কর্ম ফল

কর্ম ফল

ওঠো বৌমা, ওঠো, তুমি এতো ভেঙে পড়লে কি করে হবে, তুমি আমাদের দুর্গা মা। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় তৃষা, তুহিনের অসাড় দেহটা দেখে তার করুণা হয় তবু চোখের জল মুছে বলে চলুন মানু কাকা, অফিসে দেরী হয়ে যাবে। অফিসে ঢুকতেই তিলক, রবিন, সামুয়েল, জনার্দন এগিয়ে এসে জানতে চান, আজ কেমন আছেন স্যার? “ভালো “বলে নিজের কেবিনে ঢোকে তৃষা, চেয়ার টেনে বসে পড়ে, সামুয়েল আসতেই কাজ বুঝিয়ে দেয়,সে চলে যায়।টেবিল ক্যালেন্ডার টেনে নিয়ে আজকের তারিখটা কেটে দেয়।আজ দশ মাস সাতাশ দিন হলো তুহিন হাসপাতালে।

সামান্য বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্পাইনাল কডে মারাত্মক চোট,তারপর থেকে সারা শরীর অসাড়,তবে ব্রেন ঠিক চলছে,কে কি বলছে সব বুঝছে কিন্তু বলতে পারছেনা।ঘড়ঘড় করে গলা দিয়ে শব্দ করে কি যেন বলার চেষ্টা করে ,কিন্তু কিছু বোঝা যায় না।সামনে টেবিলের ওপর তুহিনের হাসি মুখের ছবি। ছবিটাকে কাছে টেনে নিয়ে তৃষা বললো, তোমার এই শাস্তি তো হওয়ার ছিল তাইনা! কথায় বলে না “পাপ বাপকেও ছাড়েনা “, দেখলে তো, প্রমাণ পেলে তুমি, এখন যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এই রকম ভাবে! কোথায় গেল তোমার এই মায়াবী হাসির আড়ালে শয়তানের রূপ! আমি চাই তুমি বেঁচে থাকো তোমার যন্ত্রণা নিয়ে, যত কষ্ট তুমি দিয়েছো মান্তু,সুরভী, অহনা মনে পড়ে তোমার এদের কথা!

মান্তুকে বড্ড যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছো তুমি, পেটে তোমার সন্তান ছিল তার, দিনের পর দিন বিয়ের প্রলোভন ছিঃ! তোমার বাচ্চাটার কথা ভেবে মায়া হয়নি না, কি নিষ্ঠুর তুমি, গাড়ির চাকার তলায় পিষে চলে গেলে রাতের আঁধারে।
কেউ ধরতে পারেনি বলে সাহস বেড়ে গেছিলো, সুরভী তোমার দ্বিতীয় শিকার। ওর সাথে দীঘাতে গিয়ে বাজী রেখে ছিলে জুয়াতে হেরে গিয়ে ওদের মুখে ছেড়ে দিয়ে, তুমি মদ খাচ্ছিলে তাই না, তার হেনস্থা দেখে মজা নিচ্ছিলে! ঘেন্নায় নিজেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লো। তোমার গায়ে আঁচটুকু লাগালো না সে। আর অহনা আমার বোন! ওকে তো সামাজিক রীতিনীতি মেনে বিয়ে করে এনেছিলে, আমি তখন জার্মানিতে, আসতে পারিনি, আসলেও তোমার সুন্দর মুখের আড়ালে কদর্য চেহারাটা ধরতে পারতাম না।

তোমার নিজের সন্তানের ওপরেও মায়া হয়নি না, নইলে ঐ ফুটফুটে শিশুর মাকে কি করে ভিটামিন টনিকের বোতলে বিষ মিশিয়ে সে জেনে গেছিলো তোমার চরিত্র, প্রায় তোমার কাজের দোহাই দিয়ে অন্য শহরে মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করার কথা, রাগারাগি, অশান্তি অনেক কিছু ভোগ করেছে মেয়েটি, আমি এসে ওর চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম, ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু বোকা মেয়েটা তোমায় যে বড্ড ভালো বাসতো। শেষে যখন ওর খুব বাড়াবাড়ি, তখন ভালো নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেও বাঁচাতে পারতাম না হয়তো, সারা শরীর বিষাক্ত হয়ে গেছে ততোদিনে। বাড়িতে বাইরে থেকে ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিলে তুমি! একটুও সন্দেহ হয়নি আমার তোমার ভালো মানুষি দেখে। অহনা ও তার বাচ্চার জন্য সেদিন রয়ে গেছিলাম তোমার বাড়িতে, মনে পড়ছে তোমার, যেদিন ভোর বেলায় অহনা সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিল! তোমাকে খুঁজছিল সে, ফোন করতে বলছিল বারবার আমায়, তোমার ফোন সুইচ অফ ছিল।

ও যাওয়ার আগে বলেছিল তোমার সব কীর্তিকলাপ, বিশ্বাস করতে মন চায়নি। অনেক রাতে কারো কান্নার আওয়াজে গিয়ে দেখি তোমার পা ধরে মানু কাকা কাঁদছে আর বলছে, এতো নির্দয় হয়ো না ছোট সাহেব, বাচ্চাটার কথা তো ভাবো!তোমার চরিত্র বুঝতে সেদিন আমার আরও একটু দেরি হয়ে গেছিলো, অহনার নিঃশ্বাস আর পড়ছিল না, আমি পাগলের মতো ডাক্তারকে ফোন করে যাচ্ছিলাম। ‌আমার সামনে দিয়ে অহনাকে সাজিয়ে নিয়ে গেলে তুমি মেকি জল চোখে নিয়ে। ‌বাবা মা কে রাজি করিয়ে তোমায় বিয়ে করলাম অন্তুর জন্য, তোমার আর অহনার সন্তান! ‌প্রতিশোধের জ্বালা ছিল বুকে, ব্যবসা আমি তোমার চেয়ে ভালো বুঝতাম, তালিম ছিল বিদেশের, তুমি আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে আমায় পেতে চেয়েছিলে আর আমি তোমায় ধনে প্রাণে মারতে চেয়েছিলাম। তোমাকে আমি খুব ঘৃণা করি,তাই কোনোদিন তোমায় ছুঁতে দিইনি নিজেকে।

‌আমি ব্যবসায় সর্বেসর্বা হয়ে তোমায় রাখলাম পাশে। মানু কাকার থেকে সব জেনে ফেলেছিলাম বলে তুমি তাকে সরাতে চেয়েছিলে, মাঝরাতে তার ঘরে আগুন দিয়ে ছিলে। মানু কাকাকে আমি পাঠিয়ে ছিলাম আমার বাবা মায়ের কাছে ছেলেকে রেখে আসতে, নইলে বেচারা ঐ ঘরে পুড়ে মরতেন। ম্যাম! আসবো, কেবিনের দরজায় নক করে রবীন। তাকে আসতে বলে কিছু পেপার্স এ সিগনেচার করে তৃষা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। রবীন ওটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলে ম্যাম, এবার আমাদের পুজোর বোনাস না হয় না দিলেন। স্যার সুস্থ হতেন তারপর না হয় ওসব নিয়ে ভাববেন না, আপনাদের পরিশ্রমের ফলে কোম্পানি এতো ভালো জায়গায় পৌঁছেছে, আপনারা এভাবেই পাশে থাকবেন, আপনি এখন আসুন!

রবীন চলে যেতে আবার ফটোর দিকে চাইলো তৃষা, বললো তোমার স্টাফরা তোমাকে এখনো কত ভালোবাসে, তোমাকে নিয়ে ভাবে, আর তুমি দিনের পর দিন ওদের শোষণ করেছো, জিনিসের দাম বাড়লেও ওদের মাইনা বাড়েনি, বোনাস বাড়েনি, আমি সব বাড়িয়ে দিয়েছি, ওদের আনন্দে যদি তোমার পাপ খন্ডন হয়, তুমি মুক্তি পাও!
তোমার সবকিছু জানার পর ভাবতাম ভগবান বলে কিছু নেই, কিন্তু আমার সে ধারণা ভেঙে গেছে। ভগবান আছেন তাই তো আমার হাত দিয়ে এতো বড় একটা পাপ করালেন না। আমি তোমাকে বাঁচতে দিতাম না জানো, তিল তিল করে মারতাম। এখন দেখ তুহিন, কিভাবে বেঁচে আছো তুমি! তুমি বেঁচে থাকো তুহিন, তুমি এভাবেই বেঁচে থাকো। বৌমা আসবো! মানু কাকার গলা পেয়ে তৃষা বললো আসুন কাকা, তোমার গাড়ি রেডি, আজ তো হরিপুরের সাইট টা হ্যাঁ আপনি চলুন, আমি আসছি! তৃষা করিডোর দিয়ে যেতে যেতে দেখলো সব স্টাফদের মধ্যে বোনাস পাওয়া নিয়ে খুশীর উচ্ছাস।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত