বিয়ের পরে রিয়ার মা এই প্রথম বেড়াতে এসেছে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মেয়েটাকে কাছে টেনে বসে মা। মা-বাবার আদরের মেয়েটার এতো পরিশ্রম তার চোখে জল আনে। মেয়েকে বুকে টেনে মা বলে-খুব কষ্ট হয় তোর নারে?
-কই আর কষ্ট হয় মা। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। কান্নাটাকে গিলে মুখে মিথ্যে হাসি ফোটায় রিয়া পাশাপাশি খেতে বসে রাই আর রোহান। লেগ পিসগুলো রোহানের পাতে পড়ে আজও। দু পিস মাংস রাইয়ের পাতে দিয়ে মা বলে- আজ এটা খেয়ে নে রাই, ভাই তো ছোটো !! সামনের দিন তোকে দেবো।
কথা শুনে রাই হাসে। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-খা ভাই আমি তো বড়ো সামনের দিনও তুই খাস..আমার সোনা ভাই বাস থেকে নেমে তাড়াতাড়ি পা চালায় দুলকি। চারটে বাড়ির কাজ সারতে বেশ দেরী হয়ে গেল আজ। ঘরে ছয় বছরের একমাত্র ছেলেটার ধুম জ্বর। ঘরে ঢুকেই জলপট্টি দিয়ে একটু মুড়ি খাইয়ে আবার শুইয়ে দেয় ছেলেটাকে। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই আঁচল টেনে ধরে ছেলেটা। বড্ড মায়া হয় তার। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই রাত্রি নামে। মাতাল স্বামী ঘরে ফিরে ভাত না পেয়েই চুলের মুঠি ধরে,
-শালী কার ঘরে আদর ঢুলাচ্ছিলিস? রাঁধিসনি কেনে? আয় তোর ঢলানি ছুটাই অসুস্থ ছেলের সামনেই বিবস্ত্র হয়ে যায় । শয়তানটা আঁচড়ে কামড়ে ঘুমিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরে ছেলের শিয়রে বসেই রাত কাবার হয়ে যায় দুলকির স্নান সেরে আলগোছে দামি হাউসকোটটা পরে নেয় সুরভী। বেডরুমে এসে হাল্কা প্রসাধন লাগাতেই দরজায় আওয়াজ হয়।
-এসো মালতি।
-কফি নেবে দিদি? বাইরে থেকেই জানতে চায় চব্বিশ ঘন্টার কাজের মেয়েটি।
-নারে। তুই ঘুমিয়ে পড় ,আমি জেগে আছি।
মধ্যরাত্রি পেরিয়ে উজান এলো পার্টি থেকে। আজ একটা বিহিত করবেই ভেবে সুরভী পথ আটকায়- রোজ রোজ কোথায় যাও তুমি ,জানিনা ভাবো? ঐ বাজারের মেয়েটাকে যদি এতোই ভালোবাসো তবে আমাকে কেন বাঁধলে?
-সম্মান আর ঐশ্বর্যের মাঝে রেখেছি তোমাকে। একটা মিডিলক্লাস ফ্যামিলির হয়েও আর কী আশা করো তুমি? বেশি ঘ্যানর ঘ্যানর করলে পথ খোলা আছে যেতে পারো। ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে যায় উজান। মধ্যবিত্ত বাবার সম্মান আর অর্থ বাঁচাতে মানিয়ে চলে সুরভী আজ তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল শাশুড়ি-বৌ এর মাঝে।কমলা সুন্দরী রাগে গজ্গজ করতে করতে সশব্দে দোর দিলেন। আজ ছেলের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি।
সারা দিন পর অফিস থেকে ফিরেই মায়ের ঘরে ডাক পড়লো তুফানের। মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে তনিমা কে চিৎকার করে ডেকে ওঠে।রান্নাঘরে সে তখন সবার জন্য সবে চা বসিয়েছে।চিৎকার শুনে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় স্বামীর সামনে।তাকে দেখে আরও জোরে চিৎকার করে তুফান-আবার ঝগড়া করেছো মায়ের সাথে? বরের মেজাজের ধার জানে সে।তাই জবাব দেওয়ার সাহসও দেখায়না। পিছনে অপেক্ষারত শাশুড়ি ফোঁড়ন কাটে-ওকে জিজ্ঞাসা করছিস কেন?আমি কি মিথ্যা বলছি তোকে? এমন কথায় মাথায় আগুন জ্বলে যায় তুফানের, “আমার বাড়িতে ওসব চলবে না।চুপচাপ থাকতে হলে থাকো নয়তো রাস্তা দেখ।” তনিমার চোখ বাঁধা মানেনা। সেই সতেরো বছরে বাবা মা কে পর করে এসে, এগারো বছর হল এবাড়িতে।তবুও এ বাড়ি তার নয় জবাব দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা রইলো না আর।
ধীর পায়ে অনিশ্চিতের পথে এগিয়ে যায় সে কোথায় যাবে সে? বাবার বাড়িও যে দাদার হয়েছে ৬.স্টেশন থেকে বেরিয়ে ঝোলাটার ভিতর হাত গলিয়ে পয়সাগুলোকে আন্দাজ করে নেয় বছর তেরোর রুমকি। আজ বেশ ভালোই পয়সা পেয়েছে সে। আজ ভাইটাকে একটা পাউরুটি কিনে দেবে বলে মনস্থির করে। সেদিন খুব আবদার করছিল ছোট্ট ভাইটা । রেল লাইনে মায়ের কাটা পড়ার পর থেকেই দুজনের পেটের কথা তাকেই ভাবতে হয়। বাপটা অনেক আগেই পালিয়েছে অন্য কোথাও। স্টেশন লাগোয়া চায়ের দোকানটার দিকে পা বাড়ায় রুমকি। ঝোলা থেকে পয়সা বের করে পাউরুটির সাথে দুটো কলাও কিনে নেয় সে। ভাইটা আজ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে…ভাবতেই মনটা ঝরঝরে লাগছে রুমকির।
আজ একটু বেশিই দেরী হয়েছে তার। দ্রুত পা চালিয়ে অন্ধকার গলিটার কাছে চলে আসে সে। আর কিছুটা গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ঝুপড়িতে। হাল্কা আলোয় জনমানবহীন গলিতে পায়ের শব্দ পায় রুমকি। পিছনে তাকিয়ে তিনটে বলিষ্ঠ পুরুষ দেখে মনটা কু ডাকে..পায়ের গতি বেড়ে যায় তার.. তারাও বাড়িয়েছে গতি তারপর ছুট ছুট ছুটসবটা অন্ধকার ছোট্টো অপেক্ষারত বাচ্চাটার অপেক্ষার দিন শেষ দিদিটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে জঙ্গলে দাউদাউ করে জ্বলছে সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই রুমকি, সুরভী,দুলকি, রাইরা কেবল জ্বলছে,পুড়ছে,ত্যাগ করছে করেই চলেছে কিন্তু সময় একদিন বদলাবেই!! বদলাতে বাধ্য!! সেদিনের জন্য তৈরী তো সবাই!!