ভোরের অপেক্ষায়

ভোরের অপেক্ষায়

আজ সকালের আকাশটা, কেন জানি না, বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে! বৃষ্টি নামবে হয়তো! খোলা জানালা দিয়ে অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, বেশ মিষ্টি গন্ধটা! অপরাজিতা চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই নবীনের দিকে তাকালো আজ অহনার এক বছর হোল দিল্লী যাওয়া, তোমার খুব মেয়ের কথা মনে পড়ছে না, অপরাজিতা! একটু কথা বলবে মেয়ের সঙ্গে, ফোনে ধরবো?

এই মানুষটা কি করে যে মনের কথা জানতে পারে, অবাক হয়ে যায়, অপরাজিতা! মুখে শুধু বললো, না, থাক! ফোনে কথা বলে আমার ঠিক বুক ভরে না, ওকে যদি একটু বুকের মধ্যে নিয়ে ওম নিতে, ছুঁয়ে দেখতে পারতাম! ঠিক আছে, তুমি যাবে দিল্লী মেয়ের কাছে? আমি নিয়ে যাবো তোমাকে! নাগো, এখন আর যাবো না, আর তো ছটা মাস গেলেই অহনার এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি আসার কথা! এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে কলিং বেলটা বেজে উঠলো! নবীন বলে উঠলো, এই সময়ে কে এলো আবার?

আমি দেখছি তুমি বসো, দরোজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে অনিশ! অপরাজিতা এই সময়ে, অনিশকে দেখবে বুঝতে পারেনি! কত বছর পর অনিশকে দেখছে চেহারার কি অবস্থা করেছে, সেই সুদর্শন অনিশকে চেনায় যায়না যে! শরীর ভেঙ্গে গেছে উস্কোখুস্কো চুল! মানুষটা কেমন যেন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মনে হচ্ছে! অপরাজিতা কথা বলতে গিয়েও পারছে না, অনেক কষ্টে বলে উঠলো আপনি?

কে এসেছে অপরাজিতা? আমি আসবো? বলতে বলতেই নবীন অপরাজিতার পেছনে দাঁড়িয়ে অনিশকে দেখতে পায়! সেকি অনিশ দা আপনি? আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে, আসুন আসুন ভেতরে আসুন! না নবীন আমি ভেতরে আসবো না, আমি শেষ বারের মতো অপরাজিতার সঙ্গে কথা বলতে, মানে ক্ষমা চাইতে এসেছি! ওর যে অসম্মান আমি করেছি তার ক্ষমা হয়তো নেই, তবুও! আরে ছিঃ ছিঃ কি কথা বলছেন? আসুন ভেতরে! না নবীন ভেতরে যাবো না!

আমি বলছি আপনি ভেতরে আসুন, অপরাজিতা বলতেই অনিশ মন্থর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে থপ করে চেয়ারে বসে পড়ে, শরীর আর চলছে না অনিশের! বসেই হাপাতে হাপাতে বলে ওঠে, মেয়েটার সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না, ওকে বলো আমাকে যেন ক্ষমা করে! নবীন বলে, কি সব ভুলভাল বকছেন অনিশদা, অহনা আপনার মেয়ে, মেয়ের কাছে কেউ ক্ষমা চাই? ওকে আশির্বাদ করুন, অহনা যেন তার লক্ষ্যে সফল হতে পারে!

আমি তো তোমাদের জন্য কোন দায়িত্ব পালন করিনি অপরাজিতা! তাই শেষ বেলায় আমার এই দানটুকু তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি, এটা নাও, তোমাদের দিতেই এখানে আসা! কী ওটা? কিসের প্যাকেট? আমার বাড়িটা অহনার নামে লিখে দিয়েছি! তার দলিল!কিন্তু আমার মেয়ে তোমার বাড়ি নেবে কেন? অহনা এখন সাবালিকা! তোমার সঙ্গে তো আমার মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই! এক নিমেষে অপরাজিতা কথাগুলো বলেই চুপ করলো! জানি, এটাই বলবে, কিন্তু এটুকু না করলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না অপরাজিতা? কেন আপনি মরবেন কেন? কি হয়েছে আপনার? ডাক্তার বাবু জবাব দিয়েছেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত আমি! শেষ পর্জায় চলছে! সে কী! কোথায় চিকিৎসা করিয়েছেন?

কলকাতা, ব্যাঙ্গালোরের সব চেয়ে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি, এসবই আমার কৃতকর্মের ফল অপরাজিতা! তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি, অপমান করেছি, তারপর কি করে ভালো থাকি বলো? অপরাজিতা জানতে চায়, মীরা কোথায়? ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে! ভেতরে আসতে পারেনি! কথা বলতে বলতেই অনিশ মেঝেতে ঢলে পড়লো! ধরাধরি করে বিছানায় শুয়ে দিয়ে, নবীনবাবু ডাক্তার বাবুকে কল করলেন! ডাক্তার ঘোষ, স্টেথো লাগিয়ে ভালো করে দেখে বললেন, না নবীনদা, ইনি আর বেঁচে নেই! অপরাজিতার কোলে অনিশের মাথাটা রাখা! অপরাজিতা শূন্যদৃষ্টিতে অনিশের দিকে তাকিয়ে আছে!

নবীন অপরাজিতার চোখমুখ দেখে ভয় পেয়ে, অপরাজিতাকে ডেকে উঠলো, অপরাজিতা, এই অপরাজিতা, নবীন দেখলো অপরাজিতার মাথাটা হঠাৎ অনিশের বুকের উপর ঢুলে পড়লো! নবীনবাবু চিৎকার করে উঠলেন, ডাক্তার বাবু অপরাজিতার কি হোল? ডাক্তার বাবু, অপরাজিতার নাড়ি টিপে দেখলেন, কোন পাল্স নেই, জীবনের কোন সন্ধান পেলেন না অভিজ্ঞ ডাক্তার ঘোষ, না নবীনদা অপরাজিতাদেবীও আর নেই! সেকি! নেই মানে? অপরাজিতাদেবীও মারা গেছেন নবীনদা!

এই সংবাদে দিশেহারা নবীনবাবু, একমাত্র মেয়ে দিল্লীতে, ওকে মেসেজ করে দিয়েই দাহ সৎকারের জন্য পাড়ার মানুষজনকে ভার সঁপে দিলেন! বললেন, অর্থের কোন কম পড়বে না, সৎকারের কাজটা যেন ভালোভাবে হয় বিনয়দা, এটা আপনার দায়িত্ব দাদা! ঠিক আছে নবীন, তুমি শান্ত হও, আমি দেখছি!মীরা দেবী ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন, নবীন দাদা, আমি অনিশের বডি নিয়ে যাচ্ছি সৎকারের জন্য! আজ মা, অপরাজিতাদেবীর শ্রাদ্ধের কাজ সারলো মেয়ে অহনা অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে! মেয়ে অহনার পাশে তার বাবা নবীনবাবুবাবু!

অপরাজিতার ছবিতে ফুলের মালাটা পরিয়ে দিয়ে, ছবির সামনে নবীনবাবু চুপটি করে বসে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বাবা ওঠো, ঘরে যাবে চলো! অহনা, তুই যে দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেলি আমি যে পারলাম না, পালন করতে? তোর মাকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিতে আমাকে ক্ষমা করিস মা, বলে শিশুর মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন! থাক বাবা, এটাই হয়তো ভবিতব্য! তুমিই এখন থেকে আমার বাবা, আমার মা দুইই! মায়ের আত্মা শান্তি পাক এইটুকুই চাই! বাবা-মেয়ের যুগল প্রার্থনা ভোরের আকাশে চিত্রিত হোল- “অপরাজিতা”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত