— কিরে! তোকে বলেছিলাম না একটু তাড়াতাড়ি আসতে,শীত পড়েছে গরম জামাকাপড়গুলো রোদে দেব।সেই দেরী করলি….
— কি করব বৌদি,ছেলেটার জ্বর, কিছুতেই আমাকে ছাড়তে চাইছিল না।অনেক কষ্টে ভুলিয়ে রেখে এসেছি।
— তাই বুঝি।ঠান্ডা পড়েছে, একটু সাবধানে রাখবি তো।নিশ্চয় ঠান্ডা লেগেছে।
মালতি চুপ করে রইল।মনে মনে বলল, ঠান্ডার আর দোষ কি,ওই তো একখান দরমার বেড়া দেওয়া ঘর।হু হু করে হাওয়া ঢোকে।শীতকালে পরাবার মত গরম জামাকাপড় ও তেমন নেই।ঠান্ডা তো লাগবেই।সংসারে তিন-তিনটে মানুষ।ক বাড়ি কাজ করে কোনক্রমে পেট টুকুই চলে।গরম জামা কিনব কোথা থেকে। মালতির স্বামী ছেলের জন্মের পর পর ই ওদের রেখে চলে গেছে অন্য সংসার পাততে।বুড়ি শাশুড়ি আর ছেলেকে নিয়েই মালতির সংসার।এবছর সাত এ পড়ল ছেলেটা। স্কুলেও ভর্তি করেছে মালতি।শাশুড়ি অসুস্থ।কোনমতে সংসার আর ছেলেটাকে দেখে রাখে।তাই তো মালতি কাজে বেরোতে পারে।
— নে,নে এগুলো নিয়ে ছাদে চল দেখি…
— হ্যাঁ, বৌদি যাই।ওমা এই ছোট সোয়েটারগুলো কার গো বৌদি?
— আমার ছেলের রে মালতি।
— তোমার ছেলে?কই কোনদিন দেখি নি তো তাকে।বাইরে থাকে বুঝি।পড়াশুনা করতে গেছে তাই না।
মুহূর্তেই সুমির মুখে চোখে কেমন যেন কালো মেঘের ছায়া নেমে এলো।মালতি অবাক হয়ে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল সুমির মুখের দিকে।আঁচল দিয়ে চোখের কোনটা মুছে সুমি বলল,
— না রে মালতি,সে আর নেই।পাঁচ বছর হল আমরা তাকে হারিয়েছি।ক দিনের জ্বরে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল।অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কিচ্ছু করতে পারলাম না।এখন শুধু ওর স্মৃতি আগলে বেঁচে থাকা।ওর কোন জিনিস ফেলিনি জানিস, কাউকে কিচ্ছুটি দিই নি।ওর খেলনা, জামাকাপড়, সোয়েটার সব কিছু রেখে দিয়েছি বুকে আগলে।মাঝে মাঝে রোদে দি আর গুছিয়ে রাখি।ওগুলোতে যে আমার বাবুর ছোঁয়া লেগে আছে।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সুমি।মালতি ও নিজেকে সামলাতে পারল না।তার আবছা চোখে বার বার ভেসে উঠতে লাগল ওর ছোট্ট ছেলে পিকলুর মুখটা।তার ও যে খুব জ্বর।বুকটা কেমন কেঁপে উঠল।আসলে সে মাত্র ছয় মাস হল এ বাড়িতে কাজে এসেছে তাই এই ঘটনা তার অজানা।সুমিরা আগে দিল্লী তে থাকত।বছর খানেক হল এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে এসেছে।তাই এইসব কথা কেউ জানেনা। কাজ সেরে তড়িঘড়ি মালতি দৌড়োলো নিজের বাড়ির দিকে।কে জানে কেমন আছে ছেলেটা। পরদিন সাথে করেই ছেলেকে নিয়ে সুমির বাড়ি কাজে এল মালতি।
— এই তোর ছেলে বুঝি?
— হ্যাঁ গো বৌদি, আজ সাথে করেই নিয়ে এলাম।চোখে চোখে রাখতে পারব।
— জ্বর কমেছে ওর?
— অল্প জ্বর রয়েছে।শরীরটাও বড় দুর্বল।শাশুড়ির তো বয়স হয়েছে।এই দুর্বল ছেলেকে আর কি করে দেখে রাখবে, তাই নিয়ে এলাম।
— কি নাম তোর?
— পিকলু।
— টেবিলে ফল রাখা আছে ওকে দে মালতি।দেখে তো মনে হচ্ছে ভাল করে খায়নি কদিন। আজ কেন জানিনা পিকলুর মুখটা দেখে সুমির নিজের ছেলের মুখটা মনে পড়ছে।ঠিক এমনি ক্লান্ত, বিষন্ন একটা মুখ।ছেলেটার গায়ে একটা গরম জামা পর্যন্ত নেই।
— মালতি যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাস।দরকার আছে। এই কথা বলে পিকলুর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সুমি।
— কাজ হয়ে গেছে বৌদি…
— এই নে টাকাটা ধর।ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে নিস আর ও যা খেতে চায় কিনে দিস।আর এই সোয়েটার দুটো নিয়ে যা।ওর গায়ে ভালোই হবে।পড়াবি ওকে।
— কিন্তু এগুলো তো..
— হ্যাঁ এগুলো আমার ছেলের ছিল।আজ থেকে পিকলুর।জিনিস আগলে রেখে কি করবো রে সে তো থাকবেই চিরকাল আমার মনে।তার চেয়ে এগুলো যদি ওর কাজে লাগে লাগুক না।আমার ছেলেটা খুশি ই হবে রে।আমার চোখের সামনে একটা বাচ্চা ঠান্ডায় কষ্ট পাবে তা কিছুতেই হতে পারে না।নিয়ে যা এগুলো।
— তুমি যে কি উপকার করলে বৌদি তুমি নিজেই জানোনা।টাকার অভাবে একটা সোয়েটার কিনে দিতে পারিনি ওকে।আমার ছেলেটাকে বাঁচালে তুমি বৌদি।ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন দেখো।