লাগেজ সাজানোর জন্যে ব্যাগ বের করে ঝাড়তে গিয়ে ঝুপ করে পায়ের কাছে পড়ল একটি শুকনো ফুলের মালা। মালাটা হাতে নিয়ে বসে পড়ল সুরভী।দু’চোখ জলে ভরে উঠলো, মনে পড়ে গেল সারিকার কথা।ড: সারিকা চেন্নাইয়ের এক নামকরা হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার।
সুরভীর সাথে তার পরিচয় হয়েছিল মাসতিনেক আগে।সুরভী ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল সেখানেই পরিচয়। সারিকা তামিলনাড়ুর স্থানীয় বাসিন্দা তবু বাংলাটা ভালো না বলতে পারলেও অনেকটাই বোঝে। কারণ তার ঠাকুমা বাঙালি।ঠাকুরদা ছিলো নামকরা গ্যাস্ট্রোলাইজারদের মধ্যে একজন, ঠাকুমা বাঙালি ডাক্তার কর্মক্ষেত্রে তাদের পরিচয় তারপর বৈবাহিক জীবন।সেই সূত্র ধরে হয়তো বা খানিকটা কৌতূহল বসেও সারিকার একটু -আকটু বাংলা শেখা।
সারিকা সুরভীর ডাক্তার নয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার সময় ঐ রুমে ফাস্ট দেখা হয় তার সঙ্গে। সুরভী দেখেছে এখানে ডাক্তার , নার্স, ডি গ্রুপে কর্মরত র্কমীরা কেউই বাংলা বোঝেনা।খুবই অসুবিধা হচ্ছিল সুরভীর, সে বাংলা ছাড়া। অন্য কোন ভাষা বলতে পারে না বোঝেওনা।সারিকা ভাংগা ভাংগা ভাবে বাংলায় বলল―ভয় পাচ্ছো কেন?কিছু হবে না। নিজে থেকে আমাদের সাথে একটু কো-অপারেট করো তাহলে কাজটা অনেকটা সহজ হয় আমাদের কাছে।
আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে সুরভী সারিকার দিকে। সারিকা কাছে এসে ঘাঢ়ের উপর হাত রেখে বলে― আমি আছি তো। সামান্য একটা কথা।কিন্তু এর গভীরতা অপরিসীম,খুব কাছের মানুষ ছাড়া এতটা ভরসা কেউ দিতে পারে না।আর এতো দরদ মাখানো ছিল যে সে আওয়াজ যেন এখনো কানে বাজে সুরভীর।
সুরভী প্রথম যখন জানতে পেরেছিল তার এই মারাত্মক অসুখের কথা।অপারেশনই যার একমাত্র চিকিৎসা তবে প্রচুর ব্যয়বহুল।মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। কিন্তু উপায় কি? ডাক্তার সাহেব উপদেশ দিলেন এতো টাকার ব্যপার হটাৎ করে জোগাড় করা সম্ভব না হলে তিন মাসের অষুধ নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।টাকা-পয়সা জোগাড় করে পরে আসতে।
সুরভী তার হাজব্যান্ডকে বোঝালো এই অনিশ্চিত জীবনটাকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয়না।যদি সব কিছু ঠিক না হয়!যদি একটা কিছু হয়ে যায়!তবে একটা মৃত্যু আর পাঁচজনের বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। তাই জমি-যায়গা বিক্রি করে অথবা ঋণের জালে জড়িয়ে এই চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এতো দিনের সংসার, মায়ার বাঁধন হয়তো এতো সহজে উপেক্ষা করা যায় না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো একবার ভেলুরে ঘুরে আসা যাক যদি কম খরচে কিছু করা যায়। তাই আবার লাগেজ গোছানো।
এই লাগেজ গোছাতে গিয়েই সারিকার স্মৃতিটা বেরিয়ে এলো। লাষ্ট দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাথরুমে যাওয়ার নাম করে সুরভী সারিকার রুমে গিয়েছিল দেখা করতে। সারিকা সব শুনে সুরভীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল।
বলেছিল―কিছু হবে না তোমার সুরভী। তুমি খুবই ভালো মেয়ে, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে, ঈশ্বর তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না। বলে ওর মাথার থেকে ফুলের মালাটা খুলে সুরভীর হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিল।
সুরভী বললো―এটা তুমি কি করছো সারিকা! আমি জানি তোমাদের মাথার এই ফুলের মালা তোমাদের ঐতিহ্য। আমি প্রথম দিন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম-যে এখানে স্থানীয়রা প্রত্যেকের মাথায় ফুলের মালা। ডাক্তার, নার্স,সাফাই কর্মী, রাস্তায় মানুষের মাথায়, এমনকি পেসেন্ট ডাক্তার দেখাতে এসেছে, রোগের যন্ত্রণার মধ্যেও তাদের মাথায় ফুলের মালা দেখে আমি কৌতূহল হয়ে আমাদের এক বাঙালি পেসেন্টকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এটা কেন?
উনি আমাকে বলেছিলেন― এটা তোমাদের ঐতিহ্য, সংস্কার, সম্মান, ভালোবাসা যাই বলো তাই।প্রতিদিন তোমরা যে ফুলের মালা চুলে দাও তা তোমাদের কাছে খুব দামী।এর মূল্য সোনা বা হীরার চেয়েও বেশী।কোনো অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা যায় না।
হ্যাঁ তুমি ঠিকই শুনেছ।তবে তোমার চেয়ে দামি নয় আমার কাছে।তুমি, তোমার বন্ধুত্ব এর থেকে অনেক দামি।শোন সুরভী একদম মন খারাপ করবে না।তিন মাস অষুধ গুলো খাও, রেস্টে থাকো। তারপর তুমি যখন আবার চেন্নাইতে আসবে অপারেশন করাতে যখন তুমি আমাদের হাসপাতালে ভর্তি থাকবে তখন আমি প্রতিদিন তোমার জন্য একটি করে ফুলের মালা নিয়ে আসব আর তোমার চুলে পরিয়ে দেবো।
বন্ধুর দেওয়া সেই অসামান্য উপহার যার হয়তো আজ রূপ নেই, গন্ধ নেই অথচ সুরভীর কাছে তা কোটি টাকার চেয়েও দামি। তাই বার বার শুকনো ফুলের মালাটি হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে চুমু খেতে খেতে নিজের মনেই বলে ওঠ ―কেমন আছো তুমি সারিকা, এ জীবনে আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।ভালো থেকো তুমি।