উহ্হ, কি ভীষণ অন্ধকার চারদিকে। কোথাও কোনো আলো নেই, নেই একটুও রোশনাই বা কোনো আলোর রেখা। চোরাবালির মতো অন্ধকারটা আমাকে গ্রাস করছে চারদিক থেকে। কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছি আমি। কবি আর লেখকেরা – অন্ধকারের মধ্যেও যে খুঁজে পায় ক্ষীণ আলোয় মাখা রাস্তা। ওরা আরো বলে, সবরকম অন্ধকারের শেষেই আছে আলো !
আচ্ছা, এতো ঘন অন্ধকার কি অমাবস্যার রাতেও নেমে আসে ? আমার তো মনে পড়ছে না একটুও। আর আজ, এই অন্ধকারের সাথে আবার মিলেমিশে রয়েছে এক গভীর – ঘন নির্জনতা, নিস্তব্ধতা চারদিকে। শুধু নিজেরই পায়ের আওয়াজ আসছে ভেসে আমার কানে। ভয়ে চমকে উঠছি সেই আওয়াজে মাঝে মাঝেই, হাসছি নিজের মনে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, অনেকগুলো ছায়া যেন দাঁড়িয়ে আছে পেছনে; মাঝে মাঝে আবার আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো – হাতের স্পর্শ; কি ঠান্ডা সেই হাতগুলো। কারা এরা ? নাকি সব-ই আমার মনের ভুল ?
আচ্ছা, এইরকম অন্ধকার রাস্তার কল্পনা করেই কি লেখকদের মনে ভূতের গল্পের নিত্য নতুন গল্পগাথা এসে ভিড় করে ? ওখানেও তো এইরকম সব বর্ণনা থাকে – অন্ধকার রাস্তা, পেছনে অশরীরী কারোর উপস্থিতি, ঘাড়ের ওপরে পড়তে থাকা ঘন গভীর নিঃশ্বাস , তার সাথে দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকার বা খিলখিল করে হাসি ? হাসি ? না না, হাসি তো নয় ? এতো আর্তনাদ, কারোর কান্নার আওয়াজ ! কে কাঁদছে এভাবে ? কাদের আর্তনাদ ভেসে এসে জর্জরিত করছে আমাকে ?
না না , সব আমার মনের ভুল। এসব মিথ্যে, মিথ্যে এই অন্ধকার , মিথ্যে এই ছায়াগুলো , মিথ্যে ওদের স্পর্শ। আসলে , অন্ধকারে আমি ভয় পেয়েছি। আমাকে হেঁটে যেতে হবে সামনের দিকে, একটু একটু করে। আমি ঠিক আআ আরে, ওই তো ! ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি আগুনের শিখা ! অনেকটাই দূরে, কিন্তু আমি ঠিক পৌঁছে যাবো ওখানে। অবশেষে, আঁধার পেরিয়ে আলোর সন্ধান ! তাহলে সবাই ঠিক কথাই বলে : আঁধারের শেষে আলো থাকে।
আমি এগোতে থাকি একটু একটু করে। বুকে জেগে ওঠে উদ্দীপনার ঢেউ, উত্তেজনায় কাঁপছি আমি। কিন্তু আমি জোরে দৌড়োবো না ! যদি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই ? প্রতিটা পদক্ষেপ আমি ফেলবো ধীর স্থির ভাবে , সাবধানে, ভেবে চিন্তে ! সময় একটু বেশি লাগবে ? তা লাগুক, আমার কাছে অনেক অনেক সময় আছে !
আগুনের শিখা বড়ো হচ্ছে একটু একটু করে, লেলিহান সেই শিখা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে জ্বলছে। ত্রিভুজাকৃতি ওই শিখা অদ্ভুত এক ছন্দে নেচে চলেছে, দাউদাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে , মনে হচ্ছে সবকিছু আজ গ্রাস করবে এই আগুন, ধ্বংস করবে বিশ্বসংসার। তাহলে, এটাই আমার লক্ষ্য, এই আগুন আমাকে নেভাতে হবে ! যাক, অবশেষে তাহলে আমি পৌঁছে গেছি আমার গন্তব্যে।
আরে ? এরা আবার কারা ? আগুনের ধারে বসে আছে কেন গোল করে ? এরা কি আমাকে আগুনটা নেভাতে বাধা দেবে ? দেখি, জিজ্ঞেস করি গিয়ে। সেরকম কিছু হলে আমাকেও ‘শক্ত’ হতে হবে ! “এই , সরে যাও সামনে থেকে , সরে যাও তোমরা সবাই ! ” এক বৃদ্ধা উঠে আসছে আমার দিকে একটু একটু করে। শরীরের সব চামড়া ঝুলে গেছে, একটাও দাঁত নেই ওর ! কপালে অজস্র বলিরেখা। কত বয়স হবে ওনার ? আশি ? নব্বই ? খনখনে ভাঙা গলায় বলে ওঠে বৃদ্ধা, ” সরবো না বাছা। তুমি আমাকে সরাতে পারবে না আজ আর। ”
“ককে কেন ? কেন সরবে না তুমি ? জানো আমার অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে ? এই সামান্য একটা কাজ করতে হবে আমাকে, তারপরেই আমি “সামান্য ? সামান্য কাজ ? হাহাহাহা ! ” উঠে দাঁড়ায় এক যুবতী একটু দূর থেকে। রাগ আর ঘৃণা ঝরে পড়ছে ওর চোখ থেকে। চোখের পলকে আমার সামনে লাফ দিয়ে এসে দাঁড়ায় সেই যুবতী , “গন্ধ পাচ্ছ না তুমি ? গন্ধ ? মানুষ পোড়ার গন্ধ ? রক্ত চামড়া মাংস গলে যাওয়ার গন্ধ ? ” “গন্ধ ? কিসের গন্ধ ? আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছি না তো ! ” বলে উঠি আমি। আমার পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে আসে একটা বাচ্চা , ফুটফুটে কি সুন্দর মেয়েটা। নিষ্পাপ মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে। কোলে তুলে নিলাম ওকে আমি একটু নিচু হয়ে, আমার দুহাত বাড়িয়ে।
এ একি ? এই অবস্থা কি করে হয়েছে বাচ্চাটার ? সারা শরীরে এতো রক্ত ? ওর গোলগাল হাঁটুর বেয়ে নামছে রক্ত নিচের দিকে ! কে , কে করলো এরকম ? এর পরেও বাচ্চাটা কি করে হাসতে পারছে এভাবে ? কে কেড়ে নিয়েছে ওর শৈশব ? আমি চোখ তুলে তাকাই সামনের দিকে। আগুনের চারপাশে ভিড় বেড়েছে আরো। সবাই তাকিয়ে আমার দিকে, সবার চোখে ফুটে উঠেছে যন্ত্রনা, অসহায়তা , হতাশা, নিরাশা। ভিড়ের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো কেউ, “মা এর পরেও এই আগুন নিভিয়ে দেবে ? পারবে তো ? ” চমকে উঠি আমি , এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, “কে ? কে বলছো এই কথা ? কে তুমি? সামনে এসো ! ”
আগুনের সামনে জড়ো হওয়া ভিড়টা সরে যায় দুদিকে ধীরে ধীরে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে আর একটি মেয়ে , কতই বা বয়স হবে ওর ? কুড়ি ? বাইশ ? কোনোরকমে নিজেকে টেনে টেনে আসছে মেয়েটা আমার দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ! ভালো করে তাকাই আমি ওর দিকে ! আর্তনাদ করে মুখ ঘুরিয়ে নিই অন্যদিকে ! ও ওটা কি ? ওর দুই পায়ের ফাঁকে একটা লম্বা লোহার রড উহহ, কি নৃশংসতা, বর্বরতা ! কি করে কে কেন ?
মেয়েটা আমার কানের কাছে এসে চিৎকার করে বলে, “কোনো উত্তর আছে তোমার কাছে ? মা ? ভারতমাতা ? ” দেখো, দেখো ভালো করে আমাদের, আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখো ভালো করে একবার , সবার মুখের দিকে তাকাও, সবার চোখের দিকে তাকাও ! শুনতে পাচ্ছ আমাদের আর্তনাদ ? আমরাও তো তোমার-ই সন্তান, মা ! তাহলে কেন বারবার এই অত্যাচার ? তোমারই আর একদল সন্তান – আর আমরা , আমাদের এক সুন্দর সম্পর্ক হয়েছে আজ ; জানো সেটা ? আমি কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে জিজ্ঞেস করি , “কি ? কি সেই সম্পর্ক ?”একসাথে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে , “খাদ্য আর খাদক’ ! ”
“না ! নাআআআ !” আমি পেছোতে থাকি একটু একটু করে। আর তাকাতে পারছি না আমি ওদের দিকে। আমার পরণের তিনরঙা শাড়ি – এখন রক্তে রাঙা ! হাজার হাজার আর্তনাদ আমার কানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে “আমি বুড়ো মানুষ, রাতে একটু বাইরে গিয়েছিলাম ; আর সেই সময় কয়েকটা ছেলে, আমার নাতির বয়সী, আমাকে ধরে নিয়ে গেলো গোয়ালে , আর তারপরে “স্কুল থেকে ফিরছিলাম বন্ধুদের সাথে। পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো আর টেনে তুলে নিলো আমাকে। একটা অন্ধকার ঘর, পাঁচদিন ধরে পাঁচজন লোক এসে বারে বারে আমাকে কারোর কিছুই হলো না মা ! উল্টে লোকজন বললো আমার চরিত্র ছিলো খারাপ ! ” “আমি কি দোষ করেছিলাম মা ? আমি তো বিয়ে করে সব কর্তব্য, দায়িত্ব করছিলাম সংসারের। তবুও আমার বর দিনের পর দিন আমার ওপরে জোর করে; আর তারপরে প্রতিবাদ করায় ওর আরো দু জন বন্ধুর হাতে তুলে দিলো আমাকে ফুর্তি করার জন্য ! ”
“অফিসে যাবো বলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে। সেখানে পাশে একটা ভ্যান এসে দাঁড়িয়ে টেনে নিয়ে গেলো আমাকে, জঙ্গলের মধ্যে তারপর “আর আমি ?” আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেই প্রথমের মেয়েটি , “আমি তো আমার কাজ করতেই গিয়েছিলাম ! কাজ সেরে যখন আসছিলাম, আমাকে একা পেয়ে ওই চারজন আর জানো মা ? ওই রাস্তাটা আবার বেশ কয়েকমাস আগে ঘোষিত হয়েছিলো ‘সেফ করিডোর’ হিসেবে ! আর তারপরেও শান্তি হয় নি গো মা ওদের। আমাকে পুড়িয়ে দিলো ! জ্বালিয়ে দিলো। পাচ্ছ না সেই গন্ধ ? দেখো না, দেখো ! আমি এখনো জ্বলছি ওখানে। দেখো ! ”
আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছি মাটির ওপরে। সামনে আগুনটা আরো দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে হঠাৎ করে। ওর মধ্যে থেকে উঠে আসছে একটার পর একটা মেয়ে; ছ মাসের বাচ্চা থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধা ! শিউরে উঠি আমি ! এ আমি কি দেখছি ? আমি ‘মা’ হয়ে আমার এতো লক্ষ কোটি সন্তানের এই অবমাননা আমি কি করে মেনে নিলাম ? এতদিন ধরে কি কেউ আমার চোখ বেঁধে রেখে দিয়েছে – মিথ্যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে ?
স্মার্ট-সিটি ? বুলেট ট্রেন ? মহাকাশ যাত্রা ? ফ্রি ইন্টারনেট ? ইলেক্ট্রিক গাড়ি ? বড়োবড়ো কথা ? এইসব চাকচিক্যে আমি এতদিন ভুলে ছিলাম ? হারিয়ে ফেলেছি আমার স্বত্বাকে ? আমার এতো সন্তান প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কাঁদছে, আর আমি শুনতে পাচ্ছি না ওদের সেই আর্তনাদ ?
কবি বলেছিলো ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ ! এই সেই শ্রেষ্ঠত্ব ? এই সেই মহানতা ? এই সেই উন্নয়ন ? চাই না আমি ডুবে যেতে এই উন্নয়নের চোরাবালিতে। আজ আমি নিজেও ঝাঁপ দেবো ওই আগুনে – আমি ভারতমাতা , সব শেষ করে দেবো ! দাউদাউ করে জ্বলুক এই আগুন, শেষ করে দিক সবকিছু। শেষ করে দিক সেই সব সন্তানদের যারা আমারই করে চলেছে অবমাননা , যারা আমাকে করছে ধর্ষণ – প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে ! অনেক হয়েছে , আর নয় ! রণচণ্ডী রূপে উদ্ভাসিত হবো আমি। তৈরী থাকো তোমরা সবাই , তৈরী থেকো !