অনিকেত একটা সমস্যায় পড়েছে, ঠিক এই মুহূর্তে। সমস্যাটার নাম, ‘খুঁত’! বাংলায় আরো সমার্থক আছে এটার। গলদ, অপূর্ণতা, অভাব, ত্রুটি.. ইত্যাদি। সে খুঁত খুঁজছে। পেলেই সমস্যা মিটে যায়, পাচ্ছেনা বলেই অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে তার। প্রকৃতি নিখুঁত মানুষ পছন্দ করেনা। অথচ অনিকেত পুরো পনেরো মিনিট মেয়েটির পেছন পেছন হেঁটেছে, বইমেলার যে স্টলে মেয়েটি গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, ঐ স্টলেই সে যাচ্ছে পেছন পেছন। সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনে দাঁড়িয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে দেখা শেষ। অনিকেত হতাশ হলো।
মেয়েটি শাড়ি পড়েছে। কালো রঙের শাড়ি। একহাতে দু’টো বই। ‘অনন্ত অম্বরে’ আর ‘দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই!’ গোল মুখ, নাক, চোখ, ভ্রুঁ, চুল এখনো এমন কিছু পায়নি যেটা অল্প একটু খুঁত বলে ধরে নেয়া যায়। হাইট নিয়ে ও খুঁত বের করা গেলোনা, পারফেক্ট হাইট। বেশি লম্বা না, বেশি বেঁটে না। পারফেক্ট গায়ের রঙ। বেশি সাদা নয়, বেশি কালো নয়.. উহু, শ্যামলা ও নয়। এ কেমন রঙ? অনিকেত চোখ বড় করে হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে, হা করে নিঃশ্বাস নেয়, কি আশ্চর্য! খুঁত পাওয়া যাচ্ছেনা কেন? কি অদ্ভুত!
মেয়েটি এখন স্টল একটার সামনে দাঁড়িয়ে বই নেড়েছেড়ে দেখছে। মেয়েটির সাথে আরো একটি মেয়ে আছে। ফ্রেন্ড হতে পারে, বোন ও হতে পারে। যেটাই হোক, ঐ মেয়েটির কিন্তু খুঁত পাওয়া গেছে। অনিকেত প্রথম দেখেই খুঁত বের করে ফেলেছে, মেয়েটির মুখের বাঁ দিকের দাঁত একটা বাঁকা। কথা বলার সময় দেখা গেছে বার কয়েক। অনিকেত এখন অপেক্ষায় আছে, এই মেয়েটি কখন কথা বলবে। এই মেয়েটির এখনো দাঁত দেখা হয়নি, হয়তো দেখা যাবে এই মেয়েটির ও দাঁত একটা বাঁকা। কিংবা মেয়ের গলার স্বর মোটা। অনিকেত ঠিক এই মুহূর্তে প্রচন্ড হতাশ। মেয়েটি কথা বলার সময় দাঁত তেমন না দেখা গেলেও, হাসার সময় দেখা গিয়েছে। পারফেক্ট দাঁত, কোনো খুঁত নেই। এখন শুধু গলার আওয়াজ আর নাম শোনার অপেক্ষা। দেখা যাবে নাম হয়তো মান্ধাতার আমলের, খাপ খাবেনা। অনিকেত মেয়েটির দিকে এগোয়, কথা বলা প্রয়োজন।
— একটু কথা বলতে পারি?
মেয়েটি অনিকেতের দিকে তাকায়, তাকানো দেখেই মনে হলো মেয়েটি জানতো অনিকেত ঠিক এখন তার সামনে এসে এই প্রশ্নটিই করবে। ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
— খেয়াল করলাম, প্রায় আধাঘন্টা ধরে ফলো করছেন আমাদের। কেন জানতে পারি?
অনিকেত দম ধরে ছিলো গলার আওয়াজ শোনার জন্যে, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো! হতাশ, এই মুহূর্তে চরম হতাশ সে। এই মেয়ের গলার স্বর চুড়ির মতো, কিংবা নুপুরের মতোন। একটুতেই বেজে উঠে, মধুর সঙ্গীত… রিনিঝিনি রিনিঝিনি। অনিকেত হতাশ স্বরে বললো,
— খুঁত খুঁজছি। এখনো পাইনি; পেলেই চলে যাবো। মেয়েটি অবাক চোখে তাকায়, জিজ্ঞেস করে,
— খুঁত? কিসের খুঁত? অনিকেত মাথা দোলায়, হতাশ হয়েই। বলে,
— প্রকৃতি নিখুঁত মানুষ পছন্দ করেনা, সবাইকেই অল্প একটু আধটু খুঁত দিয়ে পাঠায়! আমি আপনার টা খুঁজছি, পাইনি এখনো। পেলেই চলে যাবো। নাম কি আপনার? মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে একটা ভ্রুঁ কুচকানো হাসি দিয়ে রিনিঝিনি স্বরে জবাব দেয়,
— পদ্ম।
অনিকেতের হুট করে মনে হলো, তার সামনে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে একটা পদ্মফুল, চারদিকে পানি, পানির মাঝে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা অদ্ভুত সুন্দর ফুল.. স্বর্গীয় ফুল, মাঝে মাঝে এদিক ওদিক নড়ছে। অনিকেত ফুলের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা দোলায়। পদ্মের ফ্রেন্ডের হাসির আওয়াজে ঘোর কাটে অনিকেতের।
বইমেলায় আর কথা হয়নি, অনিকেত বাসায় এসে ঔষুধ খেয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বাবা দুইবার এসে চুপিচুপি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে গেলেন, কি করছে ছেলে। অনিকেত বসে ছিলো বিছানায়। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার এখন। বিছানা থেকে একটু দুরে সামনে টিভি আছে, টিভি টা লাথি দিয়ে ভেঙ্গে ফেললে কেমন হয়, এক মুহূর্ত ভাবলো সে। তারপর উঠে দু’পা সামনে গিয়ে এক লাথিতে টিভির স্ক্রীন ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো, কেডসের কারণে পায়ের তালু না কাটলেও হাঁটুর একটু নিচে রক্ত ঝরতে দেখা গেলো। কাঁচের টুকরো দু-তিনটে গেঁথে গেছে সম্ভবত। অনিকেত কাটা পা নিয়ে বিছানায় গিয়ে আবার বসলো। হাঁটুর নিচ থেকে রক্তের একটা ধারা নিচে নেমে এসে সাদা কেডসে লাল ছাপ বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা কিছু একটা ভাঙ্গার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত এসে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়, তারপর ভেতর থেকে বন্ধ দরজায় বাড়ি দিতে শুরু করে। ‘অনি, দরজা খুলো.. অনি…!’ অনিকেত চোখ বন্ধ করে দু’হাতে কপাল চেপে চুপ করে বসে আছে। একটা মানুষ এতোটা নিঁখুত হবে কেন? একটুও খুঁত নেই! কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য!
পদ্মের কাপড় বদলাতে ইচ্ছে করছেনা। বইমেলা থেকে আসছে প্রায় দু’ঘন্টা হলো। তিনটে বই কিনেছে, সেগুলো টেবিলের উপরে রেখে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে সে অনেকক্ষণ ধরে। এমন কখনো হয়নি, নতুন বই কিনে বাড়ি এসে তার প্রথম কাজ হচ্ছে বইগুলো মুখের সামনে এনে বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়া। তারপর পড়া আরম্ভ করা। আজ তেমন কিছু করতে ইচ্ছে করলোনা তার। মা এসে বারকয়েক বকে গেলো, সন্ধ্যের সময় ঘরের লাইট না জ্বালিয়ে কেন বসে আছে বারান্দায়। পদ্ম চুপ করে বসে আছে। আসলেই তো, কেন বসে আছে সে? রাতে বারকয়েক ঘুম ভাঙ্গলো পদ্মের। পদ্মের ঘুমের ডিস্টার্ব নেই, এক ঘুমেই সকাল হয়। তবে মাঝে মাঝে প্রচন্ড টেনশনে থাকলে এমন ডিস্টার্ব হয়। শেষ এমন হয়েছে বাবার ছোটখাটো একটা এ্যাক্সিডেন্টের পর। কয়েকরাত ঘুমোতে পারেনি। বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ আছে, অথচ তারপরেও কোনো এক সম্ভাব্য মারাত্মক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে এসেছেন তিনি, কি ভয়ংকর ব্যাপার! পদ্ম ভীষণ কেঁদেছিলো। বাবাকে সে ভয়ানক বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আজ কেন ঘুম ভাঙ্গছে পদ্মের?
রাত দু’টো বাজে। পদ্ম জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার চোখে ভাসছে একটা দৃশ্য। বইমেলা, একটা স্টল, মিষ্টি বিকেল আর একটা অদ্ভুত হতাশ ছেলে। পদ্ম হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো। পরক্ষণে বিব্রত বোধ করলো নিজের হাসির শব্দে। সে যে অপরুপা, জানে সে। অনেকের কাছ থেকেই শুনেছে, বেশিরভাগই ছেলে বন্ধু। প্রশংসা অনেক শুনেছে, কিন্তু এমন করে কেউ কখনো বলেনি। ‘খুঁত খুঁজছি, পেলেই চলে যাবো।’ পদ্মের আবার হাসি পেলো খুব। সারারাত ঘুম হলোনা ওর, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্নে একটি হতাশ গলার স্বর কানের কাছে এসে বাজতে লাগলো বারবার,
— খুঁত খুঁজছি, পেলেই চলে যাবো। খুঁত খুঁজছি, পেলেই চলে যাবো।
বইমেলায় এসে স্টলে স্টলে ঘুরলো অনেকক্ষণ পদ্ম, আজ বই কেনার ইচ্ছে ছিলোনা। কিনবোনা, কিনবোনা করেও দু’টো বই কিনে ফেলেছে সে। মনি মোবাইলে কথা বলছে সারাক্ষণ। অনেক কষ্টে তাকে রাজি করানো গেছে এখানে আসতে আবার। পদ্ম আসা মাত্রই বারবার সামনে- পেছনে, আশেপাশে দেখেছে, পায়নি তাকে। পদ্ম কাউকে খুঁজছে, হতাশ বাবু কে খুঁজছে। হতাশ বাবু আজ কি আসবে?
— আমি একটু কথা বলতে পারি?
পদ্ম একটা বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছিলো, প্রশ্ন শুনে কোনো এক অজানা কারণে অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করলো। এ এক তীব্র সুখময় অনুভুতি। বুঝতে দিলোনা সেটা, বইয়ের পাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো,
— বলুন।
হতাশ বাবু আজ হতাশ নেই। কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সামনে, পদ্মের হাসি পাচ্ছে। এতোবড় ছেলে, অথচ কি নিষ্পাপ মুখ। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও। পদ্ম অপেক্ষায় আছে, হতাশ বাবু কি বলে আজ শোনার জন্যে। হতাশ বাবু বললো,
— খুঁজে পাইনি।
— কি?
— খুঁত।
— তো আমি কি করতে পারি?
— সাহায্য
— কিভাবে?
— আপনি আপনাকে সবচেয়ে ভালো জানেন।
আপনিই বলে দেন আপনার খুঁত কি? আমি মুক্ত হই। পদ্ম এবার শব্দ করে হাসলো, হতাশ বাবুর চেহারায় আস্তে আস্তে হতাশা ফুটে উঠছে। পদ্ম হাসি একটু গিলে নিয়ে বললো,
— আমার কোনো খুঁত নেই।
— পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই।
— তবে আমার কি খুঁত বের করুন। হতাশ বাবুর চেহারায় হতাশ ভাব কেটে গিয়ে দ্রুত একটা জিদ ফুটে উঠলো, বললো,
— করবো। অবশ্যই বের করবো। হতাশ বাবু পেছন ফিরে হাঁটা দিলো, পদ্ম মুচকি হেসে হাত উঁচু করে ডাক দিয়ে বললো,
— আপনার নামটা? হতাশ বাবু পেছন না ফিরেই হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,
— অনিকেত।
পদ্ম বিছানায় শুয়ে আছে। মন খারাপ তার। কেন? বইমেলা একমাস চলবে, পনেরো দিন পার হয়েছে। পনেরো বার দেখা হয়েছে অনিকেতের সাথে। কি অদ্ভুত এই ছেলে। খুঁত খুঁজে বেড়ায়। আজ বিকেলের কথা গুলি পদ্মের কানে বেজে উঠছে। আর যতোবার বেজে উঠছে ততোবার ই মন খারাপ হচ্ছে। আজ বিকেলে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেছিলো, মনি ছিলোনা। পদ্ম ই শুরু করেছিলো,
— পেয়েছেন এখনো? অনিকেত প্রশ্ন বুঝেনি, জিজ্ঞেস করে,
— কি?
— খুঁত
— ওহ..। না।
— কি মনে হয়? পাবেন?
— পাবো।
— তারপর?
— তারপর আর কি?
— খুঁত খুঁজে পাওয়ার পর?
— চলে যাবো। আপনি মুক্ত।
পদ্মের চোখ বিষন্ন হয়ে আসলো, পদ্ম ভেবে পেলোনা কেন এমন বিষন্ন হবে তার চোখ। কেন মন খারাপ হবে তার। এ কে? এই ছেলের সাথে কেন সে বারবার দেখা করছে? কিসের এতো টান? কেন এই মায়া? পদ্ম বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশের উপর মাথা রাখলো, ডান চোখ দিয়ে অশ্রু ফোঁটা গুলি বাঁ দিকে গড়িয়ে পড়লো। কেন এতো কান্না পাচ্ছে তার? কি অদ্ভুত! আঠারো দিন পার হয়েছে। অনিকেত হাঁটছে, তার গায়ে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রঙ সবুজ। অনিকেতের বিষন্ন চোখ, ভেজা গলায় বললো,
— একটা নিঁখুত মানুষ ছিলো আমার। দুই বৎসর একসাথে ছিলাম আমরা। প্রথম এক বৎসর শুধুই ভালোবাসা, পরের বৎসর শুধুই বোঝাপড়া। সব বোঝাপড়া শেষ করে, একদিন একটা কার্ড আর একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায় নিখুঁত মানুষটি। চিঠি তে লিখা ছিলো, ‘আমি একটা সুস্থ মানুষ চেয়েছি, তুমি সুস্থ নও। কখনো কাউকে বুঝতে শিখোনি!’
পদ্ম অনিকেতের বিষন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বইমেলায় এতো মানুষের ভীড়ে কান্না পায় তার। বহু কষ্টে কান্না আটকে জিজ্ঞেস করে,
— কার্ড টা?
— বিয়ের কার্ড। কিছুদিন পর বিয়ে তার। কার্ডে লেখা ছিলো, ‘আপনারা সপরিবারে আমন্ত্রিত।’ অনিকেত মুচকি হাসলো, হাসিটা বিষন্ন চোখের বিষন্নতা একটুও কমালো না, বরং বাড়িয়ে দিলো।
— আমরা সপরিবারেই যাই বিয়েতে। আমিই নিয়ে যাই বাবা মা কে। ওদের বলি, বন্ধুর বিয়ে। আপনার কি অদ্ভুত লাগছে না পুরো ব্যাপারটা? পদ্ম চুপ করে থাকে, অনিকেত বলতে থাকে,
— নিখুঁত মানুষটি কল্পনায় ও আনেনি, আমি আসবো বিয়েতে। হতভম্ব হয়ে বাবা মায়ের সাথে দেখা করে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে। স্টেজে বিয়ের সাজে বসে থাকা নিখুঁত মানুষটির দিকে আমি পুরোটাসময় তাকিয়ে থাকি। খুঁত খুঁজে পাইনি, দুই বৎসরেও না। এখনও না। বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে আসার আগে শেষ ক’টি কথা বলেছিলো নিখুঁত মানুষটি, ‘তুমি আসলেই অসুস্থ একটি মানুষ! অনেকগুলো খুঁত নিয়ে জন্মেছো…’
অনিকেত একটা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, একটা বই নেড়েছেড়ে দেখে। পদ্ম চুপ করে সবুজ পাঞ্জাবির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে, বই দেখার ছুতোয় অনিকেতের হাতের ছোঁয়া পেতে। পরক্ষণেই নিজের ইচ্ছের জন্যে ভীষণ লজ্জিত আর বিব্রতবোধ করলো সে। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? কেন?
বই মেলা শেষ হয়ে আসছে। আর মাত্র পাঁচ ছয় দিন বাকি আছে। অনিকেতের সময় শেষ হয়ে আসছে, বইমেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় নিয়েছিলো সে। এর মধ্যেই পদ্মের কোনো না কোনো একটা খুঁত খুঁজে বের করবেই করবে। পদ্ম কোনো এক অজানা কারণে আনন্দিত বোধ করছে এখন। এই জিদ্দি ছেলেটার কাছে আর অল্প সময় আছে, যদি খুঁত খুঁজে বের করতে না পারে তবে হারাতে হবেনা ছেলেটাকে আর। রাতে শুয়ে, না ঘুমিয়ে জেগে থেকে, এক অদ্ভুত আবেগে চোখ ভেসে যায় পদ্মের। জীবনে প্রথমবারের মতো ‘নিখুঁত’ শব্দটার প্রতি প্রচন্ড কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মে তার।
আজ শেষ দিন বইমেলার। পরিচিত স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পদ্ম। অনিকেত এখনো আসেনি। পদ্ম আজ হালকা সেজেছে। প্রথম দিনের সাজ। কালো শাড়ি, আর টিপ। একটা চিঠি এলো পদ্মের জন্যে। একটা নয়, দু’টো। সবুজ খামে। যে চিঠি নিয়ে এসেছে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে ফুড়ুৎ। কে চিঠি দিলো? প্রথম খামের উপরে লিখা, ‘এটা আগে খুলবে…’! দ্বিতীয় খামের উপরে লিখা, ‘প্রথম চিঠি পড়ার আট বৎসর পর এটা খুলবে…’! পদ্ম কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম চিঠির খাম ছিঁড়ে ফেললো, চাপা উত্তেজনা কাজ করলো তার মধ্যে। ভেতরে একটা চিঠি,
“পদ্ম, অতঃপর খুঁত খুঁজে পেয়েছি। ভালোবেসেছো। এটা খুঁত নয়। খুঁত হচ্ছে, একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো।
অনিকেত” পদ্ম চিঠি হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, স্টলের সামনে ভীড় বাড়ে। সবাই স্পেশাল কোনো একটা বই চাচ্ছে, হিমুর বই। ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’। এই বইটায় হিমু আর মিসির আলি, দু’জনের দেখা হয়েছে। সবাই ভীড় করে কিনছে। ভীড় বাড়ছে, শোরগোল বাড়ছে। পদ্ম ভীড় থেকে বের হয়ে চুপ করে হাঁটতে থাকে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। হিমুও এভাবে হাঁটতো।
খুলনা, শহীদ হাদীস পার্ক, সন্ধ্যে ৬টা। অদ্ভুত, অসমাপ্ত একটা গল্প শোনার পর মানুষ যে অবস্থায় থাকে, আমি এখন সে অবস্থায় আছি। হা হয়ে আছি। আমার পাশে পদ্ম নামের ভদ্রমহিলা বসে আছেন। অপরুপা বলতে যা বোঝায়, ইনি তা ই। বয়েস বাড়লে মানুষের শারীরিক সৌন্দর্য কমে আসে, আমি কল্পনা করছি, ইনি দশ এগারো বৎসর আগে কেমন ছিলেন! কল্পনা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই পার্কে দেখার কিছু নেই, একটা পুকুর ছাড়া। পুকুরে বড় বড় রুইমাছ আছে, পাড় থেকে লোকজন খাবার দিলে একসাথে দশ বারোটা ভেসে উঠে, খাবার কামড়াকামড়ি করে খায়। লোকজন মজা পায়। আমি শহীদ মিনারের গোড়ায় বসে আছি। এই ভদ্রমহিলার পাশে। ভদ্রমহিলাকে আমি চিনিনা।
এখানে এসে দাঁড়াবার পর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখি, ভদ্রমহিলার ছোট ছোট দুই সন্তান খেলছে সামনে, হাসবেন্ড ও খেলছে তাদের সাথে, কি চমৎকার সুখময় একটা ব্যাপার, অথচ ভদ্রমহিলার চোখদু’টো বিষন্ন। একটু পর সন্তান একটা ‘মা মা, তুমিও এসো..’ বলে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভদ্রমহিলার। ভদ্রমহিলা সন্তান বুকে জড়িয়ে ধরে হাসলেন, তারপরেও চোখে বিষন্ন ভাব এতোটুকু কমলোনা। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্যময় দৃশ্য এটি। আমার ভীষণ ইচ্ছে করলো মানুষটির একটি ছবি তুলতে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, পাশে গিয়ে বসি তার। ভদ্রমহিলাই আগবাড়িয়ে কথা বললেন, বিষন্ন মানুষেরা আগ বাড়িয়ে কথা বলে, বিষন্নতা ছড়িয়ে দেয় চারোপাশে, ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করে।
— খেয়াল করলাম, অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছো। ঐ যে আমার হাসবেন্ড, ঐ যে দু’টো সন্তান আমার এতো আগ্রহ নিয়ে তারাও কখনো এতোটা সময় আমার দিকে তাকায়নি। আমি থতমত খেলাম, ঘুরিয়ে বলার প্রয়োজন হচ্ছেনা। এই মহিলা সেটা পছন্দ করেনা বলেই মনে হচ্ছে। সরাসরিই বললাম,
— আমি ছবি তুলি। শখের ফটোগ্রাফার। আপনার চোখে কিছু একটা আছে। আমি এই জীবনে এতো বিষন্ন চোখ দেখিনি আর।
ভদ্রমহিলা গল্প শেষ করেছেন একটু আগে। দু’টো চিঠি বুকে জড়িয়ে বইমেলা থেকে বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে সারারাত কেঁদেছেন। আমি হা করে চেয়ে আছি ভদ্রমহিলার দিকে। আমাদের দু’জন থেকে একটু সামনে ভদ্রমহিলার হাসবেন্ড আর দুই সন্তান খেলছে, দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে, চিৎকার করছে। আমি ওদিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তারপর, অনিকেত?
— পাইনি আর ওকে। আসলে খোঁজার চেষ্টা ও করিনি তেমন। একটা ভুল খুঁত ধরিয়ে দিয়ে গেছে সে। ভুল মানুষকে ভালোবাসা খুঁত নয়। মানুষটা যদি ভুল হয়, তবে ওটা মানুষটারই খুঁত.. মানুষটাকে ভালোবাসা নয়!
— আপনার কি ধারণা? অনিকেত সুস্থ কোনো মানুষ?
— নাহ। একটা অস্পষ্ট মানসিক সমস্যায় ভুগছিলো সে। যদিও তার সম্পর্কে আমার কখনোই কিছু জানা হয়নি আর।
— দ্বিতীয় চিঠি তে কি লেখা ছিলো?
— পড়িনি এখনো। আজকেই আট বৎসর পার হয়েছে। আজ দ্বিতীয় চিঠি পড়ার সময়; একটু পর ই খুলবো সবুজ খামটা।
আমায় আরেকবার বিষ্মিত হতে হলো, এটা কি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার। আমি অপেক্ষায় থাকলাম। দ্বিতীয় চিঠির অপেক্ষায়। “পদ্ম, আট বৎসর পর। কেমন আছো? ভাবছো, একটা ভুল খুঁত ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে এসেছি? আমি জানি। এটাই ভাববে। আট বৎসর পরেও এটাই ভাববে। তুমি ঠিক ই ভাবছো। এটা কোনো খুঁত নয়। ভুল মানুষকে ভালোবাসা, একটা মানুষের খুঁত হতে পারেনা। ভালোবাসা’ই আসলে কোনো খুঁত নয়। এটা স্বর্গীয় অনুভুতির ব্যাপার। পবিত্র। শুদ্ধ। খুঁত হচ্ছে, কখনো কাউকে ভালোবাসতে না পারা।
পদ্ম, আট বৎসর পর! আমি জানি তোমার চোখে এখনো সে বিষন্নতা আছে। যেটা দেখেছিলাম, আট বৎসর আগে এক বইমেলায় সেই পরিচিত স্টলের সামনে। সময় নিতে হয়েছে আমায়, অনেক। তুমি বিয়ে করবে, সন্তান হবে তোমাদের। কিন্তু জীবনেও কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা আর। এটাই তোমার খুঁত। পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই। আমি জিতে গিয়েছি। অনিকেত” আমি ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকি চিঠির কালো শব্দগুচ্ছের দিকে। পার্কের হলুদ আলোয় চিঠি পড়া কষ্টের, আমার জানা ছিলোনা, ভেজা চোখে চিঠি পড়া তারচেয়েও বেশি কষ্টের। ভদ্রমহিলা বিষন্ন চোখে সামনে তাকিয়ে। একটা অদ্ভুত আবেগহীন গলার আওয়াজ শুনি তার,
– আমার আর কখনো কাউকে ভালোবাসা হয়ে উঠেনি। কাউকে ভালোবাসতে না পারার মতো তীব্র কষ্ট পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আমার হাসবেন্ড, প্রচন্ড ভালোবাসে আমায়। প্রায়ই রাতে আমরা মিলিত হই, আটবৎসর ধরে… শুধুমাত্র শরীরের প্রয়োজনে। একটা বিছানা, দু’টো বালিশ, একজন স্বামী, একজন স্ত্রী… একটা মানুষ আর একটা মনহীন মানুষ। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হওয়ার ভান করি প্রায়শই। পারিনা। একটা খুঁত এঁকে দিয়ে গিয়েছে অনিকেত। চোখে। বিষন্নতা এঁকে দিয়ে গিয়েছে। শারীরিক খুঁত যন্ত্রনা দেয়.. মানসিক খুঁত মেরে ফেলে। আমি মারা গিয়েছি আট বৎসর আগে। একটু হেল্প করবে আমায়? আমি ভদ্রমহিলার চেহারার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা উপর নিচ করি, ভদ্রমহিলা বলেন,
— চিঠি টা ঐ পুকুরের পানিতে ফেলে দাও।
শহীদ হাদীস পার্কে রাত নেমে এসেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি পুকুরের পাড়ে। পুকুরের পানিতে একটা সাদা কাগজ ভাসছে, একটা চিঠি। পুকুর পাড়ে একটা সাইনবোর্ড, ওখানে লেখা, ‘পুকুরে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না!’
আমি শহীদ মিনারের গোড়ায় তাকাই, হাসবেন্ড দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে, ভদ্রমহিলার সন্তান দু’টো খেলে ক্লান্ত হয়ে মায়ের পাশে এসে বসেছে। মায়ের চোখ বিষন্ন, ঠোঁটে হাসি। আমি তাকিয়ে থাকি। বিষন্নতার গোপন গোপন গল্প গুলো পার্কের হলুদ আলোয় একটু একটু করে মিশে যেতে থাকে। টুকরো হাসির ঠোঁট দেখা হয়, ছোঁয়া হয়.. চোখ দেখা হয়না। কত গোপন গল্প, কত গোপন কষ্ট, কত গোপন বিষন্নতা চোখে আঁকা থাকে। অথচ একলক্ষ রাত, এক বিছানায় গা জড়িয়ে ঘুমোনো হাসবেন্ড সেটা কখনোই খুঁজে পায়না!