজানুলম্বিত, চক্ষু ক্ষুদ্র ও কোটরগ্ৰস্ত নাসিক উন্নত এবং ললাট প্রশস্ত। মুখ দেখিয়াই কেমন ক্রূর প্ৰকৃতি বলিয়া বোধ হইল।
অপর কথায় সময় নষ্ট করিতেছেন দেখিয়া আমি বিরক্ত হইলাম। বলিলাম,–আমি আপনার দুঃখের কথা শুনিতে আসি নাই। কন্যাবিয়োগে আপনি যে কাতর হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য্য কি? এখন আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর দিন; আপনার কন্যার লাস কোথায় বলুন?
আত্ম সংবরণ করিয়া শোভন সিং বলিলেন,–সেই কথাই বলিতেছি,–রূপসীর লাস পাওয়া যাইতেছে না।
আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! লাস পাওয়া যাইতেছে না কি?
কাঁদ কাঁদ হইয়া শোভন সিং বলিলেন,–এখান হইতে কিছু দূরে আমার এক আত্মীয় বাস করেন, রূপসী আজি প্রাতে তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল। বাছা আমার সেই অবধি আর ফিরে নাই।
তবে খুন হইয়াছে বলিতেছেন কেন? আপনার কন্যা নিরুদেশ হইয়াছে। হয় সে নিজে পলায়ন করিয়াছে, নচেৎ কোন লোক তাহাকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে।
না মহাশয়! সকল কথা শুনিলে বুঝিতে পরিবেন। রূপসী আর এ জগতে নাই।
এই বলিয়া শোভন সিং আবার চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। কন্যাবিয়োগে তিনি বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া আবার বলিতে লাগিলেন,–প্ৰাতে রূপসী একজন সঙ্গিনী লইয়া এ বাড়ী হইতে বাহির হয়। পথে এক বৃদ্ধা তাহার সহিত আলাপ করে এবং উভয়কেই ভুলাইয়া লইয়া যায়। যে রূপসীর সঙ্গে গিয়াছিল, অনেকক্ষণ পরে সে ফিরিয়া আসিয়াছে, কিন্তু রূপসী আর ফিরে নাই। গৌরীর মুখে যাহা যাহা এখন শুনিতেছি, তাহা বড়ই ভয়ানক।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–গৌরী কে?
গৌরী আমার ভাগিনেয়ী, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে এখানে আসিয়াছে। গৌরীই রূপসীর সহিত প্ৰাতে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিল।
আ। সে কি বলে?
শো। আমি তাহাকে ডাকিয়া আনিতেছি, আপনি তাহার মুখেই সকল কথা শুনুন। এমন ইংরাজ রাজত্বে এখনও যে এই লোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিতে পারে, আমার এমন ধারণা ছিল না।
এই বলিয়া আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তিনি অন্দরে প্ৰবেশ করিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই এক খৰ্বীকৃতি বালিকার হস্তধারণ করিয়া পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–এই বালিকার নাম গৌরী, আপনি ইহার মুখেই সমস্ত শুনতে পারবেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, গৌরী যখন ফিরিয়া আইসে, তখন তাহার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। সে যেন পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল।
গৌরীকে দেখিতে খৰ্ব্বাকৃতি হইলেও আমার অনুমানে তাহার বয়স অন্ততঃ পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার দেহ শীর্ণ কিন্তু তাহাতে যৌবনের চিহ্নগুলি ক্ৰমেই ফুটিয়া উঠিতেছে। গৌরীর আয়ত চক্ষু সদাই চঞ্চল, মুখখানি কাঁদ কাঁদ।
গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম,–বল মা! কি জান বল?
কাঁদ কাঁদ হইয়া গৌরী উত্তর করিল—খুব ভোরে আমরা এখান হইতে বাহির হই। পথে লোক ছিল না বলিলেও অমন বাহির হইলাম বটে, কিন্তু দু-জনেরই গা কেমন ছমছম করিতে লাগিল। যখন আমরা পদ্মপুকুরের ধারে গিয়া উপস্থিত হই, দেখিলাম, এক বুড়ী যেন আমাদেরই দিকে আসিতেছে। কাছে অসিলে দেখিলাম, সে আমাদেরই দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবা মাত্ৰ বুড়ী এক গাল হাসিয়া আমাদের নিকটে আসিল এবং নিমেষ মধ্যে দুই হাতে দুইটি জবা বাহির করিয়া আমাদের উভয়ের নাসিকার নিকট ধরিয়া বলিল,–দেখ দেখি, জবায় কেমন গোলাপ-গন্ধ? আর কখন এমন জবা দেখেছ কি?
সত্যসত্যই গোলাপের গন্ধ পাইলাম, জবাফুলে গোলাপ–গন্ধ পাইয়া কেমন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। তখন উভয়েই সমস্ত কথু ভুলিয়া গেলাম। রূপসীর বিবাহের কথা ভুলিলাম, কোথায় যাইতেছিলাম ভুললাম, বাড়ী ভূলিলাম, এমন কি, আপনাদের অস্তিত্ব পৰ্য্যন্ত ভুলিলাম। রহিল কেবল সেই বৃদ্ধ। আমরা তাহার হাতের খেলনা স্বরূপ হইলাম। সে আমাদিগকে যাহা বলিতে লাগিল, আমরা অনায়াসে তাহা করিতে লাগিলাম। প্ৰথমে সে আমাদিগকে কিছুদূরে লইয়া গেল। সেখানে একখানি গাড়ী ছিল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। কতক্ষণ পরে বনের ভিতর একটা ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় আসিয়া গাড়ী থামিয়া গেল। আমরা সকলেই গাড়ী হইতে নামিয়া সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের মধ্যে তিনজন সন্ন্যাসী একদৃষ্টি সম্মুখের প্রজ্জলিত অগ্নির দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। সন্ন্যাসী তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখিতে অতি ভয়ানক, অপর দুইজনকে তাহার শিষ্য বলিয়াই বোধ হইল।
আমাদের পায়ের শব্দে সেই ভয়ানক সন্ন্যাসী উপরদিকে চাহিল এবং বুড়ীকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া নিকটস্থ দুইখানি কুশাসন ইঙ্গিত করিয়া দেখাইয়া দিল। বৃদ্ধাও তাহার সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া আমাদের দুইজনকে সেই দুইখানি আসনে বসিতে বলিয়া স্বয়ং নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল।
কতক্ষণ এইরূপে কাটিল বলিতে পারি না। কিন্তু কিছু পরেই অপর দুই সন্ন্যাসী রূপসীর হাত ধরিয়া সেখান হইতে লইখা গেল, আমি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলাম, কিন্তু আমার চীৎকারে কেহ ভ্রূক্ষেপও করিল না। আর ও কিছুক্ষণ এইরূপে অতিবাহিত হইল। তাহার পরে দেখিলাম, রূপসীর অচেতন দেহ সেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। পরক্ষণেই বুড়ী আমার হাত ধরিয়া ঘর হইতে বাহিরে আনিল এবং কত পথ ঘুরাইয়া একটা বাগানের নিকট আমায় ছাড়িয়া দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।
আমিও চীৎকার করিতে লাগিলাম, কিন্তু যে স্থানে সেই বৃদ্ধ অ্যামকে ছাড়িয়া দিয়াছিল, সেখানে লোকজন নাই বলিলে ও চলে; এত চীৎকার করিলাম, এত কাঁদিলাম, কেহই আমার সাহায্যের জন্য আসিল না। এই সময় হইতে আমার আর কিছুই মনে নাই। আমি তাহার পর কি করিলাম, কেমন করিয়া এখানে ফিরিয়া আসিলাম, এখানে আসিয়াই বা কি করিলাম, কিছুই জানি না। যখন রাত্ৰি হইল, বর আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন আমার জ্ঞান হইল; তখন আমি সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম।
এই বলিয়া গৌরী স্থির হইল এবং একদৃষ্টি আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া শোভন সিংকে জিজ্ঞাসা করিলাম,–আপনার কন্যার গাত্রে কোন অলঙ্কার ছিল কি?
শো। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্ৰায়; দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার রূপসীর গাত্রে ছিল।
আ। আপনার ভাবী জামাতার মুখে শুনিলাম, আপনার আর্থিক অবস্থা বড় ভাল নহে। আপনি এত টাকার গহনা কোথায় পাইলেন?
শো। আমার ভাবী জামাতা সত্য সত্যই বলিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র। কিন্তু বিবাহের দুই দিন পূর্বে আমার আত্মীয়গণ এখানে আসিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ধন্যবানের পত্নী। তাঁহারাই জোর করিয়া তাহদের অলঙ্কারগুলি রূপসীকে পরাইয়া দিয়াছিল। আমি এখন ধনে প্ৰাণে মারা গেলাম।
আ। এ অঞ্চলে আপনার কেহ শত্ৰু আছে কি?
শোভন সিং কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, আমারই এক আত্মীয় আমার ঘোর শত্রু ছিলেন। তাঁহারও নিবাস এই গ্রামে ছিল। কিন্তু এক বৎসর হইল, ভজন সিং কোথায় নিরুদেশ হইয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছিলাম, তিনি না কি সন্ন্যাসী হইয়া দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।।
আ। তাহা হইলে যে সন্ন্যাসী রূপসীকে খুন করিয়াছে সেই হয় তা ভজন সিং–আপনার পুর্ব শত্ৰু। এতদিন কোনরূপ সুবিধা করিতে না পারায় আপনার উপর কোনরূপ প্ৰতিহিংসা লইতে পারে নাই। আজ আপনার কন্যার গাত্রে অনেক টাকা গহনা দেখিয়া কৌশলে সেই বুড়িকে পাঠাইয়া দিয়াছিল।
শো। আপনার অনুমান সত্য হইলেও হইতে পারে।
আ। আপনার আর কোন আত্মীয় আছে?
শো। আত্মীয়ের মধ্যে ভগ্নী—গৌরি তাহারই কন্যা।
আ। গহনাগুলিও কি তাঁহারই?
শো। আজ্ঞে না—সেও আমার মত দরিদ্রা, অত টাকা গহনা সে কোথায় পাইবে?
আ। তাঁহার নিবাস কোথায়?
শো। শিয়ালদহ ষ্টেশন হইতে কিছু দূরে।
আ। সধবা না বিধবা?
শো। আজ্ঞে সধবা–এই যে আমার ভগ্নিপতি আপনার সম্মুখেই দণ্ডায়মান।
এই বলিয়া শোভন সিং একজন বলিষ্ঠ যুবককে দেখাইয়া দিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
শোভন সিংকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি গৌরীকে বলিলাম, মা, আমাকে সেই ভাঙ্গা বাড়ীতে নিয়ে যেতে পার?
কিছুক্ষণ ভাবিয়া গৌরী বলিল, না–কোন রাস্তা দিয়ে যে সেই বুড়ি আমাদের দুজনকে নিয়ে গিয়েছিল, সে কথা আমার কিছুই মনে নাই। তা ছাড়া, তখন আমরা যে যে কার্য্য করেছি, যেন অজ্ঞান হয়েই করেছি।
আ। তুমি ত বলেছিলে, গাড়ী করে গিয়েছিলে?
গৌ। আজ্ঞে হাঁ–গাড়ী ক’রেই গিয়েছিলাম।
আ। কোচমানকে চেন?
গৌ। দেখলে চিনতে পারি।
আ। গাড়ীখানা কোথাকার?
গৌরী বিরক্ত হইয়া বলিল, সে কথা আমি কি জানি?
গৌরীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, তাহার দ্বারা আমার কোন সাহায্য হইবে না। পদ্মপুকুর আমার জানা ছিল। সেখান হইতে কিছুদূরে আজ কাল যেখানে জণ্ড বাবুর বাজার সেখানে একটা ঠিকা গাড়ীর আস্তাবলও ছিল। সেই আস্তাবলে গিয়া সন্ধান লইবার ইচ্ছা হইল।
আমি তখন লাল সিংকে আশ্বাস দিয়া তাহার নিকট বিদায় লাইলাম এবং শোভন সিং এর বাটী হইতে বাহির হইবার উদযোগ করতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, আমি ধনে প্ৰাণে মারা গেলাম। এই দুঃসময়ে লাল সিং আমাকে অন্যায় করিয়া যৎপরোনাস্তি অপমান করিতেছে। কিন্তু সে যাহাই হউক, আপনি আমার একটা উপকার করুন।–মে ব্যক্তি রূপসীকে খুন করিয়াছে তাহাকে ফাঁসী দিন। এখন আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমার সেই পূৰ্ব্বশত্রুই রূপসীকে খুন করিয়া তাহার গাত্রের অলঙ্কার গুলি আত্মসাৎ করিয়াছে। কিন্তু সে আপনাদিগের হস্ত হইতে পলায়ন করিতে পরিবে না, আপনাদের চক্ষে ধূলি দিতে পরিবে না। আজই হউক বা কালই হউক, সে নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে। আপনি তাহাকে ফাঁসী দিয়া আমার অন্তরের জালা নিবারণ করুন। এই বলিয়া চিৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অনেক সান্ত্বনার পর তিনি কিছু সুস্থ হইলে আমি সেখান হইতে বাহির হইলাম।
রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন ভবানীপুর সহর হয় নাই। এখনকার মত এত লোকেরও বাস ছিল না। পথের দুই পার্থে তৈলের আলো মিটু মিটু করিয়া জ্বলিতেছিল, দুই একটা কুকুর পথের আবর্জনারাশির নিকট দাঁড়াইয়া আহারের দ্রব্য অন্বেষণ করিতেছিল; আর মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিয়া পরস্পর বিবাদ করিতেছিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমি আস্তাবলে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দুই তিন ব্যক্তি তখনই আমার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার গাড়ীর প্রয়োজন আছে বি না?–আমারও গাড়ীর আবশ্যক ছিল, সেই মত উত্তর দিয়া একজনকে বলিলাম, তোমাদের মধ্যে কেহ কি আজ প্রাতে দুইটা বালিকা ও একজন বৃদ্ধাকে এখান হইতে কোথাও লইয়া গিয়াছিলে?
আমার প্রশ্ন শুনিয়া কিছুক্ষণ কেহ কোন কথা কহিল না; পরস্পর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছু পরে একজন উত্তর করিল, কই, না মহাশয়!
তাহার কথা আমার বিশ্বাস হইল না। আমি তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। বলিলাম,–কেন বাপু মিথ্যা কথা বলিতেছ? ভাড়া পাইয়াছ, লইয়া গিয়াছ, কোন অন্যায় কাজ কর নাই, লুকাইবার প্রয়োজন কি?
আমার কথায় আশ্বস্ত হইয়া একজন বলিয়া উঠিল,–আজ্ঞে সলামত কোচমান সে সওয়ারি নিয়ে গিয়েছিল। এখনও গাড়ী ফিরে আসে নি।
এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীর শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরেই একখানা সেকেওক্লাস গাড়ী লইয়া সলামত উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, ইহারই নাম সলামত।
আমার পোষাক দেখিয়া ও তাহার নাম শুনিয়া সলামতের ভয় হইল। সে লাগামটী গাড়ীর চালে বাঁধিয়া নামিয়া পড়িল। পরে আমার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,–কেন মশায়? আমাকে কি দরকার?
আমি বলিলাম,–আজি প্ৰাতে তুমি দুইটী বালিকা ও এক বৃদ্ধাকে যেখানে লইয়া গিয়াছিলে আমাকে এখনই সেখানে লইয়া চল।
সলামত প্রথমে কোন উত্তর করিল না। সে একমনে কি ভাবিতে লাগিল। আমি বললাম,–তোমার ঘোড়া যদি ক্লান্ত হইয়া থাকে আর দুইটী ঘোড়া ভাড়া কর। আমি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া দিব।
তবুও সলামত উত্তর করিল না। সে কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কথার উত্তর–দিতেছি না কেন? সহজে না রাজী হও অন্য উপায় দেখিব।
অনেক কষ্টে সলামত উত্তর করল,–সে জায়গাটা আমার ঠিক মনে নাই।
আমার রাগ হইল। আমি কর্কশ স্বরে বললাম,–দেখ সলামত! এই কাজ অনেকদিন থেকে করছি। তোমার মত অনেক লোক দেখেছি। তুমি একজন প্ৰবীণ লোক হ’য়ে মিথ্যা ক’রে বল, যে জায়গাটা মনে নাই? বিশেষ তুমি একজন পাকা কোচমান। একবার যে স্থান দেখবে সে আর জন্মে ভুলবে না।
আমার তোষামোদপূর্ণ কথায় সলামত ভুলিয়া গেল। বলিল, হুজুর, আমি মিছা বলি নি। যে পথ দিয়ে বুড়ী আমাকে নিয়ে গেল, সে পথ আমি আগে দেখি নি। এখনও যে আপনাকে সহজে নিয়ে যেতে পারবো এমন বোধ হয় না। চলুন, আমার ঘোড়া আজি বড় বেশী খাটে নাই, পাঁচটার সময় ঘোড়া বদল করেছি।
আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া সলামতের গাড়ীতে উঠিলাম। বাসায় যাইবার জন্য যে গাড়ী ঠিক করিতেছিলাম, তাহার কোচমান ভাড়া না পাওয়ায় অতিরিক্ত বিরক্ত হইল, গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া সলামত অশ্বে কশাঘাত করিল। সেই রাত্রে বাসা ছাড়িয়া অন্যত্র যাইতে পক্ষীরাজদ্বয়ের ইচ্ছা ছিল না; তাহারা দু-একবার অনিচ্ছা প্ৰকাশ করিল। কিন্তু উপযুপরি কশাঘাতে অগত্যা দৌড়িতে বাধ্য হইল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
নকুলেশ্বর-তলা পার হইয়া গাড়ী ক্ৰমাগত দক্ষিণমুখেই যাইতে লাগিল। পূৰ্ব্বে দুই একটা আলোক দেখিতে পাইতেছিলাম, কিন্তু ক্ৰমে আর তাহাও দেখা গেল না। পথটা অতি সঙ্কীর্ণ, দুইপাৰ্থে বাগান বা বন। বড় বড় বৃক্ষ গুলিতে খদ্যোতকুল আশ্ৰয় লইয়াছিল। দূর হইতে সেগুলিকে অতি মনোরম দেখাইতেছিল।
একে রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল, তাহার উপর আকাশে চন্দ্র নাই। চারদিক ভয়ানক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। পথে জনপ্রাণীর সাড়া-শব্দ নাই, কোথাও একটীও আলোক নাই। কোচমান অতি কষ্টে গাড়ীর আলোকে শকট-চালনা করিতেছিল।
কিছুদূর এইরূপে গমন করিয়া কোচমান সহসা গাড়ী থামাইল। আমি ভাবিলাম, বুঝি সে যথাস্থানে আসিয়া পড়িয়াছে এবং সেই মনে করিয়া গাড়ী হইতে অবতরণ করিতে উদ্যত হইয়াছি, এমন সময় কোচমান বলিল, বাবু! পথ ভুলে অন্যদিকে এসে পড়েছি। সে বাগান খানি এদিকে নয়। আমরা পূৰ্ব্বদিকে যে গলিটা ছেড়ে এসেছি, বোধ হয়। সেই পথেই আমাদিগকে যেতে হবে।
একে রাত্রি অধিক, তাহার উপর সেই ঘোর অন্ধকার, তাহতে আবার আমি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, কোচমানের কথায় আমার সৰ্ব্বাঙ্গ জলিয়া উঠিল। ক্ৰোধে কাঁপিতে কাঁপিতে আমি কর্কশাস্বরে বলিলাম, তুমি কি মনে করিয়াছ যে, আমার চক্ষে ধূলি দিয়া পলায়ন করিবে? আমি বহুদিন হইতে এই কাৰ্য্য করিতেছি। চোর, ডাকাত, দসু্যাদিগের সহিত আমার চির বিবাদ, বদ–মায়েসগণ আমার নাম শুনিলে থর থর বিকম্পিত হয়! আর তুমি একজন সামান্য কোচমান হষ্টয়া আমার সহিত চাতুরী করিতেছ? ধন্য তোমার সাহস! কিন্তু তুমি মনে করিও না যে, আমি তোমার কথায় ভুলিব না। যদি ভালো চাও, এখনই সেইস্থানে লইয়া চল।
আমাকে অত্যন্ত রাগান্বিত দেখিয়া কোচমান গাড়ি হইতে অবতরণ করিল এবং আমার পদতলে বসিয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, হুজুর! আমার এমন সাহস নাই যে, আমি পুলিসের বাবুকে প্ৰবঞ্চনা করবো। আল্লার দোহাই, আমি সত্য সত্যই পথ ভুলে গিয়েছি। একে____ তে এই ঘোর অন্ধকার, আমি রাস্তা চিনতে পাচ্চি না। আপনি একটু এই গাড়ীতে বসুন, আমি একবার দেখে আসি।
এই বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই সে সেখান হইতে চলিয়া গেল। আমি সেই ভয়ানক তমসাচ্ছন্ন নিশীথে একাকী সেই অপরিচিত স্থানে বসিয়া রহিলাম। একবার মনে হইল, লোকটা যদি দলবল লইয়া হঠাৎ আমায় আক্ৰমণ করে, তাহা হইলেই আমার সর্বনাশ! এক দুই জনের বিরুদ্ধেও আত্মরক্ষা করিতে পারা যায়, কিন্তু যদি তিন চারিজন বা ততোধিক লোকে একেবারে চারিদিক হইতে আক্রমণ করে, তাহা হুইলে কি করিব? লোকটাকে ছাড়িয়া দিয়া ভাল করি নাই। সে ত স্বচ্ছন্দে গাড়ী লইয়া পথ অন্বেষণ করিতে পারিত! গাড়ীর সহিত আমাকে এখানে রাখিয়া গেল কেন? নিশ্চয়ই তাহার মনে কোন দুরক্তিসন্ধি আছে।
এই প্ৰকার চিন্তা করিয়া আমি পকেট হইতে ক্ষুদ্র পিস্তলটি বাহির করিলাম এবং গাড়ী হইতে নামিয়া নিকটস্থ একটা প্ৰকাণ্ড বৃক্ষের তলে গিয়া প্রচ্ছন্নভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। ভাবিলাম, যদি কোচমান এক আইসে, তাহা হইলে কোন কথাই নাই। কিন্তু যদি লোক জন লইয়া আইসে, তাহা হইলে তাহার অভিপ্ৰায় নিশ্চয়ই মন্দ।
কিছুক্ষণ পরে অদূরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। আমি পিস্তলটী ঠিক করিয়া ধরিলাম। কিন্তু আমার অনুমান মিথ্যা হইল। কোচমান একাই ফিরিয়া আসিয়া একেবারে গাড়ীর নিকটে গেল এবং দরজার নিকট দাঁড়াইয়া বলিল, হুজুর! পথ ঠিক করিয়াছি। আর কোন ভয় নাই।
কোচমানের কথায় আন্তরিক প্রীত হইলাম এবং ধীরে ধীরে আসিয়া পুনরায় গাড়ীতে উঠিয়া বসিলাম। কোচমান ভাবিল, আমি বুঝি প্রস্রাব করিতে গিয়াছিলাম। সেই ভাবিয়া সে বলিল, বাবু, প্রস্রাব করতে কতদূরে গিয়েছিলেন, এই অন্ধকারে কে আপনাকে দেখতে পেত, পেলেই বা আপনার কি করতো?
আমি সে কথার কোন উত্তর করিলাম না, বলিলাম, যদি ঠিক সন্ধান পাইয়া থাক, তবে একটু শীঘ্ৰ লইয়া চল। রাত্ৰি অনেক হইয়া গিয়াছে। এমন সময় সেখানে গিয়া যে আজ কাৰ্য্য সিদ্ধ করিতে পারি, এমন ত বোধ হয় না।
কোচমান কোন উত্তর না দিয়া অশ্বে কশাঘাত করিল। অশ্বদ্বয় উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িল। প্ৰায় আধঘণ্টা পরে একটি প্ৰকাণ্ড বাগানের ভাঙ্গা ফটকের নিকট গাড়ী থামাইয়া কোচমান বলিল, হুজুর, এই সেই বাগান। এই বাগানের ভিতর একখানা ভাঙ্গা বাড়ী আছে। বুড়ী মেয়ে দুটিকে নিয়ে সেই বাড়ীতে গিয়েছিল। তার পর কি হ’ল আমি জানি না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, বাগানখানি কার? কো।
কো। আজ্ঞে সে কথা বলতে পারলাম না। এদিকে আমি কখনও আসি নাই।
আ। নিকটে কোন বাড়ী আছে?
কো। আজ্ঞে না। চারদিকেই বাগান।
আ। বাগান থাকিলে নিশ্চয়ই মালি আছে, তাহাঁদের বাস করিবার ঘরও আছে। সকালে কোন মালীর সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল?
কো। অজ্ঞে না–জন প্ৰাণী না।
আ। এইখান হইতে ফাঁড়ী করদূর?
কো। প্ৰায় এক ক্ৰোশ।
আ। তোমাকে বলিষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে, চল দেখি, উভয়ে বাগানের ভিতর যাই। প্রয়োজন হইলে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। পরিবে?
কো। হুজুর–খুব পারিব। আমি একাই তিনজনকে রাখবো।
ঈষৎ হাসিয়া কোচমানকে সঙ্গে লইলাম এবং অতি সন্তর্পণে সেই অন্ধকারের ভিতর দিয়া বাগানে প্ৰবেশ করিলাম। আমার পকেটে চোরা লণ্ঠন ছিল, বাহির করিয়া জ্বলিয়া ফেলিলাম এবং সেই আলোকের সাহায্যে অতি ধীরে ধীরে একটা ভগ্ন অট্টালিকার দ্বারে উপনীত হইলাম। দেখিলাম, দরজা খোলা। কোচমানকে সঙ্গে লইয়া আনি সেই দ্বার অতিক্ৰম করিলাম এবং অতি সন্তৰ্পণে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
বাহিরেও যেমন অন্ধকার, ভিতরেও ততোধিক, যতক্ষণ বাহিরে ছিলাম, চোরা লণ্ঠনটি হাতে ছিল, তাহারই মৃদু আলোকে কিছু? কিছু দেখিতে পাইতেছিলাম না। কিন্তু ভিতরে যাইয়া লণ্ঠনটীপকেটে রাখিলাম। ভাবিলাম, যদি কেহ দেখিতে পায়, এখনই পলায়ন করিবে, তাহা হইলে সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কাহকেও খুঁজিয়া বাহির করা বড় সহজ হইবে না।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের দরজার সম্মুখে আসিলাম। বাহির হইতে দেখিলাম, ভিতরে তিনজন প্ৰশান্তমূৰ্ত্তি সন্ন্যাসী একমনে ধ্যানে নিমগ্ন। সকলেরই চক্ষু মুদিত; সকলেই নাভীর নিম্নে করন্থয় মিলিত করিয়া একাগ্ৰচিত্তে ঈশ্বরোপাসনায় নিযুক্ত। সম্মুখে প্ৰজ্বলিত অগ্নি ধুধু শব্দে জ্বলিতেছিল।
তাহাদের গভীর ও প্ৰশান্ত মূৰ্ত্তি দেখিয়া আমার ভক্তির উদ্রেক হইল। যে কাৰ্য্যে গিয়াছিলাম, সহসা তাহা করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, এমন শান্তমূৰ্ত্তি যাহাঁদের, তাহারা নারীহত্যা করিবে কেন? কিন্তু পরিক্ষণেই দেখিলাম, তিনজনের ললাটদেশে সিন্দুরের দীর্ঘফোটা, গলে রুদ্রাক্ষ মালা, হস্তেও অনেকগুলি রুদ্রাক্ষ, পরিধানে রক্তবর্ণ পট্টবাস, গলে যজ্ঞোপবীত। বেশ দেখিয়াই বোধ হইল, তাহারা কাপালিক। শক্তি–উপাসক। শুনিয়াছি, কাপালিকগণ সিদ্ধ হইবার জন্য নরহত্যা করিতেও পশ্চাৎপদ হয় না। এরূপ ঘটনা অনেক শোনা গিয়াছিল। কিন্তু তাহদের দ্বারা নারীহত্য এক প্রকার অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল। যে শক্তির উপাসনার জন্য তাহারা সেই কঠোর নিয়ম প্ৰতিপালন করিতেছে, ইচ্ছা! করিয়া কেন তাহারা সেই শক্তিকে খুন করিবে, বুঝলাম না।
যাহাই হউক, দ্বার সমীপে গিয়া যখন দেখিলাম, তিনজন মাত্র সন্ন্যাসী—আর কোন লোক নাই, তখন আমার সাহস হইল। আমি বাহির হইতে জুতার শব্দ করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সে শব্দে তাহাদের ধ্যান ভঙ্গ হইবে। কিন্তু আমার অনুমান মিথ্যা হইল। তাহাদের কেহই চক্ষু উল্মীলন করিল না, সকলেই পূর্বের মত ধ্যানে নিমগ্ন রহিল।
আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না। কোচমানকে ৰাহিরে রাখিয়া আনি একাই ভিতরে যাইলাম এবং চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। অনেক ডাকাডাকির পর সর্বাপেক্ষা কনিষ্ঠ চক্ষু চাহিল, কিন্তু সম্মুখে আমাকে দেখিয়া পুনরায় চক্ষু মুদিত করিল। আমি বিষম ফাপরে পড়িলাম। কাহারও নাম জানি না. সুতরাং কি বলিয়া ডাকিব স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় চিৎকার করিতে লাগিলাম। প্ৰায় আধা ঘণ্টা পরে বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী চক্ষু উন্মীলন করিল, আমাকে পরিষ্কার বাঙ্গালা ভাষায় জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাপু! এখানে এত গোলযোগ করিতেছি? গোলমালের ভয়ে আমরা লোকালয় ছাড়িয়া এই নির্জন বনের মধ্যে আশ্ৰয় লইয়াছি। আর তুমি কি না। স্বচ্ছন্দে এখানে আসিয়া আমাদের ধ্যান ভঙ্গ করিতেছ। আকৃতি দেখিয়া তোমায় জ্ঞানবান বলিয়া বোধ হইতেছে, কিন্তু এ কি কাজ তোমার!
গৌরীর মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাতে তাহদের উপর কিছুমাত্র ভক্তির উদ্রেক হয় নাই। বরং তাহার মুখে ঐ কথা শুনিয়া আমার ক্ৰোধ হইল। রাগ সম্বরণ করিয়া ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলিলাম, আর তোমার সাধুগিরিতে কাজ নাই। এখন ওঠ, আমার সঙ্গে থানায় চল।
থানার নাম শুনিয়া সন্ন্যাসীর কিছুমাত্র ভয় হইল না। সে হাসিয়া উঠিল, পরে বলিল, চল, আমাদিগকে যেখানে লইয়া যাইবে সেইখানেই যাইব। কিন্তু সেখানে যেন একটু নির্জন স্থান পাই, আমরা যেন নির্বিবাদে ধ্যান করিতে পারি।
আমি হাসিয়া উঠিলাম। হাসিতে হাসিতে বলিলাম, এখন বুজরুকি রাখ ঠাকুর! সকালে যে কাণ্ড করেছ, তাহাতে শীঘ্রই চিরধ্যানে নিমগ্ন হতে হবে। আগে উঠ, পরে এই দুই জনকে নিয়ে শীঘ্র আমার সঙ্গে এস।
সন্ন্যাসী গম্ভীরভাবে বলিল, সত্যই কি আমাদিগকে তোমার সহিত যাইতে হইবে? সকালে কি কাণ্ড করেছি বাবা?
আ। এখনও বলিতেছি, বুজরুকি রাখ, সকালে কি করেছ জান না কি?
স। ধৰ্ম্মই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। আমি সেই ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বলিতেছি যে, সত্যই আমি তোমার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
আমি বিস্মত হইলাম। বলিলাম, সে কি! শোভন সিংহের কন্যাকে খুন করিয়া আবার মিথ্যা কথা বলিতেছ? তুমি কেমন সন্ন্যাসী? শক্তির উপাসক হইয়া শক্তিকে খুন?
আমার কথা শুনিয়া সন্ন্যাসী হাসিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, বাবা! তোমার ভুল হইয়াছে। কোথায় আসিতে কোথায় আসিয়াছ, আমরা শোভন সিংএর কন্যাকে আজ দেখিও নাই।
আ। আজ দেখ নাই, তবে কি আর কখনও দেখিয়াছিলে?
স। সে অনেক দিনের কথা।
আ। তবে তুমি শোভন সিংকে চেন?
স। বেশ চিনি, আমারই এক আত্মীয়ের নাম শোভন সিং। রূপসী নামে তার এক কন্যা ছিল। কিন্তু জানি না, সে এখন ও জীবিত কাছে কি না?
আ। তোমার আত্মীয়ের নিবাস কোথায়?
স। নিকটেই–এই ভবানীপুরেই তাহার বাড়ী।
আ। আর তোমার?
স। তাহারই বাড়ীর নিকটে ছিল; কিন্তু এখন আর নাই। এখন _____ সেই আমার বাড়ী।
আ। কত দিন হইল তুমি এই বেশ ধরিয়াছ?
স। প্ৰায় দুই বৎসর হইল।
আ। সংসার ত্যাগ করিলে কেন?
স। সে অনেক কথা।
আ। শোভন সিং কি তোমার শত্রু।
স। না–এ জগতে আমার শত্রু ও কেহ নাই, মিত্ৰও কেহ নাই।
সন্ন্যাসীর কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলিতেছে। পাছে শোভন সিংকে শক্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিলে আমার মনে সন্দেহ হয়, এই মনে করিয়া সে বোধ হয় কথাটা লুকাইল। এইরূপ চিন্তা করিয়া বলিলাম, আজি প্ৰাতে কি কোন বৃদ্ধা তোমার নিকট দুইজন বালিকা আনিয়া ছিল?
স। কেমন করিয়া জানিব? সমস্ত দিনের পর এই আমি চক্ষু চাহিতেছি।
দআ। বৃদ্ধ যে দুইটী বালিকাকে এখানে আনিয়াছিল তাহার সাক্ষী আছে। যে গাড়ীতে করিয়া তাহারা তোমার নিকট আসিয়া ছিল, সেই গাড়ীর কোচমান আমার সঙ্গেই আছে।
স। হইতে পারে—আপনার কথা যথার্থ হইতে পারে। কিন্তু আমি আজ সমস্ত দিনই ধ্যানে নিমগ্ন।
কথায় কথায় রাত্রি অনেক হইয়া গেল দেখিয়া, আমি তাহাকে বলিলাম, বিচার পরে হইলে, এখন তোমরা তিনজন আমাদের সঙ্গে আইস।
দ্বিরুক্তি না করিয়া সেই সন্ন্যাসী অপর দুইজনের ধ্যান ভঙ্গ করিল। তখন তিনজনে মিলিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইল এবং বাগান পার হইয়া সেই ভাঙ্গা ফটকের নিকট উপস্থিত হইল। ফটকের সম্মুখেই গাড়ী ছিল। আমি সন্ন্যাসী তিনজনকে তাহাতে উঠিতে বলিলাম। সকলে গাড়ীতে উঠিলে, কোচমান শকট চালনা করিল।
বাসায় ফিরিতে রাত্রি একটা বাজিয়া গেল। তখন সন্ন্যাসী তিনজনকে আটক করিতে বলিয়া আমি বিশ্ৰাম লাভ করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
পরদিন প্ৰাতঃকালে সমস্ত কাৰ্য্য ত্যাগ করিয়া অগ্ৰে সেই সন্ন্যাসীত্রিয়কে দেখিতে গেলাম। যে ঘরে তাহাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে বলিয়ছিলাম, তাহার দ্বারে দুইজন প্রহরী ছিল। সন্ন্যাসীদিগের কাৰ্য্য লক্ষ্য করিতে এবং তাহদের কথোপকথন শুনিবার জন্য আমি তাহাদিগকে পূর্ব রাত্রে নিযুক্ত করিয়াছিলাম। প্রহরীদ্বয়ের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে তাহাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করা যায় না। তাহারা বলিল, সন্ন্যাসীগণ কোন কথা কহে নাই, যেখানে বসিতে বলা হইয়াছিল সমস্ত রাত্রি সেই–স্থানে চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিল। ঘরে এক সামান্য আলোক দেয়া হইয়াছিল কিন্তু একমুহূর্ত্তের জন্যেও চক্ষু উন্মীলন করে নাই, কথা কহা দূরে থাক, কেহ একটী শব্দও করে নাই। অথচ গৌরীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে ত তাহাদিগের উপরই ভয়ানক সন্দেহ হয়। এ কি রহস্য!
একজন সন্ন্যাসীর মুখে শুনিলাম, শোভন সিং তাহার পরিচিত। শোভন সিং বলিয়াছিলেন, ঐ সন্ন্যাসী তাহার পরম শক্রি। এত দিন সুবিধা পায় নাই বলিয়া কোন অপকার করিতে পারে নাই। সন্ন্যাসী। কিন্তু সে কথা স্বীকার করিল না। তবে কি সন্ন্যাসীত্রয় নির্দোষী? আমি কি অন্যায় সন্দেহ করিয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ করিয়াছি। যদি তাঁহাই হয়, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট পাপ সঞ্চয় হইল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু গৌরীর কথাই বা কেমন করিয়া মিথ্যা বলি। গৌরীর বয়স চৌদ্দ–পনের বৎসরের অধিক হইবে না। এ বয়সে সে যদি এত মিথ্যা কথা সাজাইয়া বলিতে পারে, তাহা হইলে বড় হইলে সে কি করিবে বলা যায় না। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি সন্ন্যাসীদিগের নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তখনও তাঁহাদের চক্ষু মুদিত। একবার তাহাদের জিনিষপত্রগুলি দেখিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু সন্ন্যাসীদিগের আবার কি জিনিষ থাকিবে? যাহারা সংসার ত্যাগ করিয়াছে, যাহারা মন হইতে বাসনা দূর করিয়াছে, তাহারা আবার সঞ্চয় করিবে কি? তবে যদি ভণ্ড হয়, তাহা হইলে কিছু পাইলেও পাইতে পারি। এই ভাবিয়া আমি তাহদের পরিচ্ছদ, কমণ্ডলু প্রভৃতি দ্রব্য গুলি অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম।
যে দুইজন কনষ্টেবল প্রহরী ছিল, তাহারা তখনই আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হইল না। ভাবিয়াছিলাম, যদি দুই একখানা গহনা বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই রূপসীকে খুন করিয়াছে। কিন্তু সেরূপ কোন? নিদর্শন পাওয়া গেল না।
এইরূপ গোলযোগে সন্ন্যাসীগণের ধ্যান ভঙ্গ হইল। আমি তখন অপর সকলকে সেখান হইতে দূর করিয়া। গত রাত্রে যাহার সাহিত কথা কহিয়াছিলাম, তাহাকে বললাম, শোভন সিং তোমার নামে যে দোষারোপ করিয়াছেন, তাহাতে তোমাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। যদি নিজের মঙ্গল চাও, তাহা হইলে যাহা জানি সত্য করিয়া প্ৰকাশ কর। শোভন সিং বলেন যে, তুমি তাহার পরম শত্রু এবং আর কোন উপায়ে প্ৰতিশোধ লইতে না পারিয়া অবশেষে তাহার এক কাত্ৰ কন্যাকে হত্যা করতঃ তাহার গাত্রের প্ৰায় দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছ। শোভন সিংএর মুখে শুনিয়াছিলাম, সেই সন্ন্যাসীর নাম ভজন সিং। সত্য মিথ্যা জানিবার জন্য আমি সন্ন্যাসীকে নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। সন্ন্যাসী উত্তর করিল, সত্যই তার নার নাম ভজন সিং।
আমার কথা শুনিয়া ভজন সিং হাসিয়া উঠিল। বলিল, আমি তাহার শত্রু? না মহাশয়, সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী কাহারও শত্রুতাচরণ করে না। এ জগতে আমারও শত্রু কেহ নাই, আমিও কাহার শত্রু নয়। যেরূপ করিলে আপনার বিশ্বাস হয়, আপনি স্বচ্ছন্দে তাঁহাই করুন, আমার তাহাতে কোন প্ৰকার ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না। জীবন ক্ষণস্থায়ী, আজ হউক বা দুদিন পরেই হউক, কোন না কোন দিন আমাকে মরিতেই হইবে।
আ। আমি শুনিয়াছি, তুমি অতি অল্পদিনেই বিবাগী হইয়াছ, এখনকার কথা বলিতেছি না, পূর্বে যখন তুমি সংসারাশ্রমে ছিলে, তখনকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। শোভন সিংএর সহিত তোমার কিরূপ সম্পর্ক আছে? কেনই বা তুমি সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইলে?
স। সমস্তই বলিতেছি—যদি একান্তই শুনিতে চান, শুনুন। পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমার নাম ভজন সিং, আমি পিতার একমাত্র পুত্র। অল্প বয়সেই মাতৃহীন হওয়ায় আমি পিতার বড় আদরের সামগ্ৰী ছিলাম। আমার এক জ্ঞাতি ভগ্নী ছিল, পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় সে আমাদের বাড়ীতেই প্ৰতিপালিতা। তাহার সহিত শোভন সিংহের বিবাহ হয়। শোভন সিং সম্পর্কে ভগ্নীপতি। ভগ্নীপতি হইলেও শোভন সিং আমাকে দেখিতে পারিত না। আমিও তাতার সহিত মিশিতাম না। ক্ৰমে এই মনোবিধাদের বুদ্ধি হইতে লাগিল, আমি তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতাম না। শোভন সিং কিন্তু আমার অপকারের চেষ্টা করিতে লাগিল। সুবিধা পাইলেই আমার অনিষ্ট করিতে লাগিল। এই সময়ে হঠাৎ হৃদরোগে আমার পিতার মৃত্যু হয়। যখন আমি তাহার সমম্ভ সম্পত্তির অধিকারী হইলাম, তখন হইতে শোভন সিংহের মতিগতি ফিরিতে লাগিল। উপযাচক হইয়া আমার সহিত দেখা করিল, কত মিষ্ট কথায় আমাকে সান্ত্বনা করিল, আপনার অসদাচরণের জন্যবারম্বার ক্ষমা প্রার্থনা করিল। শোভন সিংহের তৎকালীন অবস্থা ও কথাবাৰ্ত্তা শুনিয়া আমার মনে কেমন বিশ্বাস হইল। আমি তাহার বশীভূত হইলাম। ক্রমে ঘনিষ্টতা হইল। উভয়ে মিলিয়া জুয়ার দলে মিশিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিল তাহা আর বলিবার নয়। অল্প দিনের মধ্যে আমি নিঃসম্বল হইয়া পড়িলাম। পিতার বহু কষ্টে সঞ্চিত প্ৰায় লক্ষাধিক টাকা জুয়া খেলিয়া জলে ফেলিয়া দিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার অধিকাংশই শোভন সিংএর উদর পূর্ণ করিয়াছিল। আমাকে নিঃস্ব করিয়াও শোভন সিংএর তৃপ্তি হইল না, সে আমাকে চোর বলিয়া ধরাইয়া দিল। সৌভাগ্যক্রমে দুইজন, ভদ্রলোক সাক্ষী ছিলেন বলিয়াই সে যাত্ৰা অব্যাহিত পাই। এইরূপে নানা কারণে মনে কেমন বৈরাগ্য উপস্থিত হইল, আমি সংসার ছাড়িয়া গুরুর নিকট যাইলাম। সেখানে দীক্ষা লইয়া সেই নির্জন বনে সাধনা করিতে থাকি। কিছুদিন হইল, এই দুইজনের ইচ্ছায় আমাকে এখানে আসিতে হইয়াছে। কিন্তু এখানেও নিস্তার নাই—শোভন সিং আমাকে প্ৰাণে মারিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু তাহাতে সন্ন্যাসীর কি করিবে?
এই বলিয়া সন্ন্যাসী স্থির হইল। সে যে ভাবে কথা গুলি বলিল, তাহাতে তাহার কথা অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তাহার কথাবার্ত্তায় তাহাকে বিদ্বান ও মহাশয় ব্যক্তি বলিয়া বোধ হইল এবং এতক্ষণ যে তাহার প্রতি উপযুক্ত সন্মান প্ৰদৰ্শন করা হয় নাই, তজ্জন্য অনুতপ্ত হইলাম। আমি তখন অতি বিনীতভাবে বলিলাম—শোভন সিং আপনাকেই তাঁহার কন্যার হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছে এবং তাঁহারই কথামত আমি আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছি। এখন আপনার মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে আমার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু তাহা হইলেও আমি এখন আপনাকে মুক্তি দিতে পারিব না। যতদিন না। আপনার বিচার হয়, ততদিন এরূপে থাকিতে হইবে। শোভন সিংয়ের ভাগীনেয়ী আপনাকে দেখিয়াছিল। আমি এখনই তাহাকে এখানে ডাকিয়া আনাইতেছি। যদি সে সনাক্ত করে, তাহা হইলে বিচারে কি হয় বলা যায় না।
সন্যাসী ভজন সিং ঈষৎ হাসিয়া বলিল—মৃত্যুর জন্য ভয় করি না–যদি অদৃষ্ট থাকে তবে আমার এই অপঘাত মৃত্যুও কেহ রোধ করিতে পরিবে না। কিন্তু দেখিতেছি, আপনি ব্ৰাহ্মণ সন্তান। দেখিবেন, যেন ভ্ৰমক্রমে একজন নিরীহ ব্ৰাহ্মণের মৃত্যুর উপলক্ষ না হন।
আমি সাগ্রহে উত্তর করিলাম,–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। যাহাতে প্ৰকৃত দোষীকে গ্রেপ্তার করিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে পারি, তজ্জন্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করিব। তবে ভবিতব্যের কথা বলিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমার নাই।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
সন্ন্যাসী ভজন সিংএর নিকট বিদায় লইয়া আমি তখনই একজন লোককে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম, দুইজন উপযুক্ত লোককে সন্ন্যাসীদিগের আড্ডায় গিয়া সেই ঘরটি বিশেষ করিয়া অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম এবং অপর একজনকে লাল সিংএর নিকট প্রেরণ করিলাম।
সন্ন্যাসী গ্ৰেপ্তার হইয়াছে শুনিয়া, শোভন সিং ভাগিনেয়ীকে লইয়া কিছুক্ষণ পরেই আমার নিকটে আসিলেন। আমি গৌরীকে সেই সন্ন্যাসিদিগের নিকট লইয়া গেলাম। গৌরী তাহাদিগকে দেখিয়াই চীৎকার করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করতঃ শোভন সিংএর পশ্চাতে গমন করিল। তাঁহার ভাব-গতিক দেখিয়া অমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে ঐ সন্ন্যাসী তিনজনকেই দেখিয়াছিল।
শোভন সিং আমার নিকট যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন। এক রাত্রের মধ্যে হত্যাকারীকে গ্ৰেপ্তার করিয়াছি বলিয়া আমার যথেষ্ট সুখ্যাতি করিলেন। কিন্তু আমার সে সকল বড় ভাল বোধ হইল না। আমিও মিষ্ট কথায় তাহাকে বিদায় দিয়া বলিলাম, প্ৰয়োজন হইলে সংবাদ দিব।
শোভন সিং চলিয়া গেলেন। প্ৰায় একঘণ্টা পরে যে দুইজন লোককে সন্ন্যাসীর সেই বাসস্থানে অন্বেষণ করিতে পাঠাইয়াছিলাম, তাহারাও ফিরিয়া আসিল এবং একছড়া স্বৰ্ণ-হার আমার হস্তে দিয়া বলিল যে, তাহারা সেই ঘরাটী তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছে কিন্তু ঐ একছড়া হার ভিন্ন আর কোন গহনা দেখিতে পায় নাই।
হারছড়া পরে একমনে ঐ সকল বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সন্ন্যাসীর কথা কোনরূপেই অবিশ্বাস করা যায় না। তিনি শোভন সিং সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহাও সত্য বলিয়া বোধ হইল। লোকটা তাহাকে উৎপীড়ন করিতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়াছে এবং এখনও যে করিবে, তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি? কিন্তু এই হারছড়া কোথা হইতে আসিল? গত রাত্রে আমি স্বয়ং অন্বেষণ করিয়াছিলাম। কিন্তু কই, তখন ত কিছুই দেখিতে পাই নাই। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই যখন হারছড়া খুঁজিয়া পাইয়াছে, তখন ইহা বিশেষ লুকান ছিল এমন বোধ হয় না। একি রহস্য? তবে কি সত্যসত্যই সন্ন্যাসী হইয়া বালিকা হত্যা করিল?
কিছুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই সত্য বলিয়াছেন। শোভন সিং লাল সিংএর সহিত যেমন ব্যবহার করিয়াছে, তাহাতে তাহাকেই শঠ ও প্রতারক বলিয়া বোধ হইতেছে। এরূপ অনেক দেখা গিয়াছে যে, প্ৰকৃত দোষী অপরের স্কন্ধে দোষারোপ করিবার জন্য অনেক প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়াছে। শোভন সিং যেরূপ প্রকৃতির লোক, তাহাতে তাহার পক্ষে উহা নিতান্ত অসম্ভব নহে।
এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে লাল সিং সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তাহাকে সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন,–আপনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহাই সম্পূর্ণ সত্য। শোভন সিং অত্যন্ত চতুর—তিনি না পারেন এমন কাজ অতি অল্প। সেই গত রাত্রে আপনার ফিরিয়া আসিবার পর কোনরূপে ঐ হারছাড়াটী সেখানে রাখিয়া আসিয়াছে। যদি তাহা না হইবে, তাহা হইলে আপনি কালই রাত্রে ঐ হার পাইতেন।
আ। যদিও আমি ভালরূপ অন্বেষণ করিবার অবকাশ পাই নাই, তত্রাপি যখন দুই ব্যক্তি এত অল্প সময়ের মধ্যে এই হার বাহির করিতে পারিল, তখন আমি যে একেবারেই উহা দেখিতে পাইলাম না, ইহাও বিশ্বাসযোগ্য নহে। হারছড়া নিশ্চয়ই তখন সেখানে ছিল না, পরে রক্ষিত হইয়াছিল।
লা। ঠিক বলিয়াছেন–আমার বিশ্বাস রূপসী এখনও জীবিত আছে। কেবল আমাকে ফাঁকি দিবার জন্যই ঐ মিথ্যা কথা রাষ্ট্র করিয়াছে। বিবাহ না দিলে পাছে আমার টাকা ফেরৎ দিতে হয়, এই ভয়ে আপনার কন্যার মৃত্যু সংবাদ রাষ্ট্র করিয়াছে।
আ। আমারও সেইরূপ মনে হয়। কিন্তু যে বৃদ্ধ গৌরী ও রূপসীকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সে কে? তাহাকে ধরিতে না পারিলে এ রহস্য ভেদ করা অতীব দুরূহ হইবে। আপনি সে বুড়ীকে চেনেন? কোন প্রকার অনুমান করিতে পারেন?
লাল সিং কিছুকাল কোন উত্তর করিলেন না; একমনে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,–রূপবতী পত্নী সত্ত্বেও, শুনিয়াছি, শোভন সিং অপর এক বেশ্যার প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছিল। সে তাহারই সমবয়স্ক, দেখিতে নিতান্ত মন্দ নহে, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীর সহিত কোন বিষয়েই তাহার তুলনা হয় না। এ ছাড়া, আমি আর কোন রমণীর সহিত শোভন সিংএর ঘনিষ্টতা আছে কি না জানি না। একে বেশ্য, তাহাতে বয়স হইয়াছে, তাহার উপর তাহার অবস্থাও এখন হীন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তাহাকে যে বুড়ীর মত দেখাইবে, আশ্চর্য্য কি? কিম্বা সে হয় ত বৃদ্ধার ছদ্মবেশ করিয়া থাকিবে। কেন না, গোপনে বালিকা ভুলাইয়া লইয়া যাওয়া বড় সহজ ব্যাপার নহে। যে সে লোকের উপর এমন কাজের ভার দেওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, সেই মাগীরই এই কাজ।
অ্যা। আপনি তাহার বাড়ী জানেন?
লা। চেষ্টা করিয়া বাহির করিব। শুনিয়াছিলাম, মেছুয়া বাজারে তাহার বাসা। তাহার নাম কামিনী।
আমি সন্তুষ্ট হইলাম। তাঁহাকে কামিনীর সন্ধান করিতে বলিলাম। লাল সিং তখনই বিদায় লইলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বেলা প্ৰায় চারিটার সময় লাল সিং পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়াই আমি বুঝতে পারিলাম যে, তিনি কাৰ্য্যে সফল হইয়াছেন।
লাল সিং আমার নিকটে বসিয়া বলিলেন, তিনি কামিনীর সন্ধান পাইয়াছেন। বয়স অধিক না হইলেও বাতে তাহাকে বৃদ্ধা করিয়াছে। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কামিনীর পরিচিত কি না? লাল সিং বলিলেন, বহুদিন পূর্বে একবার মাত্র তিনি কামিনীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেই অবধি আর তাহাদের সাক্ষাৎ হয় নাই।
লাল সিংএর কথা শুনিয়া আমি তখনই ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং তাঁহাকে লইয়া একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আহোরণ করিয়া, কামিনীর বাসা হইতে কিছুদূরে আমরা গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম এবং ধীরে ধীরে সেইদিকে যাইতে লাগিলাম।
যখন বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সেদিন শনিবার। আমি বেশ বাবু সাজিয়া গিয়াছিলাম। একে শনিবার সন্ধ্যাকাল, তাহার উপর আমি একজন নব্য বাবু, তাহাতে আবার আমি অতি ধীরে ধীরে একটী বাড়ীর বারান্দার দিকে দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। এতগুলি কারণ যখন একত্রিত হইল, তখন কাৰ্য্য না হইয়া আর যায় কোথায়? একজন আধা বাবুগোচ লোক তখনই আমাদের নিকট আগমন করিয়া বলিল,–বাবু! ঐ বাড়ীতে যাবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।
আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি হাসিয়া বলিলাম,–ও বাড়ীতে মানুষের মত কে আছে? ঐ ত সব বসে আছে?
আগন্তক ঠকিবার পাত্র নয়। সেও হাসিয়া বলিল,–আপনি রসিক বটে। কিন্তু এই সাঁঝের আঁধারে এতদূর থেকে কি ভাল দেখা যায়? বাড়ীর ভিতর চলুন।
আমি বুঝিলাম, আগন্তুক দালাল। কিছু পাইবার প্রত্যাশায় আমাকে লইয়া যাইতে চায়। বাড়ীর ভিতর যাওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে মনে করিয়া আমি বাহিরেই কামিনী সহ দেখা করিতে ইচ্ছা করিলাম। লোকটাকে বলিলাম,–বাপু, তুমি আমাকে যা মনে ক’রেছ, আমি তা নয়। তবে যখন আমার কাছে এসেছ, তখন যদি আমার একটা কাজ করা, আমি তোমায় সন্তুষ্ট করিব।
শশব্যস্তে সে বলিয়া উঠিল,–কি কাজ বলুন?
আমি বলিলাম, ঐ বাড়ীতে কামিনী নামে একটা মেয়েমানুষ আছে জান?
সে যেন মুখ বিকৃত করিল। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, আজ্ঞে হাঁ, জানি বই কি। আগে ছিল ভাল—এখন বাতে পক্ষু।
আমি বলিলাম, কামিনীকে কোনরূপে আমার কাছে আনিতে পার? আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিব না।
লোকটা কিছু কালা, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে বলিল, কি বলিয়া ডাকিয়া আনিব? আপনাকে সে কি চেনে?
আ। আমাকে সে চেনে না, কোন রকম কৌশল করিয়া তাহাকে আনিতে হইবে।
লো। কোথা দেখা করিবেন? এই রাস্তায়?
আ। না, তাহারও উপায় তোমায় করিতে হইবে।
লো। কি উপায় করি?
আ। তোমাদের কোন ঘর এখানে নাই?
লো। আছে, কিন্তু সেখানে নিয়ে গেলে সকলকে অংশ দিতে হইবে। আমরা চারিজনে ঘরটী ভাড়া লইয়াছি।
আ। ভাল, আমি তাহাদিগকেও স্বতন্ত্র দিব, তুমি কামিনীকে সেইখানে লইয়া যাইও। আপাততঃ সেই ঘরটা আমাদিগকে দেখাইয়া দাও।
তাহাদের আড্ডা নিকটেই ছিল। লাল সিংকে লইয়া আমি সেই ঘরের ভিতর বসিলাম। যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাঁহাকেই কৰ্ত্তা বলিয়া বোধ হইল। সে সকলকে চুপি চুপি আমাদের সেখানে যাইবার কারণ বুঝাইয়া দিল–পুরষ্কারের কথাও ভুলিল না। লাভের আশা পাইয়া সকলেই আনন্দিত হইল এবং আমাদিগকে যথেষ্ট সম্মান প্ৰদৰ্শন করিতে লাগিল।
অৰ্দ্ধ ঘণ্টা মধ্যেই কামিনীকে লইয়া পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তি ফিরিয়া আসিল। তখন অপরাপর লোক সকল এক একটী অছিল করিয়া সেখান হইতে বিদায় লইল। অবশেষে যে কামিনীকে আনিয়াছিল, সেও তামাক আনিবার নাম করিয়া সরিয়া পড়িল।
আমি দেখিলাম, কামিনীর বয়স প্ৰায় চল্লিস বৎসর হইলে ও তাহাকে বৃদ্ধ বলা যায়। যে কারণেই হউক, সে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। কোমর বঁকিয়া শরীরের উপরদ্ধি নত কারিয়াছে। তাহার মাথার চুল অধিকাংশ কটা। শরীরের মাংস শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে।
অনেক কষ্টে আমার দিকে মুখ তুলিয়া কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, কি বাবা, তুমিই ডেকে পাঠিয়েছিলে?
আমি বলিলাম, ছেলে মেয়ে ধরা ব্যবসা কবে থেকে আরম্ভ করেছ?
কামিনী চমকিয়া উঠিল। অনেক কষ্টে আত্ম সম্বরণ করিয়া চীৎকার করতঃ বলিল, কি বলছে বাবা! আমি কানে একটু কম শুনি বাবা!
আমি চীৎকার করিয়া পূনর্ব্বার ঐ কথা বলিলাম। এবার সে তখনই কাঁদকাঁদ সুরে উত্তর করিল, কোন ভালখাকি আমার নামে লাগিয়েছে? তার সর্বনাশ হ’ক।
অনেক কষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া আমি বলিলাম আমি স্বচক্ষে দেখেছি! কেহই আমাকে তোমার নামে কোন কথা বলে নাই। কেন বৃথা গালাগালি দিতেছ বাছা!
কামিনী আমার কথায় যেন সিহরিয়া উঠিল। কিন্তু সেবারও আত্ম সম্বরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, ও সকল কথা নিয়া কি তামাসা ভাল দেখায়? তুমি না হয় ভাল মানুষের ছেলে, কোন কথা বলিবে না, কিন্তু কথায় কথায় পাঁচ কাণ হইলে ত সৰ্ব্বনাশ! কার মনে কি আছে কেমন করিয়া জানিব। ও সকল কথা ছেড়ে দাও—এখন যে জন্য ডেকেছ বল?
আমি কমিনীকে নিকটে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলাম, আমাকে বড় সহজ লোক মনে করো না। আমাকে এখনো কি চিনতে পার নাই? যদি বাঁচবার ইচ্ছা থাকে, সকল কথা প্ৰকাশ কর। তা না হলে তোমাকে জেলে দিব। মেয়েমানুষ বলে ছেড়ে দিব না।
কামিনীর মুখ শুকাইয়া গেল। ভয়ে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল, কিছুক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে আর দাঁড়াইতে না পারিয়া আমার পদতলে বসিয়া পড়িল।
আমি তখন বলিলাম, যখন কাজটা করেছিলে, তখন কি এ সকল কথা ভেবেছিলে? জান না কি, ইংরেজ রাজত্বে দোষ করিলে শাস্তি পাইতেই হইবে, কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইবে না।
আমার কথায় কামিনী কাঁদিয়া উঠিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল, দোহাই বাবা! আমার বেশী দোষ নয় বাবা। পেটের দায়ে একটা হতভাগা সন্ন্যাসীর কথায় আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। কে জানে এমন হবে?
আমি ধমক দিয়া বলিলাম, এখন কান্না রাখ, আমি যাহা বলি, তাহার উত্তর দাও। দুটী বালিকাকে নিয়ে গিয়েছিলে বটে, কিন্তু একটী ত ফিরে এসেছে। অপরটা কি হ’লো?
কা। কেমন করে বলি? আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে দিয়ে চলে এসেছিলেম।
আ। কত টাকা পেয়েছিলে?
কা। দশ টাকা।
আ। কে দিল?
কা। সন্ন্যাসী।
আ। তাহাকে চিনতে পারবে?
কা। দেখলেই চিনতে পারবো।
আ। সকল কথা গোড়া থেকে খুলে বল। কিন্তু সাবধান, মিথা বলিও না। যদি জানিতে পারি যে, মিছা বলছে, তাহলেই তোমায় জেল দিব।
কা। না বাবা, আমি মিছা বলবো না। সন্ন্যাসীর কথায় রাজী হয়ে আমি মেয়ে দুটিকে ধরিবার চেষ্টা করি। দুই দিন তাদের বাড়ীর কাছে কাছে ঘুরেও ধরতে পারি নাই। শেষে একদিন ভোরে দুজনে মিলে বাড়ী থেকে বাহির হয়। আমি পাছু নিই। যখন তাহারা পদ্মপুকুরের ধারে গেল, তখন আমি কৌশলে আরক মিশান দুটী জবাফুল তাদের নাকের কাছে ধরি। ফুলের গন্ধে তারা এক রকম পাগল হয়ে যায়। আমি যা বলি, তারাও তাই করে। এই সুবিধা পেয়ে দ্বিরুক্তি না করে, আমি তাহাদিগকে এক গাড়ীতে করে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাই। তার পর সন্ন্যাসীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। মেয়ে দুটীর কি হলো জানি না।
আ। দুটি মেয়েকেই কি ধরিবার কথা ছিল?
কা। না—কেবল একজনকে। কিন্তু যখন দুজনে এক সঙ্গে ছিল, তখন দুজনকেই ধরে নিয়ে গেলাম।
আ। মেয়ে দুটী সন্ন্যাসীর কি দরকারে লেগেছিল?
কা। জানি না। তবে শুনেছি, সেই সন্ন্যাসী না কি কাপালিক, অনেক নরহত্যা করেছে।
আ। জেনে শুনে তুমি মেয়ে দুটিকে স্বচ্ছন্দে তার হাতে দিলে?
কা। নিজের পেট কাঁদলে জ্ঞান থাকে না।
আ। আচ্ছা—শোভন সিংকে চেন?
কামিনী চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে শোভন সিং? আমি তাকে চিনি না।
আমি লালসিংএর দিকে চাহিলাম। তিনি আমার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কামিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ, কামিনী, ইনি তোমার পূর্ব কথা সমস্তই জানেন। তুমি যে এক সময়ে শোভন সিংএর রক্ষিতা ছিলে, ইনি তাহাও শুনিয়াছেন। এখনঈ মিথ্যা বলিতেছ?
কামিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া কি বলিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। আমারও তাহা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। আমি বলিলাম, কামিনীকে এখনই আমার সহিত থানায় যাইতে হইবে।
আমার কথায় কামিনীর ভয় হইল। সে রোদন করিতে লাগিল। আমি মিষ্ট কথায় কামিনীকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলাম, তোমার কোন ভয় নাই। যদি দোষ না থাকে, এখনই মুক্তি পাইবে।
কামিনী আমার শ্লেষ বাক্য বুঝিতে পারিল না। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া লালসিং কর্তৃক আনীত একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আমরা সকলেই আরোহণ করিলাম। আড্ডার সকল লোককে পুরষ্কার দিয়া সন্তুষ্ট করত কোচমানকে আমাদের থানায় যাইতে আদেশ করিলাম।
থানায় আসিয়া কামিনী ভজনসিংকে সনাক্ত করিল। সে বলিল, তাঁহারই পরামর্শ মত সে দুই জন বালিকাকে ভুলাইয়া তাঁহার নিকট লইয়া যায়; এবং এই কার্য্যের জন্য সন্ন্যাসী তাহাকে দশটী টাকা দিয়াছেন।
সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসীত্রয় তখন ধ্যানে নিমগ্ন—কেহই কামিনীর কথা শুনিতে বা বুঝিতে পারিলেন না।
বালিকাদ্বয়কে ভুলাইয়া লইয়া যাইবার জন্য কামিনীকে গ্রেপ্তার করা হইল। যতদিন না বিচার শেষ হয়, ততদিন তাহাকে হাজতে রাখিবার ব্যবস্থা হইল। কামিনী অনেক কান্নাকাটি করিল, অনেক কাকুতি মিনতি করিল, অনেক গালি বর্ষণ করিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
পূৰ্বোক্ত পরিচ্ছেদে বর্ণিত কাৰ্য্যগুলি শেষ করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমি নির্জনে বসিয়া এই অদ্ভুত রহস্তের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, তবে কি সত্য সত্যই সন্ন্যাসীগণ রূপসীকে হত্যা করিয়াছে? কামিনী যখন ঐ সন্ন্যাসীকে সনাক্ত করিল, যে ভাবে কামিনী তাহার কথা ব্যক্ত করিল, তাহাতে তাহার কথা মিথ্যা বলা যায় না। অথচ সন্ন্যাসী আমাকে যাহা বলিলেন, তাহাতে তাঁহার কথাতেও অবিশ্বাস হয় না। তবে একজন সাধু সচ্চরিত্ৰ সদাশয় ব্যক্তি, অপর বেশ্যাতিপস্বিনী। কামিনীর কথা মিথ্যা হইতে পারে, কিন্তু সে পুলিসের লোকএর নিকট এমন সাজান কথা বলিয়া পরিত্রাণ পাইবে, তাহা বোধ হয় না। সন্ন্যাসী মিথ্যা বলিবে কেন? সন্ন্যাসীর মৃত্যুরই বা ভয় কি? যাঁহার সংসার-বন্ধন শিথিল হইয়া গিয়াছে, এ জগতে যাঁহার আপন বলিতে কেহ নাই, তিনি সামান্য প্রাণের জন্য, তুচ্ছ জীবনের জন্য পারত্রিক সুখ নষ্ট করিবেন কেন? সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী।
কিন্তু কেমন করিয়া তাঁহাকে নির্দ্দোষী বলিয়া প্রমাণ করিব। শেষে প্রমাণাভাবে কি একজন নিরপরাধ ব্রাহ্মণ-সন্তানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিব। কামিনী নিশ্চয়ই মিথ্যা বলিতেছে। সে যখন শোভন সিংএর রক্ষিতা বেশ্যা ছিল, সে যখন এক-সময়ে শোভন সিংএর পয়সা খাইয়াছে, তখন সে কখনো শোভন সিংএর অনিষ্ট করিতে পারে না। রূপসী শোভনের কন্যা—বাল্যকালে সে যে কামিনীর বাড়ীতে যাইত, তাহা স্পষ্টই জানা যায়। সুতরাং কামিনী যে রূপসীকে ভালবাসিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। সে যে রূপসীকে চুরি করিবে, বিশেষতঃ একজন সামান্য সন্ন্যাসীর কথায় রূপসীকে হত্যা করিবার জন্য তাহার হন্তে অৰ্পণ করিবে, ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। রমণীর প্রতিহিংসা–বৃত্তি ভয়ানক প্রবল। রমণী যদি কাহারও উপর রাগান্বিত হয়, তাহা হইলে সে যে কোন রূপেই হউক, যতদিন পরেই হউক, তাহার উপায় প্ৰতিশোধ লইবেই লইবে। কিন্তু কামিনীর কোন কারণ ঘটে নাই। লাল সিংএর মুখে শুনিলাম কামিনী এখনও শোভনের নিকট হইতে কিছু কিছু পাইয়া থাকে।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ একটা উপায় মনে পড়িল। লাল সিং তখনও থানায় ছিলেন। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। তিনি আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভনের ভগ্নী ছাড়া ছাড়া আর কোন আত্মীয় আছে কি না? কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া লাল সিং উত্তর করিলেন,–আজ্ঞে না—শোভনের দুইটী ভগ্নী ছিল। একটী ছোট বেলায় মারা পড়ে, অপরটী এখনও বিদ্যমান।
আ। শোভনের এই ভগ্নীর স্বভাব কেমন?
লা। অতি কুৎসিত। তাহার মত খল আর নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সেই ভগ্নীই যত অনিষ্টের মূল। শোভনের ইচ্ছা থাকিলেও কেবল ঐ ভগ্নীর কথায় সে রূপসীর সহিত আমার বিবাহ দিতে নারাজ ছিলেন।
আ। ভগ্নীর পুত্ৰাদি আছে?
লা। একটী কন্যা ছাড়া আর কোন সন্তান হয় নাই।
আ। বাড়ী কোথায়?
লা। সিয়ালদহের নিকট, আমি সে বাড়ী জানি।
আ। শোভনের ভগ্নী ত এখন তাঁহারই বাড়ীতে আছেন। শুনিয়াছি, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে তিনি ভ্রাতার বাড়ীতে গিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ এখনও ফিরিয়া আইসেন নাই।
লাল সিং আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন,–কে বলিল, শোভনের ভগ্নী তাঁহারই বাড়ীতে আছে? আমার বিশ্বাস, তিনি বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন।
আমিও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! রাত্রে ভাইঝির বিবাহ–আর প্রাতে তিনি নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন? এ কি নূতন রহস্যের কথা বলিতেছেন?
লা। আজ্ঞে—রহস্যই বটে। তিনি রূপসীর বিবাহ দেখিতে আসিলেন—অথচ বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন কেন? তাহা বুঝিতে পারিলাম না।
আ। শোভন সিংএর মুখে ত সে কথা শুনিলাম না। তাঁহার ভগ্নী যে সেইদিন প্রাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, এ কথা ত তিনি বলিলেন না। বরং এমন কথা বলিয়াছিলেন, যাহাতে আমি বুঝিয়াছিলাম যে, তিনি তখনও সেই বাড়ীতে বাস করিতেছেন, এমন কি, তিনি তাহার ভগ্নীপতিকে পৰ্যন্ত দেখাইয়াছিলেন।
লা। তাঁহার ভগ্নীপতি এখনও আছেন বটে কিন্তু ভগ্নী নাই।
আ। কেন তিনি নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, বলিতে পারেন?
লা। আজ্ঞে না। সে কথা বলিতে পরিলাম না।
কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি লাল সিংকে বলিলাম,–আপনাকে এখন একটা কাজ করিতে হইবে। আমি একবার শোভনের ভগ্নীর বাড়ী যাইতে চাই। আপনাকে দূর হইতে বাড়ীখানি দেখাইয়া দিতে হইবে।
লাল সিং সন্মত হইলেন। আমি পুনরায় ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া লাল সিংএর সঙ্গে সঙ্গে সিয়ালদহ অভিমুখে গমন করিলাম। রাত্রি আটটার পর লাল সিং একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিলেন। আমি তাহাকে থানায় ফিরিয়া যাইতে আদেশ করিয়া অতি ধীরে ধীরে সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল। বহির্ব্বাটী বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সদর দরজা পার হইয়া উভয়দিকে দুইটী ঘর দেখিতে পাইলাম। কিন্তু দুইখানি ঘরের দরজাতেই চাবি দেওয়া।
সদর দরজা অতিক্রম করিয়া কিছুদূর গমন ক্রইবার পর আর একটী দরজা দেখিতে পাইলাম। কিন্তু সেটীর ভিতর দিক হইতে আবদ্ধ। ভিতরে প্রবেশ করিতে না পারিয়া আমি সেই দরজার নিকটে দাঁড়াইয়া কড়া নাড়িতে লাগিলাম।
অনেকক্ষণ কেহ কোন সাড়া দিল না, আমি প্ৰায় অৰ্দ্ধঘণ্টা ধরিয়া সেই কড়া নাড়িতে লাগিলাম। অবশেষে বিরক্ত হইয়া চীৎকার করিলাম। কিছুক্ষণ এই প্রকার চীৎকার করিবার পর ভিতর হইতে একজন স্ত্রীলোক উত্তর দিল, কে গো, দরজা যে ভেঙ্গে গেল।
আমার বড় রাগ হইল। আমি বলিলাম, সে কি আমার দোষ—এক ঘণ্টা ডাকাডাকি করেও সাড়া পাই নাই কেন?
আমার কথা শেষ হইতে না হইতে দরজাটী ভিতর হইতে খুলিয়া গেল। একটা বুড়ী দাসী একটা আলোক হস্তে লইয়া আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি চান?
কোন প্ৰকার গৌরচন্দ্ৰিক না করিয়া আমি একেবারে বলিয়া উঠিলাম, রূপসীকে শীঘ্ৰ আমার কাছে এনে দাও। এখানে রাখা ঠিক নয়, পুলিসের লোকে জানতে পারলে বাড়ী শুদ্ধ সকলকে এখনই বেঁধে নিয়ে যাবে। শুনেছি তিনজন সন্ন্যাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। যতদিন না বিচার হয়, ততদিন রূপসীকে সাবধানে রাখতে হবে।
আমার কথা শুনিয়া দাসী আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কোন উত্তর করিল না। রূপালী আছে, কি না, সে বিষয়েও কোন কথা বলিল না। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হইল, রূপসী সেখানেই আছে, কিন্তু সে কথা সাহস করিয়া বলিতে পারিতেছে না। আমি নিশ্চয় জানিতাম না যে, রূপসী সেখানেই আছে, আন্দাজ করিয়াছিলাম মাত্র। বিশেষতঃ যখন লাল সিংএর মুখে শুনিলাম যে, বিবাহের দিন প্রাতে শোভন সিংএর ভগ্নী তাহার বাড়ীতে প্রস্থান করিয়াছেন, তখন তিনি রূপসীকে লইয়াই আসিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। সেই জন্যই আমি রূপসী সেখানে আছে কিনা, জিজ্ঞাসা না করিয়া তাহাকে আমার নিকট অনিয়া দিবার কথা বলিলাম।
দাসীর মনোগত অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিলাম, সে যে আমার উপর অবিশ্বাস করিতেছে, তাহাও জানিতে পারিলাম, আমি যখন তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত, তখন তাহার এরূপ অবিশ্বাস জন্মিতে পারে বিবেচনা করিয়া, পূর্ব হইতেই প্ৰস্তুত ছিলাম। তখনই পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া বলিলাম, আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, এই পত্র লও। শোভন সিং আমাকে এই পত্র দিয়াছেন। যাও, আর বিলম্ব করিও না।
এই বলিয়া পত্ৰখানি দ্বাসীর হন্তে প্ৰদান করিলাম। দাসী উহা গ্ৰহণ করিয়া বলিল, না মহাশয়, আপনাকে আমাদের অবিশ্বাস নাই। তবে কি, এ কাজ খুব গোপনে করাই ভাল। আমি পূর্বে আপনাকে আর কখনও দেখি নাই। সেই জন্যই চিনিতে পারিতেছি না। একজন পরিচিত লোক পাঠান শোভনের উচিত ছিল।
আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, আজ রাত্রেই রূপসীকে কোন গোপনীয় স্থানে সরাইয়া ফেলিতে হইবে। এত তাড়াতাড়ি পরিাচিত বিশ্বাসী লোক কোথায় পাইবেন? আমি যদিও তোমাদের পরিচিত নই বটে কিন্তু শোভন সিং আমাকে বাল্যকাল হইতেই চেনে। আমার মত বিশ্বাসী লোক এত শীঘ্ৰ পাইবেন না বলিয়াই কোন পরিচিত লোককে পাঠাইতে পারেন নাই। সে যাহা হউক, তুমি পত্রখানি ভিতরে লইয়া যাও, ও শোভন সিংএর ভগ্নীর হস্তে প্ৰদান কর। তাঁহার পাঠ হইলে তিনি যেরূপ হুকুম দিবেন, সেই–মত কাৰ্য্য করিব।
দাসী হাসিয়া বলিল, পাঠ করিবেন কেমন করিয়া—তিনি লেখাপড়া জানেন না।
আ। তা আমি জানি। কিন্তু শোভন বলিলেন,–তাঁহার ভগ্নীর চাকর পড়াশুনা জানে এবং সেই তাঁহার ভগ্নীপতির অবৰ্ত্তমানে এ বাড়ীর অনেক চিঠি পত্ৰ পড়িয়া থাকে।
দা। সে চাকরিটা ত তাঁহাদের বাড়ীতেই আছে।
আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। মনে হইল, এইবার বুঝি বা ধরা পড়িলাম। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম। তখনই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, সে কি! শোভন সিং যে আমার সাক্ষাতে তাহাকে এখানে আসিতে বলিলেন। সে কি এখনও সেখান হইতে ফিরিয়া আইছে নাই?
দা। কই, এখনও ত আসে নাই।
আ। শীঘ্রই আসিবে বটে কিন্তু আমি ত ততক্ষণ বিলম্ব করিতে পারিব না। কে জানে, হয় তা ইহার মধ্যেই পুলিসের লোক এখানে অসিতে পারে।
দ। এখানে আসিলে কিছু করিতে পরিবে না, তবে যদি—
দাসী আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না দেখিয়া আমি বলিলাম, তবে যদি কি? আমার নিকট কোন কথা বলিতে ভয় করিও না। আমার দ্বারা উপকার ভিন্ন কোন প্ৰকার অপকারের সম্ভাবনা নাই।
দাসী বলিল, আপনাকে কোন অবিশ্বাস নাই, আপনাকে সকল কথাই বলিতে পারি, কিন্তু কি জানি, যদি আর কোন লোক আমাদের এ সকল কথা শোনে, সেই জন্যই সাবধান হইতেছি।
আ। এখানে আপাততঃ আর কোন লোক নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে সকল কথাই বলিতে পার। এখন কি বলিতেছিলে বল?
দা। বলছিলাম, যদি রূপসী কোন প্রকার চীৎকার করিয়া পাঁচজনকে জানাইয়া দেয়, তাহা হইলেই সৰ্ব্বনাশ! মেয়েটা বড় দুষ্টু।
আ। কেন?
দা। সে না কি সেই বুড়োকে বিবাহ করতে পাগল হয়েছে।
আ। বুড়ো কে?
দা। কেন—যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা।
আ। সে বুড়ো না কি? আমি ত একবার মাত্র তাকে দেখেছিলাম।
দা। দেখতে বুড়ো না হলেও তার বয়স হয়েছে। তাহার প্রথম পক্ষের ছেলেটী থাকলে এতদিন দশ বছরের হত। যার ছেলের বয়স দশ বছর, তার আবার বিয়ে করা কেন?
আ। তাঁহার ছেলেটী এখন কোথায়?
দা। মারা গেছে।
আ। রূপসীয় তবে এ বিবাহে অমত নাই?
দা। না—এত বয়স হ’লো, এখনও বিয়ে হয় না—বাপের চেষ্টাও নাই। কাজেই এখন যার তার সঙ্গে বিয়ে হ’লেই হ’ল।
আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি বলিলাম, সে কথা পরে হইবে, এখন রূপসীকে নিয়ে এস। আমি তাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। আজই কোন দূরদেশে রওনা না হইলে শোভনের রক্ষা নাই। শুনিয়াছি, সে ভাবী জামাইয়ের নিকট হইতে আট শত টাকা আদায় করিয়াছে।
দাসী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া বাড়ীর ভিতর গেল এবং কিছুক্ষণ পরে রূপসীকে লইয়া পুনরায় সেখানে ফিরিয়া আসিল।
পূৰ্বে আমি রূপসীকে দেখি নাই। মনে করিয়াছিলাম, সে বালিকা মাত্র। কিন্তু এখন যাহা দেখিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। রূপসীর বয়স প্ৰায় পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার শরীরে যৌবনের সমস্ত চিহ্নগুলি পরিস্ফুট হইয়াছে। সে আমার মুখের দিকে সাহস করিয়া চাহিতে পারিল না।
রূপসী সুন্দরী ও যুবতী। তাহার জন্য লাল সিং যে অনায়াসে আটশত টাকা দিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?
দাসীর সহিত রূপসীকে দেখিয়া আমি বলিলাম, মা! তোমার বাপের ইচ্ছা নয় যে, তুমি আর এখানে থাক। তোমাকে এখনই আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।
ভিতর হইতে আর একজন রমণী উত্তর করিলেন, দাদার যেমন বুদ্ধি। আমাদের এখানে থাকিলে কোন প্ৰকার গোলযোগের সম্ভাবনা নাই। কেন তিনি রূপসীকে এখন হইতে সরাইতেছেন বলিতে পারি না। যাহাই হউক, দাদার কথামত রূপসীকে আপনার সঙ্গে পাঠাইলাম। দেখিবেন, যেন কোন প্রকার বিপদে পড়িতে না হয়।
আমিও উদ্দেশে উত্তর করিলাম, আপনি সে ভয় করিবেন না। বিশেষ না জানিয়া শুনিয়া শোভন সিং আমার উপর এ কার্য্যের ভার দেন নাই, বরং রূপসী এখানে থাকিলে আপনাদের বিপদের সম্ভাবনা হইতে পারে, আমার সহিত যাইলে সেরূপ কোন ভয়ের কারণ নাই। আপনি পত্রখানি রাখিয়া দিন। উহাতে আমার নাম ধাম সমস্তই আছে। প্রয়োজন হইলে আমায় সংবাদ দিতে পারিবেন। তবে এই পর্য্যন্ত জানিয়া রাখুন যে, আমি আজই রাত্রি সাড়ে দশটার সময় কলিকাতা ত্যাগ করিব।
রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না। রূপসীকে লইয়া একখানি গাড়ীতে উঠিলাম এবং আধঘণ্টার মধ্যেই থানায় ফিরিয়া আসিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ।
থানায় আসিয়া রূপসীকে একটী ঘরে রাখিলাম। পরে তখনই একজন কনস্টেবলকে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। বলিয়া দিলাম, সে যেন অবিলম্বে তাহাকে ডাকিয়া আনে।
এক ঘণ্টার মধ্যেই কনষ্টেবল শোভনকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। কোন কথা না বলিয়া তখনই তাহাকে বন্দী করিতে আদেশ করিলাম।
শোভন সিং আমার আদেশ শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, এ কিরূপ বিচার হইল? একেত আমি ধনে প্রাণে মারা পড়িয়াছি, তাহার উপর আবার আমাকেই বন্দী করিলেন? আমার অপরাধ কি?
আমি গম্ভীরভাবে উত্তর করিলাম, আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে, সকল কথা কালই জানিতে পারিবেন।
শো। আমার অপরাধ?
আ। যথেষ্ট—আপনি লালসিংএর নিকট হইতে আটশত টাকা প্রবঞ্চনা করিয়া লইয়াছেন; একজন নিরীহ সন্ন্যাসীর উপর আপনার কন্যার হত্যাপরাধ চাপাইবার মানস করিয়াছেন।
শো। সে কি! আমার কন্যা কোথায়?
আ। আপনি কি বিবেচনা করেন?
শো। সেই সন্ন্যাসী–আমার ঘোর শত্রু ভজন সিং তাহাকে হত্যা করিয়াছে, আমি এই জানি।
আ। এই দেখুন—এখনও মিথ্যা বলিতেছেন। রূপসীকে যে কেহ খুন করে নাই, এ কথা আপনিও অবগত আছে। কিন্তু বলুন দেখি, পরশু রাত্রি হইতে আপনি কি কাণ্ড করিয়াছেন? আপনার রোদন দেখিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম, আপনার কন্যা সত্য সত্যই খুন হইয়াছে, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখন সমস্ত রহস্য ভেদ করিয়াছি। আপনি যে কি ভয়ানক লোক, একজন নিরীহ লোকের প্রাণবিনাশ করিবার জন্য কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছেন, তাহা কাল প্রাতেই জানিতে পরিবেন। আজ অনেক রাত্রি হইয়া পড়িয়াছে, বিশেষতঃ সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, আজ এই রাত্ৰে আর। সে সকল কথার প্রয়োজন নাই।
এই বলিয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে ইঙ্গিত করিলাম। সে আমার সঙ্কেত বুঝিতে পারিল এবং তখনই শোভন সিংকে আমার সম্মুখ হইতে স্থানান্তরিত করিল। শোভন সিং অতি বিমৰ্ষভাবে হাজতে গেল।
পরদিন প্রাতঃকালে লালসিং থানায় আসিলে আমি তখন তাঁহাকে কোন কথা না বলিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিলাম। তিনি আমার মুখ দেখিয়া কি বুঝিয়েছিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা যেন অধিক আনন্দিত বলিয়া বোধ হইল।
অন্যান্য কাজ শেষ করিয়া আমি শোভন সিং, লাল সিং, কামিনী ও সন্ন্যাসী তিনজনকে একটী ঘরের মধ্যে আনয়ন করিতে বলিলাম। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে আমার আদেশমত কাৰ্য্য হইল। আমি তখন সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া শোভন সিংএর দিকে চাহিয়া বলিলাম, আপনার সমস্ত চাতুরী ধরা পড়িয়াছে। রূপসীকে কেহ হত্যা করে নাই, তাহাকে আপনিই কৌশলে আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে সরাইয়াছিলেন। রূপসী যখন গৌরীর সহিত পদ্মপুকুরের নিকট দিয়া যাইতেছিল, তখন কামিনী কৌশলে উহাদের উভয়কে ভুলাইয়া গাড়ীতে তুলিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বে সন্ন্যাসীগণের নির্জন আশ্রম–সেই ভগ্ন অট্টালিকায় লইয়া গিয়াছিল। সন্ন্যাসীগণ নিশ্চয়ই ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁহারা এ বিষয়ের কিছুই জানিতেন না—এমন কি, সন্দেহও করেন নাই। এই স্থান হইতে রূপসীকে কৌশলে বাহির করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; এবং গৌরীকে নানা প্ৰকার ভয় দেখাইয়া কামিনী স্বয়ং বাহির করিয়া আনিয়াছিল। গৌরী স্বচক্ষে রূপসীকে হত্যা করিতে দেখে নাই। সে কামিনীর মুখে শুনিয়াছিল মাত্র এবং সেই শোনা কথা এমন ভাবে রাষ্ট্র করিয়াছিল, যেন সে উহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে। আপনি লোক নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহারাই রূপসীকে অন্য পথ দিয়া বাহির করিয়া আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে লইয়া যায়। এদিকে আপনার ভগ্নীও সেইদিন প্ৰাতঃকালে আপনার বাড়ী ছাড়িয়া নিজ বাড়ীতে গিয়াছিলেন। বিবাহোপলক্ষে তাঁহার আগমন। অথচ বিবাহের দিন প্রাতঃকাল নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া যাওয়া বড়ই আশ্চর্য্যের কথা। এখন বলুন, আপনি কি জন্য কন্যার মিথ্যা মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্র করিতেছেন? কেনই বা নিরপরাধী এই সন্ন্যাসীগণের উপর খুনের দাবী দিয়াছিলেন? আর কেনই বা এই লাল সিংকে প্ৰবঞ্চনা করিতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন? আমার প্রত্যেক কথার প্রমাণ আছে। বলেন ত সমক্ষেই তাহারা সাক্ষ্য দিতে প্ৰস্তুত। আমার কথায় অস্বীকার করা বাতুলের কাৰ্য্য।
আমার কথায় শোভন সিংএর মুখ পাংশুবৰ্ণ ধারণ করিল। তিনি আমার কথার ভাবেই বুঝিয়াছিলেন যে, আমি মুখে যাহা বলতেছি, কাজেও তাহা করিব। এই ভাবিয়া তিনি বলিলেন, না—যাহা করিয়াছি এবং যখন ধরা পড়িয়াছি, তখন অস্বীকার করিব কেন? আপনার সমস্ত কথাই ঠিক। আপনি সব করিতে পারেন। নিতান্ত কষ্টে পড়িয়াই লাল সিংএর টাকা নষ্ট করিয়া ফেলিলাম।
আমি বলিলাম, আর আপনার টাকার দরকার নাই। যখন আপনার কাছে রূপসী জীবিত, তখন তাহার সহিত লাল সিংএর বিবাহ দিন। যে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া টাকা লইয়াছেন, সেই প্ৰতিজ্ঞা পূর্ণ করুন। আপনার কন্যা এখানেই আছে, আর সে লাল সিংকে বিবাহ করিতে সম্পূর্ণ ইচ্ছুক। আপনি অন্যায় করিয়া মিথ্যা এই বিপদ ঘটাইয়াছেন। কেন না, নিরীহ সন্ন্যাসীগণের উপর মিথ্যা কন্যার খুনের দাবী দিয়া আপনাকে বিষম বিপদে ফেলিয়াছেন। যথেষ্ট অর্থদণ্ড না দিলে নিষ্কৃতি নাই।
শোভন সিং বিবাহের কথা শুনিয়া আন্তরিক রাগান্বিত হইলেন। কিন্তু সাহস করিয়া সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কেমন করিয়া জানিলেন, রূপসী এ বিবাহে ইচ্ছুক? সে আমার দুধের মেয়ে, এই বুড়ো বরকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিবে কেন?
আ। কেন তাহা জানি না। কিন্তু আপনার কন্যা আমার বাড়ীতে ঐ রূপই বলিয়াছে।
শো। আমার মেয়ে—বালিকা নয়, সে এখন যুবতী। বিশেষ তাহার কোন অপরাধ নাই, কেবল, সাক্ষ্য স্বরূপ তাহাকে এখানে আনা হইয়াছে, সেই জন্য তাহাকে বাহিরে পুলিসের অন্যান্য কর্ম্মচারিদিগের সহিত একত্র রাখিলাম না;–আমার অন্দরেই স্থান দিয়াছি। রূপসী বড় ভাল মেয়ে। তাহার মন বড় সরল।
শোভন সিং আর কোন কথা কহিলেন না। সন্ন্যাসীগণকে তখনই মুক্ত করিয়া দেওয়া হইল। তাঁহারা, বিশেষতঃ ভজন লাল আমায় আশীৰ্বাদ করিতে করিতে প্ৰস্থান করিলেন।
লাল সিং আমার কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। আপাততঃ রূপসী তাঁহারই বাড়ীতে গেল। শোভন সিং বিবাহে সন্মতি দিয়াছিলেন। সুতরাং রূপসীকে লাল সিংএর সহিত যাইতে নিষেধ করিলেন না।
কামিনী হাজতেই রহিল। কোন লোক তাহার জামিন হইল না। সৌভাগ্য বশতঃ অধিককাল তাহাকে হাজতে থাকিতে হইল না। সৌভাগ্য বশতঃ অধিককাল তাহাকে হাজতে থাকিলে হইল না। শীঘ্রই বিচার হইয়া গেল। বিচারে শোভন সিংহের পাঁচ শত মুদ্রা এবং কামিনীর দুইশত মুদ্রা অর্থদণ্ড হইল। অর্থ দিতে না পারিলে শোভন সিংকে ছয় মাস এবং কামিনীকে একমাস কাল সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে।
রূপসীকে লাভ করিয়া লাল সিং এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, বিশেষ রূপসী তাঁহাকে বিবাহ করিতে অভিলাষিণী শুনিয়া তিনি এত আনন্দিত হইয়াছিলেন যে, শোভন সিংএর মুক্তির সমস্ত টাকা নিজেই প্ৰদান করিলেন। শোভন মুক্ত হইলেন। কামিনীও দুই শত টাকা দিয়া মুক্তি লাভ করিল।
বাড়ী ফিরিয়াই শোভন সিং কন্যার বিবাহের আয়োজন ক্রিতে লাগিলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে লাল সিংকে পাঁচ শত মুদ্রা দিতে দেখিয়া তিনি লাল সিংএর পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। রূপসীকে নিজ বাড়ীতে আনিয়া মহা সমারোহে বিবাহ দিলেন। নব দম্পতীকে শোভন প্রাণ খুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন।
সমাপ্ত।