মা আমি গানের ক্লাসে যাচ্ছি। সিদ্ধভাত করে রেখে গেলাম, খেয়ে নিও।আর শোন―তুমি গুছিয়ে নিয়ে পুরো রেডি হয়ে বসে থাকবে। ষোল নাম্বারে নাম কিন্তু, আমি এসেই তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। আচ্ছা ঠিক আছে, যেন তুই আমার মা।আর আমি তোর মেয়ে। সে তুমি যাই বলো।তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে মা? তুমি বোঝনা সেটা ! নিয়মিত ডাক্তার না দেখালে , ডাক্তারের পরামর্শ মত না চললে তুমি যে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুই আমাকে বড্ডো ভালোবাসিস না রে !
কি যে বলো মা, তোমার মত মানুষকে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে ! আমি তো তোমাকে ভগবানের পরের জায়গাটা দিয়েছি । কে আমি ! কি আমার পরিচয় ! তুমি না থাকলে কোথায় ভেসে যেতাম আমি, আমার অস্তিত্ব থাকতো আজও ! নরখাদকদের দল কবেই আমার শরীরটাকে ছিড়ে থাক—থা—ক, ওসব পুরোনো কথা মনে করতে হবে না। আমি উকিল বাবুকে সোমবার সকালে ডেকেছি , বাড়িটা তোর নামে লিখে দেবো, তারপর তোর গানের স্কুল বাড়িতেই করবি। মা এখনই এসব কেন ! তাছাড়া দিদিভাই তোর অতসব ভাবতে হবে না, তাছাড়া তোর কি মনে হয় রিয়া বাধা দেবে। দিদিকে তুই চিনিস না! আমি দুজনকেই সমান ভাবে দেবো।
তুই যা তো, তোর কাজে যা। অপা চলে যেতেই পুরোনো কথাগুলো জাঁকিয়ে বসল সৌমির মনে। অপা― মানে অপরাজিতা নামকরণটা সৌমিই করেছিল পুটিকে দত্তক নেওয়ার সময়। সৌমি বলেছিল―সমস্ত পরাজয়কে হার মানিয়ে যে জিৎতে পারে সেই তো অপরাজিতা। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন সৌমি চাকরি করত,স্বামী বেঁচে ছিলেন, মেয়ে কলেজে পড়ছে।সব মিলিয়ে ব্যস্ত জীবন । সকালে এতোটাই ব্যস্ত থাকতে হতো যে মনে হতো নিশ্বাস নেবার সময় নেই। স্বামীর টিফিন, মেয়ের টিফিন, নিজেরটা তারপর সকালের খাবার রান্না। নিজের গোছানো আবার ওদের জিনিস পত্র খুঁজে পেতে সাহায্য করা। কাজের মাসি আছে তবে রান্নার দিকটা সম্পূর্ণ সৌমির হাতে। কর্তা পছন্দ করতেন না অন্যের রান্না। এক ব্যস্ততম সকালে মাংস এনে দেওয়ার কেউ নেই। স্বামীর অফিসে জরুরী মিটিং থাকায় সকালেই বেরিয়ে গেছেন , মেয়ে কোসিং-এ গেছে, কাজের মাসি অসুস্থ বলে আসতে পারেনি, তার ছোট মেয়েকে পাঠিয়েছে হাতে হাতে একটু সাহায্য করতে । সৌমি ওকে বলল ― এই মেয়ে পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে এক কিলো মাংস এনে দিতে পারবি ?
হ্যাঁ দিদিমনি খুব পারবো, বলে ই হাতের থেকে টাকাটা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেল। সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা থমথমে ছিলো। এক পশলা বৃষ্টি হয়েও গেল । মেয়েটার মাংস নিয়ে ফিরে আসতে দেরি দেখে অগত্যা সৌমিই রাস্তায় বেরোলো। কিন্তু মাংসের দোকানে গিয়ে শুনলো পুটি মাংস নিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে। দোকানদার বললো ― পুটি আপনার কথা বলতেই দোকানে ভীড় থাকা সত্ত্বেও ওকে ছেড়ে দিয়েছি ,আপনি ট্রেন ধরবেন বলে। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কয়েক পা এগোতেই লোকের চিৎকার চেঁচামেচি কানে এল।একজন বললো― আপনার বাড়িতে কাজ করে ওর মা।
কি হয়েছে ? আর হয়েছে , বৃষ্টির মধ্যে বোধহয় ঐ পরিত্যক্ত গোডাউনে আশ্রয় নিয়েছিল মেয়েটা। ভিড় ঠেলে দেখতে গিয়েই সৌমির চোখ কপালে উঠল। চারিদিকে মাংসের ছড়াছড়ি তার মাঝখানে নয় বছরের একরত্তি মেয়েটা যেন এক টুকরো মাংসের দলা। ক্ষত বিক্ষত উলঙ্গ দেহটা রক্তে ভেষে যাচ্ছে। নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে ওকে জড়িয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে একটা গাড়ির খোঁজ করতে লাগলো সৌমি। পাশের লোকজন এবার আহা করা ছেড়ে সৌমিকে বলতে শুরু করল ― কি করছেন দিদি ? এসব পুলিশি কেস । ফালতু ঝামেলায় জড়াবেন না ভদ্রলোক হয়ে।
আপনারা তো কিছু করবেন না।অন্তত আমাকে কিছু করতে দিন, প্রথম কাজ হলো মেয়েটাকে বাঁচানো। ওসব পুলিশি ঝামেলা আমি বুঝে নেবো আপনাদের ভাবতে হবে না। তারপর যমে-মানুষে টানাটানি চললো বহু দিন। তার উপরে ঐ মিডিয়া, পুলিশ কেউ তো কিছু করবে না বরং অবান্তর , অশালীন কিছু প্রশ্নের তীর বিদ্ধ করা। কি করেছিল ? কি বলেছিল ছেলেগুলো ? একজ্যাকলি কি ঘটেছিল ? কোথায় হাত দিয়েছিল ? সৌমি আর সহ্য করতে পারেনি, প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিল― ছিঃ আপনারা মানুষ , একটা বাচ্চা মেয়েকে এই কুৎসিত প্রশ্ন করতে আপনাদের লজ্জা করে না । পারলে দোষীদের ধরে শাস্তি দিন। এই যে প্রতিদিন গাদা গাদা টাকা খরচ হচ্ছে, পারলে ঐ অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ান। সেটা তো কেউ করবেন না, তবে কেন এই নোংরা বিষয়টি হাইলাইট করে মজা লুটছেন। সবাই মিলে এবার সৌমিকে ঘিরে ধরল― ও আপনি তো সেই মহিলা যে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন।ওদের পাশে দাঁড়িয়েছেন । রাইট। তো আপনার পরিচয় ? আমি মানুষ। সরুন আপনারা, ভীড় বাড়াবেননা আপনারা এবার আসুন প্লিজ।
তারপর ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ হয়ে উঠল পুটি, ডাক্তার জানালো দুই এক দিনের মধ্যে ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়, পুটির মা কেঁদে বললো― ও মরে গেল না কেন দিদিমনি। এ তুমি কি বলছ পুটির মা ! ঠিকই বলছি দিদিমনি, ওকে নিয়ে আমি কি করব ! না পারবো ওকে কোনদিন বিয়ে দিতে, ও তো ঘর থেকেই বের হতে পারবে না। কোনো বাড়িতে ঐ অশৌচ মেয়েকে কাজে নেবে না ।অথচ ও নষ্ট হয়ে গেছে বলে আরো শেয়াল শকুনে ওকে ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করবে। আমি কতদিন কতো সময় ওকে আগলে রাখবো বলুন।
সৌমি বললো চিন্তা করোনা আমি দেখছি। সৌমি তার স্বামীকে ব্যাপারটা জানালো।তার স্বামী কখনও সৌমির ইচ্ছার অমর্যাদা করেন নি, তিনি জানতেন সৌমি যেটা করবে সেটা মানুষের ভালোর জন্যই করবে। তাই তিনি বলেছিলেন তোমার মন যা চায় তাই করবে। মেয়ের কাছেও জিঞ্জাসা করেছিল সৌমি, মেয়েও মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত , মায়ের চাওয়াকে সমর্থন করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি।বরং মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ―আমি গর্বিত যে তুমি আমার মা। কিন্তু বাঁধ সেধেছিল আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী। তারা বলেছিল―একে তো ছোট জাত, ভিনধর্মী,তারপর আবার ধর্ষিতা নষ্ট মেয়েকে তুমি দত্তক নেবে !
হ্যাঁ নেবো, আমি জাত মানিনা, ধর্ম মানিনা জানোতো। আমি জাতি বলতে একটাই জাতি বুঝি সে হলো মানুষ জাতি।ধর্ম বলতে একটাই ধর্ম বুঝি মনুষ্যত্ব। আর নষ্ট মেয়ে,ওর তো কোনো দোষ নেই এতে।আমি ঘৃণা করি তাদের যারা ওকে নষ্ট করেছে,ওকে নয়। আমি ওকে দত্তক নেবো, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবো।পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাচার যোগ্য করে তুলবো ওকে । হাসপাতালে ছুটি দিলে সোজা আমার এখানে নিয়ে আসবো। ও হবে আমার অপরাজিতা।