যোগিনী

যোগিনী

-হ্যালো
-আমি কি মিষ্টার অরণ্য রায়ের সাথে কথা বলছি?
-ইয়েস,স্পিকিং!
-চিনতে পারছিস?

-না,তবে আপনার সম্বোধন শুনে আন্দাজ করতে পারছি আমাদের পূর্ব পরিচয় আছে।
-আলবাত আছে! আরে আমি সমুদ্র রে এবার চেনা গেল?
-সমুদ্র!? হোয়াট আ প্লিসেন্ট সারপ্রাইজ! আছিস কোথায় এখন? কতদিন বাদে কথা হচ্ছে বল তো?
-আপাতত তোর শহরেই আছিরে, আর কথা?তা প্রায় বছর পাঁচেক বাদে হবে! শেষ বারে…
-আর বল? বাড়িতে সকলে ভালো?
-বাবা লাস্ট ইয়ার গত হয়েছেন।মা ওই আছেন কোনও রকম আয়াদের ওপর ভরসা করে..
-বেশ বেশ, আর তোরা?
-আমরা বলতে আমি দিব্য আছি! অফিস বাড়ি ক্লাব আর টুকটাক লেখালিখি নিয়ে…
-তোর কয়েকটা গল্প কবিতা পড়েছি! খাসা হাত! আর মহামায়ার খবর কি?
-হা হা! তোর মনে পড়ে অরণ্য মায়া কলেজে পড়তে প্রায়ই একটা কথা বলত,-“যতই চেষ্টা করিস না কেন আমায় এড়িয়ে যাবি এমন সাধ্য নেই তোদের..”।

-হুম।তা হঠাৎ সেকথা কেন?
-দেখ এতক্ষণ ধরে তুই চেষ্টা করে যাচ্ছিলি যাতে তোকে মহামায়ার নাম মুখে না আনতে হয় অথচ আমি নিজেই তোকে ওর খবর দিয়ে দিই..
-ডোন্ট টক রাবিশ সমুদ্র! মহামায়া তোর ওয়াইফ, ওর কথা তোকে জিজ্ঞেস করাটাই স্বাভাবিক তাই না!?
-কুল ডাউন ভাই! এতদিন বাদে কলেজের বন্ধুর সাথে কথা বলছি,একটু ইয়ার্কি করার লোভটা তাই..
-সমুদ্র এক কাজ কর,তুই আর মহামায়া একদিন আমার বাড়ি এসে ঘুরে যা..আমার ওয়াইফ নীলি তোদের দেখে খুব খুশি হবে…আমার মেয়েটাকেও দেখে যাস না হয়…

-হুম।তবে তো আসতেই হয় একদিন! তবে কিনা আমায় একাই আসতে হবে ভাই।
-কেন তোর ওয়াইফ বুঝি আজকাল গরীবের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
-হা হা হা হা হা হা! ওয়াইফ!
-হাসছিস যে!?
– আমার জীবনের মস্ত বড় ভূল কি জানিস!? আমি মহামায়া কে একটা সমাজস্বীকৃত বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছিলাম! ওই মেয়েকে যে বাঁধা যায়না তা বুঝিনি..তারচেয়ে তোর মত প্রেম-প্রেম খেললেই হয়তো…

-স্টপ ইট সমুদ্র!সাতসকালে ফোন করে আমায় ডেলিবারেটলি অপমান করার কোনও রাইট নেই তোর!
-সরি ভাই! উত্তেজিত হোস না শোন..
-আমি একটু ব্যস্ত আছি রে, সামনাসামনি কথা হবে একদিন কেমন?
-বেশ।তা মহামায়ার খবর না নিয়েই রেখে দিবি? তারপর শান্তিতে আজ সারাদিন কলেজে ক্লাস নিতে পারবি তো?
-কি শুরু করলি বল তো!? তোর আজ অফিস নেই?
-হা হা! অফিসে আজকাল আমি খুব কম যাই জানিস! ভাবছি লেখালিখি নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব..কি হবে ওসব চাকরি-বাকরি করে…

-তোর কি হয়েছে বল তো সমুদ্র!? ইস এভ্রিথিং অলরাইট?
-আমি দিব্য আছি রে অরণ্য! শুধু মহামায়া চলে যাবার পর থেকে কেমন যেন …
– মানে! কি বলছিস? কি হয়েছে মায়ার!?
-ভয় পাস না।তোর মায়া বেঁচেবর্তেই আছে,শুধু আমার কাছে নেই..
-তোর কাছে নেই মানে!? কি বলতে চাইছিস বলতো!?কোথায় গেছে মায়া?
-কোথায় গেছে জানিনা।

তবে আজ থেকে এই বছর দুই আগের এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠে আমি একটা চিরকুট পেয়েছিলাম।তাতে লেখা ছিল-“আমায় আর মনে করিস না, তোর কষ্ট বাড়বে..আমি চললাম। অথচ তার আগের রাতেও কি তীব্রভাবে আমরা মিলিত হয়েছিলাম তোকে বলে বোঝাতে পারবো না আমি।

-তুই মিসিং ডায়েরি করিস নি? খোঁজ করিস নি?,ও যা অভিমানী মেয়ে! হয়তো..
-বহুবার করেছি! এমনকি পেপারে বিজ্ঞাপন অব্ধি দিয়েছি..কোনও খোঁজ পাইনি।একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়ে যে হুট করে কোথায় হারিয়ে গেল…
-তোদের কি কোনও কারণে মনোমালিন্য হয়েছিল?
-তোর মনেহয় ওর মত মেয়ের সাথে কারও কখনও মনোমালিন্য হতে পারে? অত বড়লোকের মেয়ে বিয়ের পর আমার তখনকার দশহাজারির চাকরিতেও দিব্যি মানিয়ে সংসার গুছিয়ে নিয়েছিল…নিজেও একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াত..আমার মায়ের প্রায় নিজের মেয়ে হয়ে উঠেছিল জানিস!

-তারপর?এমন এবসার্ড ডিসিশন নিল কেন মায়া?
-বড় প্রেম পাগলি মেয়ে ছিল রে মহামায়া! সব কিছুতে প্রেম খুঁজতে চাইতো..সব সময় আদুরী বিড়ালির মত গায়ে ঘেঁষে থাকতে চাইতো..

-তোর মনে আছে সমুদ্র বর্ষার বৃষ্টি দেখলে, শরৎের কাশবন দেখলে কেমন পাগলামি করত মেয়েটা! মনে আছে রথের মেলায় গিয়ে কাচের চুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য জেদ করত?

-হা হা! সব মনে আছে! জানিস বিয়ের পরপর ও চাঁদের আলোয় ভাসাভাসি হয়ে আদর করতে চাইতো! কি সব্বোনেশে মেয়ে ভাব!

-সত্যিই!
-এমনই এক ভালোবাসাবাসির সময় মহামায়া রাগমোচনের পর্যায়ে -“অরণ্য, অরণ্য” বলে গুঙিয়ে উঠেছিল…
-সমুদ্র, ডোন্ট গেট মি রং.. আসলে ওই একবার কলেজে পড়ার সময়..
-আমি জানি অরণ্য।মহামায়া পরেরদিন সকালে এমনভাবে আমায় পুরো ঘটনাটা ইলাবোরেট করে বলেছিল যে হাজার চেষ্টা করেও আমি তোদের সেই প্রথম মিলিত হওয়াটাকে পাপ বলে ভাবতে পারিনি…ওই মুহুর্তে মহামায়া তোর কথায়, তোর দৃষ্টিতে প্রেম খুঁজে পেয়েছিল..ওর মনে হয়েছিল তোকে সব দেওয়া যায়..

-আ আসলে ওই কাঁচা বয়সে…ওই খানিক উন্মাদনা থেকে..
-সেই উন্মাদনা টাকেই প্রেম ভেবে বসেছিল পাগলিটা..
-তোদের সম্পর্ক টা কি সেজন্যই…মানে ঝগড়া অশান্তি কিছু..
-নারে,আমি তখন মহামায়া তে ডুবে! মনেমনে প্রতিদিন তোকে ধন্যবাদ দিতাম তখন জানিস! ভাগ্যিস তুই ওর হাতটা ওই সময়ে ছেড়েছিলি! নইলে আমার মত চাকচিক্যহীন একটা ছেলে কি মহামায়ার যোগ্য!?

-তোকে একটা কথা বলব? কনফেশন বলতে পারিস.. মহামায়ার সাথে আমার মাত্র একদিনের শারীরিক নৈকট্যের সম্পর্ক ছিল না..তারও বহুদিন আগে থেকেই.. আমার মনে হয়েছিল আমি ভালোবাসি ওকে কিন্তু ওর মতন প্রবল প্রেমিকার প্রেম বয়ে নিয়ে চলতে পারি এত ক্ষমতা আমার ছিল না..ভালোবেসে সকলে সব কিছু ত্যাগ করতে পারেনা রে..আমিও পারিনি, মহামায়ার তীব্র প্রেম, পজেসিসভনেসে আমার কেমন ভয় করত পরের দিকে, ওকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছিলাম… আর আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে একদিন হাসতে হাসতে মহামায়া বলেছিল -” আমায় এড়িয়ে চলা অত সহজ নয় রে..” এরপর থেকেই আমার দিক থেকে সম্পুর্ণ নিজেকে সরিয়ে নেয় ও..আর তোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরী হয় ওর..কলেজের একেবারে শেষদিক সেটা একদিন ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে দেখি তুই আর মহামায়া খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে..

-আর তাই কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় যা নয় তাই বলেছিলি আমায় মনে পড়ে তোর? সেই আমাদের শেষ মুখোমুখি কথা..

-সরি ভাই! আসলে তোদের ওভাবে দেখে খুব আঘাত পেয়েছিলাম..ওভাবে বলতে চাইনি আসলে মহামায়া যে এত তাড়াতাড়ি আমায় ভূলে..

-খুব ভালোবাসার কাঙাল ছিল কি না!পাগলি ছিল একটা…ওই সময়টা আমার জীবনের একমাত্র সোনালী অধ্যায়.. মরুভূমির ওপর বৃষ্টির জল পরলে যেভাবে মাটি তা শুষে নেয় ঠিক সেভাবে প্রতিমুহূর্তে আমি মায়ার প্রেমরস শুষে নিতাম..আমার মনে হত এত সুখও ঈশ্বর আমার কপালে লিখেছিলেন! শুধুমাত্র মায়াকে হারানোর ভয়ে কলেজ শেষ হতেই চাকরি নিলাম.. তারপর একদিন হঠাৎ বিয়েও করলাম সব দারুণ চলছিল জানিস..

-আমি তখন মাস্টার্স শেষ করে ডক্টোরেটের প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন খবর পেলাম তোরা বিয়ে করেছিস..ঈশ্বর কে বলেছিলাম যেন আর কখনও তোদের সাথে যোগাযোগ না হয় আমার..

-হা হা হা! সেই যোগাযোগ হয়েই গেল দেখ!আসলে সবই ঠিক ছিল জানিস, দিব্যি সসংসার চাকরি সব..তবে মানুষের মন তো,কত খাতে যে বয়! তাই প্রতিদিনের জীবন যাপনের গেঁড়াকলে মহামায়ার প্রতি আমার সেই পাহাড় সমান উঁচু টলটলে প্রেমও সময়ের সাথে কিছুটা থিতিয়ে পড়েছিল যেন.. ওই চোখে হারানো ব্যাপারটা কমে গেছিল অনেক..সাধারণ গড়পড়তা গৃহস্থের বোধহয় সেটাই নিয়ম, কিন্তু মহামায়া তো চিরকাল সব নিয়মের উর্ধে! তাই বিয়ের অতদিন বাদেও আমার হাত ধরে বৃষ্টি ভিজতে চাইতো,রাত জেগে গল্প করতে চাইতো আর আমার না চাওয়া বুঝতে পেরে কষ্ট পেত..আমি বুঝতে পারছিলাম ওপরে শান্ত ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে অশান্ত হয়ে উঠছিল ও! কিন্তু ওইসময়ে কেন যে সব বুঝেও ওকে আঁকড়ে ধরলাম না আমি! একদিন রাতে ও খুব যত্ন করে রাঁধল, আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম তারপর সারারাত ধরে ভালোবাসাবাসি হল..আর পরদিন সকালে একটা চিরকুট লিখে মহামায়া চলে গেল.. হয়তো ওই রাতটা আমাকে দেওয়া ওর শেষ উপহার ছিল! প্রেম প্রেম করে পাগল ছিল মেয়েটা, আমাদের দুজনের মধ্যে ওর প্রেমিক কে খুঁজতে চেয়েছিল..কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা দুজনেই ওর স্তাবকের বেশি কিছু হতে পারিনি..

-ঠিকই বলেছিস..ওই মেয়ের ভালোবাসার যোগ্য সবাই হতে পারেনা..আমরা তো ছিলামই না..

-দেখ হয়তো অন্য কোথাও আর কারো মধ্যে এখনও ওর প্রেমিককে খুঁজে চলেছে পাগলিটা!

-তা যা বলেছিস! পাগলিটা প্রেম প্রেম করে নিজেও মরল, আমাদেরও মারল..
-সত্যিই! মহামায়ার প্রেমিক হতে পারলাম না বলে আর কিছুই হওয়া হল না আমাদের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত