“আপনার কত নাম্বারে নাম আছে?”
“আমি নাম লেখাই নি।”
“সেকি?ডাক্তার দেখাবেন আর আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট করে আসেন নি?এপয়েন্টমেন্ট করা না থাকলে ম্যাডাম তো দেখবেন না।”
“আসলে দেখাতে আসিনি। ম্যাডামের সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি।”
“তাহলে বসুন।সমস্ত পেসেন্ট দেখা হোক।তারপর ম্যাডামের সাথে দেখা করবেন।”
“বেশ ঠিক আছে” বলে আবার চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়ে পূরবী।পাশের চেয়ারটায় বসে আছে অনিন্দ্য।অনিন্দ্য পূরবীর হাজব্যাণ্ড। হাজব্যাণ্ড আর ছেলেকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে ম্যাডামের সাথে দেখা করতে।
শহরের নামকরা গাইনোকোলজিস্ট গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের বাড়িতেই রোগী দেখেন। পূরবীকে গায়ত্রী ম্যাডামের খোঁজ দিয়েছিল ওরই এক বান্ধবী সুস্মিতা।সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনে দেখা সুস্মিতার সাথে…
“কি রে সমস্যার কিছু সমাধান হল?”
“না রে অনেক ডাক্তারই তো দেখাচ্ছি।কিছুই হচ্ছে না।”
“তুই একবার ডঃ গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখাতে পারিস। শুনেছি ভীষণ ভালো ডাক্তার।”
“উনি কোথায় বসেন?”
“আজ রাতে ফোন করিস একবার। তখন ডিটেইল বলে দেবো।”
সেদিন সুস্মিতার কথা শুনেই ম্যাডামের কাছে আসা পূরবীর।Polycystic Ovarian Syndrome যার ফলে তার এই সন্তানহীনতা। টানা দেড় বছর ম্যাডামের ট্রিটমেন্টে ছিল পূরবী।গায়ত্রী ম্যাডাম পূরবীর কাছে ভগবানের সমান। তাই হয়তো আজ এমন সুদিনের মুখ দেখতে পেয়েছে। কথা গুলো ভাবছে এমন সময়…
“আপনারা ভিতরে যান। ম্যাডাম ফ্রি হয়েছেন এবার।”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে”…বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে পূরবী ভিতরে ঢোকে, সঙ্গে হাজব্যাণ্ডও।
“ম্যাডাম চিনতে পারছেন তো?”
“হ্যাঁ.. চিনতে কেন পারব না। ছেলে তো বড়ো হয়ে গেল। এক বছর বয়স হল তাই না?”
“সামনের মাসে মানে ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ এলেই এক বছর পূর্ণ হয়ে যাবে।”
“বাহ্ ভালো থেকো সব সময়। তারপর কি দরকার বলো.. শুনলাম অনেকক্ষণ থেকে এসে বসে আছো। ”
“হ্যাঁ, তাও অনেকক্ষণই হল এসেছি। ম্যাডাম এটা আপনার জন্য।”
“এটা আবার কি?”
“ও সেরকম কিছু না।সামান্য কিছু মিষ্টি আছে।সেই কবে থেকে ভাবছি আপনার সাথে দেখা করব।আজ একটু সময় পেলাম, তাই চলে এলাম।”
“এসবের আবার কি দরকার ছিল।”
“আজ আপনার জন্যই আমার মুখে এত হাসি।আপনি আমার কাছে ভগবান।”
“আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এর থেকে বেশি কিছু না।”
“তা হলেও ম্যাডাম। আপনি না থাকলে কোনোভাবেই আমাদের আশা পূরণ হত না।”
“তোমার ছেলে তো বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। ছেলের নাম কি রাখলে?”
“অপরূপ”
ম্যাডাম পূরবীর ছেলেকে কোলে টেনে নিলেন ।আদর করতে করতে বলেন, “বাহ্ বেশ সুন্দর নাম।”পূরবীও অবাক হয় ম্যাডাম তার ছেলেকে কোলে তুলে আদর করছে দেখে। তারপর ভাবে ডাক্তার তো কি হয়েছে, উনিও তো একজন মা।তারপর ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে..
“ম্যাডাম, আপনার ছেলে না মেয়ে?”
“আমি নিঃসন্তান।”
“মানে, আপনি নিজে তো ডাক্তার “তাতে কি।শুধু এটা জেনে রেখো ভগবান সবাইকে সবকিছু দেয় না।”
পূরবী এরপর কি বলবে ভেবে পায় না।হয়তো এমন প্রশ্ন করে ম্যাডামের মনটাই খারাপ করে দিল পূরবী। কিন্তু পূরবী তো সে কথা জানত না।তাই জিজ্ঞাসা করে ফেলেছে।মা না হতে পারার যন্ত্রণা পূরবীও বোঝে। সমাজ, সংসার কেউ তখন বলতে ছাড়ে না।তারপর ইতস্তত করতে করতে পূরবী বলে “সরি ম্যাডাম, আমি বুঝতে পারিনি। তাই জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি।আসলে আমিও এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম।তার উত্তর কি যে দেব সেটাই ভেবে পেতাম না।”
“না না সরি বলার কিছু নেই। একদম সাধারণ কথা জিজ্ঞাসা করেছো।ওই যে আগেই বললাম সবাই সব কিছু পায় না।আমি ডাক্তার হলেও আমি তো একজন মেয়ে। আর প্রতিটা মেয়ের মধ্যে সেই মাতৃত্ব আছে।নিজে মা হতে পারিনি তাতে আমার দুঃখ নেই। বেশ কিছু গরীব বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার একটা ছোটো স্কুল আছে। তারা আমাকে “মাদার” বলে ডাকে। তাদের সব দায়দায়িত্ব পড়াশোনা সব আমি চালাই। আমার যাবতীয় রোজগার তাদেরই জন্য।” “ম্যাডাম তাহলে আপনার ওই স্কুল দেখাশোনা করে কে?”
“আমার হাজব্যাণ্ডই ওই গুরুদায়িত্ব সামলায় । তাই তো সে তার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ওই স্কুল চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সঙ্গে আরো দুজন শিক্ষক আছেন।ওদের পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ গানের পাঠও দেয় ।আমার তো সারাদিনের কিছুটা সময়ই কেটে যায় ওদের সাথে। এই তো রোগী দেখা শেষ হল, এবার আমিও বেরিয়ে যাব। যাবে তো চলো আমার সাথে আমার সেই সুখের ঠিকানায়।দেখে আসবে অন্তত।” এমন কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে যায় পূরবীর। অনিন্দ্যকে বলে.. “চলো না, একবার ঘুরেই আসি।” সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য বলে, “অবশ্যই।”
সঙ্গে কিছু চকোলেট কিনে নেয় বাচ্চাদের দেবার জন্য।ম্যাডাম তাঁর নিজের গাড়িতে ওদের কে বসিয়ে নিয়ে চলে সেই সুখের ঠিকানায়।পূরবী পৌঁছে যায় ম্যাডামের স্কুলে।সত্যিই কত বাচ্চা। কত হাসি মুখ। ম্যাডাম গাড়ি থেকে নামতেই বাচ্চারা ছুটে আসে। মাদার মাদার বলে একটা চিৎকার। কি অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ম্যাডামকে না দেখলে বোঝা যায় না কতটা আবেগ আর ভালোবাসা তাদের জন্য। পূরবী ম্যাডামকে বলে..
“এটা দেখে আমি সত্যিই অভিভূত।কে বলেছে আপনি নিঃসন্তান।এত গুলো বাচ্চাকে মা রূপে আগলে রেখেছেন, সেই সঙ্গে আরও হাজার মায়ের কোলেও বাচ্চা উপহার দিচ্ছেন। আপনি সত্যিই মহীয়সী।আপনার এই স্নেহ মাখা হাসি দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।আজ যে আপনাকে নতুন রূপে চিনলাম।আপনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করে একটা কথাই বলব..আপনি মাদার, আপনি প্রকৃতই মমতাময়ী মা।”