গোসলটা সেরে খড়ের গাদার সামনে দাঁড়ালো রহিমা। একটা ছেঁড়া গামছা দিয়ে চুল ঝাড়তে শুরু করলো। তার বয়স খুব একটা বেশি নয়। এই পঁচিশে পড়লো। তবে মনটা খুব চঞ্চল এখনো। কম বয়সে বিয়ে, তারপর মা হয়ে যাওয়াতে সেই চঞ্চলতাটা প্রায় মরিমরি করছে এখন। সুযোগ পেলেই সেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ঘরের বাইরে আসলো ফারুক। তার লুঙ্গিটা কায়দা করে কাছা মারা। বাইরে এসেই দেখলো বউ শরীর বাঁকিয়ে গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ছে। তার হালকা মেদওয়ালা ফর্সা পেট দেখা যাচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফারুক। তারপর আবার কয়েক সেকেন্ড পরেই কী যেন ভেবে অনুচ্চস্বরে চীৎকার করে উঠলো সে, “পেট ঢাইকা চুল ঝাড় মাগী! কতবার কইছি এইকথা, মনে থাকেনা?”
চীৎকারটা আস্তে দিতে চাইলেও চীৎকার দেয়ার সময় গলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ফারুক। যারফলে চীৎকারটা বেশ জোরে হয়ে গেলো। চমকে উঠে ফারুকের দিকে তাকালো রহিমা। চুল ঝাড়তে গেলে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। বেগুনী রঙের শাড়িটা টেনে দ্রুতহাতে কোমরেরর একপাশে গুঁজে ঘরের দিকে এগুতে এগুতে ফারুকের কথার জবাব দেয় রহিমা, “সক্কাল সক্কাল কী শুরু করলেন? আম্মা ঘুমাইতাছে শুনবো তো। আর আপনে এখনো গোসল করেন নাই ক্যান? লুঙ্গিতে দাগ দেখা যাইতেছে।” দ্রুতপায়ে ছনের ঘরটায় ঢুকে গেলো রহিমা। ওটা মুরগীর খোঁয়ার। মুরগীগুলোকে খোঁয়ার থেকে বের করতে যাচ্ছে ও। ফারুক কিছুটা লজ্জা পেয়েছে বউয়ের কথায়। আঙুলে আরেকটু কয়লা লাগিয়ে সেটা দাঁতে ঘষতে ঘষতে পুকুরের দিকে চলে গেলো সে। “আমার ওজুর পানি কই?”
রহিমা রান্নাঘরে রান্না করছিলো। শ্বাশুড়ির গলা শুনে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে মুখ বের করে বললো, “পানি আপনের চৌকির নিচে ঘটিতে রাখছি দেখেন।” “পানিতো ঠান্ডা। এই পানি দিয়া ওজু করুম ক্যামনে? আমারে এই শীতেই মাইরা ফেলবা নাকি?” “আমিতো গরম পানিই দিছিলাম। পানি দেয়ার সময়েই কইছিলাম তাড়াতাড়ি ওজু কইরা নিতে। আপনে দেরি করছেন বইলাই তো পানি ঠান্ডা হইছে।” কথাটা বলতে গিয়েও বললোনা রহিমা। জানে ঘুরেফিরে শেষ দোষটা তারই হবে। তাই কিছু বলেও লাভ নেই। চুলার ভেতর লাকড়ি ঠেলে দিয়ে আগুনটা একটু উসকে মুখটা কালো করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ও। “আপনে একটু খাড়ান। আমি পানি আবার গরম কইরা দিতেছি।” বলে ঘটিটা নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে আসে শ্বাশুড়ির রুম থেকে। দাঁড়িয়ে থাকলে আরো কয়েক দফা কথা শুনতে হবে তার।
রান্নাবান্না শেষে পাতিলগুলো লুচনি দিয়ে একবার মুছে নিলো রহিমা। রান্না করার আগেও একবার মুছেছিলো। কিন্তু এখন আবার না মুছলে কালি লেগে থাকবে। এমন সময় বাইরে কারো শশব্দ চীৎকার শুনলো সে। কলিম মক্তব থেকে ফিরে এসেছে। কলিম তাদের একমাত্র ছেলে। পুরো নাম মোহাম্মদ কলিম উদ্দিন। বয়স ছয় বছর। ফারুক সবসময় ছেলেকে পুরো নাম ধরে ডাকে। একমাত্র ছেলে হওয়াতে সবার খুব আদরের কলিম। সরকারী প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে সে। আর মক্তবে কায়দা পড়তো, কিছুদিন আগে হুজুর তাকে ছিপারা দিয়েছে। চার পাঁচ প্যাকেট নাবিস্কু দিয়ে সেদিন মিলাদ পড়িয়েছিলো ফারুক। কলিম ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো। মক্তবেও, স্কুলেও। “আম্মা ভাত দেও।” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে কলিম। ঢুকেই দাদীর রুমে যায়। ওটা তারও রুম। হাতের ছিপারা আর রেহালটা রাখে তার ছোট টেবিলটার উপর। দাদী তখন নিচু স্বরে তসবিহ জপছে। সেটা থামিয়ে কলিমের দিকে হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন, “মক্তবে আজ কী পড়াইলো রে কলিম? সব পারসোস তো?”
“হ পারুমনা আবার! গতকাইল হুজুরে সূরা ফিল বানান কইরা পইড়া যাওয়ার জন্য কইছিলো। আমি ছাড়া কেউই পুরাটা ঠিকমত কইতে পারেনাই। সবারই একটু একটু ভুল হইছে।” কথাটা সগর্বে বললো কলিম। তারপর প্রশংসা পাওয়ার জন্য হাসিমুখে তাকালো দাদীর দিকে, “তুই পারবিনা তো পারবো কেডা? তোর বাপেও ছোটবেলায় এমন আছিল। তোর দাদার মুখেও শুনছিলাম উনিও নাকি কোনোদিন মক্তবের পড়া না শিখে যান নি। তুইতো ওদেরই বংশধর।” বলতে বলতে সস্নেহে কলিমের মাথায় হাত রাখলেন দাদী। মনমতো প্রশংসা পেয়ে একেবারে বিগলিত হয়ে গেলো কলিম। দাদীকে জড়িয়ে ধরলো।
মাটিতে একটা চাটাই বিছিয়ে ফারুক খেতে বসেছে। কলিমও এসে বসলো ফারুকের পাশে। ফারুকের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। গোসল করার পর তার মনে পড়েছে গরুগুলোকে ধোয়ানো হয়নি। গোসলের আগে মনে পড়লে গরুগুলো ধুয়ে গোসলটা সেরে নিতে পারতো। পরে মনে পড়ায় গোসল করে গরু ধুতে গিয়ে আবার ভিজেছে ও। খেয়ে আবার যেতে হবে মাঠে। এখন বোরো ধান রোপণ করার সময়। ট্রাক্টর দিয়ে হাল বাওয়ার কথা আজ। হাল দেয়ার সময় ও পাশে দাঁড়িয়ে না থাকলে ঠিকমত হাল দেবেনা ট্রাক্টরওয়ালা।
শীতের দিনে এতোকিছু সহ্য হয়? ভাত দিতে দেরী হচ্ছে দেখে বউয়ের উপর খেঁকিয়ে উঠলো সে, “তোর ভাত দিতে এত সময় লাগে ক্যান? এতক্ষণ ধইরা বইসা আছি চোখে পড়েনা তোর?” রাগটা বউয়ের উপরই ঝাড়ছে ও। “দিতেছি তো। আপনে আম্মারে ডাক দেন।” ফারুকের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় রহিমা। “আম্মারে তুই ডাকতে পারোসনা?” “থাক থাক আমারে আর ডাইকা লাভ কী? কয়দিন পরে তো এমনেই মইরা যামু। যদি এখনই না খাওয়াইয়া মাইরা ফেলতে পারোস, তাইলেই তো তোদের ভালো হয়!” কাঠের জলচৌকিটাতে বসতে বসতে বললেন কলিমের দাদী রুপচাঁন বানু। জন্মের সময় উনি খুব সুন্দর দেখতে হয়েছিলেন, তাই উনার এই নাম রাখা হয়। এখনো উনাকে দেখে উনার যুবতীকালের সৌন্দর্য কিছুটা আন্দাজ করা যায়। মাকে দেখে একটু দূরে সরে গেলো ফারুক। মাকে বেশ ভয় পায় ও।
সবার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, এমন সময় “আর দুগ্গা ভাত দে” বলে থালাটা রহিমার দিকে এগিয়ে দিলো ফারুক। রহিমা থালাটা হাতে নিয়ে ভাতের হাঁড়ির ঢাকনাটা খুলে দেখলো আর দুমুঠ ভাত পড়ে আছে হাঁড়িতে। রহিমা এখনো খায়নি। শূন্য দৃষ্টিতে হাঁড়ির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো ও। ভাত নেই বললে ফারুক আর শ্বাশুড়ি দুজনেই ক্ষেপে যাবে কোনো সন্দেহ নেই। অতিকষ্টে দীর্ঘশ্বাসটা চেপে ভাতগুলো ফারুকের থালায় তুলে দিলো। হাঁড়িতে যে আর ভাত নেই সেটা কেউ বুঝতে পারলোনা।
ফারুক মাঠে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে দুপুরের ভাতটা যেন কলিমকে দিয়ে মাঠে পাঠিয়ে দেয়। কলিম এখন স্কুলে। দুপুরের আগেই ফিরে আসবে অবশ্য। কলিমের দাদী নিজের রুমে ঘুমাচ্ছেন। রহিমা কাঁথা সেলাই করতে বসেছে। সকালে ভাত ছিলোনা তাই ঘরে রাখা কয়টা মুড়ি খেয়ে পানি খেয়ে নিয়েছে ও। যদিও সেটাতে পেট একটুও ভরেনি। তার প্রমাণ হচ্ছে পেটে হালকা ব্যথা হচ্ছে এখন। এই ব্যথার সঙ্গে পরিচিত রহিমা। পেটে খিদে থাকলে এরকম ব্যথা হয়। তবে ভাগ্য ভালো, এমন সময় পাশের ঘরের বদরুদ্দিনের বউ হাফসা আসলো গল্প করতে। ওরসাথে কথা বলতে বলতে পেটব্যথাটা মোটামোটি ভুলে গেলো ও।
কলিম স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। এসেই মায়ের কাছে স্কুলে কী কী হয়েছে সব সবিস্তারে বর্ণনা করতে শুরু করলো। ও আর দুতিনজন ছাড়া ক্লাসের সবাই স্যারের বেত খেয়েছে সেগুলো বেশ সগর্বে বললো ও। বলতে বলতেই মায়ের কাছে ভাত চাইলো। রহিমার রান্না করাই ছিলো। ছেলেকে খাইয়ে একটা বলের মধ্যে ফারুকের জন্য ভাত প্রস্তুত করলো তাড়াতাড়ি। খাওয়ার পর কলিম সেটা নিয়ে মাঠে চলে গেলো। রহিমা শ্বাশুড়িকে ডাকতে গেলো খাওয়ার জন্য।
বেলা পড়ে এসেছে। দুপুরে ঠিকমত খেয়ে সুস্থবোধ করছে রহিমা। কলিম মাঠে গেছে খেলতে। ফারুক এখনো ফেরেনি। কলিমের কাছে বলে দিয়েছে তার ফিরতে রাত হবে। অনেক কাজ নাকি পড়ে আছে মাঠে। রহিমা মুরগীগুলো খুঁজতে শুরু করে। অন্ধকার হওয়ার আগেই সেগুলোকে খোঁয়ারে না ঢুকালে রাতে আর খুঁজে নাও পেতে পারে। পরে সকালে উঠে দেখা যাবে শেয়ালে মুরগী সব ধরে নিয়ে গেছে। এরমধ্যে কলিমও এসে গেছে মাঠ থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতেই মাকে মুরগী খোঁজায় সাহায্য করলো ছেলেটা।
শ্বাশুড়িকে মাগরীবের নামাজের ওজুর জন্য গরম পানি করে দিয়ে রান্না বসালো রহিমা। তার নামাজ পড়া হয়নি। একবার ভেবেছিলো নামাজটা পড়ে নেয়। তারপর আবার ভাবলো এরমধ্যে যদি ফারুক এসে পড়ে, আর এসে দেখে ভাত হয়নি, তখন কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ফেলবে। নামাজ পরে ক্বাজা পড়ে নেবে এই ভেবে চুলায় আগুন ধরালো। লাকড়ির চুলা তাই প্রচুর ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কাশতে শুরু করলো ও। ওদিকে কলিম গুনগুন করে পড়ছে। তার পড়ার খুব একটা শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। কাশতে কাশতেই ছেলেকে জোরে জোরে পড়ার তাগাদা দেয় রহিমা। কলিম জোরে পড়ছে এটা নিশ্চিত হয়ে বটি দিয়ে পেঁয়াজ কাটতে শুরু করলো ও। হঠাৎ ‘উফ’ বলে আঙুলটা চেপে ধরলো রহিমা। দ্রুত পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি অনেকটাই কেটে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে আঙুল থেকে।
কাটা আঙুল নিয়েই কোনোরকমে রান্নাটা শেষ করলো রহিমা। হাত প্রচন্ড জ্বলছিলো, কিন্তু কিছু করার নেই। তাড়াতাড়ি করে রান্না শেষ করেছে যাতে ফারুক এসে সবকিছু প্রস্তুত পায়। রান্না শেষে বারবার চেখে দেখেছে লবণ মরিচ সব ঠিক আছে কীনা। দ্রুত রান্না করায় হয়তো একটু এদিক সেদিক হবে ভেবেছিলো ও। কিন্তু এমন কিছু হয়নি। মশলাপাতি সব ঠিকই আছে দেখে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হলো।
ফারুক ফিরলো রাত প্রায় নয়টার দিকে। মাঠের কাজ সব শেষ করে বাজারে গিয়েছিলো ও। গিয়ে বাজারপাতি করে ফেরার সময় পরিচিত একদল লোক জুটে যায় ওরসাথে। তাদের সাথে আড্ডা আর চা খেতে খেতে দেরী হয়ে গেছে। ফারুকের শব্দ শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে রহিমা। দেরী কেন করেছে এটা জানতে চাইতে গিয়েও ফারুক রেগে যেতে পারে এই ভয়ে থেমে গেলো ও। বাজারপাতি সব হাতে নিতে নিতে ফারুককে গোসল করতে বলে ভেতরে চলে গেলো। ফারুক অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই রাতের বেলা গোসল করতে গেলো। তার নিজেরও শরীর কুটকুট করছিলো, গোসল না করলে ঘুমাতে পারবেনা।
গোসল সেরে শরীরে সরিষার তেল দিয়ে খেতে বসলো ফারুক। সবাই ওরজন্য অপেক্ষা করছিলো। খেতে খেতে কলিম বাবার কাছে সারাদিন কী কী করেছে সবকিছুর একটা ফিরিস্তি দিলো। স্কুলে যে সে আর কয়েকজন বাদে সবাই স্যারের বেত খেয়েছে সেটা খুব গুছিয়ে বললো সে। ফারুক মন দিয়ে ছেলের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ খেয়াল করলো রহিমা নিজের পাতের ভাত নাড়াচাড়া করছে শুধু, খাচ্ছেনা কিছু।
“কীরে ভাত খাসনা ক্যান?” চড়া গলায় জানতে চাইলো ফারুক। রহিমা কাটা হাত দিয়ে খেতে পারছেনা। সেটা বলবে কীনা ইতস্তত করছে ও। মুখটা শুকিয়ে গেছে ওর। “কীরে তোর কানে কথা যায়না নাকি? কী জিগাইলাম, খাসনা ক্যান?” আগের চেয়ে আরো চড়া গলার বললো ফারুক। “পেঁয়াজ কাটতে গিয়া আঙুল কাইটা ফালাইছি। এখন জ্বলতেছে তাই খাইতে পারতেছিনা।” ধরা গলায় কৈফিয়ত দিলো রহিমা। কাটা আঙুল এমনিই জ্বলছিলো, এখন আবার ফারুকের ধমক খেয়ে অনেকটাই দিশা হারিয়ে ফেললো ও। অনেক কষ্টে কান্না থামাচ্ছে।
“তুই তো আঙুল কাটবিই। একটা কাজ ঠিকমতন করতে পারোসনা, আবার নানান আকাম ঘটায়া বইসা থাকোস। এখন আঙুল কাটসোস, পরেরবার হাত কাটবি। আর সব ঝামেলা আইসা চাপবো আমার ঘাড়ে। তোর চিন্তার কী?” তিরিক্ষি গলায় ঝাঁঝের সাথে কথাগুলো বললো ফারুক। রাগের চোটে দ্রুত হাত চালাচ্ছে ভাতের থালায়, যারফলে কিছু ভাত পড়ে যাচ্ছে থালা থেকে। এতক্ষণ ধরে সব দেখছিলেন রুপচাঁন বানু। কোনো কথা বলেননি। ছেলের ব্যবহার দেখে আর থাকতে পারলেন না তিনি। গলায় সর্বোচ্চ আওয়াজ তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই বউমারে আরেকটা কথা বলবি তো থাবড়ায়া সব দাঁত ফালাই দিমু বদমাইশ। খালি তুই’ই আমার পোলা নাকি? বউমাও তো আমার মাইয়া। ওরে কিছু কওয়ার লাগলে আমি কমু, বকতে হইলে আমি বকমু, তুই কে রে? কাটা আঙুল নিয়া মাইয়্যাডা রান্না করলো, আর তুই কীনা ওরে বকতেসোস। তোর সাত জনমের ভাগ্য যে এইরকম একটা মাইয়ারে তুই পাইসোস। ওর বাপটা নেহাত গরীব না হইলে তোরমত পোলার দিকে চোখ তুইলাও তাকাইতো না। সারাটাদিন তুই ওরসাথে খিটখিট করোস, দেখি আমি। আবার খালি দেখি এমন করতে। বয়স বাড়ছে তো কী, তোরে থাবড়ানোর মত হাত আমার এখনো আছে।”
মায়ের বকা খেয়ে একেবারে মিইয়ে গেলো ফারুক। মাকে খুব সমীহ করে চলে সে। চুপ করে খেতে শুরু করলো আবার। ভাতের লোকমা মুখে দিতে গিয়ে দেখলো তার মা রহিমার মুখে নিজের হাতে ভাত তুলে দিচ্ছে। রহিমা মুখটা আরেকপাশে সরিয়ে কান্না লুকাচ্ছে। অবাক হয় ফারুক। এই নারীজাতিকে কখনোই বুঝতে পারবেনা সে। তারা সকালে এক, তো বিকালে আরেক। থাক, ও এসব বুঝতেও চায়না। এমনিতেই তার মা আর বউয়ের এসব দৃশ্য দেখে তার নিজের চোখও আর্দ্র হতে শুরু করেছে। সেটা থামাতে দ্রুত ভাত গিলতে শুরু করলো।
রাত অনেক হয়েছে। কলিম আজ বাবা মায়ের রুমে পড়তে বসেছিলো। একটু আগে বইখাতা গুটিয়ে তার দাদীর কাছে ঘুমাতে চলে গেছে। হারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিলো রহিমা। আস্তে আস্তে চুলের বিনুনি খুলতে শুরু করলো। ওর ঘনকালো লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারপাশে। ফারুক বিছানায় শোয়া ছিলো। হঠাৎ করেই তার মনে হলো তার বউটাতো খুব সুন্দর। এই রাতের বেলায় হারিকেনের আলোতে চুলের বিনুনি খুলতে থাকা অবস্থায় কী মায়াবীই না লাগছে ওকে। লম্বা চুল, ডাগর চোখ, ছিপছিপে ধারালো শরীর রহিমার। শরীরে কোনো খুঁত নেই পেটে হালকা পরিমাণ মেদটা ছাড়া। তবে কেন জানি এই মেদ থাকার কারণে রহিমাকে আরো সুন্দর দেখতে লাগে। শহরের ভালো কোনো পরিবেশে থাকলে হয়তো এই রহিমার সাথে কথা বলারই সাহস করতোনা ফারুক।
কিন্তু বিধি বাম! পরিস্থিতির কারণে রহিমা আজ ফারুকের পরম আজ্ঞাবহ। ধীরে ধীরে রহিমার দিকে এগিয়ে যায় ফারুক। ওর একটা হাত রাখে রহিমার পিঠে। হাতটা একটু একটু করে এগিয়ে যায় ওর স্তনের দিকে। সেটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয় রহিমা। গাল ফুলিয়ে বলে, “আপনে ধরবেন না আমারে। আপনের সাথে আমি রাগ করছি।” বলে আবার চুলের বিনুনি খোলার দিকে মনোযোগ দিলো রহিমা। এটাই রহিমার ফারুকের সাথে রাগ দেখানোর একমাত্র সময়। এরকম সময়ে ফারুককে দিয়ে মাঝেমাঝে বড়সর শপথও করিয়ে নেয় ও। স্বামীর সাথে রাগ করতে বেশ ভালো লাগে ওর। তবে সেই সুযোগ সবসময় আসেনা। তাই এখনো সে সুযোগটা হারাতে চায়না। “মাফ কইরা দে বউ। আর হইবোনা এমন।” ফারুক অনুনয়ের সুরে বলে। “করুমনা আপনেরে মাফ। ঘুমানগা যান।”
“তুই মাফ করবি, তোর চৌদ্দগোষ্টী মাফ করবো।” বলেই রহিমার কোমর ঝাপটে ধরে ওর নাকে তার নিজের নাকটা একটু ঘষে দেয়। রহিমার রাগ কর্পূরের মত ওড়ে যায়। আসলে আর কিছু করারও নেই তখন। ফারুকের শক্ত বাহুবেষ্টনীতে আড়ষ্ট হয়ে যায় ও। মনে মনে দ্রুত মাফ করে দেয় ফারুককে। রহিমা জানে ও যদি ফারুককে মাফ না করে, তাহলে ফারুক ওকে স্পর্শ করলে ফারুকের পাপ হবে। সে তার স্বামীকে পাপ করতে দিতে চায়না। লেখকের কিবোর্ড মেয়েদের এই অদ্ভুত স্বভাব বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখেনা। যারা নিজের উত্তাপে অন্যকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে, সেই উত্তাপে যখন তারা নিজেরাই জ্বলে যায়, তখন তাদের বিশ্লেষণ করা সত্যিই ভীষণ কঠিন কাজ।
বাইরে তখন নিশুতি রাত। চাঁদের আলো পৃথিবীতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা কুয়াশার কারণে। দূরে কোথাও দুর্বল শব্দে কয়েকটা রাতজাগা পাখি জানান দেয় তারা এখনো রাতকে পাহারা দিচ্ছে। প্রচন্ড শীতে গাছ থেকে ঝড়ে পড়ছে কিছু মরা পাতা। সেই পাতা পড়ার মরমর শব্দে কেটে যাচ্ছে অন্ধকারের সুর। রাত বাড়ছে। কিংবা কমছে। একদিনের এই সাধারণ গল্পের হয়তো মহাকালের কাছে কোনো মূল্য নেই। কিন্তু এই গল্পের শেষ হবেনা। এই গল্পের শেষ নেই। এই গল্প শেষ করা যায়না…