” বিয়ের চতুর্থ দিনের মাথায় যখন শাশুড়িমা ছাঁদ থেকে পড়ে দেহত্যাগ করলেন, আমার সেই পুরনো অসুখটা আবার ফিরে এলো। কি ভয়ঙ্কর সে যন্ত্রণা! মনে হয় যেন সর্বক্ষণ কেউ জলন্ত আগুনের শিক, আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর সেই তাপে এখনই মগজ থেকে সাদা সাদা ঘিলু উপচে পড়বে।
কিন্তু কি আশ্চর্য! এভাবে কিছুক্ষণ যাবার পরই কেউ একজন এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর সাথে সাথেই আমার সব যন্ত্রণা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। হালকা একটা মিষ্টি গন্ধে আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। এরপর আর কিছুই মনে থাকে না আমার। যখন জ্ঞান ফেরে, দেখতে পাই আমি ছাদে শুয়ে আছি। ব্যাপারটা যে এক দুদিন ঘটে তা কিন্তু নয়। টানা তিনমাস রোজ আমার সাথে ঘটনাটা ঘটে। এতোদিনে সেই মানুষটাকেও আমি চিনতে পেরেছি। তিনি হলেন আমার শাশুড়িমা। তার সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে এখন। রোজ তিনি আসার সময় আমার জন্য তাজা বকুল নিয়ে আসেন। সেই তাজা বকুলের গন্ধে আমার কেমন ঘোর লেগে যায়। যেমন এখন লাগছে। নিশ্চয়ই এখন তিনি আমার আশেপাশেই আছেন। ” এতটুকু লিখেই অরু তার নীল মলাটের ডায়েরিটা বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখে। এরপর তার শাশুড়ির ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘক্ষণ গল্প চলে তাদের মধ্যে। এইতো সেদিন অরুকে তিনি বললেন,
– বৌমা, তুমি যে আমায় ছাঁদ থেকে ফেলে দিলে।আমি কিন্তু কিচ্ছু মনে করি নি। অবাক হয়ে অরু বললো,
– কি বলছেন মা! আমি আপনাকে ফেলে দিয়েছি?
– হ্যাঁ বৌমা। তোমার মনে নেই?
– না তো মা।
– এসব কথা মনে না থাকাই ভালো।
তারপরও তোমাকে ঘটনাটা বলি শোনো। আসিফ তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করে আনলেও পুত্রবধূ হিসেবে কিছুতেই তোমাকে মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে, সেটা তুমিও জানো। তোমাদের পরিবারে দোষ আছে।
তোমার বড় বোনের সাথে যার বিয়ে ঠিক হলো, পাকা কথা হওয়ার দুইদিনের দিন ছেলেটা আত্মহত্যা করলো। আর এক সপ্তাহ পর তোমার বোন। এসব কথা জানার পর আমি খুব ঘাবড়ে যাই। বাপ মরা ছেলেটাই যে আমার সব। তাই সেদিন রাতে, তোমাকে ছাঁদ থেকে ফেলে আমাদের জীবন থেকে তাড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হওয়ার এক পর্যায়ে, হঠাৎ তুমিই আমাকে রাগের মাথায় ধাক্কা দিয়ে ছাঁদ থেকে ফেলে দিলে। সাদা টাইলসে পরে যখন আমার মাথাটা থেঁতলে গেলো, কি ভীষণ যন্ত্রণা যে হচ্ছিল! তখনই ভেবেছিলাম মরার পর তোমাকে খুব জ্বালাবো। কিন্তু পরে যখন ভাবলাম মারতে তো তোমাকে আমি চেয়েছিলাম! এরপর থেকেই তোমার ওপর কেমন মায়া পরে গেলো। গোটা গোটা চোখ করে অরু বললো,
– কী ভয়ানক কান্ড! অথচ আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আচ্ছা মা, আপনার কি বাবার সাথে দেখা হয়? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
– নারে মা। সে তো আর অপঘাতে মারা যায় নি! তবে তোমার বোনের সাথে দেখা হয়। খুব দুঃখ মেয়েটার জানো তো, সবসময় শুধু কাঁদে। অরু আবারও কিছু বলবে এমন সময় তার শাশুড়িমা বললেন,
– আসিফ এসেছে বৌমা। কথাটা বলেই তিনি একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। অরু দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।
– কতক্ষণ ধরে কলিংবেলটা চাপছি অরু। ছিলে কোথায় তুমি? মুখটা ফেঁকাসে করে অরু বললো,
– একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম।
আর কথা না বাড়িয়ে আসিফ নিজের রুমে চলে যায়। ইদানিং সে অরুনিমার ওপর খুবই বিরক্ত। বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ স্ত্রী হিসেবে কোনো দায়িত্বই সে পালন করে না। বিয়ের এক মাসের মাথায় আসিফ নিজেই তাদের খাট আলাদা করে দিলো অরুর ইচ্ছায়। ঘরের কাজের জন্যও লোক রাখলো। কিন্তু কোনো কাজের লোকই বেশিদিন থাকে না। দুদিনের মাথায়ই নানান অজুহাতে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। আসিফ ব্যপারটাকে এতোদিন গুরুত্ব না দিলেও আজ তাকে বিষয়টা ভাবাচ্ছে। অরুনিমার মাঝে কিছু তো অস্বাভাবিকতা আছে যা সে ধরতে পারছে না। কিন্তু কি সেটা? এসব ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো সে। চুলোয় ভাত আর আলুসিদ্ধ বসিয়ে গুনগুন একটা আওয়াজে থমকে দাঁড়ায় আসিফ। আওয়াজটা অরুর ঘর থেকে আসছে। মৃদু পায়ে ঘরের কাছে গিয়ে সে দেখলো, কুন্ডলী পাকিয়ে অরু শুয়ে আছে আর কিছু একটা বলে গুনগুন করছে। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে! আসিফের চোখে পানি চলে এলো। চোখটা মুছে সামনে তাকাতেই দেখে অরু বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। ছুটে গিয়ে অরুকে বুকে জড়িয়ে নিল সে। কাঁদতে কাঁদতে অরু বললো,
– তোমাকে খুব কষ্ট দেই আমি, তাইনা?
– না অরু। এভাবে কেন বলছো?
কথাটা বলে আসিফ আরও শক্ত করে অরুকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে অরু ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে নাস্তা রেডি করে অফিসের জন্য বেরিয়ে পরলো আসিফ। অরু তখনও ঘুমোচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই সে বালিশের নিচে হাত দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সেখানে তার ডায়েরিটা নেই! তন্নতন্ন করে সারা বাড়ি খুঁজেও ডায়েরিটা কোথাও পাওয়া গেল না। দুপুরের দিকে তীব্র একটা বকুলের ঘ্রাণ অরুকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করছে এমন সময় আসিফ বাসায় ফিরলো। রুমে ঢুকেই সে অবাক হয়ে যায়! পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। এক মুহূর্তও দেরি না করে দৌড়ে সে অরুর রুমে যায়। সেখানেও একই অবস্থা। পুরো ঘর এলোমেলো আর অরু মেঝেতে পরে আছে। জলদি অরুকে বিছানায় তুলে চোখেমুখে পানির ছিটা দেয় আসিফ। একটা সময় অরুর জ্ঞান ফিরলে তার কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করায় কোনো উত্তর দিতে পারে না সে। আসিফও তাকে আর জোর করলো না। সেদিন রাতে আসিফ অরুর রুমেই সোফাতে ঘুমিয়ে পরে। মাঝরাতে হটাৎ তীব্র বকুলের গন্ধে অরুর ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকারের মাঝেই সে উঠে তার শাশুড়িমার ঘরে যায়।
– মা আপনি এসেছেন? নীল ডায়েরিটা হাতে নিয়ে তার শাশুড়িমা বললেন,
– হ্যাঁ বৌমা। দেখো তোমার জন্য কি এনেছি! অরু অবাক হয়ে ডায়েরিটা নিয়ে বললো,
– এটা আপনি কোথায় পেলেন মা?
– আসিফের ব্যাগে পেয়েছি। ও তোমার বালিশের নিচ থেকে লুকিয়ে নিয়েছিল পড়ার জন্য। পড়লে কি সর্বনাশ হতো বুঝতে পারছো? এই বলে মেহেরজান বেগম বেশ রেগে যায়। অরু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
– এমন ভুল আর কখনও হবে না মা। এই বলে তার সামনেই ডায়রির সবগুলো পাতা ছিঁড়ে ফেলে। এভাবেই দুজন সারা রাত গল্প করে। শেষ রাতের দিকে চলে যাওয়ার সময় মেহেরজান বেগম বৌমাকে বললেন,
– এই জগতে আমার আর একা একদম ভালো লাগে না বৌমা। এরপর যেবার আসবো, তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যাবো। কেমন?
এতোদিন মনে মনে এটা চাইলেও আজ অরু ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে আসিফকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে সে। জিজ্ঞেস করলে এবারও কিছুই বলে না অরু। কিন্তু এরপর থেকে আসিফ লক্ষ্য করলো অরুর মাঝে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সবসময় কেমন চুপচাপ হয়ে থাকে সে আর মাঝেমধ্যে ” যাও, চলে যাও ” বলে চিৎকার করে ওঠে।
অনেক ডাক্তার দেখাানো হলেও অরুর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। ধীরে ধীরে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকায় সবার পরামর্শে আসিফ তাকে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসে। এখন রোজ আসিফ নিয়ম করে দুবেলা অরুকে দেখতে যায়। কেমন উষ্কখুষ্ক চুলে আনমনা হয়ে মেয়েটা বসে থাকে। প্রথম প্রথম দু-একটা কথা বললেও এখন কেবল তার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।