“কই রে ছোট কোথায় গেলি তুই?চায়ের কাপটা ছোটঠাকুরপোর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আয় দেখি।আর বড়দিভাই তুমি আটাটা মেখে ফেল।শীতের এরো বেলা। কখন যে দেখতে দেখতে সময় চলে যাচ্ছে”;সকালের নরম ওমে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে চাদরটা টেনে নিতে নিতে ইশার কানে আসে ওর শাশুড়িমা সুধাময়ীদেবীর কন্ঠস্বর।উফফ পারেও বটে এই গুহঠাকুরতা বাড়ির লোকগুলোগুলো।কাকভাঙা ভোর থেকেই এদের জীবনযাপন শুরু হয়।কেউ রান্নাঘরে খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত,কেউ কলতলায় ঝপঝপ করে গায়ে স্নানের জল ঢালছে আর কেউবা ঠাকুরঘরে পুজোর গোছগাছ সারছে।আর রাত এগারোটা বাজতে না বাজতেই সব নিস্তব্ধ।এই বাড়ির ছেলে আদিত্যর সাথে ইশার এই বাড়িতে বিয়ে হয়েছে মাত্র দিন কুড়ি হল তার মধ্যেই ও হাঁফিয়ে উঠেছে।আসলে বিয়ের পর এক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে এসে পড়লে যা হয় আর কি!এখনকার ভাষায় নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি থেকে একধাক্কায় যৌথ পরিবারে এসে পড়া।
লেক গার্ডেন্সে তিন কামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকত ইশা,ওর মা আর বাবা সাথে ওর পোষ্য কোকো।তিনজনের ছিমছাম সংসার অনেকটাই নিরিবিলি। সবাই যে যার মত।আর এখানে যেন দিনরাত পাখির কলকাকলি।বাবা যে কি দেখল এই আদিত্যর মধ্যে যে বিয়ে বিয়ে করে একেবারে নেচে উঠল।অবশ্য ওর যে বিয়ের বয়স হয়নি সেটাও নয়।চাকরিও পেয়ে গেছিল একটা বহুজাতিক সংস্থায়। কদিন পরে বিয়ে হলেও মহাভারত অশুদ্ধ হতনা। কিন্তু গতবছর বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতে মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেলেন হঠাৎ কিছু হলে একমাত্র মেয়ের কি হবে সেই ভাবনায়।শেষমেশ বাবার এক অফিসের সহকর্মী মারফত ভবানীপুরে এই গুহঠাকুরতা বাড়ির মেজোঘরের ছেলে আদি ওরফে আদিত্যর সম্বন্ধ এল।আদিত্য একটি বিদেশী কোম্পানিতে কপিরাইটারের কাজ করে।এমনিতে পাত্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা ও,অন্তত এই কদিনে ইশা যা বুঝেছে সেই থেকে ওর এই ধারণা জন্মেছে।সবমিলিয়ে এই বাড়ির লোকসংখ্যা এখন পনেরো।আদির জ্যাঠা,জেঠি,জেঠতুতো দাদা,বৌদি আর ওদের দুই ছেলে,মেয়ে সব মিলে ছয়।
আদির বাবা মানে ইশার শ্বশুর মেজ।ওনারা মিলিয়ে চার জন আর ইশার খুড়োশ্বশুর ওনার বউ,আর দুই মেয়ে আর এক ছেলে মিলিয়ে পাঁচ।সবাই মিলে সকাল থেকে হইহই, রইরই কাণ্ড।কেউ অফিস যাবে, কেউ স্কুল কারুর আবার কলেজ,টিউশন।যৌথ হাঁড়িতে রান্না হচ্ছে নানা পদ।ছুটির দিনে টানা বারান্দায় বসে খাওয়া হচ্ছে একসাথে।আর সপ্তাহের দিনগুলোতে বাড়ির পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে গেলে দুপুরে খাওয়া সেরে শুরু হয় তিন শাশুড়ির মানে ইশার নিজের শাশুড়ি,জেঠিশাশুড়ি আর খুড়িশাশুড়ির আড্ডা।সেটা কখনো বা দক্ষিণের টানা বারান্দায় কখনো বা ছাদের মিঠে রোদে গা এলিয়ে ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে। আবার কখনো বা আচার বানানো।ইশার কপালে যে কি আছে কে জানে?এই বাড়ির বউরা কেউ চাকুরিরতা নয় তাদের নাহয় অমন গতে বাঁধা জীবন কাটাতে অসুবিধা নেই কিন্তু ওর যে আজ থেকে অফিস শুরু।বিয়ে,অষ্টমঙ্গলা সব মিলিয়ে যা ছুটি নিয়েছিল সব শেষ।নাহ!আর আরাম বিলাস করলে চলবেনা।এবার ইশাকে বিছানা ছাড়তেই হবে।বাপের বাড়িতে থাকতে না হয় মা সবটা গুছিয়ে রাখত জায়গামতো। ওকে কোনো দিকে ফিরেও তাকাতে হতনা। কিন্তু এখানে ওর কথা কে ভাববে?নিজেরটা নিজে ভাবা ছাড়া গতি নেই।অগত্যা উঠে পড়ে ও।
আদি ততক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি সেভ করছে।ওকে উঠতে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,”সুপ্রভাত।এতক্ষণে তাহলে ঘুম ভাঙ্গলো মহারানীর?আজ থেকে তো অফিস শুরু।চলো আজ আমি তোমাকে অফিসে ছেড়ে দেব তারপর নিজের অফিস যাব।নতুন বউয়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধটা যতক্ষণ পাওয়া যায় সেটাই আর কি…”
__”ছাড়ো তো ঢং করোনা কত যেন ভাব তুমি আমার কথা। আমি যাই স্নান সেরে নিই”,দিয়ে বলে স্লিপার পায়ের গলিয়ে ইশা বাথরুমে ঢোকে। ঝটপট স্নান সেরে নীল রঙের ময়ূরকণ্ঠী সালওয়ারটা গায়ে চাপিয়েছে ও এমনসময় দরজায় মৃদু টোকা,”ইশা ব্যস্ত না থাকলে একটু বাইরে আসবি মা?” এতো ওর শাশুড়ি সুধাময়ীর গলা।তাড়াতাড়ি বাইরে যেতেই ইশা দেখে হাতে একটা লাঞ্চবক্স নিয়ে মিটিমিটি হাসছেন ওর শাশুড়ি।
__”মা তুমি এখানে।কিছু দরকার?কিছু দরকার তো আমাকে বললেই পারতে আমি যেতাম।আর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভিতরে এসো”;ইশা বলে।
__”না তুই এতদিন পর আবার অফিস যাবি তাই তোকে আর ডাকিনি রান্নাঘরে। ভাবলাম এই টিফিনটা তোদের ঘরেই পৌঁছে দিই।লুচি আর সাদা আলুর তরকারি আছে খেয়ে নিস সময়মত।এতদিন তো এক মায়ের রান্না খেয়ে বড় হয়েছিস।দেখ আবার এই নতুন মায়ের হাতের বানানো টিফিন তোর পছন্দ হয় কিনা?ভালো না লাগলে কিন্তু জোর করে খাসনা।ক্যান্টিন থেকে কিনে খাবি খালি পেটে থাকবিনা…” সুধাময়ী বলতে থাকেন আপন ছন্দে।
ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়ে ইশার খুড়িশাশুড়ি বলেন,”হালকা ঠাণ্ডা পড়ছে ইশা,এই পশমিনার চাদরটা বেরোনোর আগে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিস।অফিস থেকে বেরিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিবি।” ওদের কথাগুলো শুনতে শুনতে খোলা জানলা দিয়ে আসতে থাকা নরম রোদের দিকে চেয়ে ইশা তখন ঈষৎ আনমনা।না বিয়ের পরিবারের রূপটা পাল্টে গেলেও নিজের লোকদের ভালোবাসার গন্ধটা বোধয় একইরকম থাকে।এদের জন্য না হয় আজ থেকে একটু অন্যরকম ভাবে বাঁচবে ও।
সমঝোতা মানে যে সবসময় হেরে যাওয়া নয়।জীবনের ক্যানভাসে ভালোবাসার জলছবি আঁকতে গেলে যে সংসারে একসাথে থাকা বাহ্যিক মানুষগুলোর মনের ভিতরে ছড়িয়ে থাকা রামধনু রঙগুলোকে বের করে নিয়ে আসা খুব দরকার।আইনি পরিভাষায় এটা শ্বশুরবাড়ি হলে কি হবে এই গুহঠাকুরতা বাড়িতে ইশা খুঁজে পেয়েছে ওর ভালো থাকার রসদ। আজ থেকে লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে মা,বাবার পাশাপাশি এই মানুষগুলোকে আর অন্য চোখে দেখবেনা ও।
__”কিরে কি ভাবছিস আমাদের কথা কি কানে যাচ্ছে তোর?টিফিনের ব্যবস্থা তো হল?তাই বলে খালি পেটে অফিস বেরোবি নাকি তুই? আমি একটু গরম ভাত,সিদ্ধ ডাল,আর পোস্তর বড়া ভেজে থালে বেড়ে দিয়েছি তুই জলদি খাবি আয় নইলে বড়া ঠাণ্ডা হয়ে যাবে…”;হুশ ফিরতেই ইশা দেখে ওর জেঠিশাশুড়ি ওকে ডাকতে এসেছেন সব কাজ ফেলে।
__”ভাবছি যে আজ অফিস থেকে ফিরে বাড়ির সব মেয়েরা মিলে একটা সিনেমা দেখতে গেলে কেমন হয়? রাতের খাওয়াটা বাইরেই সেরে নেব।আগামীকাল সপ্তাহের শেষ,বেশ মজা হবে কিন্তু।কি বল তোমরা?রাজি থাকলে বলো। আমি অনলাইন টিকিট কেটে নেব তাহলে”;ইশা বলে লাঞ্চবক্সটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে।
__”সেই বিয়ে হবার পরপর যা একটু বেরোতাম। তারপর যা হয় আর কি আস্তে আস্তে সংসারের চাপে বাঁধা পড়ে গেলাম এই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে। আমাদের না বলা কথাগুলো তোর মত করে আর কেউ ভাবেনি ইশা।বেরোলে মন্দ হয়না সকলে। জীবনের এই শেষবেলায় মুঠো মুঠো ছেলেবেলা,মেয়েবেলাকে খুঁজে নেব আরো একবার নতুন করে তোর হাত দিয়ে।তাই রাজি রাজি রাজি…”তিন শাশুড়ি মিলে সমস্বরে বলে ওঠেন।অদূরে কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসে সাম্প্রতিককালের জনপ্রিয় একটি বাংলা ছায়াছবির গান,”শেষবেলায় তুমি ভেসে আসা শঙ্খের সুর, শেষবেলায় তুমি নিয়ে চলো দূর বহুদূর”।।।