এ জীবন টকঝালমিষ্টি

এ জীবন টকঝালমিষ্টি

“সুগত আজ তোমার জন্য সকাল সকাল উঠে চিঁড়ের পোলাও বানালাম।একটু তো অন্তত মুখে দিয়ে তারপর অফিস বেরাও”,চায়ের কাপে দুধ মেশাতে মেশাতে বলে সুগতর স্ত্রী অনু ওরফে অনন্যা।

__”প্লিজ ঘ্যান ঘ্যান করোনা অনু।অলরেডি আই অ্যাম গেটিং লেট ফর অফিস।কাল অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে প্রজেক্টের কাজ করেছি।সকালে তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হল।তোমার তো আর ওসবের ভাবনাচিন্তা নেই।রান্নাঘর নিয়েই পরে আছ সারাদিন”;কথাগুলো বলতে বলতে কোনমতে টাইটা বেঁধে বেরিয়ে পরে সুগত।এই নিয়ে পরপর তিনদিন এমন হল।সত্যি কি যে হয়েছে ওর!ইদানিং অল্পতেই মেজাজ হারায়।আর হবে নাই বা কেন ক্রমাগত ওপরে ওঠার নেশা যে জাঁকিয়ে বসেছে ওর উপর।বারবার অল্পতে খুশি থাকার কথা বলেও ব্যর্থ হয়েছে অনন্যা।তাই এখন আর আগের মত খারাপ না লাগলেও একটা মনখারাপের হালকা রেশ তো থেকেই যায় মনের মধ্যে।তাছাড়া মানুষটা তো ওদের মুখ চেয়েই খাটে যাতে ওরা ভালো থাকে সেই আশায়।কিন্তু সত্যি বলতে গেলে বছর সাতেক আগেও ওদের সম্পর্কের চালচিত্রটা এরকম ছিলনা।

ছোট থেকেই হালিসহরে বড় হয়ে ওঠা সুগত ওখানেই একটা ছোটখাট কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি করত। অন্যদিকে অনন্যার বাড়ি নৈহাটিতে।কলেজে পড়াকালীন প্রিয় বান্ধবী তুয়ার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল ওরই মাসতুতো দাদা এই সুগতর সঙ্গে।তারপর আলাপটা কখন যে মনের ঢালু জমিতে গড়াতে গড়াতে মনের ভালোবাসায় পরিণতি পেয়েছিল ওদের।পড়ন্ত বিকেলে গঙ্গার পাড়ে সুগতর কাঁধে মাথা রেখে বসে কখনো ঝালমুড়ি কখনো বা রঙিন কাঠি আইসক্রিমে খেতে খেতে আগামীর স্বপ্নে বিভোর থাকত ওরা।

কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত।ক্রমশ অনন্যার গ্রাজুয়েশন,মাস্টার্স শেষ হবার পর ওদের সম্পর্কের কথা তুয়ার মাধ্যমে দুই বাড়িতে জানাজানি হতেও বেশি দেরি লাগেনি।অবশ্য কারুর অমতও ছিলনা।টানা পাঁচবছর প্রেমপর্ব চলার পর সকলের আশীর্বাদ আর ভালোবাসা নিয়ে বছর দুয়েক আগে এক শুভদিনে ওদের চারহাত এক হয়।দিব্যি চলছিল ওদের মিঠেকড়া দাম্পত্য।এরই মধ্যে হটাৎ করে একদিন এক নামকরা সংবাদপত্রের পাতায় সল্টলেকে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি বিজ্ঞাপন দেখে সুগত।মাইনেকড়ি বেশ ভালই।

ইন্টারভিউতে সফল হয়ে চাকরিটা পেয়েও যায় ও শেষমেশ।কিন্তু ওখানে যা কাজের শিডিউল তাতে রোজগার যাতায়াতের ঝামেলা এড়াতে মহিষবাথানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করে সুগত ওর বউ অনুকে নিয়ে।তারপর যা হয় আর কি?ক্রমশ ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।হারিয়ে যায় ওদের সেই ছোটখাট খুনসুটি,ভালোলাগাগুলো। দাম্পত্যের চালচিত্রটা এখন এককথায় বলতে গেলে শুধুই নিয়মমাফিক।সারাদিন টুকটাক ঘরের কাজের আর এসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যে দিয়েই কখন যে অনন্যার সময় কেটে যায়। শীতের এরো বেলা ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে।শহরের বুকে নিয়ন আলো জ্বলে ওঠে পরপর সার দিয়ে।ঘরের মানুষ না খেয়ে বেরোলে কোনো স্ত্রীর পক্ষে কি একা একা খেতে ভালোলাগে?দু কাপ চা,কটা বিস্কুট আর ব্ল্যাক কফি ছাড়া সারাদিন আর কিছুই পেটে পড়েনি বলতে গেলে।

তবে এবার অনন্যার পেটের খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়েছে।প্রথমে ভাবছিল সুইগিতে কোনো একটা জায়গা থেকে চাউমিন আর ড্রাই চিলি চিকেন আনিয়ে নেবে।তারপর হঠাৎ মনে হয় ঝালমুড়ির কথা।রেডি টু ইট খাবারে অভ্যস্ত হতে হতে ঘরের খাবারের স্বাদগুলো প্রায় ভুলতেই বসেছে যেন ওরা।আজ একটু জম্পেশ করে ঝালমুড়ি মাখা করা যাক।যেমন ভাবা তেমন কাজ। আয়োজনে লেগে পরে অনন্যা।জোগাড়যন্তর যখন প্রায় শেষের দিকে এমনসময় দরজায় বেল বেজে উঠতেই ও গিয়ে দেখে সুগত দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

__”তুমি এত তাড়াতাড়ি আজ?অন্যদিন তো নটা না বাজলে ফেরোনা…শরীর খারাপ করল নাকি”;অনু বলে বেশ একটু চিন্তার সুরে।

ঘরে ঢুকে সুগত বলে,”না শরীর ঠিক আছে।আসলে বাড়িতে অশান্তি করে গেলে সারাদিন কার ভালো লাগে বলো।সরি অনু এইকদিন একটু ওভাররিএক্ট করা হয়ে যাচ্ছে তোমার উপর। এটা অনুভব করতেই ভাবলাম আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে একসাথে সময় কাটাই দুজন মিলে।আর দেখ কি এনেছি তোমার জন্য।টুটিফ্রুটি ফ্লেভারের কাঠি আইসক্রিম। আমাদের অফিস থেকে ফেরার পথে যে নতুন আইসক্রিম পার্লারটা খুলেছে ওখান থেকে নিলাম। তোমার মনে পড়ে অনু তুমি এই কাঠি আইসক্রিম আর ঝালমুড়ি খেতে কত্ত ভালোবাসতে একটা সময়ে।তাই ইচ্ছে হল সেই পুরনো দিনগুলোতে নতুন করে আরো একবার ফিরে যেতে।এবার বলো কেমন লাগল বলো এই সারপ্রাইজ?”

__”আইসক্রিম এনে সারপ্রাইজ কি তুমি একাই দিতে পার বরমশাই?আমিও কিছু কম যাইনা। ঝালমুড়ি আজ ঘরেই বানাচ্ছি আমি। দুটোয় মিলে ভালোই জমবে। চলো মুখ হাত ধুয়ে খেতে এস, পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে…”;অনন্যা বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে।

এক ঝটকায় ওকে নিজের বুকের খুব কাছে টেনে নিয়ে সুগত বলে,”বাঙালির অনেক কিছু আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে বটে কিন্তু টক,ঝাল,মিষ্টি প্রেমের স্বাদটা বোধয় সেই একই রকম রয়ে গেছে।” অনুর মনে পড়ে রবিঠাকুরের “হটাৎ দেখা” কবিতাটির কয়েক পংক্তি,”রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।”ভালোবাসাও আসলে ঠিক তেমন।হারিয়ে যেতে যেতে আবারো ফিরে আসে নতুনরূপে,নতুনকরে।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত